উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/মহাভারতের কথা/নচিকেতা

নচিকেতা

 অতি প্রাচীনকালে ডদ্দানকি নামে এক মহর্ষি ছিলেন। তাঁহার একটি পুত্র ছিলেন, তাঁহার নাম নচিকেতা।

 একদিন মহর্ষি ডদ্দানকি নদীতে স্নান ও তাহার তীরে সাধন ভজন শেষ করিয়া, আনমনে কুটিরে চলিয়া আসিলেন, সঙ্গে কাঠ, কলসী, ফুল আর ফল ছিল, তাহা লইয়া আসিবার কথা তাঁহার মনে হইল না।

 বাড়ি আসিয়া সেইসকল দ্রব্যের কথা মনে পড়াতে মহর্ষি নচিকেতাকে ডাকিয়া বলিলেন, “বৎস, আমি বেদপাঠ করিতে করিতে অন্যমনস্ক হইয়া পূজা আর রন্ধনের আয়োজন নদীর তীরে ফেলিয়া আসিয়াছি তুমি গিয়া শীঘ্র তাহা লইয়া আইস।”  নচিকেতা তখনই ছুটিয়া নদীর ধারে গেলেন, কিন্তু সেখানে কাঠ বা কলসী, ফুল বা ফল, কিছুই দেখিতে পাইলেন না। তিনি আসিবার পূর্বেই নদীর স্রোতে তাহা ভাসিয়া গিয়াছিল। তাহা দেখিয়া তিনি দুঃখিত মনে পিতার নিকট আসিয়া বলিলেন, “বাবা, নদীর ধারে ত আমি কিছুই দেখিতে পাইলাম না। বোধ করি, তাহা স্রোতে ভাসিয়া গিয়াছে।”

 তখন বেলা অনেক হইয়াছিল, আর কাঠ ও ফল ফুল কুড়াইয়া মহর্ষি নিতান্ত ক্লান্ত এবং ক্ষুধা তৃষ্ণায় কাতর হইয়াছিলেন। এমন অবস্থায় মানুষের সহজেই রাগ হয়। নচিকেতার কথা শুনিবামাত্র মহর্ষি ক্রোধে অস্থির হইয়া বলিলেন, “তোমার এখনই যমের সহিত দেখা হউক।”

 রাগের মাথায় কি বলিয়াছেন, মহর্ষির তাহা ভাবিয়া দেখিবার অবসর ছিল না। কিন্তু এই দারুশ কথা তাঁহার মুখ দিয়া বাহির হইবামাত্র, নচিকেতা সকালবেলার শেফালিকা ফুলটির ন্যায় মাটিতে লুটাইয়া পড়িলেন। পিতার রাগ দেখিয়া সবে তিনি দুটি হাত জোড় করিয়া, “বাবা আমাকে দয়া করুন! এইমাত্র বলিয়াছিলেন;ইহার অধিক আর তিনি বলিতে পাইলেন না।

 নচিকেতার সেই অবস্থা দেখিয়া মহর্ষির চৈতন্য হইল। কিন্তু হায়! এখন চৈতন্য হইলেই বা কি, আর না হইলেই বা কি? যাহা ঘটিবার তাহা ঘটিয়া গিয়াছে এখন আর ক্রন্দন ভিন্ন উপায় নাই। “হায়, আমি কি করিলাম!” বলিয়া মহর্ষি মাটিতে গড়াগড়ি দিতে লাগিলেন; “হ পুত্র! হ বাপ নচিকেতা!” বলিয়া ব্যাকুল ভাবে চিৎকার করিতে লাগিলেন। কিন্তু তাঁহার প্রাণের বেদনা তাহাতে বাড়িল বই কমিল না।

 এদিকে নচিকেতা যম রাজার পুরীতে গিয়া উপস্থিত হইয়াছেন। সেখানে গিয়া তিনি দেখিলেন যে, ধর্মরাজ যম সস্র যোজন বিস্তৃত উজ্জল সোনার সভায় বসিয়া, ন্যায়ের দণ্ড হাতে পাপপূণ্যের বিচার করিতেছে।

 নচিকেতাকে দেখিবামাত্র যম বলিলেন, “শীঘ্র ইহার বসিবার জন্য আসন লইয়া আইস! ইনি অতিশয় পিতৃভক্ত এবং পুণ্যবান; ইহাকে মহামূল্য মণিমুক্তার থালা আনিয়া উপহার দাও।”

 নচিকেতা যমের সৌজন্যে অতিশয় সন্তুষ্ট হইয়া বিনয়ের সহিত তাঁহাকে বলিলেন, “ধর্মরাজ! আমি আপনার রাজ্যে উপস্থিত হইয়াছি। এখন আমি যে স্থানে থাকিবার উপযুক্ত, সেইখানে আমাকে পাঠাইয়া দিন!”

 এ কথায় যম একটু হাসিয়া যার পর নাই স্নেহের সহিত বলিলেন, “বৎস তোমার ত মৃত্যু হয় নাই। তোমার পিতা অতিশয় তেজস্বী, তাঁহার কথা আমি অমান্য করিতে পারি না। তিনি তোমাকে আমার সহিত দেখা করিতে বলিয়াছে। তাই তোমাকে এখন আনিয়াছি। এখন দেখা হইয়া গেল;তুমি মনের সুখে গৃহে চলিয়া যাও। আর, তোমাকে আমি অতিশয় স্নেহ করি; তুমি তোমার ইচ্ছামত বর প্রার্থনা কর।”

 নচিকেতা বলিলেন, “পুণ্যবানেরা আপনার অধিকারে আসিয়া কিরূপ স্থানে বাস করেন, তাহা জানিতে আমার বড়ই ইচ্ছা হয়। আপনি যদি আমার উপর তুষ্ট হইয়া থাকেন, তবে কৃপা করিয়া আমাকে সেই-সকল দেখিতে দিন।”

 এ কথায় যম নচিকেতাকে উজ্জল রথে চড়াইয়া পুণ্যবান দিগের বাসস্থান সকলে লইয়া গেলেন, সেখানে যে যেমন পুণ্যবান, তাঁহার সেইরূপ সুখে থাকিবার ব্যবস্থা আছে। সেসকল স্থান যে কি সুন্দর আর তাহাতে বাস করিতে যে কি আরাম, তাহা যাহারা সেখানে গিয়াছে, আর তথায় বাস করিয়া দেখিয়াছে, তাহারাই বলিতে পারে। নচিকেতা দেখিলেন, সেখানে মিষ্টান্নের পর্বত, দুগ্ধের নদী ও ঘৃতের হ্রদ আছে। সেখানকার যে বাড়ি ঘর, সেসকল চন্দ্র, সূর্যের ন্যায় উজ্জল; আর তাহাতে ঘরের কাজও চলে, গাড়ির কাজও চলে, বেলুনের কাজও চলে, জাহাজের কাজও চলে। |

 নচিকেতা এই-সকল আশ্চর্য স্থান দেখিয়া যেমন আনন্দ লাভ করিলেন, যমের সুন্দর উপদেশ শুনিয়া তেমনি উপকারও পাইলেন। তারপর বিনীতভাবে যমকে নমস্কার পূর্বক তিনি তাঁহার নিকট বিদায় প্রার্থনা করিলে, যমের লোকেরা তাঁহাকে আদরের সহিত মহর্ষি উদ্দানকির আশ্রমে রাখিয়া গেল।

 এদিকে মহর্ষি উদ্দানকি পুত্রশোকে নিতান্ত কাতর হইয়া সমস্ত দিন এবং সমস্ত রাত্রি কাঁদিয়াই কাটাইলেন। তাঁহার চক্ষের জলে নচিকেতার দেহ ভিজিয়া গেল, তথাপি তিনি শান্ত হইতে পারিলেন না। রাত্রি প্রভাত হইয়া আসিল; তখনো নচিকেতার দেহ তাঁহার কোলে, তাঁহার চোখ দিয়া দরদর ধারে জল পড়িতেছে। এমন সময় কি এক অপরূপ সৌরভে কুটির পরিপুণ্য হইয়া গেল, আর, মহর্ষির মনে হইল, যেন নচিকেতার হ'ত পা অল্প অল্প নড়িতেছে। তাহার পর মুহূর্তেই নচিকেতা উঠিয়া বসিলেন। তখন মহর্ষির মনে এত আনন্দ হইল যে, তিনি আর আশ্চর্ণ হইবার অবসর পাইলেন না।

 ইহার পরে বোধহয় আর তিনি নচিকেতাকে সহজে কটু কথা কহিতেন না। আর এই ঘটনার দরুণ যে নচিকেতার মনে তাঁহার পিতার প্রতি কিছুমাত্র রাগ হয় নাই, তাহাও আমি নিশ্চয় বলিতে পারি। তিনি বলিতেন যে, বাবা আমাকে শাপ দিয়াছিলেন বলিয়াই আমি এমন সকল আশ্চর্য ব্যাপার দেখিতে পাইয়াছি।