উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/মহাভারতের কথা/শুকদেব
শুকদেব
পূর্বকালে মহাদেব এবং পাবতী কর্ণিকার ফুলের অপরূপ শোভা এবং সুগন্ধে পরিপূর্ণ পর্বতের শৃঙ্গে বাস করিয়াছিলেন; সেই সময় দেবতা, গন্ধর্ব, মুনি, ঋষি সকলে মিলিয়া। তাঁহাদের স্তব করিতেছিলেন।
সেই সময় ভগবান বাস, সকল গুণে গুণবান দেবতুল্য পুত্র লাভের জন্য মহাদেবের নিকট গিয়া বায়ুভক্ষণ পূর্বক অতি আশ্চর্য তপস্যা করিতে লাগিলেন। এক বৎসর কঠোর তপস্যায় কাটিয়া গেল। তথাপি ব্যাসদেব কিছুমাত্র কাতর বা চঞ্চল হইলেন না। সেই তপস্যার তেজে তাঁহার জটা আগুনের মত উজ্জ্বল হইয়া উঠিল, এবং তদবধি চিরকালই তাহা ঐরূপ উজ্জ্বল দেখা যাইত। ত্রিভুবনের লোক সে তপস্যা দেখিয়া অবাক হইয়া গেল।
সে তপস্যায় মহাদেব নিতান্ত সন্তুষ্ট হইয়া, স্নেহের সহিত ব্যাসকে বলিলেন, “দ্বৈপায়ন (ব্যাসদেবের অন্য নাম) তুমি শীঘ্রই অগ্নি, বায়ু, পৃথিবী, জল ও আকাশের ন্যায় পবিত্র পরম গুণবাণ পুত্র লাভ করিবে। সেই পুত্র তাহার সমুদয় মন প্রাণ ভগবানের চরণে সমর্পণ পূর্বক ত্রিভুবনে অক্ষয় কীর্তি রাখিয়া যাইবে।”
ইহাতে ব্যাসদেব যার পর নাই আহ্লাদিত হইয়া মহাদেবকে প্রণাম পূর্বক হোমের আয়োজন করিতে লাগিলেন। হোমের প্রথম প্রয়োজন অগ্নি। তাহার জন্য ব্যাসদেব অরণী কাষ্ঠ দুখানি (সেকালে দিয়াশলাই এর বদলে কাঠে কাঠে ঘষিয়া আগুন বাহির করিতে হইত ঐ কাঠে নাম অরণী) লইয়া ঘর্ষণ করিতেছে। এমন সময় সেই কাষ্ঠ হইতে অগ্নির ন্যায় উজ্জা পরম সুন্দর এক কুমার জন্মগ্রহণ করিলেন। সেই কুমারই ব্যাসদেবের পুত্র, তাহার নাম শুক।
শুকদেব জন্মগ্রহণ করিবামাত্র, স্বয়ং গঙ্গাদেবী সেখানে আসিয়া তাহার পবিত্র জলে তাহাকে স্নান করাইয়া দিলেন। তাহার সঙ্গে স্বর্গ হইতে তাহার জন্য দণ্ড এবং কৃষ্ণাজিন (পরিবার জন্য কৃষ্ণসার নামক হরিণের ছাল) নামিয়া আসিল। দেবতারা দুন্দুভি বাজাইয়া পুষ্পবৃষ্টি করিলেন।
স্বয়ং মহাদেব পার্বতীর সহিত আসিয়া মহানন্দে শুকদেবের উপনয়ন করিলেন। ইন্দ্র তাহার জন্য অপূর্ব কমণ্ডলু আর দিব্য বস্তু আনিয়া দিলেন। হংস, সারস, শুক প্রভৃতি পক্ষিগণ আনন্দে কোলাহল পূর্বক তাঁহার চারিধারে উড়িয়া বেড়াইতে লাগিল। শুকদেব পরম ভক্ত সন্ন্যাসী হইয়াই জন্মিয়াছিলেন, তাই কেহই তাহাকে পৃথিবীর ধনরত্ন কিছু উপহার দেয় নাই। ধর্মজ্ঞান এবং ভগবানের চিন্তা ভিন্ন আর কোন চিন্তাই তাহার মনে আসিত না। সুতরাং সাংসারিক সুখের আয়োজনে তাহার কি প্রয়োজন ছিল?
দেবগণের গুরু বৃহস্পতির নিকট শুকদেব বিদ্যাশিক্ষা করিতে গেলেন; কিন্তু বৃহস্পতির তাঁহার জন্য অধিক পরিশ্রম করিতে হইল না। বেদ, বেদাঙ্গ, ইতিহাস প্রভৃতি সকল শাস্ত্র যেন আপনা হইতেই তাহার কণ্ঠস্থ হইয়া যাইতে লাগিল। অতি অল্প দিনের মধ্যেই দেখা গেল যে, তাঁহার আর কিছুই শিখিতে বাকি নাই।
তারপর শুকদেব তপস্যা আরম্ভ করিলেন। দেবতারা এবং ঋষিগণ তাহা দেখিয়া বলিলেন, “অহো! কি আশ্চর্য তপস্যা!” শুকদেব তখনো বালক ছিলেন। কিন্তু সেই বালককে দেখিলে দেবতারাও নমস্কার করিতেন।
কিন্তু বিদ্যা, সম্মান, তপস্যা এ-সকলের কিছুতেই শুকদেবের মন সন্তুষ্ট থাকিতে পারিল। তিনি বলিলেন, “এ সকল পাইয়া আমার কি হইবে? আমি ভগবানকে চাই আমি মুক্তি চাই।”
তাই শুকদেব পিতার নিকট উপস্থিত হইয়া বলিলেন, “পিতঃ! আমি মুক্তি লাভ করিতে চাই, দয়া করিয়া আমাকে তাহার পথ বলিয়া দিন।”
এ কথা শুনিয়া আনন্দে ব্যাসদেবের চক্ষে জল আসিল। তিনি তখন হইতেই মুক্তি লাভেব উপায়সকল শুকদেবকে শিক্ষা দিতে লাগিলেন। সে শিক্ষা সমাপ্ত হইলে তিনি বলিলেন, “বৎস এখন তুমি মিথিলার রাজা জনকের নিকট যাও, তিনি তোমাকে মুক্তির কথা বলিবেন। বিনয়ের সহিত সেই মহাপুরুষের নিকট গমন করিবে;মনের ভিতরে কোনরূপ অহঙ্কার লইয়া যাইও না। তিনি আমাদিগের যজমান, তথাপি তুমি তাঁহাকে গুকর ন্যায় মান্য করিবে।”
শুকদেব তখনই মিথিলায় যাত্রা করিলেন। তিনি ইচ্ছা করিলেই চক্ষের পলকে শূনপথে তথায় গিয়া উপস্থিত হইতে পারিতেন। কিন্তু পাছে তাহাতে কিছুমাত্র অহঙ্কার প্রকাশ হয়। তাই তিনি সেরূপ না করিযা, অতিশয় শ্রদ্ধা এবং বিনয়ের সহিত, পথের কষ্ট সহ্য করিয়া, তথায় হাঁটিয়া চলিলেন।
সুমেরু হইতে মিথিলা অনেক দূরের পথ। কত নদী, কত পর্বত, কত তীর্থ, কত সবোবর, কত বন, কত প্রান্তর পার হইয়া, ইলাবৃতবর্ষ হরিবর্ষ ও কিম্পূরুষবর্ষ অতিক্রম পূর্বক তবে ভারতবর্ষে উপস্থিত হওয়া যায়। সেই ভারতবর্ষে আর্যাবর্ত, তাহার ভিতরে বিদেহ রাজ্য, সেইখানে মিথিলা নগর। মুক্তি ও ভগবানের চিন্তা করিতে, শুকদেব অনেক কষ্টে দুই প্রহর বেলায় প্রখর রৌদ্রের সময় সেই মিথিলায় উপস্থিত হইলেন।
শুকদেব রাজপুরীর প্রথম মহলে প্রবেশ করিবামাত্র, অশিষ্ট দরোয়ান সকল আসিয়া, ভ্রুকুটি পূর্বক অতি কর্কশভাবে তাঁহার পথ আটকাইল। কিন্তু তিনি ক্ষুধা, পিপাসা এবং পথশ্রমে কাতর হইয়াও, তাহাদের কথায় কিছুমাত্র ক্রোধ না করিয়া, শান্তভাবে সেই প্রখর রৌদ্রে দাঁড়াইয়া রহিলেন। তখন সেই দারোয়ানদিগের একজন, না জানি ইনি কোন মহাপুরুষ হইবেন, এই ভাবিয়া জোড়হাতে তাঁহার নিকট ক্ষমা প্রার্থনা পূর্বক, তাঁহাকে দ্বিতীয় মহলে প্রবেশ করিতে দিল। সেখানে রাজমন্ত্রী তাঁহাকে দেখিতে পাইয়াই, পরম সম্মান ও আদরের সহিত তাঁহাকে তৃতীয় মহলে লইয়া গেলেন।
রাজর্ষি জনক যখন জানিলেন যে, শুকদেব পথশ্রমে কাতর হইয়া তাঁহার সহিত দেখা করিতে আসিয়াছে, তখন তিনি তাঁহার লোকদিগকে বলিলেন, আজ ইহাকে যত্ন পূর্বক বিশ্রাম করাও, কাল আমি ইহার সহিত দেখা করিব।
এ কথায় জনকের লোকেরা শুকদেবের বিশ্রামের নানারূপ আয়োজন করিতে লাগিল। কি আশ্চর্য আয়োজনই তাহারা করিয়াছিল। সুশীতল সরবত, মনোহর মিষ্টান্ন, সুকোমল শয্যা, সুমধুর গীতবাদ্য, সুন্দর ফুলের সৌরভ ও বিচিত্র পাখার বাতাস, কোন বিষয়েই তাহারা ত্রুটি করে নাই। এমন সেবা দেবতারাও কমই পাইয়া থাকেন। কিন্তু শুকদেব এমন সেবা পাইয়াও কিছুমাত্র চঞ্চল হইলেন না, তিনি সমস্ত রাত্রি ভগবানের চিন্তাতেই কাটাইলেন। |
পরদিন রাজা জনক পাত্রমিত্র সমেত তাঁহার নিকট আসিয়া অশেষরূপে সমাদর পূর্বক, ভক্তিভরে তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ভগবন্, আপনি এত কষ্ট করিয়া কিজন্য আমার নিকট আসিয়াছে?
শুকদেব কহিলেন, “মহারাজ, পিতৃদেব আমাকে বলিয়াছেন যে, আপনার নিকট আসিলে আমি মুক্তির কথা শুনিতে পাইব। আপনি দয়া করিয়া আমাকে সে বিষয়ের উপদেশ দিন।
এ কথায় জনক শুকদেবকে যে আশ্চর্য উপদেশ দিয়াছিলেন, তেমন উপদেশ আর কেহই দিতে পারেন না। সেই অমূল্য উপদেশ লাভ করিয়া, শুকদেব অপার আনন্দের সহিত হিমালয় পর্বতে চলিয়া গেলেন। ভগবান ব্যাস সে সময়ে পর্বতের পূর্বদিকে একটি অতি নির্জন স্থানে থাকিয়া সুমন্তু, বৈশম্পায়ন, জৈমিনি ও পৈল নামক চারিটি শিষ্যকে বেদশিক্ষা দিতেছিলেন। শুকদেব তথায় উপস্থিত হইয়া জনক রাজার উপদেশের কথা বলিলে, ব্যাসের মনে অতিশয় আহ্লাদ হইল।
ক্রমে ব্যাসদেবের শিষ্যেরা বেদশিক্ষা সমাপন করিয়া দেশে চলিয়া গেলেন। তারপর ভগবান ব্যাস এবং নারদের নিকট নানারূপ উপদেশ পাইয়া মুক্তির পথ শুকদেবের নিকট অতি পরিষ্কার এবং সহজ হইয়া গেল। তখন তাঁহার মনে এই চিন্তা হইল যে, সংসারে থাকিলে অনেক কষ্ট পাইতে হয়, আমি মোগা বলে এই দেহ ত্যাগ করিয়া ইহার চেয়ে উৎকৃষ্ট স্থানে চলিয়া যাইব।’
এই ভাবিয়া শুকদেব তাঁহার পিতার নিকট উপস্থিত হইয়া, তাহাকে প্রণাম পূর্বক বিনীতভাবে বলিলেন, পিতঃ! আমার আর সংসারে থাকিতে ইচ্ছা নাই। অনুমতি করুন, আমি যোগবলে ইহার চেয়ে উৎকৃষ্ট স্থানে চলিয়া যাই।
ব্যাস বলিলেন, ‘বৎস, ক্ষণকাল অপেক্ষা কর, আমি তোমাকে দেখিয়া চক্ষু জুড়াইয়া লই।
কিন্তু পিতার এইরূপ স্নেহের কথায়ও কিছুমাত্র ব্যাকুল না হইয়া, শুকদেব সেখান হইতে কৈলাস পর্বতে চলিয়া আসিলেন। সেই পর্বতের চূড়ায় বসিয়া যোগ সাধন করিতে করিতে ঐমে ভগবানের দেখা পাইয়া, তাঁহার আত্মা আনন্দে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল। দেখিতে দেখিতে তিনি বায়ুর ন্যায় আকাশে উড়িয়া প্রবল বেগে চলিয়া যাইতে লাগিলেন। তখন তাঁহাকে সুর্যের ন্যায় ঊল দেখা যাইতেছিল, আর তিনি দেখিতে পাইতেছিলেন যে, সমুদয় সৃষ্টি ভগবানের দ্বারা পরিপূর্ণ হইয়া রহিয়াছে। সে সময়ে দেবতাগণ তাঁহার উপরে পুষ্পবৃষ্টি করিতেছিলেন, আর মহর্ষি, সিদ্ধ, অপ্সরা ও গন্ধর্বগণ আশ্চর্য হইয়া বলিতেছিলেন, এই মহাত্মা তপোবলে সিদ্ধি লাভ করিয়াছেন, ইনি কে?
শুকদেব সূর্যের দিকে চাহিয়া গভীর শব্দে আকাশ পরিপূর্ণ করতঃ ক্রমাগত পূর্বদিকে যাইতে লাগিলেন। অপ্সরাগণ তাঁহাকে দেখিয়া জিজ্ঞাসা করিল, ইনি কোন্ দেবতা?’ কেহ বলিল, ‘আহা, ইহার পিতা ইহাকে কতই স্নেহ করেন, তিনি কিরূপে এমন পুত্রকে বিদায় দিলেন?
এ কথায় তখনই শুকদেবের পিতার কথা মনে পড়াতে, তিনি বৃক্ষ, লতা, নদী, পর্বত, সকলকে ডাকিয়া বলিলেন, হে বন্ধুগণ! যদি আমার পিতা আমার জন্য ব্যাকুল হইয়া উচ্চৈঃস্বরে আমাকে ডাকেন, তবে দয়া করিয়া তোমরা তাহার উত্তর দিও।
তাহা শুনিয়া বৃক্ষ, লতা, নদী, পর্বত সকলে বলিল, 'হাঁ শুকদেব, আপনার পিতা আপনাকে ডাকিলেই আমরা উত্তর দিব।'
ক্রমে শুকদেব মেরু ও হিমালয় পর্বতের শত যোজন প্রশস্ত সোনা আর রূপার শৃঙ্গ দুইটির নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলেন। পর্বতের চূড়া শুকদেবকে দেখিবামাত্র দুই ভাগে ভাগ হইয়া তাঁহাকে পথ ছাড়িয়া দিল। অমনি চারিদিক হইতে শব্দ উঠিল, 'কি আশ্চর্য!’ ‘কি আশ্চর্য!
এইরূপে শুকদেব ত্রিভুবনের লোককে আশ্চর্য করিযা শেষে ভগবানের সহিত মিলিত হইলেন।
শুকদেব চলিয়া আসিলে ব্যাসের প্রাণ তাঁহার জন্য নিতান্ত ব্যাকুল হইয়া উঠিল। তখন তিনি আর স্থির থাকিতে না পারিয়া শুকদেবকে খুঁজিতে খুঁজিতে সেই পর্বতের নিকট আসিয়া দেখিলেন, তাহারা দুইভাগ হইয়া গিয়াছে। ব্যাসদেবকে দেখিয়া মহর্ষিগণ তাঁহার নিকট আগমন পূর্বক আহ্লাদ এবং বিস্ময়ের সহিত শুকদেবের আশ্চর্য কার্য সকলের কথা কহিতে আরম্ভ কবিলে, ব্যাসদেব, 'হা বৎস!' 'হা, বৎস' বলিয়া চিকার করিতে লাগিলেন। তখন বৃক্ষ, লতা, পর্বত সকলে শুকদেবেব সেই কথা স্মরণ করিয়া ভো!’ শব্দে ব্যাসদেবের কথার উত্তর দিল। সেই অবধি এখনো পর্বত বা নদীর নিকট কথা কহিলে, তাহারা তাহার উত্তর দিয়া পবম ভক্ত শুকদেবের পবিত্র নাম স্মরণ করাইয়া দেয়।