উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/মহাভারতের কথা/পরশুরাম
কান্যকুব্জের রাজা গাধির সত্যবতী নামে একটি রূপবতী কন্যা ছিলেন। ঔর্বের পুত্র মহর্ষি ঋচীক সেই কন্যাকে অতিশয় ভালবাসিতেন, এবং তাহাকে বিবাহ করিবার জন্য রাজার নিকট প্রার্থনা করেন।
ঋচীক রূপে, গুণে, জ্ঞানে, ধর্মে পরম সুপাত্র বটেন, কিন্তু তিনি নিতান্ত দরিদ্র, নিজে দুইবেলা পেট ভরিয়া খাইতে পারেন, এমন সঙ্গতি তাঁহার নাই। এমন দরিদ্রের সহিত কন্যার বিবাহ দিতে রাজার কিছুতেই ইচ্ছা হইল না। সুতরাং ঋচীক দুঃখের সহিত গৃহে ফিরিতে প্রস্তুত হইলেন।
তখন রাজা ভাবিলেন, ‘তাই ত, এমন মহাপুরুষকে অমনি ফিরাইয়া দেওয়াটা দেখিতে কেমন হয়? ইহাতে লোকে নিন্দা করিতে পারে, আর ইনিও বিরক্ত হইতে পারেন, সুতরাং ইঁহাকে সোজাসুজি “না”, না বলিয়া, কৌশল পূর্বক ফিরাইয়া দিই।’
এই মনে করিয়া তিনি ঋচীককে বলিলেন, “আমাদের কুলের একটি নিয়ম আছে যে, আমরা কন্যার বিবাহ দিবার সময়ে বরের নিকট হইতে পণ গ্রহণ করিয়া থাকি। সত্যবতীকে বিবাহ করিতে হইলে, আপনাকে পণ দিতে হইবে; আপনি কি তাহা আনিতে পারিবেন?”
ঋচীক বলিলেন, “কিরূপ পণ, তাহা জানিতে পারিলে, একবার চেষ্টা করিয়া দেখিতে পারি।”
রাজা বলিলেন, “সমস্ত শরীর ধবধবে কেবল একটি কানের ভিতর লাল, বাহির কালো, এই রূপ একহাজারটি অতিশয় তেজস্বী ঘোড়া সত্যবতীর বিবাহের পণ। ইহা আনিয়া দিতে পারিলেই আপনি তাহাকে বিবাহ করিতে পাইবেন।”
এইরূপ একহাজারটি ঘোড়া বাজারে খুঁজিয়া পাওয়ার কোন সম্ভাবনা ছিল না; আর থাকিলেও ঋচীক তাহার দাম দিতেন কোথা হইতে? কাজেই রাজা পণের কথা বলিয়া মনে করিয়াছিলেন যে, খুবই কৌশল করা হইয়াছে। কিন্তু ঋচীক অতি সহজ উপায়ে পণের জোগাড় করিয়া ফেলিলেন, তাঁহার টাকার চিন্তাও করিতে হইল না, বাজারে বাজারে ঘুরিতেও হইল না। তিনি বরুণের নিকট গিয়া ঐরূপ একহাজারটি ঘোড়া চাহিবা মাত্র, বরুণ শুধু যে তাহাকে ঘোড়া দিলেন, তাহা নহে, সেই ঘোড়ার পাল তাড়াইয়া দেশে আনার পরিশ্রম হইতেও তাঁহাকে বাচাইয়া দিলেন।
বরুণ বলিলেন, “মুনিঠাকুর, আপনি নিশ্চিন্তে দেশে চলিয়া যাউন। সেখানে গিয়া আপনি ঘোড়ার কথা মনে করিবামাত্র তাহারা আপনার নিকট উপস্থিত হইবে।”
এ কথায় ঋচীকের ত আর আনন্দের সীমাই রহিল না, তিনি দিব্য আরামে ভজন গাহিতে গাহিতে কান্যকুব্জের নিকট গঙ্গার ধারে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। সেখানে আসিয়া যেই তিনি ভাবিয়াছেন যে, ‘এখন ঘোড়া গুলি আসিলে হয়,’ অমনি দেখিলেন, তাহারা চী-হিঁ হিঁ-হিঁ শব্দে নাচিতে নাচিতে গঙ্গার ভিতর হইতে উঠিয়া আসিতেছে। গঙ্গার সেই স্থানটির নাম তদবধি অশ্বতীর্থ হইয়া গেল।
সেই একহাজার আশ্চর্য ঘোড়া লইয়া ঋচীক যখন হাসিতে হাসিতে গাধির নিকট উপস্থিত হইলেন, তখন রাজা ত তাহা দেখিয়া একেবারে অবাক! যাহা হউক, এখন আর তাঁহার ঋচীককে ফিরাইয়া দিবার উপায় রহিল না। সুতরাং তিনি অবিলম্বে শুভ দিন দেখিয়া তাঁহার সহিত সত্যবতীর বিবাহ দিলেন!
ঋচীক সত্যবতীকে যেমন ভালবাসিতেন, সত্যবতীও তাঁহাকে তেমনি ভক্তি করিতেন। সুতরাং বিবাহের পর তাঁহাদের দিন অতিশয় সুখেই যাইতে লাগিল। ইহার মধ্যে কি হইল, শুন।
সত্যবতীর পুত্র হয় নাই। তাঁহার মাতারও পুত্র হয় নাই। সকলেরই ইচ্ছা যে, তাঁহাদের দুজনের দুটি পুত্র হয়। এজন্য ঋচীক নিজ হাতে দুই বাটি চরু, অর্থাৎ পায়েস প্রস্তুত করিয়া এক বাটি সত্যবতীকে এবং এক বাটি তাঁহার মাতাকে খাইতে দিলেন।
সত্যবতী সেই চরু হাতে মাতার নিকট গিয়া উপস্থিত হইলেন, রানী বলিলেন, “মা, আমি তোমার স্বামীর চেয়েও তোমার মান্য লোক, কাজেই আমি যাহা বলি, তোমার তাহাই করা উচিত!” সত্যবতী বলিলেন, “কি করিব মা?”
রানী বলিলেন, “আমার মনে হয়, তোমার স্বামী তোমাকে যে চরু খাইতে দিয়াছেন, তাহা আমার চরুর চেয়ে অনেক ভাল; তুমি সেই চরু আমাকে খাইতে দাও, আর আমার চরুটা তুমি খাও।”
মা যখন বলিতেছেন, তখন সত্যবতী আর কি করেন? কাজেই তিনি তাহার নিজের চরু রাণীকে খাইতে দিয়া, রাণীর চরু নিজে খাইলেন। |
ত্রিকালজ্ঞ মহামুনি ঋচীকের এসকল কথা জানিতে বাকি রহিল না। তিনি ইহাতে দুঃখিত হইয়া সত্যবতীকে বলিলেন, “সত্যবতি, কাজটা ভাল কর নাই। তোমার মাতা রাজরানী, আর তুমি তপস্বিনী। আমি চাহিয়াছিলাম যে, তোমার পুত্রটি ধার্মিক তপস্বী, আর মহারাণীর পুত্রটি তেজস্বী বীর হয়; সেরূপ চরুই আমি প্রস্তুত করিয়াছিলাম। এখন তোমরা চরু বদল করিয়া খাওয়াতে, তোমার ভাই হইবে নিরীহ ব্রাহ্মণ, আর তোমার পুত্র হইবে ঘোরতর ক্ষত্রিয়।”
এ কথায় সত্যবতী নিতান্ত আশ্চর্য এবং ব্যস্ত হইয়া বলিলেন, “হায়, হায়, কি করিয়াছি। এমন পুত্র লইয়া আমি কি করিব?”
ঋচীক বলিলেন, “আমি কি করিব? ঐ চরুর ঐ গুণ। তুমি তাহা খাইযা বসিযাছ এখন আর উপায় কি আছে?”
সত্যবতী বলিলেন, “তোমার পায়ে পড়ি, ইহার একটা উপায় হয় কি না দেখ। নাহয় আমার নাতি ক্ষত্রিয় হউক কিন্তু আমার পুত্রটি যেন তপস্বী ব্রাহ্মণ হয়।”
ঋচীক বলিলেন, “আচ্ছা তাহা বোধহয় হইতে পারে। তোমার পুত্র ব্রাহ্মণই হইবে, কিন্তু তোমার নাতিটি বড়ই উৎকট যোদ্ধা হইবে।”
ইহার কিছুদিন পরে সত্যবতীর একটি পুত্র হইলে, তাহাব নাম জমদগ্নি-রাখা হইল। ইনি বড় হইয়া একজন বিখ্যাত মুনি হইয়াছিলেন। সত্যবতীর ভাই হইলেন বিশ্বামিত্র। তিনি যে রাজা হইয়াও কি করিয়া শেষে মুনি হইয়াছিলেন, তাহা আমরা সকলেই জানি।
জমদগ্নি বড় হইয়া রাজা প্রসেনজিতের কন্যা রেণুকাকে বিবাহ করেন। ইহার পাঁচটি পুত্র হইয়াছিলেন, তাঁহাদের নাম 'রুমন’, ‘সুষেণ’, 'বসু’, ‘বিশ্বাবসু’ এবং ‘রাম'। ইহাদের মধ্যে রাম যদিও সকলের ছোট, তথাপি গুণে তিনি সকলের বড় হইয়াছিলেন, ঋচীক সত্যবতীকে যে উকট যোদ্ধা নাতির কথা বলিয়াছিলেন, রাম সেই নাতি। ইহার কিঞ্চিৎ বয়স হইলেই, ইনি মহাদেবকে তুষ্ট করিবার জন্য গন্ধমাদন পর্বতে গিয়া ঘোরর তপস্যা আরম্ভ করেন এবং শেষে তাহার নিকট হইতে নানারূপ আশ্চর্য অস্ত্র পাইয়া ত্রিভুবনজয়ী অদ্বিতীয় বীর হইয়া উঠেন। মহাদেব তাহাকে এমনই অদ্ভুত একখানি পরশু, অর্থাৎ কুঠার দিয়াছিলেন যে, তাহার ধার কিছুতেই কমিত না, আর তাহার ঘায় পর্বতও খণ্ড খণ্ড হইয়া যাইত। এই পরশুখানি সর্বদাই রামের হাতে থাকিত; এজন্য সেই অবধি তাহার নাম ‘পরশুরাম’ হইল।
পরশুরাম ব্রাহ্মণের ঘরে জন্মিয়াছিলেন বটে, কিন্তু তাহার মন ছিল ক্ষত্রিয়ের মত কঠিন। সে যে কিরূপ কঠিন, তাহার পরিচয় একটা ঘটনাতেই পাওয়া গিয়াছিল। কোন কারণে একদিন রেণুকার উপর জমদগ্নি মুনির বড়ই ভয়ানক রাগ হয়। রাগে তিনি একেবারে পাগলের মত হইয়া পুত্রগণকে বলিলেন, “তোমরা এখনই রেণুকাকে বধ কর।” রুমন, সুষেণ, বসু, বিশ্বাবসু ইহাদের কেহই এমন অস্বাভাবিক নিষ্ঠুর কাজ কাজ করিতে সম্মত হইলেন না, কিন্তু পরশুরাম পিতার আজ্ঞা মাত্র কুড়াল দিয়া তাঁহার মায়ের মাথা কাটিয়া ফেলিলেন। জমদগ্নি তখন ক্রোধ ভরে সাপ দিয়া রুমন, সুষেণ, বসু, এবং বিশ্ববসুকে পশু করিয়া দিলেন। পরশুরামকে তিনি বলিলেন, “বৎস; আমার কথায় তুমি বড়ই কঠিন কাজ করিয়াছ, এখন তোমার যেমন ইচ্ছা বর প্রার্থনা কর।”
এ কথায় পরশুরাম বলিলেন, “বাবা, যদি তুষ্ট হইয়া থাকেন, তবে মাকে বাঁচাইয়া দিন। আর দাদাদিগকে আবার ভাল করিয়া দিন।”
জমদগ্নি বলিলেন, “আচ্ছ, তাহাই হউক, তুমি আর কি চাহ?”
পরশুরাম বলিলেন, “আমি যে মাকে বধ করিয়াছিলাম, এ কথা যেন তাহার মনে না থাকে, আর ইহার জন্য যেন আমার পাপ না হয়।”
জমদগ্নি বলিলেন, “আচ্ছা তাহাই হউক, তুমি আর কি চাহ?
পরশুরাম বলিলেন, “আমি যেন অমর হই, আর পৃথিবীতে যত বীর আছে, সকলের চেয়ে বড় হই।”
জমদগ্নি বলিলেন, “আচ্ছা তাহাই হইবে।”
ইহার পর একদিন জমদগ্নির পুত্রগণ আশ্রম হইতে বাহির হইয়া গিয়াছে; এমন সময় হৈহয়ের রাজা কার্তবীর্য সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। এই কার্তবীর্য বড়ই ভয়ঙ্কর লোক ছিলেন। ইহার আসল নাম অর্জুন, পিতার নাম কৃতবীর্য। এই জন্যই লোকে ইহাকে কার্তবীর্যাজুন অথবা শুধু কার্তবীর্য বলিয়া ডাকিত। সাধারণ মানুষের দুটি বই হতে থাকে। শুধু ইহার ছিল একহাজারটি। এই একহাজার হাতে একহাজার অস্ত্র লইয়া ইনি যখন যুদ্ধ করিতেন, তখন ইহার সামনে টিকিয়া থাকা কিরূপ কঠিন হইত, বুঝিতেই পার। তাহাতে আবার “দত্তাত্রেয়ের” বরে তিনি এমন একখানি রথ পাইয়াছিলেন যে, তাহাকে জল, স্থল, আকাশ, পাতাল, যেখান দিয়া বলা যাইত, সেখান দিয়াই সে গড় গড় করিয়া চলিত! এমন লোক যদি দুষ্ট হয়, তবে তাহাকে সকলেই ভয় করে। তাই দেবতারা অবধি কার্তবীর্যকে দেখিলে দূর হইতে পলায়ন করিতেন।
এহেন অদ্ভুত লোক আশ্রমে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন। অথচ কেবল জমদগ্নি আর রেণুকা ভিন্ন তাহার সমাদর করিবার কেহই নাই। রেণুকা নিতান্ত ব্যস্ত হইয়া তাঁহার যথাশক্তি রাজাকে বিশ্রাম করিতে বলিয়া কুশল মঙ্গল জিজ্ঞাসা প্রভৃতি করিলেন বটে, কিন্তু তাহার সে আদর রাজা গ্রাহ্যই করিলেন না। তাহার বদলে তিনি আশ্রমের গাছপালা ভাঙ্গিয়া বলপূর্বক মহর্ষির হোমধেনুর (হোমের গরুর) বাছুরটিকে লইয়া প্রস্থান করিলেন।
পরশুরাম আশ্রমে ফিরিয়া মহর্ষির মুখে এ কথা শুনিবামাত্র রাগে তাহার দুই চক্ষু লাল হইয়া উঠিল! তিনি আর-এক মুহূর্তও বিলম্ব না করিয়া ধনুর্বাণ, এবং তাহার সেই সাংঘাতিক কুঠার হস্তে কার্তবীর্যের সস্থানে ছুটিয়া চলিলেন। দুইজনে দেখা হইলে তাহাদের যে যুদ্ধ হইয়াছিল, সে বড়ই ভয়ঙ্কর ব্যাপার। কিন্তু কার্তবীর্য তাহার একহাজার হাত এবং একহাজার অস্ত্র লইয়াও পরশুরামকে কিছুতেই আঁটিতে পারলেন না। পরশুরামের পরশু, দেখিতে দেখিতে তাহার সেই একহাজার হাত সুদ্ধ তাহাকে কাটিয়া খণ্ড খণ্ড করিল।
কার্তবীর্যের মৃত্যু সংবাদ শুনিয়া তাঁহার পুত্রগণের যে ভয়ানক রাগ হইবে, ইহা আশ্চর্য নহে। সুতরাং তাহারা তখন হইতেই ইহার প্রতিশোধ লইবার সুযোগ খুঁজিতে লাগিল। শেষে একদিন, পরশুরাম আর তাঁহার চারি ভাই আশ্রম হইতে বাহির হইয়া গেলে, দুষ্টেরা খালি আশ্রম পাইয়া, বাঘের মত আসিয়া জমদগ্নিকে আক্রমণ করিল। জমদগ্নি প্রহারের যন্ত্রণায় অস্থির হইয়া, কাতরভাবে 'হা রাম’! বলিয়া কতই চিৎকার করিলেন, দুরাত্মাগণের তথাপি দয়া হইল না।
এইরূপে সেই দুষ্টেরা জমদগ্নিকে হত্যা পূর্বক সেখান হইতে প্রস্থান করিবার কিঞ্চিৎ পরেই পরশুরাম আশ্রমে ফিরিয়া আসিলেন। আশ্রমের আঙ্গিনায় প্রবেশমাত্রই তিনি দেখিলেন, সেখানে রক্তের স্রোত বহিতেছে, আর তাহার মধ্যে তাঁহার পিতার দেহ শত অস্ত্রের ঘায় ক্ষতবিক্ষত হইয়া পড়িয়া রহিয়াছে। তখন যে তাহার প্রাণে কি দারুণ কষ্ট হইল, আর কিরূপ কাতরভাবে তাঁহার পিতার গুণের কথা বলিয়া তিনি ক্রন্দন করিলেন, তাহার বর্ণনা আমি কি করিব! কাঁদিতে কাঁদিতে ক্রমে তিনি রাগের আগুন হইয়া উঠিলেন। এমন রাগ বুঝি বা এ পৃথিবীতে আর কাহারো হয় নাই।
জমদগ্নির দেহ পোড়ানই অবশ্য এ সময়ে পরশুরামের প্রথম কর্তব্য হইল। সে কাজ শেষ হইলে, তিনি ধনুর্বাণ এবং ভীষণ কুঠার হস্তে সাক্ষাৎ মৃত্যুর ন্যায়, কার্তবীর্যের পুত্রগণের প্রাণবধ করিতে বাহির হইলেন। অল্পকালের ভিতরেই ঘোরতর যুদ্ধে তাহাদের সকলে পরশুরামের কুঠারের ঘায় খণ্ড খণ্ড হইল, কিন্তু তথাপি পরশুরামের রাগ থামিল না। ইহার পর তিনি কার্তবীর্যের বংশের সকল লোক এবং তাহাদের আশ্রিত সকলকে বধ করিলেন, তথাপি তাহার রাগ থামিল না। শেষে ক্ষত্রিয়মাত্রেই তাহার রাগের পাত্র হইয়া দাঁড়াইল।
যতদিন পৃথিবীতে ক্ষত্রিয় খুঁজিয়া পাইয়াছিলেন, ততদিন আর পরশুরাম বিশ্রাম করেন নাই। ক্রমে ক্ষত্রিয়ের রক্তে পৃথিবীরময় কাদা হইয়া গেল, ক্ষত্রিয়দের শিশুরা পর্যন্ত পরশুরামের হাতে প্রাণ ত্যাগ করিল;তাহার পর আর ক্ষত্রিয় খুঁজিয়া পাওয়া গেল না! তখন পরশুরামের মনে দয়া হওয়াতে, তিনি দুঃখের সহিত বনে চলিয়া গেলেন।
বনে গিয়াও পরশুরাম অনেক সময় সেখানকার মুনিদিগের নিকট অহঙ্কার করিয়া বলিতেন, “আমি পৃথিবী নিঃক্ষত্রিয় (ক্ষত্রিয় শূন্য) করিয়াছি।” কিন্তু মুনিরা কেহই তাহার এ নিষ্ঠুর কার্যে সন্তুষ্ট ছিলেন না।
এই ভাবে একহাজার বৎসর চলিয়া গেল। ইহার মধ্যে ক্ষত্রিয়দের যে দু-একটি শিশু ভগবানের কৃপায় রক্ষা পাইয়াছিল, ক্রমে তাহাদের ছেলেপিলে হইয়া আবার এ পৃথিবী ক্ষত্রিয়ে পরিপূর্ণ হইয়া গিয়াছে। এমন সময় একদিন বিশ্বামিত্রের পৌত্র পরাবসু পরশুরামকে নিন্দা করিয়া কহিলেন, “তুমি যে ক্ষত্রিয় শেষ করিয়াছ বলিয়া এত বড়াই করিয়া থাক, কই! আবার ত দেখিতেছি পৃথিবী ক্ষত্রিয়ে পরিপূর্ণ হইয়া গিয়াছে।
এ কথায় পরশুরামের সেই নিভানো রাগের আগুন আবার ধু ধু করিয়া জ্বলিয়া উঠিল! সুতরাং আর তিনি বনের ভিতর চুপ করিয়া বসিয়া থাকিতে পারিলেন না। তখন আবার ভীষণ কাণ্ড উপস্থিত হইল। আবার ক্ষত্রিয়ের রক্তে পৃথিবী ভাসিয়া গেল। যতক্ষণ একটি মাত্র ক্ষত্রিয়ও খুঁজিয়া পাওয়া গিয়াছিল, ততক্ষণ আর পরশুরাম বিশ্রাম করেন নাই। যখন আর ক্ষত্রিয় পাওয়া গেল না। তখন আর কি করেন? তখন কাজেই তাহাকে থামিতে হইল। কিন্তু তা আর কতদিনের জন্য? যখন আবার ক্ষত্রিয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পাইল, তখন পরশুরামের রাগও হঠাৎ আবার বাড়িয়া গেল। এমনি করিয়া ক্রমাগত একুশবার তিনি পৃথিবীকে নিঃক্ষত্রিয়া করিয়াছিলেন। শেষে ক্ষত্রিয়ের রক্তে সমন্তপঞ্চক নামক তীর্থের পাঁচটি হ্রদ হইয়া গেল, সেই রক্তে পূর্বপুরুষদিগের তর্পণ করিয়া তাঁহার মনে হইল, যেন এতক্ষণে রাগটা একটু কমিয়াছে।
ক্ষত্রিয়েরাই ছিলেন পৃথিবীর রাজা, সেই ক্ষত্রিয়দিগকে জয় করাতে সমস্ত পৃথিবী এখন পরশুরামেরই হইল। কিন্তু তিনি ত আর রাজ্যের লোভে ক্ষত্রিয়দিগকে বধ করেন নাই, রাজ্যের প্রয়োজন তাঁহার কিছুমাত্র ছিল না। সুতরাং ইহার পর তিনি একটি অশ্বমেধ যজ্ঞ করিয়া সেই যজ্ঞের দক্ষিণা স্বরূপ সমস্ত পৃথিবী মহর্ষি কশ্যপকে দান করিয়া ফেলিলেন।
পরশুরামের নিষ্ঠুর কার্যে অন্যান্য মুনিগণের ন্যায় কশ্যপও নিতান্ত দুঃখিত ছিলেন। সমস্ত পৃথিবী দক্ষিণা পাইয়া তাহার মনে হইল যে, ক্ষত্রিয়দিগকে রক্ষা করিবার এই উত্তম সুযোগ। এই ভাবিয়া তিনি পরশুরামকে আঙ্গুল দিয়া দক্ষিণে যাইবার পথ দেখাইয়া বলিলেন, “হে মহাপুরুষ! তুমি তবে এখন এই পথে দক্ষিণ সমুদ্রের তীরে চলিয়া যাও। এ-সকল দেশ ত এখন আমার হইয়াছে। সুতরাং ইহাতে আর তোমার বাস করা উচিত নহে!”
এ কথায় পরশুরাম আর কিছুমাত্র আপত্তি না করিয়া তখনই দক্ষিণ সমুদ্রের তীরে চলিয়া গেলেন। সমুদ্র তাহাকে দেখিবামাত্র খানিক দূর সরিয়া গিয়া তাঁহার বাসের জন্য ‘শপাকার’ নামক একটি নতুন দেশ প্রস্তুত করিয়া দিল।
এদিকে পৃথিবীর নানারূপ দুর্দশা উপস্থিত হইল। ক্ষত্রিয়েরা মরিয়া যাওয়াতে কোথাও আর রাজা রহিল না। কশ্যপ মুনি পৃথিবীকে পাইয়া যদি তাহাতে রাজ্য করিতেন, তাহা হইলেও কতক কাজ হইতে পারিত। কিন্তু তিনি তপস্বী মানুষ, রাজ্য দিয়া তিনি কি করিবেন? যে মুহূর্তে তিনি পৃথিবী দক্ষিণা পাইলেন, তাহাব পর মুহূর্তেই তিনি তাহা ব্রাহ্মণদিগের হাতে দিয়া নিজের কাজে চলিয়া গেলেন। ব্রাহ্মণরা পৃথিবীতে বাস করিয়া মনের সুখে তাঁহাদের জপতপ করিতে লাগিলেন; উহা যে আবার শাসন করিতে হইবে, এ কথা তাহাদের মাথায় আসিল না। এভাবে কিছুদিন চলিলেই দেখা গেল যে, যত চোর ডাকাত, তাহারাই রাজ্যের কর্তা হইয়া দাঁড়াইয়াছে। চোরেরা নিশ্চিন্তে চুরি করিয়া বেড়ায়, কেহ তাহাদিগকে সাজা দিবার কথা বলে না। ভাল লোকেরা দুষ্ট লোকদিগের ভয়ে সর্বদা শশব্যস্ত থাকে, ধন পাইয়া লোকে এতটুকুও আসা করিতে পারে না যে, আর দু-দণ্ড সে ধন তাহার হাতে থাকিবে। শেষে পৃথিবী আর পাপীদের অত্যাচার সহিতে না পারিয়া রসাতলে (পাতালে) যাইতে আরম্ভ করিলেন। ভাগ্যিস ভগবান কশ্যপ সেই সময়ে তাড়াতাড়ি আসিয়া নিজের উরু দিয়া পৃথিবীকে আটকাইয়া ছিলেন;নহিলে এখন আমরা কোথায় বাস করিতাম?
কশ্যপ উরু দিয়া আটকাইয়াছিলেন বলিয়াই পৃথিবীর এক নাম হইয়াছে উর্বী। সে যাত্রা পৃথিবী কোন মতে বাঁচিয়া গেলেন, কিন্তু নিজের দুরবস্থার কথা ভাবিয়া তিনি কিছুতেই মন স্থির করিতে পারিলেন না। তাই তিনি অতিশয় বিনয়ের সহিত কশ্যপকে বলিলেন, “ভগবন, আমি কিসের ভরসায় সুস্থির থাকিব? আমাকে কে দেখিবে? রাজারা সকলেই মরিয়া গিয়াছেন, এখন তাহাদের জায়গায় কেহনা আসিলে ত আমি আর উপায় দেখি না। ইহাদের কয়েকজনের সন্তানকে আমি অনেক কষ্টে নানাস্থানে লুকাইয়া রক্ষা করিয়াছি কৃপা পূর্বক তাহাদিগকে আনিয়া রাজা করিলে আমিও রক্ষা পাইতে পারি।” তখন ভগবান কশ্যপ আর বিলম্ব না করিয়া এই-সকল রাজপুত্রকে খুঁজিয়া আনিবার জন্য লোক পাঠাইলেন। ঋক্ষবান পর্বতে ভল্লুকেরা অতিশয় স্নেহের সহিত বিদুরথের পুত্রকে পালন করিতেছিল। মহর্ষি পরাশর সৌদাসের পুত্র সর্বকর্মাকে মাতার ন্যায় মেহরক্ষা করিয়াছিলেন। প্রতর্দনের পুত্র বসকে বাছুরেরা তাহাদের মধ্যে লুকাইয়া রাখিয়াছিল। শিবির পুত্র গোপতিকেও গরুরা পালন করিয়াছিলেন। দিবিরথের পুত্রকে মহর্ষি গৌতম রক্ষা করিয়াছিলেন। বৃহদ্রথ নামক একটি রাজপুত্রকে গৃধ্রুকুট পর্বতে গোলাঙ্গুলগণ (একপ্রকার বানর) পালন করিয়াছিল। ইহা ছাড়া সমুদ্র মরুত্ত রাজার বংশের কয়েকটি বালককে রক্ষা করিয়াছিলেন।
মহর্ষি কশ্যপ এই-সকল বালককে আনাইয়া পৃথিবীতে রাজা করিলে, তাহারা বিধিমতে দুষ্টের দমন ও শিষ্টের পালন পূর্বক ধর্মকে রক্ষা করিতে লাগিলেন।