উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/মহাভারতের কথা/বামদেব ও বামীর কথা

লুয়া ত্রুটি মডিউল:Header_template এর 348 নং লাইনে: bad argument #1 to 'next' (table expected, got nil)।

বামদেব ও বামীর কথা


 পরীক্ষিতের তিনপুত্র; শল, দল আর বল।

 শল বড় হইলে তাঁহার হাতে রাজ্য দিয়া পরীক্ষিত তপস্যা করিবার জন্য বনে চলিয়া গেলেন।

 একদিন শল মৃগয়া করিতে গিয়া একটা হরিণকে তাড়া করিলেন। কিন্তু তাঁহার সাবথি অনেক চেষ্টা করিয়াও তেমন বেগে রথ চালাইতে পারিল না। রাজা, ‘জোরে চালাও! বলিয়া বেচারাকে কতই ধমকাইলেন; কিন্তু ধমকের জোরে যদি ঘোড়াব পায়ে জোর হইত, তবে আর কথা কি ছিল। শেষে সারথি ভয়ে ভয়ে হাত জোড় করিয়া বলিল, “মহারাজ, আমার উপরে ক্রোধ করিবেন না; এসকল ঘোড়া দিয়া ও হরিণকে ধবা একেবারে অসম্ভব। মহারাজের রথে যদি বামী জোতা থাকিত, তবে নাহয় একবার চেষ্টা করিয়া দেখিতাম।”

 বামীর কথা শুনিয়া রাজা বলিলেন, “সে আবার কিরকম ঘোড়া? শীঘ্র বল, আমি তাহাই নাহয় আনিয়া লইব।”

 এ কথায় সারথি বড়ই সঙ্কটে পড়িল। মহর্ষি বামদেবের দুটি আশ্চর্য ঘোড়া ছিল, তাহাদেরই নাম বামী। রাজার কথার উত্তর দিলে হয়ত তিনি ঐ দুই ঘোড়া লইয়া আসিবেন। আর যদি তিনি তাহা ফিরাইয়া না দেন, তবে মুনিঠাকুর হয়ত সারথির উপর চটিয়া গিয়া তাহাকে শাপ দিয়া ভস্ম করিবেন; কাজেই সে কোন কথা বলিতে সাহস না পাইযা চুপ করিয়া রহিল। ইহাতে রাজা বিষম ভুকুটিপূর্বক ক্রোধভরে তলোযাব উঠাইয়া বলিলেন, “বটে রে দুষ্ট, তুই আমাব কথার উত্তর দিবি না? এখনই তোর মাথা কাটিব।”

 তখন আর সারথি কি করে? সে প্রাণের ভয়ে কাপিতে কাপিতে বলিল, “বামদেবের খুব ভাললা দুটি ঘোড়া আছে, তাহাদেরই নাম বামী!"

 রাজা বলিলেন, “তবে এখনই বামদেবের আশ্রমে লইয়া চল!”

 দেখিতে দেখিতে রথ বামদেবের আশ্রমে উপস্থিত হইল। মুনি যখন দেখিলেন যে, তাহার ঘোড়া দুটি রথে জুতিয়া হরিণ ধরিবার জন্য রাজা বড়ই ব্যস্ত হইয়াছেন, তখন আর তিনি ঘোড়া দিতে আপত্তি করিলেন না; কিন্তু রাজাকে বিশেষ করিয়া বলিয়া দিলেন, “আপনার কাজ হইয়া গেলেই ঘোড়া দুটি ফিরাইয়া দিবেন।”

 রাজা বলিলেন, “তাহা আর বলিতে? আমি অবশ্যই ঘোড়া ফিরাইয়া দিব!”

 এই বলিয়া ত রথে মুনির ঘোড়া জুতিযা রথ হাঁকান আরম্ভ হইল। আশ্রমের বাহিরে গিয়াই রাজা সারথিকে বলিলেন, “কি বল হে সারথি। এত ভালো ঘোড়া দিয়া মুনির কি কাজ? এ গোড়া আমার ঘোড়াশালে থাকিলেই মানাইবে ভালো, মুনিকে আর উহা ফিরাইয়া দিবার কোন প্রয়োজন নাই।”

 সারথি আর কি বলিবে? সে চুপ করিয়া রহিল।

 একমাস চলিয়া গেল, তথাপি রাজা ঘোড়া ফিরাইয়া দিলেন না দেখিয়া, বামদেব তাঁহার আত্রেয় নামক শিষ্যকে দিয়া ঘোড়া দুটি চাহিয়া পাঠাইলেন। কিছুকাল পরে আত্রেয় শুধু হাতে ফিরিয়া আসিয়া দুঃখের সহিত বলিলেন, “ভগবন, আমি রাজার নিকট ঘোড়া চাহিলে তিনি তাহা দিতে অস্বীকার করিলেন। বলিলেন, এমন ঘোড়া রাজারই উপযুক্ত। ব্রাহ্মণের আবার ঘোড়ার প্রয়োজন কি? আপনি আশ্রমে চলিয়া যান!”

 ইহাতে বামদেব নিজে রাজার নিকট গিয়া বলিলেন, “মহারাজ আমার ঘোড়া ফিরাইয়া দাও।”

 রাজা বলিলেন, “আপনি ঘোড়া ফিরাইয়া লইয়া কি করিবেন? উহা আমারই কাছে থাকুক।”

 মুনি বলিলেন, “আমি তোমার ভালোর জন্য বলিতেছি। ঘোড়া দুটি ফিরাইয়া দাও। নচেৎ তোমার বড়ই দুর্গতি হইবে।”

 রাজা বলিলেন, “শাস্ত্রে বলে, ব্রাহ্মণের বাহন ষাঁড়। আপনার মত লোকেরা কি শাস্ত্র অমান্য করিতে পাবেন? দুটি ষাড় কিনিয়া লউন।”

 বামদেব কহিলেন, ব্রাহ্মণের ষাঁড় বাহন ত স্বর্গে; পৃথিবীতে তোমারও ঘোড়া বাহন আমারও ঘোড়া বাহন। সুতরাং আমার ঘোড়া দুটি ফিরাইয়া দাও।”

 রাজা বলিলেন, “ষড় যদি পছন্দ না হয়, তবে বরং গাধা বা খচ্চর বা আর চারিটি ঘোড়া চডিয়া চলা ফেরা করুণ, আব মনে করুন যে, বামী ঘোড়া আপনার নহে, আমারই।”

 মুনি বলিলেন, “যদি তোমার বাঁচিয়া থাকিতে ইচ্ছা হয়, তবে শীঘ্র আমার বামী ঘোড়া ফিরাইয়া দাও।”

 রাজা বলিলেন, “মুনিঠাকুর, ঐ একটি কথা বাদে আপনি যাহা বলিবেন, আমি তাহাই করিতে রাজি আছি কিন্তু ঘোড় ফিরাইয়া দিতে পারিব না। আপনি ত শিকার করেন না, আপনার এত ভালো ঘোড়াব প্রয়োজন কি?

 এ কথা বলিতে বলিতেই বিষম বিকটাকার চারিটা রাক্ষস, চোখ ঘুরাইতে ঘুরাইতে আর দাঁত খিচাইতে খিচাইতে, ভয়ঙ্কর শূল উঠাইয়া বাজার সম্মুখে আসিয়া দাঁড়াইল। তখন তিনি চিৎকার করিয়া বলিলেন, “আমার লোকজন আমার পক্ষে থাকিলে, কখনই আমি ঘোড়া ছাড়িয়া দিব না। এই মুনি দেখিতেছি নিতান্ত পাপিষ্ঠ!" কিন্তু তাহার কান্না শেষ হইতে না হইতেই রাক্ষসেরা তাহাকে মারিয়া ফেলিল।

 শলের মৃত্যুব পব বাজা হইলেন দল। বামদেব তাহারও নিকট আসিয়া বলিলেন, “মহারাজ আমার বামী ঘোড়া ফিরাইয়া দাও।”

 ইহার উত্তরে দল বলিল, “সারথি, তীর ধনুক আন ত! আমি এই মুনিকে মারিয়া কুকুরকে খাইতে দিব।”

 তখনই ধনুর্বান আসিয়া উপস্থিত হইল। রাজা ভয়ঙ্কর এক বাণ হাতে লইয়া মুনিকে মারিতে প্রস্তুত হইলেন। তাহা দেখিয়া মুনি বলিলেন, “এ বাণে আমি মরিব না; মরিবে তোমার খোকা!”

 এ কথার সঙ্গে সঙ্গেই দল মুনিকে বাণ মারিলেন, কিন্তু সে বাণ মুনির দিকে না গিয়া, অন্তঃপুরে প্রবেশপূর্বক রাজাব দশ বৎসরের পুত্র শ্যেনজিৎকে বধ করিল!

 এই ঘটনার সংবাদ পাইবামাত্র, দল আর একটি বাণ হাতে লইয়া বলিলেন, “এই বাণে দুষ্ট ব্রাহ্মণকে সংহার করিব!”

 এ কথায় বামদেব হাসিয়া বলিলেন, “বান ছুঁড়িতে পারিলে তবে ত আমাকে মারিবে!”

 বাস্তবিকই, রাজা বাণ ছুঁড়িতে গিয়া দেখেন, তাঁহার হাত অসাড় হইয়া গিয়াছে। তিনি আর তাহা নাড়িতে পারেন না! তখন তিনি ভয়ে অস্থির হইয়া বলিলেন, “আমি যে অবশ হইয়া গিয়াছি। মুনিঠাকুরের সঙ্গে বিবাদ করিয়া আমার কাজ নাই!”

 এমনি করিয়া রাজার ভালো বুদ্ধি আসিল। তারপর রানী বামদেবকে মিষ্ট কথায় তুষ্ট করিলে, তিনি দলের অপরাধ মার্জনাপূর্বক তাঁহাকে বর দিয়া, ঘোড়া দুইটি লইয়া আহ্লাদের সহিত আশ্রমে ফিরিলেন।

 মুনির বরে রাজার পাপ দূর হইল। ইহার পর তিনি আর কোন অন্যায় কাজ করেন নাই।