উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/মহাভারতের কথা/পরীক্ষিৎ ও সুশোভনার কথা

পরীক্ষিৎ ও সুশোভনার কথা

 অযোধ্যায় পরীক্ষিৎ নামে এক রাজা ছিলেন।

 একদিন মহারাজ পরীক্ষিৎ ঘোড়ায় চড়িয়া শিকারে বাহির হইলেন। শিকার করিতে করিতে তিনি দেখিলেন যে, একটা আশ্চর্যরকমের হরিণ বনের ভিতর চড়িয়া বেড়াইতেছে। হরিণটা তাঁহাকে দেখিয়াই ছুটিয়া পালাইতে লাগিল। মহারাজও তাহার পিছু পিছু ঘোড়া ছুটাইলেন, কিন্তু কিছুতেই তাঁকে ধরিতে পারিলেন না। সে পাগলা হরিণ বনের ভিতর দিয়া, পাহাড়ের উপর দিয়া, খানা খন্দ পার করাইয়া, তাঁহাকে কত দেশ যে ঘুরাইল, আর কি নাকাল যে করিল, তাহা আর বলিবার নয়। শেষকালে হতভাগা মহারাজকে একটা ঘোর অন্ধকার অরণ্যের ভিতরে আনিয়া গা ঢাকা দিল, তখন তিনি আর কি করেন? তিনি ভাবিলেন, “আর আমার হরিণ তাড়াইয়া কাজ নাই, এখন একটু জল খাইতে পাইলে বাঁচি।

 ভাবিতে ভাবিতে খানিক দূর গিয়াই তিনি দেখিলেন যে একটি অতি সুন্দর সবোবর সেখানে রহিয়াছে। মহারাজ সেই সরোবরে স্নান আর তাহার জল পান করিয়া সুস্থ হইলেন, ঘোড়াটাকে পদ্মের মৃণাল খাইতে দিলেন। তারপর সেই পুকুরের ধারে কোমল সবুজ ঘাসের উপর শুইয়া তিনি বিশ্রাম করিতেছেন, এমন সময় কোথা হইতে অতি মধুর গানের শব্দ তাঁহার কানে আসিয়া পৌছিল। এই ঘোর অরণ্য, ইহাতে মানুষের গতিবিধি নাই, এমন স্থানে কে এমন করিয়া গান গাহিতেছে? মহারাজ যত ভাবেন, ততই তাঁহার আশ্চর্য বোধ হয়। কিন্তু তাহার অধিক ভাবিতে হইল না। খানিক পরেই তিনি দেখিলেন যে, একটি অতি অপরূপ সুন্দরী কন্যা ফুল তুলিতে তুলিতে, আর গান গাহিতে গাহিতে তাঁর দিকেই আসিতেছে। রাজা তখন শশব্যস্তে উঠিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ভদ্রে, তুমি কে? কাহার স্ত্রী?

 কন্যা বলিল, ‘আমি কাহারো স্ত্রী নহি, আমার এখনো বিবাহ হয় নাই।

 রাজা বলিলেন, তবে আমাকে বিবাহ কর।

 কন্যা বলিলেন, আপনি যদি একটি প্রতিজ্ঞা করিতে পারেন, তবে আমি আপনাকে বিবাহ করিতে পারি।

 রাজা বলিলেন, ‘কি প্রতিজ্ঞা?

 কন্যা বলিল, ‘প্রতিজ্ঞাটি এই যে, আপনি কখনো আমাকে জল দেখিতে দিবেন না।

 রাজা বলিলেন, ‘আমি প্রতিজ্ঞা করিতেছি, তোমাকে কখনো জল দেখিতে দিব না।

 তারপর সেই কন্যার সহিত রাজা বিবাহ হইয়া গেল, রাজা যার পর নাই আনন্দের সহিত তাহাকে পাল্কিতে করিয়া অযোধ্যায় লইয়া আসিলেন অযোধ্যায় আসিয়া তাঁহার এই এক বিষম চিন্তা হইল, না জানি কখন রানী জল দেখিয়া বসেন, আর তাহাতে কি সর্বনাশ উপস্থিত হয়।

 আশপাশের সকল পুকুর মাটি দিয়া বুজাইয়া ফেলা হইল, সরযূ নদীর দিকের সকল জানালা বন্ধ হইয়া গেল, ছাতের উপর প্রকাণ্ড দেওয়াল উঠিল। রাজা দাসদাসীদিগকে বলিলেন, “খবরদার, তোরা জল খাইতে পারিবি না।

 তথাপি রাজার চিন্তা দূর হইল না। চাকর চাকরানীরা যদি কথা না শোনে আর যদি বৃষ্টি হয়? এই ভাবিয়া রাজা নিতান্ত ব্যস্ত ভাবে রানীর নিকট বসিয়া ক্রমাগত চাকরানীদিগের উপর পাহারা দিতে লাগিলেন, আর, মেঘ আসিলেই জানালা বন্ধ করিতে হইবে, তাই তিনি প্রত্যেক মিনিটে দুবার করিয়া ছাতে উঠিয়া আকাশ দেখিতে লাগিলেন।

 কাজেই রাজার আর রাজ্যের কাজ দেখিবার অবসর রহিল না। মন্ত্রীরা ব্যস্ত হইয়া উঠিলেন, প্রজারা চটিয়া গেল। রাজাকে খবর দিতে গেলেই তিনি বলেন, আমার অবসর কোথায়?

 মাসের পর মাস এইভাবে গেল, ইহার মধ্যে কেহই রাজার দর্শন পাইল না। বুড়া মন্ত্রী দাড়ি চুলকাইতে চুলকাইতে বলিলেন, তাই ত? ইহার একটা উপায় না করিলে নয়।

 অন্দরমহলে চাকরানীদিগকে মন্ত্রী জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমাদের কি কি কাজ করিতে হয়?

 চাকরানীরা বলিল, যাহাতে বাড়ির ভিতর জল না আসে, সকল কাজের আগে আমাদিগকে তাহাই দেখিতে হয়।

 রানী যে জল দেখিতে নারাজ, মন্ত্রীমহাশয় তাহার কথা একটু একটু শুনিয়াছিলেন, তিনি চাকরানীদিগের কথা শুনিয়া ভাবিলেন, ‘হুঁ—উ’ তবে দেখিতেছি, রানীকে জল দেখাইবার ফন্দি করিতে হইল।

 এই ভাবিয়া মন্ত্রী মহাশয় একটি বাগান প্রস্তুত করাইলেন। বাগানের ভিতরে এমন একট বাড়ি হইল যে, বাহিরে বৃষ্টি হইলেও সে বাড়ীর ভিতর হইতে তাহা দেখিতে পাওয়া যায় না। সেই বাগানে একটি অতি সুন্দর ছোট পুকুরও ছিল, কিন্তু তাহা দেওয়াল এবং গাছপালার ঘোরফেরের মধ্যে এমনি কৌশলপূর্বক লুকাইয়া রাখা হইয়াছিল যে, দিনকতক, বাগানেব ভিতরে না ঘুরিলে আর তাহার সন্ধান পাইবার জো ছিল না।

 ক্রমে রাজা সংবাদ পাইলেন যে, মন্ত্রী একটি আশ্চর্য বাগান করিয়াছেন, তাহার ভিতরে জল নাই, আর তাহার মধ্যে একটি সুন্দর বাড়ি আছে, সে বাড়ির ভিতরে থাকিলে বাহিরে বৃষ্টি হইলে তাহা দেখা যায় না। ক্রমাগত ছাতে উঠিয়া উঠিয়া রাজা মহাশয়ের বড়ই পা ধরিয়া গিয়াছিল। মন্ত্রীর বাগানবাড়ির কথা শুনিয়া তিনি লম্বা নিশ্বাস ফেলিলেন, আর বলিলেন, আমি উহা দেখিতে যাইব!

 বাগানবাড়ি দেখিয়া রাজার এতই ভালো লাগিল যে, তিনি রানীকে সেখানে লইয়া আসিতে আর একদিনও বিলম্ব করিলেন না, বুড়া মন্ত্রীর মনের ভিতরে আর হাসি ধরে না। তিনি পরম আদরে রাজা ও রানীকে বাগানে পৌঁছাইয়া দিয়া, বাহির হইতে তালা লাগাইয়া দিলেন।

 এতদিন ঘরের ভিতরে বন্ধ থাকার পর বাগানের খোলা হাওয়ায় রাজা রানীর প্রাণ জুড়াইয়া গেল। তাঁহারা দুইজনে ভোরে উঠিয়া বাগান দেখিতে আরম্ভ করিলেন, দুপুরবেলাও ঘরে ফিরিলেন না। রাজামহাশয় একে ত সেই রানীকে আনিয়া অবধি জল খান নাই, ইহার উপর আবার দুপুরবেলায় প্রখর রোদ লাগিয়া, তাঁহার এমনি ভয়ানক পিপাসা আর জ্বালা হইল যে কি বলিব। পিপাসার তাড়নায় তিনি রোদ ছাড়িয়া ক্রমাগত ঘন ছায়ার দিকে যাইতে লাগিলেন, সেই ঘন ছায়ার ভিতরে, ঘনগাছের আড়ালে, রাজামহাশয় আসিয়া দেখিলেন— একটি পুকুর!

 তখন রাজামহাশয় কেবল পিপাসার জ্বালার কথাই ভাবিতেছিলেন, জলের ভয়ের কথা তাঁরা মনেই ছিল না। তাই পুকুর দেখিবামাত্র তিনি অতিশয় আনন্দিত হইয়া রানীকে ডাকিলেন, তারপর দুইজনে জলে নামিয়া স্নান করিতে গেলেন।

 স্নানের পর শীতল হইয়া রাজা তীরে আসিলেন, কিন্তু হায়রে হায়! রানী সেই জলে ডুবিলেন, আর ভাসিলেন না। রাজার মাথায় আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়িল, রাজ্যময় হুলুস্থুল পড়িয়া গেল। জেলেরা আসিয়া জাল দিয়া পুকুর ছাঁকিল, কিন্তু কিছুই পাইল না। পুকুরের জল সেঁচিয়া ফেলা হইল, কিন্তু তাহাতে কিছুই ফল হইল না, খালি দেখা গেল, এক গর্তের মুখে একটি ব্যাঙ বসিয়া আছে।

 ব্যাঙ দেখিয়া রাজা ক্রোধভরে বলিলেন, ‘এই দুষ্টই আমার রানীকে খাইয়াছে! সুতরাং তোমরা সকলে মিলিয়া ব্যাঙ বধ কর। যে যত ব্যাঙ মারিবে, আমি তাহার উপর তত খুশি হইব, এবং তাহাকে তত বেশি পুরস্কার দিব!

 এ কথায় ছেলে বুড়ো সকলে তখনই লাঠি আর ঝুড়ি হাতে ব্যাঙ মারিবার জন্য ছুটিয়া বাহির হইল। জলের ধারে, বনের ভিতরে, ঘরের কোণে, সারাদিন খালি ধুপ ধাপ ভিন্ন আর কোন শব্দ শুনিবার জো রহিল না। রাজবাড়ীর দিকে অবিরাম লাঠি বগলে, ঝুড়ি মাথায় লোকের স্রোত বহিতে লাগিল। রাজামহাশয় সভায় আসিয়া আর অন্য কোন শব্দ শুনিতে পাইতেন না, খালি, ‘জয় হোক মহারাজ! এক ঝুড়ি ব্যাঙ আনিয়াছি!’ দিনরাত্রি এই কথাই তাঁহাকে শুনিতে হইত।

 আর বেচারা ব্যাঙদিগের কথা কি বলিব? খোলা জায়গা পাইলে তাহাদিগকে তাড়াইয়া মারে, জলে ঝাঁপ দিলে ছাঁকিয়া আনে, বনে লুকাইলে খুঁজিয়া বাহির করে, গর্তে ঢুকিলে খুঁড়িয়া তোলে। তাহারা প্রাণের ভয়ে নিতান্ত কাতর হইয়া তাহাদের রাজার নিকট গিয়া বলিল, “দোহাই মহারাজ! আমাদিগকে রক্ষা করুন, রাজার লোক আমাদিগকে মারিয়া শেষ করিল।

 তখন ব্যাঙের রাজা তপস্বীর বেশে পরীক্ষিতের নিকট উপস্থিত হইয়া বিনয়পূর্বক বলিলেন, 'মহারাজ, ভেকদিগের কোন অপরাধ নাই, তুমি তাহাদের উপর ক্রোধ করিও না।

 রাজা বলিলেন, তাহা হইতে পারে না। ঐ দুরাত্মারা আমার রানীকে খাইয়াছে উহাদিগকে অবশ্য বধ করিব।

 ব্যাঙের রাজা বলিলেন, ‘তোমার রানী আমারই কন্যা! উহার নাম সুশোভনা। আমার নাম আয়ু, আমি ব্যাঙদিগের রাজা। আমি বেশ জানি, তোমার রানীকে কেহই খায় নাই।

 এ কথায় রাজা নিতান্ত আহ্লাদিত হইয়া বলিলেন, তবে আপনার কন্যাকে আনিয়া দিন।

 ইহাতে আয়ু সুশোভনাকে রাজার নিকট উপহিত করিয়া, তাঁহাকে বলিলেন, ‘সুশোভনা, তুমি মহারাজকে এমন করিয়া কষ্ট দিয়াছ ইহাতে আমি বড়ই অসন্তুষ্ট হইয়াছি, এই অপরাধে তোমার সন্তানেরা ব্রাহ্মণদিগের সহিত বন্ধুতা করিতে পারিবে না।

 রানীকে পাইয়া রাজার আনন্দের আর সীমা রহিল না। তিনি ভক্তিভরে শ্বশুরকে প্রণাম করিয়া নানারূপ মিষ্ট কথায় তাঁহাকে তুষ্ট করিলেন, তারপর আয়ু, রাজা ও রানীকে আশীর্বাদ করিয়া দেশে চলিয়া গেলেন।

 তখন হইতে পরীক্ষিতের সময় খুব সুখেই কাটিতে লাগিল। ইহার পর আর সুশোভনা জল দেখিতে আপত্তি করেন নাই।