উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/মহাভারতের কথা/সত্যবান ও সাবিত্রীর কথা

সত্যবান্ ও সাবিত্রীর কথা

 মদ্র দেশে অশ্বপতি নামে এক রাজা ছিলেন। ধার্মিক, দাতা, সত্যবাদী— মহারাজ অশ্বপতি সকল গুণে পৃথিবীর সকল রাজার বড়, ইহার উপরে যদি তাঁহার একটি সন্তান থাকিত, তবে বড়ই সুখের কথাই হইত।

 ভালো একটি সন্তান পাওয়া দেবতার বিশেষ কৃপার কথা। মহারাজ একটি সন্তানের জন্য আঠার বৎসর ধরিয়া সাবিত্রী দেবীর আরাধনা করিলেন। আঠার বৎসর দিনের শেষে সামান্য জলযোগ মাত্র করিয়া কাটাইলেন।

 শেষে দেবীর কৃপায় হইল। তিনি যজ্ঞের অগ্নি হইতে অতি মনোহর বেশে উঠিয়া আসিয়া, বাজাকে বলিলেন, “মহারাজ, আমি তুষ্ট হইয়াছি; বর প্রার্থনা কর।”

 অশ্বপতি ভূমিতে লুটাইয়া দেবীকে প্রণামপূর্বক করজোড়ে কহিলেন, “দেবি যদি তুষ্ট হইয়া থাকেন, তবে দয়া করিয়া এই বর দিন যে, আমার যেন অনেকগুলি সন্তান হয়।”

 দেবী কহিলেন, “মহারাজ, তোমার জন্য আমি ব্রহ্মাকে বলিয়াছিলাম। তিনি বলিয়াছেন, তোমার একটি পরমাসুন্দরী আর অতি গুণবতী কন্যা হইবে।”

 দেবী চলিয়া গেলেন। কিছুদিন পরে রাজার ঘর আলো করিয়া, রানীর কোলে চাঁদের মত সুন্দর একটি কন্যা আসিল। সাবিত্রী দেবীর দয়ায় কন্যাটিকে পাইয়াছেন, তাই রাজা তাঁহার নাম রাখিলেন, সাবিত্রী।

 যেমন দেবতার নামে নাম, তেমনি মেয়েটি দেখতে দেবতার এত সুন্দর! বিধাতা যেন সোনার সহিত সকালবেলার সূর্যের আলোেক মিশাইয়া তাঁহার শরীরখানি গড়িয়াছিলেন। লোকে মোহিত হইয়া একদৃষ্টে তাঁহাকে চাহিয়া দেখিত, আর ভাবিত, না জানি কোন্ দেবতার মেয়ে আমাদের রাজার ঘর আলো করিতে আসিয়াছেন।

 সাবিত্রী ক্রমে বড় হইয়া উঠিলেন, আর ক্রমেই তাঁহার মনে ভগবানের প্রতি ভক্তি জাগিয়া উঠিল। ভগবানের কৃপায়, সকল সময়েই তাঁহার মুখে এমন আশ্চর্য একটি তেজ দেখা যাইত যে, রাজপুত্রেরা তাঁহাকে দেখিলেই নিজেদের চঞ্চলতার কথা ভাবিয়াই লজ্জিত হইতেন। সেই লজ্জায় তাঁহাদের কেহই সাবিত্রীকে বিবাহ করিতে আসিতে সাহস পাইলেন না।

 একদিন সাবিত্রী স্নানের পর দেবতার পূজা করিয়া, রাজার নিকট আসিয়া দাঁড়াইলে, তাঁহার সেই অপরূপ মূর্তি দেখিয়া রাজা নিতান্ত দুঃখের সহিত চিন্তা করিতে লাগিলেন, ‘হায়! মায়ের এমন সুন্দর মূর্তি এমন সকল গুণ—মাকে কেহই বিবাহ করিতে আসিল না।’

 তারপর তিনি সাবিত্রীকে বলিলেন, “মা লক্ষ্মি, ধনরত্ন লোকজন সঙ্গে দিব, সোনার রথ সাজাইয়া দিব, একবার দেশ ভ্রমণ করিয়া আইস, যদি কোন রাজপুত্রকে দেখিয়া তোমার ভালো লাগে, সেই রাজপুত্রের সহিত তোমার বিবাহ দিব।” তাহা শুনিয়া সাবিত্রী লজ্জায় মাটির দিকে তাকাইলেন।

 বুড়া মন্ত্রী বিশ্বাসী লোকজন ঠিক করিলেন। পথে খরচের জন্য মণি-মুক্তোর পুঁটলি কোমরে বাঁধিয়া লইলেন। তারপর সোনার রথ সাজাইয়া সাবিত্রীর ঘরের দরজায় আসিয়া দাঁড়াইলেন।

 তারপর সাবিত্রী পিতামাতার চরণে ভক্তিভরে প্রণাম করিয়া তাঁহাদের পায়ের ধূলা মাথায় লইলেন।

 তখন বুড়া মন্ত্রী স্নেহের সহিত তাঁহাকে রথে তুলিয়া দিলে, সারথি রথ চালাইয়া দিল। তারপর বাজকুমারী কত তীর্থ, কত তপোবন দেখিয়া বেড়াইলেন, কত দান করিলেন, কত আনন্দ পাইলেন, তাহা বলিতে গেলে আমি শেষ করিয়া উঠিতে পারিব না।

 অনেকদিন পরে যখন সাবিত্রী দেশে ফিরিলেন, তখন অশ্বপতি আর নারদ মুনি বসিয়া কথাবার্তা কহিতেছিলেন। সাবিত্রী তাঁহাদিগকে প্রণাম করিতে গেলে, নারদ বলিলেন, ‘মহারাজ তোমার এই কন্যাটি কোথায় গিয়েছিল? মেয়েটি বড় হইয়াছে, তবুও কেন উহার বিবাহ দিতেছ না?’

 রাজা বলিলেন, ‘আমি ইহাকে দেশ ভ্রমণে পাঠাইয়াছিলাম, মনে করিয়াছিলাম, কোন রাজপুত্রকে ইহার ভালো লাগিলে, তাহারই সহিত ইহাব বিবাহ দিব।’

 এই বলিয়া রাজা সাবিত্রীকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘মা, এমন কোন রাজপুত্রকে দেখিয়াছ কি?’

 পিতার কথার উত্তর না দিলেই নয়, অথচ মুনিঠাকুর সামনে বসিয়া আছেন। তাই সাবিত্রী নিতান্ত জড়সড় হইয়া বলিলেন, ‘আমি দ্যুমৎসেনের পুত্র সত্যবান্কে মনে মনে বরণ করিয়াছি।’

 দ্যুমৎসেন শাল্ব দেশের রাজা ছিলেন, তিনি অন্ধ হইয়া যাওয়াতে, শত্রুরা সুযোগ পাইয়া তাঁহাকে রাজ্য হইতে তাড়াইয়া দেয়। তখন রাজা আর রানী তাঁহাদের সত্যবান্ নামক শিশু পুত্রটিকে লইয়া বনবাসী হইলেন। সেই অবধি বনের ভিতরে থাকিয়া সত্যবান্ এখন বড় হইয়াছে।

 সত্যবানের কথা শুনিয়া নারদ চমকিয়া উঠিলেন। তারপর তিনি মুখ ভার করিয়া মাথা নাড়িয়া বলিলেন, ‘তাই ত! কাজটি ভালো হয় নাই! মহারাজ, সত্যবান্‌কে বরণ করিয়া তোমার কন্যা বড়ই ভুল করিয়াছে।’

 ইহাতে রাজা ব্যস্ত হইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘কেন মুনিঠাকুর? ছেলেটি কি ভালো নয়?’

 নারদ বলিলেন, ‘অতি চমৎকার ছেলে। দেখিতে অশ্বিনীকুমারের ন্যায়, তেজে সূর্যের ন্যায়, বুদ্ধিতে বৃহস্পতির ন্যায়! এমন শান্ত সরল সত্যবাদী ধার্মিক যুবক পৃথিবীতে আর নাই।’

 রাজা বলিলেন, ‘সত্যবানের দোষ কি?’

 নারদ বলিলেন, ‘সত্যবানের দোষ এই যে, আজ হইতে এক বৎসরের মধ্যে তাহার মৃত্যু হইবে। এই এক দোষে তাহার সকল গুণ বৃথা হইয়াছে।’

 তখন রাজা নিতান্ত দুঃখের সহিত সাবিত্রীকে বলিলেন, ‘মা মুনি বলিতেছেন আর এক বৎসর পরেই সত্যবানের মৃত্যু হইবে। তুমি ইঁহাকে বিবাহ করিওনা।’

 সাবিত্রী বলিলেন, আমি যখন তাঁহাকে বরণ করিয়াছি। তখন তিনিই আমার পতি। তাঁহার আয়ু অল্প হয় হউক, আমি তাঁহাকে ছাড়িয়া অন্য কাহাকেও বরণ করিব না।

 তাহা শুনিয়া নারদ বলিলেন, মহারাজ, তোমার কন্যার বুদ্ধি বড়ই স্থির, ধর্মে ইহার মতি নিতান্তই অটল। আমি বলি, সত্যবানের সহিতই ইহার বিবাহ দাও। সত্যবানের ন্যায় গুণবান্ লোক আর নাই।

 রাজা বলিলেন, আপনি আমার গুরু, আপনি যাহা বলিলেন, তাহাই হউক।

 নারদ বলিলেন, “আচ্ছা, তবে আমি এখন আসি। তোমাদের মঙ্গল হউক।

 এই বলিয়া নারদ চলিয়া গেলেন, আর অশ্বপতি সাবিত্রীর বিবাহের আয়োজন করিতে লাগিলেন। তারপর শুভ দিন স্থির করিয়া, ব্রাহ্মণ পুরোহিত সকলের সহিত রাজা সাবিত্রীকে লইয়া সেই বনের ভিতরে দ্যুমৎসেনের নিকট উপস্থিত হইলেন।

 অন্ধ রাজা দ্যুমৎসেন এক শাল গাছের তলায় কুশাসনে বসিয়া আছে, এমন সময়, অশ্বপতি সেখানে গিয়া বলিলেন, ‘মহারাজ, আপনাকে নমস্কার করিতেছি, আপনি ভালো আছেন ত? আমি মদ্রদেশ হইতে আসিয়াছি, আমার নাম অশ্বপতি।

 দ্যুমৎসেন পরম সমাদরে তাঁহাকে অর্ঘ্য আর আসন দিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, মহারাজ, কি জন্য আসিয়াছেন?'

 অশ্বপতি বলিলেন, “মহারাজ, আমার সাবিত্রী নাম্নী কন্যাটি পরম সুন্দরী ও গুণবতী। আমি তাহাকে আপনার নিকট উপস্থিত করিয়াছি, স্নেহপূর্বক ইহাকে আপনার পুত্রবধু করুন।

 দ্যুমৎসেন যার পর নাই আশ্চর্য হইয়া বলিলেন, “মহারাজ, আমরা বনবাসী দরিদ্র লোক। আপনার কন্যা কি করিয়া বনবাসের দুঃখ সহ্য করিবেন?

 অশ্বপতি বলিলেন, ‘আমার কন্যা তাহা পারিবে, আর তাহার ভিতরেই সুখে থাকিবে। ইহার জন্য আপনি কোন চিন্তা করিবেন না।

 দ্যুমৎসেন বলিলেন, “আমার রাজ্য নাই, তাই আমি ওরূপ কহিতেছিলাম। নহিলে, আপনার কন্যা আমার বধূ হইবেন, ইহার চেয়ে সুখের আর কি হইতে পারে?”

 বনের ভিতর যত তপস্বী ছিলেন, তাহারা সকলেই সাবিত্রী আর সত্যবাকে জানিতেন।

 বিবাহের নিমন্ত্রণ পাইয়া তাহারা আনন্দের সহিত আসিয়া দুমৎসেনের আশ্রমে উপস্থিত হইলেন। তাঁহাদের সকলের আশীর্বাদে এই সুখের ব্যাপার অতি সুন্দররূপেই শেষ হইল। সাবিত্রীকে যথার্থ সুপাত্রে দান করিয়া অশ্বপতির মনেও আনন্দের সীমা রহিল না।

 তারপর রাজা রানী, ব্রাহ্মণ পুরোহিত সকলে মিলিয়া বিদায় হইয়া গেলে, সাবিত্রী মনের সুখে স্বামী আর শ্বশুর শাশুড়ীর সেবা করিতে লাগিলেন। রাজবেশ পরিত্যাগপূর্বক তপস্বিনীর কষায় বসন (গেরুয়া কাপড়) পরিয়া যেন তাহার কতই আরাম বোধ হইতে লাগিল।

 সাবিত্রী নারদের সেই নিদারুণ কথা এক মুহূর্তের তরেও ভুলেন নাই। বৎসরের শেষ যতই কাছে আসিতে লাগিল, ততই সেই ভীষণ বিপদের চিন্তা অন্য সকল চিন্তাকে ডুবাইয়া দিয়া, তাহাকে ব্যাকুল করিয়া তুলিল। প্রতিদিন দিন গণিয়া যখন তিনি দেখিলেন যে, আর চারিটি দিন মাত্র বাকি আছে, তখন তিনি আহার নিদ্রা একেবারেই পরিত্যাগ করিয়া, একমনে কেবল ভগবানকে ডাকিতে লাগিলেন। এইরূপে তিনদিন চলিয়া গেল। তারপর সেই দিন আসিয়া উপস্থিত হইল, যেদিন সত্যবান্ তাহাকে চিরকালের মত ছাড়িয়া যাইবেন।

 সেদিন সকালে উঠিয়া সাবিত্রী সকলের আগে ভক্তিভরে দেবতার পূজা করিলেন। তারপর গুরুজনদিগের চরণে প্রণাম করিয়া জোহাতে তাহাদের সম্মুখে দাঁড়াইলে, তাহারা বহুকষ্টে চোখের জল থামাইয়া আশীর্বাদ করিলেন, “তোমার পতি বাঁচিয়া থাকুন।”

 চিন্তায় এবং অনাহারে সাবিত্রীর দেহ ক্ষীণ হইয়া যেন তাহার ছায়াখানি মাত্র অবশিষ্ট রহিয়াছে। তাহা দেখিয়া তাঁহার শ্বশুর শাশুড়ীর মনে বড়ই কষ্ট হইল।

 তাহারা বলিলেন, “মা, তিনদিন জলটুকুও মুখে দাও নাই, এখন আহার কর” সাবিত্রী তাহাদিগকে বিনয় করিয়া বলিলেন, “আজিকার দিনটি আমাকে ক্ষমা করুন, সূর্য অস্ত গেলে আমি আহার করিব।”

 কথায় বার্তায় বেলা হইল। সত্যবান্ কুড়াল কাঁধে লইয়া কাঠ আনিবার জন্য বনে যাইতে প্রস্তুত হইলেন, তাহা দেখিয়া সাবিত্রী বলিলেন, “আজি আমি কিছুতেই তোমার কাছ ছাড়া হইব না; আমাকে সঙ্গে লও।”

 সত্যবান্ বলিলেন, “সাবিত্রি, তুমি ত কখনো বনে যাও নাই, তাহাতে তোমার শরীর এত দুর্বল। তুমি কি করিয়া পথ চলিবে? কি করিযা বনের কষ্ট সহ্য করিবে?”

 সাবিত্রী বলিলেন, “আমার কোনো কষ্ট হইবে না। তোমার দুটি পায়ে পড়ি, আমাকে বারণ করিও না।”

 সত্যবান্ বলিলেন, “তুমি যাহাতে সুখী হও, আমি তাহাই করিতে প্রস্তুত। কিন্তু মা, বাবা কি তোমাকে যাইতে দিবেন?”

 সাবিত্রী শ্বশুর শাশুড়ীর পায়ে ধরিয়া বলিলেন, “বাবা, মা আজিকার দিনে দয়া করিয়া আমাকে ইহার সহিত যাইতে দিন।”

 দ্যুমৎসেন দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, “এক বৎসর সত্যবানেব বিবাহ হইয়াছে, ইহার মধ্যে মা আমার কোনদিন কিছু প্রার্থনা করেন নাই। আজ তাহার এই প্রথম আবদার আমি কোন প্রাণে অগ্রাহ্য করিব? যাও মা, আজ তুমি সত্যবানের সঙ্গে সঙ্গেই থাক।”

 দুজনে মিলিয়া বনের ভিতরে প্রবেশ করিলেন। চারিদিকে শোভার অন্ত নাই; ফল ফুলে বন পরিপূর্ণ হইয়া আছে। নদীতে হাঁস খেলিতেছে, গাছে বসিয়া পাখি গান গাহিতেছে, সত্যবানের আজ আনন্দ ধরে না। তিনি ক্রমাগত বলিতেছে, “সাবিত্রি, দেখ, দেখ!” হায়! সাবিত্রী কি দেখিবেন? বাহিরের ঘটনা স্বপ্নের মত তাহার চক্ষে সম্মুখ দিয়া চলিয়া যাইতেছে কিন্তু তাহার মন তাহার কোন সংবাদই লইতেছে না। সেই নিদারুণ মুহূর্ত কখন আসিয়া উপস্থিত হয়, এই চিন্তায় অন্য সকল কথা একেবারে ভুলিয়া গিয়া, তিনি বারবার কেবল সত্যবানকেই চাহিয়া দেখিতেছেন।

 ক্রমে বেলা পড়িয়া আসিল, সাজি ফলে ভরিয়া গেল। তারপর সত্যবান্ কাঠ কাটিতে আরম্ভ করিলেন। কাটিতে কাটিতে তিনি বলিলেন, “সাবিত্রি, আমার বড় মাথা ধরিয়াছে শরীর কেন ভাঙ্গিয়া পড়িতেছে; বুক যেন ফাটিয়া যাইতেছে। আমি আর দাঁড়াইতে পারিতেছি না; একটু নিদ্রা যাইব।”

 অমনি নারদ মুনির সেই কথা সাবিত্রীর মনে হইল। কিন্তু তাহার জন্য আর ব্যস্ত না হইয়া, তিনি সত্যবানের মাথাটি নিজের কোলে লইয়া;স্থিরভাবে বসিয়া রহিলেন, কিঞ্চিৎ পরেই তিনি দেখিলেন যে, এক ভয়ঙ্কর পুরুষ হঠাৎ কোথা হইতে সত্যবানের নিকট আসিয়া, একদৃষ্টে  তাঁহাকে চাহিয়া দেখিতেছে। সেই ভয়ঙ্কর পুরুষ দেখিতে সূর্যের ন্যায় উজ্জল। তাহার চক্ষু অত্যন্ত লাল, শরীর ঘোর কালো, পরিধানে লাল কাপড়, এবং হাতে পাশ (ফাঁদ)।

 সেই ভয়ঙ্কর পুরুষকে দেখিবামাত্র সাবিত্রীর প্রাণ কঁদিয়া উঠিল। তখন তিনি স্নেহভরে সত্যবানের মাথাটি নামাইয়া, বিনীতভাবে উঠিয়া দাঁড়াইলেন; এবং জোড়হাতে জিজ্ঞাসা করিলেন, “আপনি কে? কি জন্য এখানে আসিয়াছেন?”

 ভয়ঙ্কর পুরুষ বলিলেন, “আমি যম। আজ তোমার পতি সত্যবানের আয়ু শেষ হইয়াছে। তাই তাহাকে বাঁধিয়া নিতে আসিয়াছি।”

 সাবিত্রী বলিলেন, “মানুষকে ত আপনার দূতেরাই লইয়া যায়, শুনিয়াছি। আজ আপনি নিজে কি জন্য আসিয়াছেন?”

 যম বলিলেন, “এই সত্যবান্ অসাধারণ পুণ্যবান পুরুষ, তাই আমি নিজে ইহাকে লইতে আসিয়াছি।”

 এই বলিয়া তিনি সত্যবানের দেহ হইতে অঙ্গুষ্ঠ প্রমাণ (বুড়ো আঙ্গুলের মতন বড়) একটি পুরুষকে পাশে ধাঁধিয়া টানিয়া বাহির করিলেন। উহাই ছিল সহবানের আত্মা। উহা বাহির হইবামাত্র তাঁহার শরীর অসাড় হইয়া মড়ার মত পড়িয়া রহিল।

 যম সেই অঙ্গষ্ঠ প্রমাণ পুরুষকে বাঁধিয়া লইয়া দক্ষিণ দিকে যাত্রা করিলেন; সাবিত্রীও শোকে কাতর হইয়া বাকুলভাবে তাঁহার পশ্চাতে যাইতে লাগিলেন।

 যম বলিলেন, “সাবিত্রী, তুমি কি জন্য আসিতেছ? তুমি ফিরিয়া যাও। সত্যবানের শ্রাদ্ধের আয়োজন করিতে হইবে।”

 সাবিত্রী বলিলেন, “স্বামী যেখানে যান, স্ত্রীরও সেইখানেই যাওয়া উচিত। আমাদের দুজনে মিলিয়া ধর্ম-সাধন করিতে হইবে; সুতরাং আমার স্বামীকে ছাড়িয়া আমি কোথায় থাকিব? আমি তপস্যা করিয়া, এবং আপনার কৃপায় যেখানে ইচ্ছা যাইবার ক্ষমতা পাইয়াছি আমি আমার স্বামীর সঙ্গে যাইব।”

 যম বলিলেন, “সাবিত্রী, ফিরিয়া যাও। আমি তোমার কথায় বড় সন্তুষ্ট হইয়াছি। সত্যবানের জীবন ছাড়া, তোমার যাহা ইচ্ছা বর লও।”

 সাবিত্রী বলিলেন, “আমার শ্বশুর অন্ধ হইয়াছেন, এবং রাজ্য হারাইয়া বনে বাস করিতেছে। আপনার কৃপায় তাঁহার চক্ষু ভাল হউক, আর তিনি অগ্নি ও সূর্যের ন্যায় বল লাভ করুন।”

 যম কহিলেন, “আচ্ছা, তাহাই হইবে। এখন তুমি বড়ই ক্লান্ত হইয়াছ দেখিতেছি। আর কষ্ট পাইও না, এখন ঘরে যাও।”

 সাবিত্রী বলিলেন, “আমি আমার স্বামীর সঙ্গে রহিয়াছি, আমার কিসের কষ্ট, আর আপনার নিকটে থাকিলে আমার পুণ্য লাভ হইবে। আমার ঘরে ফিরিবাব প্রয়োজন নাই।”

 যম কহিলেন, “সাবিত্রী, তোমার কথা বড়ই মিষ্ট। সত্যবানের জীবন ভিন্ন তুমি আর একটি বর প্রার্থনা কর।”

 সাবিত্রী বলিলেন “তবে আমার শ্বশুর আবার তাঁহার রাজ্য ফিরিয়া পাউন!” যম কহিলেন, ‘তোমার শ্বশুর শীঘ্রই তাহার রাজ্য পাইবেন। এখন ফিরিয়া যাও।”

সাবিত্রী বলিলেন, “আপনি ধর্মরাজ; পাপের শাস্তি আপনিই বিধান করেন, পুণ্যবানের মনোবাঞ্ছা আপনিই পূর্ণ করেন। আপনার ন্যায় মহতেরা শত্রুকেও দয়া করিয়া থাকেন।”

 যম কহিলেন, “পিপাসার সময়ে জলে যেমন তৃপ্তি হয়, তোমার এই কথাগুলি শুনিয়া আমার তেমনি তৃপ্তি বোধ হইতেছে। সত্যবানের জীবন ভিন্ন তুমি আর-একটি বর প্রার্থনা কর।

 সাবিত্রী বলিলেন, “আমার পিতার পুত্র সন্তান নাই; তাহার একশতটি পুত্র হউক।”

 যম কহিলেন, “তাহাই হউক! তোমার একশতটি অতি সুন্দর ভাই হইবে। এখন ত সকলই পাইলে; এখন ফিরিয়া যাও, দেখ, তুমি কত দূরে চলিয়া আসিয়াছ।”

 সাবিত্রী বলিলেন, “আমি ত আমার স্বামীর কাছে রহিয়াছি, তবে আর দূরে কি করিয়া হইল! আমার ইহার চেয়ে আরো দূরে যাইতে ইচ্ছা হইতেছে। আপনি চলিতে চলিতেই আমার কথা শুনুন। ন্যায় এবং সাধুতাকে আপনি রক্ষা করেন, এইজন্য আপনার নাম ধর্মরাজ। আপনার প্রতি আমার যেমন বিশ্বাস হয়, আমার নিজের প্রতিও তেমন হয় না। তাই আমি আপনার সঙ্গে চলিয়াছি।

 যম কহিলেন, সাবিত্রি, এমন সুন্দর কথা ত আমি আর কাহারো নিকট শুনি নাই। আমি বড়ই সুখী হইলাম। সত্যবানের জীবন কিনা তুমি আরো একটি বর প্রার্থনা কর।

 সাবিত্রী বলিলেন, তবে সত্যবানের একশতটি পূত্র হউক।

 যম কহিলেন, “আচ্ছা তবে তাহাই হইবে। এখন ঘরে যাও।

 সাবিত্রী বলিলেন, সাধু লোকের নিকট সাধু লোেক আসিলে সর্বদাই মঙ্গল হইয়া থাকে। সাধুদিগের অনুগ্রহ কখনো বিফল হয় না। সাধুরাই সকলকে রক্ষা করেন।

 যম কহিলেন, সাবিত্রি, তোমার কথা যত শুনিতেছি ততই তোমার উপর আমার ভক্তি হইতেছে। তুমি পুনরায় বর প্রার্থনা কর।

 সাবিত্রী বলিলেন, ‘আপনি সত্যবানের শতপুত্র হইবার বর দিলেন, তথাপি তাঁহাকে লইয়া যাইতেছে। তাহা হইলে আপনার কথা কেমন করিয়া সত্য হইবে! সুতরাং সত্যবানকে ছাড়িয়া দিন।

 তখন যম আহ্লাদের সহিত সত্যবামের বাধন খুলিয়া দিয়া বলিলেন, “এই নাও, তোমার স্বামীকে ছাড়িয়া দিলাম। ইহার পর চারিশত বৎসর তোমরা সুখে বাঁচিয়া থাকিয়া একশতটি পুত্র লাভ কর।

 এই বলিয়া যম সেখান হইতে প্রস্থান করিলে, সাবিত্রী বনের ভিতরে ফিরিয়া আসিয়া দেখিলেন, সত্যবানের দেহ সেইভাবে পড়িয়া রহিয়াছে। তখন তিনি পরম আদরে তাঁহার মাথাখানি কোলে লইবামাত্র সত্যবান্ চক্ষু মেলিয়া বলিলেন, ‘কি আশ্চর্য! রাত্রির হইয়া গিয়াছে তবুও আমি ঘুমাইতেছিলাম। সাবিত্রি, তুমি আমাকে জাগাও নাই কেন? আর আমাকে যে ধরিয়া টানিতেছিল, সেই কালো লোকটি কোথায় গেল?

 সাবিত্রী বলিলেন, ‘সেই লোকটি চলিয়া গিয়াছে। এখন বোধহয় তোমার শরীর একটু সুস্থ হইয়াছে, এখন উঠ, দেখ, রাত্রি হইয়াছে।

 তখন সত্যবান্ উঠিয়া দাঁড়াইয়া চারিদিক চাহিয়া বলিলেন, “আমার মনে হইতেছে যে, আমি শুধু ফল খাইয়া তোমাকে লইয়া বনে আসিয়াছিলাম। তারপর কাঠ চিরিতে চিরিতে আমার ভয়ানক মাথা ধরিল, আমি তোমার কোলে মাথা রাখিয়া ঘুমাইয়া পড়িলাম। তারপর যেন একটা ভয়ঙ্কর কালো লোককে দেখিলাম। সে সত্য কি স্বপ্ন তাহা বলিতে পারি না।

তুমি কিছু দেখিয়াছ?'

 সাবিত্রী বলিলেন, কাল সব বলিব। এখন রাত্রি হইযাছে, চল শীঘ্র বাড়ি যাই, নহিলে বাবা আর মা ব্যস্ত হইবেন। অন্ধকার হইয়াছে জানোয়ারেরা ডাকিতেছে, আমার বড়ই ভয় হইতেছে।

 সত্যবান্ বলিলেন, এই ভয়ঙ্কর অন্ধকারের মধ্যে তুমি পথ দেখিতে পাইবে না।

 সাবিত্রী বলিলেন, “তোমাকে বড় দুর্বল বোধ হইতেছে। তোমার যদি চলিতে কষ্ট বোধ হয়, তবে নাহয় চল এইখানেই আজ রাত্রে থাকি। ঐ দেখ, একটা গাছ জ্বলিতেছে, ঐখান হইতে আগুন আনিয়া এই কাঠগুলো জ্বালাইয়া দিই, তাহা হইলে তোমার একটু আরাম বোধ হইতে পারে।

 সত্যবান্ বলিলেন, আমার এখন বেশ ভালো বোধ হইতেছে, চল ঘরেই যাই। আর কখনো আমার ঘরে ফিরিতে এত দেরি হয় নাই। সন্ধ্যা হইলেই মা আমাকে ঘরের ভিতরে বন্ধ করিতেন। দিনের বেলায় আমি বাহিরে গেলেও মা বাবা ব্যস্ত হইতেন। তখন বাবা আমাকে কত খুঁজিতেন। একদিন আমার বিলম্ব হওয়াতে, বাবা বড়ই দুঃখিত হইয়াছিলেন, আর আমাকে অনেক বকিয়াছিলেন। আজ না জানি আমার জন্য তাঁহার কতই ব্যাকুল হইয়াছে। আহা। আমি ভিন্ন যে আর তাঁহাদের কেহই নাই! হায় হায়! কেন ঘুমাইয়া পড়িলাম?'

 এই বলিয়া সত্যবান্ কাঁদিতে আরম্ভ করিলেন। তখন সাবিত্রী স্নেহের সহিত তাঁহার চোখের জল মুছাইয়া দিয়া, তাঁহাকে শান্ত করিলে তিনি বলিলেন, সাবিত্রি, আর বিলম্ব করা হইবে না, চল শীঘ্র ঘরে যাই। বাবা-মা'র যদি কিছু হয়, তবে আর আমার বাঁচিয়া থাকিয়া ফল কি?

 তখন সাবিত্রী সত্যবানের কুড়াল আর ফলের ঝুড়ি হাতে করিয়া লইলে, সত্যবান্ একহাতে তাঁহার বাম কাঁধের উপর ভর দিয়া ধীরে ধীরে চলিতে লাগিলেন। বনের সকল পথই সত্যবানের বেশ ভালোরূপে জানা ছিল, কাজেই অন্ধকারের ভিতরেও তাঁহাদের চলিতে বিশেষ কষ্ট হইল না।

 এদিকে এক আশ্চর্য ঘটনা হইয়াছে। অন্ধ দ্যুমৎসেন আশ্রমে বসিয়া সত্যবানের কথা ভাবিতেছিলেন, ইহার মধ্যে হঠাৎ তাঁহার চক্ষু ভালো হইয়া গেল। তিনি আশ্চর্য হইয়া চারিদিক চাহিয়া বলিলেন, ‘সত্যবান্ কোথায়?’ যখন শুনিলেন তিনি তখনো ফিরেন নাই, তখন আর তাঁহার দুঃখের সীমা রহিল না। তখন সেই অন্ধকারের ভিতরেই স্ত্রীকে সঙ্গে লইয়া তিনি বনে বনে সত্যবানকে খুঁজিবার জন্য পাগলের মত ছুটিয়া বাহির হইলেন। কাঁটার ঘায় তাঁহাদের পা ক্ষতবিক্ষত হইয়া গেল। শরীর বাহিয়া রক্ত পড়িতে লাগিল। সে কষ্ট তাঁহাদের কষ্ট বলিয়াই মনে হইল না। কোন শব্দ হইলেই দ্যুমৎসেনের মনে হইতে লাগিল যে, ঐ বুঝি উহারা আসিতেছে। এই মনে করিয়া তিনি কতবার যে সত্যবান্! সত্যবান! সাবিত্রি। সাবিত্রি।’ বলিয়া ডাকিলেন তাহার সংখ্যা নাই।

 ভাগ্যিস আশ্রমের লোকেরা এই শব্দ শুনিয়া অনেক কষ্টে তাঁহাদিগকে খুঁজিয়া বাহির করিলেন, নচেৎ না জানি কি হইত? মুনিরা সকলে তাঁহাকে আশ্রমে আনিয়া, অতি মিষ্টভাবে তাঁহাকে বুঝাইয়া শান্ত করিতে লাগিলেন।

 সুবচা বলিলেন, ‘আপনারা স্থির হউন! সাবিত্রীর পুণ্যের বলে সত্যবান্ অবশ্যই জীবিত আছে, ইহাতে সন্দেহ নাই।

 গৌতম বলিলেন, “আমি অনেক তপস্যা কবিয়াছি, লোকের মনের কথাও বলিয়া দিতে পারি, আমি নিশ্চয় বলিতেছি, সত্যবানের মৃত্যু হয় নাই।

 এ কথায় গৌতমের একজন শিষ্য বলিলেন, “আমার গুরুদেবের কথা কখনো মিথ্যা হয় না। সত্যবান্ অবশ্যই বাঁচিয়া আছে।

 দালভ্য কহিলেন, “তোমার চক্ষু যখন ভালো হইয়াছে, তখন সত্যবানও ভালো আছেন।

 মুনিদিগের কথায় দুমৎসেন অনেক সুস্থির হইযাছে, এমন সময় সাবিত্রী আর সত্যবান হাসিতে হাসিতে আশ্রমে ফিরিয়া আসিলেন। তাহাতে মুনিগণ আনন্দে কোলাহল করিতে করিতে দ্যুমৎসেনকে কত যে আশীর্বাদ করিলে তাহার সীমা নাই। তারপর সকলে সত্যবানকে জিজ্ঞাসা করিলেন, সত্যবান্ আজ তোমার ঘরে ফিরিতে এত বিলম্ব কেন হইল? তোমাদের জন্য তোমার পিতামাতা কত যে কষ্ট পাইয়াছেন, তাহা বলিয়া শেষ কবা যায় না।

 ইহাতে সত্যবান্ নিতান্ত দুঃখিত হইয়া বলিলেন, আমার কখনো ত এমন হয় না, কিন্তু আজ বড় মাথা ধরায়, বনের ভিতরে অনেকক্ষণ ঘুমাইয়াছিলাম।

 তখন গৌতম কহিলেন, ‘সত্যবান্, তোমার পিতার চক্ষু কি করিয়া ভালো হইল, তুমি তাহার কিছুই জান না, কিন্তু সাবিত্রী তাহার সমস্তই জানেন, তিনি যদি তাহা আমাদিগকে বলেন, তবে বড় সুখী হইব।

 গৌতমের কথায় সাবিত্রী সে রাত্রির আশ্চর্য ঘটনাসকলের কথা বলিলে মুনিরা যার পর নাই আহ্লাদিত হইয়া উচ্চৈঃস্বরে তাঁহার প্রশংসা করিতে করিতে নিজ নিজ আশ্রমে চলিয়া গেলেন।

 পরদিন সকালে দ্যুমৎসেন মুনিদিগের সহিত বসিয়া রাত্রির ঘটনার বিষয়ে কথাবার্তা বলিতেছে, এমন সময়ে শাল্বদেশ হইতে তাঁহার প্রজাগণ তাঁহার নিকট উপস্থিত হইয়া বলিল, মহারাজ! মন্ত্রী আপনার শত্রুকে বধ করিয়াছে, তাহার সৈন্যরা পলাইয়া গিয়াছে। আমরা সকলে মিলিয়া স্থির করিয়াছি যে, আপনার চক্ষু থাকুক বা না থাকুক, আপনিই আমাদের রাজা হইবেন। তাই আমরা রথ লইয়া আপনাকে লইতে আসিয়াছি, আপনি আপনার রাজ্যে চলুন।

 বলিতে বলিতেই তাহারা দেখিল যে, রাজা আর অন্ধ নহেন, তাঁহার দুই চক্ষু ভালো হইয়া গিয়াছে। ইহাতে তাহারা নিতান্ত আশ্চর্য এবং আনন্দিত হইয়া তাঁহার পায়ের ধূলা লইতে আরম্ভ করিল।

 তারপর দেশে গিয়া দ্যুমৎসেন রাজা আর সত্যবান্ যুবরাজ হইলেন। কালে সত্যবান ও সাবিত্রীর একশতটি পুত্র আর রাজা অশ্বপতিরও একশতটি পুত্র হইল।

 এমনি করিয়া সাবিত্রী পিতা, মাতা, শ্বশুর, শাশুড়ী এবং স্বামীর দুঃখ দূর করিয়াছিলেন। আর সেইজন্য এখনো আমাদের দেশের লোকে সাবিত্রীকে ভক্তি করে।