উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/মহাভারতের কথা/বৈবস্বত মনু ও আশ্চর্য মাছের কথা
বৈবস্বত মনু ও আশ্চর্য মাছের কথা
সত্যযুগে এক মুনি ছিলেন, তাঁহার নাম ছিল মনু। তাঁহার পিতার নাম ছিল বিবস্বান্, তাই লোকে তাঁহাকে বলিত, বৈবস্বত (বিবস্বানের পুত্র) মনু।
তখন পৃথিবীতে কত সুন্দর মানুষ ছিল, কিন্তু বৈবস্বত মনুর মত সুন্দর কেহই ছিল না। কত বড় বড় মুনি ছিলেন, কিন্তু বৈবস্বত মনুর চেয়ে বড় মুনি কেহই ছিলেন না।
চারিণী নদীতে বৈবস্বত মনু স্নান করিলেন। তাঁহার মাথার জটা, পরনের কাপড় ভিজাই রহিল। তাহা লইয়াই মুনি তপস্যা করিতে বসিলেন। তাঁহার মতন তপস্যা কেহই করিতে পারিত না।
নদীতে একটি ছোট্ট মাছের ছানা ছিল। সে বেচারা কতই ছোট, তাহাকে ভাল করিয়া দেখিতেই পাওয়া যায় না।
মহামুনি তপস্যায় বসিয়াছেন, ছোট্ট মাছের ছানাটি তাঁহার নিকট আসিয়া, তাহার ছোট্ট ডানা দুখানি জোড় করিয়া বলিল—
“মুনি ঠাকুর! আমাকে দয়া করুন। দেখুন, আমি কতই ছোট— বড় মাছেরা আমাকে খাইয়া ফেলিবে।”
মুনি চাহিয়া দেখিলেন, একটি ছোট মাছের ছানা তাঁহার নিকট হাত জোড় করিতেছে। মুনির দয়া হইল, তিনি বলিলেন—“বাছা, তোর কি চাই? বল আমি কি করিলে তোর দুঃখ দূর হইবে।”
ছোট মাছের ছানাটি তাহার ছোট্ট ডানা দুখানি জোড় করিয়া বলিল— “আমাকে এখান হইতে লইয়া যাউন। আমাকে দিয়া আপনার উপকার হইবে।”
দুহাতে অঞ্জলি করিয়া, মহামুনি ছোট্ট মাছের ছানাটিকে তুলিয়া লইলেন। এরপর তাহাকে বাড়িতে আনিয়া, ধবধবে সাদা কলসীর ভিতরে রাখিয়া, পরম যত্নে পুষিতে লাগিলেন।
যতদিন যাইতে লাগিল, মাছের ছানাটি ততই বাড়িতে লাগিল। শেষে আর সেই কলসীতে তাহার জায়গা হয় না। তখন সে মুনিকে বলিল—“মুনি ঠাকুর, এখানে ত আমি নড়িতে চড়িতে পাই না। দয়া করিয়া আমাকে অন্য জায়গায় লইয়া যাউন!”
সেইখানে একটা খুব বড় দীঘি ছিল, তাহার এপার হইতে ওপার ধোঁয়ার মত দেখা যাইত। মুনি মাছের ছানাটিকে কলসী হইতে তুলিয়া, সেই দীঘিতে নিয়া রাখিলেন।
তারপর অনেক বৎসর গেল। অনেক বৎসর ধরিয়া সেই দীঘিতে থাকিয়া, মাছটি ক্রমে বড় হইতে লাগিল। শেষে আর সেই বিশাল দীঘিতেও তাহার জায়গা হয় না! তখন সে অনেক মিনতি করিয়া মুনিকে আবার বলিল— “মুনি ঠাকুর, আপনার দয়ায়, দেখুন, আমি কত বড় হইয়াছি! এখন আর এই দীঘিতেও আমার জায়গা হয় না। আপনার দুটি পায়ে পড়ি, দয়া করিয়া আমাকে আর কোথাও লইয়া যাউন৷”
তখন মুনি মাছটিকে সেই দীঘি হইতে তুলিয়া, গঙ্গায় নিয়া ছাড়িয়া দিলেন। কিন্তু কিছুদিন পরে, গঙ্গায়ও তাহার জায়গা কুলাইল না। তখন সে মুনিকে বলিল—মুনি ঠাকুর এখানেও আমার জায়গা হইতেছে না। আমাকে সমুদ্রে লইয়া চলুন৷”
তখনই, এত বড় মাছ, তাহাকে মুনি মাথায় করিয়া লইলেন। তাহার গায় এমন গন্ধ ছিল, সে গন্ধ মুনি সহিয়া রহিলেন, শ্যাওলা আর পোকার কথা তিনি মনেই করিলেন না। এইরূপে তাহাকে বহিয়া নিয়া মুনি সাগরের জলে তাহাকে ছাড়িয়া দিলেন৷
তখন সেই মাছ হাসিতে হাসিতে বলিল—“মুনি ঠাকুর, আপনি আমাকে এত করিয়া বাঁচাইলেন, আমিও আপনার উপকার করিতে ভুলিব না। এখন, এক যে ভয়ানক বিপদের সময় আসিতেছে, তাহার কথা শুনুন। সৃষ্টি নষ্ট হইতে আর দেরি নাই। এই বেলা আমি যাহা বলিতেছি তাহা করুন একটা খুব বড় নৌকা প্রস্তুত করাইয়া, তাহাতে খুব মোটা, খুব শক্ত দড়ি বাঁধিয়া রাখিবেন। সেই নৌকায়, সকল রকমেব বীজ সঙ্গে লইয়া, সপ্তর্ষিদিগের সহিত, আপনি উঠিয়া বসিয়া থাকিবেন। তারপর যখন সময় হইবে, তখন আমি আপনা হইতেই আসিয়া উপস্থিত হইব। তখন আমার মাথায় একটা শিং থাকিবে৷”
এই বলিয়া মাছ চলিয়া গেল। মুনি নৌকা প্রস্তুত করাইয়া তাহাতে উঠিয়া বসিয়া রহিলেন। খানিক পরে, সেই মাছও শাল গাছের মতন উচু শিং মাথায় করিয়া, সেইখানে আসিয়া দেখা দিল। সেই শিঙে সেই মোটা দড়ি দিয়া নৌকাখানিকে বাঁধিয়া দিলে, আর কোন ভয় বহিল না৷
তারপব মেঘ ডাকিত লাগিল; ঢেউ সকল পর্বতের মত উঁচু হইয়া ছুটিতে লাগিল, অকুল সমুদ্রের ভিতরে ভয়ঙ্কর ঝড়ে পড়িয়া নৌকাখানি ঘুরপাক খাইতে লাগিল। সেই বিষম ঝড়ে সংসারের সকল প্রাণী ডুবিয়া মরিল, কেবল মনু আর সেই সাতজন ঋষি, সেই মাছের দয়াতে প্রাণে বাঁচিয়া রহিলেন৷
শেষে জল কমিতে লাগিল। ক্রমে হিমালয়ের চূড়া দেখা দিল, তখন সেই মাছ বলিল— “মুনি ঠাকুর, এই পর্বতের চূড়ায় নৌকা বাঁধুন৷”
মাছের কথায় মুনিরা সেইখানে নৌকা বাঁধিলেন। সেই মাছ ছিলেন ব্রহ্মা। তিনি এইরূপ করিয়া প্রলয়ের সময়ে সেই আটটি মুনিকে বাঁচাইয়া ছিলেন৷