উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/মহাভারতের কথা/সৃষ্টি ও প্রলয়ের কথা

সৃষ্টি ও প্রলয়ের কথা

 মহাভারতে লেখা আছে যে, সৃষ্টির পূর্বে কেবলই অন্ধকার ছিল। তারপর প্রথমে একটি ডিম হইল। ব্রহ্মাণ্ডের সকল বস্তুর বীজ এই ডিমের ভিতরে ছিল।

 ডিমটি যখন ফুটিল, তখন তাহার ভিতর হইতে সকলের আগে ব্রহ্মা বাহির হইলেন, তারপর ক্রমে দেব, দানব, যক্ষ, পিশাচ, পৃথিবী, জল, বায়ু, আকাশ প্রভৃতির সৃষ্টি হইল।

 ব্রহ্মার অনেক পুত্র, তাহার মধ্যে মরীচি, অত্রি, অঙ্গিরাঃ, পুলস্ত্য, পুলহ, ক্রতু এবং বশিষ্ঠ, এই সাতজনকে সপ্তর্ষি বলে। ব্রহ্মার বুক হইতে ধর্ম ও ভৃগু, এবং তাঁহার পায়ের বুড়া আঙ্গুল হইতে দক্ষের জন্ম হয়। দক্ষের পঞ্চাশটি কন্যা ছিল, মরীচির পুত্র কশ্যপ এই পঞ্চাশটির মধ্যে তেরটিকে বিবাহ করেন। সেই তেরটি কন্যার নাম—অদিতি, দিতি, দনু, কালা, দনায়ু, সিংহিকা, ক্রোধা, প্রধা, বিশ্বা, বিনতা, কপিলা, মুনি ও কদ্রু। ইঁহারাই দেব, দৈত্য, গন্ধর্ব, অপ্সরা, প্রভৃতির মাতা।

 কিন্তু জীবজন্তু সকলেই যে ইঁহাদের সন্তান, তাহা নহে। রাক্ষস, বানর, যক্ষ, কিন্নর ইহারা পুলস্ত্য হইতে এবং সিংহ, ব্যাঘ প্রভৃতি পুলহ হইতে জন্মিয়াছিল। তাহা ছাড়া, অন্যান্য কয়েকজনের সন্তানও প্রাণীদিগের ভিতরে আছে। এইরূপে ক্রমে ক্রমে সকল প্রাণীর সৃষ্টি হইয়াছিল।

 সৃষ্টির সময়টি ছিল এই সংসারের শিশুকাল। এখন তাহার অনেক বয়স হইয়াছে। তাহার পর যখন তাহার শেষকাল উপস্থিত হইবে, তখন প্রলয় আসিয়া সৃষ্টি নষ্ট করিয়া দিবে। তাহার পর ভগবান আবার নূতন সৃষ্টি করিবেন। যেমন দিনের পর বাত্রি, তারপর আবার দিন, তারপর আবার রাত্রি—সেইরূপ সৃষ্টির পর প্রলয়, তারপর আবার সৃষ্টি তারপর আবার প্রলয়। সংসারটা যেন একটা মস্ত জাল, ভগবান সেই জালকে ক্রমাগতই কেবল মেলিতেছেন। আর গুটাইতেছেন।

 মানুষের জীবনে যেমন শিশুকাল, যৌবনকাল, প্রবীণ বয়স আব বৃদ্ধকাল থাকে, আমাদের প্রাচীন শাস্ত্রসকলের মতে এই সংসারের জীবনেও সত্যযুগ, ত্রেতাযুগ, দ্বাপরযুগ, আর কলিযুগ, এই চারিটি যুগ আছে। সত্যযুগে সকলই ছিল খুব ভাল ভাল আর বড় বড়। তখনকার এক একটা মানুষ নাকি হইত একুশ হাত লম্বা। তারপর ত্রেতাযুগে সংসারে একটু মন্দা দেখা দিল, মানুষও একটু দুষ্ট আর একটু খাটো হইল। কিন্তু তখনো সে চৌদ্দ হাত লম্বা হইত। দ্বাপরযুগের মানুষ সাত হাত মাত্র লম্বা ছিল, আর তখন ভাল মন্দের ভাগও সমান সমান ছিল, তারপর শেষে এখন কলিযুগ উপস্থিত হইয়াছে। এখনকার হতভাগ্য মানুষ সাড়ে তিন হাত বই লম্বা হয় না, আর একটা ভাল কাজ করিতে করিতে তিনটা মন্দ কাজ করিয়া বসে! এইরূপে এই সংসার যখন পুরাতন ময়লা ছেঁড়া কাপড়ের ন্যায় অতিশয় নোংরা আর অকর্মণ্য হইয়া পড়িবে, তখন ভগবান তাহাকে নষ্ট করিয়া ফেলিবেন— অর্থাৎ তখন প্রলয় হইবে। এইরূপে কতবার যে সৃষ্টি আর প্রলয় হইয়াছে, তাহা কে বলিতে পারে?

 যাঁহারা অমর, প্রলয়ের সময় তাঁহাদেরও মৃত্যু হয়, কিন্তু মার্কণ্ডেয় নামক মুনির মৃত্যু হয় না। পাণ্ডবদিগের বনবাসের সময় এই আশ্চর্য মুনির সহিত তাঁহাদের দেখা হইয়াছিল। তখন তিনি যুধিষ্ঠিবকে বলিয়াছিলেন যে তিনি প্রলয় দেখিয়াছেন এবং আবার যখন প্রলয় হইবে, তখনো তিনি বাঁচিয়া থাকিনে। মার্কণ্ডেয় মুনির বয়স যে কত হাজার হাজার বৎসর, তাহা কেহই বলিতে পারে না। কিন্তু তাঁহাকে দেখিলে কাহারো মনে হইবে না যে, তাঁহার এমন ভয়ানক বেশি বয়স হইয়াছে। দেখিলে মনে হয় যে, তাঁহারা পঁচিশ ছাব্বিশ বৎসর মাত্র বয়ঃক্রম হইতে পারে।

 প্রলয়ের সময় মার্কেণ্ডেয় মুনিকে বড়ই কষ্টে পড়িতে হইয়াছিল, আর তিনি অনেক আশ্চর্য ঘটনাও দেখিতে পাইয়াছিলেন। প্রলয়ের অনেক বৎসর পূর্ব হইতেই বৃষ্টি বন্ধ হইয়া গেল। গাছ-পালা সব মরিয়া গেল। ছোট ছোট জন্তুরা সকলেই অনাহারে প্রাণত্যাগ করিল।

 তারপর এক কালে সাতটি সূর্য আকাশে উঠিয়া, ভীষণ তেজের দ্বারা নদ, নদী, সমুদ্র, সকলই শুকাইয়া ফেলিল;ঘাস, পাতা, কাঠ, যাহা কিছু পৃথিবীতে ছিল, পোড়াইয়া ছাই করিল।

 তারপর সম্বর্তক নামক ভয়ঙ্কর আগুন জ্বালিয়া উঠিল, আর তাহার সঙ্গে সঙ্গে ঝড় বহিয়া তুমুল কাণ্ড উপস্থিত করিল। সে আগুন পাতাল পর্যন্ত ধরিয়া বসিলে, আর দেব, দানব, যক্ষ, রাক্ষস, জীবজন্তুর সহিত সকল সৃষ্টি সেই আগুনে পুড়িয়া নষ্ট হইল।

 তারপর আসিল মেঘ। লাল মেঘ, নীল মেঘ, কালো মেঘ, হাতির মত মেঘ, পর্বতের মত মেঘ। তখন বিদ্যুতের ঝিকিমিকি আর বজ্রপাতের ঘোরতর শব্দে আকাশ পাতাল তোলপাড় করিয়া মুষলধারে বৃষ্টি আরম্ভ হইল। সেই বৃষ্টি দেখিতে দেখিতে সেই ভীষণ আগুন নিভাইয়া, পাহাড় পর্বত তল করিয়া দিল। বার বৎসরের মধ্যে আর সেই সাংঘাতিক বৃষ্টির বিরাম হইল না। তারপর যখন ঝড়-বৃষ্টি থামিল, তখন দেখা গেল যে, বিশ্বব্রহ্মাণ্ড জলে ডুবিয়া গিয়াছে, জল ভিন্ন জগতে আর কিছুই নাই।

 এত কাণ্ডের ভিতরে মার্কণ্ডেয় মুনি কি করিয়া বাঁচিয়া রহিলেন, তাহা জানি না, কিন্তু তিনি মরেন নাই। যাহা হউক, ক্ষুধায় ভুগিয়া, আগুনে পুড়িয়া, আর জলে ভাসিয়া, তাঁহার নিতান্তই ক্লেশ আর অসুবিধা হইয়াছিল, তাহাতে সন্দেহ কি? সৌভাগ্যের বিষয় এই যে, এই বিপদের সময় তিনি একটা অতি বিশাল বটগাছ দেখিতে পাইলেন। সেই বটগাছের নিকট গিয়া তিনি দেখিলেন যে, তাহার ডালের উপর একখানি খাট, তাহাতে চমৎকার বিছানা, আর সেই বিছানার উপরে পূর্ণচন্দ্রের ন্যায় উজ্জ্বল পরম সুন্দর একটি নীলবর্ণ বালক বসিয়া আছেন।

 এত আশ্চর্য ঘটনার ভিতর দিয়া আসিবার পরেও এই ঘটনাটি মার্কণ্ডেয়ের নিকট বড়ই আশ্চর্য বোধ হইল, এত কাণ্ড হইয়া গেল, চরাচর লণ্ডভণ্ড হইল, তথাপি এই বালক কি করিয়া রক্ষা পাইল? মার্কণ্ডেয় ত্রিকালজ্ঞ (অর্থাৎ গত কাল, উপস্থিত কাল আর যে কাল আসছে, এই তিন সময়ের কথাই যে জানে) হইয়াও এই প্রশ্নের উত্তর ভাবিয়া স্থির করিতে পারিলেন না।

 সেই বালক কিন্তু মার্কণ্ডেয়কে দেখিয়া কিছুমাত্র চিন্তিত হইলেন না। তিনি তাঁহাকে দেখিবামাত্রই বলিলেন—

 “মার্কণ্ডেয়, তোমার বড়ই পরিশ্রম হইযাছে? আইস, আমার পেটের ভিতরে আসিয়া বিশ্রাম কর!”

 এই বলিয়া বালক হাঁ করিলেন, আর মার্কণ্ডেয় তাঁহার পেটের ভিতর ঢুকিয়া গেলেন!

 কিন্তু কি আশ্চর্য! বালকের পেটের মধ্যে গিয়া, মার্কণ্ডেয় কোথায় হজম হইয়া যাইবার জন্য প্রস্তুত হইবেন, না, তাহার বদলে তিনি দেখেন যে, তিনি পরম সুখে এই পৃথিবীতেই ঘুরিয়া বেড়াইতেছেন! সেই হিমালয়, সেই গঙ্গা, সেই-সকল গ্রাম, নগর আর তীর্থস্থান, সেই লোকজন, সেই হাট-বাজার, সেই সংসার যাত্রার সকল আয়োজন ও আনন্দ।

 হাজার হাজার বৎসর ধরিয়া মার্কণ্ডেয় সেই নিতান্ত অদ্ভুত বালকের পেটের ভিতরে বাস করিলেন, কিন্তু তাহার শেষ কোথাও খুঁজিয়া পাইলেন না। এত ঘটনার পরে, তাঁহার মনে হইল, ‘হয়ত বা এই বালক একটা কেহ হইবে।’ তখন তিনি তাঁহার স্তব করিতে আরম্ভ করিবামাত্র দেখেন যে, তিনি হঠাৎ বালকের পেটের ভিতর হইতে বাহিরে চলিয়া আসিয়াছেন, আর বালকটি যেমন ছিলেন, তেমনিই সেই বটগাছের ডালে খাটের উপরে বসিয়া আছেন। মার্কণ্ডেয়কে বাহিরে আসিতে দেখিয়া তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন—“মার্কণ্ডেয়, বিশ্রাম ভালরূপ হইল ত?”

 তারপর মার্কণ্ডেয় জানিতে পারিলেন যে, এই বালক আর কেহ নহেন, স্বয়ং নারায়ণ।

নারায়ণ মার্কণ্ডেয়কে বলিলেন, “ব্রহ্মা এখন ঘুমাইতেছেন। তাঁহার ঘুম ভাঙিলে আবার নূতন সৃষ্টি করা যাইবে, ততক্ষণ তুমি এইখানে বিশ্রাম কর।”

 এই বলিয়া নারায়ণ অন্তর্হিত হইলেন (আকাশে মিলাইয়া গেলেন)। তারপর আবার নূতন সৃষ্টি ও প্রলয়ের কথা মহাভারতে এইরূপ লেখা আছে।