উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/মহাভারতের কথা/রুরু ও প্রমদ্বরার কথা

রুরু ও প্রমদ্বরার কথা

 পূর্বকালে স্থূলকেশ নামে একজন পরম ধার্মিক তপস্বী ছিলেন। একদিন তিনি ফল আনিতে বনে গিয়াছিলেন, ফিরিয়া আসিয়া দেখিলেন যে, একটি নিতান্ত ছোট খুকিকে কে তাঁহার আশ্রমে ফেলিয়া গিয়াছে। এমন নিষ্ঠুর নীচ কাজ যাহারা করিতে পারে, সে-সকল হতভাগ্য লোকেদের সংবাদ লইয়া আমাদের কোন প্রয়োজন নাই। এমন সুন্দর শিশুর প্রতিও যাহার দয়া হয় নাই, না জানি তাহার প্রাণ কতই কঠিন!

 মুনি সেই কন্যাটিকে কোলে করিয়া ঘরে আনিলেন, এবং মায়ের মতন যত্নের সহিত তাহাকে পালন করিতে লাগিলেন। খুকিটি ক্রমে বড় হইতে লাগিল, আর দেখিতে দেখিতে তাহার আধ আধ মিষ্ট কথায় আর কোমল ব্যবহারে সকলের মন কাড়িয়া লইল। তাহার সেই সুন্দর মুখখানি দেখিলে, কেহই তাহার সহিত দুটি কথা না কহিয়া থাকিতে পারিত না, আর একটিবার তাহার সেই সুন্দর মুখের মধুমাখা কথা শুনিলে, তাহাকে ছাড়িয়া যাইতে চাহিত না। বাস্তবিক এমন সুন্দর মেয়ে কেহই কখনো দেখে নাই; এমন মিষ্ট কথাও শুনে নাই, এমন সুন্দর ব্যবহারও কেহ আর কোন বালক বা বালিকার নিকট কখনো পায় নাই। তাই মহর্ষি স্থূলকেশ মেয়েটির নাম রাখিলেন প্রমদ্বরা, অর্থাৎ সকল মেয়ের সেরা।

 মেয়েটি যখন বড় হইল, তখন একদিন মহর্ষি চ্যবনের নাতি মহাত্মা প্রমতির পুত্র রুরু সেই আশ্রমে বেড়াইতে আসিলেন। সেখানে প্রমদ্বরাকে দেখিয়াই তাঁহার মন কেমন হইয়া গেল, সেই অবধি আর তাঁহার কিছুই ভালো লাগে না। তিনি কেবলই প্রমদ্বরার কথা ভাবেন, আব যে কাজ করিতে হইবে তাহারই কথা ভুলিয়া যান।

 রুরুর বন্ধুরা প্রমতির নিকট গিয়া বিনয় করিয়া কহিল, “ভগবন্, আপনার পুত্র, স্থূলকেশের আশ্রমে প্রমদ্বরা নাম্নী একটি কন্যাকে দেখিয়া, তাহাকে বড়ই ভালোবাসিয়াছে। এখন সে খাওয়া দাওয়া ছাড়িয়া দিয়া সকল সময়ই সেই কন্যার কথা ভাবে। অতএব আপনি যাহা ভালো মনে করেন, করুন।”

 এ কথা শুনিবামাত্রই প্রমতি স্থূলকেশের নিকট গিয়া বলিলেন, “হে মহর্ষি, আমি আমার পুত্র রুরুর জন্য, আপনার প্রমদ্বরাকে চাহিতে আসিয়াছি। আপনার মত হইলে, এই দুইজনের বিবাহ হইতে পারে।”

 ইহার উওরে স্থূলকেশ অতিশয় আনন্দের সহিত বলিলেন, “আহা! মহর্ষি, আপনি কি সুন্দর প্রস্তাবই করিয়াছেন। আপনার পুত্রটি দেখিতে যেমন সুশ্রী তেমনি বিদ্যায়, বুদ্ধিতে, বিনয়ে, তপস্যায়, সকলেরই বিশেষ স্নেহের পাত্র হইয়াছে। আমিও মনে করিতেছিলাম যে, ইহার সহিত আমার প্রমদ্বরার বিবাহ হইলে যৎপরোনাস্তি (যার পর নাই) সুখের বিষয় হয়।”

 তারপর দুই মুনিতে মিলিয়া হিসাব করিয়া দেখিলেন যে, আর কয়েক সপ্তাহ পরেই, ফান্ধুনী নক্ষত্রে বিবাহের অতি উত্তম দিন রহিয়াছে। সুতরাং সেই দিনেই বিবাহ স্থির করিয়া, সকলে তাহার আয়োজন করিতে লাগিলেন।

 কিন্তু হায়! মানুষেরা কত সময় কত আশা করিয়া আনন্দের আয়োজন করে, আর কোথা হইতে বিপদ আসিয়া তাহাদিগকে দুঃখের সাগরে ভাসাইয়া দেয়। একদিন প্রমদ্বরা তাঁহার সঙ্গিনীগণের সহিত মিলিয়া আশ্রমের নিকটে আমোদ প্রমোদ করিতেছিলেন; তিনি জানিতেন না যে, সেইখানেই ঘাসের ভিতরে দারুণ কেউটে সাপ ঘুমাইয়া রহিয়াছে। খেলিতে খেলিতে, সেই কেউটে সাপের উপর প্রমদ্বরার পা পড়িল, আর অমনি দুষ্ট সাপ রাগে অস্থির হইয়া তাঁহাকে কামড়াইয়া দিল।

 এমন দুঃখের কথা আমাদের বলিতে এবং শুনিতেই কত কষ্ট হইতেছে, যাহারা সে ঘটনায় উপস্থিত ছিল, তাহাদের হয়ত কষ্টের আর সীমাই ছিল না। এইমাত্র প্রমদ্বরা কত হাসিতেছিলেন, মুহূর্তের মধ্যে সে হাসির আলো নিভিয়া গেল। সোনার শরীর ছাইয়ের মত হইয়া মাটিতে লুটাইয়া পড়িল।

 সঙ্গিনীরা তখন ভয়ে অস্থির হইয়া চিৎকার করিতে লাগিল। সেই চিৎকারে আশ্রমের সকলে ছুটিয়া আসিয়া দেখিলেন, সর্বনাশ হইয়া গিয়াছে। এত আনন্দের ভিতরে হঠাৎ এমন বিপদ উপস্থিত হওয়াতে, ক্ষণকালের জন্য মুনিরাও হতবুদ্ধি হইয়া গেলেন। তাঁহারা সকলে প্রমদ্বরার মৃত দেহের চারিধারে বসিয়া কাঁদিতে লাগিলেন, কাহারো মুখে কথা সরিল না। তখনো দেখিলে মনে হইতেছিল, যেন প্রমদ্বরার মৃত্যু হয় নাই, তিনি ঘুমাইতেছেন। মুখখানি কালো হইয়াও যেন পূর্বের চাইতে মিষ্ট দেখা যাইতেছিল।

 রুরু সেখানে ছিলেন, আর মেয়েদের চিৎকার শুনিয়া সকলের সঙ্গে ছুটিয়াও আসিয়াছিলেন, সেখানে আসিয়া সকলে কাঁদিতে বসিল, আর তিনি পাগলের মত হইয়া ঊর্দ্ধশ্বাসে বনের দিকে ছুটিয়া পলাইলেন। তাঁহার মোটামুটি মনে হইল যে, প্রমদ্বরা মরিয়া গিয়াছেন। কিন্তু তাঁহাকে আর ফিরিয়া পাইবেন না, এ কথা কিছুতেই তাহার মন মানিতে চাহিল না।

 রুরু ক্রমে গভীর বনের ভিতরে ঢুকিয়া, মাটিতে গড়াগড়ি দিয়া ভয়ানক কাঁদিতে লাগিলেন। কাঁদিতে কাঁদিতে হঠাৎ তাহার প্রাণ যেন তেজে পরিপূর্ণ হইয়া গেল। তিনি তৎক্ষণাৎ উঠিয়া দাঁড়াইয়া, স্বর্গের দিকে দৃষ্টি পূর্বক উচ্চৈঃস্বরে বললেন—

 “আমি যদি দান করিয়া থাকি, যদি তপস্যা করিয়া থাকি, যদি ভক্তিপূর্বক গুরুজনেব সেবা করিয়া থাকি, তবে আমার প্রমদ্বরা বাঁচিয়া উঠুক। আমি জন্মাবধি যত পূণ্য সঞ্চয় করিয়াছি, তাহার বলে আমার প্রমদ্বরা উঠিয়া দাঁড়াক!”

 রুরুর এই কথা স্বর্গে গিয়া পৌঁছিল। তাহার পবেই তিনি দেখিলেন যে, সেই অন্ধকার বন আলো করিয়া দেবদূত আসিয়া তাঁহার সম্মুখে দাঁড়াইয়াছেন।

 দেবদূত বলিলেন, ‘রুরু, মানুষ একবার মরিলে ত আর সে ফিরিয়া আসিতে পারে না। সুতরাং তুমি যাহা চাহিতেছ, তাহা কি করিয়া হইবে? প্রমদ্বরার আয়ু শেষ হইয়াছিল, তাই তাহার মৃত্যু হইয়াছে। সুতরাং তুমি আর দুঃখ করিও না।’

 দেবদূতের কথা শুনিয়া রুরু বলিলেন, তবে কি আমার প্রমদ্বরাকে পাইবার কোন উপায় নাই?’

 দেবদূত বলিলেন, ‘আছে! তুমি যদি একটি কাজ করিতে পার, তবে প্রমদ্বরাকে আবার বাঁচান সম্ভব হয়।’

 রুরু বলিলেন, ‘বল, সে কি কাজ। আমি এখনই তাহা করিতেছি।’

 দেবদূত বলিলেন, ‘দেবতাগণ বলিয়াছেন যে, তুমি যদি অর্ধেক আয়ু প্রমদ্বরাকে দিতে পার, তবে সে সেই পরিমাণ সময়ের জন্য আবার তোমার নিকট আসিতে পারে।’

 রুরু বলিলেন, “আমি আমার অর্ধেক আয়ু প্রমদ্বরাকে দিলাম। সুতরাং সে আবার বাঁচিয়া উঠুক।”

 এ কথায় দেবদূত যমের নিকট গিয়া বলিলেন, ‘হে যম, রুরু প্রমদ্বরাকে তাঁহার অর্ধেক

আয়ু দান কবিয়াছেন। অতএব, আপনি অনুমতি করুন, প্রমদ্ববা আবার জীবন লাভ করুন।

 যম বলিলেন, ‘আচ্ছা, তবে তাহাই হউক।’

 যমের মুখ দিযা এ কথা বাহির হইবামাত্র, প্রমদ্ববা চোখ রগড়াইতে রগড়াইতে উঠিয়া বসিলেন। তখন সকলে তাঁহাব চারিধারে বসিযা কাঁদিতেছিল। তাহাবা তাঁহাকে উঠিতে দেখিয়া নিতান্তই আশ্চর্য এবং আনন্দিত হইযাছিল, তাহাতে সন্দেহ নাই। সে আনন্দ সামলাইয়া উঠিতে তাহাদেব অনেক সময় লাগিযাছিল। কেননা, বিবাহেব দিনও ইহাব পবে দেখিতে দেখিতে আসিযা উপস্থিত হইল। রাজা-রাজড়ার বিবাহে অবশ্য খুব জমকালো রকমের ধুমধাম হয়। মুনিঋষিদেব বিবাহে অত ঘটা না হইবার কথা। কিন্তু রুরু আর প্রমদ্ববার বিবাহে সকলের মনে যেমন আনন্দ হইযাছিল আমি সাহস করিয়া বলিতে পাবি, কোন কালে আর কোন বিবাহে তাহার চেয়ে বেশি হয় নাই।

 এইরূপ আনন্দের ভিতরে এই ব্যাপারের শেষ হইল। রুরুর মনে ইহাতে খুবই সুখ হইযাছিল এ কথা আমরা কল্পনা করিয়া লইতে পাবি। কিন্তু দুষ্ট সাপ তাঁহার প্রমদ্ববাকে কামড়াইয়া ক্ষণকালেব জন্য তাঁহাকে যে কষ্ট দিছিল তাহার কথা তিনি কিছুতেই ভুলিতে পারিলেন না। এই ঘটনাতে সর্পজাতি উপর তাঁহার এমনই বিষম রাগ হইয়া গেল যে, তিনি আর ঘরে থাকিতে না পারিয়া বিশাল ডাণ্ডা হতে সাপের বংশ ধ্বংস কবিতে বাহির হইলেন। সে সময়ে কোন হতভাগ্য সাপ তাঁহার সম্মুখে পড়িল, আর কি তাহার রক্ষা ছিল? সে ফোঁস করিবার আগেই সেই ভীষণ ডাণ্ডা ধাঁই শব্দে তাহার মাথায় পড়িয়া তাহার সর্পলীলা সাঙ্গ করিয়া দিত।

 এইরূপে রুরু বন, জঙ্গল পাহাড় পর্বত খুজিযা কত সাপ যে সংহার করিলেন, তাহার লেখাজোখা নাই। একদিন তিনি সাপ খুঁজিতে খুঁজিতে গভীব বনের ভিতরে প্রবেশ করিয়া ‘ডুণ্ডুভ' নামক একটা সাপ দেখিতে পাইলেন। সাপটি নিতান্তই বুড়ো এবং অস্থিচর্মমসার হইযাছে, ভালো কবি নড়িতে চড়িতে পাবে না। সেই বুড়া ডুণ্ডুভ সাপকে দেখিবামাত্র, ও ক্রোধ ভরে তাঁহার সেই বিশাল ডাণ্ডা উঠাইয়া তাঁহাকে মারিতে গেলেন।

 তাহা দেখিয়া সেই সাপ কহিল, ‘মুনি ঠাকুব, আমি ও তোমার কোন অনিষ্ট করি নাই, তবে কেন বিনা অপবাধে আমার প্রাণ বধ করিতে আসিতেছ?’

 রুরু বলিলেন, ‘তাহা বলিলে কি হইবে? আমার প্রমদ্ববাকে সাপে কামড়াইযাছিল। সুতরাং দেখিতেছ ডাণ্ডা। আজ আর আমার হাতে তোমার রক্ষা নাই।’

 সাপ কহিল, ‘ঠাকুর, আমরা ডুণ্ডুভ সাপ, কোনদিন কাহাবো হিংসা করি না। যাহারা কামড়ায় তাহারা অন্য সাপ। আমবা তাহাদের মত নহি, অথচ তাহাদের দোষেব জন্য অকারণ সাজা পাই। তুমি ধার্মিক লোক, আমাদের দুর্দশা দেখি কি তোমার দয়া হয় না?’

 বাস্তবিকই সেই সাপটির কথা শুনিয়া রুরুর দয়া হইল। সুতং তিনি আর তাহাকে বধ করিয়া মিষ্টভাবে জিজ্ঞাসা কবিলেন, ‘তুমি কে? কি করিয়া তোমার এমন দুর্দশা হইল?’

 সাপ কহিল, ‘পূর্বজন্মে আমি সহস্রপাদ নামে মুনি ছিলাম, ব্রাহ্মণের শাপে সর্প হইয়াছি।’

 রুক বলিলেন, ‘তোমার কথা আমার বড়ই আশ্চর্য বোধ হইতেছে। ব্রাহ্মণ কেন তোমাকে শাপ দিলেন, আর সে শাপ দূব হইবার কোন উপায় আছে কি না— এ-সকল কথা শুনিতে পাইলে আমি অতিশয় সুখী হইব।’

 সর্প কহিল, ‘ছেলেবেলায় ‘খগম’ নামে আমার একটি বন্ধু ছিলেন। তিনি সর্বদাই তপস্যা করিতেন, আর কখনো মিথ্যা কথা কহিতেন না। একদিন আমি, তামাশা দেখিবার জন্য একটা খড়ের সাপ লইয়া তাঁহাকে ভয় দেখাইতে গেলাম, আমি জানিতাম না যে, সেই খড়ের সাপের ভয়ে তিনি অজ্ঞান হইয়া যাইবেন। জ্ঞান হইলে পর তিনি রাগে অস্থির হইয়া আমাকে এই শাপ দিলেন যে, তুমি যে খড়ের সাপ দিয়া আমাকে ভয় দেখাইলে সেই খড়ের সাপের মত অকর্মণ্য সাপ তুমি হইবে। খগমের তপস্যার তেজ আমি জানিতাম, তাই তাঁহার কথা শুনিয়া আমি জোড়হাতে বলিলাম, ‘ভাই, আমি তামাশা করিতে গিয়া একটা অপরাধ করিয়া ফেলিয়াছি। আমাকে তুমি ক্ষমা কর আর কঠিন শাপ হইতে আমাকে বাঁচাইয়া দাও।’

 ইহাতে খগমের চোখে জল আসিল, তিনি কাঁদিতে কাঁদিতে বলিলেন, ‘ভাই, নিষ্ঠুর কথা মুখে আনিয়া ফেলিয়াছি, এখন ত আর উপায় দেখি না। এখন আমি যাহা বলিতেছি, মন দিয়া শুন, আর কখনো ভুলিও না। মতির পুত্র রুরুর সহিত দেখা হইলে তোমার শাপ দূর হইবে।

 কি আশ্চর্য! সাপ তাহার কথা ভালো করিয়া শেষ করিতে না করিতেই তাহার চেহারা একটু একটু করিয়া মানুষের মত হইতে লাগিল। তখন সে বলিল, বুঝিয়াছি, আপনি সেই প্রমতির পুত্র রুক। তাই আপনার দর্শন পাইয়া আজ আমার শাপ দূর হইল।’ বলিতে বলিতে সহস্রপাদ তাহার নিজের সুন্দর মূর্তিতে উঠিয়া দাঁড়াইলেন। তারপর তিনি স্নেহের সহিত রুরুকে অনেক সুন্দর উপদেশ দিয়া সেখান হইতে প্রস্থান করিলেন।