উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/মহাভারতের কথা/চ্যবন ও সুকন্যার কথা

চ্যবন ও সুকন্যার কথা

 ভৃগুর পুত্র মহর্ষি চ্যবনের তপস্যার কথা অতি আশ্চর্য। তিনি বনের ভিতরে একটি সরোবরের ধারে এক আসনে বসিয়া কত কাল যে তপস্যা করিতেছিলেন, তাহ কেহই বলিতে পারিত না। তাঁহার শরীর ধুলায় ঢাকিয়া গেল, সেই ধূলার উপর গাছপালা হইল, সেই গাছে পিঁপড়ের বাসা হইল;তথাপি তাঁহার তপস্যার শেষ হইল না। শেষে এমন হইল যে তাঁহাকে দেখিলে মনে হইত ঠিক যেন একটি উইয়ের ঢিপি। লোকে সেই উইঢিপিকে অত্যন্ত ভক্তি করিত। তাহদের পিতামহের পিতামহেরা উঁহাদের পূর্বপুরুষগণের নিকট শুনিয়াছিলেন যে, সেই উইঢিপির ভিতরে মহামুনি চ্যবন তপস্যা করিতেছেন।

 এইরূপে অনেক কাল গেল। তারপর একদিন মহারাজ শর্যাতি, অনেক লোকজন সঙ্গে লইয়া সপরিবারে সেই সরোবরের ধারে বনভোজন করিতে আসিলেন। ছোট ছোট মেয়েদের অনেকেই আর কখনো বনের শোভা দেখে নাই। তাই এরকম জায়গায় এত গাছ আর ফুল দেখিয়া তাহদের অতিশয় আনন্দ হইল। “এটা কিসের গাছ?” “ওটা কি ফুল?” “এ ফল কি খায়?” “ও গাছে কি হয়?” ক্রমাগত এই-সব কথা জিজ্ঞাসা করিয়া তাহারা সঙ্গের লোকদিগকে এমনি ব্যস্ত করিয়া তুলিল যে, ব্যস্ত যাহাকে বলে।

 রাজার একটি কন্যা ছিলেন, তাঁহার নাম সুকন্যা। মেয়েটি বড়ই বুদ্ধিমতী, আর তাহার মনটি অতিশয় সরল। আর দেখিতে তিনি এমনই সুন্দর যে, তেমন আর দেখা যায় না। বাপ মায়ের একমাত্র সন্তান, কাজেই বড় আদরের মেয়ে, আর সেইজন্যই তাঁর স্বভাবটি একটু একগুঁয়ে —একটু ঝোঁকের মাথায় কাজ করেন। কিন্তু তাঁর মনটি বড় ভালো।

 রাজকন্যা সখীদিগকে লইয়া বনের শোভা দেখিতে দেখিতে সেই উইয়ের টিপির নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলেন। মুনির ধ্যান তখন সবে শেষ হইয়াছে, আর তিনি চক্ষু মেলিয়া চাহিয়াছেন আর চাহিয়াই তিনি দেখিলেন, সম্মুখে এক রাজকন্যা। দেবতার মতন রূপ, আর দেবতার মতন পবিত্র মনের জ্যোতি তাঁহার মুখে ফুটিয়া উঠিয়াছে।

 রাজকন্যাকে দেখিবামাত্রই মুনির মন স্নেহে গলিয়া গেল। তাঁহার বড়ই ইচ্ছা হইল, কন্যার পরিচয় গ্রহণ করেন; আর দুটি মিষ্ট কথা তাঁহকে বলেন। কিন্তু বহুকালের অনাহারে তাহার কণ্ঠ একেবারেই শুকাইয়া গিয়াছিল— তাহাতে কথা সরিল না।

 উইয়ের ঢিপি দেখিয়া রাজকন্যার আশ্চর্যের সীমা রহিল না। এমন অদ্ভুত পদার্থ তিনি আর কখনো দেখেন নাই, সুতরাং তাঁহার মনে হইল, ‘এ জিনিসটাকে একটু ভালো করিয়া ঘাঁটিয়া দেখিতে হইবে।’ এই ভাবিয়া সেই উইঢিপির খুব কাছে গিয়া, সুকন্যা দেখিলেন যে, তাহাতে দুটি ছোট ছোট কি জিনিস ঝক ঝক করিতেছে।

 ইহার একটু আগে, বনের ভিতরে একটি গাছে খুব লম্বা লম্বা কাঁটা দেখিতে পাইয়া রাজকন্যা, তামাশা দেখিবার জন্য, তাহার একটা সঙ্গে লইয়াছিলেন। উইঢিপিতে দুটো চকচকে জিনিস দেখিয়া তিনি, “বাঃ! এগুলো আবার কিরে?” বলিয়া সেই কাঁটা দিয়া তাহাতে খোঁচা মারিলেন।

 সেই চকচকে জিনিস দুটি আর কিছুই নয়। উহা চ্যবনের চোখ। সমস্ত শরীর মাটি চাপা পড়িয়া কেবল উঁহার ঐ চোখ দুইটি জাগিয়া ছিল। দেখিতে উহা দুটি চকচকে পাথরের মতনই দেখা যাইতেছিল, সুকন্যা স্বপ্নেও ভাবিতে পারেন নাই যে, উহা আবার কোনো মানুষের চোখ হইতে পারে।

 যাহা হউক, মুনির বড়ই লাগিল, তাহাতে আর ভুল নাই। তিনি যে লাফাইয়া উঠেন নাই, তাহা কেবল মাটির চাপনে। চ্যাঁচান নাই যে, সে কেবল গলা শুকাইয়া যাওয়াতে। আর, সুকন্যাকে যে শাপ দেন নাই কেন, তাহা আমি ঠিক করিয়া বলিতে পারিতেছি না।

 কিন্তু তাঁহার বড়ই রাগ হইয়াছিল। তাই তিনি রাজার সৈন্যদিগের এমনি অদ্ভুত রকমের এক অসুখ উপস্থিত করিয়া দিলেন যে, বলিতে গেলে তাহা তেমন সাংঘাতিক অসুখ কিছু নয়, অথচ তাহারা ভয়ে আর অসুবিধায় পাগলের মত হইয়া উঠিল।

 হঠাৎ এমন আশ্চর্য ব্যাপার উপস্থিত দেখিয়া রাজা ত নিতান্তই চিন্তিত হইলেন। কিন্তু তিনি ইহার কারণ কিছুই ভাবিয়া ঠিক করিতে পারিলেন না। শেষে তিনি সৈন্যদিগকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমরা ত সেই উইঢিপির ভিতরের মুনিঠাকুরকে কোনরকমে অমান্য কর নাই।” সৈন্যগণ জোড়হাতে বলিল, “মহারাজ, আমরা তাঁহার অমান্য করিব দূরে থাকুক, আমরা কেহ ঐদিক্ দিয়া যাই-ই নাই। আপনি নাহয় তাঁহার নিকট গিয়া বিনয়ের সহিত ইহার কারণ জিজ্ঞাসা করুন।”

 রাজা আর সৈন্যদিগের কথাবার্তা শুনিয়া সুকন্যা বুঝিতে পারিলেন যে, ঐ ঢিপির ভিতরে একজন তপস্বী আছেন, তখন তাঁহার মনে হইল যে, সেই চকচকে জিনিস দুটাতে খোঁচা মারাতেই বা কোনরূপ দোষ ঘটিল। সুতরাং তিনি তখনই রাজার নিকট গিয়া একটু দুঃখিত ভাবে বলিলেন, “বাবা আজ বেড়াইবার সময় আমি ঐ ঢিপিটাতে দুটা চকচকে জিনিস দেখিতে পাইয়া তাহাতে কাঁটা দিয়া খোঁচা মারিয়াছিলাম।”

 ইহার পর আর রাজার বুঝিতে বাকি রহিল না যে, কিসে সর্বনাশ হইয়াছে। তিনি তৎক্ষণাৎ যার পর নাই ব্যস্ত হইয়া সেই ঢিপির নিকট ছুটিয়া চলিলেন, আর জোড়হাতে চ্যবনকে বলিলেন, “ভগবন্‌, আমার কন্যা না জানিয়া আপনাকে কষ্ট দিয়াছে তাহাকে ক্ষমা করুন।”

 চ্যবন বলিলেন, “মহারাজ, তোমার মেয়ে আমার চোখে যে খোঁচা মারিয়াছে, তাহার পর আর কিছুতেই উহাকে ক্ষমা করা যাইতেছে না। তোমার সেই সুন্দরী পাগলী মেয়েটিকে আমি বিবাহ করিব, তবে ছাড়িব।”

 কি সর্বনাশ! হাজার বৎসরের বুড়া মুনি, তাহাকে আবার উইয়ে খাইয়া হাড় ক’খানি মাত্র বাকি রাখিয়াছে। সে কিনা বলে, “তোমার মেয়েকে বিবাহ করিব।” রাজা ত বড়ই সঙ্কটে পড়িলেন—এখন উপায় কি?

 উপায় আর কি হইবে? মেয়ে বিবাহ না দিলে মুনি কিছুতেই রাজার সৈন্যদিগকে ছাড়িতেছেন না। এতক্ষণে তাহারা অসুখের জ্বালায় আধপাগলা গোছের হইয়া উঠিয়াছে আর খানিক বাদে কি করিবে তাহার ঠিক নাই। কাজেই, রাজার বুক ফাটুক আর যাহাই হউক, মুনির কথায় তাঁহাকে রাজি হইতেই হইল।

 হায়! এমন আদরের ধন, তাহার কপালে কিনা এই ছিল! মা বাপের দুঃখ হইবে সে আর কতবড় কথা—রাজ্য সুদ্ধ লোক ইহাতে কাঁদিয়া অস্থির হইল।

 কিন্তু যাঁহার জন্য এত দুঃখ, আশ্চর্যের বিষয় এই যে, তাঁহাকে ইহাতে কিছুমাত্র দুঃখিত মনে হইল না। সুকন্যার মনের ভাব ছিল অন্যরূপ। তিনি মনে মনে ভাবিয়াছিলেন, ‘এত কষ্ট পাওয়ার পরেও যে মহাপুরুষ আমার সমস্ত দোষ ক্ষমা করিয়া আমাকে এমন স্নেহ দেখাইতে পারেন, তাঁহার সেবা করিয়া তাঁহাকে সুখী করাই হইতেছে আমার কাজ।’ সুতরাং তিনি এই ঘটনার দুঃখিত না হইয়া বরং আনন্দিতই হইলেন।

 এদিকে পণ্ডিতেরা পঞ্জিকা দেখিয়া বিবাহের শুভদিন স্থির করিয়াছেন; বিবাহের আয়োজনের ঘটা পড়িয়া গিয়াছে। তারপর শুভকার্য শেষ হইতেও আর অধিক বিলম্ব হইল না। বিবাহে ধুমধাম যে নিতান্ত কম হইয়াছিল তাহা নহে, কিন্তু আনন্দ আর কোথা হইতে হইবে? বিবাহের পর সুকন্যার কথা ভাবিয়াই সকলে দুঃখ করিতে লাগিল, কিন্তু সুকন্যা আনন্দের সহিত তপস্বিনীর বেশে, তাঁহার স্বামীর সহিত বনে চলিয়া গেলেন। সেখানে গিয়া স্বামীর সেবায় এবং ভগবানের চিন্তায় পরম সুখে তাঁহার দিন কাটিতে লাগিল।

 ইহার মধ্যে একদিন সুকন্যা স্নান করিয়া তাঁহাদের কুটীরের নিকট দাঁড়াইয়া আছেন, এমন সময় অশ্বিনীকুমার দুইভাই সেইখান দিয়া যাইতে ছিলেন। বনের ভিতরে এমন অপরূপ সুন্দরী একটি মেয়েকে দেখিয়া অশ্বিনীকুমারদিগের আশ্চর্যের সীমা রহিল না। তাঁহারা সুকন্যার নিকট আসিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “ভদ্রে, তুমি কে? এই বনের ভিতর কিজন্য আসিয়াছ?” সুকন্যা মাথা হেঁট করিয়া লজ্জিতভাবে বলিলেন, “ভগবন্‌, আমি রাজা শর্যাতির কন্যা; মহর্ষি চ্যবনের স্ত্রী।”

 এ কথায় অশ্বিনীকুমারেরা হাসিতে হাসিতে বলিলেন, “না জানি তোমার পিতা কিরকম লোক, যে এই বুড়ার সঙ্গে তোমার বিবাহ দিলেন। তোমার মতন সুন্দরী মেয়ে স্বর্গেও দেখিতে পাওয়া যায় না। তোমাকে হীরা মুক্তায় জড়াইয়া রাখিলে তবে তোমার উপযুক্ত শোভা হয়। এই সামান্য ময়লা কাপড়খানি পরিয়া থাকা কি তোমার সাজে? আহা! তুমি এমন গরীবের হাতে পড়িয়াছ যে, তোমাকে ভাল করিয়া খাইতে পরিতে দিতে পারে না। এমন হতভাগ্য লোকের নিকট থাকিয়া কেন কষ্ট পাইতেছ? আমাদের একজনকে বিবাহ কর, স্বর্গে গিয়া পরম সুখে থাকিবে।”

 ইহাতে সুকন্যা আশ্চর্য এবং বিরক্ত হইয়া বলিলেন, “মহাশয়, আমি আমার স্বামীকে অত্যন্ত ভালবাসি, এবং ভক্তি করি, আমার সাক্ষাতে এমন কথা মুখে আনিবেন না।”

 কিন্তু ইহাতেও অশ্বিনীকুমারদিগের ভদ্রতা শিক্ষা হইল না। তাঁহারা ফাঁকি দিয়া সুকন্যাকে ঠকাইবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন। অশ্বিনীকুমারেরা স্বর্গের চিকিৎসক ছিলেন, কাজেই চিকিৎসায় তাঁহাদের ক্ষমতা অতি আশ্চর্য ছিল। তাঁহারা খানিক চিন্তা করিয়া সুকন্যাকে বলিলেন, “আচ্ছা আমরা যদি তোমার স্বামীকে যুবা এবং সুশ্রী করিয়া দেই, তবে কেমন হয়? একবার তোমার স্বামীকে জিজ্ঞাসা করিয়া দেখ ত, তিনি কি বলেন।”

 এ কথা সুকন্যা চ্যবনের নিকট বলিলে, তিনি বলিলেন, “বেশ কথা! আমি তাহাতে প্রস্তুত আছি। জিজ্ঞাসা কর, আমাকে কি করিতে হইবে?”

 অশ্বিনীকুমারেরা বলিলেন, “আর কিছুই করিতে হইবে না, কেবল একটিবার এই পুকুরের জলে ডুব দিতে হইবে।

 অশ্বিনীকুমারের কথায় চ্যবন পুকুরের জলে ডুব দিবামাত্র, সেই দুই দুষ্ট দেবতাও ঝুপ করিয়া সেই জলের ভিতরে ঢুকিয়া গেলেন। তারপর যখন তাঁহারা মুনির সঙ্গে জল হইতে উঠিয়া আসিলেন, তখন দেখা গেল যে, তিনজনেরই অবিকল একরকম চেহারা!

 দুষ্ট দেবতাগণ ভাবিছিলেন যে, চ্যবনের চেহারা ঠিক তাঁহাদের নিজেদের মত করিয়া দিলে, আর সুকন্যা তাঁহাকে চিনিতে পারিবেন না। কিন্তু যর্থার্থ বুদ্ধিমতী ধার্মিক স্ত্রীলোককে ফাঁকি দেওযা এত সহজ নহে। সুকন্যা দেখিলেন যে, চেহারা একরকম হইলেও চোখের ভাবে অনেক প্রভেদ আছে। চ্যবন তাহার দিকে যেমন স্নেহেব সহিত তাকাইতেন, সেই স্নেহের দৃষ্টি চিনিয়া লইতে সুকন্যার মত মেয়ের ভুল হইতে পাবে? তিনি একবার চ্যবনের চোখের দিকে তাকাইয়া অপার আনন্দের সহিত তাঁহার নিকট গিয়া দাঁডাইলেন।

 কিন্তু দুঃখের বিষয় চ্যবন দুর্বাসা ছিলেন না। তাহা হইলে দেবতা মহাশয়েরা তাঁহাদের উচিত সাজা তখনই হাতে হাতে পাইতেন। চ্যবন অতিশয় ভালমানুষ ছিলেন, তাই তিনি ইহার কিছুই না করিয়া, তাঁহাদিগকে বলিলেন, “ভগবন, আমি বুড়া ছিলাম, আপনারা আমাকে যুবা আর সুশ্রী করিলেন। দেবতাগণ সোমবস পান করেন, আপনাদিগকে তাহার ভাগ দেন না। আমি প্রতিজ্ঞা করিতেছি যে, আপনাদিগের জন্য সোমরসের ভাগ লইয়া দিব।”

 ইহাতে অশ্বিনীকুমারেরা অতিশয় সন্তুষ্ট হইয়া সেখান হইতে চলিয়া গেলেন।

 এদিকে চ্যবন আবার যুবা এবং দেখিতে অতি সুন্দর হইযাছেন এই আশ্চর্য সংবাদ দেখিতে দেখিতে মহাবাজ শর্যাতির নিকট গিয়া উপস্থিত হইল। সে সংবাদে তিনি এতই আনন্দিত হইলেন যে, সকলকে লইয়া চ্যবনের আশ্রমে আসিতে আর কিছুমাত্র বিলম্ব করিলেন না। তখন সকলের মনে কি যে আনন্দ হইল, তাহা লিখিয়া আর কত জানাইব? সেখানে কিছু কাল নানারূপ কথাবার্তায় অতিশয় সুখে কাটিলে, চ্যবন শর্যাতিকে বলিলেন, “মহারাজ, আমি আপনার জন্য একটা যজ্ঞ করিব, আপনি তাহার আয়োজন করুন।”

 রাজা আনন্দের সহিত অতি অল্প দিনের ভিতরেই যজ্ঞেব আয়োজন শেষ করিয়া দিলে চ্যবন যজ্ঞ করিতে আরম্ভ করিলেন। সে যজ্ঞ বড়ই চমৎকাব হইয়াছিল। আর তাহাতে যে একটি ঘটনা হইয়াছিল তা নিতান্তই অদ্ভুত।

 যজ্ঞে দেবতারা সকলেই উপস্থিত হইয়াছেন, তাঁহাদের জন্য অনেক কলসী সোমরস প্রস্তুত হইয়াছে। চ্যবন তাঁহাদের সম্মান বুঝিয়া সকলকেই সোমরস বাঁটিয়া দিতেছেন;তাঁহারাও আনন্দের সহিত তাহা পান করিতে আরম্ভ করিয়াছেন। ইহার মধ্যে দুইটি বাটিতে সোমরস ঢালিতে আরম্ভ করিয়া, চ্যবন বলিলেন, ইহা অশ্বিনীকুমারদিগকে দিতে হইবে।”

 এ কথায় ইন্দ্র হাত তুলিয়া উচ্চৈঃস্বরে বলিলেন, “তাহা হইতে পারে না। অশ্বিনীকুমারেরা নিতান্তই সামান্য দেবতা, চিকিৎসা করিয়া খায়। উহাদিগকে কখনই সোমরস[] দেওয়া যাইতে পারে না।”

 চ্যবন বলিলেন, “অশ্বিনীকুমারেরা আমাকে দেবতার ন্যায় সুখী এবং সুস্থ করিয়াছেন, তাঁহারা সোমরস পাইবেন না, আর কেবল আপনারাই যত সোমরস খাইবেন, ইহা ত ভালো কথা নহে। আপনি যেমন দেবতা, তাঁহাদিগকেও তেমনি দেবতা বলিয়া জানিবেন।”

 তথাপি ইন্দ্র ক্রমাগতই বলিতে লাগিলেন, “সে কি কথা। উহারা চিকিৎসক, হীন জাতি,[]উহারা কি করিয়া সোমরস খাইবে?”

 ইন্দ্রের কথায় কান না দিয়া চ্যবন নিজ হাতে অশ্বিনীকুমারদিগের জন্য সোমরস ঢালিতে লাগিলেন। তাহা দেখিয়া ইন্দ্র বিষম রাগের সহিত বলিলেন, “যদি তুমি উহাদিগকে সোমরস ঢালিয়া দাও, তাহা হইলে এখনই বজ্র দিয়া তোমাকে বধ করিব।”

 এ কথায় চ্যবন একটু হাসিলেন, কিন্তু তিনি সোমরস ঢালিতে ছাড়িলেন না।

 ইহাতে ইন্দ্র রাগে অস্থির হইয়া চ্যবনকে মারিবার জন্য বজ্র উঠাইলে, সকলের প্রাণ ভয়ে কাঁপিয়া উঠিল। কিন্তু চ্যবন ভয়ও পাইলেন না, পলায়নও করিলেন না। তিনি কেবল একটি কি মন্ত্র পড়িতে পড়িতে, যজ্ঞের আগুনে খানিকটা ঘি ফেলিয়া দিলেন। আর অমনি, সংসারে যত ভয়ঙ্কর জিনিস আছে তাহাদের সকলের চেয়ে ভয়ানক, মদ নামক অতি বিকটাকার একটা অসুর সেই আগুন হইতে উঠিয়া আসিল। সে হাঁ করিবামাত্র তাঁহার এক ঠোঁট মাটিতে আর এক ঠোঁট স্বর্গে গিয়া ঠেকিল। তখন দেখা গেল যে, তাহার ছোট ছোট দাঁতগুলিরই এক একটি দশযোজন লম্বা। আর বড় দাঁত চারিটির ত কোনটিই একশত যোজনের কম হইবে না। উহার চোখ দুইটা সূর্যের মত জ্বলিতেছে, আর হাত পা যে কোথায় গিয়া ঠেকিয়াছে, তাহার ঠিকানাই নাই। সে অসুর যখন তাহার হাজার যোজন লম্বা লক্‌লকে জিবখানি বাহির করিল, তখন সকলের মনে হইল, বুঝি সে সৃষ্টি সুদ্ধ চাটিয়া খায়। তারপর যখন সে ইন্দ্রের দিকে আড় চোখে চাহিয়া ঠোঁট চাটিতে চাটিতে ঘোরতর ঘোঁৎ ঘোঁৎ শব্দে তাঁহাকে খাইতে আসিল, তখন তিনি প্রাণপণে চ্যাঁচাইয়া বলিতে লাগিলেন, “ও ঠাকুর মহাশয়, রক্ষা করুন। আরে হাঁ হাঁ। অশ্বিনীকুমারেরা সোমরস খাইবে, খাইবে। রক্ষা করুন।”

 সুতরাং তখন চ্যবন দয়া করিয়া দেবরাজকে অসুরের হাত হইতে রক্ষা করিলেন, আর অশ্বিনীকুমারেরাও, সেই অবধি, সকল যজ্ঞেই সোমরসের ভাগ পাইতে লাগিলেন।

 এইরূপে চ্যবন তাঁহার প্রতিজ্ঞা রাখিয়া সুকন্যার সহিত নিজের আশ্রমে চলিয়া আসিলে, তাঁহাদের সময় অতি সুখেই কাটিতে লাগিল।

  1. সোমলতা নামক একপ্রকার লতার রস খাইতে দেবতারা বড়ই ভালবাসিতেন।}}
  2. দেবতাদিগের ভিতরেও ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্র প্রভৃতি জাতি আছে। অশ্বিনীকুমারেরা শূদ্র জাতীয় দেবতা।