উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/মহাভারতের কথা/দুষ্মন্ত ও শকুন্তলার কথা
দুষ্মন্ত ও শকুন্তলার কথা
এমন মায়ের কথা কি কেহ শুনিয়াছ যে, সে তাহার কচি খুকিটিকে নদীর ধারে ফেলিয়া নিষ্ঠুর ভাবে চলিয়া যায়? মেনকা নামে এক অপ্সরা ঠিক এমনি নিষ্ঠুর ছিল। তাহার একটি খুকি হইল, আর সে তাহকে মালিনী নদীর ধারে ফেলিয়া, পাষাণীর মতন চলিয়া গেল।
আহা! মা হইয়া কি এমন নিষ্ঠুর কাজ করে? খুকিটির মুখখানি এতই সুন্দর ছিল যে, তাহার দিকে একবার চাহিয়া দেখিয়া বনের পাখিরাও তাহাকে ভালো না বাসিয়া থাকিতে পারিল না। তাহারা বনের পাখি, মানুষের ছানাকে কি খাওয়াইতে হয়, তাহা তাহারা জানে না। তাহারা খালি খুকিটির চারি ধারে বসিয়া তাহাকে পাহারা দিতে লাগিল, আর ডানা দিয়া তাহাকে সূর্যের তাপ হইতে বাঁচাইয়া রাখিল।
এমন সময় মহামুনি কন্ব সেই নদীতে স্নান করিতে আসিলেন। ধার্মিক তপস্বীরা পশুপক্ষীকে পর্যন্ত কত দয়া করেন, এমন খুকিটিকে দেখিয়া তাঁহার প্রাণ স্নেহে গলিয়া যাইবে, ইহা আশ্চর্য কি? তিনি তাহাকে বুকে করিয়া পরম যত্নে নিজের আশ্রমে লইয়া আসিলেন। নিজের সন্তান ছিল না, সেই খুকিটিকে তিনি তাঁহার প্রাণের সমস্ত স্নেহ দিয়া, মনে ভাবিলেন, যেন সেই তাঁহার সন্তান।
পাখিরা তাহকে পালন করিয়াছিল, এই জন্য কন্ব সেই কন্যাটির নাম রাখিলেন, শকুন্তলা (শকুন্ত=পক্ষী)। শকুন্তলা যখন কথা কহিতে শিখিল তখন কন্বকে সে ‘বাবা’ বলিয়া ডাকিতে লাগিল। সে জানিত যে, মুনিই তাহার পিতা।
সেই মেয়েটিকে পাইয়া না জানি মুনির প্রাণে কতই আরাম বোধ হইয়া ছিল। তাহার সুন্দর মুখখানির দিকে তাকাইলেই তাঁহার আনন্দ উথলিয়া উঠিত। মেয়েটির এমন বুদ্ধি যে, তাহাকে কিছুই বলিয়া দিতে হইত না। সে তাহার দুটি খুরখুরে পায় ছুটাছুটি করিয়া, আর তাহার ছোট ছোট হাত দুখানি নাড়িয়া মুনির ঘর ঝাঁট দেওয়া হইতে ফুল তুলিয়া আনা অবধি, এত কাজ করিয়া রাখিত যে, তাহা যে দেখিত, সেই আশ্চর্য হইয়া যাইত।
বনের যত হরিণ, আর পাখি, তাহারা ছিল শকুন্তলার খেলার সঙ্গী। তাহারা তাহাকে দেখিলেই ছুটিয়া আসিত। শকুন্তলা তাহাদিগকে খাবার দিয়া তাহাদের গায়ে হাত বুলাইয়া দিত, তাহারাও শকুন্তলার আঁচলে মাথা গুঁজিয়া খেলা করিত।
এইরূপে বনের পশুপক্ষীর সঙ্গে খেলা করিয়া, আর কন্বের নিকট ভগবানের কথা শুনিয়া, শকুন্তলা ক্রমে বড় হইয়া উঠিল। মুনি ঋষি ছাড়া বাহিরে মানুষ তপোবনে প্রায় আসিত না। কাজেই শকুন্তলা তাহাদের কথা বেশি করিয়া জানিতেও পারিল না। তাহার জন্ম এবং শিশুকালের কথা কন্ব অন্যান্য মুনিদিগকে অনেক সময় বলতেন, সুতরাং সে-সকল কথা সে মোটামুটি জানিয়াছিল।
ইহার মধ্যে একদিন সেই বনের ধারে হস্তিনার রাজা দুষ্মন্ত মৃগয়া করিতে আসিলেন, সঙ্গে তাঁহার লোকজনের অন্ত ছিল না। তাহাদের কোলাহল শুনিয়াই বনের জন্তুদের প্রাণ উড়িয়া গেল। শুয়োর হরিণ যত ছিল, রাজা তাহার অনেকগুলিই মারিয়া ফেলিলেন। সবগুলিকে যে মারেন নাই, তাহা কেবল তাঁহার ভয়ানক পিপাসা হইয়াছিল বলিয়া।
পিপাসায় অস্থির হইয়া, রাজা জল খুঁজিতে খুঁজিতে ক্রমে কন্বমুনির আশ্রমের নিকট আসিয়া উপস্থিত হইলেন। অতি সুন্দর আশ্রমটি। গাছের ছায়ায়, ফুলের গন্ধে আর পাখির গানে সেখানে গেলেই প্রাণ শীতল হইয়া যায়। মালিনী নদী তাহার নীচ দিয়াই কুল কুল শব্দে বহিয়া যাইতেছে। এমন সুন্দর নদী, এমন নির্মল জল, আর কোথাও নাই। জলের পাখিরা ঝাঁকে ঝাঁকে নদীতে সাঁতার দিতেছে তাহাদের কলরব যেন সেতারের বাদ্য, এমনি মিষ্ট।
আশ্রমের নিকট আসিয়া আর তাহার শোভা দেখিয়া সকলের মনেই ভক্তির উদয় হইল, সৈন্যেরা তাহাদের ধূলামাখা বিকট চেহারা লইয়া উহার ভিতরে প্রবেশ করিতে সাহস পাইল না। রাজা তাঁহার রাজ বেশ ছাড়িয়া বিনয়ের সহিত সাধারণ লোকের মত, কেবল অমাত্য আর পুরোহিত সঙ্গে লইয়া মুনির সঙ্গে দেখা করিতে চলিলেন।
আশ্রমের ভিতরে মুনিগণ কেহ বা বেদগান করিতেছেন, কেহ বা ধর্মের কথা বলিতেছেন, কেহ বা ভগবানের চিন্তা করিতেছেন। রাজা যত দেখেন, ততই বলেন, ‘আহা! কি সুন্দর, কি সুন্দর!’
আশ্রমের যেখানে কন্ব থাকেন, তাহার নিকট আসিয়া রাজা পুরোহিত আর অমাত্যকে বলিলেন, ‘আপনারা এইখানেই থাকুন, আর ভিতরে গিয়া কাজ নাই।’ তারপর রাজা একাকী ভিতরে প্রবেশ করিয়া উঠানে দাঁড়াইয়া এদিক-ওদিক চাহিয়া দেখিলেন, কিন্তু কন্বকে দেখিতে পাইলেন না, তখন তিনি বলিলেন, ‘কুটীরের ভিতরে কেহ আছ কি? যদি থাক বাহিরে আইস!’
কুটীরের ভিতর আর কে থাকিবে? শকুন্তলাই সেখানে ছিলেন। রাজা হয়ত ভাবিয়াছিলেন মুনির কোন শিষ্য কুটীর হইতে বাহির হইবে, কিন্তু উহার ভিতর হইতে যে এমন সুন্দর দেবতা বাহির হইয়া আসিবেন, এ কথা তিনি মনে করিতে পারেন নাই।
শকুন্তলা বাহিরে আসিয়া দেখিলেন, বাড়িতে অতিথি উপস্থিত। তিনি অতিশয় বুদ্ধিমতী মেয়ে ছিলেন, সুতরাং ইহাও তাঁহার বুঝিতে বাকি রহিল না যে, অতিথি সাধারণ লোক নহেন, নিশ্চয় কোন রাজা। মুনি বাড়িতে নাই, সুতরাং অতিথির আদর শকুন্তলাকেই করিতে হইল।
তাই তিনি রাজাকে বসিবার আসন আর পা ধুইবার জল দিয়া অতিশয় মিষ্ট কথায় জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘মহারাজ, এখানে কিজন্য আসিয়াছেন? আজ্ঞা করুন, আপনার কোন্ কাজ করিতে হইবে।’
রাজা বলিলেন, ‘ভদ্রে, আমি মহর্ষি কন্বের পায়ের ধূলা লইতে আসিয়াছি। তিনি কোথায়?’
শকুন্তলা বলিলেন, ‘তিনি ফল আনিতে গিয়াছেন একটু পরে আসিবেন, আপনি বসুন।’
রাজা শকুন্তলার অপরূপ সৌন্দর্য দেখিয়া যার পর নাই আশ্চর্য হইয়াছিলেন। এখন তাঁহার মিষ্ট কথা শুনিয়া, আর বুদ্ধি আর ভদ্রতা দেখিয়া, তিনি একেবারে মোহিত হইয়া গেলেন। সুতরাং তিনি আর তাঁহার পরিচয় না লইয়া থাকিতে পারিলেন না।
রাজা শকুন্তলাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘তুমি কে? এই বনের ভিতর কি জন্য বাস করিতেছ? আর কি করিয়াই বা এমন সুন্দর হইলে?’
শকুন্তলা বলিলেন, ‘আমি মহর্ষি কন্বকেই আমার পিতা বলিয়া থাকি। কিন্তু শুনিয়াছি আমার পিতার নাম বিশ্বমিত্র, আর মার নাম মেনকা। মহর্ষি কন্ব আমাকে মালিনী নদীর ধারে কুড়াইয়া পাইয়া, কৃপা পূর্বক নিজের কন্যার মতন আমাকে পালন করিয়াছেন। আমার নাম শকুন্তলা।’
শকুন্তলার কথা শুনিয়া রাজা বলিলেন, ‘শকুন্তলা, আমি তোমাকে বড়ই ভালবাসি। আমি তোমাকে সোনালি শাড়ি, গজমতির মালা, আর নানান্ দেশের মহামূল্য মণি-মাণিক্য আনিয়া দিব, আমার রাজ্যে যত ধন আছে, সকলই তোমার হইবে, তুমি আমার রানী হও।’
শকুন্তলা বলিলেন, ‘মহারাজ, আমিও তোমাকে অত্যন্ত ভালবাসি। আমি তোমার রানী হইব।’
এ কথায় রাজা পরম আনন্দের সহিত সুন্দর সুগন্ধি সাদা ফুলের মালা আনিয়া, একগাছি নিজে পরিলেন, আর একগাছি শকুন্তলাকে পরিতে দিলেন। তারপর রাজা নিজের গলার মালা লইয়া রাজার গলায় পরাইয়া দিলেন। এইরূপে গন্ধর্বদিগের মতন করিয়া তাঁহাদের বিবাহ হইয়া গেল।
বিবাহের খানিক পরে রাজা বলিলেন, ‘শকুন্তলা, দুদিন অপেক্ষা কর, আমি দেশে গিয়াই তোমাকে লইবার জন্য চতুরঙ্গ (অর্থাৎ, রথী, পদাতিক, অশ্বারোহী, গজারোহী, এই চারিরকমের) সেনা পাঠাইব।’
এই বলিয়া রাজা চলিয়া গেলেন, আর শকুন্তলা, কবে তাঁহাকে নিতে রাজার লোক আসিবে, এই ভাবিয়া পথ চাহিয়া রহিলেন।
দুষ্মন্ত চলিয়া যাওয়ার একটু পরেই কন্ব ফল লইয়া আশ্রমে ফিরিলেন। মুনি ত্রিকালজ্ঞ (অর্থাৎ ভূত, ভবিষ্যৎ বর্তমান, সকল সময়ের কথাই জানেন), সুতরাং দুষ্মন্তের সহিত শকুন্তলার বিবাহের কথা বনে থাকিয়াই তাঁহার জানিতে বাকি ছিল না। দুষ্মন্তের মত ধার্মিক এবং গুণবান রাজা এই পৃথিবীর মধ্যে আর নাই, মুনির নিতান্ত ইচ্ছা ছিল, ঠিক এমনি একটি লোকের সহিত শকুন্তলার বিবাহ হয়। সুতরাং এই বিবাহে তাঁহার এত আনন্দ হইল যে, ঘরে ফিরিয়া ফলের বোঝাটি মাথা হইতে মাটিতে নামাইবার বিলম্বটুকুও তাঁহার সহ্য হইল না। বোঝা মাথায় করিয়াই, তিনি শকুন্তলাকে ডাকিয়া বলিলেন, ‘ওমা, শকুন্তলা! মা, কি আনন্দের কথাই হইয়াছে? আমি সব জানিয়াছি মা। দুষ্মস্তের মতন এমন মহাশয় লোক তোমার স্বামী হওয়াতে, আমি বড়ই সুখী হইয়াছি। আমি আশীর্বাদ করি যে, তোমার পুত্র যেন সকল বীরের প্রধান, আর এই সসাগরা (অর্থাৎ সাগর সমেত) পৃথিবীর রাজা হয়।’
মুনি যেমন বর দিলেন, শকুন্তলার তেমনি মহাবীর পুত্র হইল। ছয় বৎসর বয়সের সময় সে সিংহ, বাঘ, শুয়োর, মহিষ, আর হাতিকে আশ্রমের নিকটের গাছে বাঁধিয়া চাবুক মারিত! তাহা দেখিয়া আশ্রমের মুনিরা তাহার নাম রাখিলেন, ‘সর্বদমন’ অর্থাৎ সকলকে যে দমন (শাসন) করিতে পারে।
কিন্তু আশ্চর্যের কথা আর কি বলিব? ‘দুদিন পরে তোমাকে লইয়া যাইব’ বলিয়া দুষ্মন্ত গেলেন, তারপর এই ছয় বৎসর চলিয়া গেল, খোকা এত বড় হইল, ইহার মধ্যে তিনি শকুন্তলার কোন সংবাদই লইলেন না।
দুষ্মন্ত যাইবার সময়, যত দূর অবধি তাঁহাকে দেখা গিয়াছিল, শকুন্তলা কুটীরের কোণে দাঁড়াইয়া ততদূর পর্যন্ত তাঁহার পানে চাহিয়া ছিলেন। তাহার পর হইতে প্রতিদিন সকালে সন্ধ্যায়, আর সকল অবসর সময়ে, সেইখানে দাঁড়াইয়া তিনি সেই পথের দিকে চাহিয়া থাকেন। প্রতিদিন তাঁহার মনে হয়, ‘আজ আমাকে নিতে আসিবে’, কিন্তু হায় প্রতিদিনই তিনি, সন্ধ্যাকাল পর্যন্ত সেই পথে কাহাকেও আসিতে না দেখিয়া, ছল ছল চোখে ঘরে ফিরেন। তাঁহার মনে এই চিস্তা ক্রমাগতই হয় যে, ‘হায়! কেন এমন হইল?’ কিন্তু পাছে কেহ দুষ্মন্তের নিন্দা করে এ জন্য নিজের মনের কথা তিনি কাহাকেও বলিলেন না।
আশ্রমের সকলেই হয়ত এ কথা ভাবিয়া আশ্চর্য হইতেন, আর হয়ত দুষ্মন্তের নিন্দাও করিতেন, কিন্তু কেন যে এমন হইয়াছিল — দুষ্মস্তের মত ধার্মিক রাজা কেন যে তাঁহার রানীকে এমন আশ্চর্যভাবে ভুলিয়া গিয়াছিলেন, তাহা তাঁহাদের মধ্যে অল্প লোকেই জানিতেন, দুষ্মন্ত চলিয়া যাওয়ার পরেই একদিন দুর্বাসা মুনি কন্বের আশ্রমে আসেন, কন্ব তখন ঘরে ছিলেন না, শকুন্তলা এক মনে দুষ্মন্তের কথা ভাবিতেছিলেন, তাই তিনিও দুর্বাসাকে দেখিতে পান নাই। ইহাতেই মুনি অপমান বোধ করিয়া শকুন্তলাকে শাপ দেন, ‘যাহার কথা ভাবিয়া তুই আমাকে অমান্য করিলি সেই দুষ্মন্ত তোকে ভুলিয়া যাইবে।’ এইজন্যই হস্তিনায় গিয়া দুষ্মন্তের আর শকুন্তলার কথা মনে ছিল না।
শকুন্তলার ছেলেটি ছয় বৎসর হইয়াছে, আর ইহারই মধ্যে সে এমন অসাধারণ বীর হইয়া উঠিয়াছে যে, ইহা দেখিয়া কন্ব শকুন্তলাকে বলিলেন, “মা, সর্বদমনের এখন যুবরাজ হওয়ার সময় হইয়াছে অতএব তোমার—আর এখানে থাকা উচিত নহে। তুমি শীঘ্র ইহাকে লইয়া হস্তিনায় চলিয়া যাও।”
এ কথায় শকুন্তলার মনে বড়ই আনন্দ হইল। আবার কেমন একটা ভয়ও হইল। তিনি তাড়াতাড়ি যাইবার আয়োজন করিতে লাগিলেন। তপস্বীর মেয়ের জিনিসপত্র অতি সামান্যই থাকে, সুতরাং তাহদের যাত্রার আয়োজনও খুব অল্পই করিতে হয়। কেবল একটি জিনিস ছিল, যাহাকে শকুন্তলা অন্য সকল দ্রব্যের চেয়ে ভালবাসিতেন আর যত্নে রাখিতেন। সে জিনিসটি একটি আংটি! বিবাহের সময়ে এই আংটিটি দুষ্মন্ত শকুন্তলার হাতে পরাইয়া দেন। সেই আংটিটি হাতে আছে কি না তাহাই শকুন্তলা সকলের আগে দেখিলেন; তারপর আর অন্য কিছুর জন্য তাঁহার বেশী চিন্তা হইল না।
এইটুকু আয়োজনে আর অধিক সময় লাগিল না, তারপর কন্বের দুইজন শিষ্যকে লইয়া, আর ছেলেটিকে কোলে করিয়া শকুন্তলা হস্তিনায় যাত্রা করিলেন। কন্বের নিকট বিদায় লইবার সময়, অবশ্য তাঁহার খুব কষ্ট হইল, কিন্তু দুষ্মন্তের আর ছেলেটির কথা ভাবিয়া তিনি তাহা সহিয়া রহিলেন। পথের কষ্টকে তিনি কষ্টই মনে করিলেন না। চলিতে চলিতে তিনি এত কথা ভাবিতেছিলেন যে, পথে কি হইতেছিল, তাহার দিকে তিনি মনই দিতে পারেন নাই। কেবল খোকা খুব উৎসাহের সহিত কোন কথা বলিলে তাহাই তিনি একটু শুনিতে পাইয়া আনমনে তাহার উত্তর দিয়াছিলেন।
এইরূপে তাঁহারা দুষ্মন্তের সভায় উপস্থিত হইলে, কন্বের শিষ্যগণ শকুন্তলাকে সেখানে রাখিয়া চলিয়া আসিলেন। কিন্তু হায়, রাজা শকুন্তলাকে দেখিয়া আনন্দিত হওয়া বা আদর করা দূরে থাকুক, তিনি তাঁহাকে চিনিতেই পারিলেন না।
রাজার মুখের ভাব দেখিয়া মনে হইল যেন শকুন্তলাকে তিনি নিতান্ত অপরিচিত স্ত্রী লোক মনে করিয়াছেন, আর আশ্চর্য হইয়া ভাবিতেছেন, “এ কিসের জন্য এমন ভাবে আসিয়া আমার সামনে দাড়াইল?” হায়! কি লজ্জা, কি কষ্ট! রাজা চিনিতে না পারায়, শকুন্তলা নিজেই নিজের পরিচয় দিলেন। তাহা শুনিয়া রাজা আরো আশ্চর্য হইয়া বলিলেন, “সে কি কথা? আমার ত তোমাকে কখনো দেখিয়াছি বলিয়াও মনে হয় না।”
তখন শকুন্তলার মনে হইল, যেন সেই ঘরখানি ঘুরিতে আরম্ভ করিয়াছে। আর কোথা হইতে অন্ধকার আসিয়া সকল জিনিস ঢাকিয়া ফেলিতেছে। তারপর কি হইল, তিনি কিছুই বুঝিতে পারিলেন না। এইভাবে খানিকক্ষণ কাটিয়া গেল।
জ্ঞান হইলে শকুন্তলার সেই আংটির কথা মনে হইল;তিনি ভাবিলেন যে, আংটি দেখিলে হয়ত সকল কথা রাজার মনে হইবে কিন্তু হায়! হাতের দিকে চাহিয়া শকুন্তলা দেখিলেন, আংটি নাই। আসিবার সময় একটি নদীতে নামিয়া হাত মুখ ধুইয়াছিলেন, তখন আংটিটি জলে পড়িয়া গিয়াছিল।
তখন শকুন্তলা নিতান্ত দুঃখের সহিত রাজাকে বলিলেন, “হায়! না জানি অন্য জন্মে আমি কি ভয়ানক পাপ করিয়াছিলাম, শিশুকালে মা আমাকে ফেলিয়া দিল; আবার এখন তুমি পতি হইয়াও আমাকে চিনিতে পারিলে না। আমার জন্য আমি ভাবি না, কারণ পিতার নিকট গেলেই আমি আশ্রয় পাইব। কিন্তু আমাদের পুত্রটিকে তুমি আদর না করিয়া বড়ই অন্যায় করিতেছ।”
ইহার উত্তরে দুষ্মন্ত বলিলেন, ‘স্ত্রীলোকেরা বড় মিথ্যাবাদী, বোধহয় তুমিও মিথ্যা কথা কহিতেছ, তোমার কথায় কে বিশ্বাস করিবে?”
এ কথা শুনিয়া শকুন্তলা বলিলেন, “তুমি যদি আমাকে অশ্রদ্ধা কর, তবে আমি নিজেই এখান হইতে চলিয়া যাইব;আর কখনো তোমার সহিত কথা কহিব না। কিন্তু হে দুষ্মন্ত! তুমি নিশ্চয় জানিও যে, তোমার পরে আমাদিগের এই পুত্রই এই পৃথিবীর রাজা হইবে।”
এমন সময় স্বর্গ হইতে দেবতাগণ অতি গভীর স্বরে দুষ্মন্তকে ডাকিয়া বলিলেন, “দুষ্মন্ত! শকুন্তলা তোমার রাণী, এই বালক তোমার পুত্র। তুমি শকুন্তলাকে অপমান করিও না। তাহাকে আর তোমার পুত্রকে আদর করিয়া ঘরে লও, আমাদের কথায় এই বালকের ভরত নাম রাখ। তোমার পরে ইনি অতিশয় বিখ্যাত রাজা হইবেন।”
দেবতাদের কথা শুনিবামাত্র দুষ্মন্তের সকল কথা মনে পড়িল। সভার লোক যে কি আশ্চর্য হইল;তাহা কি বলিব। কিন্তু অল্পক্ষণের ভিতরেই তাহাদিগকে ইহার চেয়েও অধিক আশ্চর্য হইতে হইল।
দেবতাদের কথা শুনিয়া সকলে আনন্দে কোলাহল করিতেছে, এমন সময় রাজার প্রহরীগণ এক জেলেকে বাঁধিয়া রাজসভায় উপস্থিত করিল, প্রহরীরা বলিল, “এই জেলে রাজার আংটি চুরি করিয়া বাজারে বেচিতে গিয়াছিল।”
জেলে বেচারা হাত জোড় করিয়া কাঁপিতে কাঁপিতে বলিল, “দোহাই মহারাজ, আমি আংটি চুরি করি নাই, একটা মাছের পেটের ভিতরে পাইয়াছি। ও আংটি কাহার, আমি তাহা জানি না।”
জেলের কথা শুনিয়া সকলে বলিল, “তবে বল ব্যাটা, তুই সেই মাছ কোথায় পাইয়াছিলি।”
জেলে বলিল, “আমি শচী তীর্থের নিকটে জাল ফেলিয়া সেই মাছ ধরিয়া ছিলাম।”
আংটি যে রাজার তাহাতে কোন সন্দেহ নাই, কেন না রাজার নাম তাহাতে লেখা রহিয়াছে। যে উহা হাতে নেয়, সেই বলে, “তাই ত, এ যে মহারাজের আংটি, এ আংটি মাছের পেটের ভিতরে কি করিয়া গেল?”
তাহাতে রাজা আংটিটি দেখিবার জন্য হাতে লইলেন। সে আংটির দিকে তাকাইবামাত্র তিনি আশ্চর্য হইয়া বলিলেন, “এই আংটি আমি শকুন্তলার হাতে পরাইয়া দিয়াছিলাম।”
ইহার পর কাহারো আর কোন কথাই বুঝিতে বাকি রহিল না। তখন যে কিরূপ সুখ আর আনন্দের ব্যাপার হইয়াছিল, তাহা কাগজে লেখার চেয়ে চুপ করিয়া বসিয়া ভাবিতে অনেক মিষ্ট লাগে।
শকুন্তলা যত কষ্ট পাইয়াছিলেন, দুষ্মন্তের আদরে তাহার সমস্ত ভুলিয়া গেলেন। সর্বদমন যুবরাজ হইলেন, আর তাঁহার ‘সর্বদমনের’ বদলে ‘ভরত’ নাম হইল। ইহার পরেও তিনি সিংহ আর বাঘ লইয়া খেলা করিতেন কি না তাহা আমি শুনিতে পাই নাই! কিন্তু তিনি যে রাজাদিগের সকলকেই পরাজয় করিয়াছিলেন, এ কথা মহাভারতে স্পষ্ট লেখা আছে। আমাদের এই দেশের নাম যে ভারতবর্ষ তাহা এই ভরত হইতেই হইয়াছে।
এই গল্পে যে দুর্বাসার শাপ এবং আংটির ঘটনার কথা আছে, তাহা মহাভারতে নাই। কালিদাসের শকুন্তলায় এই সকল ঘটনা আছে।