উপেন্দ্রকিশোর রচনাসমগ্র/মহাভারতের কথা/শর্মিষ্ঠা ও দেবযানীর কথা

শর্মিষ্ঠা ও দেবযানীর কথা

 বৃষপর্বা দানবদিগের রাজা, শুক্রাচার্য তাহাদের গুরু। শুক্রচার্যের কন্যার নাম দেবযানী, বৃষপর্বার কন্যার নাম শর্মিষ্ঠা। একদিন দানবের মেয়েরা বনে বেড়াইতে গেল, দেবযানী আর শর্মিষ্ঠাও তাহাদের সঙ্গে গেলেন।

 স্নানের পর পরিবার জন্য মেয়েরা যে কাপড় আনিয়াছিল, তাহা এক জায়গায় সাজাইয়া রাখিয়া, তাহারা আমোদ আহ্লাদ করিতেছিল। ইহার মধ্যে কখন বাতাস আসিয়া সেই-সকল কাপড় উল্টোপাল্টা করিয়া দিয়াছে, কেহ তাহা টের পায় নাই। সুতরাং তাহারা নিজের নিজের কাপড় খুঁজতে গিয়া ভুল করিতে লাগিল। শর্মিষ্ঠা যে কাপড়খানি হাতে লইলেন, সেখানি ছিল দেবযানীর আর দেবযানী তাহাতে রাগিয়া গিয়া শর্মিষ্ঠাকে বলিলেন, “হ্যা লো, অসুরের মেয়ে, তুই কোন্‌ সাহসে আমার কাপড় নিতে গেলি?”

 এ কথায় শর্মিষ্ঠা বলিলেন, “দেখ্‌ দেবযানী, আমি মহারাজ বৃষপর্বার কন্যা। তোর পিতা আমার পিতার চেয়ে নিচু আসনে বসিয়া সর্বদা তাঁহার স্তব করিয়া থাকে। তুই কি ভাবিয়াছিস যে খালি তোর মুখের জোরে তুই আমার সমান হইয়া যাইবি?”

 তখন দেবযানী আর কোন কথা না কহিয়া, কাপড় ধরিয়া টানিতে আরম্ভ করিলে, শর্মিষ্ঠা তাঁহাকে একটা কুয়ার ভিতর ঠেলিয়া ফেলিয়া সেখান হইতে প্রস্থান করিলেন। তাঁহার মনে হইল যে, দেবযানী নিশ্চয় মরিয়া গিয়াছে।

 সৌভাগ্যের বিষয় এই যে, ঠিক সেই সময়ে নহুষের পুত্র মহারাজ যযাতি ঘোড়ায় চড়িয়া সেই পথে যাইতেছিলেন। আর সারাদিন হরিণ তাড়াইয়া তাঁহার অত্যন্ত পিপাসা হওয়াতে, তিনি জল খুঁজিতে খুঁজিতে সেই কুয়ার নিকট উপস্থিত হইলেন।

 কুয়ার নিকটে আসিয়া তিনি যখন তাহার ভিতরে কান্না শুনিতে পাইলেন, তখন তাঁহার আর আশ্চর্যের সীমা রহিল না। তিনি ব্যস্তভাবে কুয়ার ভিতরে তাকাইয়া দেখিলেন যে, একটি পরমাসুন্দবী কন্যা তাহাতে পড়িয়া কাঁদিতেছে।

 রাজা অবিলম্বে সেই কন্যাটিকে কুয়ার ভিতর হইতে উঠাইলেন, আর তাঁহার পরিচয় লইয়া জানিলেন যে তিনি শুক্রাচার্যের কন্যা দেবযানী।

 দেবযানীকে মিষ্ট কথায় শান্ত করিয়া যযাতি সেখান হইতে চলিয়া গিয়াছেন, এমন সময় ঘূর্নিকা নামে দেবযানীদের এক দাসী, তাঁহাকে খুঁজিতে খুঁজিতে সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইল। দেবযানী কাঁদিতে কাঁদিতে তাহাকে বলিলেন, “ঘূর্ণিকা তুমি বাবাকে গিযা বল যে, শর্মিষ্ঠা আমাকে কুয়ায় ফেলিয়া দিয়াছিল, আমি আর বৃষপর্বার দেশে যাইব না।”

 শুক্রাচার্য ঘূর্নিকার মুখে এ কথা শুনিতে পাইযাই, তাড়াতাড়ি দেবযানীর নিকট চলিয়া আসিলেন। তাঁহাকে দেখিয়া দেবযানী বলিলেন, “বাবা, শর্মিষ্ঠা আমাকে কুয়ার ভিতরে ফেলিয়া দিয়াছিল; আর সে বলিয়াছে যে, আপনি নাকি বৃষপর্বার নীচে বসিয়া তাঁহার স্তব করেন। বাবা, এ কথা যদি সত্য হয় তবে তাহার নিকট আমি ঘাট মানিব। আর যদি তাহা না হয়, তবে এমন কথা বলার সাজা তাহাকে দিতে হইবে।”

 শুক্রাচার্য দেবযানীকে শান্ত করিবাব জন্য অনেক চেষ্টা করিলেন, কিন্তু কিছুতেই তাঁহার রাগ থামিল না।

 তখন শুক্র বৃষপর্বার নিকট গিয়া বলিলেন, “হে দানবরাজ, পাপ করিলে সকলকেই তাহার ফলভোগ করিতে হয়। আমার শিষ্য কচকে তুমি তোমার লোক দিয়া কতরকম যন্ত্রণাই দিয়াছিলে। তারপর তোমার কন্যা শর্মিষ্ঠা আমার কন্যা দেবযানীকে কুয়ায় ফেলিয়া দিয়াছে। সুতরাং আমরা আর তোমার দেশে বাস করিব না, আজই তোমাদিগকে ছাড়িয়া চলিলাম।”

 শুক্রের কথায় বৃষপর্বার মাথায় যেন আকাশ ভাঙ্গিয়া পড়িল। তিনি নিতান্ত ব্যস্ত হইয়া বলিলেন, “যদি আপনি আমাদিগকে ছাড়িয়া যান, তাহা হইলে আমরা নিশ্চয় সমুদ্রে ডুবিয়া মরিব।”

শুক্র বলিলেন, “তুমি তোমার যাহা ইচ্ছা করিতে পার; কিন্তু তোমার কন্যা আমার দেবযানীকে যে অপমান করিয়াছে তাহা আমরা কিছুতেই সহ্য করিব না।”

 বৃষপর্বা বলিলেন, “ভগবন্! আমাদের যাহা কিছু আছে সকলই আপনার। আপনি আমাদের সকলের প্রভু। আপনি আমাদিগকে দয়া করুন।”

 এ কথা শুক্র দেবযানীকে বলিলে, তিনি বলিলেন, “বৃষপৰ্বা যদি নিজের আমার নিকট আসিয়া এ কথা বলেন, তবে আমি ইহা বিশ্বাস করিতে পারি।”

 তাহা শুনিয়া বৃষপৰ্বা বলিলেন, “তোমার কি ইচ্ছা হয় বল, উহা যত বড় জিনিসই হউক, আমি নিশ্চয় তাহা তোমাকে দিব।”

 তখন দেবযানী বলিলেন, “আমি এই চাই যে, শৰ্মিষ্ঠা একহাজার অসুর-কন্যা লইয়া আমার দাসী হইবে। আমার বিবাহের পর যখন আমি স্বামীর গৃহে যাইব, তখনো সে এক হাজার অসুর-কন্যা সমেত আমার দাসী হইয়া আমার সঙ্গে যাইবে।”

 এ কথা শুনিয়া বৃষপৰ্বা তখনই একটি দাসীকে বলিলেন, ‘তুমি শীঘ্র শৰ্মিষ্ঠাকে ডাকিয়া আন।’

 দাসী রাজার আজ্ঞায় শৰ্মিষ্ঠার নিকট গিয়া বলিল, ‘রাজকন্যা, মহারাজ ডাকিতেছেন, তুমি শীঘ্র চল। দেবযানীকে সন্তুষ্ট করিবার জন্য তোমাকে তাঁহার দাসী হইতে হইবে, নহিলে অসুরদিগের বড়ই বিপদ, দেবযানীর কথায় শুক্র আমাদিগকে ছাড়িয়া যাইতেছিলেন।’

 এ কথায় শৰ্মিষ্ঠা বলিলেন, ‘আমার জন্য শুক্র আর দেবযানী চলিয়া যাইবেন, ইহা কখনই হইতে পারে না। তাহার চেয়ে আমাব দাসী হইয়া থাকাই ভাল।’

 এই বলিয়া শৰ্মিষ্ঠা এক হাজার সখী সমেত দেবযানীর নিকট উপস্থিত হইয়া বলিলেন, ‘গুরুকন্যা, আমি আমার এই একহাজার সখী লইয়া তোমার দাসী হইতেছি। তুমি স্বামীর ঘরে যাইবার সময় আমাদিগকে সঙ্গে লইয়া যাইও।’

 শৰ্মিষ্ঠাব কথায় দেবযানী বলিলেন, ‘সে কি? তুমি রাজার মেয়ে হইয়া কি করিয়া দাসী হইতে যাইবে?’

 শৰ্মিষ্ঠা বলিলেন, ‘আমি দাসী হইলে যদি আমার আত্মীয়গণের বিপদ নিবারণ হয়, তবে আমার তাহাই করা উচিত।’

 এইরূপে দানবদিগের উপকারের জন্য শর্মিষ্ঠা দেবযানীর দাসী হইয়া তাঁহার সেবা করিতে লাগিলেন দেবযানী কোথাও বেড়াইতে গেলে, শৰ্মিষ্ঠা একহাজার সখী লইয়া তাঁহার সঙ্গে যাইতেন, দেবযানী শুইয়া বা বসিয়া থাকিলে শৰ্মিষ্ঠা তাঁহার পা টিপিয়া দিতেন।

 একদিন দেবযানী সেই বনে আবার বেড়াইতে গেলেন। শৰ্মিষ্ঠা ও তাঁহার সখীগণ দেবযানীর সঙ্গে গিয়া তাঁহার সেবা করিতে লাগিলেন।

 সেদিনও মহারাজ যযাতি সেই বনে শিকার করিতে আসিয়াছেন, আর জল খুঁজিতে খুঁজতে সেই কন্যাগণের নিকট আসিয়া উপস্থিত হইয়াছেন। প্রথমে যখন যযাতির সহিত দেবযানীর সাক্ষাৎ হইয়াছিল, তখন দেবযানীব যার পর নাই দুঃখের অবস্থা। আর এখন তিনি পরম সুখে বসিয়া একহাজার সখী সমেত রাজকন্যার সেবা গ্রহণ করিতেছেন। সুতরাং, হঠাৎ তাঁহাকে দেখিয়া যযাতির চিনিতে না পারারই কথা।

 কিন্তু যযাতিকে দেবযানীর না চিনিতে পারার কোন কারণ ছিল না। যযাতির দয়ায় মৃত্যু হইতে রক্ষা পাওয়া অবধি দেবযানী তাঁহাকে বড় ভালোবাসিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন। যযাতিকে আবার দেখিয়া তাঁহার সেই ভালোবাসা আরো বাড়িয়া গেল।

 এই সময়ে শুক্রাচার্য সেখানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। তিনি যখন দেখিলেন যে, তাঁহার কন্যা যযাতিকে ভালোবাসেন, আর যযাতিও তাঁহার কন্যাকে ভালোবাসেন, তখন তিনি সন্তুষ্ট হইয়া যযাতিকে বলিলেন, “মহারাজ, আমি আনন্দের সহিত অনুমতি দিতেছি, তুমি আমার কন্যাকে বিবাহ কর।”

 এইরূপে যযাতির সহিত দেবযানীর বিবাহ হইল। যযাতি তাঁহাকে লইয়া পরম আনন্দে নিজের দেশে চলিয়া আসিলেন।

 অবশ্য শর্মিষ্ঠা আর তাঁহার একহাজার সখীও যযাতির সহিত তাঁহার রাজধানীতে আসিলেন। শুক্র যযাতিকে বিশেষ করিয়া বলিয়া দিলেন, “সাবধান! শর্মিষ্ঠাকে তুমি বিবাহ করিতে পারিবে না।”

 রাজধানীতে পৌঁছিয়া দেবযানী রাজার বাড়ীতে রহিলেন, কিন্তু শর্মিষ্ঠাকে তিনি সেখানে থাকিতে দিলেন না। তাঁহার কথায় রাজা একটি অশোক বনের ভিতরে শর্মিষ্ঠার জন্য একটি বাড়ী প্রস্তুত করিয়া দিলেন।

 এইরূপে দিন যায়। ইহার মধ্যে একদিন কি হইয়াছে, শুন। শর্মিষ্ঠাকে যযাতি বিবাহ করিয়াছেন কিন্তু দেবযানীকে তাহা জানিতে দেন নাই। দেবযানীর দুই পুত্র তাহদের নাম যদু আর তুর্বসু। শর্মিষ্ঠার তিনটি পুত্র, তাহদের নাম দ্রুহ্য, অনু আর পুরু। দেবযানীর পুত্রেরা রাজপুত্রের মতন পরম সুখে রাজ্যের ভিতরে চলাফেরা করে, তাহদের সম্মান আর আদরের সীমা নাই। শর্মিষ্ঠার ছেলে তিনটিকে, দেবযানীর ভয়ে, রাজা সেই অশোক বনের ভিতরেই লুকাইয়া রাখিয়াছেন, তাহাদিগকে বাহিরে আসিতে দেন না। ছেলে কয়টি আশপাশের বনে খেলা করিয়া বেড়ায়। বাহিরের লোক তাহাদিগকে দেখিতেও পায় না, কাজেই তাহাদের কথা জানেও না।

 একদিন দেবযানী রাজার সঙ্গে বনের ভিতরে বেড়াইতে গিয়া সেই ছেলে তিনটিকে দেখিতে পাইলেন। এমন সুন্দর ছেলে তিনটি বনের ভিতরে কোথা হইতে আসিল? দেখিতে রাজপুত্রের মতন অথচ তাহদের সঙ্গে লোক জন নাই। এ-সকল কথা ভাবিতে ভাবিতে সকলেরই আশ্চর্য বোধ হয়, আর তাহদের পরিচয় লইতে ইচ্ছা করে। দেবযানী তাহাদিগকে ডাকিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “বাছা তোমরা কে? তোমাদের পিতার নাম কি?”

 এ কথায় ছেলে তিনটি পরম আহ্লাদের সহিত যযাতিকে আঙুল দিয়া দেখাইয়া বলিল, “এই আমাদের বাবা! আমাদের মার নাম শর্মিষ্ঠা।”

 এই বলিয়া তাহারা হাসিতে হাসিতে যযাতির নিকট ছুটিয়া আসিল, কিন্তু যযাতি দেবযানীর ভয়ে যেন তাহাদিগকে চিনিতেই পারিলেন না। ইহাতে ছেলে তিনটি অভিমানে ঠোঁট ফুলাইয়া কাঁদিতে কাঁদিতে তাহদের মায়ের নিকট চলিয়া গেল।

 ইহার পর আর দেবযানীর জানিতে বাকি রহিল না যে, রাজা লুকাইয়া শর্মিষ্ঠাকে বিবাহ করিয়াছেন। ইহাতে তাঁহার মনে কি যে কষ্ট হইল, তাহা কি বলিব। তাঁহার বিশাল সুন্দর চক্ষু দুইটি জলে পরিপূর্ণ হইয়া গেল, তিনি আর এক মুহূর্তও সেখানে বিলম্ব না করিয়া, “মহারাজ, এই আমি চলিলাম” বলিয়া তখনই তাঁহার পিতার নিকট যাত্রা করিলেন।

 রাজা নিতান্ত দুঃখের সহিত তাঁহাকে নানারূপ মিনতি করিতে করিতে তাঁহার পিছু পিছু চলিলেন, কিন্তু দেবযানী কিছুতেই ফিরিলেন না। তিনি রাজাকে ভালো মন্দ কিছু না বলিয়া কাঁদিতে কাঁদিতে একেবারে শুক্রাচার্যের নিকট গিয়া উপস্থিত হইলেন। রাজাও তাঁহার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে গিয়া জোড়হাতে দাড়াইয়া রহিলেন।

 তারপর দেবযানীর নিকট সকল কথা শুনিয়া, শুক্র যযাতিকে এই বলিয়া শাপ দিলেন, “মহারাজ! তুমি ধাৰ্মিক হইয়া অধৰ্ম করিয়াছ। এই দোষে এখনই দারুণ জরা (ভয়ানক বুড়া মানুষের অবস্থা) আসিয়া তোমাকে ধবিবে।”

 শুক্র এ কথা বলিবামাত্র রাজার চুল পাকিয়া গেল, দাঁত পড়িয়া গেল, চোখ ঝাপসা হইয়া গেল, চামড়া ঝুলিয়া পড়িল, তাঁহার হাত পা আর মাথা কাঁপিতে লাগিল। তাঁহার মুখের ভিতরে কথা জড়াইয়া যাইতে লাগিল। তিনি আর কানে শুনিতে পান না;সোজা হইয়া দাঁড়াইতেও পারেন না।

 তখন যযাতি বিনয় করিয়া শুক্রকে বলিলেন, “ভগবন্, এই অবস্থায় আমার আর বঁচিয়া লাভ কি? আমি যে এখনো এই পৃথিবীর সুখ ভালো করিয়া ভোগ করিতে পারি নাই। দয়া করিয়া আমার শরীর হইতে এই জরা দূর করিয়া দিন।”

 শুক্র বলিলেন, “আমি যাহা বলিয়াছি, তাহা হইবেই। তবে তুমি ইচ্ছা করিলে, আমাকে স্মরণ করিয়া, এই জরা অন্য কাহাকেও দিতে পার। ইহাতে তোমার পাপ হইবে না।”

 রাজা বলিলেন, “তবে আমাকে এই অনুমতি দিন যে, আমার পাঁচ পুত্রের মধ্যে যে আমার জরা নিয়া আমাকে তাহার যৌবন দিতে সম্মত হইবে, সেই আমার রাজ্য পাইবে।”

 শুক্র বলিলেন, “আচ্ছা আমি তোমাকে এ বিষয়ে অনুমতি দিতেছি।”

 তারপর জরায় কাতর যযাতি দেশে ফিরিয়া, নিজের জ্যেষ্ঠ পুত্র যদুকে বলিলেন, “বৎস, দেখ শুক্রের শাপে আমার কি দশা হইয়াছে। পৃথিবীর সুখে এখনো আমার তৃপ্তি হয় নাই। তুমি যদি, একহাজার বৎসরের জন্য, আমার এই জরা নিয়া তোমার যৌবন আমাকে দাও, তবে আমি কিছু কাজকর্ম এবং সুখ ভোগ করিয়া লইতে পারি। একহাজার বৎসর পরে আবার তোমার যৌবন তোমাকে ফিরাইয়া দিব।”

 যদু বলিলেন, “মহারাজ, আমি আপনার জরা লইয়া কষ্ট পাইতে ইচ্ছা করি না। আপনার আরো অনেক পুত্র আছে, তাহাদিগকে আপনার জরা দিন।”

 এ কথায় যযাতি বলিলেন, “তুমি যখন আমার কথা অমান্য করিলে, তখন, তুমি বা তোমার বংশের কেহ, রাজ্য পাইবে না!”

 তারপর যযাতি তুর্বসুকে বলিলেন, “বৎস, তুমি আমার জরা গ্রহণ কর।”

 তুর্বসু বলিলেন, “মহারাজ, আমি তাহা করিতে পারিব না।”

 এ কথায় রাজা তুর্বসুকে এই বলিয়া শাপ দিলেন, “তোমার ছেলেপিলে হইবে না। আর তুমি পাপীদিগের রাজা হইবে।”

 তারপর দ্রুহ্য আর অনুকে ডাকিয়া রাজা জিজ্ঞাসা করিলেন, কিন্তু তাঁহারাও তাঁহার কথায় সম্মত হইলেন না। ইহাতে তিনি দ্রুহ্যকে বলিলেন, “তোমার কোন ইচ্ছাই পূর্ণ হইবে না। তোমার বংশে কেহই রাজা হইবে না। আর, যেখানে হাতি ঘোড়া, গাড়ি, পাল্কি কিছুই নাই, কেবল ভেলায় চড়িয়া আর সাঁতরাইয়া চলাফেরা করিতে হয়, সে দেশে গিয়া তোমাকে বাস করিতে হইবে।”

 আর অনুকে তিনি এই বলিয়া শাপ দিলেন, “তুমি যে জরা লইতে এত আপত্তি করিতেছে সেই জরা এখনই তোমাকে ধরিবে। আর তোমার ছেলেপিলে একটিও বাঁচিবে না।”

 এইরূপে পাঁচ ছেলের মধ্যে চারিজন যযাতির জরা লইতে অস্বীকার করিলেন। কিন্তু সকলের ছোট পুরু যযাতি বলিবামাত্রই তাঁহার কথায় রাজি হইলেন। ইহাতে যযাতি পুরুর উপর নিতান্ত সন্তুষ্ট হইয়া তাঁহাকে এই বলিয়া আশীর্বাদ করিলেন, “তোমার রাজ্যে প্রজারা চিরকাল পরম সুখে বাস করবে।”

 তারপর পুরুর যৌবন লইয়া যযাতি একহাজার বৎসর নানারূপ সৎকার্যে সুখে সময় কাটাইলেন। একহাজার বৎসর শেষ হইলে পুরুর যৌবন তাঁহকে ফিরাইয়া দিয়া এবং তাঁহাকে রাজসিংহাসনে বসাইয়া, তিনি তপস্যার জন্যে বনে চলিয়া গেলেন।

 অনেক যাগ যজ্ঞ এবং বহুকালের কঠোর তপস্যার ফলে যযাতির বিস্তর পুণ্য সঞ্চয় হওয়ায় মৃত্যুর পর স্বর্গে গিয়া কয়েক হাজার বৎসর তাঁহার বড়ই সুখে কাটিল। তারপর একদিন ইন্দ্রের সহিত তাঁহার দেখা হওয়ায় ইন্দ্র কথায় কথায় তাঁহাকে জিজ্ঞাস করিলেন, “মহারাজ, বল দেখি, তুমি কিরূপ তপস্যা করিয়াছিলে?”

 যযাতি বলিল, ‘সে আর কি বলিব? আমার সমান তপস্যা এই ত্রিভুবনে কেহ কখনো করিতে পারে নাই।’

 যযাতির এই অহঙ্কারে ইন্দ্র নিতান্ত অসন্তুষ্ট হইয়া বলিলেন, মহারাজ, অন্যে কিরূপ তপস্যা করিয়াছে, বা না করিয়াছে, তাহা না জানিয়াই তুমি সকলের অপমান করিলে। এই দোষে তুমি আজই স্বর্গ হইতে পড়িয়া যাইবে।’

 তাহাতে যযাতি বলিলেন, ‘যদি পড়িতে হয়, তবে যেন ভালো লোকের নিকট পড়ি।’

 ইন্দ্র বলিলেন, ‘তুমি ভালো লোকদের মধ্যেই পড়িবে।’

 এইরূপে কথাবার্তার পর যযাতি স্বর্গ হইতে পড়িয়া যাইতে লাগিলেন। পড়িতে পড়িতে তিনি স্বর্গ আর পৃথিবীর মাঝামাঝি আসিয়াছেন, এমন সময়, সেই শূন্যের উপরে, বসুমান, অষ্টক, প্রতর্দন ও শিবি রাজার সহিত তাঁহার দেখা হইল।

 এই চারিজন রাজা পৃথিবীতে অশেষ পুণ্য সঞ্চয় করিয়া স্বর্গে যাইতেছিলেন। ইঁহারা যযাতিকে আগুনের মতন তেজের সহিত পৃথিবীর দিকে পড়িতে দেখিয়া আশ্চর্য হইয়া তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, ‘হে যুবক, তুমি কে? আর কি জন্যই বা স্বর্গ ছড়িয়া পৃথিবীতে চলিয়াছ?’

 ইহার উত্তরে যযাতির নিকট সকল কথা শুনিয়া, ইঁহারা সকলেই বলিলেন, ‘মহারাজ, আমাদের পুণ্যের যে ফল, তাহা আপনাকে দিতেছি আপনি আমাদের সঙ্গে স্বগে চলুন।’

 এ কথায় যযাতি প্রথমে সম্মত হন নাই। তিনি কহিলেন, ‘দান ব্রাহ্মণেরাই লইয়া থাকে। আমি রাজা, আমি দান করিতেই পারি—দান লইতে যাইব কেন?’

 কিন্তু সেই চারিজন রাজা যযাতিকে কিছুতেই ছড়িলেন না। সুতরাং তাঁহাদের পুণ্যের জোরে, তাঁহাকে আবার স্বর্গে যাইতে হইল।