( ১৪ )

 এখন রবীন্দ্রনাথের একই সময়ের গুটি তিনেক উপলব্ধির উল্লেখ করা যাইতেছে। উপলব্ধি কয়টির একই পটভূমিকা— ১৯৩৭ সালে তিনি যখন কঠিন রোগে শয্যাশায়ী হইয়া পড়িয়াছিলেন, সেই সময়কার কয়েকটি আধ্যাত্মিক উপলব্ধির বিবরণ কবিতায় তিনি ধরিয়া রাখিয়া গিয়াছেন।অভিজ্ঞতা কয়টির পটভূমিকা রবীন্দ্রনাথের ভাষায় এইভাবে চিত্রিত হইতে পারে—

বিশ্বের আলোকলুপ্ত তিমিরের অন্তরালে এল
মৃত্যুদূত চুপে চুপে।

 অর্থাৎ মৃত্যুর একখানি কালো পর্দা পিছনে রাখিয়া এই অভিজ্ঞতা কয়টিকে দেখিতে হইবে। উপলব্ধি কয়টির বিশেষ কোন ব্যাখ্যা করা হইবে না, কারণ পূর্ববর্তী উপলব্ধিসমূহের ব্যাখ্যাই এক্ষেত্রেও সমান প্রয়োজ্য। কাজেই তাহার অনাবশ্যক পুনরাবৃত্তি হইতে বিরত থাকিলে কোন ক্ষতি বা অসুবিধা হইবে না।

 রবীন্দ্রনাথের রোগশয্যা পার্শ্বে যাঁহারা উপস্থিত তাঁহারা ব্যাপারটা বুঝিতে পারেন নাই, তাঁহারা মনে করিয়াছেন যে, রবীন্দ্রনাথ সংজ্ঞাশূন্য হইয়া পড়িয়া আছেন। আসলে কবির চেতনা রোগের অন্তরালে এক গভীরে বা ঊর্ধ্বে প্রবেশ করিয়াছিল, তাই বাহির হইতে তাঁহাকে চেতনাশূন্য সংজ্ঞাহারা মনে হইয়াছে। সেদিন নিজের যে উপলব্ধি বা অবস্থা হইয়াছিল, সে সম্বন্ধেই তিনি প্রথমে এইকথা বলিয়াছিলেন—

বিশ্বের আলোকলুপ্ত তিমিরের অন্তরালে এল
মৃত্যুদূত চুপে চুপে॥

 ইহার পরে তিনি দেখিতে পান—

শূন্য হতে জ্যোতির তর্জনী
স্পর্শ দিল একপ্রান্তে স্তম্ভিত বিপুল অন্ধকারে।
‘জ্যোতির তর্জনীর’ স্পর্শ; ইহার ফলে বা পরে—
পুরাতন সম্মোহের
স্থূল কারাপ্রাচীর বেষ্টন, মুহূর্তেই মিলাইল
কুহেলিকা॥

অবস্থাটা আরও পরিষ্কার করিয়া রবীন্দ্রনাথ বুঝাইয়াছেন—

অতীতের সঞ্চয়পুঞ্জিত দেহখানা, ছিল যাহা
আসন্নের বক্ষ হতে ভবিষ্যতের দিকে মাথা তুলি
বিন্ধগিরি ব্যবধান সম, আজ দেখিলাম
প্রভাতের অবসন্ন মেঘ তাহা, স্রস্ত হয়ে পড়ে
দিগন্ত বিচ্যুত॥

এই অবস্থায় থাকিয়াই রবীন্দ্রনাথ ঘোষণা করিয়াছেন

বন্ধমুক্ত আপনারে লভিলাম
সুদূর অন্তরাকাশে ছায়াপথ পার হয়ে গিয়ে
অলোক আলোকতীর্থে সূক্ষ্মতম বিলয়ের তটে॥

 অহং-এর পরিপূর্ণ বিলয়ের পরেই দেখা দেয় আত্মার পরিপূর্ণ প্রকাশ, তাহাই ‘বন্ধমুক্ত আপনারে’ লাভ করা। আপনার পরিপূর্ণ আত্ম-স্বরূপেই তিনি সেদিন প্রতিষ্ঠিত হইয়াছিল, ইহাই হইল রবীন্দ্রনাথের এই ঘোষণার নিগলিতার্থ।

 আর একদিনের এমনই এক অবস্থা বা উপলব্ধিতে রবীন্দ্রনাথ দেখিতে পাইয়াছেন যে, জীবন বা জগতের সঙ্গে তাঁহার বন্ধন-সূত্রটি আসলে একটি স্বপ্নসূত্রমাত্র। অকস্মাৎ ‘জন্মের সাথে লগ্ন স্বপ্নের’ সেই সূত্রটি ‘অদৃশ্যঘাতে’ ছিড়িয়া গেল, ইহা তিনি দেখিতে পান। তারপর তিনি জানাইয়াছেন,

সে মুহূর্তে দেখিনু সম্মুখে
অজ্ঞাত সুদীর্ঘপথ অতিদূর নিঃশব্দের দেশে
নিরাসক্ত নির্মমের পানে॥

 ‘দূর নিঃসঙ্গ নিরাসক্ত নির্মম’ ইত্যাদি উক্তিতে কাঁহাকে ইঙ্গিত করা হইয়াছে, খুলিয়া বলার দরকার করে না। ইহার পরেই তিনি বলিয়াছেন,

অকস্মাৎ মহা একা
ডাক দিল একাকীরে প্রলয় তোরণ চূড়া হতে।
অসংখ্য অপরিচিত জ্যোতিষ্কের নিঃশব্দতা মাঝে
মেলিনু নয়ন ॥

 ‘মহা একাকী’ বলিতে ব্রহ্মকেই তিনি বুঝাইয়াছেন, যিনি একমেবাদ্বিতীয়ম্। আর, ‘অসংখ্য অপরিচিত জ্যোতিষ্ক’ অন্য কিছু নহে, বিদেহমুক্ত জ্যোতির্ময় পুরুষদেরই জ্যোতিষ্করূপে রবীন্দ্রনাথ দেখিতে পাইয়াছেন বা বর্ণনা করিয়াছেন, শুধু এইটুকু এখানে উল্লেখ করিয়া রাখা গেল।


 সেই সময়কার সর্বশেষ উপলব্ধির উল্লেখ এখন করা যাইতেছে। এই বিষয়ে পূর্বে অন্যত্র যাহা লিখিয়াছিলাম, সেইটুকুই এখানে উদ্ধৃত করিতেছি।

 “জীবনের শেষ দিনে ঋষি-কবি রোগে শয্যাশায়ী ছিলেন। সেই সময়ে একদিন তিনি সংজ্ঞাশূন্য হইয়া বহুক্ষণ ছিলেন, শয্যার পার্শ্বে পরিচর্যারত সেবক এবং ভক্তগণ অত্যন্ত উৎকণ্ঠিত ও উদ্বিগ্ন হইয়া প্রতীক্ষা করিতেছিলেন যে, সংজ্ঞা আবার ফিরিয়া আসিবে, না ইহাই মৃত্যুর প্রথম স্পর্শ! সংজ্ঞা তাঁহার সেবার ফিরিয়া আসিয়াছিল এবং একটু সুস্থ হইয়া তাঁহার এই সংজ্ঞাহীন অবস্থার যে অভিজ্ঞতা বা উপলব্ধি ঋষি কবি লিপিবদ্ধ করিয়াছিলেন, তাহা বিশেষ কারণেই একটু উদ্ধৃত করা যাইতেছে। সেদিনের সেই সংজ্ঞাহীন অবস্থা সম্বন্ধে তিনি বলিয়াছেন—

দেখিলাম অবসন্ন চেতনার গোধূলি বেলায়
দেহ মোর ভেসে যায় কালোকালিন্দীর স্রোত বাহি,
......ছায়া হয়ে বিন্দু হয়ে মিলে যায় দেহ
অন্তহীন তমিস্রায়। নক্ষত্রবেদীর তলে আসি
একা স্তব্ধ দাঁড়াইয়া ঊর্ধ্বে চেয়ে কহি জোড়হাতে—
হে পূষণ, সংহরণ করিয়াছ তব রশ্মিজাল
এবার প্রকাশে করো তোমার কল্যাণতম রূপ
দেখি তারে যে পুরুষ তোমার আমার মাঝে এক ॥

 এ কাহার চিত্র? একী মৃত্যু-পীড়িত হৃতচৈতন্য সংজ্ঞাহীন পুরুষ বা প্রাণীর চিত্র? না তাহা নহে। ইহা দেহাতীত পরম চৈতন্য সত্তায় অবস্থিতিরই এক অমর অভিজ্ঞতা, ইহা মহাযোগীর মহাযোগ-নিমগ্ন মূর্তি, ইহা সমাধির শিখর চূড়ায় শিবজ্যোতি ও জীবজ্যোতির পূর্ণ মিলন চিত্র, ইহাই ব্রহ্মচৈতন্যে আত্মচৈতন্যের পরিপূর্ণ আত্মাহুতি বা অদ্বৈতসিদ্ধি। সোহহং, অয়মাত্মা ব্রহ্ম, অহং ব্রহ্মাস্মি এবং তত্ত্বমসি—চতুর্বদের চারটি মহাবাণীর ইহাই তো পূর্ণতম উপলব্ধি।”

 তাঁহার সেই দিনকার এই সমস্ত অবস্থা বা অভিজ্ঞতার উপসংহার রবীন্দ্রনাথ যেভাবে করিয়াছেন, অতীতে কোন ঋষির কণ্ঠে তাহা উচ্চারিত হইয়াছে কিনা জানি না। হইয়া থাকিলেও এমনভাবে এমন ভাষায় সে কথা নিশ্চয় কেহ জানাইতে পারেন নাই, যেভাবে এ যুগের ঋষি কবি জানাইয়াছেন—

এপারের ক্লান্ত যাত্রা গেলে থামি
ক্ষণতরে পশ্চাতে ফিরিয়া মোর নম্র নমস্কারে
বন্দনা করিয়া যাব এ জন্মের অধিদেবতারে॥