( ১৫ )

 রবীন্দ্রনাথ নিজের সম্বন্ধে বিভিন্ন সময়ে যে সব কথা বলিয়াছেন, তাহা হইতে যদৃচ্ছক্রমে কিছু উক্তি উদ্ধৃত হইতেছে। আমাদের যে মূল প্রশ্ন ‘রবীন্দ্রনাথ ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ কি না’, এই উদ্ধৃত উক্তিসমূহে সে জিজ্ঞাসার উত্তর হয়তো সর্বত্র নাও পাওয়া যাইতে পারে; তথাপি এই উদ্ধৃতিসমূহে রবীন্দ্রনাথের আধ্যাত্মিক চরিত্রের উপর যে আলোকপাত করিবে, আমাদের বিচার্য বিষয়ের দিক দিয়া তাহা উপেক্ষণীয় নহে। রবীন্দ্রনাথের ঋষি-চরিত্রেরই বিভিন্ন চিত্র বা দিক এই উক্তিসমূহে আমরা স্বয়ং কবি কর্তৃকই অঙ্কিত বা উদ্ঘাটিত দেখিতে পাইব।

 বছর পঞ্চাশেক বয়স হইবে, সেই সময়ে নিজের সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ এক স্থানে বলিয়াছেন—

 “বিশ্বমানবের মহাযজ্ঞে আনন্দের হোম-হুতাশনে আমার জীবনের সমস্ত সুখ দঃখ লাভ ক্ষতিকে পুণ্য আহুতির মতো সমর্পণ করে দেবার জন্যে আমার অন্তরের মধ্যে কোন্ তপস্বিনী মহানিষ্ক্রমণের দ্বার খুঁজে বেড়াচ্ছে।”

 বলা বাহুল্য, অসৎ হইতে সতে, তমসা হইতে জ্যোতিতে, মৃত্যু হইতে অমৃতে ‘মহানিষ্ক্রমণের দ্বার’টিই ঋষির অন্তরের এই তপস্বিনী খুঁজিয়াছে। দ্বার কি খোলা পাইয়াছে এই তপস্বিনী? পরবর্তী উদ্ধৃতিতে উত্তর হয়তো পাওয়া যাইতে পারে—

 “বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের রাজরাজেশ্বর যেখানে তাঁর সিংহাসনে আসীন, সেখানে তাঁর চরণে উপবেশন করতে আমি ভয় করিনি। সেখানে গিয়ে বলতে পারি, ‘হে রাজন, তোমার সিংহাসনের এক পাশে আমায় স্থান দাও। তুমি তো কেবল বিশ্বের রাজা নও, আমার সঙ্গে যে তোমার অনন্তকালের সম্বন্ধ॥”

 ‘মহানিষ্ক্রমণের দ্বার’ খুঁজিয়া না পাইলে ‘বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের রাজরাজেশ্বরের’ ‘চরণে গিয়া উপবেশন’ করা কখনো সম্ভবপর হয় কি? উপনিষদের ঋষি ব্রহ্মকে পিতা, সখা বলিয়া জানিয়াছেন এবং সম্বন্ধ স্থাপন করিয়াছেন, আর এ-যুগের, ঋষি তাঁহাকে ‘পরম প্রিয়’ বলিয়াই জানিয়াছেন, এখানে দেখা যায়। আর দেখা যায় যে, সেই ‘পরম প্রিয়ের’ পাশে প্রেমের স্বাধিকারেই আপন আসন দাবী করিয়াছেন।


 ১৩১১ সালে নিজের সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ প্রসঙ্গতঃ এক স্থানে লিখিয়াছেন—

 “তত্ত্ববিদ্যায় আমার কোনো অধিকার নাই। দ্বৈতবাদ-অদ্বৈতবাদের কোনো তর্ক উঠিলে আমি নিরুত্তর হইয়া থাকিব। আমি কেবল অনুভবের দিক দিয়া বলিতেছি, আমার মধ্যে আমার অন্তর্দেবতার একটি প্রকাশের আনন্দ রহিয়াছে— সেই আনন্দ সেই প্রেম আমার সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ, আমার বুদ্ধিমন, আমার নিকট প্রত্যক্ষ এই বিশ্বজগৎ, আমার অনাদি অতীত ও অনন্ত ভবিষ্যৎ পরিপ্লুত করিয়া আছে। এ-লীলা তো আমি কিছুই বুঝি না, কিন্তু আমার মধ্যেই নিয়ত এই এক প্রেমের লীলা॥”

 ‘কেবল অনুভবের দিক দিয়া’ এখানে যাহা বলা হইয়াছে, তাহা আসলে তাঁহাকেই অনুভব—যিনি সদা জনানাং হৃদয়ে সন্নিবিষ্টঃ।

 পূর্বোক্ত উক্তিটির বহু পূর্বে লিখিত একখানি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ নিজের সম্বন্ধে এই কয়টি কথা এক আত্মীয়াকে জানাইয়াছিলেন—

 “ঠিক যাকে সাধারণে ধর্ম বলে, সেটা যে আমি আমার নিজের মধ্যে সুস্পষ্ট দৃঢ়রূপে লাভ করতে পেরেছি, তা বলতে পারিনে। কিন্তু মনে ভিতরে ভিতরে ক্রমশ যে একটা সজীব পদার্থ সৃষ্ট হয়ে উঠছে, তা অনেক সময়ে অনুভব করতে পারি। বিশেষ কোন একটা নির্দিষ্ট মত নয়—একটা নিগূঢ় চেতনা একটা নূতন অন্তরিন্দ্রিয়। আমি বেশ বুঝতে পারছি, আমি ক্রমশ আপনার মধ্যে আপনার একটা সামঞ্জস্য স্থাপন করতে পারব—সমস্তটা মিলিয়ে জীবনটাকে একটা সমগ্রতা দিতে পারব॥”

 ‘একটা নিগূঢ় চেতনা একটা নূতন অন্তরিন্দ্রিয়’, বলিতে কি বুঝায়, সে–  ব্যাখ্যা হইতে আমরা বিরত থাকিতে পারি। এ-পত্র লেখার কয়েক বৎসর পরে শান্তিনিকেতনের এক উপাসনা-ভাষণে রবীন্দ্রনাথ এই ‘অন্তরিন্দ্রিয়ের’ কথা উল্লেখ করিয়াছেন দেখা যায়। সেইটুকু উদ্ধৃত করিলেই আমাদের জিজ্ঞাসিত প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাইবে। সে উপাসনা-ভাষণে তিনি বলিয়াছেন—

 “উপনিষৎ তাঁকে বলেছেন: গুহাহিতং গহ্বরেষ্ঠং। অর্থাৎ, তিনি গুপ্ত, তিনি গভীর। তাঁকে শুধু বাইরে দেখা যায় না—তিনি লুকানো আছেন; বাইরে যা-কিছু প্রকাশিত তাকে জানবার জন্যে আমাদের ইন্দ্রিয় আছে—তেমনি যা গূঢ়, যা গভীর, তাকে উপলব্ধি করবার জন্যেই আমাদের গভীরতর অন্তরিন্দ্রিয় আছে॥”

 তাঁহার চিঠিতে যে ‘নিগূঢ় চেতনা একটা নূতন অন্তরিন্দ্রিয়’-এর কথা রবীন্দ্রনাথ বলিয়াছেন, এই ‘গুহাহিতং গহ্বরেষ্ঠং’ যে-ব্রহ্ম, তাঁহাকেই দর্শনই ইহার কাজ। রবীন্দ্রনাথের ‘অন্তরিন্দ্রিয়’ তাঁহার দর্শন পাইয়াছে কিনা, চিঠিতেই সে প্রশ্নের জবাব আছে যেখানে তিনি বলিয়াছেন— ‘বেশ বুঝতে পারছি, আমি আপনার মধ্যে আপনার একটা সামঞ্জস্য স্থাপন করতে পারব, জীবনটাকে একটা সমগ্রতা দিতে পারব।’

 পূর্ণকে দেখিলেই তবে ‘জীবনের সমগ্রতা’ বা পূর্ণতা দান সম্ভবপর হয়। তাহার পূর্বে সমগ্রতা বা পূর্ণতার কোন আভাস মাত্রও জীবনে কাহারও আসে না, পূর্ণতা বা সমগ্রতা দানের আশা জীবনে দেখা দেওয়ার কথা তো উঠেই না।

 ৬৫ বৎসরে পদার্পণ করিয়া একখানি চিঠিতে রবীন্দ্রনাথ নিজের সম্বন্ধে লিখিয়াছেন—

 “আজ বাইরে বসে খেলার চেয়ে খেলনার সাথীকেই বেশী দেখতে পাচ্ছি।... যাকে প্রবীণেরা মায়া বলে বর্ণনা করে সেই অনিত্যের খেলাঘরে সে কোন্ আশ্চর্যকে দেখতে পেল? যাঁকে দেখেছিল পূর্বদিগন্তে ঊষার প্রদোষ আলোয়, তাঁকেই দেখল পশ্চিম সিংহদ্বারে তারার প্রদীপ জ্বালাতে ব্যস্ত। যেতে যেতে বলতে পারব, দেখেছি॥”

 ‘অনিত্যের খেলাঘরে’ কে সে আশ্চর্য, যাঁহাকে রবীন্দ্রনাথ দেখিয়াছেন? উপনিষদ যাঁহাকে বলিয়াছেন ‘নিত্যহ নিত্যানাং’ এই সমস্ত অনিত্যের যিনি নিত্য আশ্রয় বা এই সমস্ত অনিত্যের মধ্যে যিনি নিত্য, তাঁহাকেই ‘আশ্চর্য’ বলিয়া উল্লেখ রবীন্দ্রনাথ করিয়াছেন এবং তাঁহাকে তিনি দেখিয়াছেন, এই কথাই তিনি জানাইতে চাহিয়াছেন।

 এই চিঠিখানির আরম্ভেই রবীন্দ্রনাথ বলিয়াছেন,

 “আবার আমার মন পলাতক। সমস্ত দিন কিছু করিনে কেবল সামনে চেয়ে বসে আছি—দেখি পূর্ণতা সেই শূন্যে॥”

 শূন্যকে আমরা শূন্যই দেখি। কিন্তু এ কোন ‘পূর্ণতা’, যাহা শূন্যকেই পূর্ণ করিয়া পরিব্যাপ্ত রহিয়াছে?

 তপোবনের ঋষির একটি প্রার্থনা-মন্ত্রে আছে “তোমার এই শূন্যতাকে পূর্ণ করিব নিজে শূন্য হইয়া।” অহং-এর নিঃশেষে বিলোপই ‘নিজে শূন্য হওয়া’ এবং অহং সরিয়া গেলে শূন্যকে যিনি পূর্ণ করিয়া আবির্ভূত হন, তিনিই আত্মা। এঁরই এক নাম পূর্ণ এবং তাঁহাকে দেখিয়াই রবীন্দ্রনাথ বলিতে পারিয়াছেন—“দেখি পূর্ণতা সেই শূন্যে।”


 নিজের ‘জীবনবৃত্তান্ত’ লিখিতে অনুরুদ্ধ হইয়া রবীন্দ্রনাথ ১৩১১ সালে যাহা লিখিয়াছিলেন, তাহার একস্থানে এই কয়টি কথা আছে।

 “কতদিন নৌকায় বসিয়া সূর্যকরোদ্দীপ্ত জলে স্থলে আকাশে আমার অন্তরাত্মাকে নিঃশেষে বিকীর্ণ করিয়া দিয়াছি, তখন মাটিকে আর মাটি বলিয়া দূরে রাখি নাই, তখন জলের ধারা আমার অন্তরের মধ্যে আনন্দগানে বহিয়া গেছে; তখনি একথা বলিতে পারিয়াছি: যেথা যাব সেথা অসীম বাঁধনে অন্তবিহীন আপনা॥”

 ভাষ্য বা ব্যাখ্যা অনাবশ্যক। এই ‘জীবন বৃত্তান্তের’-ই অন্যত্র তিনি লিখিয়াছেন—

 “আমি, কি আত্মার মধ্যে, কি বিশ্বের মধ্যে বিস্ময়ের অন্ত দেখি না। আমি জড় নাম দিয়া, অসীম নাম দিয়া কোনো জিনিষকে একপাশে ঠেলিয়া রাখিতে পারি নাই। এই সীমার মধ্যেই এই প্রত্যক্ষের মধ্যেই অনন্তের যে প্রকাশ, তাহাই আমার কাছে অসীম বিস্ময়াবহ॥”

 ‘অনন্তের প্রকাশকেই’ বৈদিক ঋষি বলিয়াছেন ‘দেবস্যকাব্যং’, আর উপনিষদের ঋষি বলিয়াছেন ‘আনন্দলীলা’ এবং এই দুইয়েরই ব্যাখ্যা পূর্বে করা হইয়াছে।

 সপ্ততিবর্ষপূর্তি উপলক্ষ্যে কলিকাতা টাউন হলে যে রবীন্দ্র জয়ন্তী (১১ই পৌষ ১৩৩৮) অনুষ্ঠিত হয়, সেই সময়ে দেশবাসীর অভিনন্দনের উত্তরে রবীন্দ্রনাথ তাঁহার ‘প্রতিভাষণে’ নিজের সম্বন্ধে প্রসঙ্গতঃ এই কয়টি কথা জানাইয়াছিলেন—

 “আমি জীর্ণ জগতে জন্মগ্রহণ করিনি। আমি চোখ মেলে যা দেখলুম চোখ আমার কখনো তাতে ক্লান্ত হলনা, বিস্ময়ের আর অন্ত পাইনি। চরাচরকে বেষ্টন করে অনাদিকালের যে অনাহতবাণী অনন্তকালের অভিমুখে ধ্বনিত তাকে আমার মনপ্রাণ সাড়া দিয়েছে, মনে হয়েছে যুগে যুগে এই বিশ্ববাণী শুনে এলুম॥”

 ‘অনাদিকালের যে অনাহতবাণী অনন্তকালের অভিমুখে ধ্বনিত’, সেই বাণীরই উপনিষদ নাম দিয়াছেন—শব্দ-ব্রহ্ম।

 ইহার পরে এই ‘প্রতিভাষণে’ রবীন্দ্রনাথ খুলিয়াই আত্মপ্রকাশ করিয়াছেন, জনতার মাঝখানে দাঁড়াইয়া নিজের সম্বন্ধে বলিয়া গিয়াছেন—

 “প্রতিদিন ঊষাকালে অন্ধকার রাত্রির প্রান্তে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছি এই কথাটি উপলব্ধি করবার জন্য যে, যত্তেরূপং কল্যাণতমং তত্তে পশ্যামি। আমি সেই বিরাট সত্তাকে আমার অনুভবে স্পর্শ করতে চেয়েছি যিনি সকল সত্তার আত্মীয়সম্বন্ধের ঐক্যতত্ত্ব, যাঁর খুশিতেই নিরন্তর অসংখ্য রূপের প্রকাশে বিচিত্রভাবে আমার প্রাণ খুশি হয়ে উঠছে—বলে উঠেছে কোহ্যেবানাৎ কঃ প্রাণ্যাৎ যদেষ আকাশ আনন্দ ন স্যাৎ॥”

 তপোবনের ঋষিকেই কি এখানে নূতন মূর্তিতে দেখা যাইতেছে না? ঋষির ব্রহ্ম ঘোষণাই কি তিনি অসংখ্য জনতার মাঝখানে দাঁড়াইয়া এখানে করিয়া যান নাই যে, তিনি তাঁহারই কল্যাণতম রূপকে দেখিয়াছেন, যিনি আকাশ পরিপূর্ণ করিয়া আনন্দ?

 সত্তর বৎসরের এই ‘প্রতিভাষণের’ উপসংহারে আসিয়া নিজের সমগ্র জীবন, কর্ম ও কাব্যসৃষ্টি সম্বন্ধে রবীন্দ্রনাথ নিজেই এই রায় দিয়াছেন দেখা যায়—

 “সমস্ত আবর্জনা বাদ দিয়ে বাকি যা থাকে আশা করি তার মধ্যে এই ঘোষণাটি স্পষ্ট যে, আমি ভালোবেসেছি এই জগৎকে, আমি প্রণাম করেছি মহৎকে, আমি কামনা করেছি মুক্তিকে, যে মুক্তি পরম পুরুষের কাছে আত্মনিবেদনে, আমি বিশ্বাস করেছি মানুষের সত্য মহামানবের মধ্যে, যিনি সদা জনানাং হৃদয়ে সন্নিবিষ্টঃ। আমি এসেছি এই ধরণীর মহাতীর্থে—এখানে সর্বদেশ সর্বজাতি এবং সর্বকালের ইতিহাসের মহাকেন্দ্রে আছেন নরদেবতা— তাঁরই বেদীমূলে নিভৃতে বসে আমার অহংকার আমার ভেদবুদ্ধি ক্ষালণ করবার দুঃসাধ্য চেষ্টায় আজও প্রবৃত্ত আছি॥”

 যে কথা একান্ত গূঢ় ও গোপন, জনসভায় দাঁড়াইয়া আপনার সেই পরিচয়ই ঋষি কবি এখানে উদ্ঘাটন করিয়াছেন। দেশবাসীর ঐকান্তিক শ্রদ্ধার আড়ালে দেশবাসীর জিজ্ঞাসিত একটি অনুচ্চারিত প্রশ্নই হয়তো তিনি শুনিতে পাইয়াছিলেন —কে তুমি? কি তোমার সত্য পরিচয়? তাই নিজেকে কিছুটা অনাবৃত করিয়া নিজের সত্য রূপটির কিছু আভাস তিনি দেখাইয়াছিলেন। সে রূপ সত্যদ্রষ্টা ঋষির রূপ, সে রূপ ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষেরই রূপ।

 আশি বৎসরে আয়ুর শেষ সীমায় আসিয়া রবীন্দ্রনাথ যে আত্মপরিচয়টুকু লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন, তাহা হইতে মাত্র দুইটি উক্তি উদ্ধৃত করিয়া পরে প্রসঙ্গান্তরে যাওয়া যাইতেছে।

 প্রথম উক্তিটি এই—“সংসারের নিয়মকে জেনেছি, তাকে মানতেও হয়েছে, মূঢ়ের মতো তাকে উচ্ছৃঙ্খল কল্পনায় বিকৃত করে দেখিনি, কিন্তু এই সমস্ত ব্যবহারের মাঝখান দিয়ে বিশ্বের সঙ্গে আমার মন যুক্ত হয়ে চলে গেছে সেইখানে যেখানে সৃষ্টি গেছে সৃষ্টির অতীতে। এই যোগে সার্থক হয়েছে আমার জীবন॥”

 উপনিষদ বলিয়াছেন, পাদোঽস্য বিশ্বাভূতানি ত্রিপাদাস্যামৃতং দিবি—সৃষ্টি তাঁহার একপাদ আর ত্রিপাদ তাঁহার অমৃতলোকে। ‘সৃষ্টির অতীত’ বলিতে এই ‘অমৃতংদিবি’ অমৃত-স্বরূপ জ্যোতির্লোককেই বুঝানো হইয়াছে। সেখানে যাঁহার মন গিয়াছে, সেই ঋষিই কেবল বলিতে পারেন—‘সার্থক হয়েছে আমার জীবন।’

 এখন রবীন্দ্রনাথের দ্বিতীয় উক্তিটি উদ্ধৃত হইতেছে, যাহা আশি বছরে আয়ুর প্রান্তে আসিয়া তিনি আত্মপরিচয়ে লিপিবদ্ধ করিয়াছেন। উক্তিটি এই—

 “নিজের ভিতরকার এই প্রাণময় রহস্যকে, তং দুর্দর্শং গূঢ়মনুপ্রবিষ্টং, সেই অদৃশ্যকে, সেই নিগূঢ়কে কী নাম দেব জানিনে।... কিন্তু আমি তাঁকে বারবার অনুভব করেছি। বিশেষভাবে আজ যখন আয়ুর প্রান্ত সীমায় এসে পৌঁছেছি তখন তাঁর উপলব্ধি আরো স্পষ্ট হয়ে উঠছে॥”

 কার উপলব্ধি ‘আরো স্পষ্ট’ হইয়া উঠিয়াছে? উপনিষদের ভাষা আক্ষরিক গ্রহণ করিয়া তাঁহারই পরিচয় রবীন্দ্রনাথ দিয়াছেন—‘দুর্দশম্ গূঢ়ম্, অনুপ্রবিষ্টং গহ্বরেষ্ঠং পুরাণম্।’ ইনিই ব্রহ্ম।

 দেখা যাইতেছে যে, আশি বছরে আসিয়া রবীন্দ্রনাথ ঘোষণা করিয়াছেন ‘তাঁর (ব্রহ্মের) উপলব্ধি আরও স্পষ্ট হয়ে উঠছে।’