(১৯)

 গীতাঞ্জলি সম্বন্ধে বক্তব্য শেষ করা হইয়াছে, বলা যাইতে পারে। এতক্ষণ যাহা বলা হইল, সেই দৃষ্টিভঙ্গী লইয়া গীতাঞ্জলিকে বিচার করিলেই দেখা যাইবে যে, এক ব্রহ্মজ্ঞ ঋষিই এখানে ব্রহ্মানন্দে ও বিস্ময়ে গান গাহিয়া গিয়াছেন—হা৪ বু হা৩ বু হা৩ বু— আহা-আহা-আহা। ইহা মনে রাখিয়া গীতাঞ্জলির যে কোন একটি গান গ্রহণ করিলেই পাঠক আমাদের অভিমতের পূর্ণ সমর্থন তাহাতে দেখিতে পাইবেন।

 গীতাঞ্জলিকে দার্শনিকের দৃষ্টিতে দেখিলে তিনটি তত্ত্বই বিশেষ ভাবে অভিব্যক্ত দেখা যাইবে—প্রথম, অহংকারকেই ভগবানের সঙ্গে মিলনের প্রধান অন্তরায়রূপে রবীন্দ্রনাথ দেখিয়াছেন। আমিকে বুঝাইতে অহং এবং আত্মা এই দুইটি শব্দই ব্যবহৃত হইয়া থাকে, কিন্তু অহং-টি মিথ্যা আমি এবং আত্মাই আমার প্রকৃত আমি—ইহা সর্বোপনিষদের উপদেশ।

 দ্বিতীয় যে তত্ত্বটি গীতাঞ্জলিতে পাওয়া যায় তাহা হইল এই যে, দুঃখকে রবীন্দ্রনাথ ভগবানের দূত বলিয়া জানিয়াছেন। উপনিষদে সমস্ত কিছুকে ভগবানেরই দান বলা হইয়াছে এবং ভগবানকে বলা হইয়াছে বসুদান, আর রবীন্দ্রনাথ দুঃখের এই দানকেই দেখিয়াছেন প্রেমময়ের দূতীরূপে।

 গীতাঞ্জলির তৃতীয় তত্ত্বটি হইল এই যে, সর্বত্রই ভগবানের সত্ত্বা ও লীলা। উপনিষদ বলিয়াছেন ঈশাবাস্য সর্বমিদং এবং এই সৃষ্টি তাঁহার আনন্দরূপ অর্থাৎ লীলা।

 এখন গীতাঞ্জলির কয়েকটি সাক্ষ্য গ্রহণ করা যাইতেছে। তার আগে আর একবার রবীন্দ্রনাথের কথা কয়টি স্মরণ করিয়া লওয়া যাক— “কবিতাগুলি আমি লিখব বলে লিখিনি—এ আমার জীবনের ভিতরের জিনিষ—এ আমার সত্যকার আত্মনিবেদন—এর মধ্যে আমার জীবনের সমস্ত সুখ দুঃখ, সমস্ত সাধনা বিগলিত হয়ে আপনি আকার ধারণ করেছে।”

 ‘গীতাঞ্জলি’ সম্পর্কে যে সব কথা বলা হইয়াছে, তাহার সমর্থনে এবং প্রমাণ হিসাবে মাত্র কয়েকটি ক্ষেত্র হইতেই কিছু কিছু অংশ উদ্ধৃত হইবে, কারণ, অধিক উদ্ধৃতি বাহল্য।—

 গীতাঞ্জলিতে একটি গানে রবীন্দ্রনাথ জিজ্ঞাসা করিয়াছেন—

হে মোর দেবতা, ভরিয়া এ দেহ প্রাণ
কী অমৃত তুমি চাহ করিবারে পান।

 উপনিষদে ব্রহ্মকে বলা হইয়াছে জীব-হৃদয়ে অন্তর্যামী। এই অন্তর্যামীই রবীন্দ্রনাথের ‘হে মোর দেবতা’। রবীন্দ্রনাথের প্রশ্নটি হইল যে, তাঁহার মধ্যেই তাঁহার অন্তর্যামীরূপে ভগবানের এই অবস্থিতি কেন? কি তিনি চাহেন?

 উপনিষদে পাওয়া যায় যে, তিনি অগ্রে একা ছিলেন, এই একাকিত্বে নিজেকে নিজে সঙ্গ দিবার উদ্দেশ্যেই তিনি ‘বহুস্যাম’—বহু হইয়াছেন। অর্থাৎ আপন সৃষ্টিতে তিনি আপনিই ভোক্তা-ভর্তা-দ্রষ্টা-অনুমন্তা ইত্যাদিরূপে অনুপ্রবিষ্ট রহিয়াছেন। কাজেই, রবীন্দ্রনাথের এই জিজ্ঞাসা ব্রহ্মের নিকটেই ব্রহ্মজিজ্ঞাসা।

 জিজ্ঞাসাটিকে আরও স্পষ্ট করিয়া রবীন্দ্রনাথ রূপ দিয়াছেন—

আমার নয়নে তোমার বিশ্ব ছবি
দেখিয়া লইতে সাধ যায় তব কবি—
আমার মুগ্ধ শ্রবণে নীরব রহি
শুনিয়া লইতে চাহ আপনার গান?

 উপনিষদের একটি উপদেশে আছে,—

 “হৃদয় মধ্যে অধিষ্ঠিত সেই সম্ভজনীয় আত্মকে ইন্দ্রিয় সমুদয় উপঢৌকন প্রদান করে॥” প্রজারা যেমন রাজাকে ভেট দেয়, ইন্দ্রিয়বর্গও সেইরূপ অন্তর্যামী আত্মার আনন্দ বিধানে সর্বদা তৎপর—ইহাই হইল উপদেশটির অর্থ।

 উপনিষদের উপদিষ্ট এই সত্যটিই রবীন্দ্রনাথের আপন জীবনে একটি প্রশ্নে অপূর্ব সন্দর রূপান্তর গ্রহণ করিয়াছে—হে মোর দেবতা ইত্যাদি।”

 জিজ্ঞাসিত প্রশ্নটির উত্তর রবীন্দ্রনাথ নিজেই দিয়াছেন—

আপনারে তুমি দেখিছ মধুর রসে
আমার মাঝরে নিজেরে করিয়া দান॥

 বৃহদারণ্যক উপনিষদের মধুকান্ডে প্রথম অধ্যায়ে চতুর্থ ব্রাহ্মণে বলা হইয়াছে—

 “অগ্রে এই জগৎ পুরুষাকার আত্মা (বা বিরাট)রূপেই ছিলেন—আত্মৈবেদগ্র আসীৎ পুরুষবিধ।” সেই একাকী ভয় পাইলেন, ‘এইজন্য (আজও) লোকে একাকী থাকিতে ভীত হয়॥’

 তারপর সেই প্রথম পুরুষ বা বিরাট-পুরুষ সম্বন্ধে বলা হইয়াছে, ‘সবে নৈব রেমে তস্মাদেকাকী ন রমতে স দ্বিতীয়মৈচ্ছৎ’—তিনি মোটেই রতি বা আনন্দ লাভ করিলেন না। এইজন্য (আজও) কেহ একাকী থাকিলে সুখী হয় না। তিনি সঙ্গীর অভিলাষ করিলেন॥

 কেন? রতি বা আনন্দলাভ করিবার জন্য। পরম একাকী আপন একাকিত্বে নিজের আনন্দ-সঙ্গী পাইবার জন্য সৃষ্টি করিয়া সৃষ্টিতে জীবহৃদয়ে অনুপ্রবিষ্ট, ইহাই হইল উপনিষদের উপদেশ।

 উপনিষদের এই সত্য রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত জীবনে ও উপলব্ধিতে কতখানি সত্য প্রকাশ লাভ করিয়াছে বলার ভঙ্গী ও ভাবেই তাহা অভিব্যক্ত। উপনিষদ শুধু একটি সংবাদসূত্রে দিয়াছেন, একাকীরই এই সৃষ্টি। আর রবীন্দ্রনাথের জীবনে সেই সংবাদটিই রূপান্তরিত হইয়া সংবাদের বাচকের মধুময় মূর্তি পরিগ্রহ করিয়াছে—

আপনারে তুমি দেখিছ মধুর রসে
আমার মাঝারে নিজেরে করিয়া দান।

 একটা বিষয় বিশেষভাবে লক্ষ্য করিবার যে, গান-জানা এবং গান-গাওয়া এই দুইয়ের মধ্যে যে পার্থক্য, উপনিষদের উপদেশ এবং রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধিতেও সেই পার্থক্য। এটুকু মনে রাখিলে গীতাঞ্জলির উদ্ধৃত অংশ কয়টির ব্যাখ্যা বা ভাষ্য হইতে অব্যাহতি পাওয়া যাইবে।

 আরও একটি কথা, তত্ত্বে ও রসে যে পার্থক্য, উপনিষদের উপদেশে ও রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধিতে সে পার্থক্য বিদ্যমান। ব্রহ্মকে বলা হইয়াছে ‘রসো বৈ সঃ— তিনি রস-স্বরূপ’ এবং তাঁহাকে পাইলে ‘আনন্দী’ হাওয়া যায়। এই ‘রসো বৈ সঃ—এর সঙ্গেই রবীন্দ্রনাথের যে রস সম্পর্ক, তাহাই বিগলিত হইয়া গীতাঞ্জলিতে আকার গ্রহণ করিয়াছে।

 এই রস সম্পর্কে বা বন্ধনে রবীন্দ্রনাথ কখনো ভক্ত, কখনো সেবক, কখনো বন্ধুসখা, কখনো পুত্র, কখনোবা প্রিয়। নানারূপে ও ভাবে রবীন্দ্রনাথের এই ‘আনন্দী’ রূপটি গীতাঞ্জলিতে মূর্ত হইয়াছে।

 একটি গানে রবীন্দ্রনাথ বলিয়াছেন, ‘মেনেছি, হার মেনেছি।’ তাঁহার অন্তর্যামীর সঙ্গে কোন্ খেলাতে তিনি এই হার স্বীকার করিয়াছেন, তাহার ইঙ্গিত এখানে পাওয়া যায়—

আমার চিত্ত গগন থেকে
তোমায় কেউ রাখবে ঢেকে
কোনমতেই সইবে না সে
বারে বারেই জেনেছি।

 এখানে সুস্পষ্ট ঘোষণা রহিয়াছে যে, তাঁহার হৃদয় আকাশে কোন কিছুতেই সেই প্রিয়তম সেই অন্তর্যামীকে ঢাকা বা আবৃত করা যাইতেছে না। এ কী অদ্ভুত লীলা ভগবানের! আর এ কী আশ্চর্য রস-অভিযান ভক্তের!

 রবীন্দ্রনাথ শেষ পর্যন্ত হার স্বীকার করিয়া বলিয়াছেন—

মেনেছি, হার মেনেছি।
ধরা দিলেম তোমার হাতে,
যা আছে মোর এই জীবনে
তোমার দ্বারে এনেছি।

 উপনিষদের অঙ্কিত ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষে এক রেখাচিত্র দেখা গিয়ছে—হা৩ বু অহো-অহো-অহো’, এই পরম বিস্ময়-গানে উন্মত্তের ন্যায় তিনি ভূবনে বিচরণশীল। এই হা৩ বু হা৩ বু এই পরমবিস্ময়—ইহার যে কত রূপ ও কত রসপ্রকাশ সম্ভবপর, গীতাঞ্জলিই তাহার প্রমাণ। যথেচ্ছ যে কোন একটি গান গ্রহণ করিলেই তাহা ধরা পড়িবে। একটা গান লওয়া যাক—

তেমার প্রেম যে বইতে পারি
এমন সাধ্য নাই।
এ সংসারে তোমার আমার
মাঝখানেতে তাই

কৃপা করে রেখেছ নাথ,
অনেক ব্যবধান—

 বিরহ ব্যবধানের সুরটি এখানে বেশ স্পষ্ট এবং এই ব্যবধানকে প্রেমমুগ্ধ হৃদয় তাঁহার কৃপা বলিয়াই গণ্য করিয়াছে, দেখা যায়। এখন আর একটি গান লওয়া যাক—

আমার খেলা যখন ছিল তোমার সনে
তখন কে তুমি তা কে জানত।
তখন ছিল না ভয়, ছিল না লাজ মনে,
জীবন বহে যেত অশান্ত।

 তিনি ছিলেন খেলার সাথী, সখা, বন্ধু, কাজেই লজ্জা-ভয়-চিন্তা-জিজ্ঞাসা ইত্যাদির কিছুমাত্র অবকাশ সেখানে ছিল না। কিন্তু কে এই খেলার সাথী? কে এই সখা?—

হঠাৎ খেলার শেষে কী দেখি ছবি—
স্তব্ধ আকাশ, নীরব শশী রবি,
তোমার চরণ পানে নয়ন করি নত
ভুবন দাঁড়িয়ে আছে একান্ত॥

 যাঁহার সঙ্গে ব্যবধান ছিল প্রেমেরই ব্যাখ্যা, তিনিই হইলেন একেবারে খেলার সাথী, এখন খেলা শেষে দেখা গেল—তিনিই বিশ্বভুবনের ঈশান, বিধাতা।


 এই গানটিতে উপনিষদের ঋষির এক শান্ত মূর্তি প্রতিফলিত দেখা যাইবে—

প্রেমে প্রাণে গানে গন্ধে আলোকে পুলকে
প্লাবিত করিয়া নিখিল দ্যুলোক-ভুলোকে
তোমার অকল অমৃত পড়িছে ঝরিয়া।

 ব্যাখ্যার কোন অবকাশ নাই, প্রয়োজনও করে না। ইহার পরে যে কথাটি তিনি বলিয়াছেন, উপনিষদের কম ঋষির কণ্ঠেই এমন বাণী ধ্বনিত হইয়াছে—

দিকে দিকে টুটিয়া সকল বন্ধ
মুরতি ধরিয়া জাগিয়া উঠে আনন্দ;
জীবন উঠিল নিবিড় সুধায় ভরিয়া॥

 উপনিষদের ঋষি বলিয়াছেন যে, এই সৃষ্টি আনন্দ হইতে আসিয়াছে, আনন্দে বিধৃত এবং আনন্দেই পরিণামে অবসিত। কিন্তু সৃষ্টিকে একমাত্র মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক্যই বলিয়াছেন, ‘মূর্তানন্দ’। রবীন্দ্রনাথের মুখে সেই পরম বাণীই শোনা গিয়াছে যে, এই সৃষ্টিই আনন্দ, এই সৃষ্টি আর কিছ, নহে—‘মুরতি ধরিয়া জাগিয়া উঠে আনন্দ।’

 ইহার পরের উক্তিতে ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের পরিপূর্ণ প্রকাশ ও প্রণাম এক সঙ্গেই পাওয়া যায়—

চেতনা আমার কল্যাণ-রস-সরসে
শতদল সম ফুটিল পরম হরষে
সব মধু তার চরণে তোমার ধরিয়া।

 উপনিষদের ঋষির প্রার্থনা ছিল—হিরন্ময় জ্যোতিতে সত্যের মুখে আবৃত, সেই আবরণ অপসৃত হউক, যত্তে রূপং কল্যাণতম তত্তে পশ্যামি। আর সত্যের কল্যাণতম দক্ষিণ মুখটি এখানে অনাবৃত, তাই সত্যের মুখ দেখিবার প্রার্থনা নাই, আছে শুধু চরণে পরিপূর্ণ একটি প্রণামে আত্মনিবেদনে।

 অধিক উদ্ধৃতির প্রয়োজন নাই, আর উদ্ধৃতির শেষও যে অসম্ভব। পূর্বেই বলিয়াছি যে, গীতাঞ্জলি ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের হৃদয় রস। এ রস অন্তহীন অশেষ, এ রস গভীর অতল। ভক্ত ও ভগবানের বাসর-ঘরের এই নিভৃত লীলা, সীমা ও অসীমের এই অনন্ত রস কৌতুক, আত্মা ও পরমাত্মার এই মিলন-বিরহ—ইহার আদিই বা কোথায়? ইহার অন্তই বা কোথায়?

 আর তাহাকেই ব্রহ্মের লীলাসঙ্গী রবীন্দ্রনাথ গীতাঞ্জলির শুভ্র অঞ্জলিতে ভরিয়া রাখিয়াছেন, যেমন শিবের দুই নেত্রের কমণ্ডলুতে নিখিল ভাস্বর জ্ঞান জ্যোতি এবং নিখিল আনন্দ প্রেম কল্যাণ বিধৃত। এই কারণেই গীতাকে বলিয়াছি,—শুধু তত্ত্ব, আর গীতাঞ্জলিকে বলিয়াছি—রসো বৈ সঃ।—উদ্ধৃতি অনন্তকালেও যে শেষ হইবার নহে।

 উপনিষদে অঙ্কিত ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের রেখাচিত্র দেখিয়াছি—অহো-অহো-অহো বিস্ময় উন্মাদ। আর ভক্তিশাস্ত্রের বেদগ্রন্থ ভাগবতে মহাব্রহ্মজ্ঞের ভক্তরাজরূপ-চিত্রটি পাই দৈত্যরাজ প্রহ্লাদের চরিত্রে। সে চিত্রটি এই—

কবচিদ্ রূদতি বৈকুণ্ঠ-চিন্তা-শবল চেতনঃ।
কবচিদ্ধসতি তচ্চিন্তাহলাদ উদ্গায়তি ক্বচিৎ॥
············ইত্যাদি॥

 —প্রহলাদ কখন ভগবানের চিন্তায় আকুল চিত্তে রোদন করিত, কখন তাঁহার মিলনানন্দে হাস্য করিত, কখন গান করিত, কখন মক্তকণ্ঠে চীৎকার করিত, কখন নির্লজ্জের ন্যায় নৃত্য করিত, কখন বা ভগবানের সংস্পর্শ সুখে রোমাঞ্চিত হইয়া প্রগাঢ় প্রণয়ানন্দে সুখ-অশ্রুতে সিক্ত ও মুদিত চোখে তুষ্ণীভাব অবলম্বন করিত।

 মহাব্রহ্মজ্ঞ ভক্তরাজ প্রহ্লাদের এই চরিত্রের সব কয়টিরই রসচিত্র বা রসপ্রকাশ গীতঞ্জলিতে পাওয়া যাইবে। কৌতূহলী পাঠক একটু মিলাইয়া পাঠ করিলেই এই উক্তির সত্যতা সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হইতে পারিবেন। অর্থাৎ, রবীন্দ্রনাথ যে ব্রহ্মজ্ঞ ভক্তরাজ পুরুষ, ইহাতে আর সন্দেহ থাকিবে না।


 একটি গান উদ্ধৃত করিয়া গীতঞ্জলির আলোচনার উপসংহার করা যাইতেছে। গানটিতে রবীন্দ্রনাথ নিজের একটি চরম অভিলাষ জানাইয়া বিদায় লইয়াছেন। এই বিদায়-অভিলাষ কোন্ পুরুষের, তাহাও গানখানিতেই জানা যাইবে—

যাবার দিনে এই কথাটি
বলে যেন যাই—
যা দেখেছি যা জেনেছি
তুলনা তার নাই।

এই জ্যোতিঃ সমুদ্র মাঝে
যে শতদল পদ্ম রাজে
তারই মধু পান করেছি,
ধন্য আমি তাই—
যাবার দিনে এই কথাটি
জানিয়ে যেন যাই।

বিশ্বরূপের খেলাঘরে
কতই গেলেম খেলে,
অপরূপকে দেখে গেলেম
দুটি নয়ন মেলে।

পরশ যাঁরে যায় না করা
সকল দেহে দিলেন ধরা।
এইখানে শেষ করেন যদি
শেষ করে দিন তাই—
যাবার বেলা এই কথাটি
জানিয়ে যেন যাই।

 কি তিনি জানাইয়া গিয়াছেন, সে প্রশ্ন নিশ্চয়ই আমাদের শান্ত হইয়াছে। তিনি ব্রহ্মকে জানিয়াছেন, এই একটিমাত্র কথাই রবীন্দ্রনাথ সারা জীবন ভরিয়া নানাভাবে জানাইয়া গিয়াছেন।