ঋষি রবীন্দ্রনাথ/৫
( ৫ )
রবীন্দ্রনাথ ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষ কিনা, ইহাই আমাদের বিচার্য প্রশ্ন। সাধকের আপন ‘উপলব্ধি এবং শাস্ত্রবাক্য’ এই কষ্টিপাথরটি আমরা গ্রহণ করিয়াছি প্রশ্নটির বিচারের জন্য। রবীন্দ্রনাথের জীবনের প্রথম আধ্যাত্মিক উপলব্ধিটির বিচার ও বিশ্লেষণ করা হইয়াছে, অধুনা তাহার দ্বিতীয় একটি উপলব্ধিকে প্রমাণ হিসাবে উপস্থিত করা যাইতেছে।
তখন রবীন্দ্রনাথ পদ্মায় বোটে থাকেন, সেখানে তাঁহার জীবনযাত্রা ছিল লোকালয় হইতে দূরে। মাঝে মাঝে তিনি সাজাদপুরে আসিতেন, খালের পারে একটা বাড়ি তাহার দোতালার ঘরে তিনি থাকিতেন। খালের এ-পারেই ছিল একটা হাট, সেখানে বিচিত্র জনতা, তাঁহার দোতালার ঘর হইতে লোকালয়ের এই লীলা তিনি অবসর মত দেখিতেন। সেই সময়কার একদিনের উপলব্ধির কিছু বিবরণ তিনি লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন। ইহা তাঁহার জীবনের প্রথম উপলব্ধিরই পুনরাবৃত্তি বলিয়া বাহ্যত মনে হইতে পারে, কিন্তু বস্তুত ইহা সম্পূর্ণ নূতন এক গভীরতম উপলব্ধি। উপলব্ধিটির যে-বিবরণ তিনি লিপিবদ্ধ করিয়াছেন, তাহা এই—
“দোতালার জানলায় দাঁড়িয়ে সেদিন দেখছিলুম, সামনের আকাশে নববর্ষার জলভারনত মেঘ, নীচে ছেলেগুলো নতুন জলধারার ডাক শুনে মেতে উঠেচে, তাদের মধ্যে দিয়ে প্রাণের তরঙ্গিত কল্লোল। আমার মন সহসা আপন খোলা দুয়ার দিয়ে বেরিয়ে গেল বাইরে সুদূরে। অত্যন্ত নিবিড়ভাবে আমার অন্তরে একটা অনুভূতি এল, সামনে দেখতে পেলুম নিত্যকালব্যাপী সর্বানুভূতির অনবচ্ছিন্ন ধারা, নানা প্রাণের বিচিত্র লীলাকে মিলিয়ে নিয়ে একটি অখণ্ড লীলা। নিজের জীবনে যা বোধ করচি, যা ভোগ করচি, চারিদিকে ঘরে ঘরে জনে জনে মুহূর্তে মুহূর্তে যা-কিছু উপলব্ধি চলেচে, সমস্ত এক হয়েছে একটি বিরাট অভিজ্ঞতার মধ্যে। অভিনয় চলেচে নানা নাটকে নিয়ে, সুখ দুঃখের নানা খণ্ড-প্রকাশ চলচে তাদের প্রত্যেকের স্বতন্ত্র জীবনযাত্রায়, কিন্তু সমস্তটার ভিতর দিয়ে একটা নাট্যরস প্রকাশ পাচ্চে এক পরম দ্রষ্টার মধ্যে যিনি সর্বানুভূঃ। এতকাল নিজের জীবনে সুখ-দুঃখের যে-সব অনুভূতি একান্তভাবে আমাকে বিচলিত করেচে, তাকে দেখতে পেলুম দ্রষ্টারূপে এক নিত্যসাক্ষীর পাশে দাঁড়িয়ে।
“এমনি করে আপনা থেকে বিবিক্ত হয়ে সমগ্রের মধ্যে খণ্ডকে স্থাপন করবামাত্র নিজের অস্তিত্বের ভার লাঘব হয়ে গেল। তখন জীবনলীলাকে রসরূপে দেখা গেল কোনো রসিকের সঙ্গে এক হয়ে। আমার সেদিনকার এই বোধটি নিজের কাছে গভীরভাবে আশ্চর্য হয়ে ঠেকল।
“একটা মুক্তির আনন্দ পেলুম।স্নানের ঘরে যাবার পথে একবার জানলার কাছে দাঁড়িয়েছিলাম ক্ষণকালের অবসর যাপনের কৌতুকে।সেই ক্ষণকাল এক মুহূর্তে আমার সামনে বৃহৎ হয়ে উঠল। চোখ দিয়ে জল পড়চে তখন ইচ্ছা করছে সম্পূর্ণ আত্মনিবেদন ক’রে ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করি কাউকে। কে সেই আমার পরম অন্তরঙ্গ সঙ্গী যিনি আমার সমস্ত ক্ষণিককে গ্রহণ করচেন তাঁর নিত্যে। এষোহস্য পরম আনন্দঃ, আমার মধ্যে এ এবং সে- এই এ যখন সেই সে-র দিকে এসে দাঁড়ায় তখন তার আনন্দ॥”
এই উপলব্ধির মধ্যে প্রধান বা মূল কথা যেটি, তাহাকেই প্রথম গ্রহণ করা যাইতেছে। সেই প্রধান কথাটি হইল এই—“এতকাল নিজের জীবনে সুখদুঃখের যে-সব অনুভূতি একান্তভাবে আমাকে বিচলিত করেচে, তাকে দেখতে পেলুম দ্রষ্টারূপে এক নিত্যসাক্ষীর পাশে দাঁড়িয়ে।” এখন প্রশ্ন, কে এই ‘নিত্যসাক্ষী’?
ইনিই যে অন্তর্যামী ব্রহ্ম, তাহা আমরা একটু পরেই যথাস্থানে দেখিতে পাইব। আপাততঃ এইটুকু বলিয়া রাখা যাইতেছে যে, এই নিত্যসাক্ষীর পাশে দাঁড়াইয়াছিলেন বলিয়া রবীন্দ্রনাথ নিজেও দ্রষ্টার আসনে উন্নীত হইয়াছিলেন। এই নিত্যসাক্ষীর পাশে দাঁড়াইয়া দেখিলেই খণ্ডকে উত্তীর্ণ হইয়া ‘অখণ্ডলীলাকে’ দেখা সম্ভবপর হয়; তাঁহার পাশে স্থান গ্রহণ করিলেই ‘সমগ্রের মধ্যে খণ্ড’আপন অর্থ— ও সার্থকতা পায় এবং এই নিত্যসাক্ষীর পাশে দাঁড়াইতে পারিলেই নিজের অস্তিত্বের ভার লাঘব’ হইয়া যায়। ব্রহ্মই যে এই নিত্যসাক্ষী, তাহা রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধির বিবরণেই পাওয়া যায়; তাই দেখা যায় যে, এই নিত্যসাক্ষীকে তিনি বলিয়াছেন— ‘পরমদ্রষ্টা’ এবং ‘সর্বানুভূঃ’।
গীতায় শ্রীভগবান বলিয়াছেন,—
“শরীরকে ক্ষেত্র বলা হয় এবং প্রতি দেহে আমাকেই ক্ষেত্রজ্ঞ (সাক্ষী) বলিয়া জানিবে।”
এখানে বলা হইয়াছে যে, স্থাবর-জঙ্গম সর্বক্ষেত্রে ভগবানই একমাত্র ক্ষেত্রী, সাক্ষী বা দ্রষ্টা। গীতা আরও বলিয়াছেন—
উপদ্রষ্টানুমন্তা চ ভর্তা ভোক্তা মহেশ্বরঃ।
পরমত্মেতি চাপ্যুক্তো দেহেঽস্মিন পুরুষঃ পরঃ॥
—এই দেহে পরমপুরুষ পরমাত্মা মহেশ্বর বিরাজিত আছেন; তিনি সাক্ষী, অনুমন্তা, ভর্তা ও ভোক্তা॥
পূর্বের চেয়ে আরও পরিষ্কার ও স্পষ্ট করিয়া এখানে বলা হইয়াছে যে, পরমাত্মা বা ব্রহ্ম এই দেহেই আছেন এবং তিনিই একমাত্র দ্রষ্টা।
প্রাচীনতম উপনিষদ বৃহদারণ্যকে এই তত্ত্বটি বিশদভাবে বিবৃত হইয়াছে: সেখানে দেখা যায় যে, জনকের রাজসভায় ব্রহ্ম-বিচারে গার্গীর প্রশ্নের উত্তরে মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক্য বলিয়াছেন,—“হে গার্গী! সেই অক্ষর (ব্রহ্ম) অ-দৃষ্ট কিন্তু দ্রষ্টা ...... তিনি ভিন্ন অন্য দ্রষ্টা নাই, অন্য বিজ্ঞাতা নাই॥”
উপনিষদ এই তত্ত্বই স্পষ্ট ঘোষণা করিয়াছেন যে, ব্রহ্মই একমাত্র দ্রষ্টা বা সাক্ষী। ইঁহাকেই কেনোপনিষদ বলিয়াছেন—“দৃষ্টির দ্রষ্টা” এবং শ্বেতাশ্বতরোপনিষদ বলিয়াছেন—“প্রধানক্ষেত্রজ্ঞপতি”। আর তাঁহাকেই রবীন্দ্রনাথ বলিয়াছেন ‘পরমদ্রষ্টা’ এবং ‘নিত্যসাক্ষী’। মানুষ বা জীব সর্বজ্ঞ নহে, একমাত্র ঈশ্বরই সর্বজ্ঞ এবং সর্বসাক্ষী, এ তত্ত্ব সর্বশাস্ত্রেই স্বীকৃত।
কিন্তু ইহাকেই যে রবীন্দ্রনাথ দেখিয়াছিলেন এবং তাঁহারই পাশে গিয়া দাঁড়াইয়াছিলেন, তাহার প্রমাণ কি? সেই প্রমাণটি উপস্থাপিত করিবার পূর্বে উপনিষদের একটু সাহায্য লওয়া যাইতেছে।
বৃহদারণ্যক উপনিষদে জানা যায় যে, ঋষি উদ্দালকের প্রশ্নের উত্তরে মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক্য বলিয়াছেন—“এষ তে আত্মা অন্তর্যামী অমৃত”, ব্রহ্মই অন্তর্যামী ও অমৃত এবং তিনিই তোমার আত্মা॥ অতঃপর মহর্ষি অতি বিস্তৃতভাবে এই তত্ত্বটির উপদেশ দান করিয়াছেন—
“যঃ পৃথিব্যাং তিষ্ঠন্ পৃথিব্যা অন্তরো যং পৃথিবী ন বেদ যস্য পৃথিবী শরীরং যঃ পৃথিবীমন্তরো যময়ত্যেষ আত্মাহন্তর্যাম্যমৃত... ইত্যাদি”—যিনি পৃথিবীতে থাকিয়া পৃথিবীর অন্তরবর্তী পৃথিবী যাঁহাকে জানে না, পৃথিবী যাঁহার শরীর, যিনি পৃথিবীকে যমন অর্থাৎ নিয়ন্ত্রণ করেন—তিনিই অন্তর্যামী ও অমৃত এবং তোমার আত্মা......ইত্যাদি॥
যিনি বিশ্বসৃষ্টির কর্তা ও পরিচালক, তিনিই জীবদেহে অন্তর্যামীরূপে অবস্থিত এবং তিনিই জীবের আত্মা। এই অন্তর্যামী আত্মাকে জানিলেই সমগ্র সৃষ্টর অন্তর্যামী ব্রহ্মকে জানা হয়।
এই তত্ত্বই রবীন্দ্রনাথের আলোচ্য উপলব্ধিতে অভিব্যক্ত হইয়াছে। তাই তিনি বলিয়াছেন যে, এক নিত্যসাক্ষীর পাশে দাঁড়াইয়া তিনি দেখিয়াছেন—সমস্ত খণ্ডকে লইয়া এক অখণ্ডের নিত্যলীলা। এই নিত্যসাক্ষীর দিকে মুখ ফিরাইয়া তাই তাঁহাকে বলিতে শোনা যায়—“কে সেই আমার পরম অন্তরঙ্গ সঙ্গী যিনি আমার সমস্ত ক্ষণিককে গ্রহণ করেছেন তাঁর নিত্যে।” মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক্য যাঁহাকে ‘অন্তর্যামী অমৃত আত্মা’ বলিয়াছেন, তাঁহাকেই রবীন্দ্রনাথ ‘আমার পরম অন্তরঙ্গ সঙ্গী’ বলিযা দেখিয়াছেন এবং জানাইয়াছেন।
অহং-এর কেন্দ্র হইতে দৃষ্টি অর্থাৎ চৈতন্য যখন এই নিত্যসাক্ষী পরম অন্তরঙ্গ সাক্ষীর কেন্দ্রে স্থাপিত হয়, তখনই দৃষ্টির আবরণ উন্মোচিত হয় এবং অখণ্ড দৃষ্টির আলোতে জগতেরও সত্যরূপ আনন্দরূপ উদ্ঘাটিত হয়। ব্রহ্ম যিনি বৃহৎ তাঁহার পাশে গিয়া দাঁড়াইলে বড়োকে দেখা হয়, তখন জগতের যাবতীয় খণ্ডের আড়ালে বা মধ্যেও বড়োকেই দেখিতে পাওয়া যায়। তখন খণ্ড তাহার ক্ষুদ্র সীমার মধ্যেই অখণ্ডেরই লীলা উদ্ঘাটিত করে, সীমা তাহার সীমার মধ্যেই অসীমের লীলাক্ষেত্র হইয়া দেখা দেয়। তাঁহার পাশে গিয়া দাঁড়াইলে, তাঁহার অলোতে চোখ মেলিলে এই বিচিত্র সৃষ্টি যে রূপ লইয়া দেখা দেয়, তাহা হইল—লীলা বা মহাকাব্য।
ব্রহ্মসূত্রেও ভগবান বেদব্যাস সৃষ্টিকে বলিয়াছেন ব্রহ্মের লীলা। রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধিতেও এই সত্যের সাক্ষাৎ আমরা পাই। তাঁহাকেও আমরা বলিতে শুনি—“সামনে দেখতে পেলুম নিত্যকালব্যাপী একটি সর্বনুভূতির অনবচ্ছিন্ন ধারা, নানা প্রাণের বিচিত্র লীলাকে মিলিয়ে নিয়ে একটি অখণ্ড লীলা।” নিত্যসাক্ষীকে দেখার কথা যদি এই উপলব্ধিতে নাও থাকিত, তথাপি শুধু এই ‘অখণ্ডলীলা’ দর্শন ও অনুভূতি হইতেই জানা যাইত যে, রবীন্দ্রনাথ ব্রহ্মজ্ঞ, রবীন্দ্রনাথ ঋষি।