( ৬ )

 নিত্যসাক্ষীর পাশে দাঁড়াইয়া দেখিলে এই বিশ্ব একটি মহাকাব্যরূপে দেখা দেয়, একথা বলা হইয়াছে। মহাকবির এই বিশ্বকাব্য দেখিয়া বৈদিক ঋষি বলিয়াছেন—

অস্তি সন্তং ন জহাতি
অস্তি সন্তং ন পশ্যতি।
দেবস্য পশ্য কাব্যং
ন মমার ন জীর্যতি।

 —কাছে আছেন তাঁকে ছাড়া যায় না, কাছে আছেন তাঁকে দেখা যায় না, কিন্তু দেখো সেই দেবের (ব্রহ্মের) কাব্য সে-কাব্য মরে না, জীর্ণ হয় না॥

 রবীন্দ্রনাথও যে এই দেবস্য কাব্যং-ই দেখিয়াছিলেন, তাঁহার উপলব্ধিতে তাহার প্রমাণ পাওয়া যায়। তিনি বলিয়াছেন—

 "অভিনয় চলেচে নানা নাটক নিয়ে, সুখঃদুঃখের নানা প্রকাশ চলচে তাদের প্রত্যেকের স্বতন্ত্র জীবনযাত্রায়, কিন্তু সমস্তটার ভিতর দিয়ে একটা নাট্যরস প্রকাশ পাচ্চে পরমদ্রষ্টার মধ্যে যিনি সর্বানুভূঃ। জীবনলীলাকে রসরূপে দেখা গেল কোনো রসিকের সঙ্গে এক হয়ে।”

 বৈদিক ঋষি যাহাকে বলিয়াছেন ‘দেবস্য কাব্যং’, রবীন্দ্রনাথ তাহাকে বলিয়াছেন ‘নাট্য’ এবং বৈদিক ঋষি যাঁহাকে বলিয়াছেন ‘দেবস্য’, তাঁহাকেই রবীন্দ্রনাথ বলিয়াছেন ‘রসিক’, সর্বানুভূঃ।

 প্রসঙ্গত একটা কথা বলা যাইতেছে যে, এখানে যিনি নাট্যকার, রসিক, পরম অন্তরঙ্গ সাক্ষী, নিত্যসাক্ষী ইত্যাদি রূপে অভিব্যক্ত ও অভিহিত, তাঁহাকেই তাঁহার কবিজীবনে রবীন্দ্রনাথ বলিয়াছেন— ‘জীবনদেবতা’। ১৩১৪ সালের মাঘ মাসে ‘বঙ্গদর্শন’ পত্রিকায় নিজের আত্মপরিচয় প্রবন্ধে তিনি লিখিয়াছেন—

 “এই যে কবি, যিনি আমার সমস্ত ভালোমন্দ, আমার সমস্ত অনুকূল ও প্রতিকূল উপকরণ লইয়া আমার জীবনকে রচনা করিয়া চলিয়াছেন, তাঁহাকেই আমার কাব্যে আমি ‘জীবনদেবতা’ নাম দিয়াছি। তিনি যে কেবল আমার এই ইহজীবনের সমস্ত খণ্ডতাকে ঐক্যদান করিয়া বিশ্বের সহিত আমার সামঞ্জস্য স্থাপন করিতেছেন, আমি তাহা মনে করি না— আমি জানি, অনাদিকাল হইতে বিচিত্র বিস্মৃত অবস্থার মধ্য দিয়া তিনি আমাকে আমার এই বর্তমান প্রকাশের মধ্যে উপনীত করিয়াছেন:—সেই বিশ্বের মধ্য দিয়া প্রবাহিত অস্তিত্বধারার বৃহৎ স্মৃতি তাঁহাকে অবলম্বন করিয়া আমার অগোচরে আমার মধ্যে রহিয়াছে॥”

 এই ‘জীবনদেবতা’ এই রসিক এবং এই মহাকবিকে লক্ষ্য করিয়া রবীন্দ্রনাথ সত্তর বৎসর বয়সে আপন আত্মপরিচয়ে ঘোষণা করিয়াছেন—

 “আমি সেই বিচিত্রের দূত। বিচিত্রের লীলাকে অন্তরে গ্রহণ করে তাকে বাহিরে লীলায়িত করা—এই আমার কাজ।... আজ আমার আর সংশয় নেই, আমি চঞ্চলের লীলাসহচর।”

 পরবর্তীকালে ইহাকেই তিনি নাম দিয়েছেন—বিরাট পুরুষ, মহামানব। রবীন্দ্রনাথ নিজেই তাহা খুলিয়া বলিয়াছেন—“এখন নাম দিয়াছি মহামানব এই পরমাত্মা মানবপরমাত্মা, ইনি সদা জনানাং হৃদয়ে সন্নিবিষ্টঃ, ইনি আছেন সর্বদা জনে জনের হৃদয়ে, সমস্ত মানুষের ভূত ভবিষ্যৎ বর্তমান নিয়ে তিনি সর্বজনের হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিতঃ।”

 এখন গোড়ার কথায় ফিরিয়া আসা যাক্। রবীন্দ্রনাথের জীবনের যে–উপলব্ধিটির আলোচনা এতক্ষণ করা গিয়াছে, আদিতেই বলা হইয়াছে যে, তাহার প্রধান কথাটি হইল—জীবন ও জগৎকে “দেখতে পেলুম দ্রষ্টারূপে এক নিত্যসাক্ষীর পাশে দাঁড়িয়ে। এমনি ক’রে আপনা থেকে বিবিক্ত হয়ে সমগ্রের মধ্যে খণ্ডকে স্থাপন করবামাত্র নিজের অস্তিত্বের ভার লাঘব হয়ে গেল।”

 উপলব্ধির এই প্রধান কথাটিই প্রধান প্রমাণ যে, রবীন্দ্রনাথ ব্রহ্মজ্ঞ, তিনি ঋষি। প্রমাণটির একটু শাস্ত্রীয় সমর্থন অতঃপর প্রদত্ত হইতেছে।

 শ্বেতাশ্বতর এবং মুণ্ডক উভয় উপনিষদে ব্রহ্ম সম্বন্ধে এই মন্ত্র দুইটি পাওয়া যায়—

দ্বা সুপর্ণা সযুজা সখায়া
সমানাং বৃক্ষ পরিষস্বজাতে।
তয়োরন্যঃ পিপ্পলং স্বাদু অত্তি
অনশ্নন অন্যো অভিচাকশীতি॥
সমানে বৃক্ষে পুরুষো নিমগ্নঃ
অনীশয়া শোচতি মুহ্যমানঃ।
জুষ্টং সদা পশ্যতি অন্যসীশম্
অস্য মহিমানমিতি বীতশোকঃ॥

 —দুইটি সুন্দর পক্ষী একই বৃক্ষে অধিষ্ঠিত আছে। তাহারা পরস্পর পরস্পরের সখা। তাহাদের মধ্যে একজন সুস্বাদু ফল ভক্ষণ করে; অপর ভক্ষণ করে না, শুধুই দেখে। একই বৃক্ষে একজন (জীব) নিমগ্ন হইয়া ঈশ্বরভাবের অভাবে মোহাচ্ছন্ন হইয়া শোক করে; কিন্তু সে যখন অন্যকে (ব্রহ্মকে) দেখিতে পায়, তখন তাঁহার মহিমা অনুভব করিয়া শোকের অতীত হয়॥

 একই বৃক্ষে দুই পক্ষী বলিতে উপনিষদ একই দেহে জীব এবং ব্রহ্মের সহঅবস্থিতি বুঝাইয়াছেন। জীব সংসারের সুখ-দুঃখের ভোক্তা, সংসারের শোক দুঃখে মুহ্যমান, সে যখন তাহার সখা ব্রহ্মকে দেখে, তখন শোকের অতীত হয়, ইহাই হইল উপনিষদের মন্ত্র দুটির নির্গলিতার্থ। রবীন্দ্রনাথের উপলব্ধির মধ্যে যাহাকে আমরা প্রধান কথা বলিয়াছি, তাহা এই মন্ত্রদুইটিরই আক্ষরিক অনুবাদ বলা যাইতে পারে।

 উপনিষদ বলিয়াছেন, “দুই সখা”, আর রবীন্দ্রনাথ বলিতেছেন—“আমার পরম অন্তরঙ্গ সঙ্গী।”

 উপনিষদ বলিয়াছেন ‘এক পাখী সুস্বাদু ফল ভক্ষণ করে’, আর রবীন্দ্রনাথ বলিতেছেন—“দেখতে পেলুম দ্রষ্টারূপে এক নিত্যসাক্ষীর পাশে বিচলিত করেচে”।

 উপনিষদ বলিয়াছেন, ‘একজন ফল ভক্ষণ করে না, শুধুই দেখে’, আর রবীন্দ্রনাথ বলিতেছেন—“নিত্যসাক্ষীর পাশে দাঁড়িয়ে”।

 উপনিষদ বলিয়াছেন, ‘যখন জীব অন্যকে (ব্রহ্মকে) দেখিতে পায়’, আর রবীন্দ্রনাথ বলিতেছেন—“দেখতে পেলুম দ্রষ্টারূপে এক নিত্যসাক্ষীর পাশে দাঁড়িয়ে”।

 উপনিষদ বলিয়াছেন, এই দেখার পরে ‘তখন সে (জীব) শোকের অতীত হয়’, আর রবীন্দ্রনাথ বলিতেছেন—“নিজের অস্তিত্বের ভার লাঘব হয়ে গেল।... একটা মুক্তির আনন্দ পেলুম”।

 অধিক বিশ্লেষণ আর আবশ্যক করে না, এখন বলা চলে যে, এই উপলব্ধিটিই সন্দেহাতীত প্রমাণ যে, রবীন্দ্রনাথ ব্রহ্মজ্ঞ, রবীন্দ্রনাথ ঋষি। আপনার মধ্যে নিজেকে এবং ব্রহ্মকে তিনি দেখিয়াছেন, আর দেখিয়াছেন—জগৎ ব্রহ্মেরই আনন্দলীলা।

 এত বড় প্রাপ্তি এবং এত বড় মুক্তির প্রথম প্রকাশটি রবীন্দ্রনাথের ক্ষেত্রে একটি আনন্দ-প্রণামের রূপ পরিগ্রহ করিয়াছে। তাই তাঁহার উপলব্ধিটির বিবরণের উপসংহারে আসিয়া পাওয়া যায় —

 “একটা মুক্তির আনন্দ পেলুম। চোখ দিয়ে জল পড়চে তখন, ইচ্ছে করচে সম্পূর্ণ আত্মনিবেদন ক’রে ভূমিষ্ঠ হয়ে প্রণাম করি কাউকে। কে সেই আমার পরম অন্তরঙ্গ সাক্ষী।”

 ইহাই রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্ম-প্রণাম। যাঁহাকে তিনি প্রণাম করিয়াছেন, যাঁহার নিকট সম্পূর্ণভাবে তিনি আত্মনিবেদন করিয়াছেন, তিনি যে ব্রহ্ম, সে কথা রবীন্দ্রনাথ গোপন করিতে পারেন নাই, তাঁহার উপলব্ধির শেষ কয়টি কথাতেই তাহা ব্যক্ত—

 “তখনি মনে হ’ল আমার একদিক থেকে বেরিয়ে এসে আর একদিকের পরিচয় পাওয়া গেল। এষোঽস্য পরম আনন্দঃ, আমার মধ্যে এ এবং সে—এই এ যখন সেই সে-র দিকে এসে দাঁড়ায় তখন তার আনন্দঃ।”

 উপনিষদের একই বৃক্ষের দুই পক্ষীকে এখানে রবীন্দ্রনাথ এ এবং সে বলিয়াছেন দেখা যায়। আর সেই সে-ই এই এ-র পরম আনন্দ, ইহাই তিনি প্রত্যক্ষকরিয়াছেন। বৃহদারণ্যক উপনিষদে দেখা যায় যে, মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক্য শিষ্য জনককে ব্রহ্মের উপনীত করিয়া ঠিক এই কথাই বলিয়াছেন—

 হে সম্রাট, “এষাঽস্য পরমা গতিঃ এষাহস্য পরমা সম্পদেষাহস্য পরমো লোক এষোহস্য পরম আনন্দ এতস্যৈবানন্দস্যান্যানি ভূতানি মাত্রামুপজীবন্তি” — হে সম্রাট, ইনিই জীবের পরমা গতি, ইনিই জীবের পরম সম্পদ, ইনিই জীবের পরম ধাম, ইনিই জীবের পরম আনন্দ। এই আনন্দেরই অংশমাত্র অবলম্বনে সমস্ত প্রাণী ও ভূতজগৎ জীবন ধারণ করে॥

 এক কথায়, জীবের মক্তি, পরিপূর্ণতা, আনন্দ, অমৃত ইত্যাদি সমস্তই এই ব্রহ্মের মধ্যে এবং সেই ব্রহ্ম এই দেহেই জীব-সখারূপে অবস্থিত। ইহাকেই পরম অন্তরঙ্গ সঙ্গী, নিত্যসাক্ষী, পরমদ্রষ্টা, সর্বানুভূঃ প্রভৃতি নামে ডাকিয়া আত্মনিবেদনের প্রণাম রবীন্দ্রনাথ জানাইয়াছেন এবং প্রণামান্তে ঘোষণা “আমার একদিক থেকে বরিয়ে এসে আর একদিকের পরিচয় পাওয়া গেল।”

 তাঁহার উপলব্ধি এবং অভিজ্ঞতার বিবরণ কে কিভাবে গ্রহণ করিবেন এবং বুঝিবেন, এই বিষয়ে রবীন্দ্রনাথের মনে হয়তো কিছু দ্বিধা বা সংশয় ছিল। হয়তো সাধারণের নিকট ইহার যথার্থ অর্থ বোধগম্য বা গ্রহণযোগ্য নাও হইতে পারে, ইহাই ছিল তাঁহার ভয়। তাই তিনি অভিমত ব্যক্ত করিয়া গিয়াছেন—

 “এই আন্তরিক অভিজ্ঞতা অনেক কাল থেকে ভিতরে ভিতরে আমার মধ্যে প্রবাহিত—তাকে আমার ব্যক্তিগত চিত্তপ্রকৃতির একটা বিশেষত্ব বললে তাই আমাকে মেনে নিতে হবে।”

 তাঁহার এই আশঙ্কা নিতান্ত অমূলক, ইহা যদি কোন চিত্তের ‘বিশেষত্ব’ হয় তবে তাহা একমাত্র ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের চিত্তেরই বিশেষত্ব।