(৭)

 ব্রহ্মদর্শনের পর বৈদিক ঋষি ঘোষণা করিয়াছিলেন—

বেদাহমেতং পুরুষং মহান্তং
আদিত্যবর্ণং তমসঃ পরস্তাৎ॥

 —হে বিশ্ববাসী, তোমরা সকলে শোন, তমসার পারে সেই জ্যোতির্ময় মহান পুরুষকে আমি জানিয়াছি॥

 রবীন্দ্রনাথের মুখেও এইরূপে একটি ব্রহ্মঘোষণা উচ্চারিত হইয়াছে এবং তাহাই অতঃপর প্রমাণ হিসাবে বিচারের জন্য গ্রহণ করা যাইতেছে।

 এই উপলব্ধিটির বিশ্লেষণে আমরা দেখিতে পাইব, রবীন্দ্রনাথ স্পষ্টভাবেই জানাইয়াছেন যে, তিনি ব্রহ্মকে দেখিয়াছেন। আর, পূর্বে যে-সাধনার কথা বলা হইয়াছে, তাহারও স্পষ্ট ইঙ্গিত এই উপলব্ধিটির মধ্যেই পাওয়া যাইবে।

 রবীন্দ্রনাথের আধ্যাত্মিক উপলব্ধির যে কয়টি বিবরণ পাওয়া যায়, তন্মধ্যে বর্তমান উপলব্ধিটিই আমাদের আলোচ্য বিষয়ে বা প্রসঙ্গে শ্রেষ্ঠতম প্রমাণ বা সাক্ষ্যরূপে অন্তত আমার নিকট মনে হইয়া থাকে। কাজেই, রবীন্দ্রনাথের এই ব্রহ্মোপলব্ধিটির অপেক্ষাকৃত একটু বিশদ আলোচনা করা যাইতেছে।

 ব্রহ্মদর্শনের পরে রবীন্দ্রনাথের মুখে যে উদাত্ত ঘোষণা উচ্চারিত হইয়াছে, তাহা এই—

ধূলির আসনে বসি ভূমারে দেখেছি ধ্যান চোখে
আলোকের অতীত আলোকে।

অণু হতে অণীয়ান মহৎ হইতে মহীয়ান
ইন্দ্রিয়ের পারে তার পেয়েছি সন্ধান।

ক্ষণে ক্ষণে দেখিয়াছি দেহের ভেদিয়া যবনিকা
অনির্বাণ দীপ্তিময়ী শিখা॥

 রবীন্দ্রনাথের এই উপলব্ধিতে দেখা যায় যে, তিনটি দর্শনের কথা রহিয়াছে—

 তিনি ভূমাকে দেখিয়াছেন, অণু হইতে অণীয়ান মহৎ হইতে মহীয়ানকে দেখিয়াছেন এবং দেহের যবনিকার আড়ালে দীপ্তিময়ী শিখাকে দেখিয়াছেন।

 এই তিনটি দর্শনে তিনি ব্রহ্মকেই দেখিয়াছেন কিনা, ইহাই হইবে আমাদের প্রধান বিচার্য। আর এই তিনটি দর্শনের আড়ালে কি এবং কোন্ সাধনার ইঙ্গিত পাওয়া যায়, তাহাই হইবে আমাদের দ্বিতীয় জিজ্ঞাসা। এই জিজ্ঞাসাটির পৃথক কোন আলোচনার আবশ্যক করিবে না, মূল বিচার্যের বিশ্লেষণের মধ্যেই রবীন্দ্রনাথের সাধনার পরিচয়ও স্বতই আসিয়া পড়িবে।

 তিনি ভূমাকে দেখিয়াছেন, তিনটি দর্শনের মধ্যে প্রথমে এই দেখা বা উপলব্ধিকেই গ্রহণ করা যাইতেছে। স্বভাবতই প্রশ্ন হইবে, কে এই ভূমা, যাহাকে রবীন্দ্রনাথ দেখিয়াছেন?

 ভূমা শব্দের আভিধানিক অর্থ হইল মহান (ভূমা—বহু+ইমন্ = মহান)। উপনিষদে ব্রহ্মেরই (ব্রহ্ম-শব্দেরও অভিধানিক অর্থ বৃহৎ) এক নাম বলা হইয়াছে ভূমা। প্রসিদ্ধ ছান্দোগ্য উপনিষদে নারদ-সনৎকুমার সংবাদে এই ভূমাতত্ত্ব উপদিষ্ট হইয়াছে। আত্মজিজ্ঞাসু নারদকে সনৎকুমার ব্রহ্মবিদ্যায় উপদেশ করিয়া বলিয়াছেন—

 “যো বৈ ভূমা তৎসুখং নাল্পে সুখং ভূমৈব সুখং”—যাহা ভূমা, তাহাই সুখ; যাহা অল্প, তাহাতে সুখ নাই। ভূমাই সুখ॥

 অতঃপর এই ভূমার পরিচয়ে ভগবান সনৎকুমার বলিয়াছেন, “যো বৈ ভূমা তদমৃতমথ যদল্প তন্মর্তং”— যাহা ভূমা তাহাই অমৃত, আর যাহা অল্প তাহাই মরণশীল॥

 উপদেশের উপসংহার করিয়া সনৎকুমার বলিয়াছেন, “স বা এষ এবং পশ্যন্ ..আত্মরতিরাত্মক্রীড় আত্মমিথুন আত্মানন্দং স্ব স্বরাড়্ ভবতি”—

 এই ভূমাকে যিনি এই প্রকারে দর্শন করেন, তিনি আত্মরতি, আত্মক্রীড়, আত্মমিথুন (আত্মাতে যাঁহার মিথুন ভাব) এবং আত্মানন্দ হন তিনি স্বরাট (স্ব+রাজ = আত্মেশ্বর, স্বাধীন, কিম্বা আপনাতে আপনি বিরাজমান) হন॥

 এখানে উল্লেখ থাকে যে, আত্মাতে যাঁহার রতি, আত্মাতে যাঁহার ক্রীড়া, আত্মাতেই যাঁহার আনন্দ, সেই পুরুষকেই উপনিষদে ‘ব্রহ্মবিদ্ বরিষ্ঠ” বলা হইয়াছে।

 দেখা গেল যে ভূমা বলিতে উপনিষদ ব্রহ্মকেই বুঝাইয়াছেন এবং ভূমাতত্ত্ব বুঝাইতে ব্রহ্মতত্ত্বই বুঝাইয়াছেন। কাজেই ভূমাকে দর্শন মানেই ব্রহ্মদর্শন, এই বিষয়ে সন্দেহের কোন অবকাশ নাই। রবীন্দ্রনাথ বলিয়াছেন যে, তিনি ভূমারে দেখিয়াছেন। ইহার সোজা অর্থ—তাঁহার ব্রহ্মদর্শন হইয়াছে, এই স্পষ্ট ঘোষণাই রবীন্দ্রনাথ করিয়াছেন।

 নিজের উপলব্ধি এবং তাহা স্বমুখে ঘোষণা, ইহাকে কখনো রবীন্দ্রনাথের ব্রহ্মজ্ঞতার পরিচয়রূপে গ্রহণ করা যাইতে পারে না, যতক্ষণ না শাস্ত্রের সমর্থন পাওয়া যায়। কাজেই এখন আমাদের শাস্ত্রের একটু আশ্রয় গ্রহণ করিতে হইবে।

 শাস্ত্রের সমর্থন সংগ্রহে প্রথমেই একটি যে সমস্যা দেখা দিবে, তাহার উল্লেখ দরকার। সমস্যাটি এই—কেহ যদি নিজ মুখে বলে যে, তাহার জিভ নাই, সে কথা বিশ্বাস করা চলে কি?

 ব্রহ্মকে দেখিয়াছি, ভূমাকে দেখিয়াছি ইত্যাদি উক্তিও তদ্রূপ স্বতঃসিদ্ধ অবিশ্বাস্য। কারণ উপনিষদ অসংখ্যবার বলিয়াছেন যে, ব্রহ্মকে দেখা যায় না; ব্রহ্ম অনির্দেশ্য নির্দেশের অতীত, অলক্ষ্য লক্ষণের অতীত, অবাচ্য বচনের অতীত। উপনিষদ আরও বলেন যে, ব্রহ্ম অজ্ঞেয়, ব্রহ্ম জ্ঞানাতীত—তিনি অবাঙমনস গোচর।

 ব্রহ্মকে দেখা যায় না, জানা যায় না, এই বিষয়ে অসংখ্য শ্রুতি, অর্থাৎ উপনিষদের উপদেশ রহিয়াছে। কয়েকটি শ্রুতি উদ্ধৃত করা যাইতেছে।

 কঠোপনিষদ বলেন, “ন সংদৃশে তিষ্ঠতি রূপমস্য ন চক্ষুষা পশ্যতি কশ্চিদেনম্”—তাঁহার রূপ দৃষ্টিগোচর নহে, চক্ষুর দ্বারা কেহ তাঁহাকে দেখিতে পায় না।

 “নৈব বাচা ন মনসা প্রাপ্তং শক্যো ন চক্ষুষা” (কঠ)—তিনি বাক্য মন চক্ষু, কিছুরই প্রাপ্য নহেন॥

 মুণ্ডকোপনিষদ বলেন, “ন চক্ষুষা গৃহ্যতে.....”— তিনি চক্ষুর গ্রাহ্য নহেন, ইন্দ্রিয়ের গ্রাহ্য নহেন, ইত্যাদি॥

 তৈত্তিরীয়োপনিষদ বলেন, “যতো বাচো নিবর্তন্তে অপ্রাপ্য মনসা সহ”—বাক্য ও মন যাঁহার নাগাল না পাইয়া ফিরিয়া আসে।

 কোনোপনিষদ বলেন,“ন তত্র চক্ষুর্গচ্ছতি ন বাকগচ্ছতি ন মনো ন বিস্মো ন বিজানীমো যথৈতদনুশিষ্যাৎ”— সেখানে চক্ষু যাইতে পারে না, বাক্য যাইতে পারে না, মন যাইতে পারে না, বুদ্ধি যাইতে পারে না; তাঁহাকে আমরা জানি না, কিরূপে তাঁহার উপদেশ দেওয়া যাইবে।

 উপনিষদের আদি উপদেষ্টা মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক্য পূর্বোক্ত সমস্ত উক্তিকে বা তত্ত্বকে একটি কথায় পত্নী মৈত্রেয়ীকে উপদেশ করিয়াছেন।

 “বিজ্ঞাতারমরে কেন বিজানীয়াৎ” — হে প্রিয়ে, যিনি সর্বজ্ঞানের একমাত্র কর্তা, সেই বিজ্ঞাতাকে আবার কিসের দ্বারা জানিবে।

 অধিক শ্রুতির আর উদ্ধৃতির আবশ্যক করে না, যে কয়টি শ্রুতি উদ্ধৃত হইল, তাহা হইতেই জানা যাইতেছে যে, সর্বোপনিষদেরই উপদেশ—ব্রহ্ম ‘ন চক্ষুষা গৃহ্যতে’, তাঁহার ‘রূপম ন চক্ষুষা পশ্যতি’। এক কথায়-ব্রহ্মকে চোখে দেখা যায় না, জানা যায় না।

 অথচ রবীন্দ্রনাথ বলিতেছেন—‘ভূমারে দেখেছি’। এই সমস্যার মীমাংসা কি?

 যাঁহাকে দেখা যায় না, সেই ব্রহ্মকে তিনি দেখিয়াছেন, তাঁহার এই উক্তির মধ্যে, উপলব্ধির মধ্যে নহে, যে একটি স্বতঃবিরোধ রহিয়াছে, তাহা রবীন্দ্রনাথের দৃষ্টি এড়ায় নাই। তাই তৈত্তিরীয়োপনিষদের নিম্নোক্ত মন্ত্রটি উদ্ধৃত করিয়া তিনি বলিয়াছেন—

যতো বাচো নিবর্তন্তে অপ্রাপ্য মনসাসহা।
 আনন্দং ব্রহ্মণো বিদ্বান। ন বিভেতি কদাচন।।

 “—এমন অদ্ভুত বিরদ্ধ কথা একই শ্লোকের দুই চরণের মধ্যে তো এমন সুস্পষ্ট করে কোথাও শোনা যায়নি। শুধু বাক্য ফেরে না, মনও তাঁকে না পেয়ে ফিরে আসে, একেবারে সাফ জবাব। অথচ সেই ব্রহ্মের আনন্দকে যিনি জেনেছেন, তিনি আর কিছু থেকে ভয় পান না। তবেই তো যাঁকে একেবারে জানা যায় না, তাঁকে এমনি জানা যায় যে, আর কিছু থেকেই ভয় থাকে না। সেই জানাটা কিসের জানা?”

 যাঁহাকে জানা যায় না, সেই ব্রহ্মকে রবীন্দ্রনাথ কি ভাবে জানিয়েছেন? তিনি নিজে বলিয়াছেন—“ভূমারে দেখেছি ধ্যান চোখে।”

 ভূমাকে ব্রহ্মকে সত্যই ধ্যানচোখে দেখা যায় কিনা, তাহাই অতঃপর অনুসন্ধান করা যাইতেছে।

 ভূমাতত্ত্ব যে ছন্দ্যোগ্য উপনিষদে উপদিষ্ট হইয়াছে, সেই উপনিষদেই দেখা যায়, বলা হইয়াছে, ‘মনো ইমাং দৈবং চক্ষুং’—মন এই সাধকের দৈবচক্ষু।

 এখানে স্পষ্ট উপদেশ রহিয়াছে যে, চক্ষুরাদি শারীরিক ইন্দ্রিয় ছাড়া মনরূপ এক দৈব চক্ষু আছে, যাহা দ্বারা ব্রহ্মকে দেখা যায়। ছান্দোগ্য যাহাকে দৈবচক্ষু বলিয়াছেন, রবীন্দ্রনাথ তাহাকেই বলিয়াছেন— ধ্যানচক্ষু।

 অপরাপর উপনিষদেও এই একই উপদেশের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়; যাঁহাকে দেখা যায় না, সেই ব্রহ্মকেই দেখার জানার কথা বা উপদেশ আছে। প্রাচীনতম উপনিষদই বৃহদারণ্যকে মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক্য পত্নী মৈত্রেয়ীকে উপদেশ দিয়াছেন—

 “আত্মা বা অরে দ্রষ্টব্যঃ শ্রোতব্যো মন্তব্যে! নিদিধ্যাসিতব্যো মৈত্রেয়ী।” এখনে ব্রহ্মকে দর্শনেরই স্পষ্ট উপদেশ রহিয়াছে এবং তাহার জন্য শ্রবণমনন-নিদিধ্যাসনের আবশ্যক, ইহাও বলা হইয়াছে।

 মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক্য ব্রহ্মদর্শনের জন্য ‘নিদিধ্যাসন’ বলিয়াছেন, তাহারই অন্য নাম ধ্যান এবং তাহাকেই রবীন্দ্রনাথ বলিয়াছেন ধ্যানচক্ষু বা ধ্যানদৃষ্টি।

 প্রত্যেক উপনিষদেই উপদেশ রহিয়াছে যে, ব্রহ্ম কখনো ইন্দ্রিয়ের বিষয় হন না। আবার প্রত্যেক উপনিষদেই ব্রহ্মকে দর্শনের উপদেশ আছে দেখা যায়। কয়েকটি শ্রুতি উদ্ধৃত হইতেছে, যেখানে দেখা শব্দটিই উপনিষদের ঋষি প্রয়োগ করিয়াছেন। যথা—

 মুণ্ডকোপনিষদ বলেন, “যং পশ্যন্তি যতয়ঃ ক্ষীণদোষাঃ”—যাঁহাকে শুদ্ধচিত্ত সাধকগণ দর্শন করেন।

 “তং পশ্যতে নিষ্কল ধ্যায়মানঃ”—সেই ব্রহ্মকে ধ্যানিগণ দর্শন করেন।

 “তদ্বিজ্ঞানেন পরিপশ্যন্তি ধীরা আনন্দরূপমমৃতং যদ্বিভাতি”—আনন্দস্বরূপ অমৃতস্বরূপ প্রকাশমান ব্রহ্মকে ধীর ব্যক্তিগণ বিশেষ দৃষ্টিতে দর্শন করেন ইত্যাদি॥

 শ্বেতাশ্বতরোপনিষদ বলেন “তে ধ্যানযোগানুগত্য অপশ্যন”—ঋষিগণ তাঁহাকে ধ্যানযোগে দর্শন করিয়াছিলেন।

 “তমাত্মস্থং পশ্যতি বীতশোক”—সেই ব্রহ্মকে দর্শন করিয়া বীতশোক হন।

 “তমাত্মস্থং যেহনুপশ্যন্তি ধীরাঃ”—নিজের আত্মাতেই ধীরগণ তাঁহাকে দর্শন করেন ইত্যাদি॥

 কঠোপনিষদ বলেন—

এষঃ সর্বেষু ভূতেষু গূঢ় আত্মা ন প্রকাশতে
 দৃশ্যতে ত্বগ্র্যয়া বুদ্ধ্যা সূক্ষ্ময়া সূক্ষ্মদর্শিভিঃ ।

 —এই ব্রহ্ম সর্বভূতের মধ্যে গূঢ় অনুপ্রবিষ্ট, তিনি প্রকাশিত নহেন; সূক্ষ্মদর্শিগণই সূক্ষ্ম একাগ্র বুদ্ধির সাহায্যে তাঁহাকে দেখিতে পান॥

 উদ্ধৃত শ্রুতিসমূহে দেখা যায় যে, উপনিষদ যেখানেই ব্রহ্মদর্শনের কথা বলিয়াছেন, সেখানেই ধ্যানযোগ, অধ্যাত্মযোগ, নিদিধ্যাসন ইত্যাদির উপদেশ করিয়াছেন। রবীন্দ্রনাথের আলোচ্য উপলব্ধিতেও এই কথাই আমরা দেখিতে পাই, তিনিও বলিয়াছেন—“ভূমারে দেখেছি ধ্যানচোখে।”

 কাজেই ধ্যানচোখ বা ধ্যানদৃষ্টির সামান্য একটু বিশ্লেষণ প্রয়োজন। সেই বিশ্লেষণেই দেখা যাইবে যে, ধ্যানচক্ষু বা ধ্যানদৃষ্টির পশ্চাতে কি এবং কতখানি পূর্বসাধনা নিহিত থাকে। রবীন্দ্রনাথের জীবনে ব্যক্তিগত সাধনা সম্বন্ধে একটা ধারণা করিতে হইলে এই বিশ্লেষণটুকুকে পাশ কাটাইয়া যাইবার উপায় নাই।

 ধ্যান শব্দটি যোগের একটি বিশেষ পরিভাষা। কৌতূহলী পাঠক মহর্ষি পতঞ্জলির ‘যোগসূত্র’ পাঠ করিলে এই বিষয়ে বিস্তৃতভাবে জানিতে পারিবেন। বিস্তৃত আলোচনার অবকাশ বা প্রয়োজন বর্তমান ক্ষেত্রে নাই।

 সংক্ষেপে শুধু এইটুকু বলিলেই যথেষ্ট যে, যোগ বলিতে সমাধিকে বুঝাইয়া থাকে;আর ধ্যানেরই প্রগাঢ় অবস্থার নাম সমাধি। ধ্যানসিদ্ধ পুরুষই সমাধিবান পুরুষ।

 সহজ করিয়া বলা যাইতে পারে যে, ইচ্ছামাত্র যাঁহার মন ও ইন্দ্রিয়সমুদয় বিষয় হইতে প্রত্যাহৃত হয়, ইচ্ছামাত্র মন যাঁহার একাগ্র বা নিরুদ্ধ হয়, তিনিই প্রকৃত ধ্যানীপুরুষ। এই পুরুষেরই মনের একাগ্র বা নিরুদ্ধভূমিতে যে-দৃষ্টি থাকে, তাহারই নাম ধ্যানচক্ষু বা ধ্যানদৃষ্টি।

 চিত্তের একাগ্রতা বা চিত্তের নিরোধশক্তি দীর্ঘ সাধনা ও অভ্যাসের পরেই ক্রমে ক্রমে লব্ধ হয়। তাহার পরেই এই ধ্যানদৃষ্টি বা ধ্যানচক্ষু সিদ্ধসাধকের স্বভাবে বা স্বাভাবিক সম্পত্তিতে পরিণত হয়। দেহ-মন-বুদ্ধির বহু বাধা, বিঘ্ন, ক্লেশ ইত্যাদি দীর্ঘ সাধনায় পার হইয়া তবে ধ্যানভূমিতে উত্তীর্ণ হওয়া সম্ভবপর হইয়া থাকে। সেই ভূমির পুরুষেরই স্বাভাবিক অথচ বিশেষ দৃষ্টির নাম ধ্যানচক্ষু। মনের সেই একাগ্র বা নিরুদ্ধ ভূমিতে যিনি চক্ষু মেলিতে পারেন, তাঁহার দৃষ্টিতেই ব্রহ্ম প্রকাশিত হন।

 সাধারণের বোধগম্য করিয়া এককথায় বলা চলে যে, ইচ্ছামাত্র যে পুরুষ নিজের ভিতরকার সুষুপ্তি অবস্থাটিতে পৌঁছিতে পারেন এবং সেই গভীর ও প্রগাঢ় নিদ্রার মধ্যেও আপন চেতনাকে জাগ্রত অবস্থার ন্যায় সজাগ রাখিতে পারেন, তিনিই ধ্যানী পুরুষ। তাঁহার সেই ধ্যানচক্ষু নিজের ভিতরকার সেই সুষুপ্তির অন্ধকার ভেদ করিয়া “তমসার পরপারে আদিত্যবর্ণ সেই মহান পুরষকে” দেখিতে পায় যাঁহাকে উপনিষদ নাম দিয়াছেন ব্রহ্ম। এই পুরুষই বলিতে পারেন—“ভূমারে দেখেছি ধ্যান চোখে।”

 যতটুকু বিশ্লেষণ করা হইল, তাহাতেই এইটুকু জানা যায় যে, ঘুমে বা মৃত্যুতে এই চোখ বন্ধ হইবার পরও ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের যে দৃষ্টি খোলা থাকে, তাহারই নাম ধ্যানচক্ষু। এই ধ্যানচক্ষু সাধনসিদ্ধ পুরুষেরই শুধু লব্ধ বা লভ্য হইয়া থাকে।

 রবীন্দ্রনাথও সেই শ্রেণীরই পুরুষ, তাই তিনি বলিতে পারিয়াছেন “ভূমারে দেখেছি ধ্যানচোখে।”