( ৮ )

 “ভূমারে দেখেছি ধ্যানচোখে”—রবীন্দ্রনাথের এই উক্তি বিশ্বাস ও প্রত্যয় উৎপাদনের পক্ষে যথেষ্ট নহে। যে-কেহই বলিতে পারেন যে, তিনি ব্রহ্মকে দেখিয়াছেন, সে-কথা বিশ্বাস করা বা না করা শ্রোতার ইচ্ছা বা অনিচ্ছার উপর নির্ভর করে।

 আমি ব্রহ্মকে দেখিয়াছি, এই উক্তির মধ্যে ব্রহ্ম-দর্শনের কোন রূপ-রস—আস্বাদন কিছুই নাই, কাজেই ইহা শ্রোতার বিশ্বাস বা চেতনা কোনটাকেই স্পর্শ করে না। ব্রহ্মদর্শনের ঘোষণায় সেই দর্শনের অন্ততঃ কিছু পরিচয় ব্যক্ত হওয়া উচিৎ, যাহাতে শ্রোতার মনেও একটি আধ্যাত্মিক স্পন্দন কিম্বা অপরূপ ঢেউ লাগিতে পারে।

 বস্তুত উপনিষদের কোন ঋষিই “বেদাহমেতং—তাঁহাকে জানিয়াছি” বলিয়া তাঁহাদের ব্রহ্ম—ঘোষণা শেষ করেন নাই তাঁহাদের ঘোষণায় এই দর্শনের অলৌকিক রূপ-রস ইত্যাদির কিছু না কিছু আস্বাদ বা আভাস রহিয়াছে দেখা যাইবে। উপনিষদের কয়েকটি উক্তি উদ্ধৃত হইতেছে—

 কোন ঋষি বলিয়াছেন, আমি তাঁহাকে জানিয়াছি—তিনি জ্যোতির্ময়, তিনি তমসার পরপারে, তাঁহাকে জানিয়া মৃত্যু উত্তীর্ণ হইয়াছি।

 কোন ঋষি বলিয়াছেন, তাঁহাকে জানিয়া—এই দেহেই অমৃত লাভ করিয়াছি।

 কেহ বলিয়াছেন, সেই ব্রহ্মকে জানিয়াছি—যিনি গুহাহিত এবং অবিদ্যা গ্রন্থি এখন ছিন্ন হইয়াছে।

 কেহ বলিয়াছেন, তাঁহাকে জানিয়াছি—অন্তর্হৃদয় আকাশে।

 কেহ বলিয়াছেন, এই দেহপুর মধ্যে যে পদ্ম রহিয়াছে, সেই পদ্মে যে পরম দেবতা শোকহীন পাপহীন গগনসদৃশ অধিষ্ঠিত আছেন, তাঁহাকে জানিয়াছি।

 আবার কেহ বলিয়াছেন, তাঁহাকে জানিয়াছি—যিনি নীলতোয়দমধ্যস্থ বিদ্যুল্লেখার ন্যায় ভাস্বর ও অনুপম। ইত্যাদি॥

 উদ্ধৃত উক্তিসমূহে দেখা যায় যে, ঋষিদের ব্রহ্ম-ঘোষণায় হয় ব্রহ্ম সম্বন্ধে নয় ব্রহ্মদর্শনের ফল সম্বন্ধে অথবা উভয় সম্বন্ধেই কিছু না কিছু ইঙ্গিত বা বিবরণ রহিয়াছে। ব্রহ্ম সম্বন্ধে এই বিবরণকেও আবার দুই শ্রেণীতে ভাগ করিয়া দেখা যায়—তিনি কোথায় এবং তিনি কিরূপে।

 প্রথম ভাগে ঋষিদের ঘোষণায় পাওয়া যায়- তিনি তমসার পারে, তিনি হৃদয়আকাশে, তিনি গুহাহিত ইত্যাদি।

 দ্বিতীয় ভাগে পাওয়া যায়— তিনি বিদ্যুল্লেখের ভাস্বর, তিনি জ্যোতির্ময় তিনি আদিত্যবর্ণ, তিনি গগনসদৃশ ইত্যাদি।

 আর ঋষিদের ঘোষণায় ব্রহ্মদর্শনের ফল সম্বন্ধে পাওয়া যায়—মৃত্যুকে পার হইয়াছি, এই দেহেই অমৃত লাভ করিয়াছি, শোককে অতিক্রম করিয়া বীতশোক হইয়াছি, অবিদ্যাগ্রন্থি ছিন্ন করিয়াছি, ইত্যাদি।

 ঋষিদের উদ্ধৃত ব্রহ্ম-ঘোষণায় পূর্বোক্ত তিনটি বিষয়ের অন্তত কোন একটির পরিচয় বা বিবরণ সর্বদাই পাওয়া যায়, দেখা গিয়াছে। অর্থাৎ ব্রহ্ম কোথায় ব্রহ্ম কিরূপে এবং ব্রহ্মদর্শনের ফল কি—এই তিনটির কোন না কোন একটির বিবরণ ঋষিদের ব্রহ্মদর্শনের প্রসঙ্গে উপনিষদে পাওয়া যায়। ইহাই স্বাভাবিক ও সঙ্গত। যথার্থ ব্রহ্মদর্শন হইলে ‘ব্রহ্মকে দেখিয়াছি’ বলিয়া সে উপলব্ধির বিবরণ শেষ করা কাহারও পক্ষে সম্ভবপর নহে, স্বাভাবিকও নহে।

 এই কারণে রবীন্দ্রনাথও ‘ভূমারে দেখেছি ধ্যানচোখে’ বলিয়া তাঁহার উপলব্ধির বিবরণ শেষ করিতে পারেন নাই, তাই তিনি বলিয়াছেন-“ভূমারে দেখেছি ধ্যানচোখে আলোকের অতীত আলোকে।”

 কোথায় তিনি ব্রহ্মকে দেখিয়াছেন, এই প্রশ্নের উত্তরই ‘আলোকের অতীত আলোকে’—অংশটুকুতে প্রদত্ত রহিয়াছে। ‘আলোকের অতীত আলোকে’,ইহার মধ্যেই ব্রহ্মদর্শনের যথার্থ পরিচয়টুকু পাওয়া যাইতেছে।

 রবীন্দ্রনাথের ঘোষণায় আমরা ব্রহ্মকে পাই—‘আলোকের অতীত আলোকে’ আর বৈদিক ঋষির ঘোষণায় ব্রহ্মকে পাই—‘তমসঃ পরস্তাৎ’। উভয় ঘোষণা একই অর্থ বহন এবং একই সত্য নির্দেশ করিয়া থাকে।

 ‘আলোকের অতীত আলোক,’ ইহা দ্বারা রবীন্দ্রনাথ কোন্ লোক বা স্থান, অথবা কোন্ আলোকের নির্দেশ করিতে চাহিয়াছেন?

 উপনিষদ বলেন, ব্রহ্ম সর্বস্থানে এবং সর্বকালে থাকিয়াও স্থান ও কালের অতীত। সে কোন্ স্থান?

 বৃহদারণ্যকোপনিষদে ঋষি যাজ্ঞবল্ক্য সম্রাট জনককে ব্রহ্মোপদেশ করিতে গিয়া বলিয়াছেন—

যস্মাদর্বাক্, সংবৎকরোঽহোভিঃ পরিবর্ততে।
তদ্দোবা জ্যোতিষাং জ্যোতিরায়ুর্হোপাসতেহমৃতম॥

 —যাঁহাকে স্পর্শ না করিয়া সম্বৎসর দিবসের সহিত আবর্তিত হয়, দেবগণ তাঁহাকে জ্যোতির জ্যোতি অমৃত আয়ু বলিয়া উপাসনা করেন॥

 যাঁহাকে কাল স্পর্শ করে না, তিনি শুধু কালাতীতই নহেন, তিনি কালের ন্যায় স্থানেরও অনবচ্ছিন্ন এবং তিনিই ব্রহ্ম এবং তাঁহাকেই ঋষি যাজ্ঞলক্ষ্য ‘জ্যোতিষাং জ্যোতি’ বলিয়াছেন।

 আর রবীন্দ্রনাথ সেই ‘জ্যোতিষাং জ্যোতি’-কেই বলিয়াছেন—“আলোকের অতীত আলোক।”

 মুণ্ডকোপনিষদেও অনুরূপ একটি শ্লোক রহিয়াছে—

হিরন্ময়ে পরেকোশে বিরজং ব্রহ্ম নিষ্কলম্।
তচ্ছুভ্রং জ্যোতিষাং জ্যোতিস্তদ্ যদাত্মবিদোবিদুঃ॥

 —জ্যোতির্ময় শ্রেষ্ঠ কোশমধ্যে (হৃদয়-কোশে) বিরজ (দোষহীন) নিষ্কল (নিরবয়ব) যে ব্রহ্ম অবস্থিত, তিনি শুভ্র (শুদ্ধ) এবং তেজোময় পদার্থসমূহেরও অবভাসক, যাঁহারা আত্মজ্ঞানী তাঁহারাইমাত্র তাঁহাকে জানেন॥

 এখানেও ব্রহ্মকে জ্যোতিষাং জ্যোতি, আলোর আলোক বলা হইয়াছে। কিন্তু এ আলো কোথায়?

 সে স্থানের বর্ণনায় উপনিষদ বলিয়াছেন—

ন তত্র সূর্যো ভাতি ন চন্দ্রতারকং
নে মা বিদ্যূতো ভান্তি কুতোহয়মগ্নিঃ।
তমেবভান্তমনুভাতি সর্বং
তস্য ভাসা সর্বমিদং বিভাতি॥

 —সেখানে সূর্যের ভাতি নাই, চন্দ্রতারকার ভাতি নাই, বিদ্যুৎও সেখানে প্রভান্বিত নহে, অগ্নি সেখানে কোথায়? তিনি প্রকাশমান বলিয়াই তদনুযায়ী নিখিল জগৎ প্রকাশমান, তাঁহারই দীপ্তিতে এই সমুদয় প্রকাশ পায়॥

 অর্থাৎ সে-স্থান কালাতীত, স্থানাতীত, সেখানে তাই সূর্যাদির আলো পৌঁছিতে পারে না, উপনিষদ ইহাই উক্ত স্থান সম্বন্ধে নির্দেশ করিয়াছেন। সেই স্থানটিকেই বুঝাইতে গিয়া উপনিষদ বলিয়াছেন-জ্যোতিষাং জ্যোতি, অর্থাৎ সৃষ্টির সমস্ত জ্যোতিপদার্থ তাঁহারই বা সেই স্থানেরই ছায়ামাত্র।

 লক্ষ্য করিবার বিষয় যে, সে-লোক বা স্থানকে বুঝাইতে গিয়া উপনিষদ ব্রহ্মকেই নির্দেশ করিয়াছেন, অর্থাৎ সে স্থান এবং ব্রহ্ম একই ব্যাপার।

 রবীন্দ্রনাথও ঠিক এই একই কথা বলিয়াছেন—সেই ভূমাকে আমি দেখিয়াছি যিনি আলোকের অতীত আলোক, সেই ব্রহ্মকে আমি দেখিয়াছি যিনি আলোকের অতীত আলোকে।

 প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যাইতেছে যে, পরব্রহ্ম সম্বন্ধে এই তত্ত্বটিই যোগবাশিষ্ঠে অতি মনোরমভাবে বর্ণিত হইয়াছে—

অচন্দ্রাকাগ্নিতায়োঽপি কোঽবিশাশঃ প্রকাশকঃ।
অনেত্রলভ্যাৎ কস্মাৎচ প্রকাশঃ সম্প্রবর্ততি ॥

 —কে চন্দ্র, সূর্য, অগ্নি, নক্ষত্র না হইয়াও নিত্য দীপ্যমান, কে ইন্দ্রিয়ের অগোচর হইয়াও জ্ঞানের প্রকাশক॥

 তিনিই উপনিষদের “জ্যোতিষাং জ্যোতি” এবং রবীন্দ্রনাথের “আলোকের অতীত আলোক।”

 সূর্যের আলোকে প্রকাশিত বস্তুজগতকে দেখিবার জন্য যেমন চক্ষুর দরকার, সেই জ্যোতিষাং জ্যোতি আলোকের অতীত আলোকে দেখিবার জন্যও নিশ্চয় তেমনি চক্ষুর দরকার। উপনিষদ বলেন যে, এই চক্ষুতে তাঁহাকে দেখা যায় না, তাহার জন্য ‘দৈব চক্ষু’ দরকার। রবীন্দ্রনাথও তাই বলিয়াছেন এবং সেই প্রসঙ্গেই তিনি ধ্যানচক্ষুর উল্লেখ করিয়াছেন।

 এখন আমরা নিঃসন্দেহে অভিমত ব্যক্ত করিতে পারি যে, “ধূলির আসনে বসি ভূমারে দেখেছি ধ্যানচোখে আলোকের অতীত আলোকে,” রবীন্দ্রনাথের এই ঘোষণায় প্রমাণিত হয়—তিনি ব্রহ্মজ্ঞ, তাঁহার ব্রহ্মদর্শন হইয়াছে।

 এখন আমরা আরও বলিতে পারি যে, ‘ভূমারে দেখেছি ধ্যানচোখে আলোকের অতীত আলোকে,’ আর ‘বেদাঽমেতং পুরুষং মহান্তং আদিত্যবর্ণং তমসঃ পরস্তাৎ—— একই ব্রহ্মদর্শন এবং একই ব্রহ্মঘোষণা। উভয়ের পার্থক্য বা ব্যবধান শুধু কালের —একটি ঘোষণা প্রাচীন ভারতের বৈদিক ঋষির, অপরটি বর্তমান ভারতের নুতন ঋষির।