( ৯ )

 অতঃপর রবীন্দ্রনাথের দ্বিতীয় দর্শনটিতে আসা যাইতেছে। দর্শনটি এই—

“অণু হইতে অণীয়ান মহৎ হইতে মহীয়ান
ইন্দ্রিয়ের পারে তাঁর পেয়েছি সন্ধান॥”

 যাঁহার সন্ধান পাইয়াছেন বলিয়া রবীন্দ্রনাথ এখানে ঘোষণা করিয়াছেন, তিনি কে? তিনিই ব্রহ্ম। ‘অণু হতে অণীয়ান মহৎ হইতে মহীয়ান’—ইহা ব্রহ্মেরই বিবরণ বা পরিচয়। এই পরিচয় বা বিবরণ উপনিষদ হইতেই আক্ষরিকভাবে রবীন্দ্রনাথ গ্রহণ করিয়াছেন দেখা যাইবে।

 কঠ, শ্বেতাশ্বতর এবং মহানারায়ণ এই তিনখানি উপনিষদেই নিম্নোক্ত শ্লোকটি পরিদৃষ্ট হয়—

অণোরণীয়ান মহতো মহীয়ান্ আত্মাহস্য জন্তোর্নিহিতো গুহায়াম্।
তমক্রতুঃ পশ্যতি বীতশোকো ধাতুপ্রসাদান্মহিমানমাত্মনঃ॥

 —অণু হইতে অণীয়ান মহৎ হইতে মহীয়ান এই ব্রহ্ম প্রত্যেক জীবের হৃদয়গুহায় অবস্থিত। অন্তঃকরণাদি বিশুদ্ধ হইলে নিষ্কাম ব্যক্তি তাঁহাকে দর্শন করিয়া শোকাতীত হন॥

 স্পষ্টতই দেখা যাইতেছে যে, পূর্বোক্ত মন্ত্রের প্রথম ছত্রটিই রাবীন্দ্রনাথ একেবারে আক্ষরিকভাবেই গ্রহণ করিয়াছেন। এবং তাঁহারই সন্ধান তিনি পাইয়াছেন, ইহাই তিনি ঘোষণা করিয়াছেন। ব্রহ্মকেই যে তিনি বুঝাইয়াছেন, এ সম্বন্ধে সন্দেহের কোন অবকাশ নাই।

 এখানে হয়তো অনেকের মনে হইতে পারে যে, একই ব্রহ্ম অণু হইতে অণু এবং মহৎ হইতে মহৎ কি প্রকারে হন। কেমন করিয়া হন, তাহা তিনিই জানেন। আমরা শুধু জানি যে, উপনিষদের মতে ইহাই ব্রহ্মের পরিচয় এবং সে-পরিচয় আমাদের যুক্তি-তর্কের উপর নির্ভর করে না।

 ত’হা ছাড়া, উত্থাপিত প্রশ্নটি হইল আসলে ব্রহ্মজিজ্ঞাসা, আর ব্রহ্মবিচার আমাদের আলোচ্য প্রসঙ্গ নহে। উপনিষদের ঋষিগণ একই ব্রহ্ম সম্বন্ধে একই সঙ্গে বিরুদ্ধ কথা বলিয়া গিয়াছেন এবং তাহাই ব্রহ্ম সম্বন্ধে প্রামাণ্য বিবরণ বলিয়া আমাদিগকে মানিয়া লইতে হইবে।

 উদ্ধৃত মন্ত্রটির ন্যায় অন্যান্য উপনিষদেও ব্রহ্ম সম্বন্ধে অনুরূপ উক্তি বা উপদেশ পরিদৃষ্ট হইয়া থাকে।

 মণ্ডকোপনিষদ বলেন, এষোহণুরাত্মা।

 শ্বেতাশ্বেতরোপনিষদেই বলেন, আরাগ্রমাত্রোহ্যপরোঽপি দৃষ্টঃ। এখানে ব্রহ্মকে ‘আরাগ্র-মাত্রঃ’ গরু-চরাইবার পাচনির অগ্রভাগে সূঁচীমুখের ন্যায় সূক্ষ্ম-পরিমাণ বলা হইয়াছে।

 এই শ্বেতাশ্বতরোপনিষদেই অন্যত্র একই শ্লোক ব্রহ্মকে “সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম্ং বিশ্বস্য স্রষ্টারম্” সূক্ষ্মতিসূক্ষ্মা বিশ্বস্রষ্টা এবং “বিশ্বস্যৈকং পরিবেষ্টিতারং” বিশ্বের অন্তর-বাহিরে অদ্বিতীয় পরিব্যাপক বা পরিব্যাপ্তা বলা হইয়াছে।

 ছান্দোগ্য উপনিষদে শাণ্ডিলা-বিদ্যা অধিকরণে “এষো ম আত্মান্তর্হৃদয়ে” এই ব্রহ্মই আমার আত্মা এবং এই হৃদয়ের অভ্যন্তরে, ইহা বলিয়া তাঁহাকে “অণীয়ান ব্রীহেং বা যবাৎ বা......ব্রীহি যব সর্যপ ইত্যাদি অপেক্ষাও অণু”-রূপে বর্ণনা করা হইয়াছে।

 তৎপরেই পূর্ববৎ “এই ব্রহ্মই আমার আত্মা এবং এই হৃদয়ের অভ্যন্তরে” বলিয়া তাঁহার বর্ণনা দিয়াছেন—“জ্যায়ান পৃথিব্যা......ইনি পৃথিবী, অন্তরিক্ষ এই সমুদয় লোক অপেক্ষাও মহান॥”

 হৃদয়ে অবস্থিত একই ব্রহ্মকে একই সময়ে ‘অণীয়ান’ এবং ‘জ্যায়ান’ এই দুই বিরদ্ধ বিশেষণে উপনিষদ বিশেষিত করিয়াছেন দেখা যায়। কাজেই ব্রহ্ম সম্বন্ধে ‘অণোরণীয়ান মহতো মহীয়ান’ এই পরিচয় মানিয়া লওয়া ছাড়া আমাদের গত্যন্তর নাই।

 প্রসঙ্গত সংক্ষেপে শুধু এইটুকু বলিয়া রাখা যাইতে পারে যে, ব্রহ্ম সমস্ত বিরদ্ধে ধর্মের সমন্বয় এবং যাহা কিছু বিরোধ পরিদৃষ্ট হইয়া থাকে তাহা আমাদের বুদ্ধির ক্ষেত্রে মাত্র, বিরুদ্ধ ধর্ম বা বিরুদ্ধ বিশেষণ ব্রহ্মের কোন ইতরবিশেষ ঘটায় না। এককথায়, তিনি স্বয়ং সমস্ত কিছুকেই স্পর্শ করিয়া আছেন, কিন্তু তাঁহাকে কোন কিছুই স্পর্শ করিতে পারে না।

 আলোচ্য প্রসঙ্গে আসা যাইতেছে—‘অণু হইতে অণীয়ান মহৎ হইতে মহীয়ান’ বলিয়া রবীন্দ্রনাথ যে ব্রহ্মকেই বুঝাইয়াছেন, এ বিষয়ে প্রশ্নের কোন অবকাশ নাই এবং তাঁহারই সন্ধান তিনি পাইয়াছেন, ইহাই রবীন্দ্রনাথ জানাইতে চাহিয়াছেন, এই বিষয়েও সন্দেহের কোন অবকাশ নাই।

 কিন্তু এইরূপ সুস্পষ্ট ঘোষণা সত্ত্বেও আলোচ্য প্রসঙ্গে স্বয়ং বক্তার মুখের কথার উপর আমরা পূর্বে নির্ভর না করিয়া ব্রহ্মদর্শনের প্রমাণই চাহিয়াছি। এক্ষেত্রেও তাই জিজ্ঞাসা করিতে হইতেছে, রবীন্দ্রনাথ যে ‘অণোরণীয়ান মহতো মহীয়ান’-কেই দেখিয়াছেন, তাহার কিছু প্রমাণ তিনি দিয়াছেন কি?

 সেই প্রমাণ রবীন্দ্রনাথ দিয়াছেন তাঁহার এই উক্তিতে - “ইন্দ্রিয়ের পারে তাঁর পেয়েছি সন্ধান।”

 ইহা প্রমাণ কিনা, তাহাই এখন আমাদের বিচার্য। কোথায় তিনি ব্রহ্মকে দেখিয়াছেন, ইহা তিনি স্পষ্টভাবেই ঘোষণা করিয়াছেন। এই প্রমাণ-পথটি অনুসরণ করিলে ব্রহ্মেরই সন্ধান পাওয়া যায় কিনা, এইটুকু শুধু এখন আমাদিগকে দেখিতে হইবে। অর্থাৎ, ‘ইন্দ্রিয়ের পারে’ বলিতে গন্তব্য ব্রহ্মে গিয়াই শেষ হয় কিনা, ইহাই আমাদের বিচার্য।

 বৈদিক ঋষি বলিয়াছেন, ‘তমসার পারে’ তিনি ব্রহ্মের সন্ধান পাইয়াছেন, আর রবীন্দ্রনাথ বলিতেছেন, ‘ইন্দ্রিয়ের পারে তাঁর পেয়েছি সন্ধান’।

 এখন প্রশ্ন, ‘তমসার পার’ এবং ‘ইন্দ্রিয়ের পারে’ কি একই ব্যাপার?

 বাহ্যত তাহা মনে হয় না, কারণ তমসা এবং ইন্দ্রিয় কোনক্রমেই এক অর্থ বহন করে না। কাজেই ‘তমসার পার’ এবং ‘ইন্দ্রিয়ের পার’ একই ব্যাপার, ইহা প্রমাণ করিবার জন্য গলদঘর্ম হইবার দরকার নাই। আমরা আমাদের স্বাভাবিক বুদ্ধি ও যুক্তির পথ প্রথমে একটু অনুসরণ করিতে পারি এবং সে-পথে ‘ইন্দ্রিয়ের পার’-এর নাগাল অর্থাৎ অর্থ পাওয়া দুর্লভ নাও হইতে পারে।

 আমাদের ইন্দ্রিয়ের একটামাত্র দিকই আমরা দেখিতে পাই, তাহা হইল বিষয়ের দিক। ইন্দ্রিয়ের এই দিকে গিয়া তো কোন পারই পাওয়া যায় না। চক্ষু চিরকালই রূপ দেখিবে, অনন্তকাল চক্ষু মেলিয়া চাহিয়া দেখিলেও চক্ষু দিয়া কখনো রূপকে উত্তীর্ণ হইয়া কোন পারের নাগাল মিলিবে না। চক্ষুর সাধ্য নাই রূপকে সাঁতরাইয়া পার হয়,—এ যেন অসীম অকূল পাথার। অন্যান্য ইন্দ্রিয় ও তাহাদের বিষয় সম্বন্ধেও এই একই কথা সমান প্রযোজ্য।

 দেখা গেল যে, ইন্দ্রিয়ের এদিকে অনন্তকাল অগ্রসর হইলেও ‘ইন্দ্রিয়ের পার’ বলিয়া কোন কিছুরই নাগাল পাওয়া যাইবে না। রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শের জগৎ এমনই একটি ‘মহা-বৃত্ত’ যাহার পরিধি অসীম কালে এবং অসীম আকাশে বিস্তারিত। কাজেই, রবীন্দ্রনাথের কথিত ‘ইন্দ্রিয়ের পার’ এই পরিধির দিকে নয়।

 আর, যদি রবীন্দ্রনাথ ‘ইন্দ্রিয়ের পার’ বলিতে বস্তুত ইন্দ্রিয়ের সম্মুখে প্রকাশিত ও বিস্তারিত এই জগৎকেই বুঝাইয়া থাকেন, তবে ইন্দ্রিয়বান ব্যক্তিমাত্রেই ব্রহ্মজ্ঞ বলিয়া স্বীকৃত হইতে বাধ্য। কারণ, রূপ-রস-গন্ধ-স্পর্শের সে-জগৎ সকলেরই ইন্দ্রিয়-গোচর।

 তাহা ছাড়া, জগৎকে আমরা জগৎরূপেই দেখিতে পাই, সেখানে রবীন্দ্রনাথের ‘অণোরণীয়ান মহতো মহীয়ান’-কে আমরা কেহই দেখিতে পাই না। এইদিকেই যদি ‘ইন্দ্রিয়ের পার’ হইত, তবে নিশ্চয় রবীন্দ্রনাথের ন্যায় আমরাও তাঁহাকে দেখিতে পাইতাম। কাজেই রবীন্দ্রনাথের কথিত ‘ইন্দ্রিয়ের পার’ এই প্রকাশিত জগৎ-দৃশ্য হইতে পারে না।

 কিম্বা ‘ইন্দ্রিয়ের পার’ বলিতে যদি রূপ-রস-গন্ধাদির আড়ালে কোন কিছু কে রবীন্দ্রনাথ বুঝাইয়া থাকেন, তবে সে কথার কোন অর্থ হয় না। চক্ষুর কথাই ধরা যাক,—চক্ষুর সম্মুখেই রূপের রূপান্তর ঘটিয়া থাকে। এই রূপ হইতে রূপে যাহা রূপান্তরিত হয় রূপের অন্তরের সেই ‘যাহাই’ যদি ‘ইন্দ্রিয়ের পার’ বলিয়া রবীন্দ্রনাথ বুঝাইয়া থাকেন, তবে পূর্বের সমস্যাই দেখা দিবে। অর্থাৎ, চক্ষুরাদি ইন্দ্রিয়বর্গ প্রকাশিত অংশটুকুই দেখে, তাহার আড়ালে যদি কোন ‘পার’ থাকিয়াও থাকে, তাহা দেখে না।

 উপরন্তু এই ক্ষেত্রে ‘ইন্দ্রিয়ের পার’ না বলিয়া ‘সৃষ্টির পারে’ বা ‘সৃষ্টির অতীত’ অথবা ‘সৃষ্টির অন্তরে’ ইত্যাদি প্রয়োগই সমধিক সত্য ও যথার্থ হইত। কিন্তু তাহাতে বড় জোর একটা ‘তত্ত্ব’ প্রকাশ পাইত, ‘সত্যদর্শন’ প্রকাশ পাইত না। কাজেই ‘ইন্দ্রিয়ের পার’ বলিতে সৃষ্টি বা জগতের দিকে রবীন্দ্রনাথ নিশ্চয় নির্দেশ করেন নাই, বুঝিতে হইবে।

 কিন্তু ইন্দ্রিয়ের একটামাত্র দিকই আমরা জানি, একথা পূর্বেই বলা হইয়াছে। ইন্দ্রিয়কে বলা যাইতে পারে—দ্রষ্টা এবং দৃশ্যের মাঝে সংযোগসেতু। সেতুর যে-মুখটা দৃশ্যের দিকে, সে-দিকে ‘ইন্দ্রিয়ের পারে’ পাওয়া যায় নাই। সেতুর যে-মুখটা দ্রষ্টার দিকে, সে-পথে হয়তো ‘ইন্দ্রিয়ের পার’ পাওয়া গেলেও যাইতে পারে। কাজেই সেতুর এই দিকটার একটু খোঁজ লওয়া যাইতেছে।

 কোন ইন্দ্রিয়ই তাহার কর্তাকে বা দ্রষ্টাকে দেখে না, যদিও ইন্দ্রিয় কর্তারই নিজস্ব শক্তি। ইন্দ্রিয়ের এই পারটা চিরকালই অজ্ঞেয় বা দুর্জ্ঞেয়। আর একটা বিষয় লক্ষ্য করিবার যে, ইন্দ্রিয়ের যে সেতু-মুখ দৃশ্যের দিকে নিবদ্ধ, তাহা কিন্তু বিষয়ের সঙ্গে চির-লগ্ন নহে; অর্থাৎ, নিদ্রা-মূর্ছা ইত্যাদি অবস্থায় দৃশ্য হইতে ইন্দ্রিয়ের সেতুমখ উত্তোলিত বা বিযুক্ত হয়। কিন্তু দ্রষ্টা হইতে দৃষ্টিশক্তি অর্থাৎ ইন্দ্রিয় কখনো বিযুক্ত হইতে পারে না, কারণ শক্তি কখনো শক্তিমানকে বা তাহার আশ্রয়কে ছাড়িয়া থাকিতে পারে না।

 দৃশ্যের দিকে ‘ইন্দ্রিয়ের পার’ পাওয়া যায় নাই, কাজেই দ্রষ্টার দিকেই ‘ইন্দ্রিয়ের পার’ পাওয়া যাইবে, যদি রবীন্দ্রনাথের কথিত কোন ‘পার’ আদৌ থাকে। কাজেই রবীন্দ্রনাথ ‘ইন্দ্রিয়ের পার’ বলিতে এদিকেই ইঙ্গিত করিয়াছেন, ইহা ধরিয়া লইয়া এখন আমাদিগকে অগ্রসর হইতে হইবে।

 ইন্দ্রিয়ের এ-মুখে কাহাকে পাওয়া যায়? ইন্দ্রিয়ের কর্তাকে বা দ্রষ্টাকে, বা সাক্ষীকে। আর, আসল দ্রষ্টা বা সাক্ষী বলিতে আত্মাকেই বুঝাইয়া থাকে এবং সেই আত্মাই ব্রহ্ম, ইহাই উপনিষদের উপদেশ। ‘অণোরণীয়ান মহতো মহীয়ান’—রূপে ব্রহ্মেরই সন্ধান রবীন্দ্রনাথ ‘ইন্দ্রিয়ের পারে’ পাইয়াছেন বলিয়া জানাইয়াছেন। ইন্দ্রিয়ের এইদিকেই যখন ব্রহ্ম রহিয়াছেন, তখন ‘ইন্দ্রিয়ের পার’ বলিতে রবীন্দ্রনাথ দ্রষ্টার দিকেই ইঙ্গিত করিয়াছেন, ইহাই এখন সিদ্ধান্ত।

 উপনিষদে এই সিদ্ধান্তেরই সমর্থন পাওয়া যাইবে। কঠোপনিষদের একটি শ্লোকে বলা হইয়াছে—

 “স্বয়ম্ভূ ইন্দ্রিয়সমূহকে বহির্মুখ করিয়াছেন, সেইজন্য জীবগণ বহির্বিষয় দর্শন করে, অন্তরাত্মাকে দেখিতে পায় না। কোন ধীর ব্যক্তি অমৃতত্ব-অভিলাষে ‘আবৃত-চক্ষু’ হইয়া আত্মাকে দর্শন করে॥”

 এখানে পরিষ্কার বলা হইয়াছে যে, ইন্দ্রিয়গণ স্বভাবে বহির্মুখ এবং বহির্মুখ ইন্দ্রিয়ের সম্মুখে ব্রহ্ম প্রকাশিত হন না।

 আর বলা হইয়াছে যে, ধীর বিবেকী ব্যক্তি, ‘আবৃতচক্ষু হইয়া’ অর্থাৎ বহির্মুখ ইন্দ্রিয়কে বহির্বিষয় হইতে প্রত্যাহার করিয়া তবে ব্রহ্মকে দর্শন করেন।

 উপনিষদ যাহাকে ‘আবৃত-চক্ষু’ বলিয়াছেন, তাহাই রবীন্দ্রনাথের কথিত ‘ইন্দ্রিয়ের পারে’ যাইবার পথ।

 প্রশ্নোপনিষদেও দেখা যায় যে, মহর্ষি পিপ্পলাদ শিষ্য ভরদ্বাজ-পুত্র সুকেশার আত্মজিজ্ঞাসার উত্তরে এই একই উপদেশ দিয়াছেন। তিনি বলিয়াছেন—

অরা ইব রথনাভৌ কলা যস্মিন প্রতিষ্ঠিতাঃ।
তং বেদ্যং পুরুষং বেদ যথা মা বো মৃত্যুঃ পরিব্যথা ইতি॥

 —রথচক্রের নাভিরন্ধ্রে সংস্থিত অর (শলাকা)-সমূহের ন্যায় উক্ত কলাসমূহ (পঞ্চপ্রাণ, পঞ্চকর্মেন্দ্রিয়, পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় ও মন = ষোড়শ কলা) যে পুরুষে আশ্রিত রহিয়াছে, সেই বেদিতব্য পুরুষকে অবশ্যই জানিবে—যাহার ফলে মৃত্যু তোমাদিগকে ব্যথিত করিতে না পারে॥

 ইহার পরেই মহর্ষি পিপ্পলাদ বলিয়াছেন, “এতাবদেবাহিমেতং পরং ব্রহ্মবেদ। নাতঃ পরমস্তীতি”—আমি এই পরব্রহ্মকে এই পর্যন্তই জানি। ইহার অতিরিক্ত আর (ব্রহ্মতত্ত্ব) নাই॥

 এখানে এই কয়টি কথা বলা হইয়াছে, যথা—রথের চাকার শলাকাসমূহ যেমন চাকার নাভিরন্ধ্রে সংযুক্ত, ইন্দ্রিয়সমূহও তেমনি পুরুষে প্রতিষ্ঠিত বা আশ্রিত। সেই পুরুষই একমাত্র বেদিতব্য। তাঁহাকে জানিলে মৃত্যু আর স্পর্শ করে না; তিনিই পরব্রহ্ম, তাহার পরে বা অতিরিক্ত আর কিছু নাই॥

 রথের চাকার শলাকার এক মুখ পরিধির দিকে, ইন্দ্রিয়েরও এক মুখ বিষয় পরিধির দিকে। রথের চাকার শলাকার অন্য মুখ চাকার কেন্দ্রে নাভিরন্ধ্রে সংযুক্ত, ইন্দ্রিয়েরও অপর মুখ ইন্দ্রিয়ের কর্তা– পুরুষের সঙ্গে যুক্ত। ‘ইন্দ্রিয়ের পারে’ বলিতে রবীন্দ্রনাথও এই কেন্দ্রের দিকেই ইঙ্গিত করিয়াছেন। এই কেন্দ্রকেই মহর্ষি পিপ্পলাদ বলিয়াছেন—পরব্রহ্ম।

 রবীন্দ্রনাথও তেমনি বলিয়াছেন— “ইন্দ্রিয়ের পারে” অণোরণীয়ান মহতো মহীয়ানকে তিনি দেখিয়াছেন। আর ‘অণোরণীয়ান মহতো মহীয়ান্’ যে ব্রহ্ম, তাহা পূর্বেই আমরা দেখিয়াছি।—এখন আমরাও নিশ্চয় ঘোষণা করিতে পারি যে, রবীন্দ্রনাথ ব্রহ্মজ্ঞ, রবীন্দ্রনাথ ঋষি।

 ‘ইন্দ্রিয়ের পারে’ যাইবার জন্য উপনিষদ ‘আবৃত চক্ষু’ অর্থাৎ ইন্দ্রিয়সমূহকে বিষয় হইতে প্রত্যাহারপূর্বক অন্তর-কেন্দ্রে লগ্ন করিবার উপদেশ দিয়াছেন। ইন্দ্রিয়ের এই ‘প্রত্যাহারই’ পরে ধ্যানে পরিণত হয় এবং এই ধ্যানী পুরুষকেই উপনিষদ এখানে ‘আবৃতচক্ষু বলিয়াছেন, আর রবীন্দ্রনাথ তাহাকেই পূর্বে বলিয়াছেন ‘ধ্যানচক্ষু’ আর এখানে বলিয়াছেন ‘ইন্দ্রিয়ের পার’।

 কিন্তু এই ‘ইন্দ্রিয়ের পার’—পাওয়া অনায়াস বা সহজসাধ্য ব্যাপার নহে, ইহা বহু সাধনাসাপেক্ষ। ‘ইন্দ্রিয়ের পারে’ রবীন্দ্রনাথের ব্যক্তিগত জীবনে কোন সাধনার ইঙ্গিত করিয়া থাকে, ‘ধ্যানচক্ষুর’ বিশ্লেশণে তাহা পূর্বেই ব্যক্ত হইয়াছে। সুতরাং তাহার পুনরাবৃত্তি বাহুল্য এবং অনাবশ্যক।