পত্র।[]

সুহৃদ্বর যুক্ত প্রিঃ—
স্থলচর বরেষু।
জলে বাসা বেঁধেছিলেম,
ডাঙ্গায় বড় কিচিমিচি।
সবাই গলা জাহির করে,
চেঁচায় কেবল মিছিমিছি।
সস্তা লেখক কোকিয়ে মরে,
ঢাক নিয়ে সে খালি পিটোয়,
ভদ্রলােকের গায়ে পড়ে
কলম নেড়ে কালি ছিটোয়।
এখেনে যে বাস করা দায়,
ভন্‌ভনানির বাজারে।
প্রাণের মধ্যে গুলিয়ে উঠে
হট্টগােলের মাঝারে।

কানে যখন তালা ধরে
উঠি যখন হাঁপিয়ে।
কোথায় পালাই—কোথায় পালাই—
জলে পড়ি ঝাঁপিয়ে।
গঙ্গা প্রাপ্তির আশা কোরে
গঙ্গা যাত্রা করেছিলেন।
তােমাদের না বলে কয়ে
আস্তে আস্তে সরেছিলেম।

দুনিয়ার এ মজ্‌লিষেতে
এসেছিলেম গান শুন্‌তে;
আপন মনে গুন্‌গুনিয়ে .
রাগ রাগিণীর জাল বুন্‌তে।
গান শশানে সে কাহার সাধ্যি,
ছোঁড়াগুলাে বাজায় বাদ্যি,
বিদ্যেখানা ফাটিয়ে ফেলে
থাকে তারা তুলাে ধুনতে।

ডেকে বলে, হেঁকে বলে,
তঙ্গী ক’রে বেঁকে বলে—
“আমার কথা শােন সবাই
গান শােন আর নাই শােন।
গান যে কা’কে বলে সেইটে
বুঝিয়ে দেব, তাই শােন।”
টীকে করেন ব্যাখ্যা করেন,
জেঁকে ওঠে বক্তিমে,
কে দেখে তার হাত পা-নাড়া,
চক্ষু দুটোর রক্তিমে!
চন্দ্র সূর্য্য জ্বল্‌চে মিছে
আকাশ খানার চালাতে—
তিনি বলেন “আমিই আছি
জ্বাল্‌তে এবং জ্বালাতে।”
কুঞ্জবনের তানপুরােতে
সুর বেঁধেছে বসন্ত,
সেটা শুনে নাড়েন কর্ণ
হয়নাক তাঁর পছন্দ।

তাঁরি সুরে গাক্‌ না সবাই
টপ্পা খেয়াল ধুরবােদ,—
গান না যে কেউ—আসল কথা
নাইক কারো সুর বােধ!
কাগজ ওয়ালা সারি সারি
নাড়চে কাগজ হাতে নিয়ে—
বাঙ্গলা থেকে শান্তি বিদায়
তিনশো কুলাের বাতাস দিয়ে!
কাগজ দিয়ে নৌকা বানায়
বেকার যত ছেলেপিলে,—
কর্ণ ধ’রে পার করবেন
দু-এক পয়সা খেয়া দিলে।
সস্তা শুনে ছুটে আসে
যত দীর্ঘকর্ণ গুলাে—
বঙ্গদেশের চতুর্দ্দিকে
তাই উড়েছে এত ধূলাে!
ক্ষুদে ক্ষুদে “আর্য্য” গুলাে
ঘাসের মত গজিয়ে ওঠে,

ছঁচোলাে সব জিবের ডগা
কাঁঁটার মত পায়ে ফোটে।
তারা বলেন “আমিই কল্কি”
গাঁজার কল্কি হবে বুঝি!
অবতারে ভরে গেল
যত রাজ্যের গলি ঘুঁজি।
পাড়ায় এখন কত আছে
কত কব’ তার,
বঙ্গদেশে মেলাই এল
বরা’ অবতার!
দাঁতের জোরে হিন্দু শাস্ত্র
তুল্‌ বে তারা পাঁকের থেকে।,
দাঁত কপাটি লাগে, তাদের
দাঁত খিঁচুনীর ভঙ্গী দেখে!
আগাগোড়াই মিথ্যে কথা,
মিথ্যেবাদীর কোলাহল,
জিৰ নাচিয়ে বেড়ায় যত
জিহবা-ওয়ালা সঙের দল।

বাক্য-বন্যা ফেনিয়ে আসে
ভাসিয়ে নে যায় তােড়ে,
কোন ক্রমে রক্ষে পেলেম
মা-গঙ্গার ক্রোড়ে।

হেথায় কিবা শান্তি-ঢালা
কুলুকুলু তান।
সাগর পানে ব’হে নে যায়
গিরিরাজের গান।
ধরি ধরি বাতাসটি, দেয়
জলের গায়ে কাঁটা।
আকাশেতে আলাে আঁধার
খেলে জোয়ার ভাটা।
তীরে তীরে গাছের সারি
পল্পবেরি ঢেউ।
সারাদিন হেলে দোলে
দেখে না ত’ কেউ।

পূর্ব্বতীরে তরু শিরে
অরু হেসে চায়—
পশ্চিমেতে কুঞ্জমাঝে
সন্ধ্যা নেমে যায়।
তীরে ওঠে শঙ্খ ধ্বনি
ধীরে আসে কানে,
সন্ধ্যা তারা চেয়ে থাকে
ধরণীর পানে।
ঝাউবনের আড়ালেতে
চাঁদ ওঠে ধীরে,
ফোটে সন্ধ্যা দীপগুলি
অন্ধকার তীরে।
এই শান্তি সলিলেতে
দিয়েছিলেম ডুব,
হট্টগোেলটা ভুলেছিলেম
সুখে ছিলেম খুব!

জান ত ভাই আমি হচ্চি
জলচরের জাত।
আপন মনে সাঁৎরে বেড়াই—
ভাসি দিন রাত!
রােদ পােহাতে ডাঙ্গায় উঠি,
হাওয়াটি খাই চোখ্‌ বুজে।
ভয়ে ভয়ে কাছে এগােই
তেমন তেমন লােক বুঝে!
গতিক মন্দ দেখ্‌লে আবার
ডুবি অগাধ জলে।
এম্‌নি করেই দিনটা কাটাই
লুকোচুরির ছলে!
তুমি কেন ছিপ ফেলেছ
শুক্‌নাে ডাঙ্গায় বসে?
বুকের কাছে বিদ্ধ করে
টান মেরেচ কসে!
আমি তােমায় জলে টানি
তুমি ডাঙ্গায় টান’।

অটল হয়ে বসে আছ
হার ত নাহি মান।
আমারি নয় হার হয়েচে
তোমারি নয় জিৎ—
খাবি খাচ্চি ডাঙ্গায় পড়ে
হয়ে পড়েচি চিৎ।
আর কেন ভাই, ঘরে চল,
ছিপ গুটিয়ে নাও—
রবীন্দ্রনাথ ধরা পড়েছে
ঢাক পিটিয়ে দাও।


  1. (নৌকা যাত্রা হইতে ফিরিয়া আসিয়া লিখিত।)