শেষ শিক্ষা

একদিন শিখগুরু গােবিন্দ নির্জ্জনে
একাকী ভাবিতেছিলা আপনার মনে
শ্রান্ত দেহে সন্ধ্যাবেলা—হেনকালে এসে
পাঠান কহিল তাঁরে, যাব চলি দেশে,
ঘােড়া যে কিনেছ তুমি দেহ তার দাম।
কহিল গােবিন্দ গুরু—শেখজি সেলাম,
মূল্য কালি পাবে আজি ফিরে যাও ভাই।—
পাঠান কহিল রােষে, মূল্য আজই চাই।
এত বলি জোর করি ধরি তাঁর হাত-
চোর বলি দিল গালি। শুনি অকস্মাৎ
গােবিন্দ বিজুলি-বেগে খুলি নিল অসি,
পলকে সে পাঠানের মুণ্ড গেল খসি,
রক্তে ভেসে গেল ভূমি। হেরি নিজ কাজ
মাথা নাড়ি কহে গুরু, বুঝিলাম আজ

আমার সময় গেছে। পাপ তরবার
লঙ্ঘন করিল আজি লক্ষ্য আপনার
নিরর্থক রক্তপাতে। এ বাহুর পরে
বিশ্বাস ঘুচিয়া গেল চিরকাল তরে।
ধুয়ে মুছে যেতে হবে এ পাপ এ লাজ
আজ হতে জীবনের এই শেষ কাজ।

পুত্র ছিল পাঠানের বয়স নবীন
গােবিন্দ লইল তারে ডাকি। রাত্রি দিন
পালিতে লাগিল তারে সন্তানের মত
চোখে চোখে। শাস্ত্র আর শস্ত্রবিদ্যা যত
আপনি শিখাল তারে। ছেলেটির সাথে
বৃদ্ধ সেই বীরগুরু সন্ধ্যায় প্রভাতে
খেলিত ছেলের মত। ভক্তগণ দেখি
গুরুরে কহিল আসি—এ কি প্রভু এ কি?
আমাদের শঙ্কা লাগে। ব্যাঘ্র শাবকেরে
যত যত্ন কর তার স্বভাব কি ফেরে?
যখন সে বড় হবে তখন নখর।
গুরুদেব, মনে রেখো, হবে যে প্রখর।
গুরু কহে, তাই চাই, বাঘের বাচ্ছারে
বাঘ না করিনু যদি কি শিখানু তারে?

বালক যুবক হল গােবিন্দের হাতে
দেখিতে দেখিতে। ছায়াহেন ফিরে সাথে,

পুত্রহেন করে তাঁর সেবা। ভালবাসে
প্রাণের মতন-সদা জেগে থাকে পাশে
ডান হস্ত যেন। যুদ্ধে হয়ে গেছে গত
শিখগুরু গােবিনের পুত্র ছিল যত,—
আজি তাঁর প্রৌঢ়কালে পাঠান তনয়
জুড়িয়া বসিল আসি শূন্য সে হৃদয়
গুরুজীর। বাজে-পােড়া বটের কোটরে"
বাহির হইতে বীজ পডি বায়ুভরে
বৃক্ষ হয়ে বেড়ে বেড়ে কবে ওঠে ঠেলি,
বৃদ্ধ বটে ঢেকে ফেলে ডালপালা মেলি।

একদা পাঠান কহে নমি গুরু পায়,
শিক্ষা মাের সারা হল চরণকৃপায়,
এখন আদেশ পেলে নিজ ভুজবলে।
উপার্জন করি গিয়া রাজ সৈন্যদলে।
গােবিন কহিলা তার পিঠে হাত রাখি—
আছে তব পৌরুষের এক শিক্ষা বাকি।

পর দিন বেলা গেলে গােবিন্দ একাকী
বাহিরিলা,—পাঠানেরে কহিলেন ডাকি
অস্ত্র হাতে এস মােরা সাথে। ভক্তদল
সঙ্গে যাব সঙ্গে যাব করে কোলাহল—
গুরু কন, যাও সবে ফিরে। দুই জনে
কথা নাই, ধীরগতি চলিলেন বনে

নদীতীরে। পাথর-ছড়ানো উপকূলে,
বরষার জলধারা সহস্র আঙুলে
কেটে গেছে রক্তবর্ণ মাটি। সারি সারি
উঠেছে বিশাল শাল,—তলায় তাহারি
ঠেলাঠেলি ভিড় করে শিশু তরুদল
আকাশের অংশ পেতে। নদী হাঁটুজল
ফটিকের মত স্বচ্ছ –চলে একধারে
গেরুয়া বালির কিনারায়। নদীপারে
ইসারা করিল গুরু—পাঠান দাঁড়াল।
নিবে-আসা দিবসের দগ্ধ রাঙা আলো
বাদুড়ের পাখাসম দীর্ঘ ছায়া জুড়ি
পশ্চিম প্রান্তর পারে চলেছিল উড়ি
নিঃশব্দ আকাশে। গুরু কহিলা পাঠানে—
মামুদ হেথায় এস, খোঁড় এইখানে।—
উঠিল সে বালু খুঁড়ি একখণ্ড শিলা
অঙ্কিত লােহিত রাগে। গােবিন্দ কহিলা
পাষাণে এই যে রাঙা দাগ, এ তােমার
আপন বাপের রক্ত। এইখানে তার
মুণ্ড ফেলেছিনু কেটে, না শুধিয়া ঋণ,
না দিয়া সময়। আজ আসিয়াছে দিন,
রে পাঠান, পিতার সুপুত্র হও যদি
খোল তলবার,—পিতৃঘাতকেরে বধি
উষ্ণ রক্ত উপহারে করিবে তর্পণ
তৃষাতুর প্রেতাত্মার।বাঘের মতন

হুঙ্কারিয়া লম্ফ দিয়া রক্তনেত্র বীর
পড়িল গুরুর পরে; গুরু রহে স্থির
কাঠের মূর্তির মত। ফেলি অস্ত্রখান
তখনি চরণে তাঁর পড়িল পাঠান।
কহিল, হে গুরুদেব, লয়ে সয়তানে
কোরো না এমনতর খেলা। ধর্ম্ম জানে
ভুলেছিনু পিতৃরক্তপাত;—একাধারে
পিতা গুরু বন্ধু বলে জেনেছি তােমারে
এতদিন। ছেয়ে থাক্ মনে সেই স্নেহ,
ঢাকা পড়ে’ হিংসা যাক মরে’। প্রভু, দেহ
পদধূলি।—এত বলি বনের বাহিরে,
উর্ধ্বশ্বাসে ছুটে গেল, না চাহিল ফিরে,
না থামিল একবার। দুটি বিন্দু জল
ভিজাইল গােবিনের নয়ন যুগল।

পাঠান সেদিন হতে থাকে দূরে দূরে।
নিরালা শয়নঘরে জাগাতে গুরুরে
দেখা নাহি দেয় ভোরবেলা। গৃহদ্বারে
অস্ত্র হাতে নাহি থাকে রাতে। নদীপারে
গুরু সাথে মৃগয়ায় নাহি যায় একা।
নির্জনে ডাকিলে গুরু দেয় না সে দেখা।

একদিন আরম্ভিল শতরঞ্চ খেলা
গগাবিন্দ পাঠান সাথে। শেষ হল বেলা

না জানিতে কেহ। হার মানি বারে বারে
মাতিছে মামুদ। সন্ধ্যা হয় রাত্রি বাড়ে।
সঙ্গীরা যে-যার ঘরে চলে গেল ফিরে।
ঝাঁ ঝাঁ করে রাতি। একমনে হেঁটশিরে
পাঠান ভাবিছে খেলা। কখন হঠাৎ
চতুরঙ্গ বল ছুঁড়ি করিল আঘাত
মামুদের শিরে গুরু,—কহে অট্টহাসি’-
পিতৃঘাতকের সাথে খেলা করে আসি
এমন যে কাপুরুষ-জয় হবে তার!-
তথনি বিদ্যুৎ-হেন ছুরি খরধার
খাপ হতে খুলি লয়ে গোবিন্দের বুকে
পাঠান বিঁধিয়া দিল। গুরু হাসি মুখে
কহিলেন—এতদিনে হল তাের বােধ
কি করিয়া অন্যায়ের লয় প্রতিশােধ।
শেষ শিক্ষা দিয়ে গেনু—আজি শেষবার
আশীৰ্বাদ করি তােরে হে পুত্র আমার।

৬ই কার্তিক, ১৩০৬