কবিতাকুসুমাঞ্জলি/কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধাবসানে গান্ধারীর সমরক্ষেত্র দর্শন ও বিলাপ
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধাবসানে গান্ধারীর সমরক্ষেত্র দর্শন ও বিলাপ।
হায়! কে বুঝে কালের খেলা বিষম গহন,
এই অসার সংসার যেন নিশার স্বপন।
কভু অপার সুখের মেলা, কভু হাহাকার,
কভু উজ্জ্বল আলোক, কভু ঘোর অন্ধকার।
কভু রাজ্যপদ পায়, কভু পথের ভিকারী,
হায় কালের কুটিল গতি বুঝিতে না পারি।
দেখে গান্ধারীর দশা, দুখ হৃদয়ে না ধরে,
ছিল শত বীর পুত্ত্র যার দুর্ব্বার সমরে,
তার বংশে বাতি দিতে কেহ রহিল না আর,
হায় কি কহিব কত সুখ ছিল যে তাহার।
হল কুরুক্ষেত্রে রণবহ্নি নির্ব্বাণ যখন,
দেখে[১] সম্মুখে সমরক্ষেত্র গান্ধারী তখন।
যেন ইন্দ্রজালে মায়ামোহে কিম্বা যোগবলে,
হেরি রণাঙ্গণ ভাসে রামা নয়নের জলে।
হায় পতাকা শোভিত ভগ্ন রথ শত শত,
দেখে চূর্ণ হয়ে চতুর্দ্দিকে পড়ে আছে কত
কত অসংখ্য গজের যূথ পর্ব্বতের প্রায়,
গায়ে রক্ত মাখা রণভূমে গড়াগড়ি যায়।
কত পড়ে আছে নানাবর্ণ তেজীয়ান হয়,
করে সাধ্য করে সঙ্খ্যা তার, গণনা না হয়।
কত বদ্ধপরিকর সাদী ভয়ঙ্কর বেশে
আছে দশনে অধর চাপি পড়ে রণদেশে।
হয়ে যোধ-কূল প্রতিকূল দৈববশে হত,
করি বিকট মুখের ভঙ্গী পড়ে আছে কত।
আছে তার মাঝে কত বীর হেমবর্ম্ম গায়,
শিরে সুবর্ণ কিরীট শোভে খচিত হীরায়।
শোভে রুধিরাক্ত রণক্ষেত্রে তাহাদের কায়,
হেরি জ্ঞান হয়, নিদ্রা যায় লোহিত শয্যায়।
কত লক্ষ লক্ষ কাটামুণ্ড গড়াগড়ি যায়,
কত ছিন্ন হস্ত পদ আছে পড়িয়া ধরায়।
কত শেল শূল অসি চর্ম্ম মুষল মুদ্গর,
আর পরশু কার্ম্মুক গদা ভিন্দিপাল শর;
পড়ে আছে সেই রণভূমি আচ্ছাদন করে,
হয় হৃদয় কম্পিত দেখি সে শস্ত্রনিকরে।
বহে রুধিরের নদী অতি ভীম দরশন,
রবে মহানন্দে রণাঙ্গণে যত শিরাগণ।
কত শকুনি গৃধিনী সুখে শবমাংস খায়,
যত কাক বক চিল ঊর্দ্ধে উড়িয়া বেড়ায়।
আহ জয়দ্রথ ভীষ্ম কর্ণ আদি বীরগণ,
হয়ে রক্ত-সিত্ত্ব-দেহ রণে করেছে শয়ন।
হেরি গান্ধীরী কাতরা কান্দি কহিছে কেশবে,
হায় শোকে প্রাণ যায় কৃষ্ণ! দেখিয়া এ সবে।
দেখ পড়ে আছে রণভূমে মম সুতশত,
ইহা নয়নে দেখিতে হল, দুখ কব কত।
বুঝি, আমা হেন পাপীয়সী নাই ত্রিভুবনে,
তাই এখনো বাঁচিয়া আছি দেখিয়া নয়নে।
হেরি দুর্য্যোধনে মূর্চ্ছাপন্না হইল তখন,
পরে চেতন পাইয়া সতী করয়ে রোদন।
শিরে করে করাঘাত মুখে হাহাকার রব,
বলে কেন বাছা। কি লাগিয়া হইলে নীরব।
আমি শত-বীরমাতা, দেখ কি দশা আমার,
অরে আর ত সহিতে নারি পুত্ত্রশোকভার।
কৃষ্ণ! কি কব দুখের কথা দেখরে চাহিয়া,
আমি কহিতে না পারি প্রাণ যায়রে ফাটিয়া।
সদা করিত সুস্বরে যারে বন্দিগণ স্তব,
এবে সে শুনে শ্মশানে শুয়ে শৃগালের রব।
মাখি অগুরু চন্দন অঙ্গে করিত শয়ন,
হায় দুর্গন্ধ রুধিরে মাথা সে অঙ্গ এখন।
কত সুন্দরী কিঙ্করী যারে করিত ব্যঞ্জন,
এবে সে করে শকুনি-পক্ষ-পবন সেবন।
আহা কুসুমশয়নে গায়ে বাজিত যাহার,
আছে কঠিন মাটিতে পড়ে সহে কি আমার।
দেখ, কৌরব পাঞ্চাল বালা আর বধূগণ,
করে পাগলিনীবেশে রণভূমি দরশন।
হায়! দেখিয়া ওদের দুখ হৃদয় বিদরে,
দেখ, আকুলপরাণে সবে এসেছে প্রান্তরে।
কভু দিনমণি যাহাদের দেখিতে না পায়,
হায়! প্রান্তরে আসিয়া তারা কান্দিয়া বেড়ায়।
করে বধূগণে নিরখিয়া গান্ধারী রোদন,
পড়ে বিবশা হইয়া পুনঃ ধরায় তখন।
—স্মরি তাদের সে ভাব, দুখে লেখনী না সরে,
মম দুনয়নে অবিরত বাষ্পবারি ঝরে।
আমি কি কহির তাহাদের সে দুখের কথা,
তার একদৃষ্টে চেয়ে আছে যার যথা ব্যথা।
মরি হেরি তাহাদের রূপ প্রাণ ফেটে যায়,
যেন চঞ্চলা অচলা হয়ে প্রকাশে ধরায়।
গেছে কবরীবন্ধন খুলে ঝুলিতেছে কেশ,
হয় ধূলায় ধূসর, অঙ্গ পাগলিনী বেশ।
হায়! নেত্রনীরে ধৌত হল নয়নঅঞ্জন,
তাই হইল কপোল কাল শ্যামল বসন।
শোভে সজল কপোল দেশে অলক সকল,
যেন তামরসে সুখে বসি আছে অলিদল।
ক্রমে এ শোকের একশেষ হইল যখন,
হয়ে জ্ঞানহীনা দেখে তারা সেই রণাঙ্গন।
হায়! ক্ষণকাল পরে পুনঃ পাইয়া চেতনা,
কান্দে ধরায় পতিত হয়ে কুরুকুলাঙ্গনা।
সেই অস্ফুট রোদনধ্বনি উঠিল গগনে,
আহা! পাষাণ বিদরে তাহ শুনিলে শ্রবণে
সবে শোকভরে বেগে ধায় শবময় স্থলে,
কেহ হেরি নিজ পতিদেহ ধরে তার গলে।
বলে কোথা যাও অধীনীরে ত্যজিয়া এখন,
নাথ! প্রাণ যায়, কথা কও, জুড়াও জীবন।
নাহি পতিবিনা পতিরতা রমণীর কেহ,
বল কেমনে বিহনে তব, ধরিব এ দেহ।
হায়! না করিয়া প্রণয়ের ব্রত উদ্যাপন,
কভু উচিত কি হয় প্রভু! এ চিরগমন!
কভু চিবুকে ধরিয়া তার কহে সকাতরে,
দেখ রাজার মহিষী হয়ে এসেছি প্রান্তরে।
নাথ! তোমার এ মৌনভাব সাজে কি এখন,
কর নির্ব্বাণ হৃদয়ানল কহিয়া বচন।
বল কি দোষে এ দাসী দোষী তোমার চরণে,
তাই রোষবশে শুয়ে আছ মৃত্তিকাশয়নে।
তুমি ক্ষমা কর অপরাধ, গাতোল এখন,
নাথ প্রাণ যায় দেখি তব বিবর্ণ বদন।
আহা! লাগিছে তপনতাপ সহেনা অন্তরে,
বলি ধরিছে বসনাঞ্চল মুখের উপরে।
কেহ সহসা সুতের মুখ দেখিয়া তথায়,
হায়! কি হইল বলি, পড়ে অমনি ধরায়।
থাকে ক্ষণেক বিবশা হয়ে মিশে শবদলে,
পরে চেতন পাইয়া পুত্ত্রে কোলে করি বলে।
ওরে দুখিনীজীবন! তুই হৃদয়ের ধন,
বল ভূতলে শয়ান আছ কিসের কারণ।
বাছা বিবর্ণ দেখিরে কেন ও বিধুবয়ান,
হল কিসের লাগিয়া বল এত অভিমান।
তুমি যা চাহিবে তাই দিব আছে কি অভাব,
ওরে প্রাণ ফেটে যায় যাদু! দেখে তোর ভাব।
লোকে বীরের জননী বলি ডাকিত আমায়,
হায় কাঙ্গালিনী করে বাছা! যাওরে কোথায়।
তোর দুখিনী জননী আমি করিয়াছি কোলে,
মম হৃদয় শীতল কর ডাকি মা মা বোলে।
বাছা শূন্যগেছে শূন্যদেহে যাইব কেমনে,
ওরে তোরে হারা হয়ে আর কাজ কি জীবনে।
হায়! গগনে বাড়িছে বেলা শুখাল বদন,
উঠ অঞ্চলের নিধি! ঘরে চলরে এখন।
কত দৈব করে পেয়েছিনু পুত্ত্র! তোমা ধনে,
হায়! কি দোষে ত্যজিয়া যাও বধিয়া জীবনে।
অরে হতবিধি! দিয়া নিধি, করিলি হরণ,
কিছু বুঝিতে না পারি তোর বিচার কেমন।
কেহ দেখিয়া পিতার দেহ করে হায় হায়,
কাঁন্দে অধীরা হইয়া শোকে পড়িয়া ধরায়।
বলে সহিতে না পারি পিতঃ এ শোকের ভার,
হেরি দশ দিক্ শূন্যময় ভুবন আঁধার।
হায়! আর কি দেখিতে পাব ও রাঙ্গাচরণ,
কভু শুনিব কি আর সেই স্নেহের বচন।
আহা! তেমন করিয়া কেবা করিবে আদর,
দেখ তোমার নন্দিনী কান্দে হইয়া কাতর।
নাই জগতে ভকতিপদ তোমা বিনা কেহ,
হায়! শূন্যময় হইয়াছে আমাদের গেহ।
কেহ সহোদরে হেরি কাঁদে করি ছায় হায়,
পড়ে ছিন্নমূলতরু যথা সহসা ধরায়।
বলে কোথা গেলে ওরে ভাই। ত্যজিয়া আমারে,
দেখ কাঁদিছে ভগিনী তব প্রান্তরমাঝারে।
ভাই! হইল বান্ধবহীন ধরণী এখন,
হেরি তোমা বিনা এ ভুবন যেন জীর্ণবন।
আহা! এরূপে বিলাপ করে কুলবধূ যত,
শুনি বিদরে হৃদয় দুখে, আর কব কত।
পুনঃ চেতন পাইয়া হায় গান্ধারী তখন,
কহে করুণবচনে কৃষ্ণে করি সম্বোধন।—
দেখ কেশব! ধরিয়া কেহ পিতার চরণ,
হায়! হাহাকার করি কত করিছে রোদন।
কেহ ছিন্নশির যুক্ত করে অন্য কলেবরে,
তাহা, নাহি হয় অবিকল, ভিন্নরূপ ধরে।
কেহ পতিদেহে পতিমুণ্ড করিল যোজন,
হেরি পদহীন পদ তার করে অন্বেষণ।
সবে এইভাবে করে শবদেহের মিলন,
নাহি হেরি অনুরূপ হয় সজল নয়ন।
দেখ রণাঙ্গনে রামাগণে বিষণ্ণবদন,
যেন জ্ঞান হয়, শুখাইল কমলকানন।
ইহা বলিতে বলিতে পড়ে গান্ধারী ধরায়,
হায় দেখিতে দেখিতে শোকে চেতনা হারায়।
পরে চেতন পাইয়া পুন গান্ধারী তখন,
করি শিরে করাঘাত কত করয়ে দেন।
বলে কেশবে কে সবে শোক, জ্বালহ দহন,
এই রণষাগে পূর্ণাহুতি দিব এ জীবন।
সম্পূর্ণ।
দৃষ্টংকিমপি লোকেঽস্মিন্ ন নির্দোষং ন নির্গুণম্।
আবৃণুধ্বমতোদোষান্ বিবৃণুধ্বং গুণান্ বুধাঃ॥
- ↑ মহাভারতে বর্ণিত আছে, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ শেষ হইলে, গান্ধারী মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ণের বরপ্রভাবে গৃহে বসিয়াই রণভূমি দেখিতে লাগিলেন। অনন্তর যুধিষ্ঠির প্রভৃতি পাণ্ডবগণ বেদব্যাসের অনুজ্ঞাক্রমে কৃষ্ণ, ও অসহায় ধৃতরাষ্ট্রকে অগ্রসর করিয়া কৌরব মহিলা গণের সঠিত সেই রণক্ষেত্রে উপস্থিত হয়েন।