কিশোরদের মন/চতুর্থ পরিচ্ছেদ
গরমের ছুটিতে বিমল বাড়ী গিয়েছে। কথা ছিল সুবিনয়ও যাবে।
কিন্তু বিমলদের বাড়ী যেখানে সেখানকার স্বাস্থ্য এ ক’মাস ধরে’ তেমন ভালো থাক্ত না। সুবিনয়ও ওরকম পাড়াগাঁয়ে আর কখনো যায় নি।
বিমল বললে,—“বেশ্ হবে! মা ত গঙ্গাস্নানের যোগেই আস্ছেন,—ক’দিন ত এ সহরেই থাক্বেন, তখন সবারি সঙ্গে দেখা হবে। তুই শীতের সময় যাবি সুবিনয়!”
সুবিনয়ও দেখ্লে যে, বেশ হবে!
দু’জনের কথার যেন শেষ হল না!
কি করে’ যে বিমলকে যেতে হল একেবারে একা একা মন নিয়ে, চোকের জল পড়তে না দিয়ে উননের কড়াইয়ের জলের মতন—জ্বাল দিয়ে বাস্পের ধোঁয়া করে’ করে’, তা সে-ই জানে।
সহরে ট্রেণের টাইম সে পেলে না। মণ্টু আর রেণু ঘুমোলে, রাত্তিরে লুকিয়ে মাকে প্রণাম করে, আর, সুবিনয়ের হাত থেকে হাতখানা ছাড়িয়ে, দু’ মাইল দূরে একটা জংসন ষ্টেসান থেকে তাকে ট্রেণে উঠ্তে হল।
ট্রেণে বসে বসে, বিমল চল্ছিল যেখান দিয়ে সে দেশে বোধ হয় রাত্রি আর দিন নেই। কেন না, ঘুম ত আস্ছিলই না, তার মনটা পেছন দিকে দেখছিল কেবল সুবিনয়কে, মাকে, আর মণ্টুকে আর রেণুকে!
আর সাম্নে দেখছিল ছোট্ট নদী ঘেরা সবুজ গ্রামখানির ভিতরে, উঠোনের ঝল্ক দেওয়া রৌদ্রের সমুদ্রের শ্বেত পদ্মফুলের মত তার মাকে।
জান্লা দিয়ে দেখা যাচ্ছিল, আকাশের তারাগুলো যেন সেই দুইরাজ্যের সারা পথ ভরে’ ফুল ছড়িয়ে রেখে তারি সঙ্গে বসে জাগ্ছে। আর লম্বা ট্রেণ-খানারও যেন এক মাথা সে—ই সহরে, আর এক মাথা তাদের গ্রামে। কেবল ভোর হচ্ছে না। দেখে মোষের মত ফোঁস্ ফোঁস্ করে’ মাঠ মাটি সব রাগে গুঁতিয়ে শুধু গর্জ্জাচ্ছে।
ফর্সা হতেই সে তাদের ষ্টেসানে পৌঁছ্ল। বাড়ী থেকে যেতে যেমন, গাড়ী থেকে নাম্তে যেন, তেম্নি কষ্ট হচ্ছিল। তবু সে নেমে পড়্ল লাফিয়েই। রবারের বলগুলোর যেমন উপরের দিকে টান বেশি কি মাটির দিকে টান বেশি ঠিক নেই, ঠিক্ তেম্নি।
নেমেই সে টিকেটকালেক্টরের হাতে টিকেট্টা ফেলে দিয়ে হন্ হন্ করে’ ছুট্ল আম কাঁটাল বট কদম পাকুড়ের ছায়াঢাকা পথ ধরে,’ যেন দু’সারি সৈন্যের ভিতর দিয়ে সেনাপতি রাজবাড়ীতে চলেছে। খোলা মাঠ বয়ে’ যেন তার বাড়ীর হাওয়া এসে গায়ে লাগ্ছে।
বেলা সাতটায় বিমল বাড়ী পৌঁছ্ল। দেখ্ল উঠোনেই মা। মাকে দেখেই, সে প্রথমে, হেসে দিলে।
“মা! তুই দুঃখু কত্তিস্ আমি তোর একা, ভাই বোন্ একটাও আমার নেই।
কিন্তু মা, এইবারে দেখ্তে পাবি!
ইচ্ছে কচ্ছিল আমার, তোকে এখনি দেখাতে,—ছোট্ট দুটিকে পুরে’ নিয়ে আসি আমার দুটো পকেটে করে’!”
মাও হাসিমুখ হয়ে চেয়ে রয়েছেন শুধু, কিছু না বুঝ্তে পেরে।
তাঁর হাসিটুকু নিয়ে রোদ যেন কাড়াকাড়ি করছিল।
বিমল বল্লে,—“কিন্তু মা আনিনি কেন জানিস্?
তোর হাতের জামা ওরা ছিঁড়ে দিয়েছে।
তার শাস্তি দিতে হবে।
তোকে ওরা দেখ্তে পাবে, সেই যখন তুই গঙ্গাস্নানে যাবি; তার আগে নয়!
কিন্তু মা তোকে নমস্কার কর্তে ভুলে গেছি!”
তখন, দুজনে হাস্তে লাগ্লেন। মা ত তখনো খুব অবাক্ হয়েই।
বিমল বল্লে, “বল্ব, বল্ব মা, শুনিস্, বল্ব!”
খেতে বসে বিমল মার কাছে সব বল্লে।
শুনে মার কাছে যেন একখানি ছবি ফুটে উঠ্ল। মা মনে মনে সে তিনটিকে কতই যে আশীর্ব্বাদ কর্লেন! বিমলের নূতন মার কথা শুনে তাঁর মুখখানা রাঙা হয়ে কী সুন্দর হয়েই উঠ্ল।
বিমল বল্লে,—“কিন্তু মা, তোর কাছে বসে’ আর সব কথাই ভুলে যাই।
সব ভাতগুলো শুধু ডাল দিয়েই খেয়ে ফেলেছি মা!”