কিশোরদের মন/দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ
সুবিনয়ে বিমলে বেশ্ ভাব এখন। একখানা বই আন্তে একদিন বিমল সুবিনয়ের বাসাতে গিয়েছে।
বসে আছে বৈঠকখানাতে।
এমন সময়, মুখখানা ভরা বড় বড় চোক আর জোড়া ভুরু, কুমোরদের-গড়া ছোট্ট প্রতিমার মুখের মত মুখ, একটি মেয়ে, ছবির বই একখানা হাতে করে’ ঘরে ঢুকেই, বিমলকে দেখে বল্লে—“এটাকে দয়েল পাখী বলে? ইস্!—এটা শালিক!—
মণ্টু সব জানে কি-না!”
বলেই, বইয়ের পাখীর ছবির পাতাটা খুলে’ বিমলের হাঁটুর উপর রেখে নিজেও তার কোলের উপর ঝুঁকে পড়্ল।
বিমলের মনে হল, সে যেন আধ মিনিটের মধ্যে কোন্ এক স্বর্গে চলে গেছে! সে নিজে ছিল বেজায় চঞ্চল, কিন্তু এমন সরল এত চঞ্চল মেয়ে সে আর কখনও দেখে নি।
সে খুকুর পিঠ থেকে কাৎ হয়ে ঝুলে পড়া এক রাশ এলো চুলের নীচ দিয়ে বইখানাকে ধরে, তাকে ছবি দেখাতে লাগ্ল।
বিমল শুনেছিল যে, সুবিনয়ের বাবা মা চেঞ্জ থেকে দু’এক দিনেই ফির্বেন। বুঝতে পার্লে যে তাঁরা ফিরেছেন। আর সুবিনয় যে তার ছোট্ট বোন্টির কথা বল্ত, এ সেই।
ছবি দেখ্তে দেখ্তে, খুকু হঠাৎ বিমলের দিকে মুখ ফিরিয়ে চেয়ে বল্লে “তুমি আমার কে হও?”
বিমল হাস্তে লাগ্ল। বল্লে—“আমি তোমার বিমল দা!”
খুকু বল্লে—“বিমল দা, তোমার ঘোড়া আছে?
পা-দুটো এ—ই রকম করে’ চল্বে?
আমি চড়্ব।
মণ্টু আমায় চড়্তে দেয় না।”
বিমলের স্বপ্নটা যেন ভেঙে গেল। সাধারণ গৃহস্থ মা-বাপের ছেলে সে, ট্রাইসিকেলের ঘোড়া সে দেখেছে, কিন্তু ওর, কিছুই সে জানে না।
তবু সে হেসে বল্লে,—“আচ্ছা, মণ্টুকে আমি বলে দেবো।”
খুকু মুখ ভার করে বল্লে-“আমি মণ্টুকে নে’ খেল্ব না।”
বিমল বল্লে—“আচ্ছা খুকু, মণ্টুর নাম ত মণ্টু, তোমার নাম কি?”
খুকু টল্টলে’ দুটো উজ্জ্বল চোক বিমলের দিকে ফিরিয়ে, তুলে’ বল্লে-“আমি রেণু!”
সেই সময় ভেতর থেকে ডাক এল—“খুকু! লক্ষ্মি! আ—মি নাইয়ে দেব, নাইবে এস!”
খুকু চেঁচিয়ে বল্লে—“না মা, আমি নাইব না—আমি ছবি দেখ্ব——।”
ব’লে খুকু বিমলের কোলের উপর আরো ঝুঁকে পড়ে, পা দুটো দোলাতে লাগ্ল।
রাত্রে ট্রেণে আসা হয়েছে, সকাল সকাল ভালো করে’ নাইতে হবে; কিন্তু অত সকালে আর ননূয়ার মার হাতে খুকুর নাইবার ইচ্ছে নেই, তাই ছবির বই নিয়ে, পালিয়েছিল!
বিমল খুকুর পিঠে চুলের উপরে আদরে হাত বুলোতে বুলোতে বল্লে,—“খুকু! সত্যি এখনো তুমি নাও নি? মার কথা শুন্তে হয়! যাও যা-ও নাও গে!”
বিমল হাস্তে লাগ্ল।
খুকু দাঁড়িয়েই, দেখ্ল বিমলদার পিঠের জামাটা ছেঁড়া।
রেণু আরো সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে—“তুমি বুঝি মণ্টুকে ভালো বাস?
—দুষ্টু!”—
বলে’ দুই চোক আরো খুব প্রকাণ্ড করে’—রাগ করে’ দাঁড়িয়ে রইল।
বিমল কিছুই বুঝ্তে পার্লে না, সে আশ্চর্য্যে, আনন্দে, জিজ্ঞেস্ কর্লে—“কি করে জান্লে খুকু?”
“হুঁ, মণ্টু খালি জামা ছেঁড়ে। তুমিও ছিঁড়েচো, নৈলে, তুমি জামা ছিঁড়্লে কেন?”
বিমল এবার আর থাক্তে পার্লে না, ‘হো হো’ করে' হেসে উঠ্ল।
তার হাসিতে রেণু আরো রেগে গেল।
সে বড় বড় চোক একটু কুঁচিয়ে, দুই ঠোঁট চেপে বিমলের জামার ছেঁড়া জায়গায় আঙুল ঢুকিয়ে, পড়্ পড়্ করে’ আরো খানিকটে ছিঁড়ে দিলে।
“রেণু!”
বিমল চেয়ে দেখ্লে, দুর্গামূর্ত্তির মত মা দাঁড়িয়ে রয়েছেন, দরজা পেরিয়ে এসে; চোকে তাঁর ধমক মাখা, কিন্তু তবু তাঁর সমস্ত চেহারা দিয়ে যেন অমৃতের ঝর্ণা ঝরে’ পড়্ছে।
বলে’ রেণু, মার দিকে একটু এগিয়ে এসেই, বলে, তক্ষুণি আবার বিমলের ডান হাতের তিনটে আঙুল ধরে’ দাঁড়িয়ে রইল।
বিমল আগেই উঠে পড়েছিল। কার্পেটের উপর পা এগিয়ে, সে-ও দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। দোরের খোলা হাওয়াতে তার ছেঁড়া জামা তখন ইষ্টিমারের কোণ বাঁধা পর্দ্দার মত উড়্ছিল। সে তারি লজ্জা ঢাক্বে, কি সব কথা মনে করে হাস্বে, কি মাকে প্রণাম কর্বে, কিছুই ঠিক কর্তে পারছিল না।
মা এসেছিলেন খুকুর আব্দারে’ চীৎকারটি শুনে’ তাকে ধরে নিতে। ভাব্ছিলেন সে বুঝি সুবিনয়ের পড়ার ঘরে তার কাছে ছবি দেখ্ছে। বৈঠকখানার ধারে আস্তেই খুকুর কাণ্ডটি দেখতে পেলেন।
সুবিনয় ত নয়, তারি মত একটি ছেলে। তা—র জামাটা ছিঁড়ে দিচ্ছে!
একটু এগিয়ে, মা বল্লেন—“খোকা, তোমার নাম বিমল? কোথায় থাকো তুমি বাবা?”
মার কথাতে বিমল যেন কূল পেয়ে, আস্তে এগিয়ে এসে, মাকে প্রণাম করে,’ বল্তে যাচ্ছিল।
—এমন সময় মা দেখ্লেন, সুবিনয়।
সুবিনয় ঘরে ঢুক্তেই,…“কেমন! দ্যাখো দাদা! দিয়েছি ত ছিঁড়ে জামা? কেমন!”
বলে’ খুকু, ভারি খুসী হয়ে উঠল।