(৫)

কেন হাস? মিথ্যা একি? অলীক ঘটনা?
আমি কি করেছি শুধু স্বপন রচনা?
তবে কেন চিত্ত মাঝে আজো কেঁপে উঠে?
পরাণের কুঞ্জে কুঞ্জে কেন পুষ্প ফুটে?

এই যে দিবস নিশি মোর চারি পাশে
হৃদয়ের অন্তস্থলে, আকাশে বাতাসে,
সকল বিশ্বের মাঝে ফুলের সৌরভ!
মিথ্যা এ আনন্দ ভাস? মিথ্যা এ গৌরব?


সকল পরাণে মোর সারা দেহময়
এই যে দিবস নিশি কি যে কথা কয়,
কত না জীবন্ত ভাবে কত শত সুরে,
বাজিছে গানের মত এই প্রাণ পূরে!—

কভুবা গভীর কভু মধুর সরল,
কভুবা কঠিন কভু করুণা তরল!
নিমিষে নিমিষে মোরে হাসায় কাঁদায়
নিমিষে নিমিষে মোরে মরায় বাঁচায়!


এও মিথ্যা! আমি আছি, তাও মিথ্যা তবে?
আমি নাই! তুমি নাই, কিছু নাই ভবে!
মিথ্যা তবে সে দিনের ধূসর গগন!
তুমি মায়া, আমি মায়া! মোদের মিলন

মিথ্যা সে মায়ার খেলা! সেই মধু হাসি?
সেই যে অধরে তব উঠেছিল ভাসি?
তাও ভুল? তাও স্বপ্ন? তাও মিথ্যা তবে?
চোখের চাহনি সেই? তাও মিথ্যা হবে!


সেই যে কি জানি কেন বক্ষের দোলনি!
অবাক বিভোর সেই চক্ষের চাহনি!
যেন কোন দূরাগত সঙ্গীতের বাণী
সচকিত করেছিল সব দেহখানি!

স্রোতেতে ভাসা দেহ মন তরঙ্গ মূরতি!
সকল চাঞ্চল্যভরা, আচঞ্চল গতি
ফুটিয়া উঠিল সেই—চিরদিন তরে,—
আমার বক্ষের মাঝে পঞ্জরে পঞ্জরে!


এও তবে মিথ্যা কথা! শুধু স্বপ্ন বুঝি?
আমি তো হেরিছি সদা দুটি চক্ষু বুজি!
হারাইয়া যায় ব’লে বক্ষ চেপে রাখি!
আমি যে হেরিছি সদা—তাও মিথ্যা নাকি?

তবে মিথ্যা, মিথ্যা সেই আনন্দের ভাস,
আমি মিথ্যা, মিথ্যা সেই, মায়া সন্ধ্যাকাশ!
মিথ্যা সেই মধুভরা শ্যাম-দুর্ব্বাদল
মিথ্যা সেই প্রাণভরা আঁখি ছলছল!


মিথ্যা সেই সত্য-রূপী মুরতি তোমার,
আমি মিথ্যা, তুমি মিথ্যা, সবি মিথ্যাকার!
জগৎসংসার মিথ্যা মায়ার ছলনা!
বল কোন প্রবঞ্চক দৈত্যের রচনা?

মিথ্যা সেই কোমলতা করুণ-রূপিণী ৷
বুঝিবা চোখের দোষে দেখিতে পারিনি
ভাল করে’ স্বল্পালোকে, সেই সে তোমারে,
মায়া-মন্ত্রালোক-ঘেরা, সন্ধ্যার আঁধারে!


কে দিল নয়নে মায়া-অঞ্জন বুলায়ে?
সকল অন্তর মোর কে দিল ভুলায়ে?
ওগো আমি কারে বলি কারে হেরিলাম,
নয়ন-পুত্তলি মম—আঁখি অভিরাম।

তবে কি হেরেছি যাহা তুমি তাহা নহ?
ওগো মায়া! ওগো মিথ্যা! সত্য ক’রে কহ।
কোন দানবের সৃষ্টি দেবীর আকারে
দেখা দিলে সেই দিন মোরে ছলিবারে?


তবে কোন ছদ্মবেশী রূপসী রাক্ষসী
আমার এ অন্তরের অন্তঃপুরে বসি’
যত না মাধুরী ছিল, ছিল যত প্রাণ,
একই নিশ্বাসে সব করেছিল পান,

চিরস্মরণীয় সেই সন্ধ্যাকাশতলে?
আনন্দ-আবেশ-ভরে নয়নের জলে
আমি যে হেরিনু তব নিত্য মধুরূপ;—
প্রাণ-স্রোতে টলমল পদ্ম অপরূপ!


আজো হেরিতেছি তাই সেই সে তোমারে
দিবালোক-মহিমায় নিশীথ আঁধারে।
সকল জীবন ভরি’ প্রত্যেক নিমেষে,
সকল কর্ম্মের মাঝে সব কর্ম্ম শেষে!

সেই সেই তরঙ্গিত পরাণ মূরতি
সকল চাঞ্চল্যভরা আচঞ্চল গতি!—
সকল লাবণ্য-গড়া রূপে ঢল ঢল,
পরাণ-তরঙ্গে সেই স্থির শতদল!


সঘন গগনে থির চপলার মত
উজলি জীবন মোর জলে অবিরত!
সকল করম মাঝে সব কামনায়,
সকল ভাবের মাঝে সব ভাবনায়!—

সকল ঘুমের মাঝে সব চেতনায়,
সকল সুখের মাঝে সব বেদনায়,
সকল স্বপন মাঝে সব সাধনায়,—
সকল ধ্যানের মাঝে সব ধারণায়!


মিলনের মন্ত্রপড়া সেই সন্ধ্যাতলে
সেই মধু জ্বল জ্বল শ্যাম-দূর্ব্বাদলে,
অবাক নয়নে তুমি দাঁড়ালে যখন
অন্তহীন মহিমায়! সেই সে তখন—

অনিত্য কালের মাঝে একটি নিমেষ,
চমকি' থমকি' যেন আনন্দে অশেষ
ফুটিল গৌরবভরে চির-নিত্য হয়ে;
ঘিরি তারে কালস্রোত যেতেছিল বয়ে!


অফুরন্ত চির-সত্য অনন্ত অশেষ
অনিত্য কালের মাঝে সেই সে নিমেষ!
চিরদিন জাগিবে সে আপন গৌরবে!
তুমি আমি যত দিন তত দিন রবে!

সেই সে নিমেষ মাঝে তুমি দেখা দিলে
তুমি কিগো চিরকাল তারি মাঝে ছিলে?
কোন মহা-পরাণের বাঁশরী শুনিলে
আপনার আবরণ খুলে ফেলে দিলে।


সেই যে মুহূর্ত্ত মোর, তুমি মূর্ত্তি তার!
নহ মিথ্যা! সত্য তুমি! সত্য রূপাধার!
সত্যই সে দিন আমি নয়নে হেরেছি,—
সত্যই পরাণ ভ'রে পরাণে তুলেছি!

অখণ্ড সুন্দর তনু মধুর গম্ভীর,
রূপ রস গন্ধ ভরা আত্মার মন্দির!
পদতলে কলকলে কাল উর্ম্মিমালা
শিরে কোন্ দেবতার নিত্য দীপ জ্বালা।


এই যে প্রত্যক্ষ মোর প্রাণ মাঝে জাগে
তোমারে বুঝাতে নারি তাই ব্যাথা লাগে
কেমনে বুঝাব তোমা; ওগো বক্ষবাসি,
আমি সে মূরতি-স্রোতে দিবানিশি ভাসি।

মনে হয় চিরকাল ভেসে ভেসে যাই
কর জনমের সাধ বুকে লয়ে তাই
সেই সে মূরতি-স্রোতে দিবানিশি ভাসি।
এখনো সন্দেহ তব? ফের ওই হাসি?


আরে আরে অবিশ্বাসি! আরে রে নির্দ্দয়!
ওই তব বক্ষতলে নাহি কি হৃদয়?
সেদিন কি প্রাণে তোর ডাকে নাই বান?
ফুলে ফুলে উঠে নাই সকল পরাণ?

ভেসে বহে যায় নাই সকল মরম,
ডুবাইয়া সব কর্ম্ম, সকল ধরম,
ওই কোথাকার সুধা সাগরের পানে,—
পেতে পেতে নাহি পাওয়া কাহার সন্ধানে?


আমার পরাণ ভ’রে কি গীত গুঞ্জরে!
মরমের প্রতি পত্রে কি ফুল মুঞ্জরে!
বুঝাতে পারি না তোরে তাই কাঁদে প্রাণ,
পরাণ ছাপায়ে তাই ভাসে দু’নয়ান!

ওগো মর্ম্মলতা! মরমে জড়ায়ে থাক!
আমার বক্ষের মাঝে রাখ মুখ রাখ!
তবে যদি নীরবে গো পারি বুঝাইতে
আজো যাহা পাই নাই হেরিতে শুনিতে!


রাখ বুকে বুক! করগো হৃদয়ঙ্গম!—
প্রাণ-গঙ্গা মোর কোন সাগর-সঙ্গম
পানে বহি চলিয়াছে, দিবসরজনী,
কার পিছে পিছে, শুনি কার শঙ্খধ্বনি!

বুঝিতে পার না কিছু? থাক তবু থাক
আমার বক্ষের মাঝে লতাইয়া থাক!
তোমারে হৃদয়ে রাখি মোর মনে হয়
কে যেন আমার মাঝে সদা কথা কয়!


কে যেন ডাকিছে কত মধুর মন্তরে
আমাদের দুজনের অন্তরে অন্তরে!
কে যেন গো এসে এসে ফিরে চলে যায়,
হেসে হেসে জীবনের বিজন তলায়!

ওগো মর্ম্মলতা! থাক তবু থাক
আমার মর্ম্মের মাঝে জড়াইয়া থাক!
তুমিও শুনিবে প্রাণ! আমি যদি শুনি!
সেই তার নূপুরের মধু রুণুরুণী!


তুমিও হেরিবে প্রাণ! আমি হেরি যদি!
চিত্ত-মাঝে রবে বাঁধা নিত্য নিরবধি!
দেখিব দেখাবো তোরে মরমে মরমে
জীবন-মরণ ভ’রে জনমে জনমে!