(৬)

কেমনে উঠিবে ফুটি শুধু এক দিনে?
আরে! আরে! ফুল যবে হেসে ফুটে উঠে
শ্যাম পল্লবের বুকে, সুখ-সূর্য্য-করে,
একটি প্রভাত লাগি, এক নিমেষের
মাঝে, সেকি শুধু সেই মুহূর্ত্তের
লীলা? তার তরে করেনি কি আয়োজন
সমগ্র জীবন-লীলা যুগ যুগান্তের,
জন্ম জন্মান্তর ধরে? অনন্ত কালের
শুভ সঙ্গীতের মাঝে উঠে সে ফুটিয়া—
ফুটেনা ফুটেনা ফুল শুধু এক দিনে!

সেই যে মিলিনু দোঁহে সন্ধ্যাকাশতলে
সে কি শুধু মুহূর্ত্তের মিলন-উৎসব?
অকস্মাৎ আকারণ সামান্য ঘটনা?
মুহূর্ত্তে আরম্ভ তার মুহূর্ত্তেই শেষ?
সেই যে দরশ তব, আঁখি অনিমেষ,
সে যে মোর শুভ-দৃষ্টি জনমে জনমে
চির পরিচিত! সে যে অনন্ত কালের!–
যোগভ্রষ্ট যোগযুক্ত যুগ যুগান্তের!
তোমারে দেখেছি শুভে! কত শত-বার!
আবার দেখিলু সেই সন্ধ্যাকাশতলে!

যোগভ্রষ্ট আমি! কেমনে বর্ণিব বল
অনন্ত কালের সেই মাধুর্য্য-কাহিনী?
যুগে যুগে কেমনে যে পরশ লভেছি!
জনমে জনমে কেন হারায়ে ফেলেছি!
কেনবা পাইনু সেই সন্ধ্যাকাশতলে!
ফুটিয়া উঠিলে মরি! মধু-জ্বল-জ্বল
উজল রসের মূর্ত্তি! কত না কল্পনা
করিছে, জীবন যেন স্বপন-বাহিনী!
যেন ধরা দেয়, শত শত জনমের
কত না হাসির ধ্বনি কত অশ্রুজল!

জীবন-লীলার সেই প্রথম প্রত্যূষে
মনে হয়, ছিনু মোরা শিলাখণ্ড দুটি!–
অগাধ আঁধারে যেন ভেসে ভেসে উঠি
দুইটি উপল খণ্ড সৃষ্টি পারাবারে!
বুকে বুক লাগা, সেই যে প্রথম জাগা
প্রাণদীপ্ত মন্ত্রমুগ্ধ নির্ব্বাক্‌ অবাক্
দুইটি পরাণ! কে দিল তরঙ্গ তুলি?
আবার ডুবিনু কেন আঁধার নির্জ্জনে?—
তরঙ্গসস্কুল সেই গভীর অর্ণবে
জীবন-লীলার কোন্ প্রথম প্রত্যূষে?

তারপরে কত কাল কত যুগ ধরে
কালের তিমির-স্রোত ব’হে চলে যায়
কোন্ চিহ্নহীন পথে? আলোকবিহীন
কোন্ ঘন-তমসায়? কোন্ স্মৃতিহীন,
পুঞ্জীভূত অন্ধকার অরণ্যের মাঝে
হ’য়ে যায় লীন! সেই মহা শূন্যে যেন
অট্ট হাসে পূর্ণ করি দিক দিগন্তর
নৃত্য করে উন্মত্ত সে কোন্ দিগম্বর!
তারি মধ্যে তুমি আমি ছিনু কি নিদ্রায়
কত দিন কত কাল কত যুগ ধরে?

তারপর হেসে উঠে নব-বসুন্ধরা
ফলে পুষ্পে ভরা ভরা! কৌতুকে অপার
চাহিল নয়ন মেলি নব সূর্য্যপানে!
মোরাও জাগিনু দোঁহে! মধুবন মাঝে
আমি বনস্পতি ওগো! তুমি বনলতা!
কি আনন্দে কি গৌরবে মেলিলাম আঁখি!
আকড়িয়া ধরিলাম কঠিন হৃদয়ে,
মধুর কোমল কান্তি সেই লতিকারে!
গলাগলি জড়াজড়ি মিলন রভসে!
হেসে হেসে উঠিল সে নব-বসুন্ধরা!

সেই বার সেই মোর ভ্রমর জনম!
গুন্ গুন্ গাহি গান ভ্রমি বনে বনে!
বুকে লয়ে জন্মান্তের বিরহ-বেদন
গুন্ গুন্ গাহি গান ভ্রমি আনমনে!
অকস্মাৎ এক দিন কানন-প্রান্তরে
অপূর্ব্ব কুসুম-রূপে উঠিলে ফুটিয়া!
আনন্দেতে আগুসারি মিলন-তৃষায়
যেমনি আসিনু কাছে, কোন্ ঝটিকায়
ছিন্ন ভিন্ন হ’য়ে তুমি কোথায় লুকালে!–
খুঁজিতে খুঁজিতে গেল ভ্রমর-জনম।

তারপর মনে আছে? ভেলায় ভাসিনু
তুমি আমি নরনারী জীবন-সাগরে!
আশ্চর্য্য অবাক্ হ’য়ে আমি চেয়ে ছিনু,
কি জানি কেমন করে তুমি চেয়ে ছিলে!
কুসুমিত মুখকান্তি; মধু দেহলতা;
দোল দোল জ্বল জ্বল রূপের গৌরবে?
সে কি প্রেম? ভালবাসা? আকাঙ্ক্ষা? বাসনা?
কোন্ টানে চেয়ে থাকা এমন নীরবে?
চাহিতে চাহিতে কেন উঠিল তুফান?
তুমি আমি ডুবিলাম সে কোন্ সাগরে?

তারপর? পশুপক্ষী করিনু শিকার;
ভীষণ অরণ্য মাঝে ব্যাধের জনম।
একদিন বনপ্রান্তে ত্রস্তা সে হরিণী
যেমনি ফেলিনু তারে বাণবিদ্ধ করে,
সজল সরোষ আঁখি ভরা বেদনায়
কোথা হ’তে বহিরিলে বন আলো ক’রে।
নতজানু হ’য়ে কত ক্ষমা চাহিলাম,
কহিলে না কোন কথা, ছুটে চলে গেলে!
ওগো বনলতা! ওগো করুণা-রূপিণী!
সে জনমে আর কভু করিনি শিকার।

বন শকুন্তলা তুমি বনের মাঝারে
লতা-পাতা-ঘেরা ক্ষুদ্র মোদের কুটীর!
এ জনমে কাঠুরিয়া কাঠ কাটিতাম
ফল মূল জল তুমি বহিয়া আনিতে!
একদিন আক্রমিল কৃতান্তের মত
নিষ্ঠুর দস্যুর দল ঘোর অন্ধকারে!
শানিত ছুরিকা লয়ে কাঁপিতে কাঁপিতে
তোমার আমার বক্ষে বসায়ে দিলাম।
সেদিন একত্রে মোরা যাত্রা করিলাম
কোন্ টানে কি আশায় নিশার মাঝারে!

পরজন্মে জনমিলে মধু পদ্ম-আঁখি
রাজার নন্দিনী হয়ে!  তব মালঞ্চের
আমি ছিনু মালাকর!  প্রভাতে সন্ধ্যায়
গাঁথিতাম মালা, তুলি ফুল কাননের!
কি জানি কি বহে যেত শিরায় শিরায়!
কত হাসিতাম, কাঁদিতাম থাকি থাকি!
একদিন মালা দিতে কি দিনু কি জানি!
ধরা প’ড়ে গেনু!  পরদিন বধ্য-ভূমে
যবে নিবু নিবু প্রাণ, উর্দ্ধে চেয়ে হেরি
জ্বলিছে গবাক্ষে দুটি অশ্রুভরা আঁখি!

সৈনিকের বধু তুমি সে কোন্‌ জনম?
ছিলে মোর বক্ষ ভ’রে! দেহ মন গড়া
অনলে বিদ্যুতে ফুলে! চোখে হোমশিখা!
চপলা চমকে বুকে! অঙ্গের লাবণি
কুসুম-স্তবক সম মধুর কোমল!
অকস্মাৎ রণভেরী উঠিল বাজিয়া!
শত্রুর কৃপাণ যবে লাগিল হৃদয়ে,
একবার ভয় হ’ল পাছে যত্নে রাখা,
চিত্ত মাঝে তব মূর্ত্তি ছিন্ন হ’য়ে যায়!
পরক্ষণে হাসিলাম; ফুরাল জনম |

আমি কবি, রাজগৃহে গাহিতাম গান
প্রহরে প্রহরে! কত শত জনমের
মিলন বিরহ-ব্যথা সুখ দুঃখ আশা
ফুটিয়া উঠিত যেন সেই জনমের
প্রত্যেক গানের মাঝে! কারে খুঁজিতাম?
একদিন হেরিলাম লতার আড়ালে
কাল’ কাল’ দুটি চোখ, ঢাক ঢাক যেন
এলোমেলো চুলে! সেই দৃষ্টি, সেই হাসি!
সেই কত জনমের চেনা চেনা ভাব!
চমকিয়া উঠিলাম! বন্ধ হ’ল গান।

তারপর? পরজন্মে আমি চিত্রকর,
রূপসী রমণী তুমি ধনীর সংসারে!−
বহুজনসমাকীর্ণ বিপুল সে পুরী!
একদিন তোমারই আলেখ্য আঁকিতে
আমারে লইয়া গেল নয়ন বাঁধিয়া
কত রাস্তা গলি ঘুঁচি কত সিঁড়ী দিয়া
একটি কক্ষের মাঝে! সম্মুখে দর্পণ,
তারি মাঝে ভাসিতেছে প্রতিবিম্ব তব!
হৃদয়ের রক্ত দিয়া আঁকিনু সে ছবি!
হেরি কহে সবে, অপূর্ব্ব এ চিত্রকর!

মনে কি পড়ে না সেই শিবের মন্দির?
আমি যে পূজারী ছিনু সেই দেবতার।
তুমি সেবাদাসী! কোথা হ’তে এসেছিলে
নাহি জানি! দিবারাত্র মন্দির-প্রাঙ্গণে
ফুল্ল কুসুমের মত রহিতে পড়িয়া!—
সেই ঢল ঢল ঢল অঙ্গের লাবণি!
একদিন পূজা শেষে, আকুল অধীর
মত্তপ্রাণে যেই তোমা বক্ষে বাঁধিলাম,
চূর্ণ হ’য়ে পড়ে গেল মস্তকে আমার—
সেই জনমের সেই শিবের মন্দির!

একি সত্য? একি মিথ্যা? জানি না জানি না
জানি শুধু এই লীলা অনন্ত কালের!
জানি আমি জন্মে জন্মে তোমারে পেয়েছি,
লভেছি পরশ কত ভাবে কত বার!
তারি চিত্রগুলি যেন ভেসে ভেসে আসে
আলোক ছায়ার মত মোর চিত্ত-বাসে।
তোমারেই পাই ওগো, বারে বারে বারে
তরঙ্গের মত মোর মরম বেলায়।
মিলনে বিরহে কত। আর তারি সনে
যেন বেজে উঠে অনাদি কালের বীণা।

অনন্ত কালের লীলা নহে একদিনে!
সৃষ্টির প্রথম হ’তে চির প্রসারিত
মোর বাহু দুটি, জন্ম জন্ম করি ভেদ
বিদ্ধ করি ব্যাপ্ত করি যুগ যুগান্তর!
তারি আলিঙ্গন মাঝে, ধরা প’ড়ে গেলে
সেই দিন! যেন কোন্‌ মহাদেবতার
মহা-মিলনের তরে মিলেছি আমরা!—
যুগে যুগে জনমে জনমে বার বার!
তাই সন্ধ্যাকাশতলে উঠিলে ফুটিয়া;
ফোটনি ফোটনি প্রাণ, শুধু একদিনে।