কুমার সম্ভব/দ্বিতীয় সর্গ
দ্বিতীয় সর্গ।
সেই সময়ে তারকাসুর দেবতাদিগের উপর দুঃসহ উপদ্রব আরম্ভ করাতে তাঁহারা ইন্দ্রকে প্রধান করিয়া ব্রহ্মলোকে উপনীত হইলেন॥ ১॥
সরোবরে তাবৎ পদ্ম মুদিত আছে এমন সময়ে যেমন প্রভাত হইলে সূর্য্য উদয় হয়েন, তেমনি সেই সকল দেবতার মুখশ্রী মলিন, এ অবসরে ব্রহ্মা দেখা দিলেন॥ ২॥
অনন্তর, যিনি সকলের সৃষ্টিকর্ত্তা, যাঁহার মুখ চারিদিকে আছে, যিনি বাক্যের অধিপতি, সেই ব্রহ্মাকে দেবতারা নমস্কার করিয়া নিম্নলিখিত স্তুতিবাক্য দ্বারা তাঁহার স্তব আরম্ভ করিলেন; তবে অন্যান্য স্তুতি বাক্য যেরূপ মিথ্যা ও নিরর্থক হইয়া থাকে, এগুলি সেরূপ নহে, সকল কথাই ব্রহ্মার পক্ষে যথার্থ ও সার্থক॥ ৩॥
যিনি সৃষ্টির পূর্ব্বে একমাত্র মূর্ত্তিধারী ছিলেন, সত্ব রজ তম এই তিন গুণের আশ্রয়ে পৃথক্ পৃথক্ হইয়া তিন মূর্ত্তি ধারণ করিয়াছিলেন, তাঁহাকে নমস্কার॥ ৪॥
হে জন্মবিহীন পুরুষ! কারণ, জলের মধ্যে আপনি যে অব্যর্থ বীজ বপন করিয়াছিলেন, তাহা হইতেই স্থাবর জঙ্গমাত্মক ব্রহ্মাণ্ডের উৎপত্তি। আপনাকে সুতরাং উহার আদিকারণ বলিয়া কীর্ত্তন করে॥ ৫॥
আপনি এক বটেন, কিন্তু তিন মূর্ত্তিতে নিজ মহিমা প্রকটিত করিয়া সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়ের কারণ স্বরূপ হইয়া আছেন॥ ৬॥
সৃষ্টি করিবার অভিপ্রায়ে আপনি নিজ মূর্ত্তিকে যে দুই খণ্ডে পৃথক্কৃত করেন, তাহারাই স্ত্রী ও পুরুষ রূপে পরিণত হয়, সুতরাং স্ত্রী ও পুরুষ তোমার মূর্ত্তির অংশ স্বরূপ। আর সেই স্ত্রী পুরুষ হইতেই তাবৎ শরীরী পদার্থ জন্মলাভ করিয়াছে, তাঁহারা শরীরী বস্তুমাত্রের জনক জননী স্বরূপ॥ ৭॥
আপনার যে কাল পরিমাণ, তদনুসারে আপনি দিবা রাত্রি বিভাগ করিয়া যখন নিদ্রা যান, তখন সংসারের প্রলয় হয়, যখন জাগরিত হয়েন, তখন উহার সৃষ্টি হয়া॥ ৮॥
আপনি জগতের কারণ, আপনার কারণ কেহ নাই, আপনি জগৎকে শেষ করেন, কিন্তু আপনাকে শেষ করিবার কেহ নাই; আপনি জগতের অগ্রে ছিলেন, কিন্তু আপনার অগ্রে কেহ ছিল না; আপনি জগতের প্রভু, কিন্তু আপনার প্রভু কেহ নাই॥ ৯॥
আপনাকে জানিতে আপনি নিজেই যা জানেন; আপনার সৃষ্টি আপনি নিজেই করেন; আর সর্ব্বকর্ম্মক্ষম যে আপনার নিজ আত্মা, তদ্বারা আপনি আপনাতেই লীন হয়েন॥ ১০॥
আপনার যাহা ইচ্ছা সেই ক্ষমতা ধারণ করিতে পারেন; ইচ্ছা হইলে দ্রব পদার্থ হয়েন, ইচ্ছা হইলে কঠিন বস্তু হয়েন; ইচ্ছামতে স্থূল ও সূক্ষ্ম, লঘু ও গুরু এবং প্রকাশ ও অপ্রকাশ, সকল প্রকার বস্তুই স্বেচ্ছানুসারে হইতে পারেন॥ ১১॥
যে সকল পরম পবিত্র বাক্যের আরম্ভে ‘ওঁ’ এই শব্দ উচ্চারণ করিতে হয়, যাহাদিগের উচ্চারণ কালে উদাত্ত অনুদাত্ত ও স্বরিত এই তিন স্বরের প্রয়োগ করিতে হয়, যাহারা উপদেশ দিয়া থাকে যজ্ঞ করিবার জন্য, এবং স্বর্গ হইবে এই পুরস্কারের প্রত্যাশা দেয়, সেই সমস্ত বেদ বাক্যের উৎপত্তি আপনা হইতেই হইয়াছিল॥ ১২॥
সাংখ্য দর্শনে যে প্রকৃতির কথা আছে, যিনি পুরুষের ভোগ্য বস্তুসমূহ সৃষ্টি করেন এবং যে পুরুষের কথা আছে, যিনি নিশ্চিন্ত ও নির্লেপ থাকিয়া প্রকৃতিকে দর্শন করেন, সেই শাস্ত্রোল্লিখিত প্রকৃতি ও পুরুষ, এ উভয়ই আপনি॥ ১৩॥
আপনি পিতৃপুরুষদিগেরো পিতা, আপনি দেবতাদিগেরো দেবতা, আপনি সকল সূক্ষ্ম বস্তু অপেক্ষা সূক্ষ্ম, আপনি অন্যান্য সৃষ্টিকর্ত্তাকেও সৃষ্টি করিয়াছেন॥ ১৪॥
আপনিই আহুতি, আপনিই হোম করেন; আপনিই আহারের বস্তু, আপনিই আহার করেন; আপনিই জানিবার বস্তু এবং আপনিই উহা জানেন; আর আপনিই ধ্যান করিবার বস্তু অথচ আপনি ধ্যান করেন॥ ১৫॥
ব্রহ্মা দেবতাদিগের মুখ বিনির্গত এই সমস্ত মিথ্যাস্পর্শ শূন্য স্বমধুর স্তুতিবাক্য শ্রবণপূর্ব্বক প্রসন্নতাপূর্ণ অনুকূল অন্তঃকরণে তাঁহাদিগের কথার উত্তর দিলেন॥ ১৬॥
দ্রব্য গুণ ক্রিয়া জাতি এই চারি লইয়া ভাষা; অতএব সেই প্রাচীন গ্রন্থকর্ত্তা ব্রহ্মা যখন আপনার চারি মুখে বাক্য উচ্চারণ করিতে লাগিলেন, তখন ভাষার পূর্ব্বোক্ত চারি প্রকার অবয়ব যেন চরিতার্থতা লাভ করিল॥ ১৭॥
হে প্রভূত পরাক্রমশালী যুগকাষ্ঠ তুল্য দীর্ঘ বাহুধারী দেবগণ! আপনারা যে সকলে একত্রে আসিয়াছেন, জিজ্ঞাসা করি আপনাদিগের মঙ্গল ত? আপনারা নিজ নিজ ক্ষমতাবলে আপন আপন পদ অধিকার করত কালযাপন করিতেছেন ত?॥ ১৮॥
ব্যাপারটা কি? যেমন শীতকালের সমাগমে আকাশের গ্রহ নক্ষত্রাদি জ্যোতিঃ পদার্থের ঔজ্জ্বল্য হ্রাস হইয়া যায়, সেই রূপ আপনাদিগের মুখমণ্ডলে পূর্ব্বের মত স্বভাব সিদ্ধ আলোকময় কান্তি আজি দেখিতে পাই না কেন?॥ ১৯॥
দেখিতেছি যে ইন্দ্রের বজ্র হইতে পূর্ব্বে যে অগ্নিশিখার ন্যায় জ্যোতি নির্গত হইত, তাহা সকলি নির্ব্বাণ হইয়াছে, তাহাতে আর নানা বর্ণের বিচিত্র শোভা দেখিতেছি না, জ্ঞান হয় যেন উহার ফলায় আর ধার নাই॥ ২০॥
আরো দেখিতেছি, বরুণের হস্তে এই যে নাগপাশ, যাহাকে নিবারণ করা শত্রুবর্গের অসাধ্য, উহার এখন তেমনি দশা হইয়াছে, যেমন মন্ত্রবলে সর্পকে নিস্তেজ করিয়া দিলে তাহার অবস্থা হইয়া থাকে॥ ২১॥
কুবেরের হস্তে গদা নাই, উঁহাকে দেখিলে মনে হয় যেন বৃক্ষের শাখা ভঙ্গ হইয়া গিয়াছে; দেখিলেই জ্ঞান হয় যেন উনি কোথাও অপদস্থ হইয়া অন্তঃকরণে ঘোর যাতনা ভোগ করিতেছেন॥ ২২॥
যমও দেখিতেছি যে আপন দুর্দ্ধর্ষ দণ্ডদ্বারা পৃথিবীতে আঁক কাটিতেছেন, যমদণ্ডের সেই প্রভা কোথা গেল? লোকে নির্ব্বাণ অঙ্গার লইয়া যে ব্যবহার করে, উনি আপনি আপনার দণ্ডের প্রতি সে ব্যবহার কেন করিতেছেন॥ ২৩॥
আর এই যে দ্বাদশ দিবাকর, ইহাদিগের তেজ নষ্ট হইয়া শীতল হইল কেন? চিত্রপটে লিখিত সূর্য্যের ন্যায় উঁহাদিগের প্রতি দৃষ্টিপাত,করিতে ক্লেশ হয় না কেন?॥ ২৪॥
যে পথে স্রোত যাইতেছিল, তদ্বিপরীত দিকে উহার গতি দেখিলে যেমন বুঝা যায় যে কোথাও স্রোতের পথ রুদ্ধ হইয়াছে, তদ্রূপ এই উনপঞ্চাশ বায়ুর অস্থিরতা দর্শনে বিলক্ষণ বুঝিতেছি যে ইঁহাদিগের গতি আর স্বেচ্ছাধীন নাই॥ ২৫॥
একাদশ রুদ্রের মস্তকের জটাজূট যেরূপ অবনত হইয়ছে এবং উহাতে চন্দ্রকলাগুলি যে প্রকার লম্বমান হইয়া আছে, তদ্দর্শনে বিলক্ষণ বোধ হয় যে পূর্ব্বে উঁহাদিগের হুঙ্কারে যেরূপ শক্র বিনাশ হইত, এখন আর, সেরূপ হয় না॥ ২৬॥
যেমন বিশেষ সূত্রের প্রয়োগ স্থলে সামান্য সূত্র প্রয়োগ হয় না, তদ্রূপ আপনাদিগের পূর্ব্বাধিকৃত পদগুলি কি প্রবলতর শত্রুদিগের দ্বারা অপহৃত হইয়াছে॥ ২৭॥
অতএব হে বৎসগণ! বল কি অভিলাষে আমার নিকট সকলে মিলিয়া আসিয়াছ? কারণ আমি লোকদিগের সৃষ্টিমাত্র করিয়া থাকি, কিন্তু উহাদিগকে রক্ষা করিবার ভার তোমাদিগের হস্তেই ন্যস্ত আছে॥ ২৮॥
তখন দেবরাজ বৃহস্পতির প্রতি আপনার সহস্র দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া বৃত্তান্ত বলিতে ইঙ্গিত করিলেন। এই রূপে তাঁহার সেই সকল পদ্মপলাশতুল্য লোচন প্রেরিত হওয়াতে জ্ঞান হইল যেন সুমন্দ বায়ু হিল্লোলে পদ্মবন আন্দোলিত হইয়া গেল॥ ২৯॥
ইন্দ্রের সহস্র চক্ষু, বৃহস্পতির দুই চক্ষু, তথাপি ইন্দ্রের সহস্র চক্ষুর অতীত বস্তু দর্শন করাইয়া বৃহস্পতিই দিয়া থাকেন, সেই বৃহস্পতি এখন কৃতাঞ্জলি হইয়া পদ্মাসন ব্রহ্মাকে এই সমস্ত কথা বলিতে আরম্ভ করিলেন॥ ৩০॥
হে ভগবন্। আপনি যাহা অনুমান করিয়াছেন, তাহা যথার্থ; সত্যই বিপক্ষেরা আমাদিগের পদ অপহরণ করিয়াছে। আর, প্রভো, আপনি যে ইহা জানিতে পারিয়াছেন, তাহাতে আশ্চর্য্য কি? কারণ তাবৎ ব্যক্তির অন্তরাত্মার মধ্যে আপনি বিরাজ করিয়া থাকেন॥ ৩১॥
তারক নামে প্রবল পরাক্রান্ত অসুর আপনার প্রদত্ত বর প্রভাবে তেজস্বা হইয়া ধূমকেতুর ন্যায় ত্রিলোকীর সর্বনাশ করিবার জন্য জন্ম গ্রহণ করিয়াছে॥ ৩২॥
সেই অসুরের পুরী মধ্যে সূর্য্য দেবের সাধ্য নাই যে প্রখর কিরণবিতরণ করেন। তাহার পুষ্করিণীর পদ্ম যাহাতে প্রস্ফুটিত হয়, তৎপরিমাণ আতপ তিনি তথায় প্রদান করিয়া থাকেন॥ ৩৩॥
চন্দ্র কি কৃষ্ণ কি শুক্ল উভয় পক্ষেই ষোড়শ কলা পূর্ণ করিয়া তাহার মন যোগাইয়া থাকেন। কেবল মহাদেবের মস্তকের ভূষণ স্বরূপ যে চন্দ্রকলা খানি, তাহাই তিনি গ্রহণ করেন না॥ ৩৪॥
পাছে পুষ্প অপহরণ করে, একারণ তাহার উদ্যানে বায়ুর গতি নিষিদ্ধ, এবং সেই অসুরের নিকটেও যেন ব্যজন সঞ্চালন হইতেছে এই ভাবে বামু দিবা নিশি বহিয়া থাকেন॥ ৩৫॥
ঋতুগণ তাহার উদ্যানপালক স্বরূপ হইয়া আছেন। তাঁহারা ক্রমে ক্রমে আবির্ভাব হইবার স্বভাব পরিত্যাগ পূর্ব্বক ক্রমাগত অশেষ পুষ্প উৎপাদন করত তাঁহার পরিচর্য্যা করিয়া থাকেন॥ ৩৬॥
সমুদ্রের মধ্যে সেই অসুররাজকে উপঢৌকন দিবার যোগ্য যে সকল রত্ন উৎপন্ন হয়, সমুদ্র সর্ব্বদা শশব্যস্ত হইয়া সেই গুলিকে দেখিতে থাকেন এবং ভাবেন, কবে সে গুলি সুসম্পন্ন হইবেক এবং কবে উপঢৌকন দিতে পারিবেন॥ ৩৭॥
রাত্রি কালে বাসুকি প্রভৃতি বিষধরগণ মস্তকস্থিত জাজ্জ্বল্যমান মণি দ্বারা সেই অসুরের ভবনে অনির্ব্বাণ-শীল প্রদীপ স্বরূপ তাহার পরিচর্য্যা করিয়া থাকেন॥ ৩৮॥
এমন কি স্বয়ং ইন্দ্র পর্য্যন্ত সেই অসুরের নিকট অনুগ্রহের প্রত্যাশা করিয়া থাকেন এবং সেই উদ্দেশে বারংবার লোক পাঠাইয়া কল্পবৃক্ষ সমুৎপন্ন পুষ্প-রাশি তাহার নিকট প্রেরণ পূর্ব্বক তাহার চিত্তানুবর্ত্তন করিয়া থাকেন।॥ ৩৯॥
এই রূপে সকলেই তাহার সেবা করে, তথাপি সে ত্রিভুবনের উপর অত্যাচার করিতে বিরত হয় না। দুষ্ট লোকের স্বভাবই এই, সে সদ্ব্যবহার করিলে ক্ষান্ত হয় না, প্রতিফল পাইলেই সুস্থির হয়॥ ৪০॥
নন্দন কাননের যে সকল তরুর পল্লব গুলি দেব নারীরা কোমল কর-পল্লব দ্বারা দয়ার সহিত তুলিয়া লইতেন, সেই সমস্ত তরু বর্গ আজি তারকাসুরের দৌরাত্ম্যে ছেদন ও পতন যে কি, তাহা অনুভব করিতেছে॥ ৪১॥
সেই অসুর যখন নিদ্রা যায়, যুদ্ধে বন্দীকৃত দেবনারীরা তাহাকে চামর ব্যজন করিয়া থাকে, তখন সেই চামরের বায়ু ও তাহাদিগের দীর্ঘ নিশ্বাস এক হইয়া যায় এবং তাঁহাদিগের অশ্রুবারি বিন্দু বিন্দু হইয়া চামর হইতে বর্ষণ হয়॥ ৪২॥
সুমেরু পর্ব্বতের যে সকল অত্যুন্নত শিখরের উপর সূর্য্যের গমনের সময় তাঁহার রথের অশ্বেরা খুরাঘাত করিয়া থাকে, তারকাসুর সেই গুলি ভঙ্গ করিয়া আপনার গৃহে ক্রীড়াপর্ব্বত রচনা করিয়াছে॥ ৪৩॥
স্বর্গ গঙ্গা মন্দাকিনীতে এখন জল মাত্র আছে, তাহাও আবার স্নানাবতীর্ণ দিগ্গজদিগের মদজল সংস্রবে কলুষিত হইয় থাকে। পূর্ব্বে তথায় যে স্বর্ণ কমলিনী ছিল, এখন তারকাসুরের পুষ্করিণীই উহার আধার হইয়াছে॥ ৪৪॥
পাছে অকস্মাৎ তারকাসুর আসিয়া উপস্থিত হয়, এই ভয়ে, পূর্ব্বে যে পথে দিব্যরথ চলিত, এখন সেখানে কেহ গতায়াত করে না, সুতরাং সুর-লোক-বাসী দিব্য পুরুষেরা নানা ভুবন পরিভ্রমণ করিবার আমোদ এখন আর অনুভব করেন না॥ ৪৫॥
অগ্নিই আমাদের মুখ, সেই মুখে যখন সমারোহে যজ্ঞানুষ্ঠান পূর্ব্বক হোমকর্ত্তারা আহুতি প্রদান করিতে থাকেন; তখন সেই দুরাত্মা মায় বলে আমাদিগের মূর্ত্তি ধারণ করিয়া আমাদের মুখের আহার অপহরণ করে, আমরা কেবল চাহিয়া থাকি॥ ৪৬॥
উচৈঃশ্রবা নামে ইন্দ্রের যে উন্নতদেহশালী পরম সুন্দর ঘোটক, তাহাও সেই অসুর অপহরণ করিয়াছে; সেই অপহরণেই যেন দেবরাজের চিরজীবনের উপার্জিত মূর্ত্তিমান্ যশোরাশি অপহরণ করা হইয়াছে॥ ৪৭॥
যেমন সান্নিপতিক জ্বর বিকার হইলৈ প্রধান প্রধান ঔষধ দ্বারাও তাহার প্রতীকার হয়না, সেইরূপে সেই দুরাত্মাকে বিনাশ করিবার নিমিত্ত আমরা যত উপায় প্রয়োগ করি, সকলি নিষ্ফল হইয়া যায়॥ ৪৮॥
নারায়ণের সুদর্শন চক্রের উপর আমাদিগের যুদ্ধে জয়লাভের আশা, কিন্তু সেই চক্র, তাহার বক্ষস্থলে আঘাত করিয়া অগ্নিশিখা প্রকাশ পূর্ব্বক যেন তাহার বক্ষস্থলে অলঙ্কার পরাইয় দেয়॥ ৪৯॥
সেই অসুরের হস্তীরা সম্প্রতি ঐরাবতকে পরাভবপূর্ব্বক পুষ্কর আবর্ত্তক প্রভৃতি প্রলয় কালীন মেঘের উপর দন্তাঘাত করিয়া ক্রীড়া করে॥ ৫০॥
অতএব হে প্রভু, যেমন মুক্তিলাভেচ্ছু ব্যক্তিগণ সংসার বন্ধন সমুচ্ছেদনকারী কার্য্যের অনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হয়েন, তদ্রূপ আমাদিগের ইচ্ছা যে সেই দুরাত্মার বিনাশের নিমিত্ত একজন সেনাপতি সৃষ্টি করি॥ ৫১॥
সেই সেনাপতি এইরূপ হইবেন যে তাঁহাকে দেবসেনার রক্ষাকর্ত্তা স্বরূপ যুদ্ধের অগ্রভাগে সংস্থাপন পূর্ব্বক ইন্দ্রশত্রু দিগের হস্ত হইতে বন্দীমোচনের ন্যায় জয়লক্ষ্মীকে প্রত্যানয়ন করিবেন॥ ৫২॥
বৃহস্পতির কথা শেষ হইলে স্বয়ম্ভু ব্রহ্মা যে বাক্য উচ্চারণ করিলেন, উহা মেঘগর্জ্জনের উত্তরকালীন বৃষ্টি অপেক্ষাও সমধিক রমণীয় বোধ হইল॥ ৫৩॥
তোমাদিগের অভিলাষ সিদ্ধ হইবেক। কিন্তু কিয়ৎকাল অপেক্ষা কর। পরন্তু স্বয়ং আমি এবিষয়ের নিমিত্ত সৃষ্টিকার্য্যে প্রবৃত্ত হইব না।॥ ৫৪॥
আমার নিকট হইতেই সেই অসুর উন্নতি লাভ করিয়াছে, আমার উচিত নয় যে উহাকে ধ্বংস করি। দেখ, বিষবৃক্ষকেও প্রতিপালন করিলে স্বয়ং ছেদন করিতে মায়া করে॥ ৫৫॥
সেই অসুর আমার নিকট এই বরই চাহিয়াছিল, আমিও তাহাতে স্বীকার হইয়াছিলাম। যেরূপ ঘোরতপস্যা সে আরম্ভ করিয়াছিল, বর না দিলে সমস্ত সংসার দগ্ধ হইত॥ ৫৬॥
সেই অসুর যে প্রকার রণপণ্ডিত সে যখন যুদ্ধে নিজ পরাক্রম প্রকাশ করিবে, তখন তাহার পুরোবর্ত্তী হয় এমন পুরুষ কে আছে; তবে মহাদেবের ঔরসজাত সন্তান হইলে এক দিন পারিতে পারে॥ ৫৭॥
কারণ সেই প্রভু মহাদেব তমোগুণাতীত সাক্ষাৎ পরমেশ্বর; তাঁহার ক্ষমতার ইয়ত্তা করিতে আমিও পরিনা, নারায়ণও পারেন না॥ ৫৮॥
মহাদেবের মন তপস্যাতে আসক্ত আছে, অতএব পার্ব্বতীর সৌন্দর্য্য দ্বারা চুম্বক দ্বারা লৌহাকর্ষণের মত তাঁহার চিত্ত তোমাদিগকে আকর্ষণ করিতে হইবেক॥ ৫৯॥
কারণ মহাদেবের বীর্য্য-পতন সন্ধারণ করিতে পার্ব্বতীই পরিবেন, যেমন মহাদেবের জলময়ী মূর্ত্তি আমার বীর্য্যপাত সন্ধারণ করিয়াছিল॥ ৬০॥
সেই প্রভু নীলকণ্ঠের পুত্র তোমাদিগের সেনাপতি পদ গ্রহণ পূর্ব্বক অদ্ভুত পরাক্রম প্রকাশ করিয়া বন্দীকৃত দেবমহিলাদিগের বেণীবন্ধ মোচন পূর্ব্বক বিরহিণী বেশ অপনয়ন করিবেন॥ ৬১॥
সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা এই কথা বলিয়া অন্তর্ধান হইলেন। দেবতারাও মনে মনে কর্ত্তব্য অরধারণ করিতে করিতে স্বর্গে চলিয়া গেলেন॥ ৬২॥
তথায় দেবরাজ অনেক বিবেচনা পূর্ব্বক মনে মনে কন্দর্পকে স্মরণ করিলেন। তাঁহার সেই মন উপস্থিত কার্য্য সিদ্ধ করিবার জন্য ব্যগ্রতা বশত স্বাভাবিক বেগের দ্বিগুণ বেগে ধাবমান,হইল॥ ৬৩॥
স্মরণমাত্রে কন্দর্প কৃতাঞ্জলিপুটে ইন্দ্রের সম্মুখে উপস্থিত, তাঁহার পুষ্পময় ধনুকখানি কণ্ঠে সংলগ্ন রহিয়াছে, সেই কণ্ঠে নিজ পত্নী, রতির আলিঙ্গনচিহ্নস্বরূপ বলয়ের চিহ্ন লক্ষিত হইতেছে, তাঁহার ধনুকের দুই প্রান্তভাগ সুন্দরী রমণীদিগের ভ্রূ লতার ন্যায় সুশ্রী দেখাইতেছে, আর বসন্ত তাঁহার সঙ্গে, বসন্তের হস্তে কন্দর্পের বাণ আম্রমুকুল সংস্থাপিত রহিয়াছে॥ ৬৪॥