কুমারসম্ভব।

বাঙ্গালা অনুবাদ।

প্রথম সর্গ।

 উত্তর দিকে হিমালয় নামে পর্ব্বতরাজ আছে। এক দেবতা উহার অধিষ্ঠাত্রী ভূতা। এক দিকে পূর্ব্ব সমুদ্র অন্য দিকে পশ্চিম সমুদ্র পর্য্যন্ত বিস্তারিত থাকাতে জ্ঞান হয় যেন সেই পর্ব্বত পৃথিবীর পরিমাণ করিবার উপযুক্ত মানদণ্ড (মাপ্‌কাটী) স্বরূপ বিদ্যমান রহিয়াছে॥ ১॥

 পূর্ব্বকালে এক সময়ে যখন পৃথিবী গো-রূপ ধারণ করেন, তখন তাবৎ পর্ব্বত একত্র হইয়া এই হিমালয় পর্ব্বতকে ধেনু বৎস নিরূপণ করিলেন, সুনিপুণ দোগ্ধার কার্য্য সুমেরু নির্বাহ করিলেন এবং পর্ব্বতেরা পৃথিবী হইতে উজ্জ্বল উজ্জ্বল বিস্তর রত্ন এবং আশ্চর্য্য গুণশালিনী বিস্তর ওষধি দোহন করিয়া লইলেন॥ ২॥

 এই হিমালয় অশেষ রত্নের উৎপত্তি স্থান, একারণ হিমে আবৃত হইলেও ইহার সৌন্দর্য্যের হানি হয় নাই। যেমন চন্দ্রের জ্যোৎস্না দ্বারা উহার কলঙ্ক গোপন হইয়া যায়, সেই, রূপ নানা গুণের মধ্যে এক মাত্র দোষ থাকিলে উহা লক্ষ্য হয় না॥ ৩॥

 এই পর্ব্বতের ভিন্ন ভিন্ন শিখরে নানা বর্ণের অনেক ধাতু বিদ্যমান আছে, উহাদিগের বিচিত্র বর্ণ খণ্ড খণ্ড মেঘের উপর প্রতিফলিত হয়, তাহাতে জ্ঞান হয় যেন অসময়ে সন্ধ্যা হইয়াছে, তর্দ্দর্শনে পর্ব্বত-বাসিনী অপ্সরারা ব্যস্ত সমস্ত হইয়া প্রিয় সমাগমের উপযুক্ত বেশ ভূষা ধারণ করিতে উদ্যত হয়েন এবং ব্যস্ততা প্রযুক্ত এক স্থানের অলঙ্কার ভ্রম ক্রমে স্থানান্তরে সন্নিবেশিত হয়॥ ৪॥

 এই পর্ব্বতের নিতম্ব দেশ পর্য্যন্ত মেঘেরা বিচরণ করে, নিম্নস্থিত সানুদেশে (পর্ব্বতোপরিস্থিত সমতল প্রদেশ) সেই মেঘের ছায়া পড়ে, তথায় সিদ্ধেরা বিশ্রাম করিতে করিতে যখন বৃষ্টি দ্বারা উত্ত্যক্ত হয়েন, তখন তাঁহারা মেঘ মণ্ডলের উপরিস্থিত অপরাপর সানুতে উপনীত হয়েন॥ ৫॥

 এই পর্ব্বতে যখন সিংহগণ হস্তি বধ করিয়া রক্ত রঞ্জিত চরণ বিন্যাস করতঃ স্থানান্তরে চলিয়া যায়, তখন বিগলিত তুষারের জল দ্বারা সেই রক্ত ধৌত হইয়া যায়, সুতরাং চরণের চিহ্ন দেখিয়া নিরূপণ করিতে পারা যায় না যে উহারা কোন্‌ পথে গমন করিয়াছে। তথাপি সিংহের নখের মধ্য হইতে যে সকল গজ-মুক্তা নিপতিত হইয়া স্থানে স্থানে ছড়াইয়া থাকে, তদ্দর্শনে সিংহ মৃগয়াকারী ব্যাধেরা জানিতে পারে যে কোন্‌ পথে সিংহ গিয়াছে॥ ৬॥

 হিমালয় পর্ব্বতে বিদ্যাধরীদিগের যখন প্রেমের পত্র লিখিতে হয়, তখন তাঁহারা ভূর্জ্জ-পত্রের উপর ধাতুরস দ্বারা অক্ষর বিন্যাস করেন, তাহাতে সেই ভূর্জ্জ-পত্র হস্তির মস্তকস্থিত রক্ত বর্ণ বিন্দু বিশেষের ন্যায় প্রতীয়মান হইয়া থাকে। হিমালয়ে ভূর্জ্জপত্রের দ্বারা এই রূপ কার্য্য সম্পাদিত হয়॥ ৭॥

 কীচক নামে যে, এক জাতি বংশ আছে, যাহাদিগের কলেবরস্থিত ছিদ্র মধ্যে বায়ু প্রবেশ হইলে বংশীর ন্যায় শব্দ হয়, যখন হিমালয়স্থিত সেই কীচক বংশের ছিদ্রসমূহ গুহার অভ্যন্তর হইতে প্রবহমাণ বায়ু দ্বারা পরিপূর্ণ হইতে থাকে, তখন জ্ঞান হয় যেন কিন্নরেরা উচ্চৈঃস্বরে গান করিবেন জানিয়া তাঁহাদিগের নিমিত্ত হিমালয় বংশী বাদন করিতেছেন॥ ৮॥

 যখন হিমালয়ে হস্তীরা কণ্ডূতি অপনয়নের নিমিত্ত সরল নামক সৌরভশালী দেবদারু বৃক্ষের স্কন্ধদেশে গণ্ডস্থল ঘর্ষণ করে, তখন ঘর্ষণ প্রযুক্ত বৃক্ষের ক্ষীর ঝরিতে থাকে, এবং তজ্জনিত সৌরভ চতুর্দ্দিকের সানু সমূহকে আমোদিত করে ॥ ৯॥

 হিমালয়ে ওষধি নামে এক লতা আছে, রাত্রি কালে উহাদিগের মধ্য হইতে আলোক নির্গত হইতে থাকে, সেই আলোক পর্ব্বতীয় গুহ গৃহের মধ্যে পতিত হয়, সেই গৃহে যে সকল সস্ত্রীক বনচর লোক বাস করে, তাহারা যখন সুরত সুখ সম্ভোগে প্রবৃত্ত হয়, তখন ওষধি দ্বারা তৈল বিহীন প্রদীপের কার্য্য নির্ব্বাহিত হইয়া থাকে॥ ১০॥

 হিমালয়ের উপরিস্থিত পথ গুলি ঘনীভূত হিমে আবৃত থাকে, সুতরাং গমনকালে চরণ তলের নিতান্ত ক্লেশ হয়, তথাপি কিন্নরীরা গুরু নিতম্ব ভরে এত দূর পরিশ্রান্ত, যে সেই পথে গমন কালে তাঁহারা কোন ক্রমে স্বীয় মন্থরগতি পরিত্যাগ করিতে পারেন না॥ ১১॥

 হিমালয়ের গুহাতে- অন্ধকার যেন, দিবসে ভীত হইয়া লুকাইয়া থাকে এবং পর্ব্বতরাজ তাহাকে সূর্য্যের হস্ত হইতে যেন রক্ষা করেন, কারণ মহত ব্যক্তির স্বভাবই এই যে নীচ লোকেও শরণাপন্ন হইলে, যেমন সাধু লোকের প্রতি, তেমনি তাহারও প্রতি স্নেহ প্রদর্শন করেন।॥ ১২॥

 চামর রাজাদিগের এক রাজ-চিহ্ন। হিমালয় যে পর্ব্বতের রাজা, তাঁহার সেই নাম যথার্থ করিবার নিমিত্ত পর্ব্বত নিবাসী চমরীগণ ইতস্ততঃ পুচ্ছ সঞ্চালন করিয়া শরচ্চন্দ্র কিরণের ন্যায় শুভ্রবর্ণ চামরের শোভা চতুর্দ্দিকে বিস্তারিত করিয়া দিয়া থাকে॥ ১৩॥

 এই পর্ব্বতের গুহা-গৃহ মধ্যে কিন্নর কিন্নরা বিহার করে, কিন্নরীদিগকে বিবসন করিলে যখন তাহারা লজ্জা পায় তখন গৃহ দ্বারের সম্মুখে সহসা মেঘ মণ্ডল লম্বমান হইয়া যবনিকার ন্যায় তাহাদিগের লজ্জা নিবারণ করে॥ ১৪॥

 এই পর্ব্বতের বায়ু গঙ্গার নির্ঝরের জল-কণা বহন করিয়া এবং শনৈঃ শনৈঃ দেবদারু বৃক্ষ আন্দোলন করিয়া ময়ূরদিগের পুচ্ছ বিভাগ করিয়া দেয় এবং মৃগয়া পরিশ্রান্ত ব্যাধগণ সেই বায়ু সেবন করে॥ ১৫॥

 এই পর্ব্বত এত উন্নত যে সূর্য্য পর্য্যন্ত ইঁহার শিখরের নিম্ন দেশে পরিভ্রমণ করেন, সুতরাং উচ্চতর শিখরস্থিত সরোবরে যে পদ্ম বিদ্যমান আছে সপ্তর্ষিরা স্বহস্তে চয়ন করিয়া লইলে তাহার যে অবশিষ্ট থাকে, সূর্য্যদেব ঊর্দ্ধাভিমুখে কিরণ বিস্তার পূর্ব্বক সেগুলিকে প্রস্ফুটিত করেন॥ ১৬॥

 বিধাতা দেখিলেন যে যজ্ঞের অঙ্গ স্বরূপ নানা প্রকার উদ্ভিজ্জের একমাত্র উৎপত্তি স্থান হিমালয় এবং পৃথিবীকে ধারণ করিবার উপযুক্ত ক্ষমতা তাঁহার আছে, অতএব তিনি হিমালয়কে যজ্ঞের একভাগ বিধান করিয়া দিয়া ইঁহাকে তাবৎ পর্ব্বতের রাজা করিয়াছেন॥ ১৭॥

 পিতৃ পুরুষদিগের এক মানস কন্যা ছিল, তাহার নাম মেনকা, সেই কন্যা এরূপ বিদ্যাবতী যে ঋষিরা পর্য্যন্ত তাঁহাকে মান্য করিতেন, হিমালয় সেই মেনকাকে আপনার যোগ্য বিবেচনা করিয়া বংশ রক্ষার নিমিত্ত যথা বিধানে বিবাহ করেন, কারণ গৃহস্থের বিবাহ অবশ্য কর্ত্তব্য এই শাস্ত্রের আদেশ তিনি জানিতেন॥ ১৮॥

 তাঁহারা উভয়ে যেরূপ রূপবান ছিলেন, কালক্রমে তদুপযুক্ত প্রেম সুখ সম্ভোগে তাঁহারা প্রবৃত্ত হইলে রমণীয় যৌবন শালিনী পর্ব্বত রাজ-মহিষীর গর্ভ সঞ্চার হইল॥ ১৯॥

 সেই গর্ভে মৈনাক নামে সন্তান জন্মিল। যখন বৃত্রের হন্তা ইন্দ্র পর্ব্বতদিগের প্রতি ক্রুদ্ধ হইয়া পক্ষ চ্ছেদন করিতে উদ্যত হইয়াছিলেন, তখন তিনি জলনিধি সমুদ্রের সহিত বন্ধুত্ব বিধান করাতে বজ্রাঘাতের যন্ত্রণ তাঁহাকে ভোগ করিতে হয় নাই, বরং তিনি সমুদ্র মধ্য দিয়া পাতালে প্রবেশ পূর্ব্বক নাগ কন্যাদিগের প্রণয়ের পাত্র হইয়া কাল যাপন করিতে লাগিলেন॥ ২০॥

 এই সময়ে, দক্ষ নন্দিনী সতী নামে মহাদেবের যে পরম পতিব্রতা প্রথম পত্নী ছিলেন, তিনি পিতৃকৃত অপমান সহ্য করিতে না পারিয়া যোগ বলে প্রাণ ত্যাগ পূর্ব্বক মেনকার গর্ভে জন্ম গ্রহণ উদ্দেশে উপস্থিত হইলেন॥ ২১॥

 যেমন কৌশলপূর্ব্বক নীতি প্রয়োগ করিলে সেই নীতি ব্যর্থ না হইয়া উৎসাহের সংযোগে অশেষ সম্পত্তি প্রসব করে; সেই রূপ পর্ব্বতরাজ কল্যাণ গুণশালিনী সেই ভূতপূর্ব্ব দক্ষ কন্যাকে সদাচারবতী নিজ মহিষীর গর্ভে জন্মদান করিলেন॥ ২২॥

 যে দিন তাঁহার জন্ম হইল, সে দিন কি উদ্ভিজ্জ কি প্রাণী তাবৎ শরীরী পদার্থের অপূর্ব্ব সুখ উদয় হইয়াছিল, সে দিন চতুর্দ্দিক্‌ পরিষ্কার ছিল, ধূলির লেশমাত্র নাই এ প্রকার বায়ু বহিয়াছিল, এবং দিব্য লোকে শঙ্খধ্বনি ও তদনন্তর পুষ্পবৃষ্টি হইয়াছিল॥ ২৩॥

 বিদূর নামে এক পর্ব্বত আছে, মেঘের শব্দ হইলে তথাকার ভূতলে ইন্দ্রনীল মণির রেখা আবির্ভূত হয়। মেনকার সেই নবপ্রসূতা কন্যার শরীরের এপ্রকার ঔজ্জ্বল্য যে জননীকে রত্নরাজি বিরাজিত বিদূরভূমির ন্যায় জ্ঞান হইতে লাগিল॥ ২৪॥

 যেমন চন্দ্রকলা প্রথম উদয়ের পর নিত্য নিত্য জ্যোৎস্না পরিপূর্ণ নব নব কলা সংযোগে পুষ্টিলাভ করে, তদ্রূপ সেই কন্যার কলেবর বৃদ্ধি পাইতে লাগিল এবং অঙ্গ প্রত্যঙ্গ অপূর্ব্ব লাবণ্যে পরিপূর্ণ হইতে লাগিল॥ ২৫॥

 ইতিমধ্যে কন্যা আত্মীয় স্বজনদিগের প্রেমাম্পদ হইয়া উঠিলেন, এবং তাঁহার পিতার সম্বন্ধ ধরিয়া তাঁহারা তাঁহাকে পার্ব্বতী বলিয়া ডাকিতে লাগিলেন। তবে যে তাঁহার উমা নাম হয়, তাহার কারণ এই যে, তপস্যা করিতে যাইবার সময় তাঁহার জননী উ মা (না গো না) এই কথা বারংবার বলিয়া তপস্যা করিতে নিষেধ করিয়াছিলেন॥ ২৬॥

 অনেক কন্যা অনেক পুত্ত্র-সত্ত্বেও পর্ব্বতরাজের চক্ষুর যেন সেই কন্যাটীকে দেখিয়া আশ মিটিত না (তৃপ্তি হইত না)। বসন্তকালে অশেষ পুষ্প ফুটিয়া থাকে, কিন্তু ভ্রমরের দল আম্র-মুকুলেই বিশেষ আসক্ত।॥ ২৭॥

 বৃহৎ ও উজ্জ্বল শিখা হইলে প্রদীপ যেমন দেখিতে সুন্দর অথচ পবিত্র হয়, যেমন স্বর্গের পথে মৃন্দাকিনী থাকাতে তথাকার শোভা ও বিশুদ্ধতা দুই হইয়াছে, যেমন বিদ্বান্‌ ব্যক্তি সংস্কৃত ভাষা ব্যবহার করিতে পারক হইলে আদরণীয় ও বিশুদ্ধ হয়েন, সেইরূপ সেই কন্যা জন্ম গ্রহণ করাতে হিমালয়ের গৃহ পবিত্রও হইল অলঙ্কৃতও হইল॥ ২৮॥

 সেই বালিকার যেন ইচ্ছা হইল যে আর একবার বাল্যখেলার আস্বাদ গ্রহণ করা যাউক, এই উদ্দেশে তিনি সখীবর্গে পরিবৃত হইয়া ক্রীড়াচ্ছলে মন্দাকিনী-তীরে বালুকার বেদি রচনা করিতেন, এবং গোল ও পুত্তলিকা লইয়া খেলা করিতেন॥ ২৯॥

 পূর্ব্ব জন্মে বিদ্যার যে উপদেশ পাইয়াছিলেন, তাহার কিছুই তাঁহার নষ্ট হয় নাই, অতএব এ জন্মে বিদ্যাশিক্ষার সময় উপস্থিত হইলে পূর্ব্ব-জন্মার্জ্জিত তাবৎ বিদ্যা আপনা-হইতে তাঁহার অন্তঃকরণে স্ফুর্তি পাইল, যেমন শরৎকালে যেন কোথা হইতে দলে দলে হংস আসিয়া গঙ্গার বক্ষে বিরাজ করে, যেমন ওষধি-লতার স্বভাবসিদ্ধ আলোকমণ্ডল রাত্রিকালে আপনা হইতেই উদয় হয়॥ ৩০॥

 অনন্তর যে বয়স সুকুমার শরীর লতার পক্ষে অযত্নসিদ্ধ অলঙ্কার স্বরূপ হইয় উঠে, যাহা মদিরা নামে প্রসিদ্ধ নয়, অথচ অন্তঃকরণকে যেন সুরাপানে মত্ত করিয়া তুলে, যাহা পুষ্প নহে, অথচ কন্দর্পের অস্ত্র স্বরূপ হইয়া থাকে, পার্ব্বতী বাল্যকালের অনন্তরবর্ত্তী সেই নবযৌবন নামক বয়স প্রাপ্ত হইলেন॥ ৩১॥

 নবযৌবন উদয় হইয়া তাঁহার শরীরের যে অবয়ব যে প্রকার ক্ষীণ বা পুষ্ট হওয়া উচিত সেই প্রকার করিয়া দিলে উহা এমনি সর্ব্বাঙ্গসুন্দর হইয়া উঠিল, যেমন চিত্রপটে তূলিকা দ্বারা বর্ণবিন্যাস করিয়া দিলে হয়, অথবা যেমন সূর্য্যের কিরণে পদ্ম বিকসিত হইলে হইয়া থাকে॥ ৩২॥

 তাঁহার চরণের বৃদ্ধাঙ্গুলি-নখের কান্তি এমনি উজ্জ্বল রক্ত বর্ণ যে, যখন তিনি ধরাতলে চরণ বিন্যাস করিতেন, তখন বোধ হইত যেন উহা হইতে রক্তবর্ণ অলক্তক-রস নির্গত হইতেছে, যখন তিনি চলিয়া যাইতেন তখন যেন বোধ হইত যে ধরাতলে স্থলপদ্ম প্রস্ফুটিত করিতে করিতে যাইতেছেন॥ ৩৩॥

 রাজহংসদিগের ইচ্ছা ছিল যে তাঁহার নুপুরধ্বনি শিক্ষা করে অতএব তাহারাই যেন প্রত্যুপদেশ পাইবার আশয়ে সেই অবনতাঙ্গী নব-যুবতিকে বিলাসসুন্দর পাদবিন্যাস শিক্ষা দিয়াছিল।॥ ৩৪॥

 তাঁহার দুই ঊরু বর্ত্তুলাকার ও ক্রমে কৃশ হইয়া আসিয়াছে, তাহাতে এত লাবণ্য বিদ্যমান ছিল যে বিধাতা বোধ করি পার্ব্বতী-শরীর নির্ম্মাণের জন্য যে পরিমাণ লাবণ্যের আয়োজন করিয়াছিলেন, সে সমস্তই ঊরুতে নিঃশেষ হইয়াছিল এবং অবশিষ্ট অঙ্গে দিবার জন্য বিধাতাকে নূতন লাবণ্য প্রস্তুত করিতে হইয়াছিল॥ ৩৫॥

 হস্তিরাজের শুণ্ডের চর্ম্ম কঠোর, কদলীতরু নিতান্ত শীতল, এই কারণে জগদ্বিখ্যাত সৌন্দর্য্যশালী হইয়াও কি হস্তিশুণ্ড কি কদলীতরু পার্ব্বতীর ঊরুদ্বয়ের তুলনাস্থল হইতে পারে নাই॥ ৩৬॥

 নিন্দাস্পর্শ-শূন্যা সেই পার্ব্বতীর নিতম্বদেশের শোভা ইহাতেই অনুমান হইতে পারে যে, নারীমাত্রের আশার অতীত মহাদেবের ক্রোড়দেশে সেই নিতম্ব স্থান পাইয়াছিল॥ ৩৭॥

 অভিনবোদিত তাঁহার যে সূক্ষ রোমাবলী গভীর নাভিমণ্ডলের অভ্যন্তর পর্য্যন্ত প্রবেশ করিয়াছিল, তাহা দেখিলে বোধ হইত যেন রসনার (চন্দ্রহার) মধ্যস্থিত ইন্দ্রনীলমণির কিরণরাজি বস্ত্রের গ্রন্থি অতিক্রম করিয়া দেখা দিতেছে॥ ৩৮॥

 বেদির ন্যায় কৃশ মধ্য শালিনী সেই বালার কটিদেশে যে সুচারু ত্রিবলি ছিল তদ্দর্শনে জ্ঞান হইত যেন নবযৌবন কন্দর্পের আরোহণের জন্য তিন সোপান রচনা করিয়া রাখিয়াছেন॥ ৩৯॥

 নীলোৎপল লোচনা পার্ব্বতীর পাণ্ডুবর্ণ স্তনযুগল এরূপ পরিপুষ্ট হইয়াছিল যেন বোধ হইত যে পরস্পরকে পীড়া দিতেছে, আর কৃষ্ণবর্ণমুখ-বিশিষ্ট সেই দুই স্তনের মধ্যস্থলে মৃণাল সূত্রের পর্য্যন্ত অবস্থিতি অসম্ভব॥ ৪০॥

 আমার জ্ঞান হয় যে পার্ব্বতীর দুই বাহু শিরীষ পুষ্প অপেক্ষাও সমধিক সুকুমার হইবেক। কারণ কন্দর্প মহাদেবের নিকট পরাজিত হইয়াও সেই দুই বাহুকে মহাদেবের কণ্ঠমালা রূপে পরিণত করিয়াছিলেন॥ ৪১॥

 স্তনদ্বয় বিদ্যমান থাকাতে উন্নতানত তাঁহার যে বক্ষঃস্থল এবং গোল মুক্তার যে মালা তিনি গলায় পরিতেন, ইহারা পরস্পর পরস্পরের শোভা বৃদ্ধি করিয়াছিল, সুতরাং ইহা বলা ভার যে বক্ষস্থলের ভূষণ মালা অথবা মালার ভূষণ বক্ষস্থল॥ ৪২॥

 স্বভাব-চঞ্চলা লক্ষ্মী যখন চন্দ্রে অধিষ্ঠান হয়েন, তখন তাঁহার পদ্মে থাকিবার সুখ সম্ভোগ হয় না, সেই রূপ পদ্মে থাকিবার সময় চন্দ্রে থাকার আনন্দ তিনি অনুভব করিতে পান না। কিন্তু পার্ব্বতীর মুখে স্থান পাইয়া তাঁহার সেই দুই আমোদ এক কালে অনুভব হইতে লাগিল॥ ৪৩॥

 যদি নব পল্লবের উপর শ্বেতবর্ণ কোন কুসুম সংস্থাপিত হয় অথবা যদি পরিষ্কার প্রবালের উপর মুক্তাফল সন্নিবেশিত হয়, তাহা হইলে কথঞ্চিৎ রক্ত বর্ণ দুই ওষ্ঠের উপর বিরাজমান শুভ্র দশন কান্তি সুশোভিত পার্ব্বতীর যে মধুর হাস্য, তাহার তুলনা দেওয়া যাইতে পারে॥ ৪৪॥

 মধুরভাষিণী পার্ব্বতীর স্বর যেন অমৃত বর্ষণ করিত, সেই স্বরে যখন তিনি কথা কহিতেন, তখন কোকিলার, রবও তেমনি কঠোর বোধ হইত, যেমন তন্ত্রী ছিন্ন হইবার পর বীণা বাদন করিলে তাহা কখনই মিষ্ট বোধ হয় না॥ ৪৫॥

 সেই বিশাল-লোচনার যে চঞ্চল দৃষ্টি, বায়ু সংযোগে আন্দোলিত নীল পদ্মের সহিত উহার কিছুই বৈলক্ষণ্য ছিল না। সেই দৃষ্টি তিনিই হরিণীগণের নিকট শিক্ষা করিয়াছিলেন, অথবা হরিণীরাই তাঁহার নিকট পাইয়াছিল, ইহা নিরূপণ করা দুঃসাধ্য।॥ ৪৬॥

 সুদীর্ঘ সুশোভন তাঁহার দুই ভ্রূ যেন অঞ্জন সহযোগে তূলিকা দ্বারা আঁকিয়া দেওয়া হইয়াছে এরূপ জ্ঞান হইবার কথা। যখন সেই ভ্রূযুগল কামিনীজন-সুলভ বিলাস গুণে সঞ্চালিত হইত, তখন কন্দর্প আর অহঙ্কার করিতেন না যে তাঁহার ধনুর গুণ সুশ্রী॥ ৪৭॥

 চমরীজাতি আপনাদের চামরের কেশের প্রতি সাতিশয় মমতা করিয়া থাকে। কিন্তু যদি পশু পক্ষী আদি ইতর প্রাণীর অন্তঃকরণে লজ্জার সঞ্চার থাকিত, তাহ হইলে পার্ব্বতীর পরম রমণীয় কেশ কলাপ অবলোকন করিলে নিজ পুচ্ছ লোমের প্রতি তাহাদিগের সে প্রকার স্নেহ থাকিত না॥ ৪৮॥

 ফলত বিধাতার বোধ করি ইচ্ছা হইয়া থাকিবেক যে অশেষ প্রকার সৌন্দর্য্য একত্র সংগ্রহ করিলে দেখিতে কেমন হয়, এই নিমিত্ত চন্দ্র পদ্ম প্রভৃতি যেখানে যত উপমা দিবার বস্তু ছিল, সে সমস্ত পার্ব্বতী-শরীরের যথাযোগ্য অবয়বে সংস্থাপন পূর্ব্বক অতি যত্নে তাঁহাকে নির্ম্মাণ করিয়াছিলেন॥ ৪৯॥

 নারদ মুনির অভ্যাস ইচ্ছামতে সর্ব্বত্র গতি বিধি করেন। তিনি একদা হিমালয় ভবনে সেই কন্যাটীকে দেখিয়া আদেশ করিলেন যে ইনি পরে মহাদেবের একমাত্র গৃহিণী হইবেন, এবং এরূপ প্রণয় স্বামীর সহিত হইবে যে তাঁহার অর্দ্ধাঙ্গ ইনি প্রাপ্ত হইবেন॥ ৫০॥

 এই নিমিত্ত তাঁহার পিতা নব যৌবন উপস্থিত দেখিয়াও তাঁহার নিমিত্ত অন্য পাত্র অন্বেষণ করেন নাই। কারণ মন্ত্রপাঠ সহকারে ঘৃতাহুতি যে নিক্ষেপ করা, সে কেবল অগ্নিতেই হইতে পারে, সুবর্ণ রজতাদি অন্যান্য তেজঃ পদার্থ উহার ভাগী হয় না॥ ৫১॥

 কিন্তু পর্ব্বতরাজ শিব নিজে না প্রস্তাব করিলে স্বয়ং যাইয়া যে কন্যা সমর্পণ, তাহা কোন মতেই করিতে পারিলেন না। কারণ পাছে আমার অনুরোধ রক্ষা না হয় এই ভয়ে ভদ্র লোককে নিতান্ত অভিলষিত বিষয়েও অনুদ্যোগী হইয়া থাকিতে হয়॥ ৫২॥

 সুশোভন দন্তশালিনী সেই পার্ব্বতী পূর্ব্বজন্মে যে সময়ে দক্ষ প্রজাপতির প্রতি কুপিত হইয়া সতী দেহ পরিত্যাগ করেন, সেই অবধিই দেবদেব পশুপতি সংসারবাসনা বর্জিত ও গৃহিণীশূন্য হইয়া অবস্থিতি করিতেছিলেন॥ ৫৩॥

 সেই প্রভু চর্ম্মাম্বর পরিধানে তপস্যারসে মনোনিবেশপূর্ব্বক, গঙ্গার প্রবাহে দেবদারু-বৃক্ষ অভিষিক্ত হইতেছে, মৃগনাভির সৌরভে আমোদিত হইয়া আছে, কিন্নরেরা সদা গান করিতেছে, এরূপ এক সানুদেশে হিমালয়োপরি বাস গ্রহণ করিলেন॥ ৫৪॥

 তখন তাঁহার অনুচর প্রমথগণ নমেরুবৃক্ষের পুষ্প কর্ণে ধারণ পূর্ব্বক সুকুমার ভূর্জ্জবল্কল পরিধান করিয়া এবং মনঃশিলা নামক রক্তবর্ণ ধাতুরসে শরীর চিত্র বিচিত্র করিয়া সুরভি উদ্ভিজ্জে পরিপূর্ণ শিলাতলে উপবেশন করিল॥ ৫৫॥

 তখন মহাদেবের বাহন বৃষরাজ সিংহের গর্জ্জন শ্রবণে কুপিত হইয়া অহঙ্কারভরে ঘনীভূত তুষার খণ্ডের উপর খুরাঘাত করিতে লাগিল, এবং গবয় নামক হরিণেরা ভয়ে ভয়ে তাহার প্রতি দৃষ্টিপাত করিতে লাগিল॥ ৫৬॥

 মহাদেবের অষ্ট মূর্ত্তির এক মূর্ত্তি অগ্নি, সেই নিজ মূর্ত্তিভূত অগ্নিকে যজ্ঞকাষ্ঠ দ্বারা প্রজ্জ্বলিত করিয়া প্রভু স্বয়ং সর্ব্বকামনাফলের বিধান কর্ত্তা হইয়াও কোন নিগূঢ় অভিলাষে তপস্যায় প্রবৃত্ত হইলেন॥ ৫৭॥

 দেবতাদিগের পূজনীয় অতুলিত মহিমশালী সেই প্রভুকে অর্ঘদান পূর্ব্বক পূজা করিয়া পর্ব্বতরাজ আপনকন্যাকে আদেশ করিলেন যে যাও, তোমার দুই সখীর সহিত পবিত্রমনে দেব-দেবের সেবা করগে॥ ৫৮॥

 স্ত্রীলোক, সুতরাং তপস্যার ব্যাঘাত ঘটাইবার বস্তু, ইহা জানিয়াও মহাদেব পার্ব্বতীর শুশ্রূষা বিষয়ে আপত্তি করিলেন না। কারণ তাঁহার সদৃশ জিতেন্দ্রিয়গণ চিত্তচাঞ্চল্যের অশেষ হেতুর মধ্যবর্ত্তী হইয়াও সুস্থির থাকিতে পারেন॥ ৫৯॥

 সুচারু কেশকলাপবতী সেই কন্যা শিবের পূজার পূষ্প তুলিয়া আনিয়া দিতেন, নিপুণতা সহকারে হোমবেদি পরিষ্কার করিয়া দিতেন, স্নানের জল ও কুশ আনিয়া দিতেন। এই রূপ নিত্য নিত্য মহাদেবের পরিচর্য্যা কর্ম্মে নিযুক্ত রহিলেন। আর যখন যখন পরিশ্রম বোধ হইত, তখন তখন তাঁহার মস্তকস্থিত চন্দ্রের জ্যোৎস্নায় দেহ শীতল করিতেন॥ ৬০॥