কুমার সম্ভব/সপ্তম সর্গ
সপ্তম সর্গ।
তদনন্তর যখন ওষধিপতি চন্দ্রদেব দিন দিন বৃদ্ধি পাইতেছেন, এতাদৃশ শুক্লপক্ষে লগ্নশুদ্ধি-বিশিষ্ট তিথিতে হিমালয় বন্ধু-বান্ধবদিগকে একত্র করিয়া কন্যার বিবাহসংস্কারের উপযোগী কর্ম্ম সমস্ত আরম্ভ করিলেন॥ ১॥
সেই রাজধানীর লোকে পর্ব্বতরাজের প্রতি এত দূর অনুরক্ত ছিল, যে প্রত্যেক ভবনে প্রবীণা রমণীগণ বিবাহের উপযোগী নানা প্রকার মাঙ্গল্য বস্তুর আয়োজন করিতে ব্যগ্র রহিল, সুতরাং জ্ঞান হইতে লাগিল যে গিরিরাজের অন্তঃপুর আর সেই নগরী দুই যেন এক গৃহস্থের অন্তর্গত॥ ২॥
নগরের বৃহৎ বৃহৎ রথ্যাতে সন্তানক পুষ্প বিকীর্ণ হইল, পট্ট বস্ত্র দ্বারা পতাকার শ্রেণী রচনা করিয়া দেওয়া হইল আর সুবর্ণময় তোরণের দীপ্তিতে নগর চাকচিক্যময় হইয়া উঠিল, সুতরাং জ্ঞান হইল যেন অমরাবতীই এই স্থানে উঠিয়া আসিয়াছে॥ ৩॥
উমার বিবাহ সন্নিকট, একারণ তখন জনক জনকীর পক্ষে তিনি প্রাণ-তুল্য হইয়া উঠিলেন, অন্যান্য পুত্র কন্যা সত্ত্বেও এরূপ হইল যেন তিনি ব্যতীত তাঁহাদের আর সন্তান নাই, যেন বহুকালের পর তাঁহার দেখা পাইয়াছেন, যেন মৃত্যু-শয্যা হইতে তিনি গাত্রোত্থান করিয়াছেন॥ ৪॥
তিনি আশীর্ব্বাদ প্রাপ্ত হইতে হইতে ক্রোড়ে ক্রোড়ে ভ্রমণ করিতে লাগিলেন, অলঙ্কারের উপর অলঙ্কার প্রাপ্ত হইতে লাগিলেন। গিরিরাজের আত্মীয় বান্ধবদিগের স্নেহের পাত্র অনেক ছিল, কিন্তু সেই সময়ে সকল স্নেহ যেন একত্র হইল এবং উমাই উহার একমাত্র আশ্রয়স্থান হইলেন॥ ৫॥
সূর্য্য যে মুহুর্তের অধিষ্ঠাত্রী দেবতা, সেই মুহূর্ত্তের এবং চন্দ্রের সহিত উত্তর-ফল্গুণী নক্ষত্রের মিলন হইলে, যাঁহাদিগের স্বামী পুত্র দুই ছিল, এতাদৃশ স্বসম্পর্কীয় কয়েক জন রমণী পার্ব্বতীর শরীরের বেশ ভূষা সম্পাদন আরম্ভ করিল॥ ৬॥
গাত্রে তৈল হরিদ্রাদি লেপনের সময় শ্বেত শর্ষপ সংযুক্ত দূর্ব্বাদল তাঁহার কোন কোন অবয়বে সন্নিবেশিত হইল, নাভি আবরণ পূর্ব্বক পট্টবস্ত্র পরিধান করান হইল এবং একটী বাণ ধারণ করিতে দেওয়া হইল। এই স্নান-বেশ, তিনি ধারণ করাতে উহারি যেন এক অপূর্ব্ব শোভা হইল॥ ৭॥
বিবাহ সংস্কার উপলক্ষে যে এক নবীন শর তিনি হস্তে ধারণ করিলেন, উহার সমাগমে তাঁহার তদ্রূপ শোভা হইল, যেমন কৃষ্ণ পক্ষ শেষ হইলে সূর্য্য কিরণ সংস্পর্শে আলোকময় হইয়া চন্দ্রকলা শোভা পায়॥ ৮॥
লোষ্ট্রের চূর্ণ দ্বারা তাঁহার অঙ্গের তৈল অপনয়ন করা হইল, কালেয় নামক গন্ধদ্রব্য কিঞ্চিৎ শুষ্ক করিয়া তদ্দ্বারা অঙ্গরাগ রচনা করা হইল, আর স্নানের উপযুক্ত পরিধেয় বসন ধারণ করিলেন, এই বেশে রমণীরা তাঁহাকে স্তম্ভচতুষ্টয়বিশিষ্ট এক গৃহে লইয়া গেল॥ ৯॥
তথায় বৈদূর্য্য-মণি-নির্ম্মিত এক প্রস্তরফলক সংস্থাপিত ছিল, চতুর্দ্দিকে মুক্তার মালা লম্বমান থাকাতে গৃহের বিশেষ শোভা হইয়াছিল। সেই শিলাতলে তাঁহাকে উপবেশন করাইয়া তাঁহার মস্তকের উপরিভাগে সুবর্ণ কলস অবনত করিয়া রমণীগণ স্নান করাইয়া দিল এবং তৎসঙ্গে বাদ্যধ্বনি হইতে লাগিল॥ ১০॥
যেমন মেঘের জলে অভিষিক্ত হইয়া ও বিকসিত কাশ কুসুমে সুশোভিত হইয়া পৃথিবীর শোভা হয়, তদ্রূপ পূর্বোক্ত-প্রকার মাঙ্গল্য স্নান দ্বারা শরীর পরিষ্কার হইলে বিবাহের বসন পরিধান পূর্ব্বক তিনি শোভা পাইতে লাগিলেন॥ ১১॥
সেই স্থান হইতে কয়েক জন পতিব্রতা তাঁহাকে বহন পূর্ব্বক, যে বেদির উপর বসিয়া বিবাহের বেশ ধারণ করিবেন, তথায় তাঁহাকে লইয়া গেল। সেই বেদির উপরিভাগে চন্দ্রাতপ চারি মণিময় স্তম্ভের উপর লম্বমান ছিল এবং এক খানি বসিবার আসন সজ্জীভূত ছিল॥ ১২॥
তথায় রমণীগণ তাঁহাকে পূর্ব্বমুখ করিয়া উপবেশন করাইয়া অলঙ্কার সমস্ত নিকটে থাকিলেও কিয়ৎক্ষণের জন্য তাঁহার সম্মুখে উপবেশন পূর্ব্বক স্থির হইয়া রহিল, কারণ তাঁহার স্বাভাবিক সৌন্দর্য্য অবলোকন করিতে তাঁহাদিগের নয়ন ব্যগ্র রহিল॥ ১৩॥
এক জন রমণী পার্ব্বতীর কেশ-কলাপকে ধূপের সন্তাপ দ্বারা প্রথমে শোষণ করাইয়া লইল, পরে তন্মধ্যে পুষ্পসংস্থাপন পূর্ব্বক দূর্ব্বাদল-বিশিষ্ট পাণ্ডু-বর্ণ মধুক-পুষ্পময়ী মালাদ্বারা অতি চমৎকার রূপে বেষ্টন করিয়া দিল॥ ১৪॥
তাঁহার সর্বাঙ্গে শ্বেত অগুরু চন্দন লেপন পূর্ব্বক তদুপরি গোরোচনা দ্বারা পত্রাবলি রচনা করিয়া দিল। যেমন গঙ্গার বালুকাময় পুলিন দেশে চক্রবাক পক্ষী উপবিষ্ট থাকিলে দেখায়, পার্ব্বতীকে তখন ততোধিক রমণীয় দেখাইতে লাগিল॥ ১৫॥
ভ্রমর উপবিষ্ট থাকিলে পদ্মের যে শোভা হয়, অথবা এক খণ্ড মেঘ উপরে থাকিলে চন্দ্রমণ্ডলের যে কান্তি হয়, সুশোভিত অলকের দ্বারা তাঁহার মুখের কান্তি ঐ উভয় অপেক্ষা অনেক অধিক হইল, সুতরাং উপমা দিবার কথা পর্য্যন্ত উত্থাপন হইবার সম্ভাবনা রহিল না॥ ১৬॥
তাঁহার গণ্ড দেশ লোধ্রচুর্ণ দ্বারা নির্ম্মল করা হইয়াছিল, আর তদুপরি গোরোচনা বিন্যাস করাতে অতীব গৌর বর্ণ দেখাইতেছিল, একারণ যখন তাঁহার কর্ণে যবাঙ্কুর সন্নিবেশিত হইল, তখন উহা পূর্ব্বোক্ত প্রকার গণ্ডস্থলের সহিত মিলিত হইয়া চমৎকার বর্ণ-বৈচিত্র প্রাপ্ত হওয়াতে লোকের চক্ষু আকর্ষণ করিতে লাগিল॥ ১৭॥
সুগঠন-শরীরা সেই পার্ব্বতীর অধরের মধ্য-দেশে একটী রেখা ছিল, সেই অধরে কিঞ্চিৎ মধুত্থ লেপন করাতে উহার রক্তিমা আরো উজ্জ্বল হইয়াছিল। এই সময়ে স্বামীর বদন-সংসর্গ-প্রাপ্তি দ্বারা উহার সৌন্দর্য্যের সাফল্য হইবেক ইহা সূচনা করিবার জন্য যেন অধরটী কিঞ্চিৎ কিঞ্চিৎ কম্পিত হইতে লাগিল এবং অনির্ব্বচনীয় এক শোভা ধারণ করিল॥ ১৮॥
পার্ব্বতীর এক সহচরী তাঁহার দুই চরণ অলক্তক রসে রঞ্জিত করিয়া এই বলিয়া আশীর্ব্বাদ করিল “এই চরণে যেন তুমি স্বামীর মস্তকের চন্দ্র-কলা স্পর্শ কর;” তাহাতে তিনি কোন উত্তর না করিয়া মালা দ্বারা সখীকে প্রহার করিলেন॥ ১৯॥
বেশ-ভূষা-কারিণী রমণীরা সম্যক্ বৃদ্ধি-প্রাপ্ত পদ্ম-পলাশের ন্যায় চমৎকার তাঁহার দুই চক্ষু অবলোকন করিয়া কেবল মঙ্গলাচরণ বলিয়া কৃষ্ণবর্ণ কজ্জ্বল গ্রহণ করিল, সেই কজ্জ্বলের দ্বারা পার্ব্বতীর চক্ষুর রমণীয়তা বৃদ্ধি হইবেক এ জ্ঞানে নহে॥ ২০॥
যখন এক এক খানি করিয়া অলঙ্কার তাঁহাকে পরান হইতেছিল, তখন তাঁহার তেমনি শোভা উদয় হইল যেন লতার অবয়বে এক একটী পুষ্প প্রস্ফুটিত হইতেছে, যেন রাত্রির অঙ্গে এক একটী নক্ষত্র উদয় হইতেছে, যেন নদীর উপরিভাগে এক একটী পক্ষী উপবিষ্ট হইতেছে॥ ২১॥
তখন নিশ্চল বিশাল চক্ষে দর্পণের মধ্যে আপনার পরম সুন্দর শোভা দর্শন করিয়া মহাদেবের সহিত মিলনের নিমিত্ত তিনি ব্যগ্র হইলেন, যেহেতু প্রিয় ব্যক্তি দর্শন করিলেই স্ত্রী লোকের বেশ ভূষার সাফল্য হয়॥ ২২॥
তদনন্তর জননী মেনকা মঙ্গলের জন্য এক অঙ্গুলিতে হরিতাল-রস অপর অঙ্গুলিতে মনঃশিলা নামক ধাতুরস গ্রহণ পূর্ব্বক দন্তপত্র নামক সুনির্ম্মল কর্ণভূষণে শোভমান পার্ব্বতীর মুখ উন্নত করিয়া, তাঁহার ললাটে বিবাহের তিলক রচনা করিয়া দিলেন, উহা দেখিলে মনে হয় যেন পার্ব্বতীর যৌবনের আবির্ভাব অবধি জননীর মনে সর্ব্ব প্রথম যে অভিলাষ দিন দিন বৃদ্ধি পাইতেছিল, তাহাই তিলক রূপে প্রকাশ হল॥ ২৩। २8॥
পরে অশ্রুজলে আবৃত লোচনা হইয়া মেষলোমময় বিবাহের হস্তসূত্র বাঁধিয়া দিলেন, তাহা প্রথমে যথাস্থানে সন্নিবেশিত হয় নাই, যেহেতু চক্ষের জলে তাঁহার দৃষ্টি অপরিষ্কার হইয়াছিল, কিন্তু পার্ব্বতীর ধাত্রী উহাকে যথাস্থানে সরাইয়া দিলেন॥ ২৫॥
নবীন দুকূল পরিধান করিয়া এবং অভিনব দর্পণ হস্তে ধারণ করিয়া তাঁহার তেমনি আশ্চর্য্য শোভা হইল, যেন ক্ষীর সাগরের জলে পুঞ্জ পুঞ্জ ফেণ উদয় হইয়াছে, যেন শরদের রজনী পূর্ণ শশধর প্রাপ্ত হইয়াছে॥ ২৬॥
আবশ্যক কি কি কার্য্য করিতে হইবেক তদ্বিষয়ে সুবিজ্ঞ জননী বংশের গৌরবস্বরূপা সেই পার্ব্বতীকে পূজিত কুলদেবতাদিগকে প্রণাম করাইয়া এক এক করিয়া পতিব্রতাগণের চরণ বন্দনা করাইলেন॥ ২৭॥
প্রণাম কালে উমাকে তাঁহারা এই বলিয়া আশীর্ব্বাদ করিলেন, যে স্বামীর সমগ্র প্রেমের পাত্র-ভূত যেন তুমি হও। পার্ব্বতী কিন্তু শিবের অর্দ্ধাঙ্গ পর্য্যন্ত প্রাপ্ত হইয়া তাঁহাদিগের স্নেহ-যুক্ত আশীর্ব্বাদের অনেক অতিরিক্ত সৌভাগ্য প্রাপ্ত হইয়াছিলেন॥ ২৮॥
যেমন আশয় ও যেমন বিভব, তদুপযুক্ত সমারোহের সহিত গিরিরাজ পার্ব্বতীর বিবাহের আনুষঙ্গিক সকল কর্ম্ম সম্পন্ন করিয়া সুহৃন্মণ্ডলী-পরিবৃত হইয়া সভায় উপবেশন পূর্ব্বক শিবের আগমনের প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন॥ ২৯॥
সেই সময়ে কৈলাস পর্ব্বতেও সপ্ত মাতৃকারা পরম সমাদরে ত্রিপুরারি শিবের সমক্ষে সেই সর্ব্ব প্রথম বিবাহের উপযুক্ত নানাবিধ অলঙ্কার রাখিয়া দিলেন॥ ৩০॥
মাতৃকাদিগকে সম্মান করিবার জন্য শিব সেই সমস্ত অলঙ্কার স্পর্শ মাত্র করিলেন। পরন্তু তাঁহার চির-পরিগৃহীত সজ্জাই এখন ঐশ্বরিক ক্ষমতা বলে বিবাহের উপযুক্ত এক নূতন মূর্ত্তি ধারণ করিল॥ ৩১॥
তাঁহার শরীরস্থিত ভস্মই শ্বেতচন্দন হইয়া উঠিল, মস্তকস্থিত নরশির নির্ম্মল শিরোভূষণের শোভা পরিগ্রহ করিল; আর তাঁহার পরিধানভূত হস্তিচর্ম্মই চতুঃপার্শ্বে রোচনাচিহ্নে চিহ্নিত দুকূল রূপে পরিণত হইল॥ ৩২॥
আর তাঁহার ললাটে যে তৃতীয় লোচন জাজ্জ্বল্যমান ছিল, যাহার মধ্যস্থলে নির্ম্মল পিঙ্গল বর্ণ তারা বিরাজ করিতেছিল, সেই চক্ষু বিদ্যমান থাকাতে তাঁহার ললাটে হরিতাল-রস দ্বারা তিলক রচনা করিতে হইল না॥ ৩৩॥
তাঁহার শরীরের ভিন্ন ভিন্ন অবয়বে যে সকল প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড সর্প সন্নিবেশিত ছিল, তাহারা যখন সেই সেই স্থানের উপযুক্ত অলঙ্কার রূপে পরিণত হইল, তখন কেবল তাহাদিগের শরীরেরি রূপান্তর হইল, কিন্তু ফণাস্থিত সুশোভন মণিগুলি পূর্ব্ববৎ রহিল॥ ৩৪॥
শিবের মস্তকে যে চন্দ্র কলা ছিল, উহার আলোক দিবসেও উদয় হইতেছিল এবং কলা অবস্থা প্রযুক্ত কলঙ্কের লেশমাত্র লক্ষ্য হইতেছিল না; এ প্রকার চন্দ্র যখন তাঁহার শিরোভূষণ হইয় অবস্থিত ছিল, তখন অন্য কোন মাণিক্য তিনি মস্তকে কেন ধারণ করিতে যাইবেন॥ ৩৫॥
সর্ব্ব প্রকার আশ্চর্য্যের অদ্বিতীয় সংঘটন কর্ত্তা সেই মহাদেব পূর্ব্বোক্ত প্রকারে ঐশ্বরিক ক্ষমতার দ্বারা যখন চমৎকার বেশ ভূসা সম্পাদন করিলেন, তখন তাঁহার বিশ্বস্ত অনুচরেরা এক খানি তরবারি আনিয়া দিল, তন্মধ্যে তিনি আপন প্রতিবিম্ব দর্শন করিলেন॥ ৩৬॥
তখন কৈলাসতুল্য শুভ্র বর্ণ বৃহৎকায় বৃষরাজ আনীত হইল, তাহার বিশাল পৃষ্ঠদেশ ব্যাঘ্রের চর্ম্মে আচ্ছাদিত ছিল, তাহার প্রকাণ্ড আকৃতি শিবের প্রতি ভক্তি প্রযুক্ত তাঁহার আরোহণের সুবিধার জন্য সে আপনিই হ্রস্বীভূত করিয়াছিল, শিব নন্দীর হস্ত ধারণ পূর্ব্বক তদুপরি আরোহণ করিয়া যাত্রা করিলেন॥ ৩৭॥
সপ্ত মাতৃকা প্রভুর পশ্চাৎ পশ্চাৎ চলিলেন, নিজ নিজ বাহনের গমন প্রযুক্ত তাঁহাদিগের কর্ণের কুণ্ডল দুলিতে লাগিল, আর পদ্ম সদৃশ মুখের চতুঃপার্শ্বে পরাগেরন্যায় মণ্ডলাকার প্রভা দৃষ্ট হইল, তাহাতে আকাশ পদ্মে আকীর্ণ বলিয়া জ্ঞান হইল॥ ৩৮॥
সুবর্ণ-তুল্য কান্তি-বিশিষ্ট সেই সপ্তমাতৃকার পশ্চাদ্ভাগে নরমুণ্ডমালাধারিণী কালীকে তদ্রূপ দেখাইতে লাগিল, যেমন সম্মুখের দিকে দূরে বিদ্যুৎ উদয় হইতেছে, নিকটে বিস্তর বকপক্ষী উড্ডীয়মান, এতাদৃশ নীল বর্ণ মেঘমালাকে দেখাইয়া থাকে॥ ৩৯॥
তদনন্তর শিবের অগ্রগামী প্রমথগণ বিবাহের বাদ্য আরম্ভ করিল, উহা বিমানের অগ্রভাগ পর্য্যন্ত স্পর্শ করিলে দেবতারা জানিলেন যে শিবের সেবা করিবার সময় উপস্থিত॥ ৪০॥
বিশ্বকর্ম্মা এক নূতন ছত্র নির্ম্মাণ করিয়া দিয়াছিলেন, সূর্যদেব শিবের মস্তকে সেই ছত্র ধারণ করিলেন। তৎকালে ছত্রের প্রান্তে লম্বমান পট্টবস্ত্র শিবের মস্তকের নিকটবর্ত্তী হওয়াতে জ্ঞান হইতে লাগিল যেন গঙ্গার স্রোত তথায় পতিত হইতেছে॥ ৪১॥
তখন গঙ্গা আর যমুনা মূর্ত্তিমতী হইয়া চামর ব্যজন করত প্রভুর সেবায় নিযুক্ত হইলেন। সেই চামর দেখিয়া জ্ঞান হইল যে যদিও ইঁহারা নদীর মূর্ত্তি ত্যাগ করিয়াছেন, তথাপি এখনও যেন ইঁহাদের উপর হংস আসিয়া বসিতেছে॥ ৪২॥
প্রথম প্রজাপতি ব্রহ্মা আর বক্ষস্থলে শ্রীবৎস-চিহ্নধারী পুরুষোত্তম নারায়ণ তাঁহার সম্মুখে উপস্থিত হইলেন। তাঁহাদিগের মুখ-বিনির্গত জয়ধ্বনিতে শিবের মহিমা তেমনি বৃদ্ধি পাইতে লাগিল, যেরূপ ঘৃতাহুতি দ্বারা অগ্নির ঔজ্জ্বল্য বৃদ্ধি হয়॥ ৪৩॥
এই তিন দেব অর্থাৎ ব্রহ্মা বিষ্ণু মহেশ্বর, ইঁহারা একই শরীর, কেবল তিন মূর্ত্তি রূপে পৃথক্ হইয়াছিলেন, ইঁহারা প্রত্যেকেই প্রধানও বটেন, অপ্রধানও বটেন, কখন বিষ্ণু অপেক্ষা শিব প্রধান, কখন শিব অপেক্ষা বিষ্ণু, কখন ব্রহ্মা তাঁহাদিগের উভয় অপেক্ষা, কখন বা তাঁহারা উভয়ে শিব অপেক্ষা, প্রধান বলিয়া পরিগণিত হয়েন॥ ৪৪॥
ইন্দ্র আদি দিক্পালগণ আপনাদিগের রাজচিহ্ন সমস্ত পরিত্যাগ পূর্ব্বক তাঁহার নিকট উপস্থিত হইয়া নন্দীকে সংকেত করিলেন যে প্রভুর সঙ্গে দেখা করাইয়া দেওয়া হয়; নন্দী দেখাইয়া দিলে, তাঁহারা কৃতাঞ্জলি পুটে প্রণাম করিতে লাগিলেন॥ ৪৫॥
শিব ব্রহ্মার প্রতি কিঞ্চিৎ মস্তক সঞ্চালিত করিলেন, হরির সহিত আলাপ করিলেন, ইন্দ্রের প্রতি ঈষৎ হাস্য করিলেন, আর অন্যান্য অশেষ দেবতার প্রতি দৃষ্টিপাত মাত্র করিলেন। এই রূপে যে যে প্রকার সম্মানের উপযুক্ত, তাহাকে তিনি তদনুরূপ সম্মান দ্বারা আপ্যায়িত করিতে লাগিলেন॥ ৪৬॥
সপ্তঋষি তাঁহার সম্মুখে আসিয়া জয় হউক বলিয়া আশীর্ব্বাদ করিলেন। তিনি ঈষৎ হাস্য পূর্ব্বক কহিলেন, এই যে বিবাহযজ্ঞ উপস্থিত, ইহার পৌরোহিত্য করিবার নিমিত্ত অগ্রেই আমি আপনাদিগকে বরণ করিয়া রাখিয়াছি॥ ৪৭॥
বিশ্বাবসু প্রভৃতি গন্ধর্ব্বগণ প্রকৃষ্ট রূপ বীণাবাদ্য সহকারে তাঁহার ত্রিপুর-বিজয়-বৃত্তান্ত গাইতে লাগিলেন। তাহা শ্রবণ করিতে করিতে তমোগুণাতীত চন্দ্রকলাধারী প্রভু গগণ পথ অতিক্রম করিয়া যাইতে লাগিলেন॥ ৪৮॥
তাঁহার বাহন বৃষরাজ তাঁহাকে বহন করত রমণীয় গতিতে গগণে গমন করিতে লাগিল, তাহার গলদেশে লম্বমান সুবর্ণময় ক্ষুদ্র ঘণ্টা গুলি বাজিতে লাগিল, আর যখন যখন তাহার দুই শৃঙ্গ মেঘে বিদ্ধ হয়, তখনই সে দুই শৃঙ্গ সঞ্চালন করে, যেন মনে করে যে নদীতীর খনন করিয়া উহাতে কর্দ্দম সংলগ্ন হইয়াছে॥ ৪৯॥
সেই বৃষ মুহূর্ত্ত মধ্যে সেই ওষধিপ্রস্থ নগরীতে উপনীত হইল, যাহাকে কখন বিপক্ষে আক্রমণ করিতে পারে নাই। আর মহাদেবের দৃষ্টিপাত অগ্রভাগে ধাবমান হইয়া সুবর্ণ শৃঙ্খলার ন্যায় তাহাকে আকর্ষণ করাতেই যেন সে অত শীঘ্র উপস্থিত হইল॥ ৫০॥
নগরের নিকটে মেঘের ন্যায় নীলবর্ণ-কণ্ঠধারী প্রভূ, ত্রিপুরাসুরের ধ্বংস কালে আপন বাণ যে পথে প্রেরণ করিয়াছিলেন, সেই আকাশ পথ হইতে অবতরণ করিতে লাগিলেন, পুরবাসীরা মস্তক উত্তোলন পূর্ব্বক দেখিতে লাগিল, তিনি সন্নিহিত ভূমিতলে অবতীর্ণ হইলেন॥ ৫১॥
গিরিরাজ তাঁহার আগমনে আহ্লাদিত হইয়া সম্মানার্থ অগ্রসর হইয়া গেলেন, তাঁহার সঙ্গে দলে দলে হস্তী চলিল, তদুপরি সুসমৃদ্ধ-পরিচ্ছদধারী তাঁহার আত্মীয় স্বজনেরা উপবিষ্ট ছিলেন, তাহাতে জ্ঞান হইল যেন হিমালয়ের এক এক কটক যাইতেছে এবং তদুপরি বিকসিত কুসুমশালী বৃক্ষগণ বিরাজ করিতেছে॥ ৫২॥
পুরদ্বারের কপাট উদ্ঘাটিত হইলে তথায় দেবতাদিগের দল আর পর্ব্বতদিগের দল উভয় দলে সাক্ষাৎ হইল, সেই মিলনের কোলাহল অনেক দূর বিস্তারিত হইল, যেরূপ উভয়-সাধারণ এক সেতুভঙ্গ করিয়া দুই দিক্ হইতে দুই জলরাশি আসিয়া মিলিত হইলে হইয়া থাকে॥ ৫৩॥
ত্রিভুবনের পূজনীয় শিব প্রণাম করাতে গিরিরাজের লজ্জা বোধ হইল, তৎকালে তাঁহার স্মরণ ছিল না যে পূর্ব্ব হইতে শিবের মহিমার নিকট তাঁহার নিজ মস্তক অতিদূর পর্য্যন্ত অবনত হইয়াই আছে॥ ৫৪॥
আনন্দবশে হিমালয়ের মুখশ্রী প্রফুল্ল হইল, তিনি জামাতাকে পথ দেখাইতে দেখাইতে আপনার সুসমৃদ্ধ নগরে প্রবেশ করাইলেন, তথায় তৎকালে রাজমার্গে এত রাশি রাশি পুষ্প বিস্তারিত হইয়াছিল যে, গুল্ফ পর্য্যন্ত নিমগ্ন হইয়া যায়॥ ৫৫॥
সেই সময়ে পুরবাসিনীরা শিবকে দেখিতে ব্যস্ত হইল, প্রত্যেক অট্টালিকা মধ্যে তাহারা অনন্যকর্ম্মা হওয়াতে নিম্ন লিখিত ব্যাপারগুলি ঘটিতে লাগিল॥ ৫৬॥
কোন রমণী কেশপাশ বন্ধন করিতেছিলেন, হঠাৎ শিবকে দেখিতে গবাক্ষ পথে চলিলেন, তাঁহার কেশের বন্ধর শিথিল এবং অভ্যন্তরস্থ মালা বহির্গত হইয়া পড়িল, এবং হস্তে কেশকলাপ ধারণ করিয়া রহিলেন, আর বন্ধন করিবার অবকাশ রহিল না॥ ৫৭॥
কেহ চরণে লাক্ষা দেওয়াইতেছিলেন, বেশ-ভূষা-কারিণী পরিচারিকা চরণের অগ্রভাগ ধারণ করিয়াছিল, তখনও অলক্তক-রস শুষ্ক হয় নাই, তিনি হঠাৎ চরণ উহার হস্ত হইতে আকর্ষণ করিয়া লইলেন, তখন আর বিলাস-মন্থর গমনে যাওয়া হইল না, গবাক্ষ পর্য্যন্ত সমস্ত পথ লাক্ষা-রসে রঞ্জিত করিয়া দ্রুতপদে চলিয়া গেলেন॥ ৫৮॥
আর এক রমণী চক্ষে কাজল পরিতেছিলেন, দক্ষিণ চক্ষে কাজল দেওয়া হইয়াছিল, বাম চক্ষে তখনও হয় নাই, সেই অবস্থাতেই কাজল দিবার তুলী হস্তে ধারণ করিয়া গবাক্ষের দিকে ধাবমান হইলেন॥ ৫৯॥
গবাক্ষে যাইবার সময় এক রমণীর কটিবস্ত্রের বন্ধন শিথিল হইয়া গিয়াছিল, তিনি গবাক্ষের ছিদ্রে দৃষ্টিদান পূর্ব্বক তাহা আর বাঁধিবার অবকাশ পাইলেন না, কেবল হস্তদ্বারা বস্ত্র ধারণ করিয়া রহিলেন আর নাভিমধ্যে অলঙ্কারের প্রভা প্রবিষ্ট হইল॥ ৬০॥
এক রমণী মুক্তাদ্বারা চন্দ্রহার গাঁথিতেছিলেন, অর্দ্ধেক গাঁথা হইয়াছে, এমন সময় সত্বর গাত্রোত্থান করিলেন, চন্দ্রহারের সূত্র চরণের বৃদ্ধাঙ্গুলিতে বাঁধা ছিল, প্রত্যেক পাদক্ষেপে মুক্তাগুলি খসিয়া খসিয়া পড়িতে লাগিল, পরিশেষে সেই সূত্র মাত্র অবশিষ্ট রহিল॥ ৬১॥
মধুপান করাতে সেই রমণীগণের মুখে মদিরার গন্ধ ছিল, আর ভ্রমরের ন্যায় নীল চক্ষু সঞ্চালিত হইতেছিল, এই অবস্থায় অতিশয় কুতূহল প্রযুক্ত যখন তাহারা গবাক্ষের ছিদ্রের নিকট আপন আপন মুখ রাখিল, তখন গবাক্ষ গুলি যেন পদ্মে বিভূষিত হইয়া উঠিল॥ ৬২॥
সেই অবসরে চন্দ্রশেখর শিব উন্নত-তোরণ-শোভিত রাজ-পথে উপনীত হইলেন, আর তাঁহার মস্তকস্থিত চন্দ্রের জ্যোৎস্নার সংস্পর্শে দিবাভাগেও অট্টালিকার অগ্রভাগ গুলি দ্বিগুণ ঔজ্জ্বল্য ধারণ করিল॥ ৬৩॥
তৎকালে শিবই পুরবাসিনী রমণীগণের একমাত্র দৃশ্য বস্তু হইলেন, তাহাদিগের অন্য কোন বস্তুতে মনঃসংযোগ রহিল না, এ কারণ মনে হয় যেন অন্যান্য ইন্দ্রিয়ের শক্তি পর্য্যন্ত তখন সম্পূর্ণ রূপে চক্ষুর মধ্যেই প্রবিষ্ট হইয়াছিল॥ ৬৪॥
পার্ব্বতী সুকুমারাঙ্গী হইয়াও যে ইহার জন্য কঠোর তপস্যা করিয়াছিলেন, তাহা ভালই করিয়াছিলেন। কারণ ইঁহার দাসী হইতে পারিলেও রমণী-জন্ম সার্থক হইতে পারে, ইঁহার অঙ্কে যিনি বসিতে পাইবেন, তাঁহার বিষয়ে আর বলিব কি?॥ ৬৫॥
এমন চমৎকার রূপ-লাবণ্য-সম্পন্ন ইঁহাদের উভয়কে বিধাতা যদি পরস্পর মিলিত না করিতেন, তাহা হইলে এত ক্লেশ করিয়া যে ইঁহাদিগকে সুন্দর করিয়াছেন, তাঁহার সে ক্লেশ বৃথা হইত॥ ৬৬॥
বোধ হয় ইনি রোষাতিশয় প্রযুক্ত যে কন্দর্পের শরীর ভস্ম করিয়াছেন, সে কথা না হইবেক; বোধ করি ইঁহাকে দেখিয়া আপনার রূপের বিষয়ে কামদেবের লজ্জা হইল এবং তিনি আপনিই দেহ পরিত্যাগ করিলেন॥ ৬৭॥
দেখ সখি, এই প্রভুর সহিত চিরাভিলষিত বিবাহ সম্বন্ধ সংঘটন হওয়াতে, পর্ব্বতরাজ পৃথিবীকে ধারণ করেন বলিয়া অতি মান্য ব্যক্তি ত ছিলেনই, এখন আরো মান্য হইবেন॥ ৬৮॥
পুরবাসিনী রমণীরা এই সকল, কথা বলিতেছিলেন, শিব শুনিয়া আহ্লাদিত হইতেছিলেন, এই ভাবে তিনি হিমালয়ের বাটীতে উপস্থিত হইলেন, তথায় এত স্ত্রীলোক একত্র হইয়াছিল, যে লাজ বৃষ্টি করিলে উহা ভূমি তলে পতিত না হইয়া রমণীগণের কেয়ূর ঘর্ষণেই চূর্ণ হইয়া যাইতেছিল॥ ৬৯॥
সূর্য্যদেব যেমন শরৎ কালীন মেঘ হইতে অবতীর্ণ হয়েন, তদ্রূপ শিব তথায় কৃষ্ণের হস্তাবলম্ব প্রাপ্ত হইয়া বৃষ হইতে অবতীর্ণ হইলেন। পরে ব্রহ্মা অগ্রে গিয়াছিলেন, তাঁহার পশ্চাৎ হিমালয়ের ভিন্ন ভিন্ন প্রকোষ্ঠে প্রবেশ করিলেন॥৭০॥
উপাদেয় কার্য্য-সিদ্ধি যেমন সুসম্পন্ন কার্য্যের অনুগামী হয়, তদ্রূপ ইন্দ্র প্রভৃতি দেবগণ, সপ্তর্ষি প্রভৃতি পরমর্ষিগণ, এবং প্রমথেরা শিবের অনুগামী হইয়া হিমালয় বাটীতে প্রবিষ্ট হইলেন॥ ৭১॥
তথায় শিব আসনে উপবিষ্ট হইলেন, হিমালয় যথাবিধানে রত্ন, অর্ঘ, মধুপর্ক, নূতন পট্টবস্ত্র যুগল তাঁহাকে আনিয়া অপর্ণ করিলেন, তিনি মন্ত্রপাঠ সহকারে সমস্ত গ্রহণ করিলেন॥ ৭২॥
যেমন নবীন চন্দ্রের কিরণগণ সমুদ্রের স্ফীতি জন্মাইয়া দিয়া উহাকে ফেণায় আচ্ছাদিত করিয়া তীর-ভূমি অভিমুখে লইয়া যায়, তদ্রূপ পট্টবসন পরিধানের পর শিবকে শান্তস্বভাব অন্তঃপুর-রক্ষী পুরুষেরা বধূর নিকটে লইয়া গেল॥ ৭৩॥
যেমন শরৎকালের সমাগমে সংসারে চন্দ্রের কান্তি উজ্জ্বল হয়, কুমুদ বিকসিত হয়, জল পরিষ্কার হয়; তদ্রূপ সেই উজ্জ্বল-মুখ-চন্দ্র-শোভিতা কুমারীর নিকটে যাইয়া শিবের চক্ষু বিকসিত হইল, অন্তঃকরণ নির্ম্মল হইল॥ ৭৪॥
শুভ দৃষ্টির সময় চারি চক্ষু একত্র হইয়া পরস্পরকে দেখিতে ব্যগ্র হওয়াতে লজ্জা জন্য সংকোচ প্রাপ্ত হইতে লাগিল, যখন যখন চারি চক্ষু এক হয়, তখন লজ্জায় যেন অবনত হইয়া পড়ে, আর কিয়ৎকাল মিলিত ভাবে অবস্থিতি করে, পরে অপসারিত হয়॥ ৭৫॥
শিবের পুরোহিত রক্তবর্ণ অঙ্গুলি-বিশিষ্ট পার্ব্বতীর হস্ত আনিয়া দিলেন, শিব তাহা ধারণ করিলেন। সেই হস্ত দর্শন করিলে মনে হইবেক যেন কন্দর্প শিবের ভয়ে পার্ব্বতীর শরীরে লুক্কায়িত ছিলেন, এই আবার তাঁহার প্রথম অঙ্কুর দেখা দিতেছে॥ ৭৬॥
পার্ব্বতীর শরীরে রোমাঞ্চ হইল, বৃষভধ্বজ শিবের অঙ্গুলিতে ঘর্ম্মের আবির্ভাব হইল। অতএব মনে হয় যেন উভয়ের চারি হস্ত একত্র হইবার সময় কামদেবের কার্য্য সমান রূপে দুজনের শরীরে ভাগ অপাঠ্য হইল॥ ৭৭॥
কথিত আছে, বিবাহের সময় হর পার্ব্বতী বর-কন্যার শরীরে অধিষ্ঠান হয়েন, এ কারণ বর-কন্যা মাত্রেই বিবাহের সময় অতি চমৎকার শোভা ধারণ করে, যখন সামান্য বর-কন্যার এই রূপ হইয়া থাকে, তখন তাঁহাদিগের দুজনের তৎকালীন শোভার কথা আর কি বলা যাইবেক॥ ৭৮॥
যেরূপ সুমেরু পর্ব্বতের চতুঃপার্শ্বে দিন ও যামিনী পরস্পর সংলগ্ন হইয়া নিত্যকাল পর্য্যায়ক্রমে প্রদক্ষিণ করে, তদ্রূপ তাঁহারা দুজনে প্রদীপ্ত বহ্নির চতুঃপার্শ্বে পরস্পর সংলগ্ন ভাবে প্রদক্ষিণ করাতে পরম সুন্দর শোভা হইল॥ ৭৯॥
সেই স্ত্রী পুরুষ উভয়কে পুরোহিত তিন বার বহ্নি প্রদক্ষিণ করাইলেন, তখন পরস্পরকে স্পর্শ করিয়া আনন্দে উভয়ের চক্ষু মুদ্রিত হইয়াছিল। পরে বধূকে সেই প্রদীপ্ত-শিখা-বিশিষ্ট অগ্নি মধ্যে লাজ-হোম করিতে কহিলেন॥ ৮০॥
পুরোহিতের আজ্ঞাক্রমে পার্ব্বতী সুন্দর-সৌরভশালী লাজের ধূম অঞ্জলি করিয়া আপন মুখে স্পর্শ করাইলেন। সেই ধূমের অগ্রভাগ গণ্ডস্থলে বিস্তারিত হওয়াতে কিয়ৎ কালের নিমিত্ত কর্ণোৎপলের ন্যায় প্রতীয়মান হইতে লাগিল॥ ৮১॥
আচারের জন্য এই ধূম গ্রহণ করাতে বধুর মুখের এক অপুর্ব্ব শ্রী উপস্থিত হইল, গণ্ডদেশ কিঞ্চিৎ ঘর্ম্মাক্ত ও রক্তবর্ণ দুষ্পাঠ্য নার কর্ণভূষণ মলিন হইয়া গেল আর দুই চক্ষুর দুষ্পাঠ্য হইয়া উঠিল॥ ৮২॥
পুরোহিত বধূকে কহিলেন, বৎসে! এই অগ্নি তোমার বিবাহ কার্য্যের সাক্ষী হইয়ারহিলেন। তুমি এখন অসঙ্কুচিত চিত্তে তোমার স্বামী শিবের সহিত একত্র হইয়া ধর্ম্মানুষ্ঠান করিবে॥ ৮৩॥
যেমন পৃথিবী গ্রীষ্মকালের প্রখর তাপ সহ করিয়া বর্ষার সর্ব্ব প্রথম জল পান করিতে থাকেন, তদ্রূপ পার্ব্বতী লোচনপ্রান্ত পর্য্যন্ত কর্ণযুগল বিস্তার পূর্বক পুরোহিতের পূর্বোক্ত কথাগুলি শ্রবণ করিলেন॥ ৮৪॥
তাহার মৃত্যুজয়ী সৌম্যমূর্ত্তি স্বামী যখন তাঁহাকে ধ্রুবতারা দেখিবার জন্য অনুমতি করিলেন, তখন তাঁহার কণ্ঠস্বর অবশ হইয়া গেল। তিনি মুখ তুলিয়া তারা দেখিবার পর ‘দেখিয়াছি’ এই কথাটী অতি কষ্টে মুখ হইতে নির্গত করিতে পারিলেন॥ ৮৫॥
এই রূপে বিধান শাস্ত্রে স্থপণ্ডিত পুরোহিত তাহাদিগের বিবাহ সংক্রান্ত সকল কার্য্যের অনুষ্ঠান করিয়া দিলে প্রজাবর্গের জনক জননী স্বরূপ তাঁহারা উভয়ে পদ্মাসনে উপবিষ্ট ব্রহ্মাকে গিয়া প্রণাম করিলেন॥ ৮৬॥
ব্রহ্মা বধূকে এই বলিয়া আশীর্ব্বাদ করিলেন ‘হে কল্যাণি! বীর সন্তান প্রসব কর’। কিন্তু তিনি বাক্যের অধীশ্বর হইয়াও শিবকে কি আশীর্ব্বাদ করিবেন ইহা ভাবিয়া স্থির করিতে পারিলেন না, মৌনী হইয়া রহিলেন॥ ৮৭॥
তদনন্তর পুষ্পাদি শোভায় সুশোভিত চতুষ্কোণ ঐ বেদির উপর আসিয়া তাঁহারা উভয়ে সুবর্ণের সিংহাসনে উপবেশন করিলেন, তথায় আর্দ্র আতপ-তণ্ডুল মস্তকে অপর্ণ করিবার যে এক প্রথা লোকে প্রচলিত আছে এবং যাহা সকলেই ইচ্ছাপূর্ব্বক গ্রহণ করে, তাহা তাঁহারা গ্রহণ করিলেন॥ ৮৮॥
লক্ষ্মী তাঁহাদিগের মস্তকে একটী পদ্মের ছত্র ধারণ করিলেন, উহার দলের প্রান্তভাগে বিন্দু বিন্দু জল সংলগ্ন থাকাতে বোধ হইতে লাগিল যেন ছত্রে মুক্তার ঝালর বুলিতেছে; আর উহার সুদীর্ঘ নালই ছত্র-দণ্ড স্বরূপ হইয়াছিল॥ ৮৯॥
আর সরস্বতী দুই প্রকার ভাষা প্রয়োগ পূর্ব্বক তাঁহাদিগের দুজনকে স্তব করিলেন, পরম গুণবান্ বরকে সংস্কৃত ভাষাতে, আর বধূকে সুগম-রচনা-বিশিষ্ট প্রাকৃত ভাষা দ্বারা॥ ৯০॥
অপ্সরারা তাঁহাদিগের উভয়ের সমক্ষে এক নাটকের অভিনয় করিল, তাহা তাঁহারা ক্ষণ কাল দর্শন করিলেন, উহাতে প্রত্যেক সন্ধির উপযুক্ত ভিন্ন ভিন্ন রচনা-বৈচিত্র প্রদর্শন করা হইয়াছিল, এক রস ত্যাগ পূর্ব্বক অন্য রসের বর্ণনাকালে গানের আলাপ করা হইতে লাগিল আর অতি চমৎকার হস্ত-পদাদি-চেষ্টা প্রদর্শন করা হইতে লাগিল॥ ৯১॥
তদনন্তর দেবতাগণ মস্তকে অঞ্জলিবন্ধ পূর্ব্বক কৃতদার শিবের চরণে প্রণাম করিয়া এই প্রার্থনা জানাইলে যে, কন্দর্পের শাপের অবসান হউক, সে আপন শরীর পুনর্ব্বার প্রাপ্ত হইয়া তাঁহার সেবায় নিযুক্ত হউক॥ ৯২॥
মহাদেবের আর ক্রোধ ছিল না, সুতরাং তিনি অনুমতি করিলেন যে কামদেব তাঁহার প্রতিও বাণ নিক্ষেপ করিতে পাইবে। কথাই আছে যে কার্য্যজ্ঞ ব্যক্তিরা উপযুক্ত অবসর বুঝিয়া প্রভুর নিকট আবেদন করিলে উহা নিশ্চয় গ্রাহ্য হয়॥ ৯৩॥
পরে চন্দ্রশেখর শিব তাবৎ দেবতাকে বিদায় দিয়া পর্ব্বতরাজ-নন্দিনীর হস্ত ধারণ পূর্ব্বক বাসর-গৃহে আগমন করিলেন। তথায় সুবর্ণের কলস সংস্থাপিত ছিল, পুষ্পমালা প্রভৃতি পদার্থ দ্বারা গৃহ সুশোভিত করা হইয়াছিল যার ভূমিতলে শয্যা রচনা করা হইয়াছিল॥ ৯৪॥
তথায় গৌরী নবোঢ়ার সমুচিত লজ্জা স্বরূপ অলঙ্কারে অলঙ্কত হইয়া বসিয়াছিলেন, শিব তাঁহার মুখ উত্তোলনের চেষ্টা করিলে উহা সরাইয়া লইতেছিলেন, এমন কি যে সকল সহচরীর সঙ্গে একত্রে শয়ন হয়, তাহাদিগের সহিত কথা বার্ত্তাও কষ্টে কহিতেছিলেন; এই অবস্থায় শিবের অনুচর প্রমথগণ তাঁহার আদেশক্রমে কৌতুকাবহ মুখ ভঙ্গী করাতে পার্ব্বতী অস্পষ্ট রূপে কিঞ্চিৎ হাস্য করিলেন॥ ৯৫॥
সম্পূর্ণ।