কুরু পাণ্ডব

 ধৃতরাষ্ট্রের পুত্র দুর্য্যোধন প্রভৃতি একশত ভ্রাতার সহিত বালককালে পাণ্ডুপুত্র যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জ্জুন, নকুল, সহদেবের সর্ব্বদা ক্রীড়া কৌতুক চলিত। কিন্তু ভীমের বল এত অত্যন্ত অধিক ছিল যে তাঁহার পক্ষে যাহা ক্রীড়া ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের পক্ষে তাহা পীড়ার কারণ হইয়া উঠিল। তাহারা গাছে চড়িলে গাছে পদাঘাত করিয়া তিনি তাহাদিগকে শাখাচ্যুত করিয়া দিতেন, জলক্রীড়াকালে তাহাদিগকে বলপূর্ব্বক জলমগ্ন করিতেন, কেশকর্ষণ করিয়া মাটিতে ফেলিতেন, দুইজনকে পরস্পরের সহিত নিষ্পেষণ করিতেন, এইরূপে নানাপ্রকার উৎপীড়নে তিনি ধাত্তরাষ্ট্রদের অপ্রিয় হইয়া উঠিলেন।

 ভীমের বলদর্পে বিশেষভাবে দুর্য্যোধনের মনে অপ্রসন্নতা জন্মিল। ভীমকে বিনাশ করিবার জন্য তিনি মনে মনে এক উপায় স্থির করিলেন। গঙ্গাতীরে শিবির স্থাপন পূর্ব্বক একটি রমণীয় ক্রীড়াস্থান নির্ম্মাণ করাইয়া ভ্রাতাদিগকে বলিলেন, “আইস, আমরা উপবনশােভিত গঙ্গাতীরে গিয়া জলক্রীড়া করি।”

 যুধিষ্ঠির প্রমুখ পাণ্ডবগণ ইহাতে সম্মত হইয়া ক্রীড়াস্থলে উপস্থিত হইলেন। কিছুক্ষণ উদ্যানে ভ্রমণের পর তাঁহাদের আহার আরম্ভ হইল। সেই সুযােগে দুষ্টমতি দুর্য্যোধন ভীমসেনের আহার্য্য মিষ্টান্নে গোপনে বিষ মিশাইয়া দিলেন। অবশেষে আহারের পর তাঁহাদের জলক্রীড়া আরম্ভ হইল।

 সূর্য্য যখন অস্ত গেল সকলে জল হইতে উঠিয়া বিশ্রামে মন দিলেন। কিন্তু এদিকে ভীমসেন যে বিবজর্জ্জর অবশ দেহে গঙ্গাতীরেই পড়িয়া আছেন তাই। দুর্য্যোধন ছাড়া আর কাহারে দৃষ্টিগােচর হইল না। ভীমের এই অবস্থা দেখিয়া হৃষ্টচিত্তে সেই দুরাত্মা তাঁহাকে লতাপাশে বদ্ধ করিয়া জলে নিক্ষেপ করিল।

 নদীতলে নাগলােক আছে, সেখানে ভীম যখন উত্তীর্ণ হইলেন তখন নাগরাজ বাসুকি চিনিতে পারিলেন যে ইনি তাঁহারই দৌহিত্র কুন্তীভোজের দৌহিত্র। তখন ভীমকে তিনি বিষের প্রভাব হইতে মুক্ত করিবার জন্য অমৃতপূর্ণ ভাণ্ড হইতে রসপান করাইলেন। ইহাতে শরীরের সমস্ত ক্লেশ অপহৃত হওয়ায় ভীমসেন নগদত্ত দিব্যশষ্যায় শয়ন করিয়া গভীর নিদ্রামগ্ন হইলেন।

 এদিকে কৌরবেরা রাজধানীতে প্রত্যাগমনকালে দুর্য্যোধন ছাড়া আর সকলেই মনে বলেন ভীম তাঁহাদের অগ্রেই চলিয়া গিয়াছেন। যুধিষ্ঠির মাতার পাদবন্দন করিয়া সর্ব্বাগ্রে ভীমের আগমন সংবাদ জিজ্ঞাসা করিলেন। কুন্তীদেবী চমকিত ও ভীত হইয়া যুধিষ্ঠিরকে কহিলেন, “হায়, ভীমসেনকে ত আমি দেখি নাই, সে ও অগ্রে আসে নাই। অতএব যাও বৎস, অবিলম্বে তাহার সন্ধানে প্রবৃত্ত হও।”

 ভীম অষ্টম দিনে জাগরিত হইয়া গাত্রোথান করলে নাগগণ নিকটে আসিয়া বলিল, “হে মহাবাহো, তুমি যে অমৃত পান করিয়াছ তাহাতে তোমার অযুত গজোপম বল হইবে। এক্ষণে এই দিব্যজলে স্নান করিয়া গৃহে প্রতিগমন করো, তথায় তোমার অদর্শনে তোমার মাতা ও ভাতৃগণ নিতান্ত কাতর হইয়া আছেন।”

 এই উপদেশ অনুসারে ভীম স্নানাবসানে শুক্লমাল্য ও শুক্লাম্বর পরিধানপূর্ব্বক বিগতক্লম হইয়া হৃষ্টচিত্তে নাগগণের পূজা গ্রহণ করিলেন এবং তাঁহাদিগকে আমন্ত্রণ করিয়া নাগলোক হইতে উত্থানপুর্ব্বক অবিলম্বে জননীর নিকট উপস্থিত হইয়া সকলকে যথাযোগ্য অভিবাদন করিলে, পুত্রবৎসলা কুন্তী ও ভ্রাতৃগণ পরমানন্দে তাঁহাকে আলিঙ্গন করিলেন।

 যুধিষ্ঠির ভীমের নিকট সমস্ত বৃত্তান্ত শুনিয়া কহিলেন— ভ্রাতঃ! সাবধান, যেন এ কথা আর কাহারও নিকট প্রকাশ না পায়। অদ্যাবধি পরস্পরের রক্ষার্থে আমাদিগকে বিশেষ যত্নবান্ থাকিতে হইবে।

 একদিন রাজকুমারগণ দলবদ্ধ হইয়া ক্রীড়ামে নগরের বহির্দ্দেশে উপস্থিত হইলেন। ক্রীড়াকালে তাঁহাদের হস্ত হইতে এক গুলিকা জলহীন কূপের মধ্যে পড়িয়া গেল, তাহা উদ্ধার করিবার অনেক চেষ্টা করিয়াও কুমারগণ কিছুতেই কৃতকার্য্য হইলেন না। এই নিমিত্ত দুঃখিত ও লজ্জিত ভাবে তাঁহারা পরস্পরের মুখাবলোকন করিতেছেন, এমন সময়ে দেখিলেন একটি কৃশকায় শ্যামবর্ণ ব্রাহ্মণ সেই স্থান দিয়া চলিয়াছেন। ভগ্নোৎসাহ কুমারগণ তাঁহাকে বেষ্টন করিয়া গুলিকা উদ্ধারের জন্য তাঁহার সাহায্য প্রার্থনা করিলেন।

 ব্রাহ্মণ ঈষৎ হাসিয়া বলিলেন—

 তোমাদের ক্ষত্রিয়-বলে ধিক্! যেহেতু তোমরা ভরতকুলে জন্মগ্রহণ করিয়াও এই সামান্য কূপ হইতে গুলিকা উঠাইতে পারিতেছ না।

 এই বলিয়া তিনি পুনরায় কহিলেন—

 তোমরা যদি আমাকে উত্তমরূপে ভোজন প্রদান কর, তাহা হইলে আমি একমুষ্টি তৃণের সাহায্যে তোমাদের গুলিকা কূপ হইতে বাহির করিব।

 অনন্তর সেই ব্রাহ্মণ একমুষ্টি ঈষিকা গ্রহণ করিয়া প্রথমত একটি ঈষিকার দ্বারা গুলিকা বিদ্ধ করিলেন। পরে আর একটি ঈষিকার দ্বারা পূর্ব্ব ঈষিকা বিদ্ধ করিলেন। এইরূপে ক্রমে একটির দ্বারা অপরটি বিদ্ধ করিয়া এই পরম্পরাযোগে গুলিকা উদ্ধার করিলেন। কুমারগণ বিস্ময়বিস্ফারিতলোচনে এই আশ্চর্য্য কৌশল নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন, এবং গুলিকা পাইয়া তাঁহারা ব্রাহ্মণকে প্রণামপূর্ব্বক কহিলেন—

 হে দ্বিজোত্তম! আপনি কে? অন্য কাহাতেও এরূপ দক্ষতা দেখা যায় না। আপনার কী প্রত্যুপকার করিব অনুমতি করুন।

 ব্রাহ্মণ কহিলেন—তোমরা মহামতি ভীষ্মের নিকট আমার বর্ণনা করিয়ো, তিনি নিশ্চয়ই আমায় চিনিতে পারিবেন।

 ভীষ্ম এই ব্রাহ্মণের পরিচয় পাইয়া তাঁহাকে কহিলেন—হে বিপ্রর্ষে! অনুগ্রহপূর্ব্বক এখানেই অবস্থিতি করুন। আমাদের ভাগ্যবলেই আপনি এ সময়ে উপস্থিত হইয়াছেন। এ রাজ্যের সমস্ত ভোগ্যবস্তু অতঃপর আপনারই অধীন জানিবেন।

 দ্রোণাচার্য্য ভীষ্মকর্ত্তৃক সৎকৃত হইয়া রাজভবনে কিয়ৎকাল বিশ্রাম করিলে, প্রচুর অর্থের সহিত কৌরবকুমারদিগকে তাঁহার হস্তে সমর্পণ এবং তাঁহার বাসের জন্য এক উপযুক্ত গৃহ নির্দ্দেশ করা হইল।

 দ্রোণ শিক্ষাকার্য্য আরম্ভ করিলে সূতপালিত কুন্তীপুত্র বসুসেন (যিনি পরে লোকমধ্যে কর্ণ নামে খ্যাত হইয়াছিলেন) তাঁহার শিষ্যদলভুক্ত হইলেন। সমাগত শিষ্যমণ্ডলীমধ্যে ভুজবলে উদ্যোগে এবং ধনুর্ব্বেদশিক্ষায় অর্জ্জুন ক্রমে আচার্য্যের সমকক্ষ হইয়া উঠিলেন। একমাত্র কর্ণই তাঁহার সহিত স্পর্ধা করিতে সাহস করিতেন।

 অনন্তর শিষ্যগণ প্রত্যেকে সাধ্যমত বিদ্যালাভ করিয়াছেন বিবেচনা করিয়া আচার্য্য এক দিন রাজসভায় উপস্থিত হইয়া সমবেত ভীষ্ম ব্যাস বিদুর কৃপ প্রভৃতির সমক্ষে ধৃতরাষ্ট্রকে বলিলেন-

 মহারাজ! কুমারগণ সকলেই বিবিধ প্রকার অস্ত্রশিক্ষায় কৃতবিদ্য হইয়াছেন, অনুমতি হইলে তাঁহারা এক্ষণে বিদ্যার পরিচয় দিতে পারেন।

 দ্রোণবাক্যে পরম পরিতুষ্ট হইয়া ধৃতরাষ্ট্র বলিলেন—

 হে দ্বিজশ্রেষ্ঠ। আপনি আমাদের এক মহৎ কর্ম্ম সাধন করিলেন। এক্ষণে কিরূপ বঙ্গভূমিতে কুমারদিগের শিক্ষার উত্তমরূপ পরীক্ষা হইতে পারে তাহা আজ্ঞা করুন। অদ্য আমার চক্ষু নাই বলিয়া যথার্থই কষ্টবোধ হইতেছে, যাহা হউক পরীক্ষার বৃত্তান্ত শুনিতে উৎসুক হইয়া রহিলাম।

 এই বলিয়া ধৃতরাষ্ট্র সম্মুখোপবিষ্ট বিদুরক কহিলেন—

 হে ধর্ম্মবৎসল! আচার্য্য দ্রোণ আমাদের পরম উপকার সাধন করিয়াছেন। এক্ষণে তাঁহার উপদেশ অনুসারে অস্ত্রকৌশল পরিদর্শনের উপযুক্ত রঙ্গস্থলের আয়োজন কর!

 বিদুর রাজাজ্ঞা শিরোধারণ করিয়া দ্রোণের প্রিয় অনুসারে অবিলম্বে কার্য্যে প্রবৃত্ত হইলেন। তরুগুল্ম-বিহীন একটি সুপরিচ্ছন্ন সমতল ক্ষেত্রে রঙ্গভূমির সীমা পরিমাপ করা হইল। নির্দ্দিষ্ট ভূমির এক পার্শ্বে রাজশিল্পিগণ অতি বিস্তীর্ণ দর্শনগার ও তাহার মধ্যে মহিলাদের অবলোকনের জন্য সুরমা গৃহসকল প্রস্তুত করিল। পুরবাসীরাও নিজ নিজ সামর্থ্য অনুসারে চতুর্দ্দিকে অত্যুচ্চ মঞ্চ ও মহামূল্য পটবাসসকল স্থাপন ও সুসজ্জিত করিতে লাগিল।

 অনন্তর পরীক্ষার নির্দ্দিষ্ট দিন উপস্থিত হইলে মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র মন্ত্রিগণসহ কৃপাচার্য্য ও ভীষ্মকে সম্মুখীন করিয়া মুক্তাজাল-সমলস্কৃত বৈদুর্য্যমণি-শোভিত সুবর্ণময় এক দর্শনাগারে প্রবিষ্ট হইলেন। মহাভাগা গান্ধারী কুন্তী ও অন্যান্য রাজমহিলাগণ মহামূল্য পরিচ্ছদ পরিধান করিয়া দাসীগণপরিবেষ্টিত শুইয়া নির্দ্দিষ্ট গৃহে গমন করিলেন। রাজধানী হইতে চতুর্ব্বর্ণের নানাবিধ লোক রাজকুমারগণের অস্ত্রশিক্ষা-দর্শনার্থী হইয়া দ্রুত আগমন করিতে লাগিল। ক্রমে বঙ্গস্থলে প্রবেশাখীর আর সংখ্যা রহিল না। অভ্যাগতদের কোলাহলে সে স্থান উচ্ছলিত মহাসমুদ্রের ন্যায় ধ্বনিত হইতে লাগিল।

 নিরূপিত সময় আগত প্রায় হইলে বাদকবৃন্দ মৃদুমন্দ রবে বাদন আরম্ভ করিয়া দর্শকমণ্ডলীর কৌতূহল পরিবর্দ্ধন করিতে লাগিল। ইত্যবসরে শুক্লাম্বরধারী শুক্লশ্মশ্রু শুক্লচন্দনানুলিপ্ত-কলেবর মহাতেজা দ্রোণাচার্য্য পুরু অশ্বত্থামার সহিত রঙ্গমধ্যে প্রবেশ করিয়া পুরোহিতের দ্বারা মাঙ্গলিক ক্রিয়ার অনুষ্ঠান করাইতে লাগিলেন। পুণ্যকর্ম্ম সমাপনান্তে অনুচরবর্গ অস্ত্রশস্ত্র আনয়নপুর্ব্বক যথাস্থানে স্থাপন করিল।

 অনন্তর মহাবীর্য্য রাজপুত্রগণ অঙ্গুলিতে অঙ্গুলিত্র বন্ধনপূর্ব্বক বদ্ধতূণা ও বদ্ধপরিকর হইয়া যুধিষ্ঠিরকে অগ্রে করিয়া জ্যেষ্ঠ কনিষ্ঠক্রমে হস্তে ধনুর্ধারণপূর্ব্বক রঙ্গস্থলে প্রবেশ করিলেন।  প্রথমে কুমারগণ নানাবিধ অস্ত্র নিক্ষেপপূর্ব্বক স্ব স্ব হস্তুলাঘব দেখাইতে লাগিলেন। চতুর্দ্দিকে ক্ষিপ্যমাণ অস্ত্র সকল দেখিয়া অনেকে ভয়ে মস্তক অবনত করিয়া ফেলি। অর্জ্জুনের অদ্ভুত ক্ষমতা সকলেরই দৃষ্টি আকর্ষণ করিতে লাগিল।

 পরে কুমারগণ বেগবান্ তুরঙ্গমে আরোহণপূর্ব্বক কখনও স্বনামাঙ্কিত বাণদ্বারা লক্ষ্যভেদ করিয়া, কখনও বা কার্ম্মুক দ্বারা অস্থির লক্ষ্য পাত করিয়া বিশেষ প্রশংসা করিলেন।

 তৎপরে তাঁহারা রথারোহণপূর্ব্বক পরস্পরকে মণ্ডলাকারে প্রদক্ষিণ করিয়া অশ্বচালনা-কৌশল দেখাইলেন।

 পরে অসিচর্ম্ম ধারণপূর্ব্বক কেহ অশ্বে কেই বা গজে আরূঢ় হইয়া পরস্পর দ্বন্দ্বযুদ্ধ করিলেন। ভ্রাম্যমাণ শাণিত তরবারির রশ্মিজাল চতুর্দ্দিকে বিকীর্ণ হইয়া অপূর্ব্ব শোভা ধারণ করিল। দর্শকমণ্ডলী প্রচুর সাধুবাদ প্রদান করিতে লাগিলেন।

 অনন্তর গদাযুদ্ধ আরম্ভ হইলে ভীম ও দুর্য্যোধনকে পরস্পরকে বামে রাখিয়া মণ্ডলাকারে পরিভ্রমণ করিতে দেখা গেল। দুই তুল্যবীর ভীম ও দুর্য্যোধন পরস্পরের সহিত স্পর্দ্ধাপূর্ব্বক গদাযুদ্ধ আরম্ভ করায় তাঁহাদের প্রতি দর্শকবৃন্দের মনোেযোগ আকৃষ্ট হইল। দুই দল দুই পক্ষ অবলম্বন করিয়া কেহ—হা দুর্য্যোধন! কেই বা হা ভীম! বলিয়া স্ব স্ব পক্ষকে উৎসাহ দান করিয়া মহা কোলাহল বাধাইয়া তুলিল। পাছে ইহাতে উত্তেজনাবশে যোদ্ধাদের ক্রোধের উদ্রেক হয়, সেই নিমিত্ত ধীমান্ দ্রোণ দুই বীরকে নিবারণ করিবার জন্য অশ্বত্থামাকে যুদ্ধস্থলে প্রেরণ করলেন। অশ্বত্থামার চেষ্টায় ভীম ও দুর্য্যোধন নিরস্ত হইলেন।

 অনন্তর দ্রোণ বাদ্যধ্বনি নিবারণপূর্ব্বক রঙ্গপ্রাঙ্গণে দণ্ডায়মান হইয়া কহিলেন—

 হে দর্শকগণ! আমার শিষ্যদের বিদ্যা ও কৌশল তোমাদের নিকট প্রদর্শিত হইল। ইহাদের মধ্যে আমি অর্জ্জুনকেই সর্ব্বশ্রেষ্ট জ্ঞান করি, অতএব তোমরা বিশেষরূপে তাঁহাকে দর্শন কর।

 তখন অর্জ্জুন আচার্য্যের আদেশক্রমে গোসর্প-চর্ম্মের অঙ্গুলি ত্রাণ ও কাঞ্চনময় কবচ পরিধানপূর্ব্বক ধনুর্ব্বাণ লইয়া রঙ্গস্থলে একাকী অবতীর্ণ হইবামাত্র তুমুল শঙ্খধ্বনি ও বাদ্যোদ্যম হইল।

 ইনি শ্রীমান কুন্তীনন্দন!—ইনি তৃতীয় পাণ্ডব!—ইনি দেবরাজ ইন্দ্রদত্ত পুত্র!-ইনি শ্রেষ্ঠ অস্ত্রবেত্তা!-ইনি কৌরবদের রক্ষক হইবেন!—প্রভৃতি প্রশংসাধ্বনি চতুর্দ্দিক হইতে উত্থিত হইতে লাগিল। পুত্রের সুযশ ঘোষণায় কুন্তী অশেষ প্রতি লাভ করিলেন।

 এই সকল মহৎকার্য্য সমাপনান্তে সভা যখন ভগ্নপ্রায়, বাদ্যকোলাহল নিস্তব্ধ এবং দর্শকবৃন্দ নির্গমনোম্মুখ, সেই সময়ে রঙ্গভূমির দ্বারদেশে সহসা কিঞ্চিৎ চঞ্চলতা অনুভূত হইল এবং কোন বীরপুরুষের বাহ্বাস্ফোটন-শব্দ শুনা গেল দ্বারের দিকে সকলের কৌতূহল দৃষ্টি নিক্ষিপ্ত হইল। পঞ্চপাণ্ডবেষ্টিত দ্রোণাচার্য্য দণ্ডায়মান হইয়া সে দিকে নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন।

 দ্বারের নিকটস্থ সকলে পথ মুক্ত করিলে মহাবীর সূতনন্দন কর্ণ সহজাত দিব্য কবচ ও কুণ্ডলে শোভমান হইয়া রঙ্গমধ্যে প্রবেশপূর্ব্বক সগর্ব্বে ইতস্তত দৃষ্টিপাত করিয়া ঈষৎ অবহেলাভরে দ্রোণ ও কৃপ আচার্য্যদ্বয়কে অভিবাদন করিলেন। সভাস্থ সকলে এই সূর্য্যসদৃশ দীপ্তিমান রীরের পরিচয় জানিবার জন্য ব্যগ্র হইয়া উঠিলেন।

 অনন্তর কর্ণ অজ্ঞাতভ্রাতা অর্জ্জুনকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন-

 তুমি মনে করিতেছ একমাত্র তুমিই এই সকল স্তুতির অধিকারী, কিন্তু বিস্মিত হইয়ো না, আমিও এই সমস্ত অদ্ভুত কর্ম্ম সাধন করিব।

 দুর্য্যোধন এতক্ষণ অর্জ্জুনের অজস্র প্রশংসাবাদে অতিশয় ঈর্ষান্বিত হইতেছিলেন, এক্ষণে তাঁহার উপযুক্ত প্রতিপক্ষ উপস্থিত হওয়ায় অনুরূপ হর্ষযুক্ত হইলেন। লোকসমক্ষে রূঢ় বাক্য শ্রবণে অর্জ্জুনের একান্ত লজ্জা ও ক্রোধের উদ্রেক হইল।

 কর্ণ স্বীয় অঙ্গীকার অনুসারে অর্জ্জুনকৃত সমস্ত কার্য্য সুসম্পন্ন করিয়া দর্শকবৃন্দকে চমৎকৃত করিলে দুর্য্যোধন আনন্দের উচ্ছ্বাসে থাকিতে না পারিয়া কর্ণকে আলিঙ্গন পূর্ব্বক কহিলেন হে বীরবর! তােমার অদ্ভুত কৌশল দেখিয়া অদ্য আমরা অত্যন্ত প্রীত হইলাম।

 কর্ণ বলিলেন—প্রভো! বােধ করি আমি অর্জ্জুনকৃত সর্ব্বপ্রকার কার্য্যই সম্পাদন করিয়াছি, এক্ষণে দ্বন্দ্বযুদ্ধ করিয়া অর্জ্জুনের শ্রেষ্ঠত্বের প্রকৃত পরীক্ষা করিতে ইচ্ছা করি।

 কর্ণের স্পর্ধায় ও দুর্য্যোধনের অনুমোদনে অর্জ্জুনের রোষের আর সীমা রহিল না। তিনি কর্ণকে সাম্মোধনপূর্ব্বক দুর্য্যোধনকে উদ্দেশ করিয়া বলিলেন-

 হে সূতপুত্র! যাহারা অনাহূত সমক্ষে উপস্থিত হয়, এবং অযাচিত বাক্যবিন্যস করে, তাহারা যে-লোকে গমন করে, অদ্য আমার হস্তে প্রাণ ত্যাগ করিয়া তুমি সেই লােকে গমন করিব;

 কর্ণ উত্তর করিলেন—

 হে অর্জ্জুন! এই রঙ্গভূমি যােদ্ধা মাত্রেইর অধিকৃত, ইহাতে কাহাকেও আহ্বান বা নিবারণ করা সম্বন্ধে তোমার কোনাে প্রভূতা নাই।

 অনন্তর অর্জ্জুন দ্রোণের অনুমতি প্রাপ্ত হইয়া এবং ভ্রাতৃগণকর্ত্তৃক উৎসাহিত হইয়া যুদ্ধার্থে কর্ণের দিকে অগ্রসর হইলেন।

 সভাস্থ সকলেই মনে মনে দুই দলে বিভক্ত হইয়া পাড়লেন, দ্রোণ কৃপ ও পাণ্ডবভ্রাতৃগণ অর্জ্জুনের পক্ষ এবং ধার্ত্তরাষ্ট্র শতভ্রাতা ও অশ্বত্থামা কর্ণের পক্ষ লইলেন।

 দুই পুত্রের মধ্যে আসন্ন সাঙ্ঘাতিক যুদ্ধসম্ভাবনায় কুন্তী মনের আবেগে একেবারে সংজ্ঞাহীন হইয়া পড়িলেন। কুশলী কৃপাচার্য্য সমূহ বিপদ্‌ বুঝিয়া যুদ্ধনিবারণ-কামনায় কর্ণকে বলিলেন-

 হে বসুসেন! অজ্ঞাতকুলশীল ব্যক্তির সহিত রাজকুমারের ত যুদ্ধ করিবার নিয়ম নাই। তোমাকে সকলে সূতপালিত বলিয়াই জানে, সূতপুত্রের সহিত রাজপুত্র কি প্রকারে যুদ্ধ করিবেন? তবে হে মহাবাহো! তুমি যদি তোমার প্রকৃত পিতামাতার নামোল্লেখপূর্ব্বক কোন রাজ বংশকে তুমি অলঙ্কৃত করিয়াছ তাহা আমাদের নিকট জ্ঞাপন কর, তাহা হইলে পাণ্ডুনন্দন অর্জ্জুন অনায়াসেই তোমার প্রতিযোদ্ধা হইতে পারেন।

 এইরূপে অভিহিত হইলে কর্ণ স্বীয় কুলশীল না জানায় লজ্জায় অধোবদন হইয়? রহিলেন। দুর্য্যোধন স্বীয় শরণাগত বীরের অবমাননা সহ্য করিতে না পারিয়া উত্তর প্রদান করিলেন—

 হে আচার্য্য! আমি ত জানিতাম যে, বীরের সহিত বীরমাত্রই যুদ্ধের অধিকারী। যাহা হউক অর্জ্জুন যদি রাজা ব্যতীত অন্যের সহিত যুদ্ধ না করেন, তবে আমি এইক্ষণেই বসুসেনকে অঙ্গরাজ্যে অভিষিক্ত করিতেছি।

 এই বলিয়া তিনি তৎক্ষণাৎ সুবর্ণপীঠ আনয়নপূর্ব্বক তদুপরি কর্ণকে উপবিষ্ট করাইয়া, মন্ত্রবিদ্‌ ব্রাহ্মণগণকে আহবানপূর্ব্বক লাজ কুসুম ও সুবর্ণদ্বারা তাঁহাকে যথাবিধি অঙ্গরাজ্যে অভিষিক্ত করলেন।  দারুণ অবমাননাকালে এইরূপে মর্য্যাদা রক্ষা হওয়ায় কর্ণ দুর্য্যোধনের প্রতি যৎপরোনাস্তি কৃতজ্ঞ হইলেন। তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া বলিলেন-

 মহারাজ! রাজাদানের অনুরূপ তোমার কোনো প্রত্যুপকার করিবার আমার সাধ্য নাই। তবে আমার সাধ্য অনুসারে যাহা বলিবে, আমি তাহাই করিতে প্রস্তুত আছি।

 দুর্য্যোধন প্রীতিসহকারে কহিলেন—

 হে অঙ্গরাজ! এক্ষণে তোমার সহিত চিরসখ্য স্থাপন করিবার ইচ্ছা করি।

 কর্ণ তথাস্তু, বলিয়া তাহা স্বীকার করলেন এবং যাবজ্জীবন ক্ষণকালের নিমিত্তও এ প্রতিজ্ঞার তিনি অন্যথাচরণ করেন নাই।

 এই সময়ে রাজ-সূত অধিরথ, অর্জ্জুনের সহিত কর্ণের বিবাদের কথা শ্রবণ করিয়া যুদ্ধ নিবারণ উদ্দেশে ঘর্ম্মাক্তকলেবর ও স্খলিতোত্তরচ্ছদ হইয়া সহসা রঙ্গমধ্যে প্রবেশ করিলেন। মহাবীর কর্ণ পিতৃতুল্য সারথির গৌরব-রক্ষার্থ শরাসন পরিত্যাগপূর্ব্বক তাহাকে সভাস্থ সকলের সমক্ষে প্রণাম করিলেন। অধিরথ কর্ণকে অক্ষত দেখিয়া আনন্দ ভরে তাঁহাকে পুত্রসম্বোধনপূব্বক তাঁহার অভিষেক মস্তক পুনর্ব্বার আনন্দাশ্রুপাতে অভিষিক্ত করিলেন।

 ইহা অবলোকন করিয়া ভীমসেন বিদ্রূপবাক্যে কহিলেন-

 হ সূতনন্দন! যুদ্ধক্ষেত্রে অর্জ্জুনের মত বীরের হস্তে প্রাণ বিসর্জ্জন করিতে শসা তোমার পক্ষে সুযুক্তির কার্য্য হয়  নাই। কুক্কুর যেমন যজ্ঞীয় হবি সেবনের অনুপযুক্ত, তোমাকে তেমনি অঙ্গরাজ্য শোভা পায় না। তোমার পক্ষে কুলোচিত বল্পা-গ্রহণই শ্রেয়স্কর।

 এই উদ্ধতবাক্যে কর্ণ ক্রোধে অধীর হইলেন, তাঁহার অধর কম্পিত হইতে লাগিল, কিন্তু বহুকষ্টে অত্মসম্বরণপূর্ব্বক তিনি অস্তাচলগামী সূর্য্যকে এক দৃষ্টে নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন। কিন্তু অসহিষ্ণু দুর্য্যোধন ভীমের শ্লেষ বাক্যে সহসা উখিত হইয়া কহিলেন-

 হে ভীম, এ অশিষ্ট উক্তি তোমার উপযুক্ত হয় নাই। ক্ষত্রিয়দের বলাই শ্রেষ্ঠ। যিনি নিজ ভুজবলে সমস্ত পৃথিবী জয় করিতে সমর্থ, তাঁহার পক্ষে অঙ্গরাজ্য তো সামান্য। বসুসেন যেরূপ সহজ ও কুণ্ডল ও কবচে শোভমান, তাহাতে তিনি সামান্য বংশসম্ভূত নহেন বলিয়া বিলক্ষণ প্রত্যয় হয়। যাহা হউক বসুসেনের অঙ্গরাজ্যপ্রাপ্তি-সম্বন্ধে যাঁহার বিদ্বেষ থাকে, তিনি আমার সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হউন।

 এই বাক্যে সভাস্থ অনেকে ধন্য ধন্য করিল।

 এই সময়ে সূর্য্যাস্ত হওয়ায় সেদিনকার অস্ত্রপরীক্ষাব্যাপার সমাধা হইল। দুর্য্যোধন কর্ণের সম্ভধারণপূর্ব্বক রণস্থল হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলেন। পাণ্ডবগণ দ্রোণ ও ভীষ্মের সহিত স্ব স্ব গৃহে গমন করিলেন। সভাভঙ্গ হইলে পৌরগণ কে অর্জ্জুনের, কে কর্ণের, কেহ দুর্য্যোধনের প্রশংসা করিতে করিতে প্রস্থান করিল।