কুরু পাণ্ডব/২
২
এদিকে পৌরগণ পাণ্ডবদিগকে অশেষগুণসম্পন্ন দেখিয়া সর্ব্বদাই তাহাদের গুণকীর্ত্তন করিত। যেখানে জনকতক একত্র হইত, সেখানেই পাণ্ডবদের রাজাপ্রাপ্তিসম্বন্ধে আলোচনা হইত।
এই সকল কথোপকথন ক্রমে দুর্য্যোধনের কর্ণগোচর হওয়ায় তিনি যৎপরোনাস্তি ক্ষুব্ধ ও ঈর্য্যান্বিত হইলেন এবং সস্থর ধৃতরাষ্ট্রের নিকট উপস্থিত হইয়া বলিলেন—
হে পিতঃ! পৌরগণ আপনাকে ও ভীষ্মকে অতিক্রম করিয়া যুধিষ্ঠিরকে রাজ্য দিবার পরামর্শ করিতেছে। শুনিতে পাই ইহাতে রাজ্যপরাঙ্মুখ ভীষ্মেরও সম্মতি আছে। এ বিষয়ে উদাসীন থাকিলে আর নিস্তার নাই।
পুত্রের কাতরাক্তি শ্রবণে ধৃতরাষ্ট্র দোলাচলচিত্ত হইলেন, কিন্তু তথাপি অধর্ম্মভীতিনিবন্ধন কোনো কার্য্য করিলেন না।
কিন্তু দুর্য্যোধন নিশ্চিন্ত রহিলেন না। তিনি বন্ধু কর্ণ ও মাতুল শকুনির সহিত মন্ত্রণা করিয়া পুনরায় ধৃতরাষ্ট্রের নিকট আসিয়া বলিলে-
হে তাত! আপনি পাণ্ডবগণকে কোনো সুনিপুণ উপায়ে কিয়ৎকালের নিমিত্ত বারণাবৎ নগরে প্রেরণ করুন। এক্ষণে সমুদায় ধন ও অমাত্যবর্গ আমারই অধীন, আমি ইত্যবসরে উপযুক্ত উপায়ে পৌরগণকে বশীভূত করিয়া সাম্রাজ্য হস্তগত করিলে পর অনায়াসে আশঙ্কাশূন্য হইয়া তাঁহাদিগকে ফিরাইয়া আনিতে পারেন।
ধৃতরাষ্ট্র এই সকল যুক্তি সর্ব্বদাই অন্তঃকরণে আলােচনা করিতে লাগিলেন। দুর্যোধনও কার্য্যসিদ্ধি উপলক্ষ্যে প্রজাবৰ্গকে ধন মান দ্বারা বশীভূত করিতে যত্নবান্ হইলেন। অবস্থা যখন অনুকূল বিবেচিত হইল, তখন একদিন পূর্ব্বপরামর্শ অনুসারে মন্ত্রণাকুশল জনৈক অমাত্য রাজসভায় সকলের উপস্থিতিতে বলিতে লাগিলেন—
বারণাবৎ নগর অতি বৃহৎ ও পরম রমণীয় স্থান। তথায় ভগবান্ ভবানীপতি প্রতিষ্ঠিত আছেন, এই সময়ে তাঁহার পূজনার্থে নানা দিশে হইতে জনসমাগম হইবে।
এই প্রশংসাবাক্য শুনিয়া বারণাবৎ নগর দর্শন করিবার ইচ্ছা পাণ্ডবদের মনে উদয় হইল। ধৃতরাষ্ট্র তাঁহাদের কৌতূহলের উদ্রেক বুঝিতে পারিয়া দুর্যোধনের প্রীতিসাধনমানসে প্রবৃত্ত হইয়াও অধর্ম্মভয়ে সঙ্কুচিত হইয়া কুণ্ঠিতান্তঃকরণে তাঁহাদিগকে উৎসাহ করিয়া বলিলেন–বৎসগণ, সকলেই আমার নিকট বারণাবতের প্রশংসা করে, অতএব ইচ্ছা হয় ত কিছুদিন তথায় কালযাপন করিয়া আসিতে পার।
ধীমান্ যুধিষ্ঠির ধৃতরাষ্ট্রের ভাবে কোনো একটা দুরভিসন্ধির সন্দেই করিলেন, কিন্তু নিজেকে নিরুপায় বােধে “তথাস্তু” বলিয়া তাহা স্বীকার করলেন।
এই ঘটনায় দুর্য্যোধনের আনন্দের সীমা রহিল না। তিনি ইতিপূর্ব্বেই ধৃতরাষ্ট্রের অজ্ঞাতসারে এক অতি ঘোর পাপাভিসন্ধি মনে পোষণ করিতেছিলেন, তাহা এক্ষণে কার্য্যে পরিণত করিবার সুযোগ পাইলেন। পুরোচননামা এক দুর্ম্মতি সচিবকে আহ্বান করিয়া দুর্য্যোধন তাহাকে কহিতে লাগিলেন—
হে পুরোচন! পাণ্ডবগণ পাশুপত-উৎসবে বিহারার্থ বারণাবৎ নগরে গমন করিবেন। তুমি দ্রুতগামী অশ্বতরযোজিত রথে অদ্যই তথায় গমন কর। নগরের প্রান্তদেশে শন সর্জ্জরস জতুকাষ্ঠ প্রভৃতি যাবতীয় অগ্নিভোজ্য দ্রব্যদ্বারা একটি সুদর্শন চতুঃশালাগৃহ নির্ম্মাণ করাইবে। মৃত্তিকায় প্রচুর পরিমাণে তৈল ও লাক্ষাদি সংযোগ করিয়া তাহা দ্বারা ঐ গৃহের ভিত্তি লেপন করাইবে। চতুর্দ্দিকে বিবিধ আগ্নেয় দ্রব্য গুপ্তভাবে রক্ষা করিবে। পাগুবের বারণাবতে উপস্থিত হইলে সুযোগ বূঝিয়া পরম সমাদরে তাহাদিগকে তথায় বাস করিবার জন্য অভ্যর্থনা করিবে। এবং দিব্য আসনযান ও শয্যা প্রদানে পরিতুষ্ট করিবে। কিছুকাল পর তাঁহারা আশ্বস্তচিত্তে তথায় বাস করিতে আরম্ভ করিলে রাত্রিকালে ঐ গৃহে অগ্নিসংযোগপূর্ব্বক উহাদিগকে ধ্বংস করিবে। সাবধান, যেন পিতা এবং পুরবাসিগণ ইহাকে অকস্মাৎ অগ্নি বলিয়া মনে করেন—যেন পাণ্ডববধ-জনিত কলঙ্ক আমাদিগকে স্পর্শ না করে।
পাপাত্মা পুরোচন এই কথায় সম্মত হইয়া তৎক্ষণাৎ দ্রুতগমনে বারণাবতে উপস্থিত হইয়া জতুগৃহ নির্মাণ কার্য্য আরম্ভ করিল।
অনন্তর শুভদিবসে পাণ্ডবদের যাত্রার জন্য বায়ুবেগগামী সদশ্বযুক্ত রথ প্রস্তুত হইল। তাঁহারা মাতৃগণকে প্রদক্ষিণপূর্ব্বক তাঁহাদের নিকট বিদায় লইলেন এবং প্রজাগণকে বিনয়নম্র-বচনে সাদরসম্ভাষণ করিয়া রথারোহণপূর্ব্বক যাত্রা আরম্ভ করিলেন।
অনন্তর অষ্টম দিবসে মাতৃসহ পাণ্ডবগণ বারণাবতে উপস্থিত হইলেন।
পুরোচন তাঁহাদের সেবার্থে অত্যুৎকৃষ্ট ভক্ষ্য, পেয়, আসন ও শয্যা-প্রভৃতি সকল প্রকার রাজভােগ্য দ্রব্য রাখিয়াছিল। সেই দুরাত্মাকর্তৃক সৎকৃত ও প্রজাগণদ্বারা পূজিত হইয়া পাণ্ডবগণ দশদিন ঐ স্থানে অবস্থান করিলেন।
একাদশ দিবসে পুরোচন স্বীয় গর্হিত অভিসন্ধিসিদ্ধির নিমিত্ত তাঁহাদিগকে সাদরনিমন্ত্রণে জতুগৃহে বাসার্থে লইয়া গেল।
গৃহে প্রবেশ করিয়াই যুধিষ্ঠির ভীমকে বলিলেন–
ভ্রাতঃ! আমি নিঃসন্দেহ এই গৃহে ঘৃত ও জতুমিশ্রিত বসাগন্ধ পাইতেছি। এই দেখ কোনাে নিপুণ শিল্পী ঘৃৃতাক্ত মঞ্জু বল্লজ ও বংশপ্রভৃতি আগ্নেয় দ্রব্যসমূহে এই গৃহ নির্ম্মাণ করিয়াছে। অহো। দুর্যোধনের কি ক্রূর অভিপ্রায়! আমি এক্ষণে প্রত্যক্ষবৎ উহার সমস্ত কৌশল অবগত হইতেছি। সে পুরােচনের দ্বারা আমাদিগকে এই গৃহের সহিত দগ্ধ করিবার সঙ্কল্প করিয়াছে!
ভীম স্তম্ভিতের ন্যায় এই সকল যুক্তি শুনিয়া কহিলেন–
হে আর্য্য। যদি এই গৃহ স্পষ্টই আগ্নেয় বলিয়া বোধ হয়, তবে আর এখানে কালবিলম্ব করিবার কি প্রয়োজন? চল, আমরা যেখানে ছিলাম সেখানেই ফিরিয়া যাই।
যুধিষ্ঠির কহিলেন—হে বৃকোদর! বিবেচনা করিয়া দেখিলে আমাদের এখানেই বাস করা কর্ত্তব্য। নরাধম পুরোচন যদি বুঝিতে পারে যে, আমাদের মনে সন্দেহ জন্মিয়াছে, তাহা হইলে সে আমাদিগকে তদ্দণ্ডে দগ্ধ করিবে, কারণ সে দুর্ম্মতির অধর্ম্ম বা লোকনিন্দা কিছুরই ভয় নাই। এই জতুগৃহের মধ্যে বিবর খনন করিয়া রাত্রিকালে গোপনভাবে সেখানে বাস করিলে অগ্নি হইতে আর আমাদের কোনো ভয় থাকিবে না।
এই সময়ে বিদুর প্রেরিত এক বিশ্বাসী ব্যক্তি পাণ্ডবদের নিকট আসিয়া নিবেদন করিল—
হে মহাত্মগণ! আমি খমক, আপনাদের পরমহিতৈষী পিতৃব্য আমাকে প্রেরণ করিয়াছেন। দুর্যোধনের আদেশে কোনো কৃষ্ণপক্ষীয় চতুর্দ্দশীর রাত্রে পুরোচন এই গৃহে অগ্নি প্রয়োগ করিবে, এ কথা তিনি অবগত হইয়াছেন।
যুধিষ্ঠির কহিলেন—হে খনক! তোমাকে যখন আমাদের পরম-হিতাকাঙক্ষী পিতৃব্য পাঠাইয়াছেন, তখন তোমাকেও আমাদের সুহৃদ্ বলিয়া জানিলাম।
খনক সেই গৃহমধ্যে এক মহাগর্ত্ত প্রস্তুত করিয়া তাহা হইতে বহির্গমনের এক সুরঙ্গ পথ নির্ম্মাণ করিল। যাহাতে গৃহে কেহ আসিলেও ইহা বুঝিতে না পারে, এই নিমিত্ত গর্ত্তের মুখ এক কবাটদ্বারা বন্ধ করা হইল। পুৱোচনকে বঞ্চনা করিবার জন্য দিবাভাগে পাণ্ডবগণ বিশ্বস্তের ন্যায় ইতস্তত মৃগয়া করিয়া বেড়াইতেন। রাত্রিকালে খনক-নির্ম্মিত গহ্বরে অতি সতর্কতার সহিত শয়ন করিতেন।
এইরূপে সম্বৎসরকাল কাটিয়া গেলে পুরোচন পাণ্ডবদিগকে একান্ত বিশ্বস্ত জ্ঞান করিয়া কার্য্য সুসিদ্ধ হইবার আশায় উৎফুল্ল হইয়া উঠিল। তাহাকে হৃষ্টচিত্ত দেখিয়া যুধিষ্ঠির ভ্রাতাদিগকে বলিলেন—
দুরাত্মা পুরোচন আমাদিগকে বিশ্বস্তবোধে পরিতুষ্ট হইয়াছে। এই আমাদের পলায়নের উপযুক্ত সময়। পুরোচনের দ্বারা অগ্নিসংযোগের অপেক্ষা না করিয়া আইস, আমরাই জতুগৃহ দাহপূর্ব্বক সুরঙ্গপথ অবলম্বনে অলক্ষিতভাবে পলায়ন করি।
অনন্তর ঘোর তিমিরাবৃত রাত্রিকাল উপস্থিত হইল। পাণ্ডবগণ সকলকে নিদ্রিত ও অসন্দিগ্ধ জানিয়া পলায়নের উদ্যোগ করিলেন। ভীম নিঃশব্দ পদবিক্ষেপে পূর্ব্বপরামর্শ অনুসারে অগ্রে পুরোচন-অধিকৃত আয়ুধাগারে, পরে জতুগৃহের দ্বারে এবং চতুর্দ্দিকের প্রাচীরে দ্রুত অগ্নিপ্রদান করিলে সকলে মিলিয়া বহুকষ্টে সুরঙ্গপথ অবলম্বনে নির্জন বনমধ্যে নিষ্ক্রান্ত হইলেন।
অগ্নির উত্তাপ ও শব্দ প্রবল হইয়া উঠিলে জাগ্রত পুরবাসিসকল চতুর্দ্দিক হইতে ধাবমান হইল। পাণ্ডবদিগের জ্বলন্ত আবাসস্থানকে সুস্পষ্টরূপে আগ্নেয়দ্রব্য-নির্ম্মিত বুঝিতে পারিয়া তাহারা বিস্তর বিলাপ পরিতাপ করিতে করিতে বলিতে লাগিল–
অহো! ইহা নিশ্চয়ই কুরুকুলকলঙ্ক, দুর্য্যোধনের কার্য্য। তাহারই আদেশে পুরোচন এই গৃহ নির্মাণ করাইয়া তাহার অসদভিপ্রায় সিদ্ধ করিয়াছে। কিন্তু ধর্ম্মের কি অনির্ব্বচনীয় মহিমা। দেখ সে নরাধমের গৃহেও অগ্নি লাগিয়া সে দগ্ধ হইতেছে। দহ্যমান জতুগৃহের চতুর্দ্দিকে পৌরজন সমস্ত রাত্রি এরূপ বিলাপ করিতে লাগিল।
ইত্যবসরে মাতাকে লইয়া পঞ্চপাণ্ডব দ্রুতগমনে নিরাপদ স্থানে উত্তীর্ণ হইবার বিশেষ যত্ন করিলেন। কিন্তু রাত্রিজাগরণ ও দাহভয়ে পরিশ্রান্ত হইয়া সকলেই পদে পদে স্খলিত হইতে লাগিলেন। তখন একাকী ভীমসেন কাহাকেও স্কন্ধে কাহাকেও ক্রোড়ে লইয়া এবং কাহারও বা হস্তধারণপূর্বক নির্ভর দান করিয়া চলিলেন।
হস্তিনাপুরে–পাণ্ডবদের বিনাশাবার্ত্তায় সকলে পাণ্ডব-নির্বাসনের প্রকৃত অর্থ বুঝিয়া ঘোর শােকাকুল হইলেন। কিন্তু দুর্য্যোধনের চতুরতায় ইতিমধ্যে পৌরবর্গ বশীভূত হওয়ায় কেহ কিছু করিতে পারিলেন না।
ওদিকে দুর্য্যোধনের ভয়ে প্রচ্ছন্নবেশ ধারণপূর্বক পাণ্ডবগণ নক্ষত্রদ্বারা দিঙ্নিরূপণ করিয়া স্থলপথে ক্রমাগত দক্ষিণদিকে গমন করিতে লাগিলেন। ভীম পূর্ব্ববৎ সকলকে আশ্রয়দানপূর্বক উচ্চনীচ স্থলে মাতাকে পৃষ্ঠে বহন করিতে লাগিলেন।
ক্রমে এক ফলমূলজল-বিহীন হিংস্রজন্তুসমাকুল মহারণ্যের মধ্যে ঘোর অন্ধকারময় সন্ধ্যা সমাগত হইল। দারুণ পশুপক্ষীরব চতুর্দ্দিকে শ্রুত হইল, ভীষণ শব্দকারী বায়ু প্রবাহিত হইতে লাগিল। কুমারগণ নিদ্রাবেশে জড়তাক্রান্ত এবং ক্ষুধায় কাতর হওয়ায় চলৎশক্তিরহিতপ্রায় হইলেন। তৃষ্ণাতুরা কুন্তী বিলাপ করিতে লাগিলেন—
হায়! আমি পঞ্চপাণ্ডবের জননী হইয়া এবং পুত্রগণের মধ্যে থাকিয়া পিপাসায় কাতর হইলাম।
কোমলহৃদয় ভীমসেন ইহা সহ্য করিতে না পারিয়া চতুর্দ্দিকে বিহ্বল দৃষ্টিপাতে ইতস্তত ভ্রমণ করিয়া নির্জ্জন বনমধ্যে এক বিপুলচ্ছায় রমণীয় বটবিটপী দেখিতে পাইলেন। সকলকে তথায় বিশ্রামার্থ উপবেশন করাইয়া তিনি যুধিষ্ঠিরকে কহিলেন—
হে আর্য্য! তোমরা এখানে ক্লান্তি দূর কর, আমি জল অন্বেষণ করি। দূরে সারসধ্বনি শুনা যাইতেছে, ঐ স্থানে নিশ্চয়ই জলাশয় আছে।
জ্যেষ্ঠ অনুমতি প্রদান করিলে ভীম দ্রুতগতিতে সেই জলচর পক্ষীর শব্দ অনুসরণ করিয়া এক জলাশয়ে উপনীত হইলেন। অবগাহন ও জলপানে বিগতক্লেশ হইয়া উত্তরীয় বসনে মাতা ও ভ্রাতাদের জন্য জল বহন করিয়া তিনি অতি ত্বরায় সমাগত হইলেন। আসিয়া দেখিলেন, তাঁহারা ইতিমধ্যেই একান্ত শ্রান্তিভরে ধরণীতলে শয়ন করিয়া নিদ্রাভিভূত হইয়াছেন। প্রিয়তমদের এই অবস্থা দর্শনে ভীমের শোকের আর পরিসীমা রহিল না। তিনি ভাবিলেন—
এই বনের অনতিদূরে নগর আছে বলিয়া অনুমান হইতেছে, এখানে এরূপ বিশ্বস্তচিত্তে নিদ্রামগ্ন থাকা অকর্ত্তব্য। কিন্তু ইহারা নিতান্ত পরিশ্রান্ত, অতএব ইহাদের নিদ্রার ব্যাঘাত না করিয়া আমি একাকী সতর্কভাবে জাগরণ করি।
এইরূপ স্থির করিয়া ভীম উহাদের পানার্থ জল রক্ষা করিয়া স্বয়ং জাগ্রত রহিলেন।
এই স্থানের নিকটবর্তী শালবৃক্ষে মেঘের ন্যায় কৃষ্ণবর্ণ ভীষণাকৃতি হিড়িম্বনামে এক নরমাংসাশী রাক্ষস বাস করিত। বহুদিবসাবধি ক্ষুধার্ত্ত থাকায় সে মনুষ্যগন্ধঘ্রাণে সাতিশয় লুব্ধ হইয়া স্বীয় ভগিনী হিড়িম্বাকে আহ্বান করিয়া বলিল—
আজ বহুদিন পর সুকোমল মনুষ্য-মাংসে দশন নিমগ্ন করিয়া উষ্ণরুধির গান করিবার সুযোগ উপস্থিত। তুমি শীঘ্র ঐ বৃক্ষতলস্থিত মনুষ্যদিগকে বধ করিয়া আনয়ন কর, আমরা দুইজন উদর পূরণপূর্ব্বক পরমানন্দে নৃত্য করিব।
হিড়িম্বা রাক্ষসী ভ্রাতৃবাক্য শ্রবণে সত্বর পাণ্ডবগণের নিকট আসিয়া ভীমসেনকে নিদ্রিত মাতা ও ভ্রাতৃবর্গের প্রহরীরূপে জাগ্রত দেখিল। বিশালবক্ষ মহাবল ভীমসেনের যৌবনকান্তি অবলোকনে রাক্ষসী তাঁহাকে পতিত্বে বরণ করিতে অভিলাষিণী হইল এবং দিব্যাভরণবেশ ধারণপূর্বক মৃদুমন্দগমনে ভীমের নিকট আসিয়া তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিল—
হে পুরুষশ্রেষ্ঠ! তুমি কে? এই দেবরূপী পুরুষগণ এবং এই সুকুমারী রমণীই বা কি সাহসে নিদ্রিত আছেন? তোমরা কি জান না যে, এ স্থান আমার ভ্রাতা হিড়িম্বনামক রাক্ষসের অধিকৃত? সে তোমাদের মাংসভোজনে ও রুধির পানে লোলুপ হইয়া আমাকে পাঠাইয়াছে, কিন্তু হে মহাবাহো! আমি তোমার রূপলাবণ্যে মুগ্ধ হইয়া ভ্রাতৃবাক্য পালনে অসমর্থ হইয়াছি।
ভীমসেন হিড়িম্বার কথা শ্রবণে বলিলেন—
হে রাক্ষসি! আমি কি মোর দুরাত্মা ভ্রাতাকে ভয় করি? আমি একাকী সকলকে তাহার হস্ত হইতে রক্ষা করিতে সক্ষম, অতএব তুমি ইচ্ছা হয় থাক, ইচ্ছা হয় গিয়া তোমার ভ্রাতাকে পাঠাইয়া দাও, আমি ইহাদিগকে পরিত্যাগ করিতে সম্মত নহি।
এদিকে হিড়িম্ব ভগিনীর বিলম্বে অস্থির হইয়া স্বয়ং পাণ্ডবদের দিকে অগ্রসর হইতে লাগিল। হিড়িম্বা তদ্দৃষ্টে ভীত হইয়া ভীমকে ব্যগ্রস্বরে বলিল—
হে মহাত্মন্! ঐ দেখুন আমার সহোদর ক্রূদ্ধ হইয়া এদিকে আসিতেছে, এবার আর নিস্তার নাই। দাসীর বাক্য গ্রহণ করুন, আপনার আদেশ পাইলে আমি সকলকে উত্তোলনপূর্ব্বক আকাশে উড্ডীন হই।
ভীমসেন রাক্ষসকে বাহুপ্রসারণপূর্ব্বক সম্মুখাগত দেখিয়া ভ্রাতাগণের নিদ্রাভঙ্গের ভয়ে তাহার হস্ত ধরিয়া অষ্টধনু পরিমাণ স্থানান্তরে তাহাকে আকর্ষণ করিলেন। ভীমের বলদর্শনে বিস্মিত হইয়া সবলে তাঁহাকে ধারণপূর্ব্বক গর্জন করিতে লাগিল। তখন উভয়ে মত্তমাতঙ্গের ন্যায় বিক্রম প্রকাশপূর্ব্বক পরস্পরকে নিষ্পেষণ করিতে লাগিল।
তাহাদের ভীষণ গর্জ্জনে মাতৃসহ পাণ্ডবগণ জাগরিত হইয়া সম্মুখে উপস্থিত হিড়িম্বার মনোহর রমণী-মূর্তি দেখিয়া বিস্ময়াপন্ন হইলেন। কুন্তী সুমধুরস্বরে জিজ্ঞাসা করিলেন—
হে বরবর্ণিনি! তুমি কে, কি অভিপ্রায়ে এখানে আসিয়াছ?
হিড়িম্বা কহিল—হে দেবি! এই যে গগনস্পর্শী বৃক্ষসমাকুল শ্যামল অরণ্যানী দেখিতেছ, ইহা আমার সহোদর রাক্ষসেন্দ্র হিড়িম্বের বাসস্থান। এই রাক্ষসরাজ তোমাকে ও তোমার পুত্রদিগকে সংহার করিবার নিমিত্ত আমাকে এখানে প্রেরণ করিয়াছিল, কিন্তু হে শুভে! আমি তোমার তপ্ত-কাঞ্চন-সদৃশ-কলেবর পুত্রকে দেখিয়া বিমোহিত হইয়াছি। আমি তোমাদের রক্ষার্থে সকলকে লইয়া পলায়ন করিবার প্রস্তাব করিয়াছিলাম, কিন্তু তাহাতে তোমার পুত্র সম্মত হইলেন না। এক্ষণে আমার ভ্রাতার সহিত তোমার সেই পুত্রের ঘোরতর দ্বন্দ্বযুদ্ধ হইতেছে।
হিড়িম্বার এই কথা শুনিবামাত্র যুধিষ্ঠির অর্জ্জুন নকুল ও সহদেব তৎক্ষণাৎ ভীমসমীপে উপস্থিত হইলেন। তাঁহাকে দীর্ঘযুদ্ধে কিছু ক্লান্ত দেখিয়া উত্তেজনার্থ অর্জ্জুন বলিলেন—
হে আর্য্য! তোমার যদি শ্রান্তিবোধ হইয়া থাকে, ত বল, আমি তোমার সহায়তা করি।
ভীম ইহাতে দ্বিগুণ রোষাবিষ্ট হইয়া বলিলেন—
তোমরা ভীত হইও না, আমি একাকী এই বনকে এ রাক্ষসের পাপাচরণ হইতে মুক্ত করিব।
এই বলিয়া ভীম পূর্ণ বলপ্রয়োগে হিড়িম্বকে ভূমি হইতে উত্তোলনপূর্ব্বক চতুর্দ্দিকে বিঘূর্ণিত করিয়া তাহাকে পুনরায় ভূমিতে নিক্ষেপ ও পশুবৎ বধ করিলেন। ভ্রাতৃগণ পরম পরিতুষ্ট মনে ভীমকে আলিঙ্গনপূর্ব্বক ধন্যবাদ প্রদান করিলেন।
অনন্তর পাণ্ডবগণ পুনরায় চলিতে আরম্ভ করিলে হিড়িম্বা তাঁহাদের সঙ্গ লইল। ইহাতে ভীম কিঞ্চিৎ রুষ্ট হইয়া বলিলেন—
হে রাক্ষসি! তোমরা মায়ার দ্বারা সর্ব্বদাই মনুষ্যদিগকে ছলনা করিয়া থাক, অতএব তোমার আমাদের সঙ্গে আসিবার কোন প্রয়োজন নাই।
এইরূপ প্রত্যাখ্যানে দুঃখিত হইয়া হিড়িম্বা কুন্তীর শরণাগত হইয়া কহিল—
মাতঃ! আপনি আমার প্রতি অনুকম্পা প্রদর্শনপূর্ব্বক ভীমসেনকে আমার সহিত বিবাহে অনুমতি প্রদান করুন, আমি তাহার সহিত যথেচ্ছ ভ্রমণ করিয়া পুনরায় তাঁহাকে আপনাদের নিকট ফিরাইয়া আনিব।
যুধিষ্ঠির ইহা শুনিয়া বলিলেন—
হে সুমধ্যমে! তোমার অভিলাষ পূর্ণ হউক। তুমি দিবাভাগে ভীমসেনকে লইয়া যদৃচ্ছা ভ্রমণ করিও, কিন্তু রজনীযোগে তাহাকে আমাদের নিকট আনয়ন করিতে হইবে।
ভীম জ্যেষ্ঠের এইরূপ অনুমতি পাইয়া বিবাহে সম্মত হওয়ায় হিড়িম্বা পরমানন্দে তাঁহাকে লইয়া আকাশমার্গে প্রস্থান করিল।
ভীমের সহিত বাসকালে হিড়িম্বার এক বিরূপাক্ষ মহাবল অমানুষ পুত্র জন্মগ্রহণ করিল। ইহার নাম ঘটোৎকচ। এই ঘটোৎকচ পারে পাণ্ডবগণের প্রতি বিশেষ অনুরক্ত ও শ্রদ্ধাবান্ হইয়াছিল এবং তাঁহারাও উহাকে যথেষ্ট স্নেহ করিতেন।