পথে রমণীয় সরােবরাদির নিকট বিশ্রাম করিতে করিতে কুন্তীসমেত পাণ্ডবগণ ক্রমে দক্ষিণ পাঞ্চালদেশাভিমুখে গমন করিতে লাগিলেন। পথি মধ্যে বহুতর ব্রাহ্মণের সহিত তাঁহাদের সাক্ষাৎ হইল। ব্রাহ্মণগণ পাণ্ডবদের গন্তব্য স্থান না জানিয়া ও তাঁহাদিগকে স্বশ্রেণীয় বিবেচনা করিয়া কহিতে লাগিলেন–

 তােমরা আমাদের সহিত পাঞ্চালদেশে চল। তথায় পরমাদ্ভুত মহােৎসবের আয়ােজন হইতেছে। দ্রুপদরাজ যজ্ঞবেদিমধ্য হইতে এক পরমাসুন্দরী দুহিতা প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। সেই কমলনয়নার স্বয়ম্বরানুষ্ঠান হইবে।

 এই কথায় পাণ্ডবগণ ব্রাহ্মণদলভুক্ত হইয়া অনতিবিলম্বে পাঞ্চালদেশে উপনীত হইলেন। স্কন্ধাবার ও নগর সম্যক্‌রূপে পরিদর্শন করিয়া তাঁহারা ব্রাহ্মণবৃত্তি অবলম্বনপূর্বক এক কুম্ভকারের গৃহে বাস করিতে লাগিলেন।

 দ্রুপদরাজ শ্রেষ্ঠ ধনুর্দ্ধরকে কন্যাসম্প্রদান করিবার মানসে এক সুদৃঢ় দুরাণম্য শরাসন এবং ঘূর্ণ্যমাণ আকাশযন্ত্র-রক্ষিত অত্যুচ্চ লক্ষ্য প্রস্তুত করাইলেন। এবং ঘােষণা করিলেন যে, যিনি এই ধনুতে জ্যা-রােপণপূর্বক পঞ্চশরের দ্বারা ঘূর্ণ্যমাণ মন্ত্রের ছিদ্র ভেদ করিয়া লক্ষ্যপাত করিতে পারিবেন, তাঁহাকেই তিনি কন্যাদান করিবেন।

 এই উপলক্ষে নগরের প্রান্তবর্ত্তী এক পরিষ্কৃত সমতল ভূমিতে স্বয়ম্বর সমাজ প্রতিষ্ঠিত হইল।

 দ্রুপদরাজের ঘােষণা শ্রবণে চতুর্দ্দিক হইতে ভূপালগণ আগমন করিতে লাগিলেন। তন্মধ্যে কর্ণ-সমভিব্যাহারী দুর্য্যোধনপ্রমুখ কুরুবর্গ এবং বলদেব ও কৃষ্ণাদি যাদবগণ উপস্থিত হইলেন এবং নানাস্থানের ঋষি ও ব্রাহ্মণগণ উৎসবদর্শনার্থ সমাগত হইতে লাগিলেন। দ্রুপদরাজ সকলেরই উপযুক্ত সৎকার করিয়া স্বয়ম্বরের নির্দ্দিষ্ট দিন না আসা পর্যন্ত অভ্যাগতদের চিত্তরঞ্জনার্থ সভাস্থলে নৃত্যগীত বাদ্যোদ্যম ও জনগণের বিবিধ কলাকৌশল ও ব্যায়ামনৈপুণ্য প্রদর্শনের ব্যবস্থা করিলেন।

 পঞ্চদশ দিবস এইরূপে অতিবাহিত হইলে, নির্দ্দিষ্ট শুভদিন উপস্থিত হইল।

 শুভমুহূর্ত্ত উপস্থিত হইলে, ভ্রাতা ধৃষ্টদ্যুম্নের সহিত কৃতস্নানা অপূর্ব্বলাবণ্যময়ী কৃষ্ণা অনুপম বসনভূষণে অলঙ্কৃতা হইয়া হস্তে বিচিত্র কাঞ্চনী মালা ধারণপূর্বক রঙ্গমধ্যে অবতীর্ণ হইলেন। ধৃষ্টদ্যুম্ন স্তব্ধতা ভঙ্গ করিয়া মৃগম্ভীরস্বরে সকলকে বিজ্ঞাপিত করিলেন–

 হে সমাগত নরেন্দ্রগণ! আপনারা সকলে শ্রবণ করুন। এই ধনুর্ব্বাণ ও লক্ষ্য উপস্থিত রহিয়াছে; যিনি আকাশযন্ত্রের ছিদ্রমধ্যদিয়া পঞ্চশর নিক্ষেপপূর্ব্বক লক্ষ্যপাত করিতে পারিবেন, তাহাকেই আমার ভগিনী বরমাল্য প্রদান করিবেন।

 তখন ত্রিভুবনললামভূতা কৃষ্ণার দর্শনে মােহিত নরপতিগণ পরস্পর জিগীষু হইয়া রাজাসন হইতে গাত্রোত্থান করিলেন। সভাস্থ সমস্ত লােকে মুগ্ধনয়নে কৃষ্ণার প্রতি একদৃষ্টে চাহিয়া রহিল।

 এই সময়ে ধীমান্ কৃষ্ণ ইতস্তত দৃষ্টিপাত করিতে করিতে ব্রাহ্মণবেশধারী তেজঃপুঞ্জ পঞ্চ সুপুরুষকে জনসাধারণের মধ্যে উপবিষ্ট দেখিলেন, তাহাতে সহসা তাঁহার মনােযােগ আকৃষ্ট হইল। কিয়ৎকাল চিন্তামগ্ন থাকিয়া তিনি বাল্যসখা অর্জ্জুনকে নিঃসন্দেহ চিনিতে পারিলেন এবং বলদেবকেও সে দিকে দৃষ্টিপাত করিতে ইঙ্গিত করিলেন। তখন বলদেবও কৃষ্ণের অনুমান সমর্থন করিলে, উভয়ে তাঁহাদের গৃহদাহ হইতে পরিত্রাণ সম্বন্ধে আশ্বস্ত হইলেন।

 একে একে দুর্য্যোধন, শাল্ব, শল্য, বঙ্গাধিপ, বিদেহরাজ প্রভৃতি রাজতনয় কিরীট, হার, অঙ্গদ, ও চক্রবান্ প্রভৃতি বিবিধ অলঙ্কারে ভূষিত হইয়া স্ব স্ব বলবীর্য্য প্রদর্শন করিলেন। কিন্তু সেই ভীষণ কার্ম্মুকে জ্যা-সংযােগ করা দূরে থাক, উহাকে কিয়ৎপরিমাণ অনমিত করিতে না করিতেই উহার প্রবল প্রতিঘাতে তাঁহারা ইতস্তুত বিক্ষিপ্ত এবং তাঁহাদের আভরণসকল চতুর্দ্দিকে বিস্রস্ত হইতে লাগিল। ইহাতে বিফলমনোরথ রাজপুত্রগণ লজ্জিত ও নিস্তেজ হইয়া দ্রৌপদীর আশা ত্যাগ করিলেন।

 মহাধনুর্দ্ধর কর্ণ রাজগণকে এই রূপে পরাঙ্মুখ দেখিয়া সত্বর ধনুর নিকট উপস্থিত হইলেন। অনায়াসে তাহা উত্তোলনপূর্ব্বক তিনি সকলকে চমৎকৃত করিয়া সেই প্রচণ্ড কার্ম্মুক জ্যাযুক্ত করিলেন। পরে পঞ্চবাণ হস্তে লইয়া লক্ষ্যের নিকট গমনপূর্ব্বক শরসন্ধানে প্রবৃত্ত হইলে সকলে ভাবিল― ইনিই লক্ষ্যভেদ করিয়া বরমাল্য প্রাপ্ত হইবেন। পাণ্ডবগণ কর্ণের কন্যালাভ-সম্ভাবনায় নিতান্ত অবসন্ন হইয়া পড়িলেন।

 মহানুভবা দ্রোপদী সকলের মুখে—ইনি রাধেয়, ইনি অধিরথ-পালিত, ইনি সূতপুত্র― এইরূপ শ্রবণ করিয়া এবং অন্যান্য রাজগণের অবজ্ঞার হাস্য অবলোকন করিয়া সহসা বলিয়া উঠিলেন—

 আমি সূতপুত্রকে বরণ করিতে পারিব না।

 এই কথা অভিমানী কর্ণের কর্ণগােচর হইবামাত্র তিনি ঈষৎ বিমর্ষহাস্যসহকারে তৎক্ষণাৎ ধনুর্ব্বাণ পরিত্যাগপূর্ব্বক স্তম্ভিতবৎ সূর্যের প্রতি একদৃষ্টে চাহিয়া রহিলেন।

 অর্জ্জুন আর থাকিতে পারিলেন না। তিনি ব্রাহ্মণবেশ বিস্মৃত হইয়া স্বীয় ক্ষত্রিয়তেজ ও কৃষ্ণার রূপমাধুরীর বশবর্ত্তী হইয়া সহসা উত্থানপূর্ব্বক পরীক্ষাভূমির দিকে অগ্রসর হইতে লাগিলেন।

 ইহাতে বিপ্রমণ্ডলীর মধ্যে মহা কোলাহল উপস্থিত হইল। কেহ চীৎকার করিয়া অর্জ্জুনকে উৎসাহ দান করিতে লাগিলেন, কেহ বা বিমনা হইয়া বলিতে লাগিলেন—

 অহো কি আশ্চর্য! সুবিখ্যাত ধনুর্দ্ধারী ক্ষত্রগণ যে বিষয়ে অসমর্থ হইলেন, তাহাতে অকৃতাস্ত্র ব্রাহ্মণকুমার কি প্রকারে কৃতকার্য্য হইবার দুরাশা করিতে পারে। ইহাকে নিবারণ করা যাউক।

 অর্জ্জুনের পক্ষাবলম্বীরা বলিলেন―

 এই যুবার পীনস্কন্ধ দীর্ঘবাহু ও গতির উৎসাহ দেখিয়া আমাদের ভরসা হইতেছে। সকলে সুস্থির হইয়া ইহার কার্য্য অবলোকন কর।

 এই কথায় সকলে শান্ত হইয়া অর্জ্জুনকে মনোযোগসহকারে নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন।

 অনন্তর অর্জ্জুন প্রথমে বরপ্রদ মহাদেবকে প্রণাম করিয়া সেই ভীষণ শরাসনকে প্রদক্ষিণ করিলেন; পরে বাল্যবন্ধু কৃষ্ণের সস্নেহ দৃষ্টি আপনার প্রতি আবদ্ধ দেখিয়া প্রীত মনে ও মহা উৎসাহে কার্ম্মুক উত্তোলনপূর্ব্বক ধনুর্ব্বেদপারগ নৃসিংহ সকলের নিষ্ফলপ্রযত্নকে লজ্জা দিয়া তিনি নিমেষমধ্যে তাহাতে জ্যা-রোপণ করিলেন। এবং পাঁচটি বাণ গ্রহণ পূর্ব্বক শরসন্ধান করিয়া ঘূর্ণ্যমাণ যন্ত্রের ছিদ্রের মধ্য দিয়া কষ্টে দৃশ্য লক্ষ্য বিদ্ধ ও ভূতলে পাতিত করিলেন।

 সভাময় মহা হুলস্থুল পড়িয়া গেল। দেবগণ অর্জ্জুনের মস্তকোপরি পুষ্পবর্ষণ করিতে লাগিলেন। সহস্র সহস্র ব্রাহ্মণ স্বীয় উত্তরীয় অজিন বিধুননপূর্ব্বক মহােল্লাস প্রকাশ করিতে লাগিলেন। বাদকগণ শতাঙ্গ তূর্য্য বাদন এবং সুকণ্ঠ সূত ও মাগধগণ স্তুতিপাঠ করিতে আরম্ভ করিল।

 কৃষ্ণা অর্জ্জুনের অতুলকান্তি সন্দর্শনে সহর্ষে তাঁহার গলে বরমাল্য অর্পণ করিলেন। দ্রুপদরাজও পার্থের অসাধারণ বল ও অদ্ভুত কৌশলে প্রীত হইয়া তাঁহাকে কন্যাদানের আয়ােজনে প্রবৃত্ত হইলেন।

 এদিকে পুত্রগণ ভিক্ষার্থে গমন করিয়া এত বিলম্বেও প্রত্যাবর্ত্তন না করায় পৃথা কুম্ভকারের গৃহে চিন্তিতাবস্থায় কালক্ষেপ করিতেছিলেন। রাত্রি যখন আগতপ্রায় তখন কৃষ্ণাকে লইয়া পাণ্ডবগণ ভার্গবালয়ের নিকটবর্ত্তী হইলেন। গৃহের দ্বারে উপস্থিত হইয়াই উৎফুল্লবচনে তাঁহারা নিবেদন করিলেন―

 মাতঃ! অদ্য এক পরমরমণীয় বস্তু ভিক্ষালব্ধ হইয়াছে।

 পৃথা গৃহাভ্যন্তর হইতে সবিশেষ বিবেচনা না করিয়াই প্রত্যুত্তর করিলেন―

 বৎসগণ! যাহা প্রাপ্ত হইয়াছ, সকলে মিলিয়া তাহা ভোগ কর।

 পরে কৃষ্ণাকে নয়নগোচর করিয়া—আমি কি কুকর্ম্ম করিলাম― ভাবিয়া তিনি যুধিষ্ঠিরকে কহিলেন―

 হে পুত্র! তােমরা কি আনিয়াছ না জানায়, আমি সকলে মিলিয়া ভােগ করিবার কথা বলিয়া ফেলিয়াছি। এক্ষণে আমার কথা মিথ্যা না হয় অথচ অধর্ম্মও না হয়, এমন কিছু বিধান কর।

 মতিমান্ যুধিষ্ঠির কিয়ৎকাল চিন্তা করিয়া স্বার্থত্যাগপূর্ব্বক কহিলেন—

 হে অর্জ্জুন! দ্রৌপদী তােমারই জয়লব্ধ ধন, অতএব তুমিই যথারীতি ইহার পাণিগ্রহণ কর।

 অর্জ্জুনও জ্যেষ্ঠের ন্যায় একমাত্র ধর্ম্মের প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া কহিলেন—

 হে আর্য্য! আমাকে অধর্ম্মে লিপ্ত করিও না। জ্যেষ্ঠেরই অগ্রে বিবাহ করা উচিত। অতএব আমাদের এবং পাঞ্চালেশ্বরের হিতের প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া কর্ত্তব্য স্থির কর। আমাদিগকে তােমার একান্ত বশংবদ জানিবে।

 যুধিষ্ঠির ভ্রাতৃগণকে বিষণ্ণবদনে উপবিষ্ট দেখিয়া তাঁহাদের মানসিক অবস্থা বুঝিয়া লইলেন। এই উপলক্ষে পাছে ভ্রাতৃ বিচ্ছেদের সূচনা হয়, এই ভয়ে বিশেষ চিন্তান্বিত হইয়া যুধিষ্ঠির তাঁহাদিগকে নির্জ্জনে লইয়া গিয়া কহিলেন―

 আমি বিবেচনা করি এই― দ্রৌপদী আমাদের সকলেরই হউক। বর্ত্তমান সমস্যার এই একমাত্র উপায় দেখিতেছি, ইহাতে মাতারও বাক্য রক্ষা হইবে, আমাদের মধ্যেও কাহার কোন ঈর্ষ্যার কারণ থাকিবে না।

 এই সময়ে যাদবশ্রেষ্ঠ কৃষ্ণ ও বলদেব, পাণ্ডবগণ স্বয়ম্বরসভা হইতে কোথায় গমন করিয়াছেন, অনুসন্ধান করিতে করিতে এই স্থানে উপস্থিত হইলেন। পাণ্ডবদিগকে একত্র দেখিয়া দ্রুতগমনে অগ্রসর হইয়া তাঁহারা যুধিষ্ঠিরাদি ভ্রাতৃগণকে যথাযােগ্য সম্ভাষণ করিলে সকলের আনন্দের আর সীমা রহিল না। তখন যুধিষ্ঠির কুশলজিজ্ঞাসান্তে প্রশ্ন করিলেন—

 হে বাসুদেব! ছদ্মবেশী আমাদিগকে তােমরা কি রূপে জ্ঞাত হইলে?

 কৃষ্ণ হাস্য সহকারে উত্তর করিলেন—

 রাজন! অগ্নি প্রচ্ছন্ন থাকিলেও অনায়াসেই পরিজ্ঞাত হয়। পাণ্ডব ব্যতীত কোন্ মনুষ্য এইরূপ পরাক্রম প্রদর্শন করিতে পারে? হে কুরুশ্রেষ্ঠ! আমাদের ভাগ্যবলে ধার্ত্তরাষ্ট্রগণের দুরভিসন্ধি ব্যর্থ হইয়াছে এবং তােমরা জতুগৃহ হইতে পরিত্রাণ পাইয়ছি। তােমাদের হতপ্রায় মঙ্গল পুনর্ব্বার সমুজ্জ্বল হউক। এক্ষণে, অনুমতি কর, আমরা শিবিরে প্রতিগমন করি।

 এই বলিয়া ভ্রাতৃদ্বয় প্রস্থান করিলেন।

 পাণ্ডবগণ যখন কৃষ্ণাকে লইয়া সভাস্থল হইতে চলিয়া আসিয়াছিলেন, তখন পরিচয় পাইবার উদ্দেশে ধৃষ্টদ্যুম্ন অলক্ষিতভাবে তাঁহাদিগকে অনুসরণ করেন এবং ভার্গবালয়ে তাঁহাদিগকে প্রবেশ করিতে দেখিয়া তিনি নিকটবর্ত্তী নিভৃত স্থানে লুক্কায়িত থাকেন। ঐ স্থান হইতে কথোপকথনের কিয়দংশ শুনিতে পাইয়া তিনি পিতার নিকট সমস্ত বৃত্তান্ত নিবেদন করিবার জন্য সত্বর রাজসভায় প্রত্যাগমন করিলেন।

 কন্যাকে কতিপয় অজ্ঞাতকুলশীল ব্রাহ্মণতনয়ের সহিত প্রস্থান করিতে দেখিয়া দ্রুপদ বিষণ্ণ চিত্তে বসিয়াছিলেন। ধৃষ্টদ্যুম্নকে দেখিবামাত্র তিনি সাগ্রহে প্রশ্ন আরম্ভ করিলেন—

 হে পুত্র! কৃষ্ণা কাহার সহিত কোথায় গমন করিলেন? কুসুমমালা শ্মশানে পতিত হয় নাই ত?

 ধৃষ্টদ্যুম্ন আশ্বাস প্রদান পূর্ব্বক কহিলেন―

 হে পিতঃ! পরিতাপের কোনই কারণ দেখিলাম না। আমি ইঁহাদের পদানুসরণ করিয়া যে সকল আচারব্যবহার ও কথােপকথনের ভঙ্গি দেখিতে লাগিলাম, তাহাতে ইঁহাদিগকে ক্ষত্রকুলজাত বলিয়া অনুমান হইতেছে। কিয়দ্দিবসাবধি জনশ্রুতি শুনা যাইতেছে যে, পাণ্ডবগণ গৃহদাহ হইতে উদ্ধার পাইয়া প্রচ্ছন্নবেশে ভ্রমণ করিতেছেন। নিশ্চয় ইঁহারা সেই পঞ্চভ্রাতা, আমাদেরই ভাগ্যবলে কৃষ্ণাকে জয় করিয়াছেন। অর্জ্জুন ব্যতীত কর্ণের তেজ কে সহ্য করিতে সমর্থ? পাণ্ডব ব্যতীত কাহারা দুর্যোধনপ্রমুখ নরেন্দ্রশ্রেষ্ঠগণের দীপ্তি আচ্ছাদন করিয়া রাখিতে পারে?

 দ্রুপদ তখন পরিতুষ্ট মনে পুরােহিতকে আহ্বানপূর্ব্বক কুম্ভকারের কুটীরে প্রেরণ করিয়া তাঁহাকে লক্ষ্যভেদকারীর কুলশীল জিজ্ঞাসা করিয়া আসিতে বলিলেন।

 পুরােহিত পাণ্ডবসমীপে উপনীত হইয়া বাগাড়ম্বরপূর্ব্বক তাঁহাদের ভূরি ভূরি প্রশংসা করিয়া কৌশলে বলিতে লাগিলেন―

 মহাত্মা পাণ্ডু দ্রুপদরাজের প্রিয়সখা ছিলেন, অতএব অর্জ্জুনের সহিত কৃষ্ণার বিবাহ হয়, ইহাই তাঁহার চিরকাল ইচ্ছা ছিল।

 তখন যুধিষ্ঠির ভীমকে পুরােহিতের পাদ্য এবং অর্ঘ্য প্রদান করিতে বলিয়া কহিলেন—

 পাঞ্চালরাজের মনােরথ সিদ্ধ হইয়াছে! অর্জ্জুনই তাঁহার দুহিতাকে জয় করিয়াছেন।

 এইরূপ কথাবার্ত্তা হইতেছে, এমন সময় দ্রুপদপ্রেরিত কাঞ্চনপদ্মখচিত সদশ্বযুক্ত রাজোচিত রথদ্বয় এবং বিবিধ উৎকৃষ্ট খাদ্যদ্রব্য লইয়া আর এক দূত উপস্থিত হইয়া বলিল—

 মহারাজ পাঞ্চালাধিপতি দ্রৌপদীর পাণিগ্রহণার্থে আপনাদিগকে প্রাসাদে সাদর আহ্বান করিতেছেন; অতএব আর বিলম্ব করিবেন না।

 এই কথা শ্রবণে পুরােহিতকে অগ্রে বিদায় দিয়া পৃথা ও কৃষ্ণাকে এক রথে আরােহণ করাইয়া ভ্রাতৃগণ অপর রথ অবলম্বনপূর্ব্বক রাজ প্রাসাদাভিমুখে যাত্রা করিলেন।

 অজিনোত্তরীয় পুরুষপ্রবীর পাণ্ডুতনয়গণকে দেখিয়া রাজা, রাজকুমার, সচিব, সুহৃদ্‌বর্গ এবং ভৃতগণ আনন্দপ্রবাহে নিমগ্ন হইলেন। কুন্তী দ্রৌপদীর সহিত অন্তঃপুরে প্রবিষ্ট হইয়া স্ত্রীগণদ্বারা উপযুক্তরূপে সৎকৃত হইলেন।

 অনন্তর কুন্তী ও দ্রৌপদীকে অন্তঃপুর হইতে আনয়নপুর্ব্বক দ্রুপদ সকলের সমক্ষে যুধিষ্ঠিরকে বলিলেন―

 অদ্য শুভদিন, অতএব অর্জ্জুন অদ্যই কৃষ্ণার পাণিগ্রহণ করুন।

 যুধিষ্ঠির বলিলেন—রাজন্! জ্যেষ্ঠ আমি অবিবাহিত থাকিতে অর্জ্জুনের কিরূপে বিবাহ হইতে পারে?

 তদুত্তরে দ্রুপদ কহিলেন—

 হে সৌম্য! তবে তুমিই আমার কন্যাকে বিবাহ কর, অথবা অন্য কোন্ কন্যা তোমার মনোনীত, তাহা অনুমতি কর।

 তখন যুধিষ্ঠির বলিতে লাগিলেন―

 মহাশয়! আমার বা ভীমসেনের কাহারও বিবাহ হয় নাই। অর্জ্জুন আপনার কন্যাকে জয় করিয়াছে বটে, কিন্তু আমাদের মধ্যে ভ্রাতৃস্নেহবন্ধন এত অধিক যে কেহ কোন উৎকৃষ্ট বস্তু প্রাপ্ত হইলে আমরা সকলে মিলিয়া তাহা ভোগ করিয়া থাকি। মাতাও আমাদের সকলকে একত্র হইয়া কৃষ্ণাকে বিবাহ করিতে অনুমতি দিয়াছেন, সুতরাং আমাদের মধ্যে এই চিরপ্রচলিত নিয়ম আমরা এস্থলে লঙ্ঘন করিতে পারিব না। আপনার কন্যা ধর্ম্মত আমাদের সকলেরই পত্নী হইবেন। অতএব অগ্নি সাক্ষী করিয়া জ্যেষ্ঠানুক্রমে সকলেরই সহিত তনয়ার পরিণয়-ক্রিয়া সম্পাদন করুন।

 দ্রুপদ কহিলেন― হে ধর্ম্মরাজ! তোমার যদি ইহা প্রকৃতপক্ষে সদনুষ্ঠান বলিয়াই বিবেচনা হয়, তবে আমি আর কি বলিব। যাহা হউক অদ্য তুমি পুনরায় এ বিষয়ে মাতার সহিত বিশেষরূপে পর্য্যালোচনা করিয়া দেখ। কল্য তোমরা সকলে মিলিয়া যাহা কর্ত্তব্য স্থির করিবে, আমি তাহাই করিব।

 এবিষয়ে নানারূপ কথােপকথন হইতেছে, এমন সময়ে মহর্ষি দ্বৈপায়ন তথায় উপস্থিত হইলেন। তাঁহাকে দেখিয়া দ্রুপদাদি পাঞ্চলগণ এবং যুধিষ্ঠিরপ্রমুখ পাণ্ডবগণ গাত্রোত্থানপূর্ব্বক ভক্তিভরে অভিবাদন করিলেন।

 ব্যাসদেব সমস্ত অবস্থা অবগত হইয়া সকলকে আশ্বাস প্রদানপূর্ব্বক দ্রুপদকে একান্তে লইয়া দেশকাল ও অবস্থাভেদে ধর্ম্মের বিভিন্ন গতি সম্বন্ধীয় নিগূঢ় তত্ত্বসকল সুস্পষ্টরূপে বুঝাইয়া দিলেন।

 অনন্তর দ্রুপদরাজ সভায় উপস্থিত হইয়া সকলের সমক্ষে কহিলেন—

 পাণ্ডবগণ বিধিপূর্ব্বক কৃষ্ণাকে বিবাহ করুন, আমার কন্যা তাঁহাদের নিমিত্তই জন্মগ্রহণ করিয়াছেন।

 বিবাহব্যাপার সমাধানান্তে দ্রুপদরাজ জামাতাদিগকে বহুবিধ ধন, মহোন্নত হস্তী, বস্ত্রালঙ্কারবিভূষিত দাসী ও অশ্বচতুষ্টয়যোজিত সুবর্ণময় রথ প্রদান করিলেন। অভ্যাগতবৃন্দকেও পৃথক্‌ পৃথক্ ধন ও মন্থমূল্য পরিচ্ছদাদি বিতরণপূর্ব্বক বিদায় করা হইল।

 পাণ্ডবগণ সেই দেবদুর্লভ স্ত্রীরত্ন লাভ করিয়া পরম সুখে পাঞ্চালরাজ্যে কালযাপন করিতে লাগিলেন। পাঞ্চাল ও পাণ্ডবগণ পরস্পরকে সহায় পাইয়া শত্রুভয় হইতে মুক্ত হইলেন। পুরবাসিগণ সর্ব্বদাই কুন্তীর নাম সঙ্কীর্ত্তনপূর্ব্বক চরণবন্দন করিতেন।

 এদিকে চরের দ্বারা হস্তিনাপুরে সংবাদ পৌঁছিল যে পাণ্ডুতনয়গণ জীবিত আছেন। এবং তাঁহারাই দ্রৌপদীর পাণিগ্রহণপূর্ব্বক পাঞ্চালরাজ্যে বাস করিতেছেন।

 এই সংবাদ শুনিয়া ধৃতরাষ্ট্র বিদুরকে কহিলেন— বিদূর! মহাবীর পাণ্ডুপুত্রগণ আমারও পুত্রস্থানীয় এবং এ রাজ্যেরও সমাংশভাগী সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই, অতএব তুমি স্বয়ং গিয়া সৎকার প্রদর্শনপূর্ব্বক কুন্তী ও দ্রৌপদীসমভিব্যাহারে পাণ্ডুনন্দনদিগকে আনয়ন কর।

 অনন্তর ধর্ম্মজ্ঞ ও সর্ব্বশাস্ত্রবিশারদ বিদুর ধৃতরাষ্ট্রের আদেশ অনুসারে বিবিধ রত্ন ও ধনসম্পত্তি গ্রহণপূর্ব্বক পাঞ্চালরাজ্যে উপনীত হইয়া দ্রুপদকে সম্বর্দ্ধনা করিলেন। এবং পাণ্ডবদিগকে নয়নগোচর করিয়া স্নেহভরে আলিঙ্গনপূর্ব্বক কুশল প্রশ্ন করিলেন। তৎপরে কুন্তী দ্রোপদী পাণ্ডব ও পাঞ্চাল্যদিগকে যথানীত ধন ও অলঙ্কারসকল প্রদান করিয়া সকলের সমক্ষে দ্রুপদকে নিবেদন করিলেন―

 মহারাজ! পুত্র ও অমাত্য সহ মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র আপনাদের সহিত এই সম্বন্ধ সংস্থাপনে সাতিশয় প্রীত হইয়া বারম্বার আপনার কুশল জিজ্ঞাসা করিয়াছেন। কুরু-প্রধান ভীষ্ম আপনার সর্বাঙ্গীন মঙ্গল কামনা করেন, এবং আপনার সখা দ্রোণ আপনাকে উদ্দেশে আলিঙ্গন করিতেছেন। এক্ষণে বহুদিবসের বিয়োগান্ত সকল পাণ্ডুনন্দনদিগকে দেখিবার জন্য অতীব উৎসুক আছেন; ইঁহারাও বহুকাল প্রবাসে থাকিয়া রাজধানীতে গমন করিতে ব্যগ্র। কৌরবগণ ও পৌরজন পাঞ্চালীকে নয়নগোচর করিবার জন্য ব্যাকুল চিত্তে প্রতীক্ষা করিতেছেন। অতএব আপনি অনতিবিলম্বে সস্ত্রীক পাণ্ডবগণকে স্বগৃহে গমন করিবার অনুমতি প্রদান করুন।

 দ্রুপদ কহিলেন—হে মহাপ্রাজ্ঞ বিদুর! তুমি যাহা কহিলে তাহা যথার্থ। কৌরবগণের সহিত বৈবাহিক সম্বন্ধে আমিও যথেষ্ট পরিতােষ লাভ করিয়াছি। আর মহাত্মা পাণ্ডবগণের স্বরাজ্যে গমন করা কর্ত্তব্য তাহার সন্দেহ নাই।

 তখন যুধিষ্ঠির বিনয়পূর্ব্বক কহিলেন—

 হে পাঞ্চালেশ্বর! আমি এবং আমার অনুজগণ আপনারই অধীন, সুতরাং আপনি যাহা আজ্ঞা করিবেন, আমরা তাহাই শিরােধারণ করিব।

 পরে কৃষ্ণও হস্তিনাপুরগমনে সম্মতি প্রকাশ করিলে মাতৃসমেত পাণ্ডবগণ কৃষ্ণাকে লইয়া কৃষ্ণ ও বিদুর সমভিব্যাহারে যাত্রা করিলেন।

 তাঁহাদের আগমনবার্ত্তা শ্রবণে ধৃতরাষ্ট্র তাঁহাদের প্রত্যুদ্‌গমনের নিমিত্ত অন্যান্য কৌরবগণের সহিত দ্রোণ কৃপকে প্রেরণ করিলেন।

 তদনন্তর পাণ্ডবগণ পিতামহ ভীষ্ম, জ্যেষ্ঠতাত ধৃতরাষ্ট্র এবং অন্যান্য গুরুজনের পাদবন্দন করিয়া অনুমতি গ্রহণপূর্ব্বক বিশ্রামার্থে গৃহমধ্যে প্রবেশ করিলেন। তাঁহারা সম্পূর্ণ বিশ্রান্ত হইলে ভীষ্ম ও ধৃতরাষ্ট্র সকলকে আহ্বানপূর্ব্বক কহিলেন—

 বৎস যুধিষ্ঠির! তােমর অর্দ্ধেক রাজ্য গ্রহণপূর্ব্বক খাণ্ডবপ্রস্থে রাজধানী স্থাপন করিয়া পরমসুখে রাজত্ব করিতে থাক, তাহা হইলে দুর্য্যোধনাদির সহিত তােমাদের বিবাদের কোন কারণ থাকিবে না। তােমরা স্বীয় ভুজবলে সকল অনিষ্ট হইতে অনায়াসে আত্মরক্ষা করিতে পারিবে।

 অর্দ্ধরাজ্যভোগের অনুমতি পাইয়া পাণ্ডবগণ রাজাজ্ঞা স্বীকার করিয়া গুরুজনদিগকে প্রণিপাতপূর্ব্বক কৃষ্ণের সহিত অরণ্যপথে খাণ্ডবপ্রস্থাভিমুখে প্রস্থান করিলেন। তাঁহাদের আগমনে নগরী অলঙ্কৃত ও সুসজ্জিত হইল। বিস্তীর্ণ রাজপথ সুধা-ধবলিত ভবন ও চতুঃপার্শ্বস্থ আম্র নীপ অশােক চম্পক বকুল প্রভৃতি বৃক্ষরাজি অবলােকন করিয়া পাণ্ডবগণ পরম প্রীত হইলেন।

 পাণ্ডবদের আগমন সংবাদে তথায় বহু ব্রাহ্মণ বণিক ও শিল্পী বাস করিতে আসিল। কৃষ্ণ ও বলদেব পাণ্ডবদিগকে রাজ্যাভিষিক্ত দেখিয়া বিদায় লইয়া দ্বারকায় প্রতিগমন করিলেন। সত্য-প্রতিজ্ঞ যুধিষ্ঠির সিংহাসনারূঢ় হইয়া ভ্রাতৃচতুষ্টয়-সমভিব্যাহারে ধর্ম্মানুসারে প্রজাপালন করিতে লাগিলেন।