১১

 শরশয্যায় শয়ান মহামতি ভীষ্মকে আমন্ত্রণ করিয়া কর্ণ গলদশ্রুলোচনে কৌরব-সৈন্যগণের মধ্যে উপস্থিত হইয়া তাহাদিগকে নানাবাক্য-বিন্যাসে আশ্বাস প্রদান করিতে লাগিলেন। দুর্য্যোধন বহুদিবসের পর কর্ণকে যুদ্ধক্ষেত্রে রথারূঢ় দেখিয়া প্রফুল্লচিত্তে কহিলেন—

 হে কর্ণ! তুমি সৈন্যগণের রক্ষার ভার গ্রহণ করায় অদ্য তাহাদিগকে পুনরায় সনাথ বােধ হইতেছে। এক্ষণে কি কর্ত্তব্য, তাহা তুমি অবধারণ কর।

 কর্ণ কহিলেন—মহারাজ! উপস্থিত মহাত্মারা সকলেই মহাবলপরাক্রান্ত ও সমরজ্ঞ; অতএব সকলেই সেনাপতি হইবার উপযুক্ত। কিন্তু ইঁহারা পরস্পরের সহিত স্পর্ধা করিয়া থাকেন, সুতরাং ইঁহাদের মধ্যে একজনকে সৎকার করিলে মনঃক্ষুণ্ণ হইয়া অবশিষ্ট সকলে হিতৈষী হইয়া যুদ্ধ করিবেন না; অতএব কোন বিশেষ গুণে অলঙ্কৃত ব্যক্তিকেই নির্ব্বচন করা বিধেয়। এই নিমিত্ত ধনুর্দ্ধরাগ্রগণ্য সকলযােদ্ধার আচার্য্য দ্রোণকে সেনাপতি করা কর্ত্তব্য। সকলেই প্রীতিপূর্ব্বক শুক্র ও বৃহস্পতিতুল্য দুর্দ্ধর্ষ ভারদ্বাজের অনুগমন করিবেন।

 রাজা দুর্য্যোধন কর্ণের বাক্য শ্রবণ করিয়া সেনা-মধ্যস্থিত দ্রোণাচার্য্যকে কহিলেন―

 হে আচার্য্য! বর্ণ-কুল-বুদ্ধি-বীরত্বে ও দক্ষতায় আপনি সকলের শ্রেষ্ঠ; অতএব ইন্দ্র যেমন দেবগণকে রক্ষা করেন, আপনি সেইরূপ আমাদিগকে রক্ষা করুন। আপনি সেনাপতি হইয়া দেবগণের অগ্রগামী কার্ত্তিকেয়ের ন্যায় আমাদের অগ্রে গমন করুন।

 দুর্য্যোধনের বাক্যাবসানে ভূপতিগণ সিংহনাদে তাঁহার হর্ষোৎপাদন করিয়া দ্রোণকে জয়বাদ প্রদান করিলেন। সেনাগণের আনন্দকোলাহল নিবৃত্ত হইলে দ্রোণ সৈনাপত্য স্বীকারপূর্ব্বক কহিলেন―

 হে দুর্য্যোধন! তোমরা জয়াকাঙ্ক্ষী হইয়া আমাতে যে সকল গুণ, আরোপ করিলে আমি যুদ্ধকালে তাহা সার্থক করিবার চেষ্টা করিব।

 অনন্তর যুদ্ধের একাদশ দিবসে সেনাপতি দ্রোণ সৈন্যগণকে ব্যূহিত করিয়া ধৃতরাষ্ট্রগণ-সমভিব্যাহারে যুদ্ধক্ষেত্রে যাত্রা করিলেন। কৃপ কৃতবর্মা ও দুঃশাসনপ্রভৃতি বীরগণ দ্রোণের বাম পার্শ্ব রক্ষণে নিযুক্ত রহিলেন। জয়দ্রথ কলিঙ্গ ও ধার্ত্তরাষ্ট্রগণ তাঁহার দক্ষিণে অবস্থান করিলেন। মদ্রাধিপতিপ্রভৃতি বীরগণ-সমভিব্যাহারে কর্ণ ও দুর্য্যোধন অগ্রসর হইলেন।

 কর্ণ সকলের অগ্রে গমন করিতে লাগিলেন। তাঁহার সিংহ-লাঞ্ছিত সূর্য্য-সঙ্কাশ মহাকেতু স্ব-পক্ষের হর্ষবর্দ্ধন করিয়া শোভমান হইল। তখন কর্ণকে অবলোকন করিয়া কৌরবগণ ভীষ্মের অভাব গণনাই করিলেন না। যুধিষ্ঠিরও সৈন্য প্রতিব্যূহিত করিয়া ব্যূহমুখে অর্জ্জুনকে সন্নিবেশিত করিলেন। উভয় সৈন্যদল সম্মুখীন হইলে চির-বৈরী কর্ণ ও অর্জ্জুন পরস্পরকে নিরীক্ষণ করিতে লাগিলেন।

 অনন্তর বনমধ্যে হুতাশন যেমন বৃক্ষ দগ্ধ করিয়া বিচরণ করে, দ্রোণ যুদ্ধকার্য্য আরম্ভ করিয়া তদ্রূপ ভ্রাম্যমাণ হেমময় রথে পাণ্ডব সেনা দলন করিতে লাগিলেন। বায়ুসহায় গর্জ্জমান পর্জ্জনের শিলাবর্ষণবৎ দ্রোণশরপ্রপাতে পাণ্ডবপক্ষ একান্ত ক্লিষ্ট হইল। তদ্দর্শনে পাণ্ডববীর-পরিবৃত ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির সত্বর ধাবমান হইয়া তাঁহাকে নিবারণ করিলেন।

 তখন তুমুল যুদ্ধ উপস্থিত হইল। শকুনি সম্মুখীন হইয়া নিশিত শরসমূহে সহদেবকে আক্রমণ করিলেন এবং দ্রোণাচার্য্য দ্রুপদের উপর সবেগে নিপতিত হইলেন। সাত্যকি কৃতবর্ম্মার সহিত এবং ধৃষ্টকেতু কৃপাচার্য্যের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলেন, কিন্তু শল্য ব্যতীত ভীমসেনের প্রতাপ কেহ সহ্য করিতে পারিলেন না।

 অবশেষে শেষােক্ত দুই বীরে মহা গদাযুদ্ধ চলিতে লাগিল। মহাবেগশালী মাতঙ্গসদৃশ দুইজনই গদা উত্তোলিত করিয়া পরস্পরের উপর পতিত হইলেন, পুনরায় অন্তরমার্গে অবস্থানপূর্ব্বক মণ্ডলগতিতে বিচরণ করিতে লাগিলেন, পরে সহসা লম্ফ প্রদানপূর্ব্বক সেই লৌহদণ্ডদ্বারা পরস্পরকে প্রহার করিলেন। কিয়ৎক্ষণ এরূপ চলিলে উভয় বীর পরস্পরের বেগে নিপীড়িত হইয়া ক্ষিতিতলে যুগপৎ পতিত হইলেন; কিন্তু ভীমসেন অতি সত্বর পুনরায় উখিত হইলে কৌরবগণ শল্যকে অবিলম্বে স্থানান্তরিত করিয়া রক্ষা করিলেন।

 তখন মহাবাহু গদাহস্ত বৃকোদর কৌরব-সৈন্যকে আক্রমণ করিলে জয়শীল পাণ্ডবগণ উচ্চৈঃস্বরে সিংহনাদ করিয়া তাঁহার সহিত যােগদানপূর্ব্বক তাঁহাদিগকে কম্পিত করিতে লাগিলেন। সৈন্য রক্ষক দ্বিজশ্রেষ্ঠ দ্রোণাচার্য্য কৌরবগণকে ভগ্ন দেখিয়া তাহাদিগকে আশ্বাস-প্রদানপূর্ব্বক রােষাবেশে সহসা পাণ্ডব-সৈন্যমধ্যে প্রবিষ্ট হইয়া যুধিষ্ঠিরের প্রতি ধাবিত হইলেন এবং তাঁহার চক্ররক্ষককে বিনষ্ট করিয়া অন্যান্য বীরকে নিবারণপূর্ব্বক তাঁহাকে শরনিকরে বিদ্ধ করিলেন।

 তখন সৈন্যমধ্যে—রাজা ধৃত হইলেন!—বলিয়া মহাশব্দ সমুত্থিত হইল। এই কোলাহল দূরবর্ত্তী অর্জ্জুনের শ্রবণগােচর হইবামাত্র তিনি শূরগণের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ-বাহিত অতি ভীষণ শোণিত-নদী দ্রুতগতিতে উত্তীর্ণ হইয়া রথঘােষে চতুর্দ্দিক নিনাদিত ও কৌরবগণকে বিদ্রাবিত করিয়া মহাবেগে আগমন করিলেন। অনন্তর ধনঞ্জয়কৃত শরান্ধকারে না-দিক্‌ না-অন্তরীক্ষ না-মেদিনী না-কিছুই দৃষ্টিগােচর রহিল।

 এই সময় ধূলিপটলসমাচ্ছন্ন দিবাকর অস্তমিত হইল; সুতরাং দ্রোণাচার্য্য অগত্যা অর্জ্জুনকর্ত্তৃক পরাজিত সৈন্যগণকে অবহারের আদেশ দিলেন। পাণ্ডবগণও হৃষ্টচিত্তে বিশ্রামার্থে গমন করিলেন।

 অনন্তর পরদিনের যুদ্ধারম্ভ হইলে ত্রিগর্ত্তগণ অর্জ্জুনকে যুদ্ধার্থে আহ্বান করিতে করিতে দক্ষিণ দিকে প্রস্থান করিলেন।

 তখন অর্জ্জুন যুধিষ্ঠিরকে কহিলেন―

 মহারাজ! আমি যুদ্ধে আহূত হইলে কদাচ অস্বীকার করি না, ইহাই আমার ব্রত। এক্ষণে ত্রিগর্ত্তগণ আমাকে আহ্বান করিতেছে; অতএব উহাদিগকে বিনাশ করিবার অনুমতি প্রদান করুন।

 পাঞ্চালবীর সত্যজিৎ অদ্য তােমার রক্ষক হইবেন! যদি দ্রোণকর্ত্তৃক তিনি বিনষ্ট হন, তবে তুমি কোনক্রমে রণস্থলে অবস্থান করিও না।

 অনন্তর যুধিষ্ঠির প্রীতি-স্নিগ্ধ-নয়নে আলিঙ্গনপূর্ব্বক অর্জ্জুনকে ত্রিগর্ত্তগণের সহিত যুদ্ধার্থে গমনের অনুমতি প্রদান করিলে মহাবীর ধনঞ্জয় ক্ষুধার্ত্ত সিংহের ন্যায় তাঁহাদের প্রতি ধাবিত হইলেন। তখন দ্রোণসৈন্যগণ অর্জ্জুনবিহীন যুধিষ্ঠিরকে গ্রহণ করিবার নিমিত্ত হৃষ্টচিত্তে অগ্রসর হইলে উভয়পক্ষীয় বীরগণ মহাবেগে মিলিত হইলেন।

 এদিকে ত্রিগর্ত্তগণ যুদ্ধক্ষেত্রের বহির্ভাগে সমতল-ভূমিতে অবস্থান করিয়া রথদ্বারা চক্রাকার ব্যূহ নির্ম্মাণ করিলেন এবং অর্জ্জুনকে আগত দেখিয়া হর্ষভরে চীৎকার করিলেন। অর্জ্জুন তাঁহাদিগকে সন্তুষ্ট দেখিয়া সহাস্যমুখে কৃষ্ণকে কহিলেন―

 হে বাসুদেব! এই মুমূর্ষু ত্রিগর্ত্তগণকে অবলােকন কর। ইহারা রােদন করিবার স্থলে হর্ষ প্রকাশ করিতেছে, অথবা অভিলষিত লােকসকল প্রাপ্তির সম্ভাবনায় ইহার সত্যই আনন্দিত হইতেছে।

 এই বলিয়া অর্জ্জুন ত্রিগর্ত্তরাজের সম্মুখে রথস্থাপনপুর্ব্বক সুবর্ণালঙ্কৃত দেবদত্ত-শঙ্খধ্বনি করিলেন। তখন ত্রিগর্ত্তগণ সকলে মিলিয়া এককালে অর্জ্জুনের প্রতি বাণনিক্ষেপ করিতে লাগিলেন। তন্মধ্যে ত্রিগর্ত্তরাজের এক ভ্রাতা অর্জ্জুনের কিরীটে অস্ত্রাঘাত করিলে ধনঞ্জয় প্রথমেই তাঁহার শিরশ্ছেদন করিলেন এবং পরে অবিচ্ছিন্ন শরনিকরে তাঁহাদের সৈন্যগণকে সংহার করিতে লাগিলেন। তখন তাহারা একান্ত ভীত হইয়া দুর্য্যোধনের সৈন্যসমুদায়ের সহিত মিলিত হইবার নিমিত্ত পলায়নের উপক্রম করলে ত্রিগর্ত্তরাজ ক্রোধাবিষ্ট হইয়া কহিলেন—

 হে বীরগণ! তােমরা পলায়ন করিও না। কৌরবগণের সমক্ষে সেরূপ ভয়ানক শপথ করিয়া এক্ষণে কিরূপে তাঁহাদের নিকট গমন করিবে।

 এই কথায় সৈন্যগণ উত্তেজিত ও পুনরায় মিলিত হইয়া যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইল। অর্জ্জুন তাহাদিগকে প্রত্যাগত দেখিয়া বাসুদেবকে কহিলেন—

 হে কেশব! বােধ হয় ত্রিগর্ত্তগণ জীবনসত্ত্বে রণ পরিত্যাগ করিবে না, আরও নিকটে রথ লইয়া চল। আজি তুমি আমার ভুজবল ও গাণ্ডীব-মাহাত্ম্য অবলােকন করিবে।

 তখন কৃষ্ণ অপূর্ব্ব কৌশল প্রদর্শনপূর্ব্বক মণ্ডল অবলম্বন ও গতি প্রত্যাগতি সহকারে ত্রিগর্ত্ত সৈন্যমধ্যে বিচরণ করিতে আরম্ভ করিলে অর্জ্জুন দ্বিগুণীকৃত তেজে অস্ত্রবর্ষণ করিয়া এককালে সম্মুখস্থিত সমগ্র বীরগণকে যমালয়ে প্রেরণ করিলেন। পরে অবশিষ্ট ত্রিগর্ত্তগণকে শরনিকরে অতিশয় পীড়ন করিতে লাগিলেন।

 অবশেষে সমস্ত ত্রিগর্ত্তগণ জীবিতাশা পরিত্যাগপূর্ব্বক একসঙ্গে বাণ বর্ষণ আরম্ভ করিলে অর্জ্জুন ও কৃষ্ণ তাহাতে একান্ত আচ্ছন্ন হইয়া আর পরস্পরেও দৃষ্টিগোচর রহিলেন না। ত্রিগর্ত্তগণ ইহা দেখিয়া উঁহাদিগকে নিহত-বোধে বস্ত্রবিধূননপূর্ব্বক মহা কোলাহল করিতে লাগিল। বাসুদেব ক্ষত-বিক্ষতাঙ্গ ও একান্ত ক্লান্ত হইয়া বলিতে লাগিলেন―

 হে পার্থ! তুমি ত অক্ষত আছ? আমি তোমাকে দেখিতে পাইতেছি না।

 তাঁহার বাক্য শ্রবণে অর্জ্জুন বায়ব্যাস্ত্রে সেই সমস্ত শরজাল অপসৃত করিলেন এবং তৎপরে তাহাদিগকে নিতান্ত ব্যাকুল করিয়া ভল্লাস্ত্রদ্বারা কাহারও মস্তক, কাহারও হস্ত, কাহারও উরুদেশ ছেদন করিতে লাগিলেন। তখন নিঃশেষিতপ্রায় ত্রিগর্ত্ত-সৈন্য অর্জ্জুনের প্রভাব আর সহ্য করিতে না পারিয়া পলায়ন করিল।

 অর্জ্জুনও শত্রুগণকে পরাজিত দেখিয়া সত্বর যুধিষ্ঠিরের নিকট প্রত্যাগত হইবার নিমিত্ত রথচালনা করিলেন এবং উঁহার গতিনিবারণকাৱী সৈন্যদলকে পদ্মবনপ্রবিষ্ট মাতঙ্গের ন্যায় বিমর্দ্দিত করিয়া অতি বেগে ধাবমান হইলেন। অর্জ্জুনের অবারিত গতি দর্শনে প্রাগ্‌জ্যোতিষেশ্বর ভগদত্ত স্বীয় মেঘসঙ্কাশ হস্তীর উপর হইতে তাঁহার প্রতি অস্ত্রবর্ষণ আরম্ভ করিলেন।

 তখন হস্তী ও রথে ঘােরতর সংগ্রাম আরম্ভ হইল। মহাবাহু ভগদত্ত অনায়াসে অর্জ্জুনের শরনিকর নিরাকৃত করিয়া রথসহ তাঁহাকে ও কৃষ্ণকে বিনাশ করিবার মানসে হস্তী সঞ্চালন করিলেন। মহামতি জনার্দ্দন সেই গজকে কালান্তক যমের ন্যায় আগমন করিতে দেখিয়া অতি সত্বর রথ দক্ষিণপার্শ্বস্থ করিলেন।

 সেই সুযােগে অর্জ্জুন পশ্চাদ্দেশ হইতে হস্তী ও আরােহীকে বিনষ্ট করিতে পারিতেন, কিন্তু ধর্ম্ম স্মরণ করিয়া তাহা করিলেন না। তখন সেই মহাগজ অবিশ্রাম পাণ্ডবসৈন্য সংহার করিতে পাকিলে অর্জ্জুনের ক্রোধের পরিসীমা রহিল না। তিনি সুতীক্ষ্ণ শরদ্বারা হস্তীর বর্ম্ম ছেদন করিলেন এবং ভগদত্ত-নিক্ষিপ্ত অস্ত্রসমুদায় নিবারণ করিয়া তাঁহাকে গাঢ়বিদ্ধ করিলেন। তখন ভগদত্ত ধনঞ্জয়ের মস্তকে এক তােমর নিক্ষেপ করিলে সেই আঘাতে তাঁহার কিরীট বিবর্ত্তিত হইল। পার্থ কিরীট যথাস্থানে সন্নিবেশিত করিয়া রােষভরে ভগদত্তকে কহিলেন—

 হে প্রাগ্‌জ্যোতিষেশ্বর। এই সময়ে সকলকে উত্তমরূপে নিরীক্ষণ করিয়া লও। আমার কিরীট যে বিপর্য্যস্ত করে, তাহার আর রক্ষা নাই।

 এই বাক্যে ভগদত্ত যৎপরােনান্তি ক্রুদ্ধ হইয়া এক অঙ্কুশ নিক্ষেপ করিলেন। অর্জ্জুন তাহা নিবারণ করিতে পারিলেন না দেখিয়া কৃষ্ণ সত্বর তাঁহাকে আচ্ছাদনপূর্বক স্বীয় শরীরে তাহা গ্রহণ করিলেন। ইহাতে মহাবীর ধনঞ্জয় নিতান্ত ক্লিষ্টচিত্তে কৃষ্ণকে কহিলেন―

 হে মধুসূদন! তুমি প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলে যুদ্ধ করিবে না, এক্ষণে তাহা রক্ষা করিলে না। আমি অশক্ত বা ব্যসনাপন্ন হইলে অবশ্য আমাকে রক্ষা করা তোমার কর্ত্তব্য হইত, কিন্তু আমি অস্ত্রধারী ও যুধ্যমান থাকিতে সমরব্যাপারে হস্তক্ষেপ করা তােমার উচিত হয় নাই।

 এই বলিয়া অর্জ্জুন সহসা হস্তীর কুম্ভান্তরে নারাচ নিক্ষেপ করিলেন। তখন ভগদত্ত বারম্বার হস্তিচালনার চেষ্টা করিলেও কৃতকার্য্য হইলেন না। সেই হস্তী মর্ম্মাহত হইয়া কিয়ৎক্ষণ মধ্যেই স্তব্ধগাত্র ও অবনি-তলগত হইল এবং আর্ত্তস্বরে চীৎকার করিয়া প্রাণত্যাগ করিল। সেই সময়ে ধনঞ্জয় অর্দ্ধচন্দ্রবাণে ভগদত্তের হৃদয় ভেদ করিলে তিনিও ধনুর্ব্বাণ পরিত্যাগপূর্ব্বক পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হইলেন। তখন অর্জ্জুন পুনরায় অনিবারিত গতিতে যুধিষ্ঠিরের নিকট গমন করিতে লাগিলেন।

 ওদিকে অর্জ্জুন স্থানান্তরিত হইলে দ্রোণাচার্য্য অতি দুর্ভেদ্য ব্যূহরচনা করিয়া যুধিষ্ঠিরকে গ্রহণ করিবার মানসে পাণ্ডবসৈন্য-অভিমুখে অগ্রসর হইতে লাগিলেন, তখন যুধিষ্ঠির প্রতিব্যূহ নির্ম্মাণ করিলে দ্রোণ ও তাঁহার রক্ষকগণের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ উপস্থিত হইল। যেমন বায়ুবেগে মেঘমণ্ডল ছিন্নভিন্ন হয়, তদ্রূপ দ্রোণাচার্য্যের গতিরোধক সৈন্যদল নিতান্ত বিক্ষিপ্ত হইতে লাগিল। সেই সুযােগে মহাবীর দ্রোণ যুধিষ্ঠিরকে প্রাপ্ত হইয়া তাঁহাকে শরনিকরে আচ্ছন্ন করিলেন।

 গজযূথপতিকে মহাসিংহ আক্রমণ করিলে করিগণ যেরূপ আর্ত্তনাদ করে, যুধিষ্ঠিরকে দ্রোণকর্ত্তৃক আক্রান্ত দেখিয়া পাণ্ডবসেনা সেইরূপ কোলাহল আরম্ভ করিল। তখন অর্জ্জুন-নির্দিষ্ট রক্ষক সত্যজিৎ সহসা দ্রোণের প্রতি ধাবমান হইয়া তাঁহার সারথি ও অশ্বকে গাঢ় বিদ্ধ করিয়া মণ্ডলাকারে বিচরণপূর্ব্বক আচার্য্যের ধ্বজচ্ছেদন করিলেন। ইহাতে দ্রোণ ক্রুদ্ধচিত্তে দশ বাণে সত্যজিতের কলেবরবিদ্ধ করিলেও তিনি কিছুমাত্র কম্পিত না হইয়া পুনরায় দ্রোণকে প্রহার করিলেন।

 পাণ্ডবগণ সত্যজিতের এভাদৃশ পরাক্রম দর্শন করিয়া বীরনাদ ও বসনকম্পনে তাঁহার অভিনন্দন করিলেন। দ্রোণাচার্য্য বারম্বার সত্যজিতের শরাসন ছেদন করিতে লাগিলেন, কিন্তু সেই সত্যপরাক্রম বীর ক্রমাগত শরাসন গ্রহণপূর্ব্বক বিচলিত-চিত্তে ঘােরতর সংগ্রাম করিতে লাগিলেন। অবশেষে অবসর পাইকমাত্র আচার্য্য অর্দ্ধচন্দ্রবাণে সত্যজিতের মস্তকচ্ছেদন করিলেন। তখন অর্জ্জুনের উপদেশক্রমে যুধিষ্ঠির জয়শীল আচার্য্যের সম্মুখে অবস্থান না করিয়া যুদ্ধক্ষেত্র হইতে প্রস্থান করিলেন।

 যুধিষ্ঠিরকে প্রাপ্ত না হইয়া দ্রোণ ক্রোধভরে রণক্ষেত্রে বিচরণপূর্ব্বক বহুসংখ্যক পাঞ্চালকে বিনষ্ট করিলেন। ইত্যবসরে অর্জ্জুন ভগদত্তকে সংহারান্তে পথিমধ্যে অসংখ্য কৌরবসৈন্য বিনষ্ট করিয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইলে পাণ্ডবগণ নবোৎসাহ-লাভপূর্ব্বক একান্ত দুর্দ্ধর্ষ হইয়া উঠিলে সেই সময়ে দ্রোণ-সৈন্য ক্ষণমাত্রও তাঁহাদের সমক্ষে অবস্থান করিতে সক্ষম হইল না। দ্রোণাচার্য্য চতুর্দ্দিক্ হইতে আক্রান্ত হইয়া বিফল মনোরথে তথা হইতে প্রস্থান করিলেন। তখন দুর্য্যোধন স্বপক্ষকে নিতান্ত হাস্যাস্পদ হইতে দেখিয়া আচার্য্যের অনুমতিক্রমে অবহারের আদেশ প্রদান করিলেন।

 অনন্তর পরদিন প্রভাতে তাবশিষ্ট ত্রিগর্ত্তগণ পুনরায় অর্জ্জুনকে রণক্ষেত্রের বহির্দ্দেশে আহ্বান করিয়া তাঁহার সহিত ঘোর সমরে ব্যাপৃত হইলেন। সেই সময়ে দ্রোণ তাঁহার বাক্যানুসারে দুর্ভেদ্য ব্যূহ রচনাপূর্ব্বক অপ্রতিহত গতিতে পাণ্ডবগণের প্রতি আগমন করিলেন।

 অনন্তর রাজা যুধিষ্ঠির আচার্য্যকে দুর্দ্দান্তভাবে আগমন করিতে দেখিয়া শঙ্কিতমনে উপায় চিন্তা করিতে লাগিলেন। দ্রোণকৃত দুর্ভেদ্য চক্রব্যূহ প্রবেশে আর কাহাকেও সক্ষম না দেখিয়া অবশেষে তিনি অর্জ্জুন-সমতেজা অভিমন্যুর উপর এই দুর্ব্বহভার সমর্পণ করিয়া কহিলেন―

 বৎস! আমরা কিরূপে এই চক্রব্যূহ ভেদ করিব কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। এক্ষণে অর্জ্জুন প্রত্যাগমন করিয়া যাহাতে আমাদিগকে নিন্দা করিতে না পারেন, তুমি সেইরূপ অনুষ্ঠান কর।

 অভিমন্যু কহিলেন―হে আর্য্য! আমি এই ব্যূহপ্রবেশের কৌশল জ্ঞাত আছি বটে, কিন্তু ইহা হইতে নির্গমনের উপায় অবগত নহি; অতএব প্রজ্বলিত হুতাশনে পতঙ্গ-প্রবেশের ন্যায় এই বিপদাবহ কার্য্যে কি গমন করা কর্ত্তব্য?

 তখন যুধিষ্ঠির কহিলেন―

 বৎস! তুমি ব্যূহ একবার ভেদ করিলে আমরা সকলেই তোমার পশ্চাতে প্রবিষ্ট হইয়া তােমাকে রক্ষা ও কৌরবগণকে বিনষ্ট করিব; অতএব তুমি আমাদিগকে শক্রমধ্যে প্রবেশের দ্বার করিয়া দাও।

 মহাবীর অভিমন্যু এইরূপে অভিহিত হইয়া সারথিকে কহিলেন—

 হে সুমিত্র! তুমি অবিলম্বে দ্রোণ-সৈন্যাভিমুখে রথ চালনা কর।

 অভিমন্যু বারম্বার এই আদেশ করিলে সারথি কহিল―

 হে আয়ুষ্মন্! আপনি অতি গুরুভার গ্রহণ করিতেছেন। এরূপ দুঃসাহস আপনার উচিত হইতেছে কি না তাহা বিশেষ বিবেচনাপুর্ব্বক যুদ্ধে প্রবৃত্ত হৌন।

 তখন অর্জ্জুন-নন্দন হাসিয়া কহিলেন—

 ক্ষত্রিয়-পরিবৃত দ্রোণের কথা দূরে থাক্, আমি ঐরাবত সমারূঢ় ত্রিদশাধিপতির সহিত যুদ্ধ করিতে পশ্চাৎপদ হই না; অতএব তুমি অবিলম্বে রথচালনা কর।

 সারথির বাক্য এইরূপে অনাদৃত হইলে সে অতিশয় উদ্বিগ্ন -চিত্তে সুবর্ণ-মণ্ডিত পিঙ্গল-বর্ণ অশ্বগণকে দ্রোণ-সৈন্যাভিমুখে চালনা করিল। পাণ্ডব-বীরগণও অভিমন্যুকে অনুসরণ করিতে লাগিলেন। ভাগীরথীর স্রোতের সমুদ্র প্রবেশের ন্যায় দ্রোণ-সৈন্যের সহিত অভিমন্যুর সমাগম অতি তুমুল হইয়া উঠিল। তথাপি তিনি অনায়াসে দ্রোণের সমক্ষেই ব্যূহভেদপুর্ব্বক তন্মধ্যে প্রবেশ করিলেন।

 কিন্তু তাঁহার অনুগমনে প্রবৃত্ত পাণ্ডবগণ জয়দ্রথকর্ত্তৃক ব্যূহ দ্বারেই নিবারিত হইলেন। সমবেত প্রযত্ন সত্ত্বেও তাঁহারা কিছুতেই দৈববলে বলীয়ান সিন্ধুরাজকে অতিক্রম করিতে সমর্থ হইলেন না। সেই সুযোগে কৌরবগণ পুনরায় দৃঢ়-ব্যূহিত হইয়া চতুর্দ্দিক্‌ হইতে অভিমন্যুকে বেষ্টন করিলেন।

 অনন্তর দুর্য্যোধন প্রথমে অর্জ্জুন-তনয়কে প্রহার করিতে আরম্ভ করিলেন, কিন্তু সে মহাবীরের প্রতাপ শীঘ্রই তাঁহার পক্ষে অসহ্য হইয়া উঠিলে দ্রোণাচার্য্য, অশ্বত্থামা, কৃপ, কর্ণ, শল্য ও কৃতবর্ম্মা অভিমন্যুকে নিবারিত করিয়া দুর্য্যোধনকে মুক্ত করিলেন। আস্যদেশ হইতে এইরূপে গ্রাস আচ্ছিন্ন হওয়া অভিমন্যুর সহ্য হইল না; তিনি শরজালে সকলের অশ্ব ও সারথিকে ব্যথিত করিয়া মহারথগণকে পরাঙ্মুখ করিয়া সিংহনাদ করিতে লাগিলেন।

 পরে সন্নিহিত শল্যকে শরনিকরে গাঢ়তর বিদ্ধ করিয়া তাঁহাকে মূর্চ্ছাপন্ন করিলেন। তদ্দর্শনে সৈন্যগণ সিংহনিপীড়িত মৃগের ন্যায় পলায়ন করিতে লাগিল। শল্যের কনিষ্ঠ ভ্রাতা জ্যেষ্ঠকে ব্যথিত দেখিয়া অভিমন্যুকে আক্রমণ করিলে লঘুহস্ত অর্জ্জুন-তনয় এককালে তাঁহাকে, তাঁহার সারথিকে এবং চক্ররক্ষক-দ্বয়কে সংহার করিলেন।

 তখন বহুসংখ্যক যােদ্ধা কেহ অশ্বে কেহ রথে কেহ গজে একসঙ্গে অভিমন্যুকে আক্রমণ করিলে তিনি কিছুমাত্র শঙ্কিত না হইয়া হাস্যমুখে তাহাদের মধ্যে যে অগ্রসর হইল, তাঁহাকেই নিপাতিত করিলেন।

 পরে মহাবীর অর্জ্জুন-নন্দন সমরাঙ্গণে পরিভ্রমণ করিয়া দ্রোণ, কর্ণ, কৃপ, শল্যপ্রভূতি ভূপতিগণকে বাণ-বিদ্ধ করিতে আরম্ভ করিলে তাঁহার লঘুচারিত্বপ্রযুক্ত তাঁহাকে একই সময়ে চতুর্দ্দিকে বর্ত্তমান বলিয়া বােধ হইতে লাগিল। দুর্য্যোধন ক্রুদ্ধ হইয়া কহিতে লাগিলেন—

 হে ভূপগণ! দেখ, শিষ্য-পুত্র অভিমন্যুকে আচার্য্য স্নেহবশত নিধন করিতে ইচ্ছা করিতেছেন না। তিনি বধােদ্যত হইলে এই বালক কখনই নিস্তার পাইত না। অর্জ্জুন-পুত্র দ্রোণকর্ত্তৃক রক্ষিত হইয়া আপনাকে বীর্য্যবান্ জ্ঞান করিতেছে; অতএব এই পৌরুষাভিমানী মূঢ়কে শীঘ্র সংহার কর।

 এই বাক্য শ্রবণে দুঃশাসন দর্পভরে কহিলেন—

 যেমন রাহু দিবাকরকে গ্রাস করে, আমি তদ্রূপ সকলের সমক্ষেই অভিমন্যুকে সংহার করিব।

 এই বলিয়া তিনি উচ্চৈঃস্বরে ধ্বনি করিয়া ক্রোধভরে অভিমন্যুর উপর শরবর্ষণ করিতে লাগিলেন। অনন্তর সেই রথ-যুদ্ধ-বিশারদ বীরদ্বয় দক্ষিণে ও বামে বিচিত্র মণ্ডলাকারে বিচরণপূর্ব্বক সংগ্রাম আরম্ভ করিলেন। মহাবীর অভিমন্যু কহিলেন―

 অদ্য আমি সৌভাগ্যক্রমে সমরে তােমাকে সম্মুখীন দেখিলাম। আমার পিতৃব্যগণকে যে কটুবাক্যসকল কহিয়াছিলে এক্ষণে আমি তাহার প্রতিশোধ লইব।

 এই বলিয়া দুঃশাসনের বিনাশ নিমিত্ত অর্জ্জুন-নন্দন অগ্নির ন্যায় তেজঃসম্পন্ন ভীষণ বাণ নিক্ষেপ করিলেন। মহাবাহু দুঃশাসন তাহাতে গাঢ় বিদ্ধ হইয়া রথােপরি শয়ান ও মূর্চ্ছিত হলেন। তাঁহার সারথি তাঁহাকে তদবস্থ দেখিয়া রণস্থল হইতে অপসৃত করিল।

 তখন ধার্ত্তরাষ্ট্রগণের পরম হিতকারী মহাধনুর্দ্ধর কর্ণ ক্রোধান্বিতচিত্তে সুতীক্ষ্ণ সায়কদ্বারা অভিমন্যুকে বিদ্ধ করিলেন। কিন্তু অর্জ্জুন-তনয় কিছুমাত্র বিচলিত না হইয়া কর্ণকে বহুসংখ্যক শরে বিদ্ধ করিয়া সম্মুখীন সমগ্র রথিগণকে অতিশয় ব্যথিত করিলেন; ফলত কেহই তাঁহার কোরবসৈন্য-দলন নিবারণ করিতে পারিলেন না। অভিমন্যুবিক্ষিপ্ত বিষম বিশিথসকল রথ ভগ্ন এবং নাগ ও অশ্বসমুদায় নিধন করিতে লাগিল। আয়ুধ অঙ্গুলীত্র ও অঙ্গদ-সমন্বিত হেমাভরণ-ভূষিত ছিন্ন বাহু ও মাল্যকুণ্ডল-সমলঙ্কৃত নরমস্তকসকল ধরাতলে নিপতিত হইতে থাকিল।

 ওদিকে সৈন্যগণ দেখিয়া স্তম্ভিত হইয়া রহিল যে, পাণ্ডবগণ ধৃষ্টদ্যুম্ন বিরাট দ্রুপদ প্রভৃতি মহারথগণ-রক্ষিত হইয়া ও যতবার অভিমন্যুকে রক্ষা করিবার জন্য সেই চক্রব্যূহ প্রবেশের চেষ্টা করিলেন, ততবার একাকী সিন্ধুরাজ জয়দ্রথ, অভিমন্যু-বিদারিত ব্যূহদ্বার অবরুদ্ধ রাখিয়া তাঁহাদিগকে নিবারণ করিলেন। অবশেষে অবসর-প্রাপ্ত কৌরবগণ কর্ত্তৃক সেই চক্রব্যূহ পুনরায় দৃঢ়বদ্ধ হইলে তাহাদের প্রবেশের আশা সম্পূর্ণ তিরােহিত হইল। সুতরাং শেষ পর্য্যন্ত অরক্ষিত অর্জ্জুন-নন্দন একাকী সমুদ্রমধ্যস্থিত মকরের ন্যায় সেই সুমহৎ সৈন্যদলকে বিক্ষোভিত করিতে লাগিলেন।

 ক্রমে তিনি যখন একান্ত দুর্দ্ধর্ষ হইয়া উঠিয়া কর্ণাদি বীরগণকে বারম্বার নিবারণপূর্ব্বক দুর্য্যোধনের পুত্র লক্ষণ, মদ্ররাজনন্দন রুক্মরথ-প্রভৃতি বহুসংখ্যক রাজকুমার ও মহারথ কোশলাধিপতি বৃহদ্বলকে সংহার করিলেন, তখন কৌরবগণ অতিশয় উদ্বিগ্ন হইয়া দ্রোণাচার্য্যের শরণাপন্ন হইলেন।

 কর্ণ কহিলেন—হে ব্রহ্মন্! আপনি অবিলম্বে ইহার উপায় না করিলে অর্জ্জুন-পুত্র আমাদের সকলকেই একে একে সংহার করিবে।

 আচার্য্য প্রীতমনে প্রিয়শিষ্যপুত্রের সমর-পরাক্রম অবলােকন করিতেছিলেন, তিনি কহিলেন―

 হে বীরগণ! তোমরা কি এপর্য্যন্ত অভিমন্যুকে একবারও বিশ্রাম করিতে দেখিয়াছ? অর্জ্জুন-তনয়ের লঘুচারিত্ব অবলোকন কর। কৌরবমহারথগণ যে ক্রোধপরবশ হইয়াও উহাকে ব্যথিত করিবার অণুমাত্র অবসর প্রাপ্ত হইতেছেন না, ইহাতে আমি শিষ্যপুত্রের প্রতি একান্ত প্রসন্ন হইয়াছি। উহার শরজালে আমি ব্যথিত হইয়াও সন্তুষ্ট হইতেছি।

 কর্ণ কহিলেন―হে আচার্য্য। সমর পরিত্যাগ করা নিতান্তই লজ্জাকর বলিয়াই আমি এস্থানে এখনও অবস্থান করিতেছি। এই মহাতেজা অর্জ্জুন-কুমারের দারুণ শরনিকরে আমার শরীর অতিশয় দগ্ধ হইয়াছে।

 তখন মহাবীর দ্রোণাচার্যয় হাস্যসহকারে কহিলেন―

 হে রাধেয়। এই অভিমন্যুর কবচ অভেদ্য। উহার বন্ধনকৌশল আমিই উহার পিতাকে শিক্ষা দিয়াছিলাম; অতএব তোমরা বৃথা বাণ-বর্ষণ করিতেছ। যদি উহাকে পরাজয় করিবার বাসনা থাকে, তবে দ্বৈরথ-যুদ্ধ পরিত্যাগ করিয়া তোমরা সম্মিলিত হইয়া প্রথমে উহাকে নিরস্ত্র ও বিরথ কর, পশ্চাৎ সংগ্রাম করিও। উহার হস্তে অস্ত্র থাকিতে উহাকে পরাজয় করা তোমাদের সাধ্য নয়।

 দ্রোণ-বাক্য শ্রবণমাত্র সকলে সত্বর একত্র হইয়া কেহ অভিমন্যুর ধনু, কেহ অশ্ব, কেহ সারথি, কেহ কেহ উহার নিক্ষিপ্ত অস্ত্রসমুদায় ছেদন করিতে—দ্রোণ, কর্ণ, কৃপ, অশ্বত্থামা ও কৃতবর্ম্মা কারুণ্যশূন্য হইয়া এককালে সেই বালককে প্রহার করিতে আরম্ভ করিলেন।

 তখন অভিমন্যু খড়্গচর্ম্ম-ধারণপূর্ব্বক অশ্বহীন রথ হইতে লম্ফ প্রদান করিলে দ্রোণ তাঁহার খড়্গ ও কর্ণ তাঁহার চর্ম্ম ছেদন করিলেন। একে একে সকল অস্ত্র বিনষ্ট হইলে অভিমন্যু নির্ভীকচিত্তে একমাত্র অবশিষ্ট চক্র ধারণপূর্ব্বক দ্রোণের প্রতি ধাবিত হইলেন। সেই সময়ে বীরগণ-পরিবৃত শোণিতানুলিপ্ত-কলেবর অপ্রাপ্তবয়স্ক কুমার অপূর্ব্বরূপ ধারণ করিলেন। ভূপতিগণ সেই অলৌকিক তেজোদীপ্তি সন্দর্শনে উদ্বিগ্ন হইয়া সমবেত অস্ত্রবর্ষণদ্বারা সেই চক্র খণ্ড খণ্ড করিলেন।

 সেই অবসরে দুঃশাসনপুত্র গদাহস্তে তাঁহার উপর নিপতিত হইয়া তাঁহার মস্তকে গদাঘাত করিল। সেই অকস্মাৎ আঘাতে তরুশ্রেণী মর্দ্দনান্তর নিবৃত্ত সমীরণের ন্যায় হন্ত্যশ্বরথসহ অসংখ্য বীর নিপাতনান্তে সেই পূর্ণচন্দ্রনিভানন অভিমন্যু ভূ-বিলুণ্ঠিত হইয়া প্রাণত্যাগ করিলেন।

 তখন কৌরব সৈন্যমধ্যে মহা হর্ষধ্বনি উত্থিত হইয়া গগনভেদ করিলে পাণ্ডবগণ এই শোচনীয় ঘটনা পরিজ্ঞাত হইলেন। সৈন্যগণ অতিশয় ভীত হইয়া যুধিষ্ঠিরের সমক্ষেই পলায়নের উপক্রম করিল। যুধিষ্ঠির কহিলেন—

 হে বীরগণ! মহাবাহু অভিমন্যু একাকী বহু সৈন্যমধ্যে পতিত হইলেও সমরে পরাঙ্মুখ না হইয়া ক্ষত্রিয়ের পরমগতি লাভ করিয়াছেন। তোমরা তাঁহার দৃষ্টান্ত অনুসরণ কর, পলায়ন করিও না।

 এই বাক্যে লজ্জিত হইয়া পাণ্ডব-যোদ্ধৃগণ দুর্দ্দান্তবেগে কৌরবগণকে আক্রমণপূর্ব্বক বিমুখ করিলেন। এই সময় দিন ও রজনীর সন্ধিস্থল উপস্থিত হইলে মরীচিমালী অস্ত্রসকলের প্রভাহরণপূর্ব্বক রক্তোৎপলতুল্য কলেবরে অস্তাচলচূড়া অবলম্বন করিলেন। তখন উভয়পক্ষ সমরব্যায়ামে একান্ত অবসন্ন হওয়ায় সংগ্রামস্থল দেখিতে দেখিতে জনশূন্য হইল।

 পাণ্ডববীরগণ অতিশয় বিষণ্ণ-চিত্তে রথ কবচ ও শরাসন পরিত্যাগপূর্ব্বক অভিমন্যুর চিন্তায় ভারাক্রান্ত অন্তঃকরণে যুধিষ্ঠিরের চতুর্দ্দিকে উপবিষ্ট হইলেন। ধর্ম্মরাজ অতিশয় কাতর মনে বিলাপ করিতে লাগিলেন―

 হায়! মহাবীর অভিমন্যু আমারই নিয়োগে শত্রুব্যূহমধ্যে একাকী প্রবেশপূর্ব্বক প্রাণত্যাগ করিল। সেই বালকের প্রতি দুঃসহ ভারার্পণ করিয়া তাহাকে রক্ষা করিতে সমর্থ হইলাম না। অদ্য আমি কিরূপে ধনঞ্জয় ও পুত্রবৎসলা সুভদ্রাকে অবলােকন করিব? আজি জয়লাভ, রাজ্যলাভ বা স্বর্গলাভ কিছুই আর প্রীতিজনক বােধ হইতেছে না।

 লােক-ক্ষয়কর সে ভয়ানক দিনের অবসানে মহাবীর অর্জ্জুন দিব্যাস্ত্রজালে ত্রিগর্ত্তগণকে নিঃশেষে সংহার করিয়া স্বীয় জয়শীল রথে আরােহণপূর্ব্বক বাসুদেবের সহিত যুদ্ধবৃত্তান্ত আলােচনা করিতে করিতে শিবিরে উপস্থিত হইলেন। সেনানিবেশ নিরানন্দ ও শ্রী-ভ্রষ্ট দেখিয়া অর্জ্জুন উদ্বিগ্ন-চিত্তে কহিতে লাগিলেন―

 হে জনার্দ্দন! আজি মঙ্গলতুর্য্য-নিস্বন ও দুন্দুভি-নাদসহ শঙ্খধ্বনি হইতেছে না কেন? যোদ্ধৃগণও আমাকে দেখিয়া অধােমুখে ইতস্তত পলায়ন করিতেছে। হে নাধব! কোন ঘোরতর বিপদ উপস্থিত হয় নাই ত?

 এইরূপ কথােপকথনে কৃষ্ণ ও অর্জ্জুন শিবিরে প্রবেশ করিয়া দেখিলেন যে, পাণ্ডবগণ নিতান্ত বিমর্ষ ও বিচেতনপ্রায় হইয়া বসিয়া আছেন। দুর্ম্মনায়মান ধনঞ্জয় শিবিরমধ্যে ভ্রাতা ও পুত্রগণের সকলকেই অবলোকন করিলেন। কিন্তু অভিমন্যুকে দেখিতে পাইলেন না। তখন তিনি ব্যাকুলকণ্ঠে কহিলেন—

 হে বীরগণ! তোমাদের সকলেরই মুখ বিবর্ণ দেখিতেছি এবং তোমরা কেহই আমাকে আজি অভিনন্দন করিতেছ না। বৎস অভিমনু কোথায়? সে অদীনাত্মা প্রত্যহ প্রত্যুদ্গমনপূর্ব্বক আমাকে অভ্যর্থনা করে। আজ আমি শত্রু-সংহার করিয়া আগমন করিতেছি; কিন্তু সে কেন হাস্যমুখে আমাকে সম্ভাষণ করিতেছে না? শুনিলাম, আজ আচার্য্য চক্রব্যূহ নির্ম্মাণ করিয়াছিলেন, তোমরা অভিমন্যুকে তাহার মধ্যে প্রবিষ্ট হইতে দাও নাই ত? এ ব্যূহ সে ভেদ করিতে জানে মাত্র, আমি তাহাকে নিষ্ক্রমণের কৌশল উপদেশ করি নাই।

 অনন্তর সকলকে নিরুত্তর দেখিয়া অর্জ্জুন প্রকৃত ব্যাপার বুঝিতে পারিয়া অসহ্য-শােকে বিলাপ করিতে লাগিলেন―

 হা পুত্র! তােমাকে বার বার নিরীক্ষণ করিয়াও তৃপ্ত হইতাম না, এক্ষণে কাল এই ভাগ্যহীনের নিকট হইতে তােমাকে হরণ করিল। আমার হৃদয় বজ্রসারবৎ কঠিন সন্দেহ নাই, এইজন্যই সে দীর্ঘবাহুর অদর্শনে এখনও ইহা বিদীর্ণ হইতেছে না। এক্ষণে বুঝিলাম কি নিমিত্ত গর্ব্বিত ধার্ত্তরাষ্ট্রগণ সিংহনাদ করিতেছিল। কৃষ্ণ আগমনকালে কৌরবগণের প্রতি যুযুৎসুর এই তিরস্কার-বাক্য শ্রবণ করিয়াছিলেন—

 হে অধার্ম্মিকগণ! তোমরা অর্জ্জুনকে পরাজয় করিতে অসমর্থ হইয়া এক বালকের প্রাণসংহার করিয়া বৃথা আনন্দিত হইতেছ।

 মহাত্মা বাসুদেব ধনঞ্জয়কে পুত্রশোকে নিতান্ত কাতর দেখিয়া তাহার সান্ত্বনার্থে কহিলেন―

 হে ধনঞ্জয়! এরূপ ব্যাকুল হইও না। শূরগণের এই গতিই বাঞ্ছনীয়। অভিমন্যু বীরজনাকাঙ্ক্ষিত দিব্য লোক প্রাপ্ত হইয়াছে সন্দেহ নাই। তোমার ভ্রাতা ও বন্ধুগণ তোমার শোক সন্দর্শনে একান্ত সন্তপ্ত ও অভিভূত হইতেছেন; অতএব তুমি আত্মসংযমপূর্ব্বক তাহাদিগকে আশ্বস্ত কর।

 কিয়ৎক্ষণ এইরূপে অভিমন্যু-বধ-সংক্রান্ত ঘটনাবলী চিন্তা করিতে করিতে ক্রমে তিনি ক্রোধে অধীর হইয়া উঠিলেন। তখন করে কর নিপীড়ন ও উন্মত্তের ন্যায় দৃষ্টিপাতপুর্ব্বক যুধিষ্ঠিরকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন—

 মহারাজ! আমি প্রতিজ্ঞা করিতেছি, কালই জয়দ্রথকে বিনাশ করিব! সে পাপাত্মা আমাদের পূর্ব্ব সদ্ব্যবহার বিস্মৃত হইয়া দুর্য্যোধনের পক্ষ অবলম্বনপূর্ব্বক এই শোচনীয় দুর্ঘটনার হেতুস্বরূপ হইয়াছে; অতএব কালই তাহাকে সংহার করিব।

 ―হে পুরুষশ্রেষ্ঠগণ! আমি যাহা কহিলাম, যদি তাহা অনুষ্ঠান না করি, তবে আমি যেন পুণ্যলব্ধ লোক প্রাপ্ত না হই। যদি জয়দ্রথকে বধ করিতে না পারি, তবে যেন বিশ্বাসঘাতী মাতৃপিতৃহন্তার গতি লাভ করি। যদি কাল পাপাত্মা জয়দ্রথ জীবিত থাকিতে দিবাকর অস্তগত হয়, তবে এই স্থানে তোমাদের সমক্ষে আমি প্রজ্জ্বলিত হুতাশনে প্রবিষ্ট হইব।

 মহাবীর ধনঞ্জয় এই প্রতিজ্ঞা করিয়া বামে ও দক্ষিণে গাণ্ডীব শরাসন নিক্ষেপ করিলে সেই শব্দ গগন স্পর্শ করিল। বাসুদেব সুগভীর পাঞ্চজন্য শঙ্খধ্বনি করিয়া সেই ভীষণ প্রতিজ্ঞা সমর্থন করিলেন। তখন অর্জ্জুনও দেবদত্ত শঙ্খধ্বনি করিলেন এবং চতুর্দ্দিকে সৈন্যমধ্য হইতে সহস্র বাদ্যধ্বনি ও সিংহনাদ প্রাদুর্ভুত হইল।

 কৌরবগণ চরদ্বারা এই মহাশব্দের কারণ অবগত হইলে সিন্ধুরাজ ভয়ে বিমুগ্ধচিত্ত হইয়া অনেকক্ষণ চিন্তার পর অবশেষে সভায় গমনপূর্ব্বক কহিলেন―

 হে ভূপালগণ! ধনঞ্জয় আমাক শমন করিবার সঙ্কল্প করিতেছেন; অতএব হয় আপনারা আমাকে রক্ষা করিবার সমুচিত ব্যবস্থা করুন; না হইলে, আপনাদের মঙ্গল হৌক। আমি স্বস্থানে প্রস্থানপূর্ব্বক প্রাণরক্ষা করি।

 জয়দ্রথ ভয়ব্যাকুলিত-চিত্তে এরূপ কহিলে, কার্য্য সাধন তৎপর দুর্য্যোধন কহিলেন―

 হে সিন্ধু রাজ! ভীত হইও না। এই সকল বীরগণের মধ্যে তুমি অবস্থান করিলে কেহ তােমার অনিষ্টসাধনে সক্ষম হইবে না। আমার একাদশ অক্ষৌহিণী কল্য তােমারই রক্ষার নিমিত্ত যত্ন করিবে। কর্ণ, ভূরিশ্রবা, শল্য, সুদক্ষিণ, দ্রোণ, অশ্বত্থামা, শকুনি প্রভৃতি বীরগণ তোমার চতুর্দ্দিকে অবস্থান করিবেন। তুমি স্বয়ংও রথিশ্রেষ্ঠ; অতএব অর্জ্জুনকে ভয় করিবার কোনই কারণ নাই।

 জয়দ্রথ এইরূপে দুর্য্যোধনকর্ত্তৃক আশ্বাসিত হইয়া তাঁহার সহিত দ্রোণাচার্য্যের নিকট গমনপূর্বক তাঁহার শরণাপন্ন হইলেন; তখন দ্রোণ জয়দ্রথকে অভয় প্রদানপূর্ব্বক কহিলেন―

 হে রাজন! আমি তোমাকে অর্জ্জুন-ভয় হইতে পরিত্রাণ করিব, সন্দেহ নাই। আমি তােমার রক্ষার নিমিত্ত এমন এক ব্যূহ প্রস্তুত করিব, যাহা অর্জ্জুন কদাচ উত্তীর্ণ হইতে পারিবেন না, অতএব ভীত হইও না, যুদ্ধে প্রবৃত্ত হও।

 দ্রোণের বাক্যে শঙ্কাশূন্য হইয়া জয়দ্রথ যুদ্ধে কৃতসঙ্কল্প হইলেন। তখন সমুদায় কৌরবসৈন্য হৃষ্টচিত্তে সিংহনাদও বাদিত্র-বাদন করিতে আরম্ভ করিল।

 সে রজনী প্রভাত হইলে মহাবীর দ্রোণাচার্য্য স্বয়ং অশ্বসঞ্চালনপূর্ব্বক প্রলয়বেগে পরিভ্রমণ করিয়া ব্যূহরচনা করিতে লাগিলেন। অনন্তর সৈন্যগণ যথাস্থানে সন্নিবেশিত হইলে তিনি জয়দ্রথকে কহিলেন―

 ―হে সিন্ধুরাজ! তুমি, কর্ণ, অশ্বথাম, কৃপ ও শতসহস্র চতুরঙ্গিণী সেনায় রক্ষিত হইয়া আমার ছয় ক্রোশ পশ্চাতে অবস্থান কর। শ্রেষ্ঠ বীরগণ স্ব-স্ব-সৈন্যবিভাগ লইয়া মধ্যস্থল রক্ষা করিবেন। আমাকে অতিক্রমপূর্ব্বক এই বীরশ্রেণী ভেদ করিয়া সূর্য্যাস্তের পূর্ব্বে তোমাকে প্রাপ্ত হওয়া পাণ্ডবগণের কথা দূরে থাক, দেবগণেরও অসাধ্য হইবে।

 জয়দ্রথ দ্রোণকর্ত্তৃক এইরূপে আশ্বাসিত হইয়া গান্ধারদেশীয় যোদ্ধা ও বর্ম্মধারী অশ্বারোহগণ-সমভিব্যাহারে আচার্য্যনির্দ্দিষ্ট স্থানে গমন করিলেন। ধৃতরাষ্ট্রপুত্র দুঃশাসন ও দুস্মর্ষণ সর্ব্বাগ্রগ্রামী সৈন্য মধ্যে রহিলেন। তৎপশ্চাতে দ্রোণ শকটাকারে সৈন্যের সংস্থানপূর্ব্বক ব্যূহ রচনা করিয়া স্বয়ং সেই ব্যূহমুখে অবস্থান করিলেন। তৎপশ্চাতে জয়দ্রথের নিকট গমনের পথ রোধ করিয়া ভোজরাজ কুতবর্ম্মা ও কাম্বোজরাজ সুদক্ষিণ এই শকট ব্যুহের চক্রাকারে স্ব স্ব সৈন্যবিভাগ সন্নিবেশিত করিলেন।

 এই সুবৃহৎ ব্যূহের পশ্চাতে বহুযোজন ব্যবধানে সূচি নামক অপর এক গূঢ় ব্যূহ রক্ষিত হইল। ইহার মধ্যে কর্ণ দুর্য্যোধন শল্য কৃপ প্রভৃতি বীরগণ জয়দ্রথকে আচ্ছাদন করিয়া অবস্থিত হইলেন। এই অদ্ভুত কৌশলযুক্ত ব্যূহদ্বয় করিয়া কৌরবগণ জয়দ্রথকে রক্ষিত ও অর্জ্জুনকে প্রতিজ্ঞানুসারে চিতানলে দগ্ধ বলিয়া নিশ্চয় করিলেন।

 অনন্তর পাণ্ডবসৈন্য প্রতিব্যূহিত হইলে অর্জ্জুন যুধিষ্ঠিরের রক্ষার্থে উপযুক্ত ব্যবস্থা করিয়া কহিলেন―

 হে বাসুদেব! যেখানে দুস্মর্ষণ অবস্থান করিতেছে, সেই স্থানে প্রথমত রথ লইয়া চল। আমি ঐ গজ-সৈন্য ভেদ করিয়া অরি-ব্যূহমধ্যে প্রবিষ্ট হইব।

 মহাবাহু কৃষ্ণ এই বাক্য অনুসারে রথচালনা করিলে অর্জ্জুনের সহিত কৌরবগণের ভীষণ সংগ্রাম সমুপস্থিত হইল। মেঘ যেমন পর্ব্বতোপরি বারি বর্ষণ করে, মহাবীর অর্জ্জুন তদ্রূপ অরাতিগণের উপর শরবর্ষণ করিতে আরম্ভ করিলেন। তাহাতে অসংখ্য রথী পদাতি ও মাতুঙ্গ বিনষ্ট হইলে কৌররযোদ্ধৃগণ হতোৎসাহ ও পলায়নপর হইল।

 তখন দুঃশাসন ভ্রাতার সৈন্য-বিভাগকে তদবস্থ দেখিয়া ক্রোধভরে অর্জ্জুনাভিমুখে গমনপূর্ব্বক গজসৈন্যদ্বারা তাহাকে বেষ্টন করিলেন। ক্ষত্রিয়শ্রেষ্ঠ ধনঞ্জয় সায়ক দ্বারা তাহাদের কলেবর ছিন্ন ভিন্ন করিতে করিতে সেই উত্তাল তরঙ্গ-সঙ্কুল মহাসাগরের ন্যায় ক্ষুদ্র শত্রুদল ভেদ করিয়া তন্মধ্যে প্রবেশপুর্ব্বক সন্নতপর্ব্ব ভল্লদ্বারা গজারূঢ় পুরুষগণের মস্তকচ্ছেদন করিতে লাগিলেন।

 এইরূপে কতকগুলি গজ ভূপতিত ও কতকগুলি আরোহিহীন হইয়া সৈন্যমধ্যে ভ্রমণ করিতে আরম্ভ করিলে সৈন্যগণ পুনরায় পলায়নের উপক্রম করিল। দুঃশাসনও পার্থশরে জর্জ্জরিতাঙ্গ হইয়া দ্রোণ-রক্ষিত ব্যূহমধ্যে আশ্রয় লইলেন।

 তখন অর্জ্জুন সেই শকটাকার ব্যূহ-মুখ প্রাপ্ত হইয়া আচার্য্যের সহিত সম্মিলিত হইলেন। তিনি প্রথমত বিনীতভাবে গুরুর নিকট ব্যূহপ্রবেশের অনুমতি চাহিলে দ্রোণ হাস্যসহকারে কহিলেন―

 হে অর্জ্জুন! তুমি অগ্রে আমাকে জয় না করিয়া কদাচ জয়দ্রথকে প্রাপ্ত হইতে পারিবে না।

 এই বলিয়া দ্রোণ তীক্ষ্ণ শরজালে অর্জ্জুনকে আচ্ছাদন করিলে তিনি গুরুর সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলেন। উভয় বীর হস্তলাঘব প্রদর্শনপূর্ব্বক পরস্পরের অস্ত্র নিবারণ জ্যাচ্ছেদন ও এককালে বহু অস্ত্রবর্ষণ করিয়া বহুক্ষণ অতি আশ্চর্য্য কৌশলযুক্ত যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। তখন ধীমান্ বাসুদেব প্রকৃত কার্য্যসাধনের প্রতি দৃষ্টি রাখিয়া অর্জ্জুনকে কহিলেন―

 হে মহাবাহো! আমাদের আর কালক্ষেপ করা উচিত হয় না। আচার্য্যের সহিত বহুক্ষণ যুদ্ধ করা হইয়াছে; অতএব চল উঁহাকে অতিক্রম করিয়া ব্যূহ-প্রবেশ করি।

 অর্জ্জুন এই কথায় সম্মত হইলে কৃষ্ণ দ্রোণকে প্রদক্ষিণপূর্ব্বক মহাবেগে তাঁহাকে লঙ্ঘন করিয়া ব্যূহ-মধ্যে ধাবমান হইলেন। দ্রোণাচার্য্য তাঁহাকে অবরােধ করিবার অক্ষমতা অনুভব করিয়া কহিলেন―

 হে পার্থ! তুমি না শত্রু পরাজয় না করিয়া কদাচ নিবৃত্ত হও না। তবে এক্ষণে কোথায় পলায়ন করিতেছ?

 জয়দ্রথ-বধোৎসুক ধনঞ্জয় কহিলেন―

 হে আচার্য্য। আপনি আমার গুরু, শত্রু নহেন; সুতরাং আমার সে নিয়ম আপনার সম্বন্ধে খাটে না।

 এই বলিয়া তিনি যুধামন্যু এবং উত্তমৌজা এই দুই চক্ররক্ষক লইয়া বিশাল শত্রু-সেনামধ্যে প্রবেশ করিলেন।

 তখন কাম্বোজ ও ভােজরাজ অর্জ্জুনকে নিবারণ করতে আরম্ভ করিলেন। প্রতাপশালী পাণ্ডুতনয়ের বিষম বিশিখপ্রভাবে অশ্বসকল গাঢ় বিদ্ধ, রথসমুদয় ছিন্ন ভিন্ন এবং আরােহী সমেত কুঞ্জরগণ ভূতলে নিপতিত হইতে লাগিল। বহু যােদ্ধার সহিত একাকী সংগ্রাম করিতে বাধ্য হওয়ায় অর্জ্জুনের গতিরোধ হইতেছে অবলােকন করিয়া তাঁহার উত্তেজনার্থে কৃষ্ণ কহিলেন―

 হে পার্থ! তােমার আর এই বীরগণের প্রতি দয়া করিবার প্রয়ােজন নাই। আমাদের অদ্যকার নির্দদিষ্ট কার্য্যের জন্য অল্পমাত্র সময় অবশিষ্ট আছে।

 এই কথায় অর্জ্জুন মহাবেগে বাণবর্ষণ আরম্ভ করিলে কৃতবর্ম্মা ও সুদক্ষিণ মূর্চ্ছিতপ্রায় হইলেন, সেই অবসরে বাসুদেব অলক্ষিতবেগে তাঁহাদের রক্ষিত ভোজ ও কাম্বোজ সৈন্যদল অতিক্রম করিলেন।

 এদিকে মধ্যদিনান্তে দিনমণি অস্তাচলশিখরাভিমুখী হইলে, অর্জ্জুন বহুসংখ্যক কৌরব-যোদ্ধা নিপাতন এবং সৈন্যদলকে বিদ্রাবণ ও বিলােড়নপূর্ব্বক শান্ত-দেহে ক্ষতবিক্ষতাঙ্গ অশ্ব লইয়া শকটব্যূহমধ্য হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলেন, তখন বহুদূরে ব্যূহিত শ্রেষ্ঠ মহারথগণ-রক্ষিত জয়দ্রথের অবস্থান-ভূমি দৃষ্ট হইতে লাগিল।

 অর্জ্জুন কহিলেন—কে মাধব! আমাদের অশ্ব নিতান্ত শ্রান্ত ও শরাদ্দিত হইয়াছে; অতএব তাহাদিগকে বিশ্রাম দিবার এই উপযুক্ত অবসর।

 কৃষ্ণ এই বাক্য অনুমোদন করিলে মহাবীর অর্জ্জুন অসম্ভ্রান্ত-চিত্তে রথ হইতে অবতরণপূর্ব্বক গাণ্ডীবহস্তে রথ ও অশ্বসহ বাসুদেবকে রক্ষার নিমিত্ত অবস্থান করিলেন। তখন অশ্ববিদ্যা-সুনিপুণ কৃষ্ণ অর্জ্জুন-শর-রক্ষিত ক্ষেত্রমধ্যে অশ্বগণকে মোচন করিয়া স্বহস্তে তাহাদের শল্যোদ্ধার ও গাত্র পরিমার্জ্জনপূর্ব্বক তাহাদিগকে জলপান করাইলেন।

 অনন্ত কিয়ৎক্ষণ বিশ্রামানন্তর অশ্বগণের শ্রম ও গ্লানি অপনোদন হইলে কৃষ্ণ তাহাদিগকে পুনরায় যোজনা করিয়া অর্জ্জুনের সহিত রথারূঢ় হইলেন। খল অশ্বগণ যেন পুনর্জীবন প্রাপ্ত হইয়া জয়দ্রথের দিকে দ্রুতবেগে রথ লইয়া চলিল।

 অর্জ্জুনকে অপ্রতিহত-গতিতে ধাবমান দেখিয়া কৌরবসৈন্যমধ্যে মহাকোলাহল উপস্থিত হওয়ায় অর্জ্জুনকে নিবারণ করিবার জন্য সত্বর উপস্থিত হইলেন। তখন অর্জ্জুন ক্রুদ্ধ হইয়া তাঁহাকে আক্রমণ করিলে সৈন্যগণমধ্যে―রাজা হইলেন!―বলিয়া হাহাকার-ধ্বনি উপস্থিত হইল। কিন্তু দুর্য্যোধন যখন অর্জ্জুন-বিক্ষিপ্ত প্রচণ্ড অস্ত্র সমুদায় অনায়াসে সহ্য় করিয়া তাঁহাকে ও কৃষ্ণকে বিদ্ধ করিতে আরম্ভ করিলেন, তখন সকলে একান্ত বিস্ময়াবিষ্টচিত্তে চতুর্দ্দিক্ হইতে সিংহনাদ করিতে আরম্ভ করিল।

 কৃষ্ণ কহিলেন—হে পার্থ! কি আশ্চর্য্য! তোমার বাণসকল ব্যর্থ দেখিয়া আমি অতিশয় বিস্মিত হইতেছি। আজ কি পূর্ব্বাপেক্ষা গাণ্ডীবের অথবা তােমার মুষ্টির বা বাহুদ্বয়ের বলহানি হইয়াছে?

 অর্জ্জুন কহিলেন―হে বাসুদেব! নিশ্চয়ই আচার্য্য দুর্য্যোধনের গাত্রে কবচ বন্ধন করিয়াছেন, সে কবচের বন্ধন গুরু কেবল আমাকেই শিক্ষা দিয়াছিলেন। মনুষ্য-নিক্ষিপ্ত বাণের কথা দূরে থাক্, ইন্দ্রের অশনিতেও উহা বিভিন্ন হইবার নহে। কিন্তু স্ত্রীলােকের ন্যায় দুর্য্যোধন কেবল যেন গাত্রের শােভার্থে এই কবচ ধারণ করিয়াছে, সে ইহার উপযুক্ত যুদ্ধপ্রণালী কিছুই অবগত নহে, অতএব সে এখনি আমার ভুজবল অবগত হইবে।

 এই বলিয়া ধনঞ্জয় বর্ম্মভেদ-চেষ্টা পরিত্যাগ করিয়া দুর্য্যোধনের শরমুষ্টি ও শরাসন ছেদন এবং অশ্ব ও সারথি বিনাশপুর্ব্বক তাঁহার রথ খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিলেন। তখন দুর্য্যোধনের রক্ষার্থে অসংখ্য কৌরব-সৈন্য তথায় উপস্থিত হইয়া অর্জ্জুনের গতিরােধ করিল।

 দিবার শেষভাগে অর্জ্জুনকে এইরূপে অবরুদ্ধ দেখিয়া ধূলিধূসরিত ও ঘর্ম্মাক্ত-কলেবর বাসুদেব সাহায্যের নিমিত্ত বার বার পাঞ্চজন্য শঙ্খে প্রবল ধ্বনি করিতে আরম্ভ করিলেন।

 খুধিষ্ঠির ভীমের নিকট উপস্থিত হইয়া কহিলেন―

 হে ভীম! যে বীর একমাত্র রথে দেব গন্ধর্ব্ব ও দৈত্যগণকে পরাজয় করিয়াছে, আমি তােমর সেই ভ্রাতা অর্জ্জুনের ধ্বজদণ্ড আর দেখিতে পাইতেছি না।

 এই কথা বলিতে বলিতে যুধিষ্ঠির একান্ত কাতর হইয়া মােহাবিষ্ট হইলেন। ভীম ভ্রাতাকে তদবস্থ দেখিয়া অতিশয় উদ্বিগ্ন হইয়া কহিলেন—

 হে ধর্ম্মরাজ! তোমাকে কখনও এরূপ কাতর দেখি নাই, পূর্ব্বে আমরা অবসন্ন হইলে তুমি আমাদিগকে আশ্বাস প্রদান করিতে; অতএব এক্ষণে শােক পরিত্যাগ করিয়া আমাকে আজ্ঞা কর—কোন্ কর্ম্ম করিতে হইবে।

 এই কথায় কথঞ্চিৎ প্রকৃতিস্থ হইয়া যুধিষ্ঠির কহিলেন—

 হে বৃকোদর! প্রিয়দর্শন অর্জ্জুন সূর্য্যোদয়ের সময়ে জয়দ্রথ-বধার্থে কৌরব-সৈন্যমধ্যে প্রবিষ্ট হইয়াছেন, এখনও প্রত্যাগত হইতেছেন না, এই শোকের মূল কারণ।

 ভীমসেন কহিলেন—মহারাজ! আর বৃথা করিও না। আমি এখনই চলিলাম।

 অনন্তর ভ্রাতৃ-হিতনিরত মহাবীর ভীম অস্ত্র-শস্ত্র গ্রহণ পূর্ব্বক শঙ্খধ্বনি ও সিংহনাদ করিয়া যাত্রা করিলেন। মারুতগামী অশ্ব-সংযােজিত রথে তিনি সেনাদিগকে বিমর্দ্দন ও নিবারণকারী বীরগণকে অতিক্রম করিয়া দ্রোণ-রক্ষিত ব্যূহমুখে মহাবেগে ধাবিত হইলেন।

 আচার্য্য কহিলেন—হে ভীমসেন! আমি অদ্য তােমার বিপক্ষ, আমাকে পরাজয় না করিয়া তুমি কদাচ সৈন্যমধ্যে প্রবেশ করিতে সক্ষম হইবে না।

 ভীম এই বাক্যে রুষ্ট হইয়া প্রত্যুত্তর করিলেন―

 হে ব্রহ্মন্! ইতিপূর্ব্বে আমরা আপনাকে গুরু ও বন্ধু বলিয়া জানিতাম, অদ্য আপনি বিপরীত ভাব ধারণ করিতেছেন। যাই হোক আমি কৃপাপরবশ অর্জ্জুন নহি। আপনি যদি বিপক্ষ হইতে ইচ্ছা করিয়া থাকেন, তবে আমিও অবিলম্বে শত্রুবৎ আচরণ করিব।

 এই বলিয়া ভীমপরাক্রম ভীমসেন কালদণ্ড-সদৃশ গদা বিঘূর্ণনপূর্ব্বক তাহা দ্রোণের প্রতি নিক্ষেপ করিলেন। দ্রোণ আত্মরক্ষার অন্য উপায় না দেখিয়া তৎক্ষণাৎ রথ হইতে লম্ফ প্রদান করিলে সেই প্রচণ্ড গদাঘাতে সারথি অশ্ব ও রথ এককালে বিনষ্ট হইল।

 তখন ধার্ত্তরাষ্ট্রগণ চতুর্দ্দিক হইতে ধাবিত হইয়া ভীমকে আক্রমণ করিলেন, কিন্তু তিনি অনায়াসে সম্মুখাগত ব্যক্তিগণকে সংহার করিয়া উদ্ধত বায়ু যেমন পাদপ-দলকে বিমর্দ্দন করে, তদ্রূপ কৌরবসেনাকে দলন ও অতিক্রম করিলেন।

 এইরূপে ব্যূহের পশ্চাদর্দ্ধে উপনীত হইয়া ভীম দেখিলেন যে, ভোজ ও কাম্বোজরাজ-রক্ষিত সৈন্যগণের সহিত সাত্যকি তুমুল যুদ্ধে ব্যাপৃত আছেন। সেই সুযোগ অবলম্বন করিয়া ভীমসেন অলক্ষিতভাবে শকটব্যূহ হইতে নিষ্ক্রান্ত হইলেন এবং অদূরে কৃষ্ণার্জ্জুন-সমেত কপিধ্বজ রথ তাঁহার দৃষ্টিগোচর হইলে তিনি বর্ষাকালীন জলপটলের গভীর গর্জ্জনের ন্যায় ভয়ঙ্কর সিংহনাদ করিলেন।

 পরিচিত ভীমকণ্ঠ শ্রবণে কৃষ্ণার্জ্জুন বারম্বার হর্ষধ্বনি করিয়া তাহার উত্তর প্রদান করিলেন। সেই শব্দ যুধিষ্ঠিরের শ্রুতিগোচর হইলে তিনি একান্ত প্রীতমনে ভীমসেনের প্রশংসা করিয়া ভাবিতে লাগিলেন—

 অহো! ভীম যথার্থ ই আমার আজ্ঞা প্রতিপালনপূর্ব্বক আমাকে অর্জ্জুনের কুশলসংবাদ জ্ঞাপন করিল। এক্ষণে সেই অরাতিবিজয়ী অর্জ্জুনসম্বন্ধে আমার দুশ্চিন্তা তিরোহিত হইল।

 ভীমকে ব্যূহ হইতে উত্তীর্ণ দেখিয়া ধার্ত্তরাষ্ট্রগণ জীবিতাশা পরিত্যাগ করিয়া তাঁহাকে পুনরায় পশ্চাৎ হইতে আক্রমণ করিলেন; কিন্তু মহাবল বৃকোদর স্বীয় প্রতিজ্ঞা পালনপূর্ব্বক তাহাদিগকে একে একে যম-সদনে প্রেরণ করিতে আরম্ভ করিলেন। এইরূপে ধৃতরাষ্ট্রের একত্রিংশ পুত্র নিহত হইলে ভীমকে নিবারণার্থে মহাবীর কর্ণ সূচি-ব্যূহ হইতে অগ্রসর হইয়া আসিলেন।

 তখন উভয় বীরের মধ্যে ঘোর যুদ্ধ আরম্ভ হইল। কর্ণ অনায়াসে ভীম-নিক্ষিপ্ত অস্ত্রসমুদায় খণ্ড খণ্ড করিলেন। ভীম ধনুর্যুদ্ধ নিষ্ফল দেখিয়া অসিচর্ম্ম ধারণপূর্ব্বক রথ হইতে অবতরণ করিলেন; কিন্তু কর্ণ অস্ত্রদ্বারা সে অসিচর্ম্মও বিনষ্ট করিলেন এবং অস্ত্রহীন ভীমের প্রতি ধাবমান হইলেন। তখন নিরুপায় ভীমসেন পলায়ন করিয়া মৃত-গজ-কলেবরসকলের মধ্যে বিচরণপূর্ব্বক আশ্রয় লাভ করিলেন।

 এই সময়ে কর্ণ বিশেষ অবসর প্রাপ্ত হইয়া ও কুন্তীর নিকট স্বীয় প্রতিজ্ঞা স্মরণপূর্ব্বক ভীমসেনকে সংহার করিলেন না। তিনি ভীমের আশ্রয়স্বরূপ গজদেহ ছিন্ন করিয়া রথগমনের পথ নির্মাণপূর্ব্বক তাঁহাকে প্রাপ্ত হইলেন এবং ধনুষ্কোটিদ্বারা প্রহারপূর্ব্বক সহাস্যবদনে কহিলেন―

 অহে ভীম! তুমি অস্ত্রবিদ্যা কিছুমাত্র অবগত নহ, রণস্থল তোমার উপযুক্ত স্থান নহে। মাদৃশ ব্যক্তির সহিত যুদ্ধ করতে গেলে এরূপ অবস্থা ঘটিয়া থাকে।

 ভীম অঙ্গস্পৃষ্ট সেই কর্ণের কার্ম্মুক তৎক্ষণাৎ আচ্ছিন্ন করিয়া তদ্দারা তাঁহাকে প্রতি প্রহার করিয়া কহিলেন—

 আরে মূঢ় স্বয়ং ইন্দ্রের জয় এবং পরাজয় উভয়ই হইয়া থাকে। আমিও তোমাকে ইতিপূর্ব্বে বহুবার পরাজয় করিয়াছি, তবে কেন বৃথা শ্লাঘা করিতেছ? তুমি একবার আমার সঙ্গে মল্লযুদ্ধে প্রবৃত্ত হও, তাহা হইলে তোমার প্রকৃত পৌরুষ বুঝা যাইবে।

 কিন্তু কর্ণ সকলের সমক্ষে তাহাতে পশ্চাৎপদ হইয়া স্বস্থানে প্রস্থান করিলেন।

 অর্জ্জুন যখন দুস্তর সৈন্যসাগর পার হইয়াছিলেন, সে সময়ে তাঁহার চক্ররক্ষকদ্বয় তাঁহার সহিত উত্তীর্ণ হইতে পারেন নাই। এক্ষণে যুধামন্যু ও উত্তমৌজা সৈন্যমণ্ডলীর বহির্ভাগ দিয়া অর্জ্জুনের অনুসন্ধানে তথায় উপস্থিত হইলেন। রথহীন ভীম ও সাত্যকি তাঁহাদের একরথে আরোহণ করিয়া অর্জ্জুনের অনুসরণ করিলেন। তখন জয়দ্রথ-বেষ্টনকারী দুর্য্যোধন কর্ণ কৃপ অশ্বত্থামা প্রভৃতি বীরগণ এবং স্বয়ং সিন্ধুরাজ যুদ্ধার্থে প্রস্তুত হইলেন।

 সমস্ত দিনের চেষ্টার পর অবশেষে জয়দ্রথকে সম্মুখে অবস্থিত দেখিয়া অর্জ্জুন ক্রোধপ্রদীপ্ত নেত্রে তাঁহাকে যেন দগ্ধ করিতে লাগিলেন।

 দুর্য্যোধন কহিলেন―হে কর্ণ। অর্জ্জুনের সহিত তােমার যুদ্ধের এই সময় উপস্থিত হইয়াছে; অতএব যাহাতে জয়দ্রথ বিনষ্ট না হয়, তাহার চেষ্টা কর। দিবাভাগের অত্যল্পমাত্র অবশিষ্ট আছে, অতএব অর্জ্জুনের যুদ্ধের বিঘ্ন বিধান করিতে পারিলেই আমরা জয়দ্রথ-রক্ষায় কৃতকার্য্য হইব এবং স্বীয় প্রতিজ্ঞা অনুসারে অর্জ্জুন অনলে প্রবেশ করিলে আমরা যুদ্ধেও জয়লাভ করিব।

 তদুত্তরে কর্ণ কহিলেন―

 মহারাজ! ইতিপূর্ব্বেই মহাপরাক্রান্ত ভীমসেনের সহিত যুদ্ধকালে আমার কলেবর ছিন্নবিচ্ছিন্ন হইয়াছে, যাহা হৌক আমি তােমার নিমিত্তই প্রাণ ধারণ করিয়া আছি; অতএব সাধ্যমত অর্জ্জুনকে নিবারণ করিব।

 ইত্যবসরে অর্জ্জুন জয়দ্রথকে প্রাপ্ত হইবার জন্য কোরবসৈন্য সংহার করিতে আরম্ভ করিয়া বীরগণের ভুজদণ্ড ও মস্তকছেদন করিয়া অনতিকালমধ্যে ধরণীতল রুধিরাভিষিক্ত করিলেন। অবশেষে দুর্য্যোধন কর্ণ শল্য অশ্বত্থামা ও কৃপ জয়দ্রথকে পশ্চাদ্ভাগে রাখিয়া অর্জ্জুনকে আক্রমণ করলেন। সেই সঙ্গে অন্যান্য কৌরব-বীরগণ ভাস্করকে লোহিতবর্ণ দেখিয়া মহা উৎসাহসহকারে কার্ম্মুক আনত করিয়া তাঁহর প্রতি শত শত সায়ক প্রয়ােগ করিতে আরম্ভ করিলেন।

 মহাবীর ধনঞ্জয় ক্ষুব্ধ হইয়া প্রথমত অগ্রবর্ত্তী কর্ণের অশ্ব ও সারথি বিনাশপূর্ব্বক তাঁহার মর্ম্মস্থান বিদ্ধ করিলেন এবং পরে কর্ণ রুধিরাক্ত কলেবরে অশ্বথামার রথে আশ্রয় গ্রহণ করিলে তিনি অশ্বথামা ও মদ্ররাজের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত লইলেন। কৌরবগণ-নিক্ষিপ্ত শরজালে যে গাঢ় অন্ধকার হইয়াছিল, পার্থ তাহা দিব্যাস্ত্রদ্বারা অনায়াসে দূরীকৃত করিলেন। এই রূপে মহাবীর অর্জ্জুন অরাতিগণের জীবন ও কীর্ত্তি বিলােপ করিয়া মূর্ত্তিমান মৃতুর ন্যায় রণস্থলে ভ্রমণ করিতে লাগিলেন।

 ক্রমে সৈন্যগণ সেই দেবরাজের অশনি-নির্ঘোষতুল্য গাণ্ডীব-টঙ্কারধ্বনি শ্রবণ করিয়া বাতাহত সমুদ্রজলের ন্যায় অতিশয় উদ্ভ্রান্ত হইয়া চতুর্দ্দিকে বিক্ষিপ্ত হইয়া পড়িল। কিন্তু অচিরে সূর্য্যাস্তের আশায় উৎফুল্ল কৌরব-প্রধানগণ পরস্পরের রথ সংশ্লিষ্ট করিয়া অবিচলিতচিত্তে জয়দ্রথকে বেষ্টনপূর্বক অর্জ্জুনের বাণ নিবারণ করিতে লাগিলেন। তন্নিমিত্ত মহাবীর ধনঞ্জয় জয়দ্রথকে আক্রমণ করিবার কোন ছিদ্র প্রাপ্ত হইলেন না।

 এই শঙ্কটের অবস্থায় অস্তগমনােন্মুখ বিভাকর ক্ষণকাল তিমিরাবৃত হইল। ইহাতে কৌরবগণ সূর্য্যকে অস্তগত জ্ঞান করিয়া সতর্কতা পরিত্যাগপূর্ব্বক হর্ষ প্রকাশ করিতে লাগিলেন এবং জয়দ্রথও আনন্দ ভরে আশ্রয়স্থান পরিত্যাগপূর্ব্বক উল্লসিত আননে অস্তগত সূর্য্যের দিকে দৃষ্টিবদ্ধ করিলেন।

 একমাত্র বাসুদেব প্রকৃত অবস্থা বুঝিতে পারিয়াছিলেন, তিনি তৎক্ষণাৎ অর্জ্জুনকে কহিলেন—

 হে পার্থ! সুর্য্য প্রকৃতপক্ষে অস্তগত হয় নাই, ক্ষণকাল অদৃশ্য হইয়াছে মাত্র, তুমি এই অবসরে অনায়াসে জয়দ্রথের মস্তক ছেদন করিতে পারিবে।

 এই কথায় অর্জ্জুন সত্বর সিন্ধু রাজের রথাভিমুখে ধাবমান হইলে জয়দ্রথ-রক্ষকগণ সংশয়ারূঢ় হইয়া পূর্ব্ববৎ তাঁহাকে বেষ্টন করিবার সুযােগ পাইলেন না। সৈন্যগণও ধনঞ্জয়ের রােষাবিষ্ট আগমনে ভীত হইয়া তাঁহাকে পথ প্রদান করল। তখন অর্জ্জুন অভিমন্যুর মৃত্যুর হেতুস্বরূপ সেই জয়দ্রথকে প্রাপ্ত হইয়া সৃক্কণী-লেহনপূর্ব্বক কতসন্ধান ভীষণ শর পরিত্যাগ করিলেন। শ্যেনপক্ষী যেরূপ শকুন্তকে হরণ করে, তদ্রূপ গাণ্ডীব-নির্ম্মুক্ত সেই বাণ জয়দ্রথের মস্তক হরণ করিল।

 ইত্যবসরে সুর্য্য তিমির-মুক্ত হইয়া লােহিত-কলেবরের শেষাংশ প্রকাশ করিলে, সকলে দেখিলেন যে সূর্য্যাস্তের পূর্ব্বেই অর্জ্জুন স্বীয় প্রতিজ্ঞ সফল করিয়াছেন।

 তখন জয়ঘােষণার্থে কৃষ্ণ পাঞ্চজন্য শঙ্খ প্রধ্নাপিত করিলে ভীম ঘােরতর সিংহনাদে দিগ্বিদিক পরিপূর্ণ করিলেন। তৎশ্রবণে যুধিষ্ঠির জয়দ্রথ-বধ বৃত্তান্ত অনুমান করিয়া উচ্ছ্বসিত আনন্দভরে বাদ্যধ্বনিদ্বারা অন্তরীক্ষ প্রতিধ্বনিত করাইলেন।

 এ দিকে দুর্যোধন সিন্ধুরাজের নিধনে হতাশ্বাস হইয়া বাষ্পকুললেমে ও দীনবদনে ভগ্নদশন ভুজঙ্গের ন্যায় নিঃশ্বাস পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। তিনি দ্রোণ-সমীপে গমনপূর্ব্বক কহিলেন—

 হে আচার্য্য। অস্মৎপক্ষীয় মহীপালগণের বিনাশ অবলোকন করুন। যে সকল ভূপালগণ আমাকে রাজ্য প্রদান করিবার অভিলাষ করিয়াছিলেন, এক্ষণে তাঁহারা সমস্ত ঐশ্বর্য্য পরিত্যাগপূর্ব্বক ধরাসনে শয়ান রহিয়াছেন। আমি অতি কাপুরুষ, যেহেতু মিত্রগণকে স্বীয় কার্য্য সাধনার্থে মৃত্যুমুখে নিপাতিত করিলাম। হে গুরো! আপনিই আমাদের মৃত্যু বিধান করিয়াছেন। আমার নিমিত্ত যখন এই রাজগণ অরক্ষিত হইয়া বিনষ্ট হইয়াছেন, তখন আর আমার জীবনধারণে প্রয়োজন কি?

 দ্রোণ প্রত্যুত্তরে কহিলেন—

 হে দুর্য্যোধন! কেন অনর্থক আমাকে বাক্যবাণে বিদ্ধ করিতেছ? আমি ত তোমাকে সতত বলিয়াই থাকি যে, অর্জ্জুন অজেয়। আমরা ত্রিলোকমধ্যে যাঁহাকে সর্ব্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা মনে করিতাম, সেই ভীষ্ম ইঁহারই প্রভাবে সমরশায়ী হইলেন। তবে আমি যে তোমার সেন্যরক্ষায় কৃতকার্য্য হইতেছি না, তাহাতে আমার অপরাধ কোথায়? দ্যূত-সভায় শকুনি যে অক্ষনিক্ষেপ করিয়াছিল, সেই গুলি এক্ষণে অর্জ্জুনের হস্তে সুতীক্ষ্ণ শররূপ ধারণ করিয়া তোমার সেন্য বিনষ্ট করিতেছে। অধর্ম্মের ফল হইতে নিষ্কৃতি নাই। যাহা হৌক পাণ্ডবগণ সহ পাঞ্চাল-সৈন্য আমাকে আক্রমণ করিতে আসিতেছে; অতএব এক্ষণে আমি তােমার বাক্য-শল্যে একান্ত পীড়িত হইলেও প্রাণপণ যুদ্ধ করিতে চলিলাম, তুমিও সাধ্যমত সৈন্যরক্ষাকার্য্যে মনােযােগ কর।

 এই বলিয়া দ্রোণাচার্য্য ব্যথিত-মনে পাণ্ডব-সৈন্যের প্রতি ধাবিত হইয়া যুধিষ্ঠিরকে আক্রমণ করিলেন। দ্রোণ-শরে সৈন্যগণকে নিপীড়িত দেখিয়া ভীমার্জ্জুন কৌরব-সৈন্যমধ্যে প্রবেশপূর্ব্বক আচার্য্যকে নিবারণ করিলেন।

 তখন যে অসংখ্য বীর-নিপাতন ভয়ঙ্কর সংগ্রাম উপস্থিত হইল তন্মধ্যে সকল শব্দের উপর গাণ্ডীবের ভীষণ নিস্বন ঘন ঘন শ্রুত হইতে লাগিল। ভীমসেন ধার্ত্তরাষ্ট্রের প্রতি নারাচ সন্ধানপূর্ব্বক তাহাদিগকে বজ্রাহত পাদপের ন্যায় ভূতলপাতিত করিতে লাগিলেন। মহাধনুর্দ্ধর সাত্যকিও স্বীয় বিক্রম প্রদর্শন করিতে ত্রুটি করেন নাই। তিনি বিবিধ প্রকার শরযুদ্ধ আরম্ভ করিয়া বিশিখদ্বারা বীরগণের মস্তক এবং ক্ষুরপ্রদ্বারা গজ সমুদায়ের শুণ্ড ও অশ্বগণের গ্রীবা ছেদন করিলেন। তাহাদের চীৎকার শব্দে সমাগত ঘোররূপা রজনী ভীষণতর হইয়া উঠিল।

 তদ্দৃষ্টে রাজা দুর্য্যোধন কর্ণকে কহিলেন—

 হে মিত্রবৎসল! ঐ দেখ ইন্দ্রতুল্য পরাক্রমশালী পাণ্ডব ও পাঞ্চালগণ হৃষ্টচিত্তে সিংহনাদ করিতেছে। এক্ষণে তুমি অস্মৎপক্ষীয় যােদ্ধৃগণকে পরিত্রাণ কর।

 কর্ণ কহিলেন―মহারাজ! আমি জীবিত থাকিতে তোমার বিষাদ করিবার প্রয়ােজন নাই। আমি আজি পাণ্ডবগণের সহিত সমাগত পাঞ্চাল কেকয় ও বৃষ্ণিগণকে পরাজয়পূর্ব্বক তোমাকে সাম্রাজ্য প্রদান করিব।

 অর্জ্জুন কৃষ্ণকে কহিলেন—

 হে বাসুদেব! ভুজঙ্গম যেমন পাদস্পর্শ সহ্য করিতে পারে না, আমি তদ্রূপ রণস্থলে সূতপুত্রের পরাক্রম সহ্য করিতে সমর্থ নহি। অতএব শীঘ্র কর্ণ-সমীপে রথ সঞ্চালন কর।

 কর্ণের অমােঘ-শক্তির বৃত্তান্ত অবগত থাকায় কৃষ্ণ প্রত্যুত্তরে কহিলেন―

 হে অর্জ্জুন! এক্ষণে নানা কারণে তোমার কর্ণের অভিমুখীন হওয়া উচিত হইতেছে না। নিশাচর ঘটোৎকচ উহাকে উপযুক্তরূপে নিবারণ করিতে পারিবে; তাহাকে এই কার্য্যে নিয়ােগ কর।

 কৃষ্ণের উপদেশানুসারে অর্জ্জুন ঘটোৎকচকে আহ্বান করিয়া কহিলেন―

 বৎস! এক্ষণে যুদ্ধে তােমার পরাক্রম প্রদর্শনের উপযুক্ত সময় উপস্থিত; রাক্ষসী-মায়াপ্রভৃতি তােমার যাহা কিছু অস্ত্র আছে তাহা অবলম্বন করিয়া কর্ণকে নিবারণ কর।

 ঘটোৎকচ কহিল—হে মহাত্মন্! আপনার অনুমতি ক্রমে আমি অদ্য কর্ণের সহিত এরূপ যুদ্ধ করিব, যাহা লোকে সহজে বিস্মৃত হইতে পারিবে না।

 অরাতি-ঘাতন নিশাচর ঘটোৎকচ এই বলিয়া কর্ণের সহিত তুমুল সংগ্রাম আরম্ভ করিল। কর্ণ কোন ক্রমে ঘটোৎকচকে অতিক্রম না করিতে পারিয়া দিব্যাস্ত্র বিস্তার করিলেন। তদ্দর্শনে ঘটোৎকচ রাক্ষসী মায়া পরিগ্রহপূর্ব্বক ভয়ঙ্কর শস্ত্রধারী রাক্ষস-সৈন্যেরদ্বারা পরিবৃত হইল। সেই নিশাচরগণ রাত্রিপ্রভাবে সমধিক বীর্য্যশালী হইয়া শিলাবর্ষণ আরম্ভ করিয়া কৌরবগণকে বিশেষরূপে ব্যথিত করিল।

 একমাত্র কর্ণ অবিচলিতচিত্তে সেই রাক্ষসী মায়া নিরাকৃত করিতে যত্নবান্ হইলেন। রাক্ষসগণ মায়াযুদ্ধ বিফল দেখিয়া অস্ত্রবর্ষণের দ্বারা কর্ণকে সংহার করিতে চেষ্টা করিল। ঘন ঘন নিক্ষিপ্ত শর শক্তি শূল গদা চক্র প্রভৃতিতে কৌরবগণ আক্রান্ত ও অভিভূত হইতে লাগিলেন। অশ্বগণ ছিন্ন, কুঞ্জরগণ প্রমথিত ও শিলঘাতে রথসমুদায় নিস্পিষ্ট হইল।

 অবশেষে অস্ত্রজালসমাচ্ছন্ন কর্ণ ব্যতীত কেহই রণস্থলে অবস্থান করিতে পারিল না। কিন্তু মহাবীর ঘটোৎকচ যখন এক শতঘ্নী নিক্ষেপ করিয়া এককালে কর্ণের অশ্বচতুষ্টয় বিনাশ করিল, তখন বিরথ রাধেয় কৌরবগণকে পলায়মান এবং ঘটোৎকচকে জয়শীল অবলােকন করিয়া তৎকালােচিত কর্ত্তব্য চিন্তা করিতে লাগিলেন। চতুর্দ্দিক্ হইতে কাতরস্বরে কৌরবগণ অনুনয় করিতে লাগিলেন—

 হে সূতনন্দন। কৌরবসেনা বুঝি অদ্যই সমূলে বিনষ্ট হয়। তুমি সত্বর বাসবদত্ত শক্তি প্রয়ােগে এই নিশাচরকে সংহার কর। এ ঘাের রজনী উত্তীর্ণ হইতে পারিলে বীরগণ পরে অর্জ্জুনকে পরাজয় করিবার অবসর পাইবেন। অতএব তাঁহার নিমিত্ত এই অমােঘ শক্তি বৃথা পােষণ না করিয়া উহা এখনই প্রয়ােগ কর।

 মহাবীর কর্ণ সেই ভয়ঙ্কর নিশীথসময়ে স্বীয় পক্ষের আর্ত্তনাদ উপেক্ষা করিতে না পারিয়া অর্জ্জুন-বধ-নিমিত্ত সেই বহুযত্ন-রক্ষিত অমোঘ শক্তি গ্রহণ ও নিক্ষেপ করিবামাত্র উহা ঘটোৎকচের হৃদয় ভেদ করিয়া উর্দ্ধগতি অবলম্বনপুর্ব্বক ইন্দ্রের নিকট প্রত্যাগত হইল। কৌরবগণ নিশাচর-হস্ত হইতে পরিত্রাণ পাইয়া পরমাহ্লাদে সিংহনাদ ও শঙ্খধ্বনি করিলেন। দুর্য্যোধন কর্ণকে যথােচিত পূজাপূর্ব্বক তাঁহাকে স্বীয় রথে আরোপিত করিয়া সৈন্য-মধ্যে প্রবিষ্ট হইলেন।

 কিন্তু পাণ্ডবগণকে ভীম-তনয়ের শোকে অতিশয় কাতর দেখিয়াও কৃষ্ণ তাঁহাদিগকে ব্যথিত করিয়া হর্ষ প্রকাশ করিতে লাগিলেন। তখন অর্জ্জুন কহিলেন—

 হে বাসুদেব! বৎস ঘটোৎকচের মৃত্যুতে আমরা সকলেই শােকার্ত্ত হইয়াছি, কিন্তু তুমি কি নিমিত্ত অনুপযুক্ত সময়ে আনন্দ করিতেছ?

 কৃষ্ণ কহিলেন―হে অর্জ্জুন! কর্ণ আজি ইন্দ্র দত্ত মহাশক্তি পরিত্যাগ করিয়া আমাদের অতিশয় প্রীতিকর কার্য্যের অনুষ্ঠান করিয়াছেন। কর্ণের নিকট এই মহা অস্ত্র থাকিতে স্বয়ং যমও তাঁহার সমক্ষে বিরাজ করিতে সক্ষম হইতেন না। মহাতেজা কর্ণ যেদিন কবচ ও কুণ্ডলের বিনিময়ে ইন্দ্রের নিকট এই শক্তি প্রাপ্ত হইয়াছিলেন, তদবধি তিনি তোমার বিনাশনিমিত্ত তাহা সযত্নে রক্ষা করিয়াছিলেন। —হে পার্থ! অদ্য কর্ণ শক্তিশূন্য হওয়ায় উহাকে নিপতিত জ্ঞান করিতে পার। এই নিমিত্ত আমি তোমাকে নিষেধ করিয়া নিশাচরকে উহার সহিত যুদ্ধার্থে প্রেরণ করিয়াছিলাম। যতদিন তোমার মৃত্যুস্বরূপ এই শক্তির প্রতিকার করিতে পারি নাই, ততদিন আমার নিদ্রা ও হর্ষ তিরােহিত হইয়াছিল। শদ্য মার কৌশল সফল হওয়ায় আনন্দ করিতেছি।

 ―যাহা হৌক, এক্ষণে আমাদের সৈন্যগণ হাহাকার-রবে ইতস্তত পলায়ন করিতেছে, বােধ হয় মহাবীর দ্রোণ তাহাদিগকে আক্রমণ করিয়াছেন; অতএব হে অনিন্দম! তুমি তাঁহাকে নিবারণ কর।

 তখন যুধিষ্ঠিরের আজ্ঞাক্রমে সমগ্র যােদ্ধৃগণ দ্রোণজিগীযু, হইয়া অর্জ্জুনের সহিত মহাবেগে ধাবমান হইলেন। রাজা দুর্য্যোধন তদৃষ্টে রোষাবিষ্টচিত্তে আচার্য্যের রক্ষার্থে কৌররগণকে নিয়োগ করিলেন। কিন্তু উভয়পক্ষের শ্রান্তবাহন বীরগণ রাত্রি অধিক হওয়ায় নিদ্রালু হইয়াছিলেন, সুতরাং নিশ্চেষ্টবৎ যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। সেনাপতি অর্জ্জুন তাঁহাদিগকে তদবস্থ দেখিয়া উচ্চৈঃস্বরে কহিলেন—

 হে সেনাগণ! তোমরা অন্ধকারে সমাবৃত ও নিতান্ত পরিশ্রান্ত হইয়াছ; অতএব কিয়ৎক্ষণ যুদ্ধ হইতে নিবৃত্ত হইয়া এই রণভূমিতেই নিদ্রা যাও।

 কৌরব-সেনাপতি দ্রোণও সেই বাক্য অনুমোদন করিলে কৌরব ও পাণ্ডব-সৈন্যগণ অর্জ্জুনের ভূয়সী প্রশংসা করিয়া কেহ বাহনের উপর কেহ ক্ষিতিতলে শয়ন করিয়া নিদ্রাসুখ লাভ করিল।

 অনন্তর নয়ন-প্রীতিবর্দ্ধন পাণ্ডুবর্ণ চন্দ্রমা মাহেন্দ্রী দিক্‌ অলঙ্কৃত করিলে ক্রমে ভূমণ্ডল জ্যোতির্ম্ময় হইয়া উঠিল। ঐ আলোকে সৈন্যগণ প্রবোহিত হইয়া রাত্রির শেষভাগে পুনরায় যুদ্ধার্থে প্রস্তুত হইল।

 অনন্তর কোরবসৈন্য দুই ভাগে বিভক্ত হইল। এক ভাগ দ্রোণের এবং অপর ভাগ দুর্য্যোধনের ও কর্ণের অধীনে ঘোরতর সংগ্রাম আরম্ভ করিল। তখন যুধিষ্ঠির কহিলেন—

 হে কেশব! অভিমন্যুবধে জয়দ্রথের অতি অল্প অপরাধ ছিল, কিন্তু তজ্জন্য অর্জ্জুন তাহাকে সংহার করিলেন। আমার মতে যদি কোন বিশেষ শত্রুকে বিনাশ করা আমাদের অবশ্য কর্ত্তব্য হয়, তবে অগ্রে দ্রোণ ও কর্ণকে সংহার করা অর্জ্জুনের কর্ত্তব্য। উহাদের সাহায্যে দুর্য্যোধন আশ্বস্ত হইয়া যুদ্ধকার্য্য চালনা করিতেছেন।

 যুধিষ্ঠির এই বলিয়া দ্রোণকে আক্রমণ করিলে অর্জ্জুন অন্যান্য বীরগণের সহিত তাঁহাকে রক্ষা করিতে লাগিলেন। সর্ব্বাগ্রে দ্রুপদ ও বিরাট দ্রোণের প্রতি ধাবমান হইলেন, কিন্তু দ্রোণ অনায়াসেই তাঁহাদের নিক্ষিপ্ত অস্ত্রসমূহ খণ্ড খণ্ড করিলেন। তখন বিরাট এক তোমার ও দ্রুপদ এক প্রাস নিক্ষেপ করিলে দ্রোণ অতিশয় রুষ্ট হইয়া সেই অস্ত্রদ্বয় ছেদনপুর্ব্বক সুশাণিত ভল্লদ্বারা দ্রুপদ ও বিরাটকে যমসদনে প্রেরণ করিলেন—

 তদ্দৃষ্টে দ্রুপদ-তনয় ধৃষ্টদ্যুম্ন প্রতিজ্ঞা করিলেন—

 অদ্য যদি দ্রোণ আমার হস্ত হইতে মুক্তিলাভ করেন, তবে আমি যেন ক্ষত্রিয়লােক হইতে পরিভ্রষ্ট হই।

 তখন একদিকে পাঞ্চালগণ এবং অন্যদিকে অর্জ্জুন অবস্থান করিয়া দ্রোণাচার্য্যকে প্রহার করিতে আরম্ভ করিলেন। তথাপি দেবরাজ যেমন রােযাবিষ্ট হইয়া দানবদল সংহার করিয়াছিলেন, তদ্রূপ দ্রোণাচার্য্য পাঞ্চালগণের প্রাণনাশ করিতে আরম্ভ করিলেন। তখন পাণ্ডবগণ বলিতে লাগিলেন―

 অর্জ্জুন যখন কোনমতেই গুরুর অনিষ্টাচরণ করিবেন না, তখন আচার্য্যের হস্তেই যে আমাদিগকে পরাজিত হইতে হইবে তাহার সন্দেহ কি?

 এই কথা শ্রবণে কৃষ্ণ কহিলেন―

 হে অর্জ্জুন! তুমি ব্যতীত কেহই বল প্রভাবে দ্রোণকে নিহত করিতে সক্ষম নহে, সুতরাং অপর কাহারও দ্বারা আচার্য্যের পরাজয় সাধন করিতে হইলে কৌশল অবলম্বন না করিলে উপায় নাই। অশ্বত্থামার মৃত্যু হইয়াছে শুনিলে আচার্য্য প্রিয়তম পুত্রের শোকে নিস্তেজ হইয়া পড়িবেন, অতএব কোন ব্যক্তি তাঁহাকে অশ্বত্থামার মৃত্যুসংবাদ প্রদান করুক।

 এ প্রস্তাবে অর্জ্জুন কর্ণপাতই করিলেন না, কিন্তু কৃষ্ণের অনুরোধে অনন্যোপায় যুধিষ্ঠির অতিকষ্টে উহাতে সম্মত হইলেন। অনুন্তর কিংকর্ত্তব্য অবধারিত হইলে তদনুসারে ভীমসেন অবন্তি-রাজের অশ্বত্থামা নামক এক গজ সংহারপুর্ব্বক অতি লজ্জিত মনে দ্রোণ-সমীপে গমন করিয়া―অশ্বত্থামা নিহত হইয়াছে—বলিয়া চীৎকার করিতে আরম্ভ করিলেন।

 দ্রোণাচার্য্য সেই দারুণ শোক সংবাদ শ্রবণমাত্র অতিশয় বিষণ্ণচিত্ত হইলেন। কিন্তু পুত্রকে অমিত-পরাক্রমশালী জানিয়া তিনি ধৈর্য্যাবলম্বনপূর্ব্বক এই সংবাদের সত্যতা সমর্থনের প্রতীক্ষায় ধৃষ্টদ্যুম্নের সহিত যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। তখন কৃষ্ণ পুনরায় যুধিষ্ঠিরকে কহিলেন—

 হে রাজন! যদি আচার্য্য রোষপরবশ হইয়া এইরূপে আর অর্দ্ধদিন যুদ্ধ করেন, তবে নিশ্চয়ই তোমার সমুদায় সৈন্যদল নিঃশেষিত হইবে; অতএব তুমি স্বয়ং দ্রোণকে অশ্বথামার মৃত্যু-সংবাদ পুনরায় না জানাইলে আমাদের আর উপায় নাই। প্রাণরক্ষার্থে মিথা কহিলে পাপস্পর্শ হয় না। ভীমের কথায় আচার্য্য অনাস্থা প্রদর্শন করিয়াছেন, কিন্তু তুমি কহিলে তিনি নিশ্চয়ই বিশ্বাস করিবেন।

 ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠির ভবিতব্যের আনুল্লঙ্ঘনীয়তা উপলব্ধি করিয়া এবং আচার্য্যকে নির্মমভাবে ধর্ম্মাধর্ম্ম-নির্ব্বিচারে সৈন্যসংহারে প্রবৃত্ত দেখিয়া কৃষ্ণের উপদেশপালনে সম্মত হইলেন। কিন্তু দ্রোণ-সমীপে উপস্থিত হইয়া জয়াভিলাষ এবং মিথ্যাকথনভয়ে যুগপৎ আক্রান্ত হইয়া তিনি—অশ্বত্থামা হত হইয়াছেন—এই কথা স্পষ্ট বলিয়া অস্পষ্টরূপে গজ শব্দ উচ্চারণ করিলেন। ভীমের বাক্য যুধিষ্ঠিরের দ্বারা সমর্থিত হইল দ্রোণ পুত্রশােকে অতিশয় অবসন্ন হইয়া বিচেতন প্রায় হইলেন।

 সেই সুযােগ পাইবামাত্র ধৃষ্টদ্যুম্ন তরবারি বিঘূর্ণিত করিয়া স্বীয় রথ হইতে লুম্ফ প্রদান করিলেন। তখন অর্জ্জুন অতিশয় অনুকম্পাপরতন্ত্র হইয়া―আচার্য্যকে বিনাশ করিও না—বলিয়া চীৎকার করিতে করিতে ধৃষ্টদ্যুম্নকে নিবারণোদ্দেশে তৎপ্রতি ধাবমান হইলেন; কিন্তু তিনি আগত হইবার পূর্ব্বেই দ্রুপদ-নন্দন দ্রোণকে প্রাপ্ত হইয়া তাঁহার মস্তকচ্ছেদনপুর্ব্বক তাঁহাকে ভূপাতিত করিলেন। তদ্দর্শনে ভীমসেন বাহ্বাস্ফোটনদ্বারা ধরাতল কম্পিত করিয়া মহাহ্লাদে ধৃষ্টদ্যুম্নকে আলিঙ্গনপূর্ব্বক কহিলেন―

 হে অরাতিনিপাতন! কর্ণ ও দুর্য্যোধন অনুরূপদশা প্রাপ্ত হইলে আমি তােমাকে সমরবিজয়ী বলিয়া পুনরায় আলিঙ্গন করিব।

 মহাবলপরাক্রান্ত দ্রোণাচার্য্য পাঁচ দিন ঘােরতর যুদ্ধ করিয়া নশ্বর-দেহত্যাগান্তে ব্রহ্মলােক প্রাপ্ত হইলে দুর্য্যোধনপ্রভৃতি মহীপালগণ সৈন্য অবহারপূর্ব্বক একান্ত বিমনায়মান হইয়া শােকাকুল অশ্বথামাকে বেষ্টনপূর্ব্বক সান্ত্বনা দিতে দিতে সেই দীর্ঘ রজনী অতিবাহিত করিলেন। অনন্তর রাজা দুর্য্যোধন কহিলেন―

 হে কর্ণ! আমি তােমার বলবীর্য্য এবং আমার প্রতি তােমার অটল সৌহার্দ্দের বিষয় বিলক্ষণ অবগত আছি। আমার সেনাপতি মহারথ ভীষ্ম ও দ্রোণাচার্য্য নিহত হইয়াছেন। এক্ষণে তুমি ভিন্ন আমার আর গতি নাই।

 মহাবীর কর্ণ এইরূপে অভিহিত হইয়া কহিলেন―

 হে কুরুরাজ! আমি পূর্ব্বেই তােমাকে বলিয়া রাখিয়াছি যে, পাণ্ডবগণকে সবান্ধবে পরাজয় করিব; অতএব এক্ষণে তােমার নিয়ােগানুসারে আমি নিশ্চয়ই সেনাপতিত্ব গ্রহণ করিব। তুমি নিশ্চিত-চিত্তে শত্রুগণকে পরাজিত বলিয়াই স্থির করিতে পার।

 তখন রাজা দুর্য্যোধন বিজয়াভিলাষী ভূপালগণের সহিত গাত্রোত্থান করিয়া সুবর্ণময় ও মৃন্ময় পূর্ণকুম্ভ, হস্তী, গণ্ডার ও বৃষের বিষাণ, বিবিধ সুগন্ধি দ্রব্য এবং সুসংভৃত অন্যান্য উপকরণদ্বারা পট্টাবস্ত্রাবৃত ও আসনোপবিষ্ট মহাবীর কর্ণকে বিধিপূর্ব্বক সেনাপতিপদে অভিষিক্ত করিলেন।

 অনন্তর কর্ণের অভিপ্রায়ানুসারে রাত্রিশেষে তূর্য্য প্রভৃতি বাদনদ্বারা সৈন্যগণকে সুসজ্জিত হইবার আজ্ঞা প্রদান করা হইল। এই সময়ে কৌরবগণ মহাধনুর্দ্ধর কর্ণকে ধ্বান্তনাশক ভানুর ন্যায় রথে অবস্থিত দেখিয়া ভীষ্ম দ্রোণ ও অন্যান্য বীরগণের বিনাশ দুঃখ বিস্মৃত হইলেন।

 বীরবর সূতপুত্র শঙ্খ-শব্দে যােধগণকে ত্বরান্বিত করিয়া বিপুল কৌরবসৈন্যদ্বারা মকরব্যূহ নির্ম্মাণ করিলেন। এই ব্যূহের মুখে কর্ণ, নেত্রদ্ধয়ে শকুনি ও উলূক, মস্তকে অশ্বত্থামা, মধ্যদেশে সৈন্যগণ-পরিবেষ্টিত দুর্য্যোধন, গ্রীবায় অন্যান্য ধার্ত্তরাষ্ট্রগণ, চরণচতুষ্টয়ে নারায়ণী-সেনা-পরিবৃত কৃতবর্ম্মা, দাক্ষিণাত্যগণ-বেষ্টিত কৃপাচার্য্য এবং স্ব-স্ব-সৈন্যদল লইয়া মহাবীর ত্রিগর্ত্তরাজ ও মদ্ররাজ শল্য বিরাজ করিতে লাগিলেন।

 নরশ্রেষ্ঠ কর্ণ, এইরূপে যুদ্ধযাত্রা করিলে ধর্ম্মরাজ অর্জ্জুনের প্রতি দৃষ্টিপাত করিয়া কহিলেন―

 ভ্রাতঃ ঐ দেখ মহাবীর কর্ণ বীরগণাভিরক্ষিত কৌরবসেনাকে কি প্রকারে শ্রেণীবদ্ধ করিয়াছেন। কিন্তু উহাদের শ্রেষ্ঠ যোদ্ধারা সকলেই নিহত হইয়াছেন; অতএব তোমার জয়লাভসম্বন্ধে আমি আর সংশয় করি না। তুমি যুদ্ধ করিলে আমার হৃদয় হইতে দ্বাদশবর্ষ সংস্থিত শল্য উদ্ধৃত হয় তুমি এক্ষণে উপযুক্ত প্রতিব্যূহ নির্ম্মাণ কর।

 জ্যেষ্ঠের এই কথা শ্রবণানন্তর অর্জ্জুন অর্দ্ধচন্দ্রাকৃতি ব্যূহ রচনা করিলেন। ব্যূহের বামপার্শ্বে ভীমসেন, দক্ষিণে মহাধনুর্দ্ধর ধৃষ্টদ্যুম্ন, মধ্যে অর্জ্জুন-রক্ষিত ধর্ম্মরাজ এবং পৃষ্ঠদেশে নকুল সহদেব অবস্থান করিতে লাগিলেন।

 তখন হস্তী অশ্ব ও মনুষ্যসঙ্কুল কুরু-পাণ্ডব-সৈন্যদল পরস্পরকে প্রহার করিতে আরম্ভ করিলে প্রধান যোধগণ নানাবিধ অস্ত্রদ্বারা নর-মস্তকচ্ছেদনপূর্ব্বক তদ্দ্বারা পৃথিবী পরিব্যাপ্ত করলেন। ক্রমে মহারথগণ সম্মুখসমরে সঙ্ঘটিত হইলে সে দিবস ক্রমান্বয়ে বহুবিধ দ্বৈরথ-যুদ্ধ চলিতে লাগিল। অবশেষে কর্ণ অতিশয় দুর্দ্ধর্ষ হইয়া উঠিলে কেই তাঁহাকে নিবারণ করিতে সক্ষম হইলেন না। মাতঙ্গগণ তাঁহার নারাচ-প্রহরে অবসন্ন হইয়া ভীষণ শব্দসহকারে চতুর্দদিকে পরিভ্রমণ করিতে আরম্ভ করিল এবং পদাতিগণ দলে দলে বিনষ্ট হইতে লাগিল।

 স্বীয় সৈন্যদলকে এইরূপে নিপীড়িত দেখিয়া পরিশেষে নকুল কর্ণের প্রতি ধাবিত হইয়া তাঁহাকে ও তাঁহার সারথিকে বিদ্ধ করিলেন। তখন মহাবীর কর্ণ ক্রোধাবিষ্ট হইয়া ভীষণতর আকার ধারণপূর্ব্বক নকুলকে শরনিকরে সমাচ্ছন্ন করিয়া তাঁহার শরাসন ছেদন করিলেন, এবং তিনি অন্য ধনু গ্রহণ করিবার পূর্ব্বেই তাঁহার সারথি ও অশ্ব বিনষ্ট করিয়া তাঁহার অস্ত্রশস্ত্রসমুবেত রথ খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিলেন। নকুল রথহীন ও অস্ত্রশূন্য হওয়ায় নিজেকে নিরুপায় দেখিয়া পলায়ন করিতে লাগিলেন। তখন সূতপুত্র হাস্যপূর্ব্বক পশ্চাদ্ধাবিত হইয়া তাঁহার গলদেশ জ্যা-রােপিত কার্ম্মুকদ্বারা আকর্ষণপূর্ব্বক সেই রুদ্ধকণ্ঠ যােদ্ধাকে কহিলেন―

 হে মাদ্রী-নন্দন! তুমি আমার সহিত বৃথা যুদ্ধ করিতে আসিয়াছিল। যাই হৌক এক্ষণে লজ্জিত হইবার প্রয়ােজন নাই; কিন্তু আর মহাবলপরাক্রান্ত কৌরবদেৱ সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইও না।

 মহাবীর কর্ণ তৎকালে নকুলকে অনায়াসে সংহার করিতে পারিতেন; কিন্তু কুন্তীর নিকট স্বীয় প্রতিজ্ঞা স্মরণপূর্ব্বক তিনি মাদ্রী-তনয়কে পরিত্যাগ করিয়া পাঞ্চালগণের প্রতি ধাবিত হইলেন এবং চক্রাকারে পরিভ্রমণ করিয়া তাহাদিগকে মর্দ্দন করিতে লাগিলেন। তখন পাঞ্চাল-সারথিগণ চক্রধ্বজ বা অক্ষবিহীন রথে জীবিতাবশিষ্ট রথিগণকে লইয়া পলায়ন করিতে আরম্ভ করিল।

 এইরূপে বীরবর সূতপুত্রের সায়কপ্রভাবে যুদ্ধে প্রবৃত্ত যোধগণের দুর্দ্দশার আর পরিসীমা রহিল না। অর্জ্জুন এতক্ষণ স্থানান্তরে সংসপ্তকগণের সহিত যুদ্ধে ব্যাপৃত ছিলেন। কৃষ্ণ পাণ্ডব-সেনাকে অতিশয় বিচলিত পলায়নপর দেখিয়া কহিলেন—

 হে ধনঞ্জয়! তুমি কি বৃথ। ক্রীড়া করিয়া সময় নষ্ট করিতেছ? সত্বর এই সংসপ্তকগণকে নিপাতিত করিয়া কর্ণ-বধের চেষ্টা কর।

 মহাবীর অর্জ্জুন কৃষ্ণের বাক্যে উত্তেজিত হইয়া দানবহন্তা বল প্রকাশপূর্ব্বক অবশিষ্ট সংসপ্তকগণকে আক্রমণ করিলেন। তিনি যে কখন শরগ্রহণ কখন শরসন্ধান আর কখনই বা শরনিক্ষেপ করিতে লাগিলেন, তাহ অবহিত হইয়াও কেহ জানিতে পারিল না। বাসুদেবও অর্জ্জুনের হস্তলাঘব দর্শনে চমৎকৃত হইলেন।

 অনন্তর সেই স্থানে কৌরবপক্ষীয় সৈন্যসমূহ সম্পূর্ণ পরাজিত হইলে অর্জ্জুন কর্ণ-বধে কৃতনিশ্চয় হইয়া তাঁহার প্রতি ধাবিত হইলেন। পথিমধ্যে অশ্বত্থামা ও দুর্য্যোধন তাঁহাকে নিবারণ করিবার চেষ্টা করিলেন, কিন্তু অর্জ্জুন তৎক্ষণাৎ তাঁহাদের কার্ম্মুক, অশ্ব ও সারথি বিনষ্ট করায় ক্ষণকালও বাধা প্রাপ্ত হইলেন না।

 অনন্তর কর্ণ যেখানে ক্রোধাবিষ্ট হইয়া পাণ্ডব-সৈন্য বিলােড়ন করিতেছিলেন, অর্জ্জুন তথায় উপস্থিত হইয়া হাস্যমুখে অস্ত্রজাল বর্ষণপূর্ব্বক কর্ণের বাণসমূহ প্রতিহত করিয়া শরনিকরে নভোমণ্ডল সমাচ্ছন্ন করিলেন। অর্জ্জুনের শরজাল মুষলের ন্যায়, পরিঘের ন্যায়, শতঘ্নীর ন্যায় ও অতি কঠোর বজ্রের ন্যায় নিপতিত হইতে লাগিল। কৌরব-সৈন্যগণ তাহাতে নিহন্যমান হইয়া নিমীলিত-লােচনে ভ্রমণ ও আর্ত্তনাদ করিতে লাগিল।

 এই সময়ে ভানুমান্ অস্তাচলশিখরে আরােহণ করিল এবং রণক্ষেত্র-সমুত্থিত ধূলিপটল প্রভাবে অন্ধকার গাঢ়তর হওয়ায় আর কিছুই দৃষ্টিগোচর রহিল না। তখন কৌরব, মহারথগণ পুনরায় রাত্রিযুদ্ধ-সম্ভাবনায় নিতান্ত ভীত হইয়া সৈন্যগণসমভিব্যাহারে রণস্থল হইতে অপগমন করিলেন। অগত্যা সেনাপতি কর্ণকে যুদ্ধকার্যয় স্থগিত করিতে হইল। পাণ্ডবগণ জয়শ্রী লাভ করিয়া শত্রুগণকে উপহাস এবং কৃষ্ণার্জ্জুনের স্তুতিবাদ করিতে করিতে স্ব-শিবিরে গমন করিলেন।

 পরদিন মেঘ-গর্জ্জনের ন্যায় সহস্র তুর্য্য ও অযুত ভেরীর ঘােতর শব্দ কর্ণের যুদ্ধযাত্রা বিজ্ঞাপনপূর্ব্বক কৌরবসৈন্যগণকে উদ্বোধিত করিল।

 এদিকে রাজা যুধিষ্ঠির কৌরব-সেনামুখে কর্ণকে অবলোকন করিয়া শত্রুঘ্ন ধনঞ্জয়কে কহিলেন―

 হে অর্জুন! ঐ দেখ মহাবীর সূতপুত্র সংগ্রামর্থ মহাব্যূহ রচনা করিয়াছেন। এক্ষণে তুমি কর্ণের সহিত যুদ্ধ কর, আমি কৃপের সহিত সমরে প্রবৃত্ত হইতেছি, আর ভীমসেন দুর্য্যোধনের সহিত, নকুল বৃষসেনের সহিত, সহদেব শকুনির সহিত ও সাত্যকি কৃতবর্ম্মার সহিত সংগ্রামে মিলিত হউন।

 অর্জ্জুন অনুমতি প্রাপ্ত হইয়া যাত্রার পুর্ব্বে কহিলেন—

 মহারাজ! তোমার পাদস্পর্শ করিয়া প্রতিজ্ঞা করিতেছি যে, কর্ণকে সংহার না করিয়া আমি রণস্থল হইতে প্রত্যাগমন করিব না।

 অনন্তর অপরাহ্ণকালে ভীমসেনের সমক্ষেই মহাবীর কর্ণ সোমকসৈন্যগণকে অতিশয় নিপীড়িত করিতে আরম্ভ করিলে মহাতেজা বৃকোদরও দুর্য্যোধনের সৈন্যমধ্যে প্রবিষ্ট হইয়া অতি অদ্ভুত বল প্রকাশ করিতে প্রবৃত্ত হইলেন। তাঁহার যুদ্ধ প্রভাবে কৌরব-সৈন্যগণ ভগ্ন হইতে আরম্ভ করিলে দুর্য্যোধন অশ্বত্থামা ও দুঃশাসনপ্রভৃতি বীরগণ তাঁহার প্রতি ধাবিত হইলেন।

 সর্ব্বাগ্রে মহাবীর দুঃশাসন শরনিকর বর্ষণপুর্ব্বক নির্ভয়ে ভীমসেনের সহিত যুদ্ধ আরম্ভ করিলেন। তখন বীরদ্বয় পরস্পরের বধাভিলাষী হইয়া দেহবিদারণক্ষম সুতীক্ষ্ণ বাণসমূহে পরস্পরকে আচ্ছন্ন করিলেন। মহাপরাক্রমশালী বৃকোদর ক্রোধাবিষ্ট হইয়া দুঃশাসনের প্রতি এক সুশাণিত শক্তি প্রয়োগ করিলেন, প্রজ্বলিত উদ্ধার ন্যায় সেই শক্তি সমাগম হইতেছে দেখিয়া দুঃশাসন আকর্ণসমাকৃষ্ট দশ শরে তাহা মধ্যপথেই খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিলেন। তদ্দর্শনে কৌরবগণ অতিশয় আহ্লাদিত হইয়া তাঁহার সেই মহৎকার্য্যের প্রশংসা করিতে লাগিলেন।

 অনন্তর মহাবীর দুঃশাসন সমরাঙ্গণে আশ্চর্য্য কৌশল প্রদর্শনপুর্ব্বক পুনরায় ভীমসেনকে বিদ্ধ করিয়া তাঁহার শরাসন ছেদন ও সারথিকে আহত করিলেন। তখন ভীম দুইটি ক্ষুরপ্রদ্বারা দুঃশাসনের কার্ম্মুক ও ধ্বজদণ্ড খণ্ড খণ্ড করিয়া তাঁহার সারথির মস্তকচ্ছেদন করলেন। তখন রাজকুমার দুঃশাসন স্বয়ং বল্গা গ্রহণপূর্ব্বক অশ্বগণকে স্ব-বশে রাখিয়া অন্য শরাসনে এক অশনিতুল্য ভীষণ বাণ যােজনা করিয়া তাহা ভীমসেনের প্রতি পরিত্যাগ করলেন। সেই শরে নির্ভিন্নকলেবর ও স্খলিতদেহ হইয়া ভীমসেন বাহুপ্রসারণপূর্ব্বক রথমধ্যে পতিত হইলেন, কিন্তু অবিলম্বে পুনরুত্থিত হইয়া তিনি দুঃশাসনকে কহিলেন—

 অহে দুরাত্মন্! তুমি ত আমাকে বিদ্ধ করিলে; এক্ষণে আমার এই গদপ্রহার সহ্য কর।

 এই বলিয়া মহাবল বৃকোদর এক দারুণ গদা পরিত্যাগ করিবামাত্র তাহা ভীষণ বেগে দুঃশাসনের মস্তকে পতিত হইয়া তাঁহাকে রথ হইতে দশ ধনু অন্তরে প্রক্ষিপ্ত করিল এবং তাঁহার রথ ও অশ্ব চূর্ণ করিয়া ফেলিল। দুঃশাসন উত্থানশক্তি-রহিত হইয়া কম্পিত-কলেবরে ভূতলে বিলুণ্ঠিত হইতে লাগিলেন।

 তখন সেই বীরঞ্জন-ভূয়িষ্ঠ ঘরতর সংগ্রামস্থলে দুঃশাসনকে পতিত দেখিয়া ধার্ত্তরাষ্ট্রগণ-কৃত সমস্ত অত্যাচার ভীমসেনের স্মৃতিপথে উদিত হইল। বনবাস-ক্লেশ দ্রৌপদীর কেশাকর্ষণ, বস্ত্রহরণ এবং অন্যান্য বিবিধ প্রকার লাঞ্ছনাসকল স্মরণ করিতে করিতে অসহিষ্ণু বৃকোদর ক্রোধে প্রজ্বলিত হইয়া রথ হইতে লম্ফ প্রদান করিলেন এবং ক্ষণকাল সােৎসুক নয়নে দুঃশাসনকে নিরীক্ষণ করিয়া স্বীয় প্রতিজ্ঞা সফল করিবার নিমিত্ত তিনি শিতধার অসি সমুদ্যত করিয়া ভূতলশায়ী দুঃশাসনের উপর পদার্পণপূর্ব্বক তাঁহার বক্ষঃস্থল বিদ্ধ করলেন এবং উচ্ছ্বসিত রুধিরে অঞ্জলি পরিপূর্ণ করিয়া তিনি সমবেত স্তম্ভিত বীরগণকে কহিলেন—

 হে কৌরবগণ! আজ আমি পাপাত্মা দুঃশাসনকে যমালয়ে প্রেরণ ও তাহার রুধিরপানপূর্ব্বক প্রতিজ্ঞামুক্ত হইলাম। এক্ষণে দুর্য্যোধনরূপ দ্বিতীয় পশুকে নিহত করিলে এই মহাসংগ্রাম-যজ্ঞ সমাপ্ত হইবে।

 এই সময়ে সেই রক্তাক্ত-কলেবর লােহিতাক্ষ অচিন্ত্যকর্ম্মা ভীমসেনকে হৃষ্টচিত্তে বিচরণ করতে দেখিয়া যােধগণের মধ্যে কেহ অস্ফুট স্বরে চীৎকার করিল, কাহারও বা হস্ত হইতে অস্ত্র খসিয়া পড়িল, কেহ কেহ সঙ্কুচিতনেত্রে মুখ বিবর্ত্তন করিল, এবং সৈন্যগণ ভয়ে পলায়ন করিতে আরম্ভ করিল।

 ইত্যবসরে মহাবীর অর্জ্জুন যুধিষ্ঠিরের নিকট হইতে রণস্থলে আগমন করিলে একদিক্‌ হইতে তিনি এবং অপর দিক্‌ হইতে মহাবীর কর্ণ শত্রুগণকে বিদারণ করিতে করিতে পরম্পরাভিমুখে অগ্রসর হইতে লাগিলেন। উভয়পক্ষীয় চতুরঙ্গিণী সেনা সেই বীরদ্বয়কত্তৃক নিপীড়িত হইয়া সিংহতাড়িত মৃগযূথের ন্যায় পলায়ন করিতে লাগিল। ভুপালগণ কর্ণের হস্তিকেতু এবং অর্জ্জুনের কপিধ্বজ এতদুভয় রথকে ঘোরনির্ঘোযে পরস্পরের প্রতি ধাবমান দেখিয়া বিস্ময়াবিষ্টচিত্তে সিংহনাদ-সহকারে সেই বীরদ্বয়কে অনবরত সাধুবাদ প্রদান করিতে লাগিলেন। কর্ণকে উৎসাহ প্রদানার্থে কৌরবগণ চতুর্দ্দিকে বাদিত্রধ্বনি সমুত্থিত করিল এবং পাণ্ডবপক্ষীয় শঙ্খ ও তূর্য্যনিনাদে অর্জ্জুনের অভিনন্দন করা হইল।

 অনন্তর উদ্ভিন্নদন্ত মদমত্তমাতঙ্গদ্বয় যেমন পরস্পর সংঘটিত হয় কর্ণাজ্জুনও তদ্রূপ সম্মিলিত হইলেন। মহাবীর কর্ণ দশ শরে ধনঞ্জয়কে প্রথমে বিদ্ধ করিলে অর্জ্জুনও হাস্য করিয়া সূতপুত্রের বক্ষঃস্থলে শিতধার দশ শর নিক্ষেপ করিলেন। তৎপরে সেই বীরদ্বয় অসংখ্য সুপুঙ্খ সায়কে পরস্পরকে ক্ষতবিক্ষত করিলেন।

 এই সময়ে দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামা দুর্য্যোধনের হস্তধারণপূর্ব্বক কহিলেন―

 মহারাজ! এক্ষণে ক্ষান্ত হও। যাহাতে মহারথ ভীষ্ম এবং অস্ত্রবিদ্যা-বিশারদ পিতা নিহত হইয়াছেন; সে যুদ্ধে ধিক্! আমি ও আমার মাতুল অবধ্য বলিয়াই জীবিত আছি; কর্ণ বিনষ্ট হইলে তুমিও পরিত্রাণ পাইবে না; অতএব, হে কুরুরাজ! তুমি শুনুমতি দাও, আমি ধনঞ্জয়কে নিবৃত্ত হইতে অনুরোধ করি; তিনি নিশ্চয়ই আমার কথা রক্ষা করিবেন।

 দুর্য্যোধন এইরূপে অভিহিত হইলে ক্ষণকাল চিন্তানিমগ্ন খাকিয়া অবশেষে কহিলেন―

 সখে! তুমি যাহা কহিলে তাহা সত্য, কিন্তু ভীমসেন শার্দ্দুলের ন্যায় দুঃশাসনকে হনন করিয়া যে সকল বাক্য প্রয়ােগ করিয়াছেন, তাহা তােমার অবিদিত নাই, তাহার পর আর কিরূপে শান্তি সম্ভবে? কর্ণকেও এই বহুদিন বাঞ্ছিত দ্বৈরথ যুদ্ধ হইতে নিবৃত্ত করা কর্ত্তব্য নহে। হে গুরুপুত্র! আমি ভীত হইবার কোন কারণ দেখিতেছি না। প্রচণ্ড বায়ু যেমন মেরু পর্ব্বতকে ভগ্ন করিতে পারে না, তদ্রূপ অর্জ্জুনও কখনই মহাবীর কর্ণকে পরাজয় করিতে সক্ষম হইবে না।

 এদিকে, সেই পরস্পর-প্রহার-প্রবৃত্ত প্রতিদ্বন্দ্বিদ্বয় অনবরত জ্যা-নিস্বন ও তলধ্বনি করিয়া বিবিধ অস্ত্রসকল পরিত্যাগ করিতেছিলেন। এই সময়ে মহাবীর ধনঞ্জয়ের শরাসন-জ্যা অতিমাত্র আকৃষ্ট হওয়ায় ঘােররবে সহসা ছিন্ন হইয়া গেল। সেই অবসরে লঘুহস্ত সূতপুত্র বহুসংখ্যক ক্ষুদ্রক ও কঙ্কপত্র-ভূষিত অন্যান্য বাণে ধনঞ্জয়কে সমাচ্ছন্ন করিলেন। অর্জ্জুনের রক্ষকগণ সমীপে আগত হইয়া বহুবিধ চেষ্টা করলেও কিছুতেই কর্ণশর খণ্ডন করিতে না পারায় কৃষ্ণ ও অর্জ্জুন গাঢ় বিদ্ধ হইয়া রুধিরাক্ত হইলেন। কৌরবগণ তদ্দর্শনে আপনাদিগকে সমরবিজয়ী জ্ঞান করিয়া আনন্দধ্বনি ও সিংহনাদ করিতে লাগিলেন।

 তখন মহাবীর ধনঞ্জয় ক্রোধভরে শরাসন-জ্যা অবনামিত করিয়া কর্ণের শরসমুদায় নিরাকৃত করিলেন। তাঁহার মহাস্ত্রপ্রভাবে অন্তরীক্ষ পরিব্যাপ্ত হওয়ায় পক্ষিগণের গতিরোধ হইল। কর্ণ অর্জ্জুনের অশনিতুল্য শরে সাতিশয় ব্যথিত হইলেন এবং তাঁহার রক্ষকগণ আত্মীয়দিগকে নিহন্যমান দেখিয়া পলায়ন করিতে আরম্ভ করিল। কিন্তু মহাবীর কর্ণ রক্ষককর্ত্তৃক পরিত্যক্ত হইয়াও নির্ভীকচিত্তে অর্জ্জুনকে আক্রমণ করিতে লাগিলেন।

 এইরূপে বল বীর্য্য পৌরুষ ও অস্ত্রকৌশল-প্রভাবে কখন কর্ণ ধনঞ্জয় অপেক্ষা, কখন অর্জ্জুন সূতপুত্র অপেক্ষা প্রবল হইলেন।

 অনন্তর বহুক্ষণ যুদ্ধ হইলে যখন কর্ণ কোন ক্রমেই ধনঞ্জয়কে অতিক্রম করিতে পারিলেন না, প্রত্যুত তন্নিক্ষিপ্ত শরনিকরে সাতিশয় সন্তপ্ত হইয়া উঠিলেন তখন বহুদিন যত্নরক্ষিত বিষমুখ সর্পবাণ তাঁহার স্মৃতিপথে উদয় হইল। তিনি অর্জ্জুনের মস্তক ছেদনার্থে সেই জ্বালাকরাল ভয়ঙ্কর শর পরিত্যাগপূর্ব্বক কহিলেন—

 অর্জ্জুন! এইবার তুমি নিহত হইলে।

 মহাত্মা বাসুদেব সেই সূতপুত্র-নিক্ষিপ্ত নাগাস্ত্র অন্তরীক্ষে প্রজ্জ্বলিত দেখিয়া সুশিক্ষিত অশ্বগণকে ইঙ্গিত করিবামাত্র তাহারা জানু আকুঞ্চিত করিয়া ভূতলে অবস্থানপূর্ব্বক রথের অগ্রভাগ সহসা অবনত করিয়া দিল। তখন সেই অর্জ্জুনের গ্রীবার প্রতি লক্ষিত শর তাঁহার সুদৃঢ় ইন্দ্রদত্ত কিরীটে নিপতিত হইয়া তাহা চূর্ণ করিয়া ফেলিল।

 ধনঞ্জয় অনাকুলিত-চিত্তে শ্বেতবসনদ্বারা কেশপকলাপ বন্ধনপূর্ব্বক দণ্ডবিঘট্টিত সর্পের ন্যায় ক্রোধাবিষ্ট হইয়া যমদণ্ডসদৃশ লৌহময় সুদৃঢ় বাণে কর্ণের বক্ষঃস্থল ভেদ করিলেন। সূতপুত্র অর্জ্জুনের বাণে রক্তাক্ত ও শিথিলমুষ্টি হইয়া শরাসন ও তূণীর পরিত্যাগপূর্ব্বক রথােপরি মূর্চ্ছিত হইলেন। তখন পরমধার্ম্মিক ধনঞ্জয় আতুর ব্যক্তিকে প্রহার করা অনুচিত বিবেচনায় কর্ণকে সেই ব্যসনকালে বিনাশ করিবার চেষ্টা করলেন না। বাসুদেব তর্দ্দশনে ব্যস্ত হইয়া কহিলেন—

 হে অর্জুন! তুমি কি নিমিত্ত প্রমত্ত হইতেছ? অরাতি দুর্ব্বল হইলেও তাহাদিগকে নিধন করিবার নিমিত্ত পণ্ডিতগণ কাল প্রতীক্ষা করেন না।

 হে অর্জ্জুন! কর্ণ বিমোহিত হইতেছেন, অতএব এই বেলা অস্ত্র-প্রয়োগে উহাকে সংহার কর।

 ইতিমধ্যে কর্ণ চেতনা লাভ করিলেন ও ধনঞ্জয়ের বাণবর্ষণে অত্যন্ত বিচলিত হইয়া কর্ণ পুনরুদ্দীপিত উদ্যমসহকারে ব্রহ্মাস্ত্র ত্যাগ করিতে আরম্ভ করিলে ক্রমে তিনি পুনরায় প্রবল হইয়া উঠিলেন। এই সময়ে সহসা দক্ষিণ চক্র পঙ্কে নিমগ্ন হইলে কর্ণের রথ অচল হইল। কর্ণ ক্রোধে অশ্রু বিসর্জ্জনসহকারে অর্জ্জুনকে কহিলেন―

 হে পার্থ! দৈববশত আমার রথচক্র ধরণীতে প্রোথিত হইয়াছে, অতএব তুমি মুহূর্ত্তকাল যুদ্ধ স্থগিত রাখ, আমি মহীতল হইতে উহাকে উদ্ধার করি। হে অর্জ্জুন তুমি মহৎকুলসম্ভুত ও ক্ষত্রধর্ম্মজ্ঞ, এই নিমিত্তই আমি কহিতেছি— এক্ষণে কাপুরুষের ন্যায় আমাকে প্রহার করিও না।

 কর্ণের কথার উত্তরে কৃষ্ণ কহিতে লাগিলেন―

 হে সূতপুত্র! তুমি ভাগ্যক্রমে এই সময়ে ধর্ম্ম স্মরণ করিতেছ। নীচাশয়েরা দুঃখে নিমগ্ন হইলেই নিজ দুষ্কর্ম্ম বিস্মৃত হইয়া দৈবকে নিন্দা করে। তােমার অভিমতে যখন দ্রোপদীকে দ্যূতসভায় অপমান করা হইয়াছিল, তখন তােমার ধর্ম্ম কোথায় ছিল? যখন অক্ষক্রীড়ায় অনভিজ্ঞ ধর্ম্মরাজকে শকুনির দ্বারা শঠতাপূর্ব্বক পরাজয় করা হইয়াছিল, তখন তােমার ধর্ম্ম কোথায় ছিল? আর যখন তোমরা সপ্ত মহারথ সমবেত হইয়া বালক অভিমন্যুকে পরিবেষ্টনপূর্ব্বক বধ করিয়াছিলে, তখনই বা তোমার ধর্ম্ম কোথায় ছিল? এখন তুমি ধর্ম্ম ধর্ম্ম করিয়া তালু শুষ্ক করিলে কি হইবে?

 বাসুদেবের এই কথায় কর্ণ লজ্জায় অধোবদন হইয়া নিরুত্তর রহিলেন। অনন্তর তিনি নিরুপায় হইয়া অচল রথ হইতেই অতি ঘাের বাণসমূহ বর্ষণ করিতে আরম্ভ করিলেন। তন্মধ্যে সহসা এক ভয়ঙ্কর বাণ ভীষণধেগে পরিত্যক্ত হইয়া অর্জ্জুনের বক্ষস্থলে প্রবেশপূর্ব্বক তাঁহাকে অতি গাঢ়রূপে বিদ্ধ করিল। সেই মর্ম্মঘাতী আঘাতে তাঁহার শিথিল হস্ত হইতে গাণ্ডীব স্রস্ত হইয়া পড়িল এবং তিনি কম্পিকলেবরে ক্ষণকাল অবসন্ন হইয়া রহিলেন।

 সেই অবসরে কর্ণ রথ হইতে লম্ফ প্রদানপূর্ব্বক প্রাণপণে পঙ্ক হইতে রথচক্র উদ্ধার করিবার চেষ্টা করিতে লাগিলেন; কিন্তু সেই গাঢ় নিমগ্ন চক্রকে কিছুতেই উত্তােলন করিতে সক্ষম হইলেন না। ইত্যবসরে অর্জ্জুন প্রকৃতিস্থ হইলেই বাসুদেব কহিলেন―

 হে অর্জ্জুন! কর্ণ পুনরায় রথে আরােহণ না করিতেই উহার মস্তক ছেদন কর।

 তখন অর্জ্জুন তূণীর হইতে ইন্দ্রের বজ্রসদৃশ এক বাণ গ্রহণ ও গাণ্ডীবে যােজনা করিলেন। ব্যাদিতাস্য কৃতান্তের ন্যায় সেই ভীষণ অস্ত্র অর্জ্জুনকর্ত্তৃক আকর্ণ আকৃষ্ট ও পরিত্যক্ত হইলে তাহা প্রজ্বলিত উল্কার ন্যায় দিঙ্মণ্ডল উদ্ভাসিত করিয়া কর্ণের মস্তক ছেদনপূর্ব্বক শরৎকালীন নভােমণ্ডল হইতে নিপতিত দিবাকরের ন্যায় তাঁহার দেহ হইতে ভূতলে পাতিত করিল। সূতপুত্রের উন্নত কলেবরও কুলিশ-বিদলিত গৈরিকস্রাবী গিরি-শিখরের ন্যায় ধরাশায়ী হইল।

 তখন বাসুদেব যৎপরােনাস্তি আহ্লাদিত হইয়া অতি গম্ভীরস্বরে শঙ্খধ্বনি করিতে লাগিলেন এবং অন্যান্য পাণ্ডব পক্ষীয় বীরগণ অর্জ্জুনের সমীপে আগমন করিয়া তাঁহাকে সম্বর্ধনাপূর্ব্বক সিংহনাদ এবং অস্ত্রাদি বিধুনন করিতে লাগিলেন।

 এদিকে দুর্য্যোধন শোকসাগরে একান্ত নিমগ্ন হইয়া― হা কর্ণ!―বলিয়া বারম্বার বিলাপ পরিতাপ করিতে করিতে হতাবশিষ্ট ভূপালগণের সহিত অতি কষ্টে স্ব-শিবিরে প্রবেশ করিলেন। কৌরবগণ বিবিধ যুক্তিদ্বারা কুরুরাজকে সান্ত্বনা দিবার নিমিত্ত নিরন্তর যত্নবান হইলেন, কিন্তু তিনি প্রিয়সখা ও প্রধান আশ্রয়স্থল কর্ণের নিধন-ঘটনা চিন্তা করিয়া কিছুতেই সুখ বা শান্তিলাভে সমর্থ হইলেন না।

 তখন দুর্য্যোধন অশ্বত্থামাকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন―

 হে গুরুপুত্র! কাহাকে সেনাপিতপদে অভিষিক্ত করিব তৎসম্বন্ধে তুমিই উপদেশ প্রদান কর। এক্ষণে তােমা ভিন্ন আমার আর গতি নাই।

 তদুত্তরে অশ্বত্থামা কহিলেন—

 মহারাজ! মদ্রাধিপতি শল্য বলবীর্য্য যশপ্রভৃতি অশেষ গুণসম্পন্ন। এই কৃতজ্ঞ বীর স্বীয় ভাগিনেয় যুধিষ্ঠিরকে পরিত্যাগ করিয়া আমাদের নিকট উপস্থিত হইয়াছেন; অতএব ইঁহাকে সেনাপতিরূপে বরণ করলে আমরা জয়লাভের আশা করিতে পারিব।

 এই বাক্য অনুসারে দুর্য্যোধন কৃতাঞ্জলিপুটে মদ্ররাজের নিকট নিবেদন করিলেন―

 হে মিত্রবৎসল! মিত্র ও অমিত্র পরীক্ষার কাল উপস্থিত হইয়াছে। আমরা যদি আপনার অনুগ্রহের পাত্র হই, তবে এক্ষণে সেনাপতি পদে অভিষিক্ত হৌন। ইন্দ্র যেমন দানবগণকে বিনাশ করিয়াছিলেন, আপনিও তদ্রূপ পাণ্ডব ও পাঞ্চালগণকে বিনাশ করুন।

 শল্য কহিলেন—

 হে কুরুরাজ! তুমি যাহা অনুমতি করিতেছ, আমি তাহাই করিব। পাণ্ডবগণের কথা দূরে থাক্‌, সুরগণ যুদ্ধে উদ্যত হইলেও আমি তাঁহাদের বিপক্ষে যুদ্ধ করিতে কাতর হই না।

 রাজা দুর্য্যোধন মদ্ররাজকে উৎসাহযুক্ত দেখিয়া হৃষ্টমনে তাঁহাকে শাস্ত্রবিধি অনুসারে অভিষিক্ত করিলেন। সকলে পরামর্শ করিয়া এই যুদ্ধনিয়ম সংস্থাপন করিলেন যে, কোন ব্যক্তি একাকী পাণ্ডবগণের সহিত যুদ্ধ করিবে না; পরন্তু সকলে মিলিয়া পরস্পরের রক্ষাবিষয়ে নিরন্তর যত্ন করিয়া যুদ্ধক্ষেত্রে বিচরণ করিবে।

 প্রভাত হইলে প্রবল প্রতাপশালী মদ্ররাজ সর্ব্বতোভদ্র ব্যূহ রচনা করিয়া স্বয়ং মদ্রদেশীয় বীরগণে পরিবৃত হইয়া তাহার মুখে অবস্থান করিলেন। কৌরবগণ পরিরক্ষিত মহারাজ দুর্য্যোধন ব্যূহের মধ্যভাগে, সংসপ্তকগণকে লইয়া কৃতবর্ম্মা বামপার্শ্বে, যবনসেনা-পরিবেষ্টিত কৃপাচার্য্য দক্ষিণ পার্শ্বে এবং কাম্বোজগণ-সমবেত অশ্বত্থামা পৃষ্ঠদেশে অবস্থান করিতে লাগিলেন। শকুনি ও উলুক অশ্বসৈন্যসমভিব্যাহারে সর্ব্বাগ্রে পাণ্ডবগণের অভিমুখে ধাবমান হইলেন।

 অনন্তর মদ্ররাজ সুসজ্জিত রথে আরোহণপূর্ব্বক বেগশালী শরাসনে অনবরত টঙ্কার প্রদানপূর্ব্বক শত্রুদলনার্থে ধাবমান হইলে দুর্য্যোধনের মনে পুনরায় আশার সঞ্চার হইল। এদিকে পাণ্ডবগণও প্রতিব্যূহ নির্ম্মাণপুর্ব্বক কৌরবগণের আক্রমণ নিবারণ করিলেন। ধৃষ্টদ্যুম্ন শিখণ্ডী ও সাত্যকি শল্যর সৈন্যের প্রতি গমন করিলেন, অর্জ্জুন কৃতবর্ম্মা রক্ষিত সংসপ্তকগণের প্রতি, সােমকগণের সহিত ভীমসেন কৃপাচার্য্যের প্রতি এবং নকুল ও সহদেব সসৈন্য শকুনি ও ও উলূকের প্রতি ধাবমান হইলেন।

 ক্রমে শল্যের বিক্রম অসহ্য হইয়া উঠিল। তিনি একাকীই যেন সমগ্র পাণ্ডব-সৈন্যের সহিত যুদ্ধ করিতে লাগিলেন এবং যুধিষ্ঠিরকে শরনিকরে অতিশয় ব্যথিত করিয়া তুলিলেন। তখন মহারথ ধর্ম্মরাজ রােষভরে—হয় জয়লাভ করিব না হয় বিনষ্ট হইব―এই স্থির করিয়া পুরুষকার অবলম্বনপূর্ব্বক ভ্রাতৃগণ ও বাসুদেবকে কহিলেন—

 হে নরসত্তমগণ! ভীষ্ম-দ্রোণ-কর্ণ প্রভৃতি যে সকল বীরগণ দুর্য্যোধনের নিমিত্ত সমরস্থলে পরাক্রম প্রকাশ করিয়াছিলেন, তোমরা তাঁহাদিগকে স্ব স্ব অংশানুসারে নিপাতিত করিয়াছ। এক্ষণে আমার অংশে এই মহারথ শল্য অবশিষ্ট আছেন; অতএব আমিই ইঁহাকে পরাজয় করিব। নকুল ও সহদেব আমার চক্র রক্ষা করিবেন, সাত্যকি ও ধৃষ্টদ্যুম্ন আমার দুই পার্শ্বে থাকিবেন। ধনঞ্জয় আমার পৃষ্ঠরক্ষায় নিযুক্ত হোন এবং ভীমসেন আমার অগ্রে অবস্থান করুন। আমি সত্য বলিতেছি আজি জয় হৌক আর পরাজয় হৌক আমি ক্ষত্রধর্ম্মানুসারে মাতুলের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইব।

 রাজা যুধিষ্ঠির এই রূপ প্রতিজ্ঞারূঢ় হইয়া মদ্রাধিপতি শল্যের সন্নিধানে গমন করিলেন। তখন মহাবীর মদ্ররাজ যুধিষ্ঠিরের প্রতি ইন্দ্রনির্ম্মুক্ত বারিধারার ন্যায় অনবরত শর নিকর বর্ষণ করিতে লাগিলেন। তৎকালে কেহই তাঁহার কোন রন্ধ্র প্রাপ্ত হইল না। অনন্তর ধর্ম্মরাজও অস্ত্রবর্ষণে প্রবৃত্ত হইলে দুই বীর শার্দ্দূলদ্বয়ের ন্যায় পরস্পরকে ক্ষত বিক্ষত করিতে লাগিলেন। অল্পক্ষণমধ্যেই মহাবীর শল্য এক খরধার ক্ষুরের দ্বারা যুধিষ্ঠিরের কার্ম্মুক ছেদন করিলে ধর্ম্মরাজ অতিশয় রুষ্ট হইয়া অন্য শরাসন গ্রহণপূর্ব্বক নতপর্ব্ব বাণসমূহে শল্যর সারথি ও অশ্ব বিনষ্ট করিলেন। তখন অশ্বথামা মদ্ররাজকে স্বীয় রথে আরোপিত করিয়া প্রস্থান করিলেন।

 কিন্তু যুধিষ্ঠিরের সিংহনাদ এবং পাণ্ডবগণের আনন্দধ্বনি কিছুতেই সহ্য না করিতে পারিয়া শল্য সত্বর অন্য রথে আরোহণপূর্ব্বক যুধিষ্ঠিরের সমক্ষে প্রত্যাগত হইলেন। তখন পাণ্ডব পাঞ্চাল ও সোমকগণ তাঁহাকে চতুর্দ্দিক হইতে বেষ্টন করিলেন। তদ্দর্শনে দুর্য্যোধনও কৌরবগণকে লইয়া তাঁহার রক্ষার নিমিত্ত অগ্রসর হইলেন। অনন্তর মদ্রাধিপতি সহসা যুধিষ্ঠিরকে বক্ষস্থলে বিদ্ধ করিলে ধর্ম্মরাজ উত্তেজিত হইয়া মহাবেগে শল্যর উপর শরাঘাত করিয়া তাঁহাকে মূর্চ্ছিতপ্রায় করিয়া অতিশয় আহ্লাদিত হইলেন।

 তখন মহাবীর কৃপ ছয় শরে যুধিষ্ঠিরের সারথির শিরচ্ছেদনপূর্ব্বক তাহাকে ভূতলে পাতিত করিলেন। তাহাতে মহাবল বৃকোদর মদ্রারাজের ধনু দ্বিখণ্ড করিয়া তাঁহার অশ্বগণ বিনষ্ট করলেন। এবং ধৃষ্টদ্যুম্ন শিখণ্ডী সাত্যকি প্রভৃতি বীরগণ শল্যকে শাণিত শরনিকরে সমাচ্ছন্ন করিলেন।

 সেই শরজালে বিমােহিতপ্রায় হইয়া মদ্ররাজ অশ্ববিহীন রথ পরিত্যাগপূর্ব্বক খড়্গ-চর্ম্ম হস্তে লইয়া যুধিষ্ঠিরের প্রতি ধাবিত হইলেন। শল্য অধিকদূর অগ্রসর হইবার পূর্ব্বেই ধর্ম্মরাজের বিপদ অবলোকনে ভীমসেন ভল্লদ্বারা সেই খড়্গচর্ম্ম ছেদন করিলেন। মহাতেজা বৃকোদরের সেই অদ্ভুতকার্য্য সন্দর্শনে পাণ্ডবগণ আনন্দভরে সিংহনাদ করিতে লাগিলেন।

 কিন্তু মদ্ররাজ অস্ত্রহীন হইয়া যুধিষ্ঠিরকে আক্রমণ করিবার সঙ্কল্প পরিত্যাগ না করিয়া রিক্তহস্তেই ধাবমান হইলেন। তখন ধর্ম্মরাজ ক্রোধে প্রদীপ্ত হইয়া এক প্রচণ্ড শক্তি গ্রহণ ও প্রযত্নসহকারে নিক্ষেপ করিয়া হস্ত প্রসারণপূর্ব্বক মহাতর্জ্জন-গর্জ্জন-সহকারে কহিলেন―

 হে মদ্ররাজ! এইবার তুমি নিহত হইলে।

 সেই শক্তি শল্যের বক্ষে প্রবিষ্ট হইয়া মর্ম্মস্থলসমুদায় ভেদ করিলে তিনি রুধিরসিক্ত-কলেবরে বাহুপ্রসারণ করিয়া ভূতলে নিপতিত হইলেন। হােমাবসানে প্রশমিত অগ্নির ন্যায় সেই মহারথ ধরাশয্যায় সুষুপ্তি লাভ করিলে সেনাপতিবিহীন বলসকল বিশৃঙ্খলভাবে হাহাকার করিয়া পলায়ন করিতে লাগিল। তাহাদের ব্যগ্রগতিতে সমরাঙ্গণ ধূলিরাশিতে সমাচ্ছন্ন হইলে আর কিছুই দৃষ্টিগোচর রহিল না।

 পাণ্ডবপক্ষীয় বীরগণ কৌরবসৈন্যকে নিতান্ত ছিন্ন ভিন্ন দেখিয়া হৃষ্টান্তঃকরণে তাহাদের বিনাশার্থে সােৎসাহে ধাবিত হইলেন। তখন দুর্য্যোধন সারথিকে কহিলেন―

 হে সুত! ধনুর্দ্ধর ধনঞ্জয় আমাদের সৈন্যদিগকে অতিক্রম করিবার চেষ্টা করিতেছেন; অতএব তুমি এক্ষণে সৈন্যগণের পশ্চাদ্ভাগে রথ চলনা কর। আমি সমরে অবস্থান করিয়া যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইলে সৈন্যগণ নিশ্চয়ই প্রতিনিবৃত্ত হইবে।

 সারথি দুর্য্যোধনের এই বীরজনোচিত বাক্য প্রতিপালন করিলে অবশিষ্ট পদাতিগণ রাজাকে অসহায় পরিত্যাগ করিয়া যাইতে অনিচ্ছুক হইয়া প্রাণপণে যুদ্ধার্থে পুনরায় দণ্ডায়মান হইল এবং যোধগণও জীরিতাশা পরিত্যাগপূর্ব্বক সংগ্রামে মনোনিবেশ করিয়া ধনঞ্জয়ের উপর বাণবর্ষণ করিতে আরম্ভ করলেন। কিন্তু মহাবীর ধনঞ্জয় গাণ্ডীবপ্রভাবে তাহাদের অস্ত্রসকল অনায়াসে বিফল করিলেন।

 তাঁহার অশনিসদৃশ শরসমূহ জলধরনির্ম্মুক্ত বারিধারারায় নিপতিত হইলে কৌরবসৈন্যগণ তাহা কোনক্রমেই সহ্য করিতে পারিল না। কেহ বাহনবিহীন, কেহ অস্ত্রশূন্য, কেহ বা অস্ত্রাঘাতে বিমোহিত এবং কেহ কেহ পুনরায় পলায়নপরায়ণ হইল। অনেক বীর শিবিরে পুনরাগমনপূর্ব্বক রথ ও অস্ত্র সংগ্রহ করিয়া রণক্ষেত্রে গমন করিতে লাগিলেন।

 এই সময়ে ধৃতরাষ্ট্রের দ্বাদশ পুত্রমাত্র হতাবশিষ্ট ছিলেন, তাঁহারা দলবদ্ধ হইয়া ভীমসেনকে আক্রমণ করিলেন। মহাবীর বৃকোদর কোপাবিষ্ট হইয়া ক্ষুরপ্রদ্বারা কাহারও শিরশ্ছেদন, ভল্লদ্বারা কাহাকে বা নিপাতিত এবং নারাচদ্বারা কাহারও প্রাণসংহার করিয়া ক্রমে নানাবিধ অস্ত্রদ্বারা একে একে তাঁহাদের সকলকেই যমসদনে প্রেরণ করিলেন এক স্বীয় প্রতিজ্ঞা হইতে মুক্ত হইয়া মহা আনন্দধ্বনি করিতে লাগিলেন।

 তখন অল্পমাত্র অবশিষ্ট কৌরববীরগণ পুনরায় দীনভাবাপন্ন হইলেন। তাঁহাদের অবস্থা দেখিয়া কৃষ্ণ অর্জ্জুনকে কহিতে লাগিলেন—

 হে পার্থ! অসংখ্য জ্ঞাতি-শত্রু নিহত হইয়াছে। আমাদের যােধগণ স্বীয় কার্য্য সমাধানান্তে স্ব-স্ব সৈন্যমধ্যে বিশ্রাম করিতেছেন। দুর্য্যোধন অবশিষ্ট সৈন্যদল ব্যূহিত করিয়া তম্মধ্যে অবস্থানপূর্ব্বক অসহায়ভাবে ইতস্তত দৃষ্টিপাত করিতেছেন, হতাবশিষ্ট কৌরববীরগণ কেহই এসময়ে তাঁহার নিকটে নাই। অতএব যুদ্ধকার্য্য শেষ করিবার এই প্রকৃত অবসর। তুমি এই সুযােগে দুর্য্যোধনকে সংহারপূর্ব্বক চিরপ্রজ্জ্বলিত বৈরানল নির্ব্বাপিত কর।

 তদুত্তরে অর্জ্জুন কহিলেন―

 সখে! ভীমসেন ধৃতরাষ্ট্রের আর সমুদয় পুত্র সংহার করিয়াছেন, অতএব দুর্য্যোধনেরও তাঁহার হস্তেই নিহত হওয়া সঙ্গত। এক্ষণে অনুমান পঁচ শত অশ্ব দুই শত রথ এক শত মাতঙ্গ ও তিনি সহস্র পদাতি তদুপরি অশ্বত্থামা কৃপাচার্য্য ত্রিগর্ত্তরাজ উলূক শকুনি ও কৃতবর্ম্মা এই মাত্র কৌরবসৈন্য অবশিষ্ট দেখিতেছি। কিন্তু আজি কৃতান্তের হস্ত হইতে কাহারও পরিত্রাণ নাই। আমি অদ্যই ধর্ম্মরাজকে শত্রুশূন্য করিব সঙ্কল্প করিয়াছি; অতএব রথচালনা কর। যদি দুর্য্যোধন পলায়ন না করেন, তবে তিনিও আমার হস্তে প্রাণত্যাগ করিবেন।

 এই কথায় বাসুদেব দুর্য্যোধন-সৈন্যাভিমুখে অশ্ব সঞ্চালন করিলেন। তখন অশ্ব-সৈন্য লইয়া শকুনি তাঁহাদের গতিরোধ করিলেন। এই সময়ে অমিতপরাক্রম সহদেব স্বীয় প্রতিজ্ঞা স্মরণপূর্ব্বক শকুনির প্রতি ধাবমান হইয়া তাঁহাকে শরাঘাতে অতিশয় সন্তপ্ত করিলেন। এবং এক ভল্লে সম্মুখাগত উলূকের শিরশ্ছেদন করিয়া কহিতে লাগিলেন—

 হে সুবলনন্দন! ক্ষত্রিয়ধর্ম্মানুসারে স্থির হইয়া যুদ্ধ কর। দ্যূতসভামধ্যে যে আহ্লাদ প্রকাশ করিয়াছিলে এক্ষণে তাহার ফল ভোগ কর।

 মহাবীর সহদেব এই কথা বলিয়া ক্রোধভরে শকুনিকে প্রহার করিতে আরম্ভ করিলেন। শকুনি পুত্রের নিধনদর্শনে বাষ্পাকুলনয়নে ক্ষণকাল বিদুরের তৎকালীন হিতবাক্যসমুদায় স্মরণ করিলেন, পরে সহদেবের সম্মুখীন হইয়া নিক্ষিপ্ত অস্ত্রসকল নিবারণের চেষ্টা করিতে লাগিলেন।

 কিন্তু তিনি ক্রুদ্ধ মাদ্রী-তনয়ের বেগ কিছুতেই সহ্য করিতে সক্ষম হইলেন না। অবশেষে শরযুদ্ধ নিস্ফল জ্ঞান করিয়া খড়্গ গদা প্রভৃতি অস্ত্র প্রয়োগ করিতে লাগিলেন, কিন্তু তাহাও সহদেব মধ্যপথেই খণ্ড খণ্ড করিয়া ফেলিলেন। পরিশেষে শকুনি এক সুবর্ণমণ্ডিত প্রাস ধারণপূর্ব্বক তাহা নিক্ষেপ করিতে উদ্যত হইলেন। তখন রোষানলে দগ্ধ মাদ্রীতনয় সেই সমুদ্যত প্রাস সমেত সৌবলের ভুজদ্বয় যুগপৎ ছেদন করিয়া উচ্চৈঃস্বরে সিংহনাদ করিলেন। অনন্তর আর এক ভল্ল গ্রহণপূর্ব্বক তিনি সেই দুর্ণীতির মূলীভূত মস্তকও নিপাতিত করিলেন।

 কৌরবসৈন্যগণ শকুনিকে নিহত দেখিয়া শঙ্কিতচিত্তে চতুর্দ্দিকে পলায়ন করিতে লাগিল এবং পাণ্ডবপক্ষ হইতে মহা শঙ্খধ্বনি প্রাদুর্ভূত হইল। এই সময়ে ইতস্তত ধাবমান কৗরবসৈন্যের উপর ভীমার্জ্জুন একসঙ্গে নিপতিত হইলে তাহারা আর কোনক্রমেই পরিত্রাণ পাইল না। দুই চারিজন ব্যতীত সেই সাগরােপম ত্রয়ােদশ অক্ষৌহিণীমধ্যে সমরক্ষেত্র আর কেহই উপস্থিত রহিল না।

 ভূপালগণের মধ্যে একমাত্র কুরুরাজ দুর্য্যোধন জীবিত রহিলেন। তিনি এই সময়ে দশ দিক শূন্য দেখিয়া এবং পাণ্ডবগণের হর্ষধ্বনি শুনিয়া প্রস্থান করাই শ্রেয় বিবেচনা করিলেন। তদনুসারে তিনি একমাত্র গদা হস্তে ধারণ করিয়া বিদুরের উপদেশ স্মরণ ও চিন্তা করিতে করিতে পাদচারে পূর্ব্বদিকে গমন করিতে লাগিলেন। এক বিস্তীর্ণ হ্রদের মধ্যে তাঁহার এক জলস্তম্ভ নির্ম্মিত ছিল, তিনি সেই স্থানে লুকাইত থাকিবার অভিপ্রায়ে ধাবিত হইলেন।

 সঞ্জয়ও এই সময়ে কৌরবশূন্য রণক্ষেত্র হইতে প্রস্থান করিতেছিল পথিমধ্যে কুরুরাজের সহিত তাহার সহসা সাক্ষাৎ হইল। তখন দুর্য্যোধন ব্যগ্রতাসহকারে তাহার নিকট উপস্থিত হইয়া বারবার নিরীক্ষণ ও গাত্রস্পর্শপূর্ব্বক কহিলেন―

 হে সঞ্জয়! এক্ষণে তােমা ব্যতীত আর আমার পক্ষের কাহাকেও জীবিত দেখিতেছি না। আমার ভ্রাতৃগণের ও সৈন্যদলের কি দশা হইল তাহা কি অবগত আছ?

 সঞ্জয় কহিল—মহারাজ। আমি স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করিয়াছি, আপনার সমগ্র সেনাসহ ভ্রাতৃগণ নিহত হইয়াছে। কেবল কৌরবপক্ষের তিনজন মাত্র জীবিত আছেন বলিয়া শ্রুত হইলাম।

 দুর্য্যোধন দীর্ঘ নিশ্বাস পরিত্যাগপূর্ব্বক কহিলেন―

 হে সঞ্জয়! তুমি পিতাকে কহিবে যে আপনার আত্মজ দুর্য্যোধন ক্ষতবিক্ষত শরীরে সমর হইতে বিমুক্ত হইয়া হ্রদমধ্যে প্রবেশপূর্ব্বক আত্মরক্ষা করিয়াছেন।

 কুরুরাজ এই কথা বলিয়া নিকটবর্ত্তী হ্রদ-সমীপে গমনপূর্ব্বক তন্মধ্যস্থিত জলস্তম্ভে প্রবিষ্ট হইলেন। কিয়ৎক্ষণ মধ্যেই কৃপাচার্য অশ্বত্থামা ও কৃতবর্ম্মা ক্ষতবিক্ষত-কলেবরে শ্রান্ত বাহন লইয়া সেই স্থানে উপস্থিত হইলেন। সঞ্জয়কে দেখিবামাত্র দ্রুতবেগে অশ্ব সঞ্চালনপূর্ব্বক নিকটে উপস্থিত হইয়া তাঁহারা কহিলেন—

 হে সঞ্জয়! আজি সৌভাগ্যবশত তোমাকে জীবিত দেখিলাম। আমাদের রাজা দুর্য্যোধন কি জীবিত আছেন?

 তখন সঞ্জয় দুর্য্যোধনের হ্রদ প্রবেশ বৃত্তান্ত জ্ঞাপন করিলে সকলে মিলিয়া বহুক্ষণ বিলাপ পরিতাপ করিয়া অবশেষে সঞ্জয়কে কৃতবর্ম্মার রথে আরােহণপূর্বক তাঁহারা শিবিরে প্রস্থান করিলেন।

 কৌরবসৈন্যকে নিঃশেষিত দেখিয়া ধৃতরাষ্ট্রতনয় যুযুৎসু চিন্তা করিতে লাগিলেন―

 মহাবল পরাক্রান্ত পাণ্ডবগণ রাজা দুর্য্যোধনকে পরাজয় এবং অবশিষ্ট কৌরববীর ও আমার ভ্রাতৃগণকে নিহত করিয়াছেন। এক্ষণে ভাগ্যক্রমে একমাত্র আমিই জীবিত রহিয়াছি। শিবিরস্থ ভৃত্যগণ সকলেই পলায়ন করিতেছে। রাজবনিতাদিগকে লইয়া এক্ষণে আমার হস্তিনাপুর প্রত্যাগমন করা উচিত হইতেছে।

 যুযুৎসু এইরূপ বিবেচনা করিয়া যুধিষ্ঠিরের নিকট তাহা নিবেদন করিলে করুণ-হৃদয় ধর্ম্মরাজ তাঁহাকে অলিনপূর্ব্বক তৎক্ষণাৎ বিদায় দিলেন। তিনি তখন কৌরব-সচিবগণের সহিত রাজমহিলাগণের রক্ষক হইয়া তাহাদিগকে হস্তিনাপুরে উপনীত করিলেন। বিজ্ঞতম মহাত্মা বিদুর যুযুৎসুকে অবলোকন করিয়া তাঁহাকে সাধুবাদ প্রদানপূর্ব্বক কহিলেন—

 বৎস! তুমি কৌরব-রমণীগণকে আশ্রয় প্রদান করিয়া সময়োচিত কার্য্য ও কুলধর্ম্ম রক্ষা করিয়াছ। আমি ভাগ্যক্রমে সেই বীরক্ষয়কর সংগ্রাম হইতে তোমার প্রত্যাগমন সন্দর্শন করিলাম। এক্ষণে তুমি অদূরদর্শী অব্যবস্থিতচিত্ত রাজ্যলোলুপ হতভাগ্য অন্ধনৃপতির একমাত্র যষ্টিস্বরূপ হইয়া রহিলে।

 রমণীগণের প্রস্থানে ও ভৃতবর্গের পলায়নে কৌরবশিবির একান্ত শূন্য দেখিয়া সঞ্জয়সহ অবশিষ্ট কৌরববীরত্রয় তথায় অবস্থান করিতে পারিলেন না। তাঁহারা পুনরায় হ্রদের নিকট গমন করিলেন এবং তীরে দণ্ডায়মান হইয়া সলিলনিমগ্ন রাজা দুর্য্যোধনকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন—

 মহারাজ! এক্ষণে তুমি সমুত্থিত হইয়া আমাদের সহিত আগমন কর এবং অরাতিগণের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইয়া হয় রাজ্য না হয় সুরলােক প্রাপ্ত হও। পাণ্ডবদের অল্পমাত্র সৈন্য অবশিষ্ট আছে। আমরা সমবেত হইয়া আক্রমণ করিলে তাহারা নিশ্চয়ই বিনষ্ট হইবে।

 তদুত্তরে রাজা দুর্য্যোধন কহিলেন—

 হে মহারথগণ! ভাগ্যবলে তোমরা সেই লোকক্ষয়কর সংগ্রাম হইতে বিমুক্ত হইয়া জীবিত রহিয়াছ। এক্ষণে আমার অঙ্গ ক্ষতবিক্ষত হইয়াছে, তোমরাও পরিশ্রান্ত, পাণ্ডবগণের অবশিষ্ট সৈন্যদলও নিতান্ত অল্প নহে। অদ্য রাত্রি বিশ্রাম করিয়া কল্য আমি নিশচয়ই তোমাদের সমভিব্যাহারে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হইব।

 তখন মহাবীর আশ্বত্থামা কহিলেন―

 মহারাজ! তুমি হ্রদমধ্য হইতে উত্থিত হইয়া নিশ্চিন্তচিত্তে অবস্থান কর, আমরাই বিপক্ষগণকে বিনাশ করিব। আমি প্রতিজ্ঞা করিতেছি, শত্রুবিনাশ না করিয়া কদাপি কবচ পরিত্যাগ করব না।

 এই সময়ে কতকগুলি ব্যাধ সেই স্থান দিয়া পাণ্ডবশিবিরে মাংসাদি লইয়া যাইতেছিল। তাহারা পরিশ্রান্ত হইয়া হ্রদকূলে উপবেশনপুর্ব্বক এই সকল কথােপকথন শুনিয়া স্পষ্টই বুঝিতে পারিল যে, রাজা দুর্য্যোধন জলমধ্যে প্রবিষ্ট আছেন। ইতিপূর্ব্বেই রাজা দুর্য্যোধনকে অনুসন্ধান করিবার বিশেষরূপ উদ্যোগ চলিতেছিল এবং শিবিরে যে কোন লোক গমনাগমন করিত তাহাকেই এসম্বন্ধে আদেশ দেওয়া হইত। এক্ষণে এই বৃত্তান্ত অবগত হইয়া সেই ব্যাধগণ বিপুল ধনপ্রাপ্তির আশায় সত্বর মহারাজ যুধিষ্ঠিরের শিবিরাভিমুখে ধাবমান হইল। তথায় উপস্থিত হইয়াই উহারা দ্বারীর নিষেধ মান্য না করিয়া দ্রুতগমনে একেবারে রাজ-সমীপে গমনপূর্ব্বক সমস্ত বৃত্তান্ত নিবেদন করিল।

 পাণ্ডবগণ দুর্য্যোধনের কোন সন্ধান না পাইয়া কলহের মূলোচ্ছেদসম্বন্ধে হতাশ্বাস হইয়া বিষন্নচিত্তে অবস্থান করিতেছিলেন। চতুর্দ্দিকে প্রেরিত দূতগণ প্রত্যাগত হইয়া ক্রমান্বয়ে বলিতেছিল যে কুরুরাজের কোন সংবাদ পাওয়া যাইতেছে না। এই অবস্থায় ব্যাধগণ কথিত বৃত্তান্ত শ্রবণে সকলে অতিশয় আহ্লাদিতচিত্তে তাহাদিগকে প্রভূত ধনদানে তুষ্ট করিয়া অবিলম্বে হ্রদাভিমুখে যাত্রা করিলেন।

 তখন ভীষণ সিংহনাদ ও ঘোর কলকল শব্দ প্রাদুর্ভূত হইল। দুর্য্যোধনকে প্রাপ্ত হইয়াছি—বলিয়া বীরগণ মহা চীৎকার করিতে লাগিলেন এবং বেগে ধাবমান রথিগণের চক্রনির্ঘোষে ধরণী কম্পিত হইতে লাগিল। এইরূপে পাণ্ডবগণের সহিত ধৃষ্টদ্যুম্ন শিখণ্ডী উত্তমৌজা যুধামন্যু সাত্যকি দ্রৌপদীর পঞ্চপুত্র এবং হতাবশিষ্ট পাঞ্চালগণ চতুরঙ্গ সৈন্য লইয়া ধর্ম্মরাজের অনুগমন করিলেন।

 কৃপাচার্য্য অশ্বত্থামা ও কৃতবর্ম্মা এই তুমুল নিনাদ শ্রবণ করিয়া দুর্য্যোধনকে কহিলেন―

 মহারাজ! সমরবিজয়ী পাণ্ডবগণ এই স্থানে আগমন করিতেছেন; অতএব তুমি অনুজ্ঞা কর, আমরা প্রস্থান করি।

 দুর্য্যোধন―তথাস্তু!―বলিয়া সেই সলিলমধ্যে অলক্ষিতভাবে অবস্থান করিতে লাগিলেন। কৃপাচার্য্য প্রভৃতি মহারথগণ বহু দূরে এক বটবৃক্ষমূলে গমনপূর্ব্বক রথ হইত অশ্বগণকে বিমুক্ত করিয়া অপেক্ষা করিতে লাগিলেন।

 ইতিমধ্যে পাণ্ডবগণ সেই হ্রদ-কূলে উপনীত হইলে যুধিষ্ঠির লুক্কায়িত দুর্য্যোধনকে সম্বোধনপূর্ব্বক উচ্চৈঃস্বরে কহিতে লাগিলেন―

 হে কুরুরাজ! তুমি স্বপক্ষের সমস্ত ক্ষত্রিয় ও স্বীয় বংশ বিনষ্ট করিয়া এক্ষণে কি নিমিত্ত নিজ জীবন রক্ষার্থে জলাশয়ে প্রবেশ করিয়াছ? তোমাকে সকলে বীরপুরুষ বলিয়া, কীর্ত্তন করিয়া থাকে, কিন্তু আজি তােমাকে প্রাণভয়ে লুক্কায়িত দেখিয়া তাহা মিথ্যা বলিয়া বােধ হইতেছে; অতএব তুমি অচিরাৎ সলিল হইতে গাত্রোত্থানপূর্ব্বক হয় আমাদিগকে পরাজয় করিয়া রাজ্যলাভ কর, না হয় আমাদের হস্তে পরাজিত হইয়া বীরলােক প্রাপ্ত হও।

 এই কথা শ্রবণে দুর্য্যোধন জলমধ্য হইতে যুধিষ্ঠিরকে কহিলেন―

 মহারাজ! প্রাণীমাত্রেরই যে প্রাণভয় থাকিবে তাহাতে আর আশ্চর্য্য কি? কিন্তু আমি সেজন্য পলায়ন করি নাই। আমি রথ ও অস্ত্রহীন অবস্থায় একান্ত পরিশ্রান্ত হইয়া এখানে শ্রমাপনোদন করিতেছি মাত্র। তুমি অনুচরবর্গের সহিত কিয়ৎক্ষণ বিশ্রাম কর, পরে আমি সলিল হইতে উত্থিত হইয়া যুদ্ধ করিব।

 যুধিষ্ঠির কহিলেন―হে দুর্য্যোধন। আমরা যথেষ্ট বিশ্রান্ত রহিয়াছি এবং বহুক্ষণ তোমাকে অনুসন্ধান করিয়াছি, অতএব অবিলম্বে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হও।

 তখন দুর্য্যোধন কহিলেন—

 মহারাজ! আমি যাহাদের জন্য রাজ্যলাভ অভিলাষ করিয়াছিলাম, আমার সেই ভ্রাতৃগণ সকলেই স্বর্গে গমন করিয়াছেন। অতএব তুমিই এই হস্ত্যশ্বশূন্য বন্ধুবান্ধববিহীন ভূমিখণ্ড ভোগ কর। আমার সদৃশ নৃপতি এরূপ রাজাশাসনে অভিলাষ করে না।

 তদুত্তরে যুধিষ্ঠির কহিলেন—

 হে দুর্য্যোধন। তুমি জল মধ্যে অবস্থানপূর্ব্বক বৃথা বিলাপ করিতেছ, উহাতে আমার কিছুমাত্র দয়ার সঞ্চার হইতেছে না। আর তোমার রাজ্যদানের ভাণ করিয়াই বা লাভ কি? তোমার দান করিবার অধিকারই বা কোথায় এবং তোমার প্রদত্ত রাজ্য আমিই বা গ্রহণ করিব কেন? অতঃপর তুমি ও আমি, দুই জনের জীবিত থাকিবার আর উপায় নাই; অতএব অনর্থক বাক্যব্যয় না করিয়া হয় রাজ্য না হয় স্বর্গলাভ কর।

 তখন রাজা দুর্য্যোধন যুধিষ্ঠিরের তিরস্কার-বাক্য আর সহ্য করিতে না পারিয়া সহসা জলমধ্য হইতে বহির্গত হইয়া কহিলেন—

 হে কুন্তীনন্দন। তােমাদের বন্ধুবান্ধব রথ ও বাহন সমস্তই রহিয়াছে, আমি একে পরিশ্রান্ত, তাহাতে সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্রবিহীন হইয়া কিরূপে তােমাদের সহিত যুদ্ধ করিব? এক ব্যক্তির সহিত অনেকে যুদ্ধ কোনো ক্রমেই ধর্ম্মসঙ্গত হয় না। হে পাণ্ডবগণ! আমি তোমাদের দেখিয়া কিছুমাত্র ভীত হইতেছি না, একে একে তােমাদের সঙ্গে যুদ্ধ হইলে আমি সকলকেই বিনাশ করিতে পারি।

 কুরুরাজের এই বাক্য শ্রবণে যুধিষ্ঠির কহিলেন―

 হে দুর্য্যোধন! তুমি ভাগ্যক্রমে আজি ক্ষত্রিয়ধর্ম্ম স্মরণ করিতেছ; কিন্তু তােমরা যখন বহুসংখ্যক মহারথ একত্র হইয়া বালক অভিমন্যুকে বিনাশ করিয়াছিলে তখন তােমার সে প্রজ্ঞা কোথায় ছিল? বিপৎকালে সকলেই ধর্ম্মচিন্তা করিয়া থাকে, কিন্তু সম্পদের সময় পরলােকের দ্বার রুদ্ধ অবলোকন করে। যাহা হৌক, তুমি এক্ষণে কবচ পরিধান ও অভীষ্ট আয়ুধ গ্রহণপূর্ব্বক আমাদের মধ্যে যে কোনাে অভিলষিত ব্যক্তির সহিত যুদ্ধ কর। আমি সত্য করিয়া কহিতেছি, তুমি আমাদের মধ্যে একজনকে বিনাশ করিতে পারিলেই সমুদয় রাজ্য তােমার হইবে।

 সেই কথায় দুর্য্যোধন অতিশয় হৃষ্টচিতে বর্ম্মধারণ, কেশকলাপ বন্ধন ও গদাগ্রহণপূর্ব্বক কহিলেন―

 হে ধর্ম্মরাজ! তুমি যখন আমাকে একজনের সহিত যুদ্ধের অনুমতি প্রদান করিলে তখন তােমাদের মধ্যে যাহার ইচ্ছা আমার সঙ্গে গদাযুদ্ধে প্রবৃত্ত হও। গদাযুদ্ধে তোমরা কেহই আমার সমকক্ষ নই। যাহার ইচ্ছা আমার সম্মুখে গদাহস্তে দণ্ডায়মান হইয়া আমার বাক্যের সত্যাসত্যতা পরীক্ষা কর।

 দুর্য্যোধন এইরূপ আস্ফালন করতে আরম্ভ করিলে বাসুদেব ক্রোধাবিষ্ট হইয়া যুধিষ্ঠিরকে কহিলেন—

 মহারাজ! তুমি কোন সাহসে দুর্য্যোধনকে একজনমাত্রের বিনাশদ্বারা রাজ্যলাভের অনুমতি করিলে? ঐ দুরাত্মা যদি তোমাকে বা অর্জ্জুনকে বা নকুল সহদেবকে বরণ করিত, তাহা হইলে তোমাদের কি দুর্দ্দশা হইত? গদাযুদ্ধে বোধ হয় তােমরা কেহই উহার সমকক্ষ নহ। ভীমসেন অধিক বলবান্, কিন্তু দুর্য্যোধনের অভ্যাস অধিক এবং এস্থলে অভ্যসেরই প্রাধান্য। এক্ষণে নিশ্চয়ই বোধ হইতেছে যে পাণ্ডবগণের অদৃষ্টে কখনই রাজ্যলাভ নাই―বিধাতা উহাদিগকে বনবাস বা ভিক্ষাব্রত অবলম্বন করিবার জন্যই সৃষ্টি করিয়াছেন!

 এই কথা শুনিয়া মহাতেজা ভীমসেন ঈষৎ হাস্যসহকারে কহিলেন—

 হে মধুসূদন! তুমি বৃথা বিষাদগ্রস্ত হইও না। আজি আমি নিশ্চয়ই দুর্য্যোধনকে বিনাশ করিয়া বৈরানল নির্ব্বাণ করিব।

 তখন বাসুদেব আশ্বস্ত হইয়া ভীমসেনকে প্রশংসা করিয়া কহিলেন―

 হে বীর! ধর্ম্মরাজ তোমার বাহুবলেই অরাতিবিহীন হইবেন, সন্দেহ নাই। এক্ষণে তুমি অতিশয় সাবধান হইয়া যুদ্ধে প্রবৃত্ত হও।

 এই সময়ে তীর্থপর্য্যটনান্তর বৃষ্ণিপ্রবীর বলরাম যুদ্ধ বৃত্তান্ত জ্ঞাত হইবার নিমিত্ত সে স্থানে উপস্থিত হইলেন। তাঁহাকে দেখিয়া সকলে ব্যগ্রতাসহকারে তাঁহার অভ্যর্থনা ও পাদবন্দনা করিয়া সমগ্র বৃত্তান্ত অবগত করাইলেন। ভীমসেন ও দুর্য্যোধন গদা উদ্যত করিয়া গুরুকে যথােচিত অভিবাদন করিলেন। বলরাম সকলকে আলিঙ্গন করিয়া কহিলেন―

 হে বীরগণ! আমি দ্বিচত্বারিংশ দিবস হইল তীর্থযাত্রা করিয়াছি; কিন্তু এখনও তোমাদের যুদ্ধকার্য্য শেষ হয় নাই। আমি মনে করিয়াছিলাম এ-যুদ্ধের সহিত কোনােপ্রকারে লিপ্ত থাকিব না, কিন্তু এক্ষণে শিষ্যদ্বয়ের গদাযুদ্ধ দেখিতে অভিলাষ হইতেছে। তবে এ স্থান অপেক্ষা পুণ্যতীর্থ কুরুক্ষেত্রই যুদ্ধের উপযুক্ত স্থান; অতএব চল, সকলে মিলিয়া সেখানে গমন করি।

 বলদেবের উপদেশ অনুসারে সকলে কুরুক্ষেত্রে প্রস্থান করিলেন এবং তথায় উপযুক্ত সমরাঙ্গণ নির্ব্বাচনপূর্ব্বক বলরামকে মধ্যস্থলে আসন প্রদান করিয়া অন্য সকলে চতুর্দ্দিকে যুদ্ধদর্শনার্থে উপবিষ্ট হইলেন।

 অনন্তর বর্ম্মধারী ভীমসেন মহাকোটি গদাহস্তে এবং উষ্ণীষ ও সুবর্ণবর্ম্মপরিহিত দুর্য্যোধন এক দুর্জ্জয় গদা লইয়া দণ্ডায়মান হইলেন। মহাবলপরাক্রান্ত দুর্য্যোধন গভীরগর্জ্জনে ভীমকে যুদ্ধার্থে আহ্বান করিলে ভীমসেন কহিলেন—

 হে দুর্যোধন! ইতিপূর্ব্বে যে-সকল দুষ্কর্ম্ম করিয়াছ, তাহা স্মরণ কর। আমি এইবার তােমাকে তাহার সমুচিত দণ্ড প্রদান করিব।

 তদুত্তরে দুর্য্যোধন কহিলেন—

 অহে কুলাধম! আর বৃথা বাক্যব্যয়ে প্রয়োজন নাই। মুখে যাহা বলিতেছ, কার্য্যে তাহা পরিণত কর।

 এই কথায় সৈন্যগণ দুর্য্যোধনের প্রশংসা করায় তিনি অতিশয় পরিতুষ্ট হইলে ভীম রুষ্ট হইয়া গদা উদ্যত করিয়া ধাবমান হইলেন। তখন তাঁহারা পরস্পর জিগীষাপরবশ হইয়া তুমুল যুদ্ধ আরম্ভ করিলেন। রণস্থলে ঘোরতর প্রহারশব্দ সমুত্থিত হইল এবং দুই গদার সংঘটনে চতুর্দ্দিকে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বিক্ষিপ্ত হইতে লাগিল। অনন্তর সেই বীরদ্বয় পরস্পরের রন্ধ্রান্বেষণে প্রবৃত্ত এবং আত্মরক্ষায় যত্নবান হইয়া বিচিত্র গতি প্রত্যাগতি, অবস্থান পরিমােক্ষ, প্রহার, বঞ্চন, আক্ষেপ পরাবর্ত্তন সংবর্ত্তনাদি কৌশল প্রদর্শনপূর্ব্বক পরস্পরকে ক্ষত বিক্ষত করিতে লাগিলেন।

 অবশেষে দুর্য্যোধন দক্ষিণ মণ্ডল ও ভীম বাম মণ্ডল অবলম্বন করিলে দুর্য্যোধন ভীমের পার্শ্বদেশে এক প্রচণ্ড আঘাত করিলেন এবং ভীমসেন ক্রুদ্ধ হইয়া প্রতিপ্রহারার্থে বজ্রতুল্য ভীষণ গদা উদ্যত ও বিঘূর্ণিত করিলে দুর্য্যোধন সেই গদার উপর গদাঘাত করিয়া তাঁহাকে নিবারণ করিলেন। তর্দ্দশনে সকালে বিস্ময়াবিষ্ট হইল।

 ক্রমে মহাবীর কুরুরাজ বিবিধ কৌশল প্রদর্শন করিয়া সমরাঙ্গণে সঞ্চরণ করিতে থাকিলে সকলেই তাঁহাকে সমধিক যুদ্ধনিপুণ বলিয়া বোধ করিলে তাঁহার গদাভ্রমণবেগ অবলোকন করিয়া পাণ্ডবগণের অন্তঃকরণে অতীব ভীতির সঞ্চার হইল।

 অনন্তর বৃকোদরের মস্তকে দুর্য্যোধন এক গদাঘাত করিলে তিনি তাহাতে কিছুমাত্র বিচলিত না হইয়া ক্রোধপ্রজ্বলিতচিত্তে কুরুরাজের প্রতি তাহার গদা নিক্ষেপ করিলেন; কিন্তু রাজা দুর্য্যোধন অনায়াসে সেই নিক্ষিপ্ত গদা নিষ্ফল করিয়া অরক্ষিত ভীমসেনের বক্ষে এক প্রচণ্ড আঘাত করিলেন, তাহাতে তিনি অতিশয় ব্যথিত হইয়া বিমােহিতপ্রায় হইলেন, কিন্তু তাহা সত্বেও তিনি কোন প্রকার ধৈর্য্যচ্যুতি প্রকাশ না করায় দুর্যোধন তাঁহাকে অবিচলিত ও প্রতিপ্রহারোদ্যত জ্ঞান করিয়া দ্বিতীয় আঘাত করিবার ছিদ্র অবলম্বনের সুযােগ সম্বন্ধে বঞ্চিত হইলেন।

 পরে প্রকৃতিস্থ হইয়া নিতান্ত রোষাবিষ্টচিত্তে মহাবল বৃকোদর পুনরায় গদাগ্রহণপূর্ব্বক কুরুরাজের প্রতি ধাবমান হইয়া তাঁহার পার্শ্বদেশে এক আঘাত করিলে দুর্য্যোধনের শরীর ক্ষণকাল অবসন্ন হওয়ায় তাঁহার অবনত জনুদ্বয় ধরাস্পর্শ করিল, তদ্দর্শনে পাণ্ডবপক্ষীয়গণ সিংহনাদ করিতে লাগিলেন।

 ভীমসেনের এই অভিনন্দন কুরুরাজের নিতান্ত অসহ্য হইল। তিনি উত্তেজিত হইয়া শিক্ষানৈপুণ্য প্রদর্শনপূর্ব্বক ভীমকে বারম্বার প্রহার করিতে আরম্ভ করিলেন, তাঁহার বর্ম্ম ক্রমে ছিন্নভিন্ন হইয়া গেল এবং মহাবীর বৃকোদর বহু কষ্টে ধৈর্য্য রক্ষা করিয়া সমরাঙ্গণে অবস্থিত রহিলেন। তখন বাসুদেব অতিশয় দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হইয়া অর্জ্জুনকে কহিলেন―

 সখে! দুর্য্যোধন যে শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই অতএব ন্যায়যুদ্ধে ভীমসেন কিছুতেই কৃতকার্য্য হইবেন না। শঠ দুর্য্যোধনকে শঠতাপূর্ব্বক বিনাশ করাই কর্ত্তব্য। স্বয়ং দেবরাজও ছলদ্বারা স্বীয় কার্য্য সিদ্ধ করিয়া থাকেন। এক্ষণে ভীমসেন তাঁহার উরু ভঙ্গের প্রতিজ্ঞা পালনপূর্ব্বক দুর্য্যোধনকে নিপাতিত করুন, নহিলে ধর্ম্মরাজ বিষম সঙ্কটে পড়িবেন। তোমার জ্যেষ্ঠ কি নির্ব্বোধ। উনি কি বিবেচনায় একজনের পরাজয়ে রাজ্যদানের প্রতিজ্ঞা করিলেন?

 অর্জ্জুন এই কথা শুনিয়া স্বীয় বামজানুতে আঘাত করিয়া ভীমসেনকে সঙ্কেত করিলেন। তখন বৃকোদর অর্জ্জুনের ইঙ্গিতে স্বীয় প্রতিজ্ঞা সম্বন্ধে প্রবোধিত হইয়া গদা উদ্যত করিয়া বাম মণ্ডল অবলম্বন করিলেন। সুযোগ বুঝিয়া তিনি স্বেচ্ছাক্রমে রন্ধ্র প্রদর্শন করিলে দুর্য্যোধন বঞ্চিত হইয়া তাঁহার প্রতি ধাবমান হইলেন। তখন ভীমসেন সহসা তাঁহাকে আক্রমণ করিলে দুর্য্যোধন লম্ফপ্রদানপূর্ব্বক পরিত্রাণ পাইলেন, কিন্তু তিনি ঊর্দ্ধে উত্থিত হইবামাত্র ভীম তাঁহার জানুদ্বয় লক্ষ্য করিয়া নিয়ম-বিরুদ্ধ অপঘাত করিলে দুর্য্যোধন ভগ্নোরু হইয়া ভূতলে নিপতিত হইলেন। তখন ক্রোধপরায়ণ বৃকোদর উন্মত্তের ন্যায় তাঁহার সমীপবর্ত্তী হইয়া তাঁহার মস্তকে বারম্বার পদাঘাত পূর্ব্বক কহিলেন—

 অহে দুরাত্মন! তুমি যে আমাদের প্রতি উপহাস ও দ্রৌপদীকে অপমান করিয়াছিল এই তাহার ফল ভোগ কর।

 ভীমসেনের এই নীচ-জনােচিত ব্যবহারে দর্শকগণের মধ্যে কেহ সন্তুষ্ট হইলেন না। ধর্ম্মরাজ সেই আত্মশ্লাঘানিরত বৃকোদরকে তিরস্কারপূর্ব্বক কহিলেন—

 হে ভীমসেন! তুমি বৈরঋণ হইতে বিমুক্ত হইয়াছ এবং সদুপায়েই হউক আর অসদুপায়েই হউক স্বীয় প্রতিজ্ঞা পরিপূর্ণ করিয়াছ। এ ক্ষণে ক্ষান্ত হও, আয় অধর্ম্ম সঞ্চয় করিও না! ইহার সৈন্য বন্ধু ভ্রাতা ও পুত্রগণ নিহত হওয়ায় এই বীর এক্ষণে সর্ব্ব প্রকারে শােচনীয়, তদুপরি এই কুরুকাজ আমাদের ভ্রাতা, অতএব তুমি কিরূপে নৃশংসের ন্যায় দুর্ব্ব্যবহারে প্রবৃত্ত হইতেছ?

 অনন্তর যুধিষ্ঠির দীনভাবে দুর্য্যোধনের নিকটে গমনপূর্ব্বক অশ্রুকণ্ঠে কহিলেন—

 ভ্রাতঃ। তুমি পূর্ব্বকৃত কর্ম্মের ঘোরতর ফল ভােগ করিয়াছ, এক্ষণে আর শােক করিও না। মৃত্যুই তোমাকে আশ্রয় প্রদান করিবে। আমরাই নিতান্ত হতভাগ্য, যেহেতু বন্ধুশূন্য রাজ্য শাসন ও ভ্রাতৃবধূগণকে শােকার্ত্তা নিরীক্ষণ করিতে হইবে।

 এদিকে গদাযুদ্ধবিশারদ বলরাম দুর্য্যোধনকে অধর্ম্মযুদ্ধে পাতিত দেখিয়া ভীষণ আর্ত্তনাদ-সহকারে কহিতে লাগিলেন—

 নাভির অধঃস্থলে গদাঘাত করা বিধেয় নহে, ইহা শাস্ত্রসিদ্ধ সর্ব্বজনবিদিত নিয়ম, কিন্তু মহামূর্খ ভীমসেন তাহা অতিক্রম করিয়া স্বেচ্ছাচারে প্রবৃত্ত হইল।

 এই কথা বলিতে বলিতে হলায়ুধ বলদেব তাঁহার লাঙ্গল উদ্যত করিয়া ভীমসেনের প্রতি ধাবিত হইলেন।

 তখন বাসুদেব স্বীয় বাহুযুগলদ্বারা তাঁহাকে ধারণপূর্ব্বক নিবারণ করিয়া বিনীতচনে কহিতে লাগিলেন―

 হে মহাত্মন্! তুমি ক্রোধ সম্বরণ কর। বিবেচনা করিয়া দেখ যে পাণ্ডবগণ আমাদের নিকট আত্মীয়, ইঁহারা কৌরবগণ কর্ত্তৃক অগাধ বিপদ্ সাগরে পতিত হইয়া এক্ষণে বহুকষ্টে উত্তীর্ণ হইয়াছেন। ইঁহাদের উন্নতিতেই আমাদের উন্নতি; অতএব ইঁহাদের বিরুদ্ধাচরণ বিধেয় নহে। তদ্ব্যতীত ভীমসেন সভামধ্যে দুর্য্যোধনের উরুভঙ্গের প্রতিজ্ঞা করিয়াছিলেন, ক্ষত্রিয় হইয়া সে প্রতিজ্ঞা তিনি পালন না করিয়া পারেন না।

 বাসুদেবের অনুনয়বাক্যে নিবৃত্ত হইয়া বলরাম ক্রুদ্ধবচনে উত্তর করিলেন—

 হে কৃষ্ণ! আত্মীয়তা বা লাভালাভের কথা বৃথা বলিতেছ। অর্থ ও কামই ধর্ম্মনাশের প্রধান কারণ। তুমি যতই যুক্তি প্রদর্শন কর না কেন ভীমসেন যে অধর্ম্মাচরণ করিয়াছেন, সে ধারণা আমার মন হইতে দূরীকৃত হইবে না। লােকমধ্যেও তাহার কূটযোদ্ধা বলিয়া চির অখ্যাতি রহিয়া যাইবে।

 বলরাম এই কথা বলিয়া মহারােষে রথারােহণপূর্ব্বক দ্বারকাভিমুখে প্রস্থান করিলেন।

 তখন রাজা দুর্য্যোধন কহিলেন—

 হে কৃষ্ণ! সসাগরা বসুন্ধরার শাসন, বিপক্ষগণের মস্তকোপরি অবস্থান এবং অন্যান্য ভূপালগণের দুর্লভ সুখসম্ভোগ ও ঐশ্বর্য্যলাভ করিয়াছি; পরিশেষে ধর্ম্মপরায়ণ ক্ষত্রিয়-বাঞ্ছিত পরমগতি প্রাপ্ত হইলাম। এক্ষণে ভ্রাতৃবর্গ ও বন্ধু বান্ধবের সহিত আমি স্বর্গে চলিলাম, তােমরা এই শোকসমাকুল শূন্যরাজ্য গ্রহণ কর।

 অনন্তর দুর্য্যোধন দেহ ত্যাগ করিলেন।

 তাঁহার উক্ত বাক্যে পাণ্ডবগণকে বিষণ্ণ দেখিয়া কৃষ্ণ কহিতে লাগিলেন—

 ভ্রাতৃগণ! এক্ষণে আমাদের অভিপ্রায় সিদ্ধ হইয়াছে, সায়ংকালও উপস্থিত; অতএব চল, উপযুক্ত স্থানে গমনপূর্ব্বক যুদ্ধাবসানে মাঙ্গলিক কার্য্যের অনুষ্ঠান করা যাক।

 এইরূপ কথােপকথন করিতে করিতে বাসুদেবসহ পাণ্ডবগণ সত্যকিকে সঙ্গে লইয়া পবিত্রসলিলা নদীতীরে গমন করিলেন এবং তথায় কৃষ্ণের উপদেশানুসারে মাঙ্গলিক-ক্রিয়া সম্পাদনার্থে রাত্রিযাপন করা স্থির করিলেন।