শান্তির চেষ্টায় সর্ব্বতোভাবে অকৃতকার্য্য হইয়া কৃষ্ণ উপপ্লব্য নগয়ে প্রত্যাগমন পূর্ব্বক হস্তিনাপুরে অনুষ্ঠিত সমস্ত বৃত্তান্ত পাব সন্নিধানে সংক্ষেপে বর্ণনা করিয়া কহিলেন―

 হে ধর্ম্মরাজ! কুরু সভামধ্যে যাহা কিছু ঘটিয়াছিল সকলই ব্যক্ত করিলাম। ফলত বিনাযুদ্ধে কৌরবগণ তোমাদিগকে রাজ্য প্রত্যর্পণ করিবেন না। অতএব যুদ্ধ ব্যতীত আমি অন্য গতি দেখিতে পাই না।

 এই বলিয়া বাসুদেব বিশ্রামার্থে স্বীয় আবাস ভবনে গমন করিলেন। অনন্তর রাত্রিযোগে পাণ্ডবগণ কৃষ্ণকে একান্তে আহ্বানপূর্ব্বক মন্ত্রণা করিতে লাগিলেন।

 কৃষ্ণের বাক্যানুসারে ধৃষ্টদ্যুম্নই সপ্ত অক্ষৌহিণীর সেনাধ্যক্ষগণের নেতারূপে নিযুক্ত হইলেন।

 অনন্তর সকলকে কার্য্যারম্ভের নিমিত্ত অতিশয় ব্যগ্র দেখিয়া যুধিষ্ঠির যুদ্ধযাত্রার উদ্যোগ করিবার অনুমতি প্রদান করিলেন। তাদেশ পাইবামাত্র সকলে বর্ম্ম ধারণপূর্ব্বক স্বস্ব কার্য্যে ব্যাপৃত হইলেন। অল্পকাল মধ্যেই অশ্বের হ্রেষারবে, হস্তির বৃংহিতে, রথের ঘর্ঘরে ও ইতস্তত প্রধাবমান যােদ্ধাগণের―যোজনা কর! সজ্জা কর! ―প্রভৃতি চীৎকারে সেই বিপুল সৈন্য-সমাগম ক্ষুব্ধ মহাসমুদ্রের ন্যায় শব্দিত হইতে লাগিল। সর্ব্বত্র তুমুল শঙ্খ-দুন্দুভি ধ্বনি সৈন্যগণের আনন্দের পরিচয় প্রদান করিতে লাগিল।

 অনন্তর আয়ােজনাদি কার্য্যে সে-রাত্রি অতিবাহিত হইলে প্রাতঃকালে সকলে প্রস্তুত হইয়া কুরুক্ষেত্রাভিমুখে যাত্রা আরম্ভ করিলেন। সৈন্যাধ্যক্ষগণ সেনামুখে অগ্রে চলিতে লাগিলেন। রাজা যুধিষ্ঠির যান বাহন অস্ত্রশস্ত্র কোষ শিল্পী ও চিকিৎসক প্রভৃতি একত্রিত করিয়া মধ্যস্থানে রহিলেন। অন্যান্য বীরগণ তাঁহাকে বেষ্টন করিয়া সৈন্যের পশ্চাদ্ভাগে অবস্থান করিলেন।

 কুরুক্ষেত্রে উপস্থিত হইয়া অর্জ্জুন এবং বাসুদেব তাঁহাদের ভীষণরব শঙ্খদ্বয় বাদন করিলে যােদ্ধাগণ অতিশয় উৎসাহিত হইয়া প্রত্যেকে স্ব স্ব শঙ্খে ঘোরতর নিনাদ করিলেন। অনন্তর যুধিষ্ঠির পরিভ্রমণপূর্ব্বক শ্মশান, দেবালয়, আশ্রমাদি স্থানসকল পরিহার করিয়া পবিত্র সলিলযুক্ত হিরণ্বতী নামক স্রোতস্বতী-সেবিত তৃণ-ইন্ধন-সম্পন্ন এক সমতল ভূমি সেনানিবেশের নিমিত্ত নির্ব্বাচন করিলেন।

 তথায় কিয়ৎকাল বিশ্রামান্তে গতক্লম হইয়া তিনি মহীপালসকল-সমভিব্যাহারে চতুর্দ্দিক্ পর্য্যটন ও শিবিরাদি সংস্থাপনের উপযুক্ত স্থান পরিদর্শন করিতে লাগিলেন। ধৃষ্টদ্যুম্ন ও সাত্যকি শিবিরের পরিমাণ স্থির করিলে কৃষ্ণ চতুর্দ্দিকে পরিখা খনন করাইয়া তথায় অদৃশ্যভাবে রক্ষক সৈন্যদল সংস্থাপন করিলেন। প্রথমে পাণ্ডবগণের শিবিব প্রস্তুত হইলে অন্যান্য নৃপতিগণ পরে নিজ নিজ শিবির যথাস্থানে সন্নিবেশিত করিলেন।

 প্রত্যেক শিবিরে অস্ত্রশিল্পী ও সুচিকিৎসক-সকল নিযুক্ত হইল। এবং ধর্ম্মরাজের আদেশক্রমে তন্মধ্যে প্রভূত পরিমাণে শরাসন, জ্যা, বর্ম্ম ও সকলপ্রকার শস্ত্রসমূহ, তদ্ব্যতীত তৃণ তুষ, অঙ্গার, মধু, ঘৃত, উদক এবং বিবিধপ্রকারের ক্ষতনিবারণী ঔষধ রক্ষিত হইল। পাণ্ডবগণ এইরূপে সম্পূর্ণ প্রস্তুত হইয়া যুদ্ধকাল প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন।

 অনন্তর সে রজনী প্রভাত হইলে রাজা দুর্য্যোধন স্বয়ং সেনানিবেশে উপস্থিত হইয়া একাদশ অক্ষৌহিণী পরিদর্শন ও বিভক্ত করিলেন। হস্তী অশ্ব রথাদির মধ্যে উত্তম মধ্যম ও অধম নির্ব্বাচনপূর্ব্বক সেই অনুসারে তাহাদিগকে অগ্র মধ্যে ও পশ্চাতে সন্নিবেশিত করিলেন। এবং সর্ব্বপ্রকার সংগ্রামিক যন্ত্র যাবতীয় অস্ত্রশস্ত্র ও আবশ্যকীয় ঔযধাদি সংগ্রহ করিয়া তাহা সৈন্যগণের সহিত প্রেরণ করিলেন।

 রূপ, দ্রোণ, শল্য, জয়দ্রথ, কাম্বোজাধিপতি সুদক্ষিণ, ভােজরাজ কৃতবর্ম্মা, অশ্বত্থামা, কর্ণ, ভূরিশ্রবা, শকুনি ও বাহ্লিক এই একাদশ মহারথী সৈন্যাধ্যক্ষ পদে নিযুক্ত হইলেন। দুর্য্যোধন ইহাদিগকে বিধিবৎ অর্চ্চনাপূর্ব্বক অতিশয় পরিতুষ্ট ও স্বপক্ষে দৃঢ়বদ্ধ করিলেন।

 তানন্তর উদ্যোগ কার্য্য পরিসমাপ্ত হইলে দুর্য্যোধন সেনাধ্যক্ষগণকে সঙ্গে লইয়া মহাত্মা ভীষ্মের নিকট উপস্থিত হইলেন এবং কৃতাঞ্জলিপুটে কহিতে লাগিলেন―

 হে পুরুষপ্রবীর! আমাদের সৈন্যগণ সংগ্রামার্থে প্রস্তুত হইয়া উপযুক্ত সেনাপতি অভাবে ছিন্নভিন্ন রহিয়াছে। আপনি আমার প্রিয়ানুষ্ঠান-পরতন্ত্র ও শত্রুগণের অবধ্য অতএব আপনি আমাদের সেনাপতি পদ গ্রহণ করুন। আপনার বলবীর্য্যে সুরক্ষিত হইয়া আমরা দেবগণেরও অজেয় হইব।

 ভীষ্ম কহিলেন―হে মহাবাহে! আমি তোমার অনুরােধ রক্ষা করিতে সম্মত আছি, কিন্তু তোমাদের ন্যায় পাণ্ডবগণও আমার প্রিয়পাত্র। তোমাদের আশ্রয়ে আছি অতএব তোমার পক্ষ অবলম্বন করিলাম, কিন্তু এই একটি নিয়ম সংস্থাপন করিতেছি, শ্রবণ কর। আমি সুযোগ উপস্থিত হইলেও কদাচ পাণ্ডবগণকে সংহার করিব না। তোমার প্রীতির নিমিত্ত আমি প্রতিদিন সামর্থ্য অনুসারে সহস্র সহস্র সৈন্য বিনাশ করিব। আর এক কথা, আমি সেনাপতি হইলে কর্ণ সম্ভবত যুদ্ধে যোগদান করিবেন না, অতএব বিবেচনা করিয়া আমাকে নিয়োগ কর।

 তখন কর্ণ কহিলেন―

 ইে দুর্য্যোধন! আমি পূর্ব্বেই প্রতিজ্ঞা করিয়াছি যে, পিতামহ জীবিত থাকিতে আমি অস্ত্র ধারণ করিব না। অতএব উনিই সেনাপতি হইয়া অগ্রে যুদ্ধ করুন। উনি বিনষ্ট হইলে আমি অর্জ্জুনের সহিত সংগ্রাম করিব।

 তখন সকলে বিধিপূর্ব্বক ভীষ্মকে সৈনাপত্যে অভিষিক্ত করিলেন। অনন্তর রাজা দুর্য্যোধনের বিপুল সৈন্যবল মহামতি ভীষ্মকে পুরস্কৃত করিয়া কুরুক্ষেত্রাভিমুখে যাত্রা করিল।

 অনন্তর উভয়পক্ষের সম্মতিক্রমে এরূপ যুদ্ধধর্ম্ম সংস্থাপিত হইল যে রথী রথীর সহিত, গজারোহী গজারোহীর সহিত, অশ্বাবার অশ্বাবারের সহিত এবং পদাতি পদাতির সহিত যুদ্ধ করিবে। অন্যের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত, শরণাপন্ন, যুদ্ধে পরাঙ্মুখ অথবা বিহ্বল ব্যক্তির প্রতি আঘাত করা হইবে না এবং কোন ক্রমেই ছল প্রয়োগ করা হইবে না।

 অনন্তর দুর্য্যোধনের নিয়ােগানুসারে কৌরবপক্ষীয় ভূপতিগণ রাত্রি অবসান না হইতেই স্নানান্তে মাল্য ও শুভ্রবসন পরিধান, শস্ত্র ও ধ্বজ গ্রহণ, স্বস্তিবাচনও অগ্নিতে আহুতি প্রদান করিয়া পরস্পর-শ্রদ্ধান্বিত হইয়া একাগ্রচিত্তে রণক্ষেত্রে গমন করিতে লাগিলেন।

 পঞ্চ-যােজন-বিস্তৃত মণ্ডলাকার যুদ্ধক্ষেত্রের উভয় পার্শ্বে কৌরব ও পাণ্ডব সেনানিবেশ স্থাপিত হইয়াছিল। কৌরব সৈন্যগণ এই ক্ষেত্রের পশ্চিমার্দ্ধ অধিকার করিয়া তথায় সৈন্যসজ্জায় প্রবৃত্ত হইলেন।

 এ দিকে যুধিষ্ঠিরও তাঁহার সেনানায়কগণকে অনুরূপ আদেশ প্রদান করিলে তাহারা বিচিত্র বর্ম্ম কবচাদি ধারণপূর্ব্বক শিল্পী প্রভৃতিকে শিবিরে রাখিয়া সৈন্য ও রথ গজ অশ্বাদি লইয়া ক্ষেত্রের পূর্ব্ববিভাগে চলিলেন, কিন্তু অবশেষে যেরূপ সৈন্য বিভাগ করিবেন, এক্ষণে বিপক্ষদের ভ্রম উৎপাদনের অভিপ্রায়ে অন্যরূপ ক্রমানুসারে চলিতে লাগিলেন। যুদ্ধকালে বিশৃঙ্খলা নিবারণ জন্য রাজা যুধিষ্ঠির পাণ্ডর সৈন্যগণের প্রত্যেক বিভাগের অভিজ্ঞান চিহ্নবিশেষ, ভাষাবিশেষ ও সংজ্ঞাবিশেষ নির্দ্দেশ করিয়া দিলেন।

 পাণ্ডবগণের ধ্বজাগ্র দৃষ্ট হইবামাত্র কৌরবগণ সত্বর ব্যূহিত হইতে আরম্ভ করিলেন। ভীষ্ম প্রথমত সেনাধ্যক্ষদিগকে একত্র করিয়া কহিলেন—

 হে ক্ষত্রিয়গণ! ব্যাধিদ্বারা গৃহে প্রাণ ত্যাগ করা অপেক্ষা যুদ্ধক্ষেত্রে শস্ত্র দ্বারা মৃত্যুই ক্ষত্রিয়ের পক্ষে শ্রেয়। সংগ্রামই স্বর্গগমনের অনাবৃত দ্বার; অতএব এক্ষণে সেই দ্বার অবলম্বনপূর্ব্বক অভিলষিত লােকসকল লাভের নিমিত্ত প্রস্তুত হও।

 অনন্তর কর্ণ ব্যতীত কৃষ্ণাজিনধারী সৈন্যাধ্যক্ষ-সকল দুর্য্যোধনের নিমিত্ত প্রাণপর্য্যন্ত পণ করিয়া হৃষ্টচিত্তে এক এক অক্ষৌহিণী সেনা পরিগ্রহ করিলেন। সেনাপতি ভীষ্ম শ্বেত উষ্ণীষ, শ্বেত কবচ ও শ্বেতচ্ছত্র ধারণ করিয়া অবশিষ্ট এক অক্ষৌহিণী লইয়া সকলের অগ্রে অবস্থান করিতে লাগিলেন। এরূপ অগণ্য সৈন্যদল ইতিপূর্ব্বে একস্থানে কেহ প্রত্যক্ষ করে নাই।

 অনন্তর দুই পক্ষের ব্যূহিত সৈন্যমণ্ডলী হইতে ধীরগণের সিংহনাদ ও যানবাহনাদির শব্দে দশদিক্‌ আকুলিত হইয়া উঠিল এবং দুই পক্ষের সৈন্যজালের গতিজন্য-সমুত্থিত ধূলিপটলে আকাশ সমাচ্ছন্ন হইয়া কিয়ৎকাল আর কিছুই দৃষ্টিগােচর রহিল না।

 দুই দল সম্মুখীন হইয়া স্ব স্ব অভিলষিত স্থানে স্থির হইলে ধূলিজাল অপসারিত হইয়া অপূর্ব্ব শােভা প্রতিভাত হইল। নবােদিত সূর্য্যকিরণে হিরণ্য ভূষিত হস্তী ও রথসকল চপলাবিলাসিত জলদজালের ন্যায় দৃশ্যমান হইতে লাগিল। বীরগণ বিচিত্র প্রভাসম্পন্ন কবচে বিভূষিত হইয়া অগ্নি ও সূর্য্যের ন্যায় দীপ্যমান হইলেন।

 শরাসন খড়্গ গদা শক্তি ও অন্যান্য-প্রহরণ-সমুদায়-শোভিত উভয় সৈন্যদল উন্মত্ত মকরাবর্ত্তযুক্ত যুগান্তকালীন সমবেত সাগর-দ্বয়ের ন্যায় প্রতীয়মান হইতে লাগিল। কাঞ্চনময় অঙ্গদ-শােভিত জ্বলিতানলসদৃশ বহুবিধ ধ্বজসকল ইন্দ্রকেতুর ন্যায় প্রতিভাত হইল। অন্যান্য ধ্বজচিহ্নের মধ্যে ভীষ্মের পঞ্চ-তারা-মণ্ডিত তালকেতু, অর্জ্জুনের ভীষণ কপিধ্বজ, যুধিষ্ঠিরের তারাখচিত সুবর্ণময় চন্দ্র, দুর্য্যোধনের মণিময় নাগচিহ্ন, ভীমসেনের সুবর্ণ সিংহধ্বজ, আচার্য্য দ্রোণের কমণ্ডলু ভূষিত কেতু এবং অভিমন্যুর মণি-কাঞ্চনময় ময়ূর সর্ব্বোপরি জাজ্জ্বল্যমান হইয়া প্রকাশ পাইল।

 অনন্তর রাজা দুর্য্যোধন পাণ্ডবসৈন্যকে প্রতিব্যূহিত অবলােকন করিয়া দ্রোণাচার্য্যকে কহিলেন―

 হে আচার্য্য! ঐ দেখুন শত্রুগণ ভীমসেন-পরিরক্ষিত ব্যূহ রচনা করিয়া আমাদের সৈন্যগণকে আক্রমণ করিবার সঙ্কল্প করিতেছেন, কিন্তু পাণ্ডবদের সৈন্যসংখ্যা পরিমিত, আমাদের বল অপরিমিত, অসংখ্য যোদ্ধা আমাদের হিতার্থে প্রাণদানে প্রস্তুত রহিয়াছে; অতএব শঙ্কার কোন কারণ নাই। সেনানায়কগণ প্রত্যেক ব্যূহদ্বারে অবস্থান করুন এবং আপনি স্বয়ং ভীষ্মকে রক্ষা করুন।

 তখন মহামতি ভীষ্ম দুর্য্যোধনের প্রীতিসাধনার্থে সিংহনাদসহকারে প্রচণ্ড-শব্দ শঙ্খধ্বনি করিলেন। তাহাতে প্রত্যেক সেনানায়ক স্ব স্ব বিভাগ হইতে শঙ্খধ্বনিদ্বারা যুদ্ধার্থে আগ্রহ প্রকাশ করিলেন।

 তদুত্তরে অপর পক্ষ হইতে অর্জ্জুন দেবদত্ত-নামক ও কৃষ্ণ স্বীয় পাঞ্চজন্য-নামক অতি ভীষণ-রব শঙ্খ ধ্বনিত করিয়া কৌরবগণকে ত্রাসিত ও স্বপক্ষকে উদ্বোধিত করিলেন, তখন পাণ্ডব-সেনাধ্যক্ষগণ স্ব স্ব শঙ্খবাদনদ্বারা ব্যূহ রচনা ও যুদ্ধায়োজনের সম্পূর্ণতা জ্ঞাপন করিলেন।

 অনন্তর শ্বেতাশ্বযুক্ত মণিখচিত রথারূঢ় পাণ্ডব-সেনাপতি অর্জ্জুন কৃষ্ণকে কহিলেন—

 হে বাসুদেব! উভয়সেনার মধ্যস্থলে রথ স্থাপন কর, যাহাতে কোন্ পক্ষের কোন্ যোদ্ধা কাহার সহিত যুদ্ধ করিবার উপযুক্ত, তাহা স্থির করিয়া যুদ্ধকার্য্য উপযুক্তরূপে আরম্ভ করিতে পারি।

 তখন কৃষ্ণ অর্জ্জুনের অভিলষিত স্থানে রথ উপনীত করিয়া কহিলেন—

 হে পার্থ! ভীষ্ম দ্রোণাদি যোদ্ধা ও সমগ্র কৌরববীরগণ সমবেত আছেন, অবলোকন কর।

 ধনঞ্জয় উভয় দলের মধ্যে তাঁহার পিতামহ, আচার্য্য, মাতুল, ভ্রাতা পুত্র শ্বশুর ও মিত্রগণ অবস্থান করিতেছেন দেখিয়া কারুণ্য-রস-বশংবদ ও বিষণ্ণ হইয়া কহিলেন—

 হে মধুসূদন! এই সমস্ত আত্মীয়গণ যুদ্ধার্থী হইয়া আগমন করিয়াছেন দেখিয়া আমার শরীর অবসন্ন ও চিত্ত উদ্ভ্রান্ত হইতেছে, গাণ্ডীব আমার হস্ত হইতে স্খলিত হইয়া পড়িতেছে। যাহাদের নিমিত্ত লোকে রাজ্য কামনা করিয়া থাকে, সেই আত্মীয় ও পরম দয়িত ব্যক্তি সকলকে বিনাশ করিয়া আমরা রাজ্যলাভ করিতে উদ্যত হইয়াছি। কিন্তু পৃথিবীর কথা দূরে থাক্, ত্রৈলোক্য লাভার্থেও আমি ইঁহাদিগকে বধ করিতে বাসনা করি না। ইঁহারা লোভে অন্ধ হইয়া যুদ্ধার্থে আগমন করিয়াছেন; কিন্তু হায়! আমরা সমস্ত বুঝিয়াও এই মহাপাপের অনুষ্ঠানে অধ্যবসায়ারূঢ় হইয়াছি। আমাকে নিশ্চেষ্ট অবস্থায় ইহারা বিনাশ করে সেও ভাল, কিন্তু আমি যুদ্ধ করিব না।

 এই বলিয়া ধনঞ্জয় ধনুর্ব্বাণ পরিত্যাগপূর্ব্বক শােকাকুলচিত্তে রথের উপর বসিয়া পড়িলেন। তখন বাসুদেব কৃপাভিভূত বিষণ্ণ-বদন পার্থকে কহিলেন— হে অর্জ্জুন! এই বিষম সময়ে তোমার কি নিমিত্ত এই অনার্য্যজনােচিত মােহ উপস্থিত হইল? ইহা তোমার উপযুক্ত হয় নাই। হে পরন্তপ! এই তুচ্ছ হৃদয়-দৌর্ব্বল্য অতিক্রম করিয়া উত্থান কর।

 অর্জ্জুন কহিলেন―হে কৃষ্ণ! মহানুভব গুরুজনদিগকে বধ করা অপেক্ষা ইহলােকে ভিক্ষান্ন ভােজন করা আমার শতগুণে শ্রেয় বােধ হইতেছে। ইঁহারা বিনষ্ট হইলে আমরা জীবনধারণেই কোন সুখ পাইব না, তবে রাজ্য লইয়া কি করিব? হে সখে! আমি কাতরতা-বশত ধর্ম্মান্ধ হইয়া পড়িয়াছি, অতএব আমাকে উপদেশ দাও, আমি তোমার শরণাপন্ন হইতেছি।

 তখন কৃষ্ণ সস্মিত বচনে অর্জ্জুনকে কহিলেন—

 ভ্রাতঃ! যে সকল যুক্তির দ্বারা তুমি আত্মপীড়ন করিতেছ তাহা প্রথম দৃষ্টিতে সুসম্বন্ধ বটে, কিন্তু তুমি ধীরভাবে বিবেচনা করিলে তাহার ভ্রম বুঝিতে পারিবে। ক্ষুদ্র মানব সুখ-দুঃখের উপর কর্ত্তব্যাকর্ত্তব্য নির্ভর করে না। প্রত্যেক ক্ষেত্রে সামান্য মনুষ্য-বুদ্ধি অনুসারে ফলাফল বিচার করতে গেলে সংশয়-শূন্য ও স্থির সঙ্কল্প হইয়া কোন কার্য্যই করা যায় না। সেই নিমিত্ত ফলাফল ও স্বীয় সুখদুঃখ নগণ্য করিয়া স্বশ্রেণীর নির্দিষ্ট ধর্ম্মানুসারে কর্ত্তব্য পালন করিতে হয়। হে ক্ষত্রিয়শ্রেষ্ঠ! তুমি হৃদয় দৃঢ় করিয়া ক্ষত্রধর্ম্মানুসারে যুদ্ধে প্রবৃত্ত হও, তাহাতে তােমাকে কিছুমাত্র পাপস্পর্শ করিবে না। হে পার্থ! যে চিরন্তন ঘটনাপরম্পরার ফলে এই সুমহৎ কুলক্ষয় আজি উপস্থিত হইয়াছে, ইহাতে তােমার বা কোন ব্যক্তিবিশেষের প্রভুতা বা দায়িত্ব নাই; অতএব হে স্বজন-বৎসল! তুমি এই সান্ত্বনা লাভ কর যে, তুমি কাহারও মৃত্যুর কারণ-স্বরূপ হইতে পার না। কার্য্য-কারণ-প্রবাহে, যাহা ঘটি বার তাহাই ঘটিতেছে। তন্মধ্যে তুমি স্বীয় কর্ত্তব্য অকাতরে পালন করিলে তােমার ধর্ম্মরক্ষা ও পরিণামে শাশ্বত মঙ্গল লাভ হইবে।

 কৃষ্ণের এই উপদেশ শ্রবণে অর্জ্জুনের করুণাজনিত মােহ অপসৃত হইল এবং তিনি স্বীয় কুলধর্ম্ম স্পষ্টরূপে উপলব্ধি করিয়া মনঃসংযমপূর্ব্বক কৃষ্ণকে কহিলেন―

 হে বাসুদেব! তোমার অনুগ্রহে আমার মােহান্ধকার নিরাকৃত হইল। তুমি আমাকে যুদ্ধানুষ্ঠান করিবার যে উপদেশ প্রদান করিলে আমি অবশ্যই তাহা সাধ্যানুসারে পালন করিব।

 অনন্তর অর্জ্জুন পুনরায় গাণ্ডীব গ্রহণ করিয়া গাত্রোত্থানপূর্ব্বক যুদ্ধকার্য্যে মনোনিবেশ করিলেন।

 উভয় পক্ষের বিপুল সৈন্যমণ্ডলীর যুদ্ধক্ষেত্রে অবস্থানের সংবাদ প্রাপ্ত হইলে সর্ব্ব-বেদজ্ঞশ্রেষ্ঠ ব্যাসদেব স্বীয় দুর্নীতির পরিণাম-চিন্তায় শোকাকুল ধৃতরাষ্ট্রসমীপে উপস্থিত হইলেন এবং তাঁহাকে নির্জ্জনে কহিলেন—

 হে রাজন্। কালের পর্য্যায় বোধগম্য করিয়া তুমি সংগ্রামার্থ পরস্পর সম্মুখীন পুত্রগণের নিমিত্ত শোকে চিত্তার্পণ করিও না। হে পুত্র! যদি সংগ্রামস্থলে ইহাদিগকে তোমার দেখিবার ইচ্ছা হয়, তবে আমি তোমাকে দিব্যচক্ষু প্রদান করিব।

 ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন—হে ব্রহ্মর্ষি-সত্তম। জ্ঞাতিবধ সন্দর্শনে আমি অভিলাষ করি না, কিন্তু আপনার অনুগ্রহে যুদ্ধের সমুদায় বৃত্তান্ত শ্রবণ করিতে ইচ্ছা করি। ব্যাসদেব ধৃতরাষ্ট্রের অভিপ্রায় অবগত হইয় সঞ্জয়কে বরপ্রদান পূর্ব্বক কহিলেন―

 এই সঞ্জয় তোমার নিকট যুদ্ধের সমস্ত বৃত্তান্ত বলিবে। সংগ্রামের কোন ঘটনাই ইহার অগোচর থাকিবে না; প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে, দিবায় বা নিশায় যাহা কিছু ঘটিবে, সঞ্জয় সমস্তই অবগত থাকিবে। শস্ত্র ইহাকে ছিন্ন করিবে না এবং পরিশ্রম ক্লান্ত করিতে পারিবে না। হে ভরতশ্রেষ্ঠ! তুমি শোকাভিভূত হইও না, আমি এই কুরুপাণ্ডবগণের কীর্ত্তি চিরবিখ্যাত করিয়া দিব।

 মহাত্মা ব্যাসদেব ধৃতরাষ্ট্রকে এইরূপ সান্ত্বনা দান করিয়া প্রস্থান করিলেন।

 ব্যাস-দত্ত বর প্রভাবে সঞ্জয় প্রত্যহ যুদ্ধক্ষেত্রে নির্বিঘ্নে বিচরণপূর্ব্বক প্রতিদিনের যুদ্ধাবসানের পর সমুদায় বৃত্তান্ত ধৃতরাষ্ট্রের নিকট আসিয়া কীর্ত্তন করিতেন।