খুনী কে/চতুর্থ পরিচ্ছেদ

চতুর্থ পরিচ্ছেদ।

 পরদিন বেলা আটটার পর লালমোহনকে লইয়া জলার ধারে যাইতে মনস্থ করিলাম। থানা হইতে সেই জলা অধিক দূর নহে। আকাশ মেঘশূন্য, ঝড়বৃষ্টির কোন সম্ভাবনা ছিল না, সুতরাং আমরা পদব্রজেই যাইতে লাগিলাম।

 অতি সঙ্কীর্ণ পথ। পথের দুই ধারে বিস্তৃত মাঠ। কৃষকগণ কার্য্যে ব্যস্ত। কেহ লাঙ্গল দিতেছে, কেহ বা বৃক্ষ রোপণ করি- তেছে; কেহ আবার গরুর পাল লইয়া কোন প্রকাণ্ড বৃক্ষের ছায়ায় আশ্রয় লইতেছে। এখন প্রায়ই সহরে থাকা যায়; ঘর, বাড়ী, কাষ্ঠই আমাদের দৃষ্টিগোচর হইয়া থাকে। সুতরাং প্রভাতের এই প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য দেখিয়া, আমার মনে কেমন এক অভূতপূর্ব্ব আনন্দের উদয় হইল—বাল্যকালের কথা মনে পড়িল।

 কিছুদূর যাইলে পর, লালমোহন বলিয়া উঠিলেন, “আজ প্রাতে এক নূতন খবর পাইলাম।”

 আমার কৌতুহল জন্মিল। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম, “কি সংবাদ লালমোহন বাবু?”

 লা। জমীদার মহাশয় বাঁচেন কি না?

 আ। সে কি! কাল রাত্রে ত সেরূপ কোন সাংঘাতিক পীড়ার কথা শুনি নাই।

 লা। না শুনিলেও তাঁহার জীবনের আর কোন আশা নাই।

 আ। তাঁহার বয়স কত?

 লা। ষাট বৎসর হইবে।

 আ। কতদিন তিনি এখানকার জমীদার হইয়াছেন?

 লা। অধিক দিন নহে। এখানকার পূর্ব্ব জমীদারের অবস্থা নিতান্ত মন্দ হওয়ায়, এবং তাঁহার কোন উত্তরাধিকারী না থাকায়, তিনি এই জমীদারী বিক্রয় করেন। কেশব বাবুই উহা ক্রয় করেন এবং সেই অবধি তিনি এখানকার জমীদার হইয়াছেন।

 আ। সে কতদিনের কথা?

 লা। ঠিক বলিতে পারিলাম না। শুনিয়াছি, প্রায় পনের ষোল বৎসর পূর্ব্বে কেশব বাবু এই জমীদারী ক্রয় করেন।  আ। কেশবচন্দ্র আগে কোথায় ছিলেন, বলিতে পারেন?

 লা। শুনিয়াছি—কলিকাতায়।

 আ। তাঁহার আসিবার কত পরে দামোদর এখানে আসেন?

 লা। প্রায় এক বৎসর পরে।

 আ। তিনিই বা পূর্ব্বে কোথায় বাস করিতেন?

 লা। শুনিয়াছি, তিনিও কলিকাতায় থাকিতেন। কেশব বাবুর সহিত তাঁহার বহুদিনের আলাপ। যখন কলিকাতায় বাস করিতেন, তখন তিনি না কি কেশব বাবুর অনেক উপকার করিয়াছিলেন।

 অ। সত্য না কি? সেই জন্যই বুঝি, কেশব বাবু দামোদরকে নিষ্কর ভূমি বাস করিতে দিয়াছেন এবং অনেক বিষয়ে সাহায্য করিয়া থাকেন?

 লা। আজ্ঞা হাঁ। কেশব বাবু এতদিন নানা প্রকারে দামোদয়ের উপকার করিয়া আসিতেছিলেন।

 আ। কিন্তু আশ্চর্য্যের বিষয় এই যে, দামোদর কেশব বাবুর নিকট হইতে এত উপকার পাইয়াও তাঁহার কন্যাকে আপন পুত্রের সহিত বিবাহ দিতে ইচ্ছা করেন। আরও আশ্চর্য্য, জমীদার মহাশয় স্বয়ং দামোদর-পুত্রকে আপনার কন্যাদান করিতে সম্মত নন। দামোদরের এমন কি ক্ষমতা যে, তিনি কেশব বাবুর অমতে তাঁহার কন্যার সহিত আপন পুত্রের বিবাহ দেন। ইহার মধ্যে নিশ্চয়ই কোন রহস্য আছে। আপনি কি কিছু বুঝিতে পারিয়াছেন?

 লা। কই, বিশেষ কিছু বুঝিতে পারি নাই।

 আমি হাসিয়া উত্তর করিলাম, “ব্যাপারটী নিতান্ত সহজ নহে। বাহ্যিক সহজ দেখিলেও, এ রহস্য জটিল।”  লা। সহজই হউক আর জটিলই হউক, আমি যাহা অনুমান করিয়াছি, ভবিষ্যতে তাহাই সত্য হইবে।

 আ। আপনি কি অনুমান করিয়াছেন?

 লা। যতীন্দ্রনাথই হত্যাকারী।

 আ। আমার ত সেরূপ বোধ হয় না। এখন সে কথা যাউক; এই সম্মুখেই বোধ হয় সেই জলা, কেমন লালমোহন বাবু?

 কথায় কথায় আমরা জলার ধারে উপস্থিত হইলাম। আমি তখন লালমোহনকে সকল স্থান গুলি দেখাইয়া দিতে বলিলাম। লালমোহন আমাকে সঙ্গে লইয়া যেখানে মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছিল, যেখানে পিতাপুত্রে বিবাদ হইয়াছিল, যেখানে পুত্র পিতাকে কোলে লইয়া বসিয়াছিল, সেই সকল স্থান একে একে দেখাইয়া দিলেন।

 আমি একে একে সমস্ত স্থান গুলি উত্তমরূপে পরীক্ষা করিলাম। জলার ধার দিয়া অনেক দূর গমন করিলাম। পরে সেখান হইতে ফিরিয়া যে স্থানে মৃতদেহ পাওয়া গিয়াছিল, সেইখানে উপস্থিত হইলাম।

 দেখিলাম, জলার চারিধারই ভিজা, সেই ভিজামাটীতে অনেকগুলি পায়ের দাগ দেখিতে পাইলাম। আমি কখনও দাঁড়াইয়া কখনও বসিয়া, কখনও বা হামাগুড়ি দিয়া, সেই সকল পদচিহ্ন পরীক্ষা করিতে লাগিলাম। লালমোহনও আমার পশ্চাৎ পশ্চাৎ আসিতেছিলেন। কিন্তু আমি তাহাদের গতিবিধি লক্ষ্য করিবার অবসর পাই নাই।

 কিছুকাল এইরূপ পরীক্ষা করিয়া, আমি লালমোহনকে জিজ্ঞাসা করিলাম, “সে দিন আপনি জলার ভিতরে গিয়াছিলেন কি জন্য?”

 লালমোহন আমার কথায় আশ্চর্য্যান্বিত হইয়া বলিলেন, “ভাবিয়াছিলাম, হয়ত হত্যাকারী জলার ভিতরেই কোন অস্ত্র নিক্ষেপ করিয়া থাকিবে।”

 আ। কোন অস্ত্র পাইয়াছিলেন কি?

 লা। না—কিন্তু আপনি ত সেদিন উপস্থিত ছিলেন না? আমিও আপনাকে এ বিষয়ে কোন কথা বলি নাই। তবে আপনি জানিতে পারিলেন কিরূপে?

 আ। সে কথা বলিবার এখন সময় নয়। আপনার পদচিহ্ন দেখিয়া আমি কেন, সকলেই এ কথা বলিতে পারেন। এই দেখুন, এইগুলি যতীন্দ্রনাথের পায়ের দাগ। তিনি এখান দিয়া যে যাতায়াত করিয়াছিলেন, তাহা এই পায়ের দাগ দেখিয়াই বুঝিতে পারা যায়। আবার যে সময় আপনি তাহাকে সঙ্গে লইয়া এখানে আসিয়াছিলেন ও যে যে স্থান তিনি আপনাকে দেখাইয়া দিয়াছেন, তাহাও পদচিহ্ন দেখিয়া বেশ বুঝিতে পারা যাইতেছে। এই দেখুন, এইখানে দামোদরের দেহ প্রথমে মাটিতে পড়ে। এইখানে দেখুন, দামোদর পদচারণা করিয়াছিলেন। সম্ভবতঃ, যখন পিতাপুত্রের বিবাদ হয়, তখন দামোদর ক্রোধে উন্মত্ত হইয়া ইতস্ততঃ বেড়াইয়াছিলেন। আর এইটী কি দেখুন দেখি, এই দাগটী কিসের বলিয়া বোধ হয়?

 লালমোহন অনেকক্ষণ চিন্তা করিলেন কিন্তু কিছুই বলিতে পারিলেন না। তিনি অপ্রতিভ হইয়া আমার দিকে চাহিয়া রহিলেন। আমি বলিলাম, “এই খানে বন্দুকের উপর ভর দিয়া দামোদর দাঁড়াইয়া ছিলেন। বন্দুকের তলাটা মাটীতে কতখানি বসিয়া গিয়াছে দেখিয়াছেন?”

 এইরূপ দেখিতে দেখিতে সহসা আর কতকগুলি চিহ্ন আমার নয়নপথে পতিত হইল। আমি আশ্চর্য্যান্বিত হইয়া বলিয়া উঠিলাম, “এগুলি কিসের দাগ? নিশ্চয়ই কোন লোক ধীরে ধীরে এদিকে আসিয়াছিলেন। এই যে তিনি আবার প্রস্থান করিয়াছেন। এই দাগগুলি কতদূর আছে একবার দেখিতে হইল।”

 এই বলিয়া আমি সেই দাগ দেখিতে দেখিতে অগ্রসর হইলাম। অবশেষে নিকটস্থ মাঠে উপস্থিত হইলাম। সে মাঠজমি ভিজা ছিল না। সুতরাং আর কোন পদচিহ্ন দেখিতে পাইলাম না। আমি তখন জলার ধারে আসিলাম। লালমোহনকে কহিলাম, “মৃতদেহ পাইবার পর, এই স্থান আপনার দ্বারা মাড়ামাড়ি হইয়াছে, তাহা না হইলে এই স্থান হইতেই এই মকর্দ্দমার কিনারা হইয়া যাইত।”

 লালমোহনকে পুনর্ব্বার কহিলাম, “এখন একবার সেই সাক্ষী প্রজার সহিত দেখা করিতে ইচ্ছা করি। আমায় তথা লইয়া চলুন?”

 লালমোহন হাস্য করিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “আর কষ্ট করিয়া কি হইবে? সে যাহা জানে তাহা ত আগেই বলিয়াছে।”

 আমার বড় রাগ হইল। আমি বলিলাম, “কিজন্য দেখা করিতে চাহিতেছি তাহা আপনি জানিলেন কিরূপে? আপনি দেখা করাইয়া দিউন, তাহার পর সমস্তই জানিতে পারিবেন।”

 লা। আপনার কি এখনও বোধ হইতেছে যে, এই হত্যা যতীন্দ্রের দ্বারা হয় নাই?

 আ। আমার বোধ হয়, এই হত্যা যতীন্দ্রের দ্বারা হয় নাই।

 লা। তবে হত্যাকারী কে?

 আ। হত্যাকারী কে, তাহা এখনও ঠিক হয় নাই। তবে তাহার আকৃতি দীর্ঘ, ডানহাত অকর্ম্মণ্য, ডান পায়ের জোর নাই। তাহার পরিধানে মোটা তলাযুক্ত জুতা, আরও অনেক চিহ্ন পাওয়া গিয়াছে, কিন্তু সেগুলি বিশেষ প্রয়োজনীয় নহে।

 লালমোহন আমার কথায় হাসিয়া উঠিলেন। বলিলেন, “সমস্তই কল্পনা মাত্র।”

 আমি বলিলাম, “আপনি আপনার মনের মত কার্য্য করিয়াছেন, আমি আমার নিয়ম মত কার্য্য করিতেছি। হয়ত আজ বৈকালে সমস্ত জানিতে পারিবেন।”

 লা। তবে কি এ রহস্য ভেদ করিয়াছেন?

 আ। নিশ্চয়ই।

 লা। খুনী কে?

 আ। আমি ত তাহার আকৃতি বর্ণনা করিয়াছি। এই স্থানে অধিক লোকের বাস নয়। এখানে ঐ রকম লোক খুঁজিয়া বাহির করা তত কষ্টকর হইবে না।

 ল। সে কার্য্য আমার দ্বারা হইবে না।

 আ। কেন?

 লা। লোকে আমাকে উপহাস করিবে।

 আ। কি জন্য?

 লা। আপনি যেরূপ আকৃতি বর্ণনা করিলেন, সেই আকৃতির লোক খুঁজিয়া বাহির করিতে হইলে আমায় লোকের বাড়ী বাড়ী ঘুরিতে হয়।  আ। না পারেন আমিই দেখিতেছি। কিন্তু পরে আমায় দোষ দিবেন না। আপনার সাহায্যের জন্যই আমি আসিয়াছি, আমার এমন ইচ্ছা নয় যে, এ কার্য্যের সুখ্যাতি আমিই লাভ করি। চলুন, এখন থানায় যাওয়া যাউক।