গল্পস্বল্প/কৃতজ্ঞতা
কৃতজ্ঞতা।
ধন্যস্য় কস্যচিল্লোকে হৃদয়ং তদলঙ্কৃতম্।
বিরাজতে সদা যত্র মহারত্নং কৃতজ্ঞতা।
এই পৃথিবীতে তিনিই ধন্য, তাঁহার হৃদয়ই অলঙ্কৃত যাঁহার হৃদয়ে মহারত্ন কৃতজ্ঞতা সতত বিরাজিত।
কেহ উপকার করিলে সেই উপকার অনুভব করিয়া উপকারক ব্যক্তির প্রতি হৃদয়ের যে সদ্ভাব ও অনুরাগের উদ্রেক হয় তাহাই কৃতজ্ঞতা।
উপকার পাইয়া যে ব্যক্তি কৃতজ্ঞ না হয়—সে নিতান্তই নীচ প্রকৃতির লোক। আমাদের শাস্ত্রে কৃতঘ্নতা সকল পাপের অপেক্ষা মহত্তর পাপ বলিয়া গণিত। নিম্নলিখিত গল্পটি কৃতজ্ঞতার একটি আদর্শ দৃষ্টান্ত।
নেপোলিয়নের মাতা একদা নেপোলিয়ন ও তাঁহার ভাগনী ইলিজা এই দুই জনকে প্রজাপতি ধরিবার একটি জাল দিয়া বাড়ীর বাগানের মধ্যে খেলিতে অনুমতি প্রদান করেন, কিন্তু, বাগানের বেড়ার বাহিরে যাইতে নিষেধ করিয়া দেন।
তাঁহারা জাল পাইয়া মহানন্দে বাগানে খেলা করিতেছেন—এমন সময় একটি ক্ষুদ্র প্রজাপতির প্রতি তাঁহাদের দৃষ্টি পড়িল, অমনি তাঁহারা অন্য খেলা ফেলিয়া সেইটি ধরিতে ছুটিলেন। প্রজাপতি বাগানের বাহিরে গেল। মাতার নিষেধ ভুলিয়া নেপোলিয়নও তৎক্ষণাৎ বেড়া অতিক্রম করিলেন, এবং ইলিজাকেও ধরিয়া বেড়ার বাহিরে নামাইয়া লইলেন। মনের উচ্ছ্বাসে ছুটতে ছুটিতে ইলিজা একটি ডিম্ব-বিক্রেত্রী বালিকার উপর আসিয়া পড়িলেন। ইহাতে বালিকার মস্তক হইতে ডিমের ঝুড়িটি ভূমিতলে পড়িয়া গিয়া তাহার সমস্ত ডিম্বগুলিই প্রায় ভাঙ্গিয়া নষ্ট লইয়া গেল। বালিকা কাঁদিতে লাগিল।
ইলিজা তাহাতে ভীত হইয়া নেপোলিয়নকে বলিলেন “চল ভাই আমরা পালাই। এ মেয়েটি আমাদের চেনে না, চেনা লোক কেহ দেখিবার আগে আমরা বাড়ী পৌঁছিব।”
নেপোলিয়ন বলিলেন “না আমি পলাইব না। দেখিতেছ না মেয়েটি কাঁদিতেছে? আমরা উহার ক্ষতি করিয়াছি—যতদূর পারি এখন তাহা পূরণ করিতে আমাদের চেষ্টা করা উচিত”।
ইলিজা একটু লজ্জিত হইয়া পড়িলেন,—কারণ ক্ষতি তিনিই করিয়াছেন, অথচ তিনি নিজেই পলাইতে চাহিতেছেন।
এদিকে মেয়েটী অত্যন্ত কাঁদিতে কাঁদিতে বলিল—“এই ডিম বিক্রয় করিয়া যাহা কিছু পয়সা পাওয়া যাইত, তাহাতে আমাদিগের পরিবারের তিন দিন আহার চলিত। এখন আমি কি করিয়া আমার শয্যাগত মাতা এবং ক্ষুধিত ভ্রাতা ভগিনীদিগের নিকট গিয়া বলিব যে তিন দিন আর তাহারা আহার পাইবেনা?”
এই কথা শুনিয়া নেপোলিয়ন তাঁহার পকেট হইতে ২টী ফ্লরিন লইয়া তাহাকে দিয়া বলিলেন, “আমাদের যাহা সাধ্য দিতেছি তুমি আর কাঁদিও না।”
তাহাদিগের দৈনিক জলখাবার কিনিবার এই ফ্লরিন দুইটী নেপোলিন বালিকাকে দান করিলেন দেখিয়া ইলিজা ব্যগ্র ভাবে বলিয়া উঠিলেন “ভাই, ও কি করিলে? আমরা যে শুধু রুটী ছাড়া অন্য কিছুই খাইতে পাইব না”।
নেপোলিয়ন বলিলেন “তা কি করিব? আমাদের দোষে উহারা কেন কষ্ট পাইবে?”
এইরূপ কথোপকথন চলিতেছে, এমন সময় একজন দাসী আসিয়া বলিল নেপোলিয়নের মাতা তাহাদিগকে ডাকিতেছেন। নেপোলিয়ন সেই গরীব বালিকাকে আপনাদিগের অনুসরণ করিতে বলিয়া দাসীর সঙ্গে বাড়ী ফিরিয়া গেলেন। তাঁহার মাতা তাঁহাদিগকে ভর্ৎসনা করিয়া কহিলেন “আমি তোমাদিগকে বেড়ার অপর পারে যাইতে বারণ করিয়াছিলাম তোমরা আমার কথা রাখ নাই, ঐ জাল আর তোমরা পাইবে না, আমাকে ফিরাইয়া দাও”। নেপোলিয়ন এই কথা শুনিয়া বলিলেন “মা ইলিজার কোন দোষ নাই, আমিই প্রথমে বেড়ার ওদিকে যাইয়া উহাকে নামাইয়া লইয়াছিলাম”। নিজের দোষ কাটিয়া গেল দেখিয়া ইলিজৗ প্রফুল্ল নয়নে ভ্রাতার দিকে চাহিল। ইলিজার মাতুল তখন এই ঘরে ছিলেন, তিনি নেপোলিয়নকে এইরূপ দোষ স্বীকার করিতে দেখিয়া সন্তুষ্ট হইয়া নেপোলিয়নের মাতাকে বলিলেন, “নেপোলিয়ন নিজের দোষ স্বীকার করিয়াছে অতএব আমার অনুরোধে উহাকে ক্ষমা কর।” ভ্রাতার অনুরোধে নেপোলিয়নের মা তাঁহাকে ক্ষমা করিলেন। ইলিজা তখন অশ্রুপূর্ণ নেত্রে মামাকে বলিল “মামা তুমি আমার হইয়া মাকে একটু বলিবেনা? আমি যে নেপোলিয়ন অপেক্ষাও বেশী দোষ করিয়াছি।” মাতুল বলিলেন “তোমার কি দোষ আগে বল পরে বিচার করিব”। ইলিজা তখন ডিম ভাঙ্গা হইতে আরম্ভ করিয়া সমস্ত ঘটনাই বলিয়া গেল। বলা বাহুল্য যে ইলিজাও, ক্ষমা প্রাপ্ত হইল। তখন নেপোলিয়ন তাঁহার মাকে বলিলেন “মা তুমি যদি আমাকে দুইটী ফ্রাঙ্ক ধার দাও তবে আমি এখন এই বালিকাকে তাহার ডিমের মূল্য দিতে পারি”।
মা বলিলেন “কিন্তু বুঝিয়া দেখ, তাহা হইলে তুমি আর চারি মাসের মধ্যে কিছুই পাইবে না”। নেপোলিয়ন তাহাতেও সম্মত হইয়া ফ্রাঙ্ক দুইটী লইয়া বালিকাকে দিলেন। বালিকা সন্তুষ্ট হইল এবং পূর্ব্ব প্রদত্ত ফ্লরিন দুইটী ফিরাইয়া দিতে চাহিল। বালিকার এইরূপ সদ্ব্যবহার দেখিয়া নেপোলিয়নের মাতা সন্তুষ্ট হইলেন, এবং নেপোলিয়নের অনুরোধে তাহাদিগকে সাহায্য করিবার ইচ্ছায় নেপোলিয়ন ও ইলিজাকে সঙ্গে লইয়া বালিকার অনুবর্ত্তী হইলেন। তাহাদের বাড়ী গিয়া দেখিলেন বালিকার মা শয্যাগতা এবং পাশে কয়েকটী শিশু কাঁদিতেছে, ইলিজা ও তাহার মা যাইয়া তাহাদের শুশ্রূষা করিতে বসিলেন, এবং একটী বড় বালককে কিছুদূরে বসিয়া কাজ করিতে দেখিয়া নেপোলিয়ন তাহারই সহিত বসিয়া কথা কহিতে আরম্ভ করিলেন।
এই বালকের নাম জাকোপ। ক্রমে ক্রমে নেপোলিয়নের সহিত এই বালকটীর বিলক্ষণ ভাব হইল। নেপোলিয়ন সদাই তাহাদের বাড়ী যাইতেন ও সাধ্যমত তাহাদের সাহায্য করিতেন জাকোপাও তাহার বন্ধুকে প্রাণের সহিত ভালবাসিত ও দেবতার ন্যায় ভক্তি করিত। হায়! তাহাদের এ বন্ধুতার সুখ বেশী দিন রহিল না। দশম বৎসরে পড়িবামাত্রই নেপোলিয়ন জন্মের মত কর্সিকা পরিত্যাগ করিয়া গেলেন, কাজেই তাঁহার বাল্যসখার নিকট বিদায় লইতে হইল। যাইবার সময় নেপোলিয়ন জাকোপাকে স্বনামখোদিত একটী ক্ষুদ্র বাক্স উপহার দিয়া গেলে। জাকোপা তাহা অতি আদরের সহিত গ্রহণ করিল এবং প্রতিজ্ঞা করিল জীবন থাকিতে এ বাক্স সে কখনই কাছছাড়া করিবে না।
* * * *
এই ঘটনার পর আজ অনেক বৎসর চলিয়া গিয়াছে। যে বালকের আগে একটী ফ্লোরিন মাত্র আয় ছিল আজ তিনি রাজরাজেশ্বর―আজ তিনি ফ্রান্সের সম্রাট, দুর্গম আল্প পর্য্যন্তও এখন তাঁহার গতিরোধে সমর্থ নহে, সমস্ত ইয়ুরোপ আজ তাঁহার নামে কম্পিত।
কিন্তু এখনও তাঁহার জয়ের আশা মিটে নাই। ঐ দেখ জয়াশায় এখনও তিনি যুদ্ধে ব্যস্ত। অশ্বের হ্রেষা রবে, কামানের গভীর গর্জ্জনে, ধূমে, রণবাদ্যে, আহতদিগের চীৎকারে রণস্থল এক ভীষণ মূর্ত্তি ধারণ করিয়াছে, কিন্তু জয়লক্ষ্মীকে আলিঙ্গন করিতে নেপোলিয়ন কোথায় না অগ্রসর হইতে পারেন! কিন্তু হায়! এইবার বুঝি জয়লক্ষ্মীর পরিবর্ত্তে তাঁহাকে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করিতে হয়! ঐ দেখ একজন শত্রুসেনা নেপোলিয়নের উপর অস্ত্র তুলিয়াছে―এমন সময়ে একজন ফরাসী সেনা নক্ষত্রবেগে ছুটিয়া আসিয়া নেপোলিয়নের স্থল অধিকার করিয়া তাঁহার প্রাণরক্ষা করিল বটে কিন্তু সে নিজে আহত হইল। এ সৈনিক আর কেহ নহে তাঁহারই বাল্যসখা জাকোপা। জাকোপা তাহার বন্ধুকে এত ভালবাসিত যে তাঁহার সঙ্গে থাকিবার জন্য সেও দেশ পরিত্যাগ করিয়া এখানে আসিয়া তাঁহার কোন সেনাপতির অধীনে কার্য্য গ্রহণ করে। তখন নেপোলিয়ন রাজরাজেশ্বর, জাকোপা সামান্য সৈনিক মাত্র, পরস্পরের দেখা শুনা হইবার কোন সম্ভাবনাই নাই। তথাপি বন্ধুর কাছে আছি এই ভাবিয়াই সে সুখী হইত। পরন্তু এই ঘটনার পর হইতে তাঁহাদের পুরাতন বন্ধুতা আবার জাগিয়া উঠিল। জাকোপা জয়ে পরাজয়ে সুখে দুঃখে বিপদে সম্পদে ছায়ার ন্যায় প্রভুর অনুসরণ করিত। যখন তাঁহার আর কেহই ছিল না তখনও জাকোপা ছিল। এই এই যুদ্ধের কয়েক বৎসর পরেই প্রসিদ্ধ ওয়াটারলুর যুদ্ধে বন্দী হইয়া নেপোলিয়ন সেণ্ট হেলেনায় প্রেরিত হ’ন। তিনি যতদিন সমুদ্রে জাহাজে ছিলেন জাকোপা তাঁহার উদ্ধার সাধনের জন্য অনেক চেষ্টা করিয়াছিল অবশেষে হতাশ হইয়া তাঁহার সহিত কারাবাসের প্রার্থনা করে। নেপোলিয়ন শৈশবে জাকোপার উপকার করিয়াছিলেন―সে উপকার জাকোপা জীবনে ভোলে নাই। যখন নেপোলিয়ন সেণ্ট হেলেনায় একাকী আবদ্ধ ছিলেন তখন জাকোপা ভিন্ন তাঁহার সঙ্গে আর কেহই ছিল না। প্রভুভক্ত জাকোপা মরণ পর্য্যন্ত তাঁহার সঙ্গে রহিল এবং তাঁহার মৃত্যুর পর তাঁহার যাহা কিছু অবশিষ্ট ছিল তাহা লইয়া ফ্রান্সে প্রত্যাগমন করে। এই জন্য এখন পর্য্যন্ত ফ্রান্সের রাজধানী পারিসে জাকোপার প্রস্তরনির্ম্মিত প্রতিমূর্ত্তি বিদ্যমান আছে।
এ পৃথিবীতে কিছুই বৃথা যায় না। নেপোলিয়নের জীবন নিষ্ঠুরকার্য্যে অতিবাহিত হইয়াছিল কি না, এখানে সে কথার আবশ্যক নাই কিন্তু শৈশবে তিনি যে ভাল কাজ করিয়াছিলেন মৃত্যুর পূর্ব্বকাল পর্য্যন্ত তাহার ফল ভোগ করিয়া গিয়াছেন। জাকোপা না থাকিলে তাঁহার বিজনদ্বীপের অন্তিমশয্যা যে আরও কত কষ্টকর হইত তাহা বলিবার নহে। .