গল্পস্বল্প/বীরেন্দ্র সিংহের রত্ন লাভ

বীরেন্দ্র সিংহের রত্ন লাভ।

সত্যমেব ব্রতং যস্য দয়াদীনেষু সর্ব্বদা
কামক্রোধৌ বশে যস্য তেন লোকত্রয়ং জিতম্।

 সত্যই যাঁহার ব্রত, সর্ব্বদা দীনে যাঁহার দয়া, কাম ক্রোধ যাঁহার বশীভূত লোকত্রয় জয় করিতে তিনিই সমর্থ।


 সংসারে ধন একটি প্রধান প্রয়োজনীয় বস্তু। কেননা ধনে আমাদের অনেক অভাব মোচন হয়, ধন ব্যবহার করিতে জানিলে ইহা দ্বারা জগতের অনেক উপকার সাধিত হয়, সুতরাং সকলেরি ন্যায়পথে থাকিয়া ধন উপার্জ্জনে যত্নবান হওয়া উচিত। কিন্তু তাই বলিয়া যিনি মনে করেন ধনেই বড় লোক হওয়া যায়— তিনি বড় ভুল বুঝেন। দেখ রাবণ কত বড় ধনী ছিলেন। তাঁহার লঙ্কাপুরী স্বর্ণময়ী— দেবতাগণ তাঁহার দাসত্ব করিতেন, কিন্তু তাঁহাকে ত কেহ বড় লোক মনে করে না। কেন করে না? আমরা ত পূর্ব্বেই বলিয়াছি অন্যায় কর্ম্মের পরিত্যাগেই লোকে যথার্থ বড়লোক হয়, অন্যায় কর্ম্ম করিয়া কেহ বড়লোক হয় না। রাবণ অধর্ম্মাচারী ছিলেন সেইজন্য অতুল ঐশ্বর্য্য ও ক্ষমতার অধিকারী হইয়াও তিনি বড় লোক নহেন। এ কথা কিন্তু সকলে বোঝে না; মনে করে ধনবান, ক্ষমতাবান হইলেই বড় লোক হওয়া যায়। পুরাকালে দাক্ষিণাত্যের এক রাজসভায় বীরেন্দ্র সিংহ নামে এক রাজমন্ত্রী ছিলেন—তিনিও ইহা বুঝিতেন না। তাঁহার বড় লোক হইবার বড় সাধ ছিল, তিনি মনে করিতেন রাজক্ষমতা, রাজধন পাইলেই তিনি বড় লোক হইবেন। এই লোভের বশবর্ত্তী হইয়া তিনি অন্যায় পূর্ব্বক তাঁহার প্রভুর সিংহাসন অধিকার করিয়া স্বয়ং রাজা হইলেন।

 বীরেন্দ্র সিংহ বড় মৃগয়াপ্রিয় ছিলেন। এক দিন তিনি সৈন্যসভাসদগণের সহিত মৃগয়ায় গমন করিলেন,—সহস্র সহস্র অশ্বপদদর্পে প্রান্তরপথ কম্পিত কয়িয়া মৃগয়াক্ষেত্রে আসিয়া উপনীত হইলেন। ক্ষেত্রের প্রান্ত সীমা হইতে একটা হরিণশাবক ভয়-বিহ্বল-নেত্রে অশ্বারোহীদিগের প্রতি একবার চাহিয়া দেখিয়া সহসা দ্রুতবেগে পলায়ন করিল, মহারাজ সঙ্গিবর্গকে পশ্চাতে ফেলিয়া তাহার অনুসরণ করিলেন।

 বেলা দ্বিপ্রহর হইয়াছে, সূর্য্যের প্রখর কিরণে চারিদিক ঝাঁ ঝাঁ করিতেছে, উত্তপ্ত বায়ু স্রোতে উত্তপ্ত ধূলিকণার তরঙ্গ উঠিতেছে, চারিদিক নিস্তব্ধ,—দিগন্ত-শূন্য বিশাল প্রান্তরে মৃগশিশুটি বিদ্যুতের মত এক একবার মহারাজকে দেখা দিয়া মাঝে মাঝে উন্নত অসমভূমি, ক্ষুদ্র ঝোপঝাপ ও তৃণস্তূপের অন্তরালে আবার অদৃশ্য হইয়া পড়িতেছে। আর লোক নাই, আর পশু নাই— অগ্নিময় প্রান্তর যেন জীব-শূন্য। অতিরিক্ত পরিশ্রমে মহারাজের শরীর শ্রান্ত ক্লান্ত, মৃগয়ার উৎসাহে তথাপি তিনি শ্রান্তি অনুভব করিতেছেন না, অবিশ্রান্ত অবারিত বেশে মৃগের অনুসরণ করিতেছেন। দেখিতে দেখিতে মৃগশিশুটা প্রান্তর ছাড়াইল, তিনিও প্রান্তর ছাড়াইলেন, মৃগ এক অনিবিড় বন মধ্যে প্রবেশ করিল, তিনিও প্রবেশ করিলেন; বন মধ্যে একটী মন্দির, তথায় মৃগশিশু প্রাণপণ গতিতে আশ্রয় গ্রহণ করিল,—রাজা হতাশ হইয়া মন্দিরের দ্বারে আসিয়া দাঁড়াইলেন, বুঝিলেন তাহা মন্দিরের প্রতিপালিত মৃগ—সুতরাং অবধ্য।

 নিরাশ অবসন্ন রাজা শ্রান্তি দূর করিতে মন্দিরে আশ্রয় গ্রহণ করিলেন। পুরোহিতের আতিথ্য-সৎকারে গতশ্রম হইয়া কিয়ৎক্ষণ পরে তিনি দেব চরণে প্রণাম করিতে গমন করিলেন। অপরাহ্ণের নিস্তেজ সূর্য্যরশ্মি মন্দির ভেদ করিয়া শিবমূর্ত্তি উজ্জ্বল করিতে অক্ষম,—শিবের গাত্রজড়িত একটি সর্পের মস্তকস্থিত জ্বলন্ত দীপালােকে তাঁহার মূর্ত্তি বিভাসিত দেখিলেন। প্রণাম করিয়া উঠিবার সময় মহারাজের দৃষ্টি প্রদীপে আকৃষ্ট হইল—কি আশ্চর্য্য! দেখিলেন প্রদীপ তৈলশূন্য অথচ তাহার সমুজ্জ্বল দীপ্তির কিছুমাত্র হ্রাস নাই। মহারাজকে বিস্মিত দেখিয়া পুরােহিত বলিলেন “মহারাজ বিস্মিত হইবেন না, ইহার নাম ইচ্ছাদীপ্ত প্রদীপ। এই প্রদীপের নিম্ন ভূমিতে মহাদেব একটি দেবরত্ন রাখিয়া ইহা জ্বালাইয়া রাখিয়াছেন। যদি কেহ এই রত্নটি গ্রহণ করিতে সমর্থ হয় তবেই এই প্রদীপ নিভিবে নতুবা ইহার নির্ব্বাণ নাই”। মহারাজ অতি আগ্রহের সহিত জিজ্ঞাসা করিলেন “সে রত্নটি কি?”

 পুরােহিত বলিলেন “জগতের সার রত্ন। উহা লাভ করিলে মানুষের দেবত্ব হয়”। মহারাজের লােলুপ হৃদয় তাহা লাভ করিতে উৎসুক হইল; তিনি বলিলেন “উহা কিরূপে লাভ করা যায়? পুরােহিত বলিলেন “ইহা লাভ করিতে হইলে পৃথিবীজয়ী হইতে হইবে, পৃথিবীজয়ী না হইলে লাভের আশা বৃথা।”

 মহারাজ তাহা লাভ করিতে কৃতসঙ্কল্প হইলেন। যাইবার সময় পুরােহিত তাঁহার হস্তে একটী কুশাঙ্গুরীয় পরাইয়া তাহাতে দেবপ্রদীপের কালী মাখাইয়া বলিলেন “যে দিন দেখিবে এই কালীর দাগ মুছিয়া গিয়াছে সেই দিন বুঝিও তুমিও পৃথিবীজয়ী হইয়া এই রত্ন লাভের অধিকারী হইয়াছ—দীপ নিভিয়াছে।”

 রাজা বাড়ী, ফিরিয়া আসিলেন দিগ্বিজয়ের সমস্ত বন্দবস্ত হইল, মহারাজ দিগ্বিজয়ে গমন করিলেন। তখন রাজগণ ভারত জয় করিতে পারিলেই আপনাকে পৃথিবীজয়ী জ্ঞান করিতেন। বীরেন্দ্র সিংহ সমস্ত ভারতবর্ষ জয় করিয়া দেশে প্রত্যাবর্ত্তন করিলেন। আহ্লাদে হৃদয় উন্মত্ত, তিনি মানব হইয়া স্বীয় ক্ষমতায় দেবরত্ন লাভ করিবেন, এ পর্য্যন্ত ধরাধামে এরূপ সৌভাগ্য কাহারও ঘটে নাই;— কিন্তু সহসা তাঁহার সে আহ্লাদ দুর হইল, পুরোহিত কুশাঙ্গুরীয় পরাইয়া যে কথা বলিয়াছিলেন তাহা মনে পড়িল, হস্তের দিকে চাহিয়া দেখিলেন অঙ্গুরীয়কের কালীর চিহ্ণ যেমন তেমনি রহিয়াছে। মহারাজ নিরাশ হৃদয়ে মহামহোপাধ্যায় শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতদিগকে আহ্বান করিলেন। মন্দিরের বৃত্তান্ত তাঁহাদিগকে বলিয়া এ সম্বন্ধে তাঁহাদের পরামর্শ জিজ্ঞাসা করিলেন। পণ্ডিতগণ বলিলেন “পুরোহিতের কথানুরূপ আপনি পৃথিবী জয় করিলেন কিন্তু তাহাতেও যখন অঙ্গুরীয়কের কালী মুছিল না, তথন পুরোহিতের কথার যথার্থ অর্থ তাহা নহে। পৃথিবীর রক্তপাতে যথার্থ পৃথিবী জয় হয় না। যখন আপনি পৃথিবীর হৃদয় জয় করিতে পারিবেন তখনই যথার্থ পৃথিবীজয়ী হইবেন। জগতের লোক ভয়দৃষ্টিতে আপনাকে মনুষ্যহন্তা বলিয়া না দেখিয়া যখন ভালবাসার চক্ষে, ভক্তির চক্ষে দেখিবে, যখন জগতের হৃদয় অধিকার করিবেন তখনি আপনি পৃথিবী জয়ী হইতে পারিবেন।”

 মহারাজ এই কথা সত্য বলিয়া বুঝিলেন; রাজ্যের এক প্রান্ত হইতে অপর প্রান্ত পর্য্যন্ত ধন রত্ন ঢালিয়া দিতে লাগিলেন, যশে জগত ধ্বনিত হইল, কিন্তু হায়! রাজা ব্যথিত হৃদয়ে দেখিলেন তাঁহার অঙ্গুরীয়ক এখনও কালীময়। শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিতদিগের কথাও ব্যর্থ দেখিয়া কালী মুছিবার উপায় জানিতে ভগ্নহৃদয়ে আবার তিনি সেই দেবমন্দিরের পুরোহিতের নিকট যাত্রা করিলেন।

যাইবার সময় পথে একজন সন্ন্যাসী তাঁহাকে ম্লান দেখিয়া তাহার কারণ জিজ্ঞাসা করিলেন। সবিশেষ শুনিয়া সস্নেহে বলিলেন “বৎস, রক্তপাত করিয়া, কিম্বা যশের কামনা-পরবশ হইয়া পৃথিবীজয়ী নামের আশা করিও না। তাহাতে সে প্রদীপ নিভিবে না। যদি আত্মজয় করিতে পার তাহা হইলেই তুমি যথার্থ পৃথিবী জয়ী হইবে ও তাহা হইলেই তুমি সেই দেবরত্নের অধিকারী।”

 সন্ন্যাসীর কথায় মহারাজের চৈতন্য হইল। তিনি মন্দিরে না গিয়া পথ হইতে বাটী ফিরিয়া আসিলেন। অন্যায়রূপে যে সকল রাজত্ব কাড়িয়া লইয়াছিলেন তাহা ফিরাইয়া দিলেন, নিজের দুষ্প্রবৃত্তি সকল দমন করিয়া নিঃস্বার্থ ভাবে পরোপকারে কৃতসঙ্কল্প হইলেন। আন্তরিক প্রার্থনায় ঈশ্বর তাঁহার সহায় হইলেন— ক্রমে লোভ, ঈর্ষা, অহঙ্কার সকলি তাঁহাকে পরিত্যাগ করিল— তিনি ঈশ্বরে আত্ম সমর্পণ করিতে সমর্থ হইলেন। তখন তাঁহার হস্তের কালী মুছিয়া গেল, কিন্তু তখন আর কোন রত্ন লাভে তাঁহার বাসনা রহিল না, তিনি বাসনাহীন হৃদয়ে পুরোহিতকে ধন্যবাদ দিবার নিমিত্ত সেই মন্দিরে গিয়া দেখিলেন, প্রদীপ নিভিয়া গিয়াছে। পুরোহিত বলিলেন—“তুমি যে রত্ন লইতে আসিয়াছ তাহা ইতিপূর্ব্বেই তোমার হইয়াছে—এই দেখ দীপ নির্ব্বাপিত। এখন তুমি কেবল মাত্র পৃথিবীজয়ী নহ—ত্রৈলোক্য জয়ী।”

বালকবালিকাগণ, তোমরা কি বুঝিয়াছ এই গল্পটির গূঢ়ার্থ কি? দুষ্প্রবৃত্তি মনুষ্যহৃদয়ে সর্পস্বরূপ। মনুষ্যের গুণজ্যোতি হরণ করিয়া সে নিজে প্রতিভাত হয় কিন্তু মনুষ্যকে নিস্তেজ করিয়া রাখে। সেই সর্পের ধ্বংস দ্বারাই মনুষ্য তাহার মনুষ্যত্ব ফিরিয়া পায়।