ব্যায়াম।

 আহারের দ্বারা আমাদের শরীরের ক্ষয় পূরণ হয়, ব্যায়াম আহার্য্য পরিপাকের সহায়তা করিয়া তাহার প্রকৃত ফল প্রদান করে। বস্তুতঃ আহার করিলেই হয় না, উত্তমরূপে আহার পরিপাক না হইলে তাহাতে ভাল ফল না হইয়া বরঞ্চ মন্দ ফলই হয়। সুতরাং নিয়মিত আহারের ন্যায় নিয়মিত ব্যায়ামও স্বাস্থ্যের পক্ষে অনুকূল। যে সকল বালকগণ সর্ব্বদাই দৌড়াদৌড়ি খেলাধুলা করিয়া বেড়ায় তাহাদের আর অন্যরূপ ব্যায়াম চর্চ্চার আবশ্যক করে না কিন্তু বিপরীত পক্ষে রীতিমত ব্যায়াম করা আবশ্যক। কোনরূপ ক্রীড়া দ্বারা এই ব্যায়ামকার্য্য সাধিত করিলে সর্ব্বাপেক্ষা অধিক উপকার পাওয়া যায়। কেন না খেলায় শরীর সঞ্চালিত হইবার সঙ্গে সঙ্গে মনেরও স্ফূর্ত্তিলাভ হয়, এবং মুক্ত বায়ুতে ব্যায়াম করিলে ব্যায়ামের ফল আরো অধিক হয়। কিন্তু মুক্ত বায়ুতে পরিশ্রম করিতে হইলে সেই সময় অঙ্গে একটি ফ্ল্যানেলের জামা ধারণ করা উচিত। পরিশ্রম করিতে করিতে শরীর ঘর্মার্দ্র হইলে ফ্লানেলে সেই ঘর্ম্ম শোষিত হইয়া যায়, সুতরাং ঘর্ম্মাক্ত শরীরে বাতাস লাগিলে যে অপকার হইবার কথা, ইহা দ্বারা তাহা নিবারিত হয়। আরো একটি কথা ব্যায়ামের পর যদি অঙ্গ-বস্ত্র আর্দ্র থাকে তবে তাহা ত্যাগ করিয়া শুষ্ক বস্ত্র পরিধান করা ভাল, কিন্তু তৎক্ষণাৎ গাত্রাবরণ খুলিয়া মুক্তগাত্রে থাকা উচিত নহে; এবং কিয়ৎক্ষণ বিশ্রাম না করিয়া তখনি স্নান কিম্বা আহার করাও ভাল নহে।

 ব্যাডমিনটন, লনটেনিশ, ক্রিকেট বড় সুন্দর ব্যায়াম। পল্লিগ্রামের ছেলেরা গ্রামের মাঠে সুবিধা মত এই সকল খেলার স্থান করিয়া লইতে পারেন। আর সহরে যাঁহাদের বাড়ীতে উদ্যান আছে তাঁহারা ত নিজের বাড়ীতেই ঐরূপ খেলার আড্ডা করিতে পারেন। এক এক পাড়ায় এইরূপ এক একটি স্থান থাকিলেই সেই পাড়ার সকল বালকগণই সেইখানে সমবেত হইয়া খেলায় যোগদান করিতে পারেন।

 কিন্তু সকল দিন সকলের বাড়ীর বাহিরে গিয়া ব্যায়ামের সুবিধা না হইতে পারে, বর্ষাকালেও সকল দিন বাহিরে ব্যায়াম করা চলে না সেই জন্য ঘরের মধ্যে থাকিয়া সহজে যে সকল ব্যায়াম করা যাইতে পারে তাহাও দুই একটি আয়ত্ত করিয়া রাখা উচিত। মুদ্গর ও ডম্বলের সাহায্যে, কিরূপে ব্যায়াম করিতে হয় তাহা আমাদের দেশের বালক মাত্রেই জানেন, কিন্তু লাঠি দ্বারা অতি সহজে যে কতকগুলি ব্যায়াম সম্পন্ন হইতে পারে তাহা হয়ত অনেক বালকের জানা নাই। তাহাও এক পক্ষে ব্যায়াম অন্য পক্ষে প্রীতিজনক খেলা। একজন আমেরিকাবাসী এই ব্যায়াম সম্বন্ধে যাহা বলিয়াছেন ‘বালক’ নামক মাসিক পত্রে তাহার অনুবাদ প্রকাশ হইয়াছিল। সেই অনুবাদ আমরা এইখানে উদ্ধৃত করিয়া দিতেছি।

 “ফিলাডেলফিয়ার যে স্কুলে আমি বিদ্যা শিক্ষা করিয়াছিলাম সেখানকার পড়িবার সমস্ত ঘর একই তলাতে। সমস্ত ঘরের মধ্যে এমন দেয়াল দেওয়া যে ইচ্ছা করিলে সে সমস্ত দেয়াল পাশের দিকে সরাইয়া দিয়া সকল ঘরগুলিকে একটা ঘরের মত করিয়া ফেলা যায়। হেডমাষ্টারের সঙ্কেত মত দিনের মধ্যে দুইবার, দ্বিপ্রহরে ও বিকালে, ঘরের মধ্যেকার দেয়াল সরাইয়া দেওয়া হইত। বালকেরা অমনি দেয়ালের কাছে গিয়া সেখানে যে সমস্ত লাঠি সাজান থাকিত প্রত্যেকে তাহার এক এক গাছা হাতে করিয়া ঘরের মাঝখানে আসিয়া সার গাঁথিয়া দাঁড়াইত। একজন শিক্ষক পিয়ানোর কাছে গিয়া একটা ছোট খাট সাদাসিদে সুর বাজাইতেন, আর বালকের তালে তালে লাঠি লইয়া ব্যায়াম করিত। দিনে দুইবার পাঁচ দশ মিনিট করিয়া এই প্রকার ব্যায়াম করিবার পর আমাদের এমন চমৎকার স্ফূর্ত্তি হইত, আমরা যেন নুতন বল পাইয়া আবার পড়িতে বসিতাম। অনেক দিন দ্বিপ্রহরের দিকে কেমন ক্লান্তি বোধ হইত আর ঘুম পাইত তখন এই প্রকার ব্যায়াম আমাদের জাগাইয়া দিয়া একেবারে তাজা করিয়া তুলিত। ইহাতে স্কুলের পড়ার কোন হানি না হইয়া বরং সম্পূর্ণ সহায়তা করিত। ঘণ্টা বাজিলে অমনি আবার সকলে আপন আপন হস্তস্থিত লাঠিগুলি যথাস্থানে রাথিয়া নিজের পড়া আরম্ভ করিত।”

 এই ব্যায়ামের সুবিধা এই, ইহা দ্বারা শরীরের গ্রন্থি ও মাংসপেশী সমূহকে ইচ্ছামত সকল দিকে নোয়াইবার ফিরাইবার ক্ষমতা বাড়ে; আর কাহারও যদি নত হইয়া চলিবার অভ্যাস থাকে কিম্বা বক্ষ সঙ্কীর্ণ থাকে এই ব্যায়ামে তাহারও প্রতিকার হইবার সম্ভাবনা। ইহাতে বড় অধিক পরিশ্রম হয় না। সুতরাং ইহা আরম্ভের পক্ষে তাল। ব্যায়াম করিয়া বিশেষ ক্লান্ত হইয়া পড়িলে তাহাতে উপকার না হইয়া বরং অপকার হইবারই কথা। যে পরিমাণ শ্রমে শরীরে বেশ স্ফূর্তি বোধ হয় সেই পরিমাণ শ্রমই স্বাস্থ্যকর।

 লাঠির ব্যায়ামের নিয়ম এই—লাঠিগাছটি বেশ সোজা, মসৃণ আর এক ইঞ্চি আন্দাজ মোটা হওয়া চাই, ছোট ছোট ছেলেদের জন্য দুই হাত লম্বা, বড়দের জন্য আড়াই হাত।


১ম চিত্র।

 ১। ১ম চিত্রে যেমন দেখিতেছ ঐ রকমে দুই হাত দিয়া লাঠি-গাছা তিন ভাগ করিয়া ধর। ঐ ভাবে হাত সবলে নীচে নামাইয়া পায়ের কাছাকাছি রাখ আবার দাড়ির নিম্ন ভাগ পর্যন্ত উঠাও। ছবিতে যেমন দেখিতেছ, সেইরূপ হাতের কুণুই যেন উপরের দিকে থাকে।

 ২। ১ম চিত্রে যে রকমে লাঠি ধরা হইয়াছে ঐ রকমে লাঠি ধরিয়া যথাসাধ্য উচ্চে উঠাও, দশবার এই রূপ করিবে।

 ৩। আগেকার মত লাঠি ধরিয়া যথাদাধ্য উচ্চে উঠাইয়া দ্বিতীয় চিত্রের ন্যায় ঘাড়ের নীচে নামাইয়া আন। এইরূপ দশবার করিবে।

 ৪। আগেকার মত লাঠি ধরিয়া জোরে যথাসাধ্য উচ্চে উঠাইয়া নামাইবার সময় একবার ঘাড়ের নীচে নামাইবে, আর একবার দাড়ির নীচে নামাইবে।

 ৫। এবার ৩য় চিত্রে যেমন দেখিতেছ লাঠির দুইধার দুই হাতে ধরিয়া যথাসাধ্য উচ্চে উঠাও পরে আবার ৪র্থ চিত্রে যেমন দেখিতেছ পিঠের দিকে যথাসাধ্য নীচে নামাও। দেখিও যেন হাত ঠিক সোজা থাকে, কুনুই দোমড়াইয়া না যায়। এইরূপ বিশবার করিবে।

 ৬ আগেকার মত দুইধার দুইহাতে ধরিয়া লাঠি উচ্চে উঠাও আর নামাইবার সময়ে এক বার সম্মুখ দিকে একবার পিঠের দিকে নামাও।
২য় চিত্র।

 ৭। লাঠির দুই ধার দুই হাতে ধরিয়া মাথার উপরে উঠাও, তার পরে ৫ম চিত্রে যেমন দেখিতেছ ঐ রকমে একবার বাম দিকে আর একবার ডাইন দিকে ফিরাও। দেখিও যেন কুণুই দোম্‌ড়াইয়া না যায় আর লাঠি যেন খাড়া থাকে।

 ৮। লাঠির মাঝখানে পাঁচ ছয় ইঞ্চি দূরে, দুই হাত দিয়া ধরিয়া হাত যথাসাধ্য সোজা রাখিয়া সম্মুখের দিকে বাড়াইয়া দেও, তার পরে হাত আড়ষ্ট করিয়া রাখিয়া যতদূর সম্ভব একপাশ হইতে আর একপাশে ঘুরাও।


৩য় চিত্র।
 ৯। ডানহাতে লাঠির মাথা ধরিয়া, দুই পায়ের দুই গোড়ালি একত্র করিয়া সোজা হইয়া দাঁড়াও। দাঁড়াইয়া যতদূরে পার তেড়াভাবে লাঠি বাড়াইয়া দেও, লাঠির অগ্রভাগ যেন ভূমি স্পর্শ করে এবং লাঠি ও শরীর দুইই যেন ঠিক সোজা থাকে। তার পরে ৬ষ্ঠ চিত্রে যেমন দেখিতেছ ঐ ভাবে পা বাড়াইয়া দেও, পা লাঠীর পশ্চাৎ দিকে পড়িবে। এইরূপ করিবার সময়ে কুণুই যেন দোমড়াইয়া না যায় আর লাঠি যেন না নড়ে। ইহাতে কাঁধও
৪র্থ চিত্র।
প্রায় নড়ে না, কেবল পায়ের দিকটা নড়ে—এই রকম ভাবে একবার ডান পা বাড়াইবে আর একবার বাঁ পা বাড়াইবে। দশবার এইরূপ করিবে।

 ১০। সোজা হইয়া দাড়াও; ৭ম চিত্রের ন্যায় লাঠির মাথা বা হাতে ধরিয়া তেড়াভাবে ডান দিকে যতদূরে পার ডান পা বাড়াইয়া দেও, তার পরে লাঠির দিকে বাঁ পা বাড়াইয়া দেও। বাঁ পা ঠিক ঐ অবস্থায় রাখিয়া ডান্‌ পা একবার যতদূর সাধ্য বাড়াইয়া দিবে আবার টানিয়া
৫ম চিত্র।
লইবে। ঐরূপ করিয়ায় সময় ডান পায়ের হাঁটু যেন দোম্‌ড়াইয়া না যায় আর মাথা ও কাঁধের ঝোঁক যেন পশ্চাৎদিকে থাকে।

 ১১। ৮ম চিত্রে যেমন দেখিতেছ ঐ প্রকারে লাঠি ধরিয়া দুই হাত সোজা ভাবে সম্মুখ দিকে উঠাও আবার বুকের দিকে টানিয়া লও লাঠি যেন সর্ব্বক্ষণ ঠিক খাড়া থাকে। দশবার এইরূপ করিবে।

 ১২। শেষোক্ত প্রকার ব্যায়ামের মত সম্মুখে হাত উঠাইয়া ৯ম চিত্রের ন্যায় লাঠি দক্ষিণ হস্তে রাখ আবার সম্মুখ দিকে হাত উঠাইয়া উক্তরূপে লাঠি বাম হস্তে ধর। দশ বার এইরূপ করিবে।

 ১৩। পূর্ব্বোক্ত প্রকারে সম্মুখের দিকে হাত উঠাইয়া ৮ম চিত্রের ভাবে লাঠি বুকের কাছে ধর। তারপরে
৬ষ্ঠ চিত্র।
১০ম চিত্রে যেমন দেখিতেছ ঐ রূপে একবার তেড়াভাবে লাঠি বাঁ দিকে উঠাও আবার বুকের কাছে ধরিয়া তেড়াভাবে ডানদিকে বাড়াইয়া দেও। এইরূপে লাঠি একবার এ-পাশে একবার ও পাশে কুড়িবার ধর।

 ১৪। শেষোক্ত ব্যায়ামের মত লাঠি ডানদিকে বাড়াইবে ও সেই সঙ্গে ডান পাও সেই দিকে বাড়াইবে। ১১শ চিত্রের ন্যায় পা ও লাঠি দুই তেড়াভাবে একবার বাঁ দিকে একবার ডানদিকে
৭ম চিত্র।
বাড়াইবে। এইরূপ কুড়ি বার করিবে।

 ১৫। শেষোক্ত প্রকারে লাঠি যখন বাঁ দিকে বাড়াইবে তখন সেই সঙ্গে ডান পা ডানদিকে বাড়াইবে। আবার লাঠি যখন ডানদিকে বাড়াইবে তখন সেই সঙ্গে বাঁ পা বাঁ দিকে বাড়াইবে।

 ১৬। ডান্‌ পা তেড়াভাবে সম্মুখদিকে বাড়াইবে আর সেই সঙ্গে লাঠি তেড়াভাবে বাঁ কাঁধের উপর দিয়া পিঠের দিকে বাড়াইবে, আবার বাঁ-পা ঐ ভাবে বাড়াইবে ও সেই সঙ্গে লাঠি ডান কাঁধের উপর দিয়া বাড়াইবে।

 ১৭। ডান পা তেড়াভাবে পশ্চাৎ দিকে বাড়াইবে আর সেই
৮ম চিত্র।
সঙ্গে লাঠি তেড়াভাবে সম্মুখে দিকে বাঁয়ে বাড়াইবে, ১২শ চিত্রে যেমন দেখিতেছ। বাঁ পা যখন পশ্চাৎ দিকে বাড়াইবে তখন লাঠি সম্মুখ দিকে বাড়াইবে।

 ১৮। ডান পা তেড়াভাবে পশ্চাৎ দিকে বাড়াইবে আর সেই সঙ্গে লাঠি তেড়াভাবে পশ্চাৎদিকে ডাইনে বাড়াইবে। আবার বাঁ পা তেড়াভাবে পশ্চাৎ দিকে বাড়াইবে আর সেই সঙ্গে লাঠি তেড়াভাবে পশ্চাৎ দিকে বাড়াইবে।

 ১৯। শেষোক্ত ভাবে পা ও লাঠি বাড়াইবে, কেবল যখন ডান পা বাড়াইবে তখন লাঠি বায়ে আর যখন বাঁ পা বাড়াইবে তখন লাঠি ডাইনে বাড়াইবে।

 এই ব্যায়াম সকল তালে তালে করিলে বড় ভাল হয়। বালকেরা এক গাছা লাঠি অনায়াসেই সংগ্রহ করিতে পারেন, সুতরাং উল্লিখিত রূপ ব্যায়াম অভ্যাস করা বালকদিগের যেমন সহজ সাধ্য তেমনি সুবিধাজনক।


৯ম চিত্র।

১০ম চিত্র।

১১শ চিত্র।

১২শ চিত্র।