গল্পস্বল্প/খাদ্য
খাদ্য।
কিরূপ আহার আমাদের স্বাস্থ্যের পক্ষে বিশেষ আবশ্যক, তাহা জানিতে হইলে খাদ্যের গুণাগুণ প্রথমে কিছু বুঝা আবশ্যক।
অধুনাতন বিজ্ঞানবিৎ-পণ্ডিতেরা চারি শ্রেণীতে সমস্ত ভক্ষ্যদ্রব্যকে বিভক্ত করিয়া থাকেন।—যথা—
১। সত্ত্বকারী বা প্রাণকারী।
২। তৈল বা চর্ব্বি জাতীয়।
৩। শ্বেতসার।
৪। ধাতব।
সত্ত্বকারী বা প্রাণকারী পদার্থে সচরাচর চারিটি মৌলিক বা ভৌতিক পদার্থ দেখিতে পাওয়া যায়। যথা—ক্ষারজান, অম্লজান, জলজান ও অঙ্গারজান। কখন কখন উহাতে গন্ধক ও ফসফোরসও পাওয়া যায়। ময়দা, ডিম্ব, মাংস ও দুগ্ধ এই সমুদায়ের সারাংশ এই জাতীয় পদার্থ।
২। চর্ব্বি। ইহাতে তিনটী ভৌতিক পদার্থ পাওয়া যায়। অঙ্গারজান, জলজান ও অম্লজান। সকল প্রকার চর্ব্বি ও তৈল এই জাতীয় পদার্থ।
৩। শ্বেতসার। ইহাতেও তিনটি মৌলিক পদার্থ পাওয়া যায়। অঙ্গারজান, জলজান ও অম্লজান। তবে চর্ব্বিজাতীয় পদার্থে জলজানের ভাগ অধিক। আমাদিগের প্রায় সকল প্রকার খাদ্যদ্রব্যের মধ্যে শ্বেতসার অত্যধিক পরিমাণে পাওয়া যায়। গঁদ, শর্করা, আরারুট, তণ্ডুল ময়দা, আলু ইত্যাদিতে অত্যধিক পরিমাণে শ্বেতসার আছে।
৪। ধাতব পদার্থ ও জল। এই দুই পদার্থ সকল ভক্ষ্য দ্রব্যের মধ্যেই নানাধিক পরিমাণে পাওয়া যায়।
উপরি উক্তচারি বিভাগের মধ্যে কোন একটি দ্রব্য অধিককাল পর্য্যন্ত আহার করিয়া প্রাণধারণ করিতে পারা যায় না। প্রকৃত জীবনধারণেপযােগী আহারে এই চারি জাতীয় পদার্থের উপযুক্ত পরিমাণে সংমিশ্রণ আবশ্যক। কিন্তু কোন সত্ত্বকারী পদার্থ যদি সহজে জীর্ণ হয় তাহা হইলে অন্য জাতীয় পদার্থের সাহায্য ব্যতীতও ইহা জীবন ধারণােপযােগী হইতে পারে। কারণ, সত্ত্বকারী পদার্থে যে চারিটি মৌলিক পদার্থ দেখা যায় ঐ চারিটি মৌলিক পদার্থে মনুষ্য দেহও গঠিত হইয়াছে, সুতরাং মনুষ্য দেহ ও সত্ত্বকারী পদার্থের রাসায়নিক সংঘটন একই। এতদ্ব্যতীত ধাতব পদার্থ ও জলও আমাদের দেহে পাওয়া যায়।
প্রতি মুহুর্ত্তেই আমাদের শরীর হইতে ঘর্ম্ম প্রভৃতির নিঃসরণের সঙ্গে যে এক প্রকার ক্ষার জাতীয় পদার্থ নির্গত হইতেছে, আহার কর বা না কর ইহা নির্গমনের বিরাম নাই। এই নিঃস্রবণ শরীরাভ্যন্তরিক সত্ত্বকারী পদার্থের রূপান্তর মাত্র। এই কারণে সত্ত্বকারী পদার্থ দ্বারা শরীরের ক্ষতি সর্ব্বাপেক্ষা অধিক পূরণ হইয়া থাকে। অঙ্গারাম্ল ও জল যাহা সর্ব্বদা ক্ষয়প্রাপ্ত শরীরজাত দ্রব্য মধ্যে পাওয়া যায়, তাহাও সত্ত্বকারী পদার্থের অম্লজান ও অঙ্গারজান হইতে উদ্ভূত হইতে পারে।
তােমরা এখন বুঝিতে পারিয়াছ সত্ত্বকারী পদার্থ চারি প্রকার ভক্ষ্যদ্রব্যের মধ্যে সর্ব্ব প্রধান, এবং কোন কোন অবস্থায় অন্য শ্রেণীর সাহায্য ব্যতিরেকেও উহা প্রাণধারণােপযােগী হইতে পারে। কিন্তু ইহা সত্বেও সত্ত্বকারী পদার্থ অসুবিধাজনক ও অপরিমিত খাদ্য। একটি উদাহরণ দিয়া বুঝান যাউক। ডিম্বসার একপ্রকার প্রধান সত্ত্বকারী পদার্থ। ইহার শতভাগের মধ্যে ৫৩ ভাগ অঙ্গারজান ও ১৫ ভাগ ক্ষারজান পাওয়া যায়। যদি কোন ব্যক্তিকে কেবল ডিম্বের শ্বেত ভাগ আহার দেওয়া যায় তাহা হইলে মােটামুটি ধরিতে গেলে সে ব্যক্তি প্রত্যেক ক্ষারজান ভাগের সহিত সার্দ্ধ তিন ভাগ অঙ্গারজান আহার করিবে। কিন্তু ইহা প্রত্যক্ষ দেখা যায় যে একজন সুস্থকায় পুষ্ট মনুষ্য যে নিজ ভার ও স্বাভাবিক উত্তাপ রক্ষণের উপযুক্ত মধ্যবিধ ব্যায়াম করিয়া থাকে, তাহার দেহ হইতে চারি সহস্র গ্রেণ অঙ্গার ও তিনশত গ্রেণ ক্ষারজান নির্গত হয় অর্থাৎ ক্ষারজানের তের গুণ অঙ্গারজান নির্গত হয়। অতএব যদি কোন ডিম্বসার হইতে তাহাকে ৪০০০ সহস্র গ্রেণ অঙ্গারজান লইতে হয় তাহা হইলে ঐ পদার্থ ৭৫৪৭ গ্রেণ আহার করিতে হয়। কিন্তু ৭৫৪৭ গ্রেণ ডিম্বসারে ১১৩২ গ্রেণ ক্ষারজান আছে অর্থাৎ যত ক্ষারজানের আবশ্যক তাহার প্রায় চারিগুণ অনর্থক আহার করিতে হয়।
স্বাস্থ্যরক্ষার একটি প্রধান নিয়ম এই যে আবার বলবর্দ্ধক ও শরীর রক্ষার উপযোগী হইবে অথচ পরিমাণে অধিক হইবে না। কিন্তু একমাত্র সত্ত্বকারী পদার্থ দ্বারা যদি জীবন ধারণ করিতে হয় তাহা হইলে এই নিয়ম রক্ষা হয় না, এবং তজ্জন্য় অল্প সময়ের মধ্যেই স্বাস্থ্য ভঙ্গ হইয়া শরীর দুর্ব্বল হইয়া পড়ে। এই বিশেষ কারণে মিশ্র আহার অর্থাৎ সত্ত্বকারী ও তৈল বা শ্বেতসার জাতীয় পদার্থমিশ্রিত আহার মনুষ্যের পক্ষে বিশেষ উপযোগী ও স্বাস্থ্যকর। উক্ত তিন প্রকার খাদ্যের মধ্যেই ধাতব পদার্থ ও জল পাওয়া যায়।
শরীরের পুষ্টির জন্য যাহা আবশ্যক তাহা মিশ্র আহারেই পাওয়া যায় ইহা তোমরা বুঝিলে; কখন কিরূপ আহার করিলে এই উদ্দেশ্য সাধিত হইতে পারে তাহা এইবার দেখা যাউক। ভাক্তারেরা বলেন শিশুকাল অতিক্রম করিবার পর সাধারণত দিন রাত্রের মধ্যে নিয়মিত চারিবারের অধিক না খাওয়াই ভাল। চারি বারের দুইবার পূর্ণ আহার-দুইবার লঘু আহার।
প্রত্যুষে উঠিয়া মুখ প্রক্ষালন করিয়া কিছু লঘু আহার করিয়া বেড়াইতে যাইবে; কিম্বা যদি তাহাতে অসুবিধা হয় তবে বেড়াইয়া আসিয়া এই আহার করিবে।
ইয়োরোপীয়দিগের হিন্দুদিগের ন্যায় আহারের বিচার নাই, সুতরাং ইংরাজ-ডাক্তারেরা এ সময়ে সাধারণতঃ মুরগীর কাঁচা বা অর্ধসিদ্ধ ডিম দু একটি, দুই এক টুকরা মাখনমিশ্রিত পাঁউরুটি এবং ইহার সহিত চা রুটি কোকো, কিম্বা দুগ্ধ পানের ব্যবস্থা দিয়া থাকেন। কেননা ডিম্ব একদিকে লঘু ও অপরদিকে পুষ্টিকর খাদ্য। আমাদের দেশে অনেকের ধারণা আছে কাঁচা ডিম কাঁচা মাংসের ন্যায় অখাদ্য। কিন্তু বস্তুতঃ কাঁচা ডিম বিস্বাদ নহে এবং সিদ্ধ ডিমের অপেক্ষা শীঘ্র পরিপাক হয়। তবে আমাদের দেশে মুরগীর ডিম অখাদ্যের মধ্যে পরিগণিত সুতরাং এদেশের বালকগণের পক্ষে অল্প পরিমাণ ছোলাভিজা মোহনভোগ ও দুগ্ধ কিম্বা দুগ্ধ-মিশ্রিত কোকো এ সময়ে উপযোগী খাদ্য। যে সকল বালকদিগের রুক্ষ ধাতু দুগ্ধাদির সঙ্গে তাহাদিগের এ সময় কিছু কিছু ফল খাওয়াও ভাল। আমাদের মত উষ্ণপ্রধান দেশে চা কাফি প্রভৃতি তেমন উপযোগী নহে।
ইহার পর স্কুলে যাইবার এক ঘণ্টা অন্ততঃ অর্দ্ধ ঘণ্টা পূর্ব্বে অন্নাহার। অন্ন ব্যঞ্জনের সঙ্গে পলতা নিম প্রভৃতি তিক্ত তরকারী আহার করা ভাল। ভাত খাইবার পরেও অন্ততঃ অর্দ্ধঘণ্টা বিশ্রাম আবশ্যক।
আবার স্কুলে ২।৩টার সময়, কিম্বা পাঠান্তে বাড়ী আসিয়া বালকগণ ফল মিষ্টান্ন মোহনভোগ আহার এবং ইহার সহিত কেহ দুগ্ধ, কেহ কোকো, যাঁহার যাহা সুবিধা তাহা পান করিতে পারেন।
সন্ধ্যা বা রাত্রিতে শেষ আহার। সমস্ত দিনের অপেক্ষা ইহা গুরু হইলে ক্ষতি নাই কেননা সমস্ত রাত্রি পরিপাকের সময় পাওয়া যায়। তবে অধিক রাত্রে আহার বিশেষত গুরু আহার করা ভাল নহে তাহাতে পরিপাকের ব্যাঘাত ঘটে। এই সময় মাংস, রুটি, লুচি খাইলেই ভাল। মাংস খাইবার যাঁহার সুবিধা নাই, রুটি লুচি মৎস্য তরকারী দুগ্ধাদি তিনি খাইতে পারেন। যাঁহারা মাংস খান না, তাঁহাদের, দুগ্ধ অপেক্ষাকৃত অধিক মাত্রায় পান করা আবশ্যক। কেননা দুধে সকল রকম দ্রব্যই আছে।
আহার করিবার সময় ভাল করিয়া চর্ব্বণ করিয়া খাইবার দিকে যেন বিশেষ লক্ষ্য থাকে। চর্ব্বণের সহিত পরিপাকের বিশেষ ঘনিষ্ট সম্বন্ধ। শুনিতে পাওয়া যায় গ্ল্যাডষ্টোন প্রত্যেক মাংসের টুকরা গুণিয়া ৩২ যায় এবং রুটির টুকরা ১৬ বার করিয়া চর্ব্বণ করেন। স্বাস্থ্যরক্ষার ক্ষুদ্র নিয়মের প্রতিও এইরূপ দৃষ্টি আছে বলিয়াই এত বৃদ্ধ বয়সেও তিনি সুস্থ সবল আছেন। আহারের সময় সন্তুষ্টচিত্তে আহার করিলে শীঘ্র পরিপাক হয়।
অতিরিক্ত ঝাল, টক বা মসলামিশ্রিত ব্যঞ্জন অধিক খাওয়া উচিত নহে। অনিয়মিত সময়ে যাহা তাহা খাওয়াও স্বাস্থ্যহানিকর,—তাহাতে বাজে জিনিষেই উদর পূর্ণ হইয়া যায়— নিয়মিত আহারের পক্ষে ব্যাঘাত জন্মে। আহারের পর কষ্ট হয়, এত অধিক করিয়া খাওয়াও স্বাস্থ্যের পক্ষে অমঙ্গলজনক। তাহাতে ক্রমে ক্ষুধা মন্দ হইয়া আসে ও পরিপাকের ব্যাঘাত ঘটে। আর একটি কথা, তৈল ঘৃত দুগ্ধ মৎস্য মাংস এ সকলই যাহাতে খাঁটি ও তাল হয় তাহা দেখা উচিত।
সাধারণ আহারের নিয়ম আমরা সংক্ষেপে একরূপ বলিলাম, তবে কোন খাদ্য কাহারও বিশেষ ধাতুতে পরিত্যক্ত হইতে পারে। যেমন অম্ল প্রধান ব্যক্তির পক্ষে ডিম্ব প্রশস্ত আহার নহে।
সুতরাং কোন বিশেষ খাদ্য কাহার পক্ষে বিশেষরূপ ভাল বা মন্দ তাহা প্রত্যেকেরই বাল্যকাল হইতে বুঝিতে চেষ্টা করা উচিত। যতক্ষণ নিজে না তাহা ঠিক বুঝিতে পারা যায় ততক্ষণ ডাক্তার ও প্রতিপালিকাদিগের উপদেশ শুনিয়া এবিয়য়ে কার্য্য করাই শ্রেয়ঃ।