সত্য।

নাস্তিসত্যসমোধর্ম্মো ন সত্যাৎ বিদ্যতে পরম্।
নহি তীব্রতরং কিঞ্চিদনৃতাদিহ বিদ্যতে।

 সত্যের সমান ধর্ম্ম নাই সত্য অপেক্ষা শ্রেষ্ঠও আর কিছু নাই, এবং মিথ্যা অপেক্ষা মোর অনিষ্টকর পদার্থ জগতে লক্ষিত হয় না।

 সত্যনিষ্ঠা সর্ব্বশ্রেষ্ঠ ধর্ম্মনীতি, কারণ যাহা ন্যায় তাহাই সত্য, যাহা পুণ্য তাহাই সত্য, আর যাহা অন্যায় যাহা পাপ তাহাই মিথ্যা। পূর্ব্বকালে ভারতবর্ষীয়গণের সত্যের প্রতি গাঢ় অনুরাগ ছিল বলিয়া তাঁহারা বড় লোকও হইয়াছিলেন। দশরথ সত্য রক্ষার জন্য তাঁহার প্রাণাধিক পুত্র রামকে বনবাস দিয়াছিলেন। আমরা বড় লোক হইতে ইচ্ছা করি কিন্তু যতদিন আমাদের সত্যের প্রতি প্রবল অনুরাগ হইবে—ততদিন আমাদের সে আশা বৃথা। তুমি যদি বড় লোক হইতে চাও কখনো মিথ্যা বলিও না। দৈবাৎ অন্যায় কার্য্য করিলে পিতা মাতার ভয়ে মিথ্যা বলিয়া তাহা লুকাইবার চেষ্টা করিও না। যাহার সত্য বলিবার সাহস আছে—পিতামাতা তাহাকে ক্ষমা করেন। যদিই বা ক্ষমা করিয়া না তোমার দোষের জন্য তোমার পিতামাতা তোমাকে ভর্ৎসনা বা অন্য কোনরূপ শাস্তি প্রদান করেন তাহা হইলেও তোমার সত্য বলিতে বিরত হওয়াউচিত নহে। কারণ সন্তানের মঙ্গল কামনা করিয়াই অর্থাৎ যাহাতে সে ভবিষ্যতে ঐরূপ গর্হিত কার্য্য পুনরায় না করে এই অভিপ্রায়েই পিতামাতা সন্তানকে দণ্ড বিধান করেন, সুতরাং দণ্ডভয়ে ভীত না হইয়া তাহা সহ্য করাই মনুষ্যত্ব। সেই দণ্ডদ্বারাই তোমার ন্যায়ান্যায় বোধ জন্মিবে এবং কর্ত্তব্যাকর্ত্তব্য শিক্ষা হইবে; সেই সামান্য কষ্ট সহ্য করিয়া তুমি মানুষ নামের যোগ্য হইবে; ইহা হইতে সুখের বিষয় আর কি আছে। একটি বালক কিরূপ স্থলে সত্য পালন করিয়া জগতের পূজনীয় হইয়াছেন তাহা শুনিবে?


 একদা একদল মুসলমান যাত্রী বোগদাদ নগরে যাইতেছিল। সন্ধ্যা হইয়া পড়িয়াছে এখনো তাহারা প্রান্তর পথ উত্তীর্ণ হইতে পারে নাই, দারুণ শীতে তাহাদের শোণিত যেন বরফের মত জমাট বাঁধিয়া আসিতেছে; নিকটে বসতির চিহ্ন মাত্র নাই; সুদূরে কোন দীপের ক্ষীণালোকও দেখিতে পাওয়া যাইতেছে না—যে তাহা দেখিয়া তাহাদের নৈরাশ্য পূর্ণ হৃদয়ে কথঞ্চিৎ আশার উদ্রেক হয়, তথাপি তাহারা লক্ষ্যহীন, নিরাশ হৃদয়ে অগ্রসর হইতেছে। সহসা তাহারা চমকিয়া উঠিল, একদল দস্যু ভীষণ চীৎকার করিয়া তাহাদের নিকটবর্ত্তী হইল। দেখিতে দেখিতে দস্যুদল কর্ত্তৃক তাহারা আক্রান্ত ও পরাভূত হইল। প্রান্তরের সীমানায় ক্ষুদ্র পাহাড়ের অন্তরালে দস্যদিগের বসতি,— যাত্রীদিগকে বন্দী করিয়া তাহারা সেইখানে লইয়া গেল, এবং তাহাদিগের সর্ব্বস্ব কাড়িয়া লইল। যাত্রীদিগের মধ্যে একটি বালক ছিল, কেবল তাহার নিকটে দস্যুগণ এক কপর্দ্দকও পাইল না। তাহার বস্ত্রাদি উত্তমরূপ অনুসন্ধান করিবার পর এক জন দস্যু তাহাকে জিজ্ঞাসা করিল—“তোমার কাছে কিছুইনাই?

 বালক বলিল—“আছে।”

 দস্যু ভাবিল বালক উপহাস করিতেছে। সে বলিল—“কি আছে?”

 বালক বলিল—৪০টি মুদ্রা আমার কাপড়ের ভিতর আছে?” দস্যু বালকের কাপড় বেশ করিয়া দেখিয়াছিল, সুতরাং এই কথায় হাসিতে লাগিল। আর একজন বলিল—“ঠাট্টা করিতেছিস্?”

 বালক বলিল—“ঠাট্টা নয়, আমি ত বলিলাম—আমার কাছে ৪০টি মুদ্রা আছে”।

 এই সময় তাহাদের দলপতি আসিয়া উপস্থিত হইল। সে শুনিল বালকের কাছে কিছু পাওয়া যায় নাই। সে আবার বালককে জিজ্ঞাসা করিল—“তাের কাছে কিছুই নাই”?

 বালক। আছে।

 দস্যুপতি। কি আছে?

 বালক। ৪০টিমুদ্রা।

 দলপতি। কোথায় আছে?

 বালক। আমার কাপড়ের মধ্যে সেলাই করা আছে।

 দস্যপতি তাহার কাপড়ের সেলাই খুলিয়া দেখিল সত্যই ৪০টি মুদ্রা আছে। সে তখন আশ্চর্য্য হইয়া বলিল—“তুমি নির্ব্বোধের ন্যায় কেন বলিলে তােমার কাছে মুদ্রা আছে? মুদ্রা যেরূপে লুকান ছিল—তুমি না বলিতে ত কেহ তাহার সন্ধান পাইত না। বলিবে ত এত যত্নে তাহা কাপড়ের মধ্যে লুকাইয়া। রাখিবার কি দরকার ছিল?”

 বালক বলিল “মা আমাকে বলিয়াছেন কখনাে মিথ্যা বলিও না।”

 এই কথায় হঠাৎ দস্যুপতির মনের ভাব পরিবর্ত্তিত হইল, সে বলিল,“হায় এই ক্ষুদ্র বালক তাহার মাতার আজ্ঞা এইরূপে পালন করিতে শিখিয়াছে—আর আমি বৃদ্ধ হইয়া গেলাম এখনও পরম পিতা ঈশ্বরের আজ্ঞা পালন করিতে শিখিলাম না”।

 দস্যুপতি অনুতপ্ত হৃদয়ে বালকের হাত ধরিয়া বলিল—“আমি তোমার হাত ধরিয়া এই শপথ করিতেছি আর কখনো ঈশ্বরের আজ্ঞা অমান্য করিব না”।

 তাহার সঙ্গিগণ এতক্ষণ অবাক হইয়া সমস্ত শুনিতেছিল— এখন সকলে দস্যুপতির নিকট অগ্রসর হইয়া বলিল, “প্রভু এই বালকের কথায় আমাদেরও চৈতন্য হইয়াছে। আমরাও পাপপথ ত্যাগ করিব। আপনি পাপপথে আমাদের নেতা ছিলেন পুণ্য পথেও আমাদের নেতা হউন”।

 সেই দিন হইতে দস্যুগণ তাহাদের অধর্ম্মলব্ধ ধনরত্ন সকল দীন দরিদ্রদিগকে বিতরণ করিয়া সাধু-জীবন অবলম্বন করিল।

 এই বালকের নাম আবদুল কাদির। পারস্য-ইতিহাসের ইনি একজন বিখ্যাত ব্যক্তি।