গল্পস্বল্প/ঝটিকা
ঝটিকা।
মেঘে মেঘে মেঘে, ছেয়েছে আকাশ,
দেখা নাহি যায় চাঁদিয়া আর,
নদীর উরসে ঢেউ সাথে ঢলি
খেলে না জোছনা রজত ধার।
মৃদুল পবন বহেনাক আর
গাছের একটি পাতা না নড়ে,
বহে কি না বহে তটিনী কে জানে
ঢেউ ত একটি নাহিক পড়ে।
আঁধার আকাশ স্তম্ভিত ধরণী
মন্ত্রস্তব্ধ যেন চারিটি ধার!
কি বিপ্লব কথা নীরবে কহিছে
থাকে না বুঝি বা জগৎ আর!
তটিনীর কূলে কুঁড়ে ঘরখানি
দ্বারের বাহিরে জেলেনী, জেলে—
ভয়াকুল প্রাণে আছে দাঁড়াইয়ে,
কুটীরের স্নিগ্ধ আলোক ফেলে।
সহসা অশনি কড় মড় কড়
ঘোষিল ভেদিয়া আঁধার নিশি!
নিবিড় জলদ ভীম গরজনে
সঘনে কাঁপায়ে তুলিল দিশি!
বীর পরাক্রমে এদিকে ওদিকে
মাতিয়ে বহিল পবন রাশি,
ধাঁধিয়ে দিগন্ত বেড়াইছে ছুটে
সুবিকট ঐ দামিনী হাসি।
নাহি সে তটিনী প্রশান্ত মুরতি
ভীষণ সংহার-মূরতি তার!
সফেণ তুফানে আক্রমিছে বেলা
দুর্দ্দাড় ভাঙ্গিয়ে ফেলেছে পাড়!
সহসা উঠিল করুণ ক্রন্দন।
তরী একখানি যেন রে ডোবে!
কাঁপিয়ে উঠিল ধীবর দম্পতি
হৃদয় দহিল দারুণ ক্ষোভে।
বলিল জেলিনী “ঐ শুন আহা
কোন অভাগার জীবন যায়!”
ততক্ষণ ছুটি, খুলি দিয়ে খুঁটি
করুণ ধীবর উঠিল ‘না’য়।
এ কালনিশায় নাহি ভুরুক্ষেপি
ঝপ ঝপ ঐ চলিল তরী।
আকুল পরাণে তীরে দাঁড়াইয়ে
কর জোড়ে সতী স্মরিল হরি।
কত রজনীতে কত ঝটিকায়
সাহসী দয়ার্দ্র সােয়ামী তার,
কত মরণেরে করেছে বারণ
কতই বিপদ করিয়ে সার।
সমুখে জাগিল সেই সব ছবি
পরাণ ভরিয়া গাহিল জয়,
পরাণ ভরিয়া ডাকিল হরিরে
‘তার’ এ বিপদে করুণাময়’।
চলিল তরণী তুফাণে তুফাণে
কভু পড়ে পুনঃ উঠিছে কভু,
অটল হৃদয় সাহসী ধীবর,
কোন ভয় ডর নাহিক তবু।
মনে তার শুধু জাগে সে রােদন
ঝটিকা তুফানে চেয়ে না চায়,
কেবলি হাঁকিছে—“কোথায় রে তােরা
ভয় নেই আর—নে যাব আয়।”
তবুও উত্তর নাহি দিল কেহ,
রোদনও আর ত শােনা না যায়,
অধীর হৃদয়ে বাহি চলে জেলে
ঝটিকায় তরী রাখাও দায়।
তুফাণের পর উঠিছে তুফাণ
গেল গেল তরী নাহিক আশ,
নাহি ভুরুক্ষেপ সে দিকে তাহার
জলে চেয়ে দেখে চুলের রাশ।
ঝাঁপাইয়ে পড়ি চোখের নিমিষে
পিঠের উপর দেহটি তুলে,—
তরঙ্গের সাথে যুঝিয়া যুঝিয়া
প্রাণ পণে জেলে উঠিল কূলে
জেলেনী দাঁড়ায়ে স্তম্ভিত মূরতি
নামাইল দেহ তাহার কাছে,
অবসন্ন প্রাণ রুদ্ধশ্বাস-দেহ
আপনি লুটিয়ে পড়িল পাছে।