সঙ্গদোষ।

মোহজালস্য যোনির্হি মূঢ়ৈরেব সমাগমঃ
অহন্যহনি ধর্ম্মস্য় যোনিঃ সাধুসমাগমঃ।

 মূঢ় ব্যক্তিদিগের সহবাসে সমূহ মোহের উৎপত্তি হয়, এবং প্রতিদিন সাধুসংসর্গে নিশ্চিত ধর্ম্মের উৎপত্তি হয়।


 সুবুদ্ধির পরামর্শে আষরা যেরূপ ভাল লোক হইতে পারি—এবং কুবুদ্ধির পরামর্শে যেমন মন্দ লোক হইয়া পড়ি—সেইরূপ মন্দ লোকের সহবাসে আমরা মন্দ হইয়া যাই—সাধু সঙ্গে আমাদের সাধুতা বৃদ্ধি পায়। সেই জন্য সাধু সঙ্গ যেমন প্রার্থনীয় মন্দ সঙ্গও তেমনি পরিত্যজ্য। ভাল লোক মন্দ সঙ্গে পড়িয়া মন্দ হইয়া গিয়াছে এমন অনেক গল্প শুনা যায়— আমি তাহার একটি তোমাদিগকে বলিতেছি।


 আজ আশ্বিন মাসের সপ্তমী, বনগ্রামের চট্টোপাধ্যায় মহাশয়ের বাড়ী মা আসিয়াছেন! প্রাতঃকালের সুমঙ্গল-ধ্বনি,—শঙ্খ, ঘণ্টা, ঢাক, ঢোল, সানাইয়ের উত্তেজনাপূর্ণ মধুর গম্ভীর-তান সমস্ত গ্রামখানির হৃদয় ভক্তিস্রোতে তরঙ্গিত করিয়াছে।

 সম্বৎসরকাল বিষাদে যাহার হৃদয় পুড়িয়াছে এই ভক্তির প্রভাবে তাহার হৃদয়েও আজ আনন্দ, সম্বৎসর যাহার চোখের জল শুকায় নাই আজ তাহারও মুখে হাসি ফুটিয়াছে,—মা আসিয়াছেন—এমন আনন্দের দিনে সাংসারিক দুঃখ আজ কে না ভুলিবে? আজ যে না হাসিবে তাহার জীবনে হাসিবার দিন আর আসিবে না।

 আজ সকাল হইতে বনগ্রামের রাস্তার দৃশ্য ফিরিয়া গিয়াছে, গ্রামে এমন লোক নাই যে সাজ সজ্জা না করিয়াছে, একখানি নূতন কাপড় না পরিয়াছে। গাঁয়ের বৌঝিগণ—যাহার যে ভাল কাপড়খানি, যে গহনাগুলি আছে তাহা পরিয়া, আলতা পায়ে দিয়া, ঘোমটা টানিয়া বৃদ্ধাদিগের সঙ্গে সঙ্গে ঠাকরুণ প্রণামে চলিয়াছে। বালক বালিকাগণ নূতন পরিচ্ছদে সাজিয়া মস্ত লোকের চালে—গম্ভীর ভাবে চারিদিকে দৃষ্টিপাত করিতে করিতে, হাস্যপূর্ণ উল্লাসিত উৎসাহিত যুবকমণ্ডলী এবং হরিনামের মালা হস্ত, প্রীতি গদ্গদ চিত্ত বৃদ্ধগণের সহিত একত্রে পূজাগৃহে গমন করিতেছে। বিশ্বজননীর আগমনে আজ গ্রাম কৃতার্থ, পবিত্র, শোভাময়, আনন্দবিভাসিত।

 এইরূপে প্রাতঃকাল কাটিয়া গেল, ক্রমে দ্বিপ্রহরের বলিদানের সময় আসিয়া পড়িল,—পূজার দালানের সম্মুখের উঠানে বলিদানের আয়োজন হইয়াছে। গ্রামের যত ছেলেরা মনভরা আনন্দ, মুখভরা হাসি লইয়া একযুগ আগে হইতে এখানে আসিয়া উপস্থিত হইয়াছে। কেবল দীননাথ এখানে নাই, দীননাথ ঠাকরুণ প্রণাম করিয়া সেই যে সকালে ঘরে গিয়াছে সেই অবধি আর তাহার দেখা নাই। দুই প্রহর অতীত হইয়া যায় তথাপি দীননাথকে গৃহে দেখিয়া তাহার মা আশ্চর্য্য হইয়া বলিলেন— “হাঁ রে দীনু, বেলা দুপর হইল এখনি বলিদান হইবে,—সব ছেলেরা এতক্ষণ পূজা বাড়ীতে, আর তুই যে এখনো ঘরে?”

 দীননাথ বলিল—“না মা এ বেলা আমি আর পূজা-বাড়ীতে যাইব না। হরি, কানাই, শ্যাম, কি কেহ আসিলে, আমি বাড়ী আছি—একথা তুমি কাহাকেও বলিও না। বলিলে আর তাহাদের হাত ছাড়াইতে পারিব না।”

 তাহার মা এই কথায় একটু ব্যস্ত হইয়া দীননাথের কপালে হাত দিয়া বলিলেন—“কেনরে বাছা পূজা দেখিতে যাইবিনে কেন? কোন অসুখ করে নাই ত?” দীননাথ বলিল “না মা অসুখ কিছুই করে নাই, এখনি পূজা বাড়ীতে পাঁটা বলি হইবে, আমি বলি দেখিতে পারি না তাই এ বেলা যাইব না”—

 দীননাথ আর বেশী কথা কহিবার সময় পাইল না। তাহার কথা শেষ হইতে না হইতে ‘দীন কোথা—দীন কোথা’ বলিয়া চীৎকার করিতে করিতে একদল ছেলে হুড় মুড় করিয়া ঘরের মধ্যে আসিয়া পড়িল। আর এড়াইবার সাধ্য কি—তাহাদের সঙ্গে সঙ্গে বলিদানের পাঁঠার মতই দীননাথ পূজাবাড়ীর উঠানে আসিয়া দাঁড়াইল। তাহারা উঠানে পা দিতে না দিতে বলিদানের শঙ্খ ঘণ্টা প্রভৃতি বাজনা বাজিয়া উঠিল, ধুপ ধূনার গন্ধে উঠান ভরিয়া গেল, পুরোহিত দালানে ছাগশিশু উৎসর্গ করিয়া বন্ধন করিয়া রাখিয়াছিলেন, একজন ব্রাহ্মণ সেই চন্দন সিন্দুর শোভিত, মাল্যভূষিত ছাগ আনিতে গেল, পুরোহিত হাড়কাঠ পূজা করিয়া খড়্গ মন্ত্রপুত করিতে লাগিলেন। ব্রাহ্মণ ছাগক্রোড়ে নিকটে আসিয়া দাঁড়াইল—ছাগশিশু তাহার ক্রোড় হইতে পলায়ন করিবার জন্য ছটফট করিতে করিতে চতুর্দ্দিকে আকুলনয়নে দৃষ্টিপাত করিয়া মর্ম্মভেদী স্বরে ডাকিতে লাগিল, যেন সে তাহার আসন্নকাল বুঝিতে পারিয়া কাতর কণ্ঠে অব্যক্ত ভাষায় বলিতে লাগিল—“আমি পশু, তোমরা মানব, আমি ক্ষুদ্র তোমরা মহান। বুদ্ধিতে তোমরা সাগর উল্লঙ্ঘন করিয়াছ, আকাশ ভেদ করিয়াছ, দেবতাদের সমকক্ষ হইয়াছ। তবে তোমাদের তুলনায় কীট হইতেও কীটাণুবৎ যে আমি, আমার ক্ষুদ্র জীবন আরো ক্ষুদ্র করিয়া তোমাদের কিসের এত উৎসব? তবে কেন তোমাদের মানসজননীকে রাক্ষসী অনুমান করিয়া তাঁহাকে তাঁহার এ সন্তানের রক্তপাতে প্রসন্ন করিবার প্রয়াসী হইয়াছ? ওগো দুর্ব্বলের বল, অসহায়ের সহায় কে আছ হেথা—যথার্থ মানব কে আছ এখানে, এই দুর্ব্বল অসহায়কে রক্ষা কর—আমার এই ক্ষুদ্র জীবন যাহা তোমাদের কাছে কিছুই নহে কিন্তু আমার নিকট অমূল্য, অসময়ে তাহার শেষ করিও না”। ছাগশিশুর সেই অস্ফুট ভাষা দীননাথ যেন বুঝিতে পারিল। সেই কাতর প্রার্থনা সেই আকুল হৃদয়ের বিলাপ তাহার প্রাণে গিয়া যেন আঘাত করিল। তাহার হৃদয় ফাটিয়া চক্ষে জল আসিতে লাগিল।

 পুরোহিত খড়্গ ছাগের গলায় ছুঁয়াইয়া কামারকে দিলেন। ছাগের গলা হাড়কাটে দেওয়া হইলে কর্ম্মকার সেই ভীষণ খড়্গ উত্তোলিত করিল। তাহার পর দীন আর কিছু দেখিতে পাইল না, তাহার মাথা ঘুরিয়া আসিল, চোখ মুদিয়া সে বসিয়া পড়িল। যখন চক্ষু খুলিয়া আবার দাঁড়াইল—দেখিল তখন আর পাঁঠা সেখানে নাই, বলিদানের স্থান রক্তপ্লাবিত। দেখিয়া সে বুঝিল বলিদান হইয়া গিয়াছে।

(২)

 সেই দিন হইতে দীননাথের গ্রামে থাকা ভার হইয়া উঠিল। ছেলেরা তাহাকে দেখিলেই উপহাস করিতে থাকে। একজন তাহাকে সাড়ি পরাইয়া মেয়ে সাজাইতে চাহে, আর একজন অমনি গম্ভীর ভাবে বলিয়া উঠে—“হাঁ হাঁ এমনো কথা! ইনি আমাদের সিপাই পুরুষ, ইহাঁকে গ্রামের সীমানায় দাঁড় করাইয়া দিলে আর কোন ভাবনাই থাকিবে না,”—আর একজন বলিয়া উঠেন— “হ্যাঁ বীর বই,কি—তা আবার বলিতে, সে দিন পাঁটা বলি দেখিয়া মূর্চ্ছা গিয়াছিলেন। বীরের হাতে গোটা কতক পাঁকাটীর লাঠী আনিয়া দাও।”

 এইরূপে গ্রাম-শুদ্ধ ছেলেরা দীনর প্রাণান্ত করিয়া তুলিয়াছে, উপহাসের জ্বালায় সে অস্থির। দীন বেচার অস্থির হইয়া, কিসে যে তাহাদের হাত হইতে উদ্ধার পাইবে তাহা ভাবিয়া পায় না। কিসে তাহারা তাহাকে ভাল বলিবে প্রাণপণে তাহার চেষ্টা করে। ছেলেরা পাখীর ছানা পাড়িতে গেলে দীন উমেদার হইয়া তাহার সঙ্গে যায়, আগেভাগে তাড়াতাড়ি গাছে উঠিয়া আপনার পুরুষত্ব বজায় রাখিবার চেষ্টা করে। এরূপ কাজ যদিও তাহার একেবারেই ভাল লাগে না, তথাপি সে লজ্জার খাতিরে উপহাসের ভয়ে তাহা করিতে প্রস্তুত। দীন বড় দুর্ব্বল, সে তাহার সঙ্গীদিগের উপহাস কোন মতেই সহিতে পারে না। বরঞ্চ সে পাখীর ছানা পাড়িয়া—নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করিয়া—মনে মনে কষ্ট সহিতে পারে, তথাপি বন্ধুদের হাসিবার কাজ করিয়া উপহাসের পাত্র হইতে চাহে না। ছেলেরা—দড়িতে ঢিল বাঁধিয়া তাহা ছুঁড়িয়া পাখী মারে,—দীন আগে কখনও তাহা করিত না কিন্তু সেই ঘটনার পর হইতে সে নিজেই অগ্রসর হইয়া ঢিল ছুঁড়ে। এইরূপে নানা প্রকারে আপনার বীরত্ব দেখাইয়া সঙ্গীদের মন হইতে সেই দিনকার ঘটনাটা মুছিয়া ফেলিতে চায়।

 একদিন গ্রামের দুই চারিজন বালক পাখী মারিতে যাইবে স্থির করিয়া দীননাথের বাড়ীতে আসিয়া উপস্থিত হইল। তাহাদের দেখিয়া দীন বুঝিল তাহারা তাহাকে ডাকিতে আসিয়াছে। এ পর্য্যন্ত সে কেবল গাছের ডাল পাতা লক্ষ্য করিয়া ঢিল ছুঁড়িত, কখনও জীবহত্যা করে নাই। সেই জন্য উহাদিগকে দেখিবামাত্র তাহার মুখ শুকাইয়া গেল। একজন বালক বলিল —“দীননাথ—এইবার তোমার সাহসের পরিচয়টা দেও, আজ কটা পাখী মারিবে বলদেখি”?

 দীন বলিতে যাইতেছিল—“আজ শরীরটা বড় ভাল নাই,— মা তাই কোথাও যেতে দেবেন না।”

 কিন্তু সে কথা কহিবার আগেই আর একজন উপহাস করিয়া কহিল—“দীনুসিংহ কটা পাখী মারিবে—তা আর জিজ্ঞাসা করিতে? অসংখ্য!”

 এই কথায় মহা হাস্য কোলাহল পড়িয়া গেল, দীন ইহাতে অত্যন্ত লজ্জিত এবং ব্যথিত হইয়া মনে মনে বলিল—“হা ভগবান—কেন তুমি আমাকে এমন দুর্ব্বল স্ত্রীলোকের প্রাণ দিয়া গড়িয়াছিলে? আমার কি বাস্তবিক একটুও পুরুষত্ব নাই? প্রতি পদে পদে আমি সকলের নিকট উপহাসাস্পদ হইব?

 দীন নিজের দুর্ব্বলতা জয় করিতে দৃঢ় সংকল্প করিল। হায়! পুরুষত্ব ও নিষ্ঠুরতার মধ্যে যে অনেক প্রভেদ তাহা সে বুঝিল না। দীন উত্তেজিতস্বরে বলিল—“কবে ছেলেবেলায় কি করিয়াছি—তার জন্য কি চিরকালই আমাকে ঠাট্টা করিবে? তোমাদের সকলের আগেই আজ আমি পাখী মারিব”

 বালকেরা দীনর কথা শুনিয়া সন্তুষ্ট চিত্তে সকলে মিলিয়া পাখী মারিতে যাত্রা করিল। প্রথমেই যে পাখীটি দেখিতে পাইল— সেইটিকে দেখাইয়া একজন বালক বলিল, “পালোয়ানজি, এইবার—এইবার”—

 এই ব্যঙ্গোক্তি শুনিলেই দীনর গা জ্বলিয়া যাইত। যদিই বা সে পাখী মারিতে একটু ইতস্ততঃ করিত, কিন্তু এই মর্ম্মান্তিক উপহাস বাক্যে আর কথাটি না কহিয়া উত্তেজিত মনে পাখীটিকে লক্ষ করিয়া ঢিল ছুঁড়িল। বৃন্তচ্যুত কুসুমের ন্যায় পাখীটী ভূমিতে পড়িয়া ছট ফট করিতে লাগিল, তাহার আহত স্থান হইতে দুই এক বিন্দু শোণিতও মাটিতে পড়িল।

 প্রাণীহত্যা-কার্য্যে দীনর এই প্রথম হাতে খড়ি, ইহার পূর্ব্বে সে নিজে রক্তপাত করিয়া তাহা কখনও দেখে নাই। দীনর প্রাণের ভিতর হইতে অশ্রুজল উথলিয়া উঠিতে লাগিল। কিন্তু পাছে অন্যান্য বালকেরা তাহা বুঝিতে পারে, এই ভয়ে প্রাণপণে তাহা সম্বরণ করিয়া লইল। বালকেরা পাখীটি হস্তগত হইয়াছে দেখিয়া আহ্লাদে চীৎকার করিয়া উঠিল, এবং দীনকে প্রশংসা করিতে করিতে অন্য পাখীর চেষ্টায় ঘুরিতে লাগিল।

 ইহার পর চারি পাঁচ বৎসর চলিয়া গিয়াছে। এখন বনগ্রামের এমন পরিবর্ত্তন ঘটিয়াছে যে এখন আর উহাকে সেই গ্রাম বলিয়াই চেনা যায় না। পূর্ব্বেকার ভদ্রপল্লী ও গ্রাম্য কুটীরের স্থলে এখন নুতন বড়মানুষদিগের এবং নীলকর সাহেবের বড় বড় বাড়ী ধপধপ করিতেছে। তখনকার অনেক লোক এখন গ্রাম ত্যাগ করিয়া গিয়াছে, বালকমণ্ডলী এখন যুবা হইয়া উঠিয়াছে। কত নূতন লোকের আবির্ভাব, কত পুরাতন লোকের তিরোভাব হইয়াছে।

আজ আবার সেই সপ্তমী পূজা। কিন্তু চাটুয্যেদের বাড়ী এখন আর পূজা হয় না, মকদ্দমায় তাহারা সর্ব্বস্বান্ত হইয়া গিয়াছে। নীলকরের দাওয়ান নবীন ঘোষের বাড়ী আজ পূজার বড় ধূম। কিন্তু সে পূজায় আবাল বৃদ্ধ বনিতা যত সুখী হইত,এ পূজায় যেন তাহাদের তত সুখ হয় না। উঠানে বালক ও যুবকেরা দাঁড়াইয়া আছে, এখনই বলিদান হইবে; এই সকল আয়োজন দেখিয়া যুবকদিগের মনে সেই ছেলেবেলার কথা জাগিয়া উঠিতেছে। চাটুয্যে মহাশয় কেমন ভাল লোক ছিলেন, তাঁহার জ্যেষ্ঠ পুত্র কেমন সকলের সহিত প্রিয়-সম্ভাষণ পূর্ব্বক কথাবার্তা কহিতেন। অমন বনিয়েদি ঘর—একেবারে উৎসন্ন গেল! আর এই নবীন ঘোষ দুদিন আগে লাঙ্গল ধরিতে ধরিতে যাহার প্রাণ গিয়াছে—তিনি আজ বাবু হইয়া কাহারও প্রতি চাহিয়া একটি কথা কহেন না!

 পূর্ব্ববৎ অনুষ্ঠান শেষ হইলে ছাগ শিশু হাড়িকাঠে বদ্ধ হইল, কামার খড়্গ উঠাইতে উদ্যত হইয়াছে, এমন সময় একটা কোলাহল পড়িয়া গেল। পুরোহিত বলিলেন, “নব কামার, তুমি থাম—থাম”।

 হারুর মা ছুটিয়া আসিয়া বলিল, “ঠাকুরমহাশয়, নব কামার, যেন এবার পাঁটা বলি না দেয়, কর্ত্তামা রাগ করিতেছেন। আর বারে সে এক কোপে কাটতে পারে নাই—সেই অমঙ্গলে আমাদের দাদাবাবুর খোকাটি মারা গেল—এবার যেন নব খাঁড়া হাতে না করে।” অবিলম্বে রামার মা শ্যামার মা দৌড়িয়া আসিয়া ঐ একই কথা বলিতে লাগিল। স্বয়ং বাড়ীর কর্ত্তা নবীন ঘোষ দৌড়িয়া আসিয়া বলিলেন—“ঠাকুরমহাশয় নব কামারকে খাঁড়া ছুঁইতে দিবেন না—তাহা হইলে মা এবার রক্ষা রাখিবেন না”।

 উঠানে একটা গোলমাল বাধিয়া গেল,সকলে বলিয়া উঠিল— “কে তবে বলিদান করিবে? আর একজন কামার ডাকিয়া আন”।

 এই সময় ভিড়ের মধ্য হইতে একজন ছুটিয়া আসিয়া নব কামারের হাত হইতে খড়্গ কাড়িয়া লইয়া বলিল—“ভায়া, খাঁড়া ধরা কি তোমার কাজ, দাও আমাকে দাও”—

 পুরোহিত বলিলেন—“এস বাপু দীন কামার, তোমার বড় ডাক নাম—মা প্রসন্ন হউন”—

 যে দীননাথ একদিন পাঁটা বলি দেখিয়া মাথা ঘুরিয়া পড়িয়া গিয়াছিল—আজ সে হাসিতে হাসিতে সঙ্গীদের উল্লাসধ্বনির মধ্যে স্বহস্তে বলিদান করিল। খড়্গ উঠাইয়া ছাগের কণ্ঠচ্ছেদ করিবার সময় আজ তাহার হাত একবার কাঁপিল না—হৃদয় একটুও ব্যথিত হইল না। সে যখন বলিদান করিয়া ফিরিয়া আসিল তখনও তাহার মুখে হাসির রেখা বিলীন হয় নাই।

 এত পরিবর্ত্তন তাহার কিসে? কেবল সঙ্গদোষে!