অভাগিনী।

 মাঘের শেষে প্রভাতের ঘন কুয়াসায় কাহার একটি ছোট মেয়ে আমার বাগানে গাঁদাফুল তুলিতে আসিয়াছিল। সেদিন আফিমের মাত্রাট একটু বেশী হইয়া যাওয়ায় রাত্রিতে মোটেই ব্যু হয় নাই, তাই হঁকাটা হাতে করিয়া টুলখানা লইয়া বারানায় বসিয়া ছিলাম। আমার বোধ হয় একটু তন্দ্রা আসিাছিল, কারণ তাহা না হইলে আমি সাজি হাতে ছোট মেয়েটকে দেখিয়া হরের মা গোয়ালিনীকে মনে করিব কেন, আর ফুল কুড়াইতে দেখিয়া সে আমার বুধি গরুর গোবর চুরী করিতেছে তাহাই বা ভাবিব কেন? বস্তুতঃ আমার টুলের উপর বসিয়া একটু তন্দ্রা আসিয়াছিল, হঠাৎ কলিকাটি না পড়িয়া গেলে মেয়েটীকে দেখিতে পাইতাম না। হরের মা নিত্য আমার বাড়ী হইতে গোবর চুরী করিয়া লইয়া যায়, আমি তাহাকে ধরিতে পারিন, তাই দৃঢ়প্রতিজ্ঞা করিয়ছিলাম যে, আজ তাহাকে ধরিবই ধরিব। তাহাকে দেখিয়াই খালি পায়ে হুঙ্কার করিতে করিতে আমি একেবারে বেলতলায় গিয়া উপস্থিত। সে আমাকে দেখি ভয়ে জড় সড় হইয়া এক পাশে সরিয়া দাঁড়াইল। সে পলাইল না দেখিয়া আমি আশ্চর্ঘ্য হইয়া গেলাম, তখন বুঝিলাম সে হরের মা নহে, কারণ সে আমাকে দেখিলেই দ্রুতচম্পট দিয়া থাকে-অবশ্য গোবরের বুড়িসমেত। মেয়েটি অনিদ্যসুন্দরী, একখানি ময়লা কাপড় পরিয়া মুখখানি হেঁট করিয়া সাজি হাতে গাঁদা গাছের পাশে দাঁড়াইয়াছিল। আমি জিজ্ঞাসা করিলাম সে কে এবং তাহার নাম কি। উত্তরে জানিলাম সে গ্রাম্য পোষ্টমাষ্টারের কন্যা এবং তাহার নাম কমলা, মাতার পূজার জন্য ফুল তুলিতে আসিয়াছে। তখন আমার মনে বড় লজ্জা হইল। আমি তাকে অভয় দিয়া বারানায় ফিরিয়া আসিলাম। এক ছিলিম তামাক সাজিয়া যেমন টুলে বসিয়াছি অমনি হাত হইতে হুঁকাটা পড়িয়া গেল, চক্ষু মেলিয়া দেখি বেলা আটটা বাজিয়া গিয়াছে, হরের মা বক্ত পূর্ব্বে বেলতলা হইতে গোবরটুকু সংগ্রহ করিয়া লইয়াছে। তাহার উপর রাগ বাড়িয়া গেল, কারণ তাহাকে ধরিতে ত পারিলামই না; আবার পাঁচ সিকা দামের হুঁকাটা পড়িয়া ভাঙ্গিয়া গেল।

 হরিসাধন বন্দ্যোপাধ্যায় আমাদের গ্রামের পোষ্টমাষ্টার, অতি সদাশয় ভদ্রলোক। তিনি এক বৎসর যাবৎ পরিবার লইয়া আমাদিগের গ্রামে বাস করিতেছেন। তাঁহার পরিবারের মধ্যে স্ত্রী, বিধবা ভগ্নী, কন্যা কমলা এবং শিশুপুত্র। তাঁহার গুণে গ্রামবাসিগণ মুগ্ধ এবং সকলেই কোন না কোন বিষয়ে তাঁহার নিকট ঋণী। বন্দোপাধ্যায় মহাশয় পরম নিষ্ঠাবান হিন্দু, প্রত্যহ পূজা না করিয়া জলগ্রহণ করেন না, শ্রাদ্ধশান্তি নিয়মিত করা আছে, যথাসাধ্য ব্রাহ্মণভোজন করাইয়া থাকেন। মোটের উপর লোকটা মন্দ নহে কিন্তু একটি দোষে লোকটা একেবারে মাটি হইয়া গিয়াছে; বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাটিতে এক ছিলিম তামাক অবধি পাইবার যে নাই।

 দেশে আর খাঁটি দুধ মিলিবার উপায় নাই, গয়লা বেটারা সব কলিকাতার চালান দিতে আরম্ভ করিয়াছে। বাঁড়ুয্যে সেদিন খুব ঘটা ক’রে মেয়েটার বিয়ে দিলে, তা বাজারে একটু ভাল ক্ষীর আর খুঁজে পেলে না। পাইবার যে কি? গয়লা বেটাদের জ্বালায় বালিএরারুট এমন কি পুকুরের জলের দরও চড়িয়া গিয়াছে। বন্দোপাধ্যায় অনেক করিয়া বলিয়া গিয়াছিল, সেই জন্য এবং মিষ্টিটা ক্ষীরটা কি রকম উতরাইল তাহা পরখ করিয়া দেখিবার জন্য একবার গিয়াছিলাম মাত্র। তা গয়লা বেটাদের জ্বালায় দই ক্ষীর ছানা কিছু কি আর মুখে করিবার যো আছে? বাঁড়ুয্যে মেয়েটার বিয়ে দিলে বটে, কিন্তু লোকে বলিল মেয়েটাকে সমুদ্রে দিল। কায়স্থপাড়ার গিরিশ বসু দুর্জ্জয় মাতাল, সে বিবাহের রাত্রে বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলিয়া বসিল, “দাদাঠাকুর মেয়েটাকে জলেত ফেল্লেই, তার আর কোন কথা নাই, কিন্তু এ যে বাধা অতলস্পর্শ, একটা শব্দও হ’ল না।” গ্রামের লোকে হাসিয়া উঠিল, বাঁড়ুয্যে বেচারা কি করে, তাহাদিগের সঙ্গে কাষ্ঠহাসি হাসিয়া উঠিল। বরের একটু বয়স বেশী বটে, তবে এমন কিছু বেশী নয়; আমাদের বয়সে অনেক বেশী বুড়ার বিবাহ দেখিয়াছি। তা আমার ত আর কোন কথা বলিবার যো নাই। বরের বয়স আন্দাজ পঞ্চাশ পঞ্চান্ন, দু‘এক গাছা চুল পাকিরাছে মাত্র, গালে ঈষৎ টোল খাইয়াছে; তাহা আবার সব সময়ে বুঝা যায় না, সুতরাং দুএকটা দাঁতও পড়িয়াছে। ছোড়াগুলা বলিল, “বরের বয়স ৭০।৭২”। রং এমন কি কালো, আমার বয়সে আমি ঢের বেশী কালো দেখিয়াছি, কিন্তু তাহা কি আমার বলিবার যো আছে, তাহা হইলে ছোঁড়ার দল অমনি ক্ষেপিয়া উঠিবে আর গ্রামময় রাষ্ট্র করিয়া দিবে যে, হারুখুড়ার আফিমের নেশা ছাড়িয়া বিবাহের নেশা ধরিয়াছে; আমার যে আর ছাড়িবার উপায় নাই, তা কি ছোঁড়া বুড়া কোন বেটা বুঝে? আর আমি এমনই পাগল হইয়াছি যে, দক্ষিণ দিকে পা করিয়া বিবাহের জন্য পাগল হইব? বন্দ্যোপাধ্যায়ের মেয়ের বিবাহের কথা বলিতে গিয়া কত আপদ বালাই আসিয়া জুটল। বন্দোপাধ্যায় জামাতা যখন সিড়ির উপরে এবং উঠানে তাহার সাড়ে তিন মণ বপুখানি চড়াইয়া মন্ত্র বলিবার নাম করিয়া হাঁপাইতেছিল, তখন মেয়েটি চুপ করিয়া বসিয়াছিল, আর মাঝে মাঝে কাঁপিয়া উঠিতেছিল, সে কম্পনের অনেক লোকে অনেক ব্যাখ্যা করিল, নবীন দল বলিল, “মেয়েটি ভবিষ্যৎ ভাবিয়া শিহরিয়া উঠিয়াছে,” প্রবীণের দল বলিল, “মহিষের ভয়ে কাঁপিতেছে,” মাঝ থেকে গিরিশ বসু বলিয়া উঠিল, “বাবাজী আমার মনে কচ্ছেন যে, কনে আনন্দে শিউরে উঠছে।” বর-বেচারা আর কি করে একবার আকর্ণবিশ্রান্ত দশনপঙ্‌ক্তি বিকাশ করিয়া হাসিল। মন্ত্রদানের পর বর উঠিয়া গেল, তখন জামাতার রূপ দেখিয়া বন্দোপাধ্যায় গৃহিণী কাঁদিয়া লুটাইয়া পড়িল, তাঁহার দেখাদেখি অন্দরে আর যে যেখানে ছিল এক একবার সুর ধরিল; আমার মৌতাতটা নষ্ট হয় দেখিয়া একটা হুঁকা লইয়া বাহিরে আসিয়া বসিলাম। তখন বেগতিক দেখিয়া বাদ্যকরেরা ঢোল সানাই লইয়া সরিবার উপক্রম করিতেছিল।

 যাক্‌, বিবাহটা তো চুকিয়া গেল। বরভায়া ক্ষীণ তনুখানি বহুকষ্টে পাল্কীজাত করিয়া ফুলশয্যার স্বপ্ন দেখিতেছিলেন। ষোল জন বেহারা প্রাণপণ শক্তিতে বহিয়া অগ্রসর হইতে পারিতেছিল না; তখন আমি ছেঁচা পানটুকু মুখে করিয়া বারান্দায় আসিয়া বসিয়াছি মাত্র। বাঁড়ুয্যে বাড়ী তখন মড়াকান্না উঠিয়াছে, সে আওয়াজ সানাইয়ের সহিত মিশিয়া মন্দ লাগিতেছিল না।

 এই পাঁচ বেটার জ্বালায় দেশে কি বাস করিবার যে আছে, না কোন কথা বলিবার উপায় আছে। বাঁড়ুয্যের জামাই মরিল তা ফেলিতে যাইবার লোক আর দেশে পাইল না, গ্রামের মধ্যে ছাই ফেলিতে ভাঙ্গা কুলা আছে হারুখুড়া, ডাক্ তাহাকে। আমার এখন তিন কাল গিয়া এক কালে ঠেকিয়াছে, গঙ্গা-মুখে পা বাড়াইয়াছি, আমার কি ছাই অত মনে থাকে? আমার অপরাধের মধ্যে আমি বলিয়া ফেলিয়াছিলাম যে, “আমার গৃহিণী অন্তঃসত্ত্বা।” গৃহিণী যে আজ বিশ বৎসর আমায় ছাড়িয়া গিয়াছেন তাহা কি আমার মনে ছিল? তাই পাঁচ বেটায় হাসিয়া আমায় মাটি করিয়া দিল, গৃহিণীর দারুণ শোক যে বজ্রের মত আমার বুকে বাজিল, তাহা কি কেহ বুঝিল? আমি রাগে লজ্জায় ঘৃণার কাঁপিতে কাঁপিতে বাড়ীর ভিতর উঠিয়া গেলাম। বাঁড়ুয্যের জামাই বেটার কি আক্কেল, সে বেটা এত দেশ থাকিতে শ্বশুরবাড়ী ভিন্ন মরিবার জায়গা পাইল না। আমার আবার বলিতে কি জান, একটু বয়সটা অধিক হয়েছে কিনা? উপদেবতার নাম করিলে গা-টা যেন কেমন করিয়া উঠে। আমি আর সেদিন ঘরের বাহির হইতে পারি নাই। সন্ধ্যা অবধি রামনাম লিখিয়াছি, পুরাতন রামকবচের মাদুলিটি নতুন সুতায় বাঁধিয়া হাতে পরিয়াছি, অবশেষে অন্ধকার হইয়া আসিলে, যখন গ্রামের ষণ্ডাগুলা বাঁশের মাচায় করিয়া হরিবোল দিতে দিতে জামাইটাকে খাটে লইয়া গেল, তখন হাঁফ ছাড়িয়া বাহিরের ঘরে আসিয়া বসিলাম। জামাইটা অনেক দিন ধরিয়া বহুমূত্রের পীড়ায় ভূগিতেছিল, নানা স্থানে চিকিৎসা করিয়াও যখন, সারিল না, তখন শ্বশুর বাড়ী উপস্থিত হইল, বলিল, “গ্রামের ধরণী কবিরাজের চিকিৎসা করাইতে আসিয়াছি।” ধরণী কবিরাজের চিকিৎসা হইতে না হইতে জামাইটা ত মরিল, মরিয়াও আমায় একটা অখ্যাতি দিয়া গেল। সেইদিন রাত্রিতে গ্রামের লোক যখন দাহ করিয়া ফিরিল, তখন পাড়ার সকলে কমলাকে নদীতে লইয়া গেল, তাহার ক্ষীণ রোদনধ্বনি এখনও আমার কানে লাগিয়া আছে।

8

 মেয়েটা বিধবা হইলে বন্দ্যোপাধ্যায় বড় আঘাত পাইল, বৎসর ফিরিতে না ফিরিতে সেও জামাতার অনুসরণ করিল; তখন শিশুপুত্র ও বিধবা কন্যা লইয়া বন্দ্যোপাধ্যায়-গৃহিণী দেশে ফিরিয়া গেল। আমাদের গ্রামে ক্রমে লোকে বাড়ুয্যের নাম ভুলিয়া গেল। আমার দিন আর কাটে না, বিষম বিপদ্‌ উপস্থিত, শুনিলাম সরকার হইতে নাকি আফিমের চাষ তুলিয়া দিবে। গিরিশ বসুর ছেলেটা কলিকাতায় ইংরাজী পড়িয়া একেবারে মাটি হইয়া গিয়াছে, সে বেটা এল, এ-না—বি, এ কি ছাই পাস করিয়া আসিয়া গ্রামখানাকে যেন কিনিয়া ফেলিয়াছে। গ্রামে আর তিষ্ঠাবার যো নাই, দিন রাতই সভাসমিতি, হট্টগোল, গোলযোগ। ষষ্ঠতলায় একখানা নূতন চালা বাঁধিয়াছে; প্রতিদিন সন্ধ্যার সময় গ্রামের যত ব্যাটা একত্র হইয়া নরক গুলজার করে। সেদিন সন্ধ্যার সময়ে গাঙ্গুলিপাড়া হইতে ফিরিতেছি, এমন সময় পাষণ্ডগুলা আমাকে ধরিয়া বসিল। আমার প্রাণ যায় আর কি? এক বেটা বলিল, “ঠাকুরদা কি ঠান্‌দি খুঁজতে বেরিয়েছ?” আর এক দল বলিল, “ঠাকুরদা, এবার কালাচাঁদ ছেড়ে গাঁজা ধর, তোমার কালাচাঁদের এবার গঙ্গাযাত্রা—শুনেছ ত?” আমার চোক ফাটিয়া জল আসিল, মনে মনে ভাবিলাম গঙ্গাধাত্রার পূর্ব্বে যেন বিশ্বনাথ আমায় দয়া করেন। এমন সময়ে গিরিশ বসুর কুষ্মাণ্ডটা ঘর হইতে বাহির হইয়া আসিল, তাহাকে দেখিয়া পাষণ্ডের দল সরিয়া দাঁড়াইল। সে যত্নের সহিত আমাকে ঘরের ভিতর লইয়া গিয়া বসাইল, এক ছিলিম তামাক খাওয়াইল, আমার মনটা একটু নরম হইয়া আসিল। ও মহাশয়! বেটা বলে কি? বলে আফিম খাওয়া ছাড়, আফিমে লোকের সর্ব্বনাশ হয়, আফিম খাইয়া চীনের মরিয়া আছে। তখন আমি রাগে থর থর করিয়া কাঁপিতেছি, হাত হইতে হুঁকাটা পড়িয়া গিয়াছে, বেটার কিন্তু তখনও ন্যাকামি, ফ্যাল ফ্যাল করিয়া তখনও আমার মুখের দিকে চাহিয়া আছে। ক্রোধে কাঁদিতে কাঁদিতে আমি বলিয়া ফেলিলাম “তুই জানিস্‌ যে, আমার অস্থিতে অস্থিতে, মজ্জায় মজ্জায় আফিম প্রবেশ করিয়াছে!” আমি আর দাঁড়াইতে পারিলাম না, হন হন করিয়া একটানে বাড়ী ফিরিয়া আসিলাম।

 গিরিশ বসু নির্ব্বংশ হইল না, কিন্তু সত্য সত্যহ আফিমের দর চড়িতে লাগিল। ঘোর কলি, সবাই বুঝিল কোম্পানী বাহাদুরের মতিচ্ছন্ন ধরিয়াছে, নতুবা দেশে এত জিনিষ থাকিতে আফিমের চাষ তুলিবার বুদ্ধি যোগাইবে কেন? জীবন রায়ের খুড়া বহুকাল অবধি কাশীবাস করিতেছে, বিশ বৎসরের পরে বুড়া দেশে আসিয়া আমার কর্ণে মন্ত্র দিয়া গেল; বলিয়া গেল যে, কাশীবাস ভিন্ন আমার আর গতি নাই। জীবন রায়ের খুড়া কাশী চলিয়া গেল; গেলত গেল,—আমার মনটা কিন্তু হরণ করিয়া লইয়া গেল। সাত পাঁচ ভাবিয়া কাশীযাত্রা করাই স্থির করিলাম। দেশের বিষয়ের অংশটি জ্ঞাতিরা ভোগ করিবে, তাহা আমার অসহ্য বোধ হইল। বিষয়-আশয়, তৈজসপত্র অবশেষে ভদ্রাসনখানি বিক্রয় করিয়া কাশীযাত্রা করিলাম। এখন আর বলিতে দোষ কি? সত্তর বৎসর পরে জন্মভূমির মায়া কাটাইলাম; দেশ ছাড়িতে বড় বিশেষ কষ্ট হয় নাই, কারণ জীবন রায়ের খুড়া বলিয়া গিয়াছিল যে, কাশীতে আফিম বড় সস্তা।

 বিশ্বেশ্বরের রাজধানী বড় সুন্দর স্থান। যাহারা বুড়া বয়সে কাশীবাস করিতে আসে তাহারা বড় সুখেই থাকে। এখানে আসিয়া বড় আনন্দেই দিন কাটিতেছে। দুধ, ঘি, মালাই, রাবড়ী, এমন কি আফিম পর্য্যন্ত জলের দর। বাঙ্গালীটোলায় এক গৃহস্থের বাটীতে একখানি ঘর ভাড়া লইয়াছি; বাড়ীওয়ালারা চারি সহোদর, চারিজনেই বিবাহিত, তাহাদিগের সংসারে গৃহিণী নাই। অপর পরিবারের মধ্যে এক বিমাতা, তাহার বয়স বড়বধুর সমান। বুড়া বলিয়া তাহারা আমাকে পরিবারের মধ্যে স্থান দিয়াছিল, তাহাদিগের মধ্যে বড় এবং মেজ-বৌ একটু বয়ঃস্থা, মুতরাং মুখ ফুটিয়াছে, সেজ এবং ছোট তখনও বালিকা। সংসারে বড় এবং মেজ-বৌ কর্ত্রী, বিধবা শাশুড়ী পাচিকা, এমন কি দাসী বলিলেও চলে। ব্রাহ্মণকন্যা একা সংসারের সমস্ত কাজ করিত। নীরবে বউ দুইটির শাসন সহ্য করিত এবং দিনান্তে এক মুষ্টি অন্ন পাইয়াই সন্তুষ্ট পাকিত। আমাকে দেখিয়া দিনকতক সে সন্ত্রম করিয়াছিল, ক্রমে মাথার কাপড় সরিয়া গেল, মুখ ফুটিল, স্বর সপ্তমে উঠিল, ক্রমে অসহ্য হইয়া উঠিল। মধ্যাহ্নের আহার শেষ করিয়া হুঁকাটি হাতে লইয়া বারান্দায় বসিয়া আছি, হঠাৎ নীচে হইতে একটু জোর গলার আওয়াজ পাওয়া গেল। শুনিলাম বড়-বৌ বলিতেছে, “মরণ আর কি, ব’ল্‌তে একটু লজ্জা হয় না, তোমার জন্য আতপ চালের কাঁড়ি কত যোগাবো? অতি বিনীতভাবে শাশুড়ী উত্তর করিল, “আতপ চাল কালই ফুরিয়েছে, তাত তখনই তোমাকে বলেছি বউমা। বড় ছেলের সম্মুখে কোন কথা বলিতে আমার বড় লজ্জা করে, তাই তোমাদের বিরক্ত করি।”

 “লজ্জাবতী লতা আর কি? যখন নিজের জন্য কাঁড়ি কাঁড়ি আনাজ কুটে নিয়ে যঞ্জি কর্‌তে বসেন, তখন লজ্জা থাকে কোথায়? আমায় বল্লেই কি ফুরিয়ে গেল? আমার এত কি গরজ যে, তোমার চালের কথাটি মুখস্থ করে রাখ্‌ব?”

 শাশুড়ী অতি কাতরভাবে বলিল, “আমি ত সকাল বেলাই তোমায় একবার মনে করে দিয়েছিলুম, তা তুমি বল্লে, “হাঁ তা হবে এখন।“আমি তোমাদের খাওয়া দাওয়া হ’লে নিজের ঝালের ঝোল চড়িয়ে দিয়ে চাল আনতে গিয়েছিলুম; তা জালায় হাত দিয়ে দেখি যে, একটি কুটাও নাই।”

 মেজ-বৌ আঁচল পাতিয়া নীচের বারান্দায় শুইয়াছিল, শাশুড়ীর কথা শেষ হইবা মাত্র মুখ ফিরাইয়া বলিয়া উঠিল, “দেখ বাছা, খেটে খুটে তোমার জন্য একটু আরাম করবার যে নাই; একদিন আতপ চাল ফুরিয়েছে, সিদ্ধ চাল খেলেই পার! এত বেলায় কে আর তোমার জন্য চাল্‌ আন্‌তে যাচ্ছে বল? তোমার অত পটপটানি কেন? যা রয় সর তাই ভাল।” ব্রাহ্মণকন্যা আর কোন কথা না বলিয়া রান্না ঘরে প্রবেশ করিল; তাহার পরেই আগুনে জল ঢালার শব্দ উঠিল; মেজ-বৌ পাশ ফিরিয়া শুইল, বড়-বৌ চীৎকার করিয়া বাড়ী মাথায় করিতে লাগিল। আমার চমক ভাঙ্গিল, দেখিলাম কলিকাটি ঠাণ্ডা হইয়া গিয়াছে। ঘরে ঢুকিয়া চকমকি কিয়া আগুন জ্বালিলাম, তামাকটি টানিতে টানিতে বাহিরে দাঁড়াইয়া তাঁহাকে উপরে ডাকিলাম। মনে মনে ভাবিলাম, আমিও ত এই বাড়ীতেই থাকি, ব্রাহ্মণকন্যা যদি উপবাসী থাকে আমার অকল্যাণ হইবে। তিনি উপরে আসিলে তাঁহাকে আহার করিতে অনুরোধ করিলাম, তিনি ফুকারিয়া কাঁদিয়া উঠিলেন, বলিলেন, “হারু দাদা, তুমি কি আমায় চিন্‌তে পারছ না? আমি যে হরি বাড়ুয্যের মেয়ে কমলা।” সেই অনশনক্লিষ্ট, রূপলাবণ্যহীনা বিধবামূর্ত্তির দিকে চাহিয়া মনে করিলাম আমিও একবার কাঁদি; কিন্তু হৃদয় শুষ্ক, নীরস মরুভূমির মত, চক্ষু তীব্র কঠোর, তাহাতে অশ্রুবিন্দুর স্থান নাই।

 বিশ্বনাথ কাশীতে সব করিয়াছেন, কেবল কৈলাসের খানিকটা আনিতে ভুলিয়া গিয়াছিলেন। কাশীধামে বড়ই গ্রীষ্ম, যেমন বিপরীত মশা, তেমনই মাছির উপদ্রব। কালাচাঁদের মহিমায় ঘুমত কখনই হয় ন, তাহার উপর ঠিক ঘুমের সময়টীতে কাশীর যত লোকের অদৃষ্টি আগুন লাগিবে। শেষ রাত্রিতে একটু নিশ্চিন্ত হইয়া ঘুমাইবার উপায় নাই, সেই সময় মাগী মর্দ্দ যাত্রায় বাহির হইবে। বিরক্ত হইয়া দশাশ্বমেধ ঘাটে উঁচু চাতালটার উপর বসিয়া আছি। শত শত লোক আসিতেছে, স্নান করিতেছে, ফিরিয়া যাইতেছে। অন্যমনস্ক হইয়া তাহাই দেখিতেছি, এমন সময় ঘাটে এক মাগি আমাকে উদ্দেশ করিয়া চীৎকার করিয়া, ডাকিল “বাবু-বাবু!” -

 আমি বলিলাম, “কি?”

 “গিন্নীরা আপনাকে আজই বাড়ী ছাড়তে বলেছেন।”

 ব্যাপারখানা কি তাহা বুঝিতে বাকী রহিল না। আমি কমলার পরিচিত, একথা লক্ষ্মীরা জানিতে পারিয়াছেন, তাই আমার উপর এই আদেশ।

 মনে করিলাম, কমলাকে লইয়া কোথাও যাই, কিন্তু লোকে বলিবে— ‘তোমার এত মাথাব্যথা কেন? সত্যই ত, আমার কি? আমি পরের বোঝা মাথায় করি কেন?

 কাছের দোকান হইতে এক ভরি আফিম কিনিয়া আমি সেই দিনই বাসা ছাড়িয়া দিলাম।