গুচ্ছ/আহ্বান
আহ্বান।
(১)
ইন্দু বালবিধবা। দশ বৎসর পূর্ব্বে তাহার বিবাহ হইয়াছিল। বিবাহের কথা, স্বামীর কথা, তাহার বড় একটা মনে ছিলনা। কেবল মাত্র মনে পড়িত শুভদৃষ্টির কথা, দুইজনে তাহাকে পিঁড়িতে বসাইয়া উচ্চে উঠাইতেছে, সে পড়িয়া যাইবার ভয়ে প্রাণপণ শক্তিতে পিঁড়ি চাপিয়া ধরিয়াছে। তাহার পর কে একখানা কাপড় আনিয়া তাহার মাথার উপরে ফেলিয়া দিল, সকলে তাহাকে ভাল করিয়া চাহিয়া দেখিতে বলিল, সে দুইতিনবার চেষ্টা করিয়াও চাহিতে পারিলন। তিরস্কৃত হইয়া বহুকষ্টে সে একবার চক্ষু মেলিয়াছিল, তাহাও সত্য সত্যই নিমেষের জন্য। লজ্জা আসিয়া পল্লবে ভর করিল, আঁখি আপনা হইতে মুদিয়া আসিল, যাহারা তাহাকে ধরিয়াছিল তাহারা ক্লান্ত হইয়া পিঁড়ি নামাইয়া ফেলিল, বামা-কণ্ঠ-উত্থিত মঙ্গলধ্বনি তাহার পিতৃগৃহ মুখরিত করিয়া তুলিল। সেই নিমেষে সে যাহা দেখিয়াছিল তাঁহাই তাহার মনে পড়িত, ইন্দু বিবাহের অপর সমস্ত কথা ভুলিয়া গিয়াছিল। সে দেখিয়াছিল নীলেন্দীবরতুল্য দুটি নয়ন সাগ্রহে তাহার দিকে লক্ষ্য করিয়া রহিয়াছে, আর দেখিয়াছিল যে কন্দর্পের শরাসনতুল্য যুগ্ম ভ্রূর উপরে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চন্দনবিন্দু শুভ্রললাট রঞ্জিত করিয়াছে। ইন্দু মেয়েটি বড় শান্ত। জ্ঞানোদয়ের পূর্ব্বে সে অনেক সহ্য করিতে শিখিয়াছিল। সে জানিত যে তাহার অলঙ্কার পরিতে নাই, সজ্জিত হইতে নাই, সমবয়স্কাদিগের সহিত প্রাণ খুলিয়া রঙ্গ রহস্যে যোগ দিতে নাই, আর, কেন নাই, তাহা জিজ্ঞাসা করিতে নাই। সে লক্ষ্য করিয়া দেখিয়াছিল যে, জিজ্ঞাসা করিলে তাহার মাতা ও পিতামহী অধীরা হইয়া পড়েন, পিতা আকুল হইয়া কাঁদিয়া উঠেন, ভ্রাতারা নীরবে নতমস্তকে চলিয়া যায়। তাহার সই বনমালা তাহা অপেক্ষা দু’এক বৎসরের বড়। তাহার কন্যাটি বিবাহযোগ্য হইয়াছে। বনমালা যখন পিত্রালয়ে আসে তখন তাহার কন্যা সইমার আকার দেখিয়া কত কথা জিজ্ঞাসা করে। তাহার মাতা তাহার মুখে চাপা দিয়া লইয়া পলাইয়া যায়। ইন্দু এই সমস্ত দেখিয়া শুনিয়া বুঝিয়াছে যে, যে কাজ তাহার করিতে নাই তাহার কোন কথা জিজ্ঞাসাও করিতে নাই। সে নীরবে জীবন-ভার বহন করিয়া চলিয়া যায়।
শরতের পূর্ণিমার চন্দ্রকলা লইয়া বিধি বোধ হয় ইন্দুবালাকে গঠন করিয়াছিলেন। সে যখন কিশোরী, কোমরে কাপড় জড়াইয়া পথে পথে খেলিয়া বেড়াইত, তখন গ্রাম্য কৃষকবর্গ তাহার রূপ দেখিয়া বিস্মিত হইত, মনে করিত নীল আকাশ হইতে বিজলী নামিয় তাহাদিগের ধূলিধূসর-পথে খেলিয়া বেড়াইতেছে। কৈশোর অতিক্রম করিয়া সে যখন যৌবনে পদার্পণ করিল, তখন তাহার সৌন্দর্য্য যেন উছলিয়া পড়িতে লাগিল। বসন-ভূষণ-বিহীন, প্রসাধন-শূন্য, তরুণী বিধবা পিতৃগৃহে পুস্প স্তবকের ন্যায় শোভা পাইত; দূর হইতে দেখিলে বোধ হইত যেন যুথিকা গুচ্ছনির্ম্মিতা দেবীপ্রতিমা শুভ্রবস্ত্রাচ্ছাদিতা রহিয়াছে। মাতা লোক নিন্দার ভয়ে কন্যাকে শুভ্র বসন পরিতে দিতেন না, ইন্দু মলিন বদনেই দিন যাপন করিত। লোকে তাহাকে দেখিয়া ভস্মাচ্ছাদিত অনলশিখা জ্ঞানে মস্তক অবনত করিত।
গৌরসুন্দর মিত্র গ্রামের একজন প্রধান ধনী। তিনি অতি সামান্য অবস্থা হইতে অধ্যবসায় ও ভাগ্যবলে অতুল ঐশ্বর্য্যের অধিপতি হইয়াছিলেন। চঞ্চলা কমলা তাঁহার গৃহে আসিয়া কিছুদিনের জন্য বিশ্রাম লাভ করিয়াছিলেন। পুত্র, পুত্রবধূ, পৌত্র, পৌত্রী, আত্মীয়স্বজন, দাসদাসীতে গৌরসুন্দরের বিশাল বাসভবন সর্ব্বদা পরিপূর্ণ থাকিত। সংসারে তাঁহার কোন অভাব ছিল না, কিন্তু তথাপি বহুকাল তাঁহার মুখে কেহ হাসি দেখে নাই। দশ বৎসর পূর্ব্বে গৌরসুন্দরের হাসির উৎস শুকাইয় গিয়াছিল; একমাত্র কন্যার বৈধব্য তাঁহার বুকে শেলের ন্যায় বিদ্ধ হইয়াছিল। তাহার পর আর কেহ তাহাকে হাসিতে দেখে নাই।
(২)
“আমার চিরসঞ্চিত এস হে, আমার চিতবাঞ্ছিত এস!
ওহে চঞ্চল, হে চিরন্তন, ভুজবন্ধনে ফিরে এস।”—
যে গাহিতেছিল তাহার কণ্ঠ বড় মধুর। কীর্ত্তনের মধুর স্বর চারিদিক যেন মাতাইয়া তুলিতেছে। গীতধ্বনি পর্ব্বতের উপত্যকা হইতে উখিত হইতেছিল, তাহা শুনিয়া তৃষ্ণাকুল মৃগযুথ নদীতীরে ফিরিয়া দাঁড়াইল। বন্ধুর শিলাসস্কুল পার্ব্বত্য উপত্যকায় তেমন মধুর শব্দ কেহ কখনও শুনে নাই। যে ধ্বনি একদিন যবনের বজ্রাদপি কঠোর হৃদয় দ্রবীভূত করিয়াছিল, তাহা কঠিন পাষাণের কাঠিন্য দূর করিয়া কোমল শয্যায় পরিণত করিয়া দিল। ক্ষুদ্রা স্রোতস্বিনী-তীরে পাষাণ খণ্ডের উপরে বসিয়া আর একজন তন্ময় হইয়া সে গান শুনিতেছিল। সে ভুলিয়া গিয়াছিল যে সে প্রখর রৌদ্রে শিলাখণ্ডের উপরে বসিয়া রহিয়াছে; সে বিস্মৃতা হইয়া গিয়াছিল যে, সে একাকিনী গৃহ হইতে বহুদূরে আসিয়া পড়িয়াছে, জনশূন্য অরণ্যসস্কুল উপত্যকায় সঙ্গীত গুনিয়া সে জ্ঞানশূন্য হইয়াছে। সে দেখিতেছিল যে, বসন্তের পূর্ণিমায় যমুনা-পুলিনে তাহার শ্যামসুন্দর বংশীবাদন করিতেছে। সে গৃহে ফিরিতেছিল, কিন্তু সঙ্গীতের মোহমন্ত্র তাহাকে অহল্যার ন্যায় পাষাণে পরিণত করিয়াছে। সে দেখিতেছিল তাহার বংশীধারী শ্যামসুন্দর, সে দেখিতেছিল কেবলমাত্র দুইটি নীল নয়ন, তাহার উপরে যুগ্ম ভ্রুর ঘন কৃষ্ণ রেখা আর চন্দনচর্চ্চিত ললাট—
“আমার বক্ষে ফিরিয়া এস হে, আমার চক্ষে ফিরিয়া এস!
আমার শয়নে স্বপনে বসনে ভূষণে নিখিল ভূবনে এস।”
কে যেন গাহিতে গাহিতে দ্রুতপদে বনপথ অতিক্রম করিতেছিল। দূরে গ্রামপ্রান্তে কৃষক বালক গোধূম ক্ষেত্রে দাঁড়াইয়া কম্পিত হৃদয়ে ইষ্টদেবতার নাম স্মরণ করিতেছিল। সে ভাবিতেছিল নিশ্চয়ই তাহার উপর উপদেবতার দৃষ্টি পড়িয়াছে, এমন মধুরকষ্ঠ কখনও কি মানুষের হইয়া থাকে। সঙ্গীত একবার থামিল—আবার শ্যামল তৃণক্ষেত্র ও বনরাজি কম্পিত করিয়া সুধার উৎস উথলিয়া উঠিল—
“আমার মুখের হাসিতে এস হে, আমার চোখের সলিলে এস!
আমার আদরে, আমার ছলনে, আমার অভিমানে ফিরে এস।”
যে রমণী শিলাখণ্ডের উপরে বসিয়া মুগ্ধ হইয়া সঙ্গীতসুধা পান করিতেছিল, তাহার পরিচ্ছদ দেখিলে বঙ্গদেশবাসিনী বলিয়া বোধ হয়, বেশ দেখিলে বোধ হয় সে হিন্দুর ঘরের বিধবা। বনমধ্যে গায়ক যেদিকে চাহিয়াছিল রমণী সেইদিকে মুখ ফিরাইয়া যেন স্বপ্ন দেখিতেছিল। গায়ক বত দূরবর্ত্তী হইতেছিল, গীতধ্বনি ততই ক্ষীণ হইয়া আসিতেছিল; কিন্তু তখনও শোনা যাইতেছিল;
“আমার সকল স্মরণে এস হে, আমার সকল ভরমে এস!
আমার ধরম-করম, সোহাগ-সরম, জনম মরণে এস।”
ক্ষীণ হইতে ক্ষীণতর হইয়া সঙ্গীতধ্বনি থামিয়া গেল! হঠাৎ দিগন্ত যেন ইন্দ্রজাল মুক্ত হইল, মৃগযুথ উর্দ্ধশ্বাসে পলায়ন করিল; স্রোতস্বিনী এতক্ষণ থামিয়াছিল, আবার কুলুকুলু রবে বহিতে আরম্ভ করিল, পাষাণ আবার কঠিন হইয়া উঠিল। কে যেন দারুণ আঘাত করিয়া রমণীর সুখ -স্বপ্ন ভাঙ্গিয়া দিল। বাসন্তী পূর্ণিমা সুর্য্য কিরণে মিলাইয়া গেল, যমুনাপুলিন ধূলির ন্যায় উড়িয়া গেল, দিগন্ত যেন একটু টলিল, আবার কাঁপিয়া উঠিল, সমস্ত ঘুরিতে লাগিল। রমণী মূর্চ্ছিতা হইয়া শিলাখণ্ডের পার্শ্বে পড়িয়া গেল।
অনেকক্ষণ পরে আরও দুইটি বঙ্গদেশীয় রমণী বনমধ্য হইতে নির্গত হইয়া সেই স্থানের নিকটে আসিলেন। উভয়েই সধবা; একজন প্রৌঢ়া, দ্বিতীয় তরুণী। দ্বিতীয়া প্রৌঢ়াকে জিজ্ঞাসা করিলেন “এই খানটাই না মা?”
প্রৌঢ়া। কি জানি মা আমি কিছু ঠিক পাচ্ছি না।
দ্বিতীয়া। এই খানটাইত, ঐ যে সেই বড় পাথরখানা দেখতে পাচ্চি। উভয়ে দ্রুতপদে শিলাখণ্ডের নিকটে আসিয়া দেখিলেন যেন শেফালিকার একটি স্তূপ শুভ্র বস্ত্রে আচ্ছাদিত রহিয়াছে। কাতরকণ্ঠে প্রৌঢ় ডাকিলেন, “ইন্দু!” যুবতী। আপনাকে কতদিন বারণ করেছি যে একাদশীর দিন ইন্দুকে নিয়ে বেরুবেন না।
প্রৌঢ়া। আমি কিছু বুঝতে পাচ্ছিন, বাছা! ইন্দুর কি সকল জ্বালাযন্ত্রণা জুড়াল?
এই কথা বলিয়া প্রৌঢ় কন্যার পার্শ্বে বসিয়া পড়িলেন। যুবতী তাঁহাকে আশ্বাস দিয়া ঝরণা হইতে কাপড় ভিজাইয়া জল আনিয়া ইন্দুর চোখে মুখে দিতে লাগিলেন। একদণ্ড পরে তাহার জ্ঞান হইল, মাত। ও ভ্রাতৃবধূ বহু কষ্টে তাহাকে লইয়া গৃহে ফিরিলেন।
বৃদ্ধাবস্থায় গৌরসুন্দর মিত্র কঠিন রোগে আক্রান্ত হইয়া মরিতে বসিয়াছিলেন। বহু কষ্টে রোগ মুক্ত করিয়া চিকিসংকগণ তাঁহাকে বায়ুপরিবর্তনের জন্য বিদেশে যাইতে অনুরোধ করিয়াছিলেন। সেই জন্য গৌরসুন্দর বাবু সমস্ত পরিবার লইয়া চুনারে আসিয়াছেন। প্রতিদিন দ্বিপ্রহরে মহিলাগণ পর্ব্বতমালার চরণপ্রান্তে অরণ্য মধ্যে ভ্রমণ করিয়া বেড়াইতেন! যে দিনের কথা পূর্ব্বে বলা হইল, সেদিন তাঁহারা পর্ব্বতের উপত্যকায় বেড়াইতে আসিয়াছিলেন। গৌরসুন্দরবাবু তখন ধীরে ধীরে বল ফিরিয়া পাইতেছেন।
(৩)
কক্ষের প্রাচীরে একখানি বহু পুরাতন ফটোগ্রাফ ঝুলান থাকিত। তাহাতে যে চিত্র ছিল তাহা বহু পূর্ব্বে মিলাইয়া গিয়াছে, পরে কোন ব্যক্তি মসী দিয়া তাহার সংস্কার করিবার চেষ্টা করিয়াছে। তাহাতে এখন মুখের ছায়া, চক্ষু দুইটি এবং ভ্রুযুগ্ম ব্যতীত আর কিছুই নাই। প্রতিদিন প্রভাতে শয্যা ত্যাগ করিয়া ইন্দু চিত্রখানি খুলিয়া লয়। তাহা লইয়া অনেকক্ষণ বসিয়া থাকে। পরে আবার তাহা ঝুলাইয়া রাখে। প্রচলিত প্রথানুসারে ইন্দু চিত্রখানিকে প্রণাম করেন বা তাহার পূজা করেনা; কেবল কোলে করিয়া বসিয়া থাকে এবং সময়ে সময়ে কালি দিয়া তাহার সংস্কার করিবার চেষ্টা করে।
বিবাহের সময়ে ফটোগ্রাফখানি ইন্দুর পিতৃগৃহে আসিয়াছিল। সে বিধবা হইবার পরে তাহার মাতা ফটোগ্রাফখানি বাঁধাইয়া তাহাকে দিয়াছিলেন। সেখানি যতদিন স্পষ্ট ছিল ততদিন লজ্জায় তাহার দিকে চাহিত না। যখন সেদিকে চাহিতে আরম্ভ করিল, তখন ছবিখানি মিলাইয়া আসিতেছে, কেবল চক্ষু দুটি ও ভ্রুযুগল স্পষ্ট দেখিতে পাওয়া যাইত। তাহার পর ছবিখানি যেমন মিলাইয়া যাইতে লাগিল, ইন্দু কালি দিয়া তাহার সংস্কার করিবার চেষ্টা করিতে লাগিল। ফলে দাঁড়াইল যে, দশ বৎসর পরে, ফটোগ্রাফের পরিবর্ত্তে, মসীলিপ্ত পীতবর্ণের একখানি মলিন কাগজ দেখা যাইত। তাহার যে কি মাধুর্য্য, তাহা ইন্দুই বুঝিত; মসী দিয়া চিত্রের যে কি সংস্কার হইয়াছিল, তাহাও সেই বুঝিত। চিত্রখানি তাহার প্রিয় বলিয়া কেহ কোন কথা বলিত না। ইন্দু চিরকালই মাতার নিকটে শয়ন করিত, সেদিনও মাতার নিকট শয়ন করিয়াছিল; কিন্তু কোন মতেই ঘুমাইতে পারিতেছিল না, বিছানায় শুইয়া ছট্ফট্ করিতেছিল। তাহার মনে হইতেছিল তাহার বুকের উপর কে যেন একটা গুরুভার দ্রব্য চাপাইয়া দিতেছে।
অনেকক্ষণ পরে ইন্দু উঠিয়া বসিল; বসিয়া একটু আরাম বোধ করিল, সঙ্গে সঙ্গে তন্দ্রা আসিয়া তাহাকে অভিভূত করিল। তাহার পর সে দেখিতে পাইল যে চিত্রখানা যেন জ্বলিয়া উঠিয়াছে, সমস্ত ছবিখানা স্পষ্ট হইয়া উঠিাছে। জ্ঞান হইবার পরে তাহার বড় ইচ্ছা হইত যে, অন্ততঃ স্বপ্নেও একবার স্বামীকে দেখে; কিন্তু তাহার সে আশা কখনও পূর্ণ হয় নাই। আজ সেই পুরাতন ছবিখানাকে নূতন হইতে দেখিয়া সে বড়ই আনন্দিতা হইল। ধীরে ধীরে সমস্ত চিত্রখানি পরিস্ফুট হইয়া উঠিল! বিস্মিত হইয়া ইন্দু চাহিয়া দেখিল, চিত্রে অপূর্ব্ব দেবমূর্ত্তি দেখা যাইতেছে। বিচিত্র বসন পরিহিত শ্যামবর্ণ যুবামূর্ত্তি বৃক্ষতলে দাঁড়াইয়া বংশীবাদন করিতেছে; কিন্তু তাঁহার চক্ষুদ্বয় ও ক্রযুগল তাহার পূর্ব্বপরিচিত।
ক্রমে বাঁশীও সজীব হইয়া উঠিল। একি! বাঁশীর স্বরও যে তাহার পূর্ব্ব-পরিচিত। আর একদিন যমুনা-সৈকতে চন্দ্রকিরণে বাঁশী গলিয়া সুধাস্রোত প্রবাহিত হইয়াছিল। সেদিনও সে স্বপ্নে দেখিয়াছিল যে, কদম্বমূলে বাঁশী-হাতে শ্যামসুন্দর দাঁড়াইয়া আছেন। কিন্তু তাহার সেদিনের শ্যামসুন্দর যুগলভ্রুর নীচে দুটি চক্ষু মাত্র। আজি সে শ্যামসুন্দরের পূর্ণরূপ দেখিতে পাইয়াছে। তাহার ক্লান্তি দূর হইল, মন প্রফুল্ল হইয়া উঠিল। সে ভাবিতেছিল যে, সে তাহার মৃত পতিকেই দেখিতে পাইতেছে। একবার ভাবিল এই রূপ ত কতচিত্রে দেখিয়াছি, কতবার বংশী হস্তে যশোদা-নন্দনের চিত্র দেখিয়াছি। ইহাই কি সেই রূপ? আবার ভাবিল—সেই নয়নদ্বয়, সেই আকর্ণলম্বিত যুগ্ম-ভ্রু কোথা হইতে আসিবে? শয্যায় বসিয়া ইন্দু এক মনে চিত্র দেখিতেছিল, অকস্মাৎ তাহার দেহের ভিতর দিয়া বিদ্যুৎ প্রবাহিত হইল; বিক্ষিত হইয়া ইন্দু শুনিল, বাঁশী গান ধরিয়াছে, মানুষের মত কথা কহিতেছে“নিকুঞ্জে দখিণা বায়, করিছে হায় হায়,
লতা পাতা হেলে দুলে, ডাকিছে ফিরে ফিরে,
দুজনে দেখা হল মধু যামিনীরে।”
তাহা হইলে পিতার কথা সত্য, শ্যামসুন্দর সত্যই তাহার পতি। ইন্দুর মাথা ঘুরিয়া গেল। সে স্থির করিল যে সে একবার মাত্র দেখিবে। একবার—দুইবার নহে। সে দূর হইতে কেবল একবার দেখিয়া আসিবে। তাহার দেখিবার ইচ্ছা বড়ই প্রবল হইয়া উঠিল; সে মনে মনে ভাবিল সে ত কেবল দেখিতে চাহে, চরণ প্রান্ত স্পর্শ করিবার ভরসাও রাখে না। আর সকলে স্বামীকে লইয়া মৃন্ময় পুত্তলিকার ন্যায় খেলা করিয়া পাকে, সে কেবল দেখিতে চাহে—
“দুজনে দেখা হ'ল মধু যামিনীরে,
কোন কথা কহিল না চলিয়া গেল ধীরে—”
বাঁশী কাহার কথা কহিতেছে? একি তাহার কথা? স্বর ক্রমশঃ কাছে, আসিতেছে। ইন্দু উঠিল, বহুকষ্টে কাপড় খানা জড়াইয়া লইয়া ধীরে ধীরে ঘর হইতে বাহির হইল। বাহিরে জ্যোছনার রজত ধারায় জগৎ হাসিতেছিল, শ্যামা রজনী পরাস্ত হইয়া বৃক্ষতলে ও পর্ব্বতের সানুদেশে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিল, মৃদু মন্দ মারুত হিল্লোলে গঙ্গাবক্ষ নাচিয়া বেড়াইতেছিল, তাহার উপরে জ্যোছনালোক পড়িয়া আলোকমালার সৃষ্টি করিতেছিল। জগৎ নীরব নিস্তব্ধ; সেই বিশাল নীরবতা ভঙ্গ করিয়া দূরে কে গাহিয়া উঠিল—
“দুজনের আঁখি-বারি গোপনে গেল ঝরে,
দুজনের প্রাণের কথা প্রাণেতে গেল মরে;
আর ত হল না দেখা, জগতে দোঁহে একা,
চিরদিন ছাড়াছাড়ি যমুনা তীরে;—।”
ইন্দু সভয়ে চাহিয়া দেখিল, গঙ্গী-সৈকতে শুভ্রবালুকা-ক্ষেত্রে অস্পষ্ট মূর্ত্তি গান গাহিতে গাহিতে চলিয়াছে। গায়ক পুরুষ, পরিধানে শ্বেত বস্ত্র, কিন্তু ইন্দু তাহা দেখিতে পাইতেছিল না। সে দেখিতেছিল সিক্ত বালুক-সৈকতে মোহনমূরতি নব-জলধর শ্যাম নাচিয়া চলিয়াছে। বাঁশীর বাদ্যের তালে তালে, রাঙা চরণের তালে তালে, রুণু রুণু ঝুমু ঝুমু নুপুর বাজিতেছে। পীতবাস জোছনা-ধারায় রজত-ধবল হইয়া গিয়াছে, যমুনা-পুলিনে শ্যামসুন্দর নাচিয়া নাচিয়া চলিতেছে। চূড়ায় শিখি-পাখা হেলিতেছে, দুলিতেছে, তালে তালে ভ্রমরকৃষ্ণ অলকগুচ্ছ লম্ফ দিয়া পৃষ্ঠের উপর পতিত হইতেছে। এই তাহার শ্যামসুন্দর, এই তাহার মানসমোহন। অশ্রুর উৎস কোথায় লুক্কায়িত ছিল, জলে তাহার নয়ন দুটি ভরিয়া আসিল; তথাপি সে দেখিতে পাইল চাঁদনী যামিনীতে যমুনাপুলিনে বংশীধর নাচিয়া নাচিয়া চলিয়াছেন। নয়ন দুটি মুদিয়া আসিল, দেহ অবসন্ন হইয়া পড়িল, ধীরে ধীরে প্রাচীর আশ্রয় করিয়া ইন্দু ছাদের উপরে বসিয়া পড়িল। তখনও দূরে মৃদু মৃদু ধ্বনি হইতেছিল—
“আরত হলনা দেখা জগতে দোঁহে একা,
চিরদিন ছাড়াছাড়ি যমুনা-তীরে।”
ইন্দু মনে মনে অপূর্ব্ব শান্তি অনুভব করিতেছিল। এত তৃপ্তি তাহার জীবনে সে কখনও পায় নাই। শীতল নিশীথ সমীরণ আসিয়া তাহাকে ব্যজন করিতেছিল। সে ধীরে ধীরে মুক্ত ছাদে ঘুমাইয়া পড়িল।
(8)
ডাক্তার আসিয়া বলিল, ইন্দু হৃদ্রোগে আক্রান্ত হইয়াছে। রজনীর বিবরণ শুনিয়া মহিলারা স্থির করিলেন যে, কোন উপদেবতা আসিয়া ইন্দুকে আশ্রয় করিয়াছে। তন্দ্রার ঘোরে সেদিন অনেকেই গান শুনিয়াছিলেন; তাহার পর গ্রামের কৃষকবালকগণ আসিয়া যখন বলিয়া গেল যে দেওয়ানা জিন বনে বনে উপত্যকায় উপত্যকায় অতি মধুর স্বরে গান গাহিয়া বেড়ায়, তখন সকলেরই বিশ্বাস বদ্ধমূল হইয়া গেল।
বুঝিল না কেবল ইন্দু। রজনীর প্রত্যেক ঘটনা তাহার হৃদয়ে অঙ্কিত হইয়া গিয়াছিল। সে স্পষ্ট বুঝিয়াছিল, সে যাহা দেখিয়াছে তাহা প্রত্যক্ষ,—স্বপ্ন নহে। সে যাহা দেখিয়াছিল, তাহা কাহাকে কাহাকেও বুঝাইবার চেষ্টা করিয়াছিল, কিন্তু তাহারা তাহার কথা হাসিয়া উড়াইয়া দিয়াছে। ইন্দু সেই অবধি গম্ভীর হইয়া গিয়াছে।
তাহার একমাত্র দুঃখ এই যে, বেড়াইবার সময় কেহ তাহাকে সঙ্গে করিয়া লইয়া যায় না। সে মনে মনে ভাবিয়া থাকে যে বেড়াইতে গেলে হয় ত তাঁহার সাক্ষাৎ পাইবে। যেখানে বনপথে মৃগশিশু স্তম্ভিত হইয়া কোকিল-কুজন শ্রবণ করে, বিশাল নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করিয়া ক্ষীণকায়া স্রোতস্বিনী একটানা গান গাহিয়া যায়, মানবের পাদস্পর্শ্বে যেখানে শ্যামল শম্প শয্যা শুকাইয়া যায় নাই, সেইখানে হয়ত নুপুর-নিক্কণ শ্রুত হইয়া থাকে, রাঙা চরণ দুখানি হরিৎ তৃণ-ক্ষেত্রের উপর দিয়া নাচিয়া চলিয়া যায়, অথচ দূর্ব্বাদলের একটিও দল ছিঁড়িয়া পড়ে না। সেইখানে যাইবার জন্য ইন্দুর প্রাণ আকুল হইয়া উঠে; কিন্তু হায়, তাহার কথায় কেহই কর্ণপাত করেনা। সকলে যখন বেড়াইতে যায়, ইন্দু তখন গৃহের নিকটবর্ত্তী একটি ভগ্ন মন্দিরের সম্মুখে গিয়া বসিয়া থাকে।
মন্দিরটি বহু পুরাতন, কত পুরাতন কেহ বলিতে পারে না। তাঁহাতে কি বিগ্রহ ছিল, তাহাও কেহ বলিতে পারে না। অধিষ্ঠাত্রী দেবতার সহিত মন্দিরের সৌভাগ্যও অদৃশ্য হইয়াছে। বৃহৎ বৃহৎ অশ্বথ ও বট তাহার শীর্ষ-স্থান অধিকার করিয়াছে; মন্দিরের অভ্যন্তরে দেবতার পরিবর্ত্তে নিশাচরগণ বাস করিয়া থাকে। পুরাতন মন্দিরটির সম্মুখে একটি পুষ্করিণী ছিল, কালে তাহাও ভরিয়া আসিয়াছে; প্রস্তরনির্ম্মিত ঘাট বনময় হইয়া উঠিয়াছে। গ্রামবাসিগণ এখনও সেখানে পূজা দিতে আসিয়া, থাকে, অমাবস্যায়, পূর্ণিমায় জীর্ণ মন্দিরের প্রাঙ্গণটি লোকে ভরিয়া যায়। তাহারা আশ্চর্য্য হইয়া ইন্দুকে দেখে, ভাবে বনমধ্যে রজনীগন্ধার স্তবক কোথা হইতে আসিল। ইন্দু লজ্জায় দূরে সরিয়া যায়।
দ্বিপ্রহরে অশ্বখ বৃক্ষের ছায়ায় বসিয়া ইন্দু পুষ্করিণীর পঙ্কিল জলে মৃণালের অপূর্ব্ব শোভা দেখিত, আর ভাবিত সে যদি একবার এই পথ দিয়া যায়, তাহা হইলে দিবালোকে প্রাণ ভরিয়া একবার তাহাকে দেখিয়া লয়। সে ত আর কিছুই চাহে না, শুধু চোখের দেখা। গ্রামের বৃদ্ধারা বলিতেন “শ্যামমুন্দরের দর্শন দুর্লভ; কত তপস্যায়, কত আয়াসে তাঁহার দর্শন মিলে।” সে ভাবিত, সে এত কি পুণ্য করিয়াছে যে সেই দুল্লভ দর্শনের সাক্ষাৎ পাইবে। সে আবার ভাবিত, যাহারা সাধনা করিয়া, তপস্যা করিয়া শ্যামসুন্দরের দর্শন পায়, শ্যামসুন্দর ত তাহাদিগের নহে; এই জন্য তাহাদিগের অত কষ্ট করিতে হয়। কিন্তু শ্যামসুন্দর ত তাহার নিজস্ব; সেই জন্যই সে দর্শন পাইয়াছে। বিনা আয়াসে, বিনা চেষ্টায় শ্যামসুন্দর তাহার নিকটে আসিবে, ইহাই তাহার বিশ্বাস।
সেই চক্ষু দুটি, সেই ভ্রূযুগল, যে মুখখানিতে আছে, তাহা যে তাহার, নিজস্ব, তাহার জন্য সাধনার, আরাধনার আবশ্যক নাই—দুঃখ, কষ্ট, তপস্যার প্রয়োজন নাই—সে তাহার নিজের। সে তাহার সম্পূর্ণ অধিকারী, এই ভাবিয়া ইন্দু অধিকারগর্ব্বে গর্ব্বিতা হইত। তাহার ক্ষুদ্র সইটি তাহার চারিহাত দীর্ঘ স্বামিটীকে অঞ্চলে বাঁধিয়া কেমন করিয়া ঘুরিয়া বেড়ায়? তাহার নিজস্ব বলিয়াই ত! সে না হয় তাহার সইয়ের মত অত সৌভাগ্যবতী নহে; তাই বলিয়া কি তাহাকে একবার দেখিবার জন্য চেষ্টা করিতে হইবে? কখনই নহে। ইন্দু মন বাঁধিয়া বসিয়া রহিল। দিনের পর দিন যায় শ্যামসুন্দর ত আসে না।
বাণীর গান শুনিবার জন্য ইন্দু উৎকর্ণ হইয়া থাকিত। পলে পলে তাহার মনে হইত ঐ বুঝি বনরাজি কম্পিত হইয়া উঠিল, বাঁশীর ঝঙ্কারে জগৎ উন্মত্ত হইয়া উঠিল, ঐ বুঝি সে আসিল; রাঙা চরণ দুখানি দূর্ব্বাক্ষেত্রের উপর দিয়া নাচিয়া গেল। যখন সে দেখিত কিছুই না, তখন সে বড় হতাশ হইয়া পড়িত। একদিন সত্য সত্যই বাঁশী বাজিল। ইন্দু প্রথমে বিশ্বাস করে নাই। ক্রমে স্বর স্পষ্ট হইয়া উঠিল—
“আজ কোকিলে গেয়েছে কুহু মুহুর্মুহু
আজ কাননে ঐ বাঁশী বাজে;
মান করে থাকা আজ কি সাজে।”—
বাঁশী অন্যদিনের মত আজ কথায় গান ধরিয়াছে—
“আজ মধুরে মিশাবি মধু
পরাণ বঁধু!
চাঁদের আলোয় ঐ বিরাজে
মান করে থাকা আজ কি সাজে”—
ইন্দুর শিরায় শিরায় বিদ্যুৎ চুটিয়া গেল। যেদিক হইতে সঙ্গীত ধ্বনি শোনা যাইতেছিল সেইদিকে মুখ ফিরাইয়া চাহিয়া রহিল; দেখিল সত্য সত্যই কে আসিতেছে। আবার গান—
“বনে এমন ফুল ফুটেছে,
মান করে থাকা আজ কি সাজে?
মান অভিমান ভাসিয়ে দিয়ে,
চল কুঞ্জ-মাঝে।”—
বিস্ময় বিস্ফারিত নেত্রে ইন্দু চাহিয়া দেখিল, যে গাহিতেছে তাহার হাতে বাঁশী নাই, চরণে নূপুর নাই, অঙ্গে পীতবাস নাই, চুড়ায় শিখিপাখা নাই। তখন তাহার মনে বড় অভিমান হইল; যদি দেখা দিতে আসিলে, তবে ছদ্মবেশ কেন? যে গাহিতেছিল তাহার সন্ন্যাসীর বেশ, কুঞ্চিত কেশরাশি উড়িয়া বেড়াইতেছিল; পরিধানে গৈরিক বদন, চরণদ্বয় নগ্ন। সে যখন নিকটে আসিল, তখন ইন্দু অভিমান ভুলিয়া গেল, সঙ্গীতের মোহিনী শক্তি তাহাকে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিল। সে আত্ম-বিস্মৃতা হইয়া উঠিয় দাঁড়াইল। গায়ক মন্দিরের নিকটে আসিয়া ইন্দুকে দেখিল, দেখিয়া স্তম্ভিত হইয়া দাড়াইল। ইন্দু অগ্রসর হইয়া জিজ্ঞাসা করিল “তুমি আজ এবেশে কেন?” গায়ক অত্যন্ত আশ্চর্য্য হইয়া বলিল “কি বেশে? আমিত নিত্যই এই বেশে আসি।”
ইন্দু ভাবিল, একি তবে সে নহে? তবে কি তাহার ভুল হইয়াছে? সে আরও অগ্রসর হইয়া দেখিল; না—সেই বটে। সেই চক্ষু দুইটি, সেই আকর্ণবিশ্রান্ত ভ্রূযুগল, কেবল কপোলে ও ললাটে চন্দনরেখা নাই। ইন্দু যতক্ষণ তাহাকে দেখিতেছিল, ততক্ষণ গায়কও তাহার দিকে চাহিয়াছিল। ইন্দু স্থির করিল যে, তাহার শ্যামসুন্দর আজ ছদ্মবেশে আসিয়াছে; আজি কিছুতেই পরিচয় দিবে না, সুতরাং জিজ্ঞাসা বৃথা। অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া শেষে জিজ্ঞাসা করিল “আবার কবে আসিবে?” গায়ক আশ্চর্য্য হইয় তাহার মুখের দিকে চাহিয়া রহিল, তাহার পর ধীরে ধীরে বলিল, “আপনি কে? আমিত আপনাকে কখনও দেখি নাই!” ইন্দু বলিল “তবে কি আমাকে চিনিতে পারিতেছেন না?” উত্তর হইল “না”। ইন্দু হতাশ হইয়া বসিয়া পড়িল, ভাবিল শ্যামসুন্দর আজ বড়ই দুষ্ট হইয়াছে, কিছুতেই মানিবেনা। এমন সময়ে পশ্চাৎ হইতে কে ডাকিল “ইন্দু”, কিন্তু ইন্দু তাহা শুনিতে পাইল না। গায়ক তখন নূতন গান ধরিয়াছে—
“ওহে জীবনবল্লভ।
আমি অপরাধ যদি করে থাকি পদে,
না কর যদি ক্ষমা,
তবে পরাণপ্রিয়, দিওহে দিও
বেদনা নব নব।”
পশ্চাতে পদশব্দ হইল। ইন্দু তাহা শুনিতে পাইল না। তাহার ভ্রাতৃবধু ধীরে ধীরে তাহার পশ্চাতে আসিয়া দাঁড়াইলেন। ইন্দু চমকিয়া ফিরিয়া দাঁড়াইয়া তাহাকে দেখিতে পাইল। তিনি জিজ্ঞাসা করিলেন “ইন্দু ও-কে?” ইন্দু হাসিয়া বলিল “তুমি চিনিতে পার নাই? এই সেই।”
“সেই কে ইন্দু?”
“চিনিতে পারিলে না?”
“ছিঃ ইন্দু, এমন কাজ করিতে নাই।”
“কেন বউ দিদি?”
“তোমার জ্ঞান হইয়াছে। তোমার কি পর-পুরুষের সহিত আলাপ করা উচিত?” “পর-পুরুষ? একি তবে সে নহে?”
ইন্দু এই বলিয়া কাঁপিতে কাঁপিতে বসিয়া পড়িল। গায়ক তখনও গাহিতেছিল—
“তবু ফেলোনা দূরে, দিবস শেষে,
ডেকে নিও চরণে;
তুমি ছাড়া আর কে আছে আমার
মৃত্যু-আঁধার ভব।”
এই লেখায় এই অংশে একটি চিত্র থাকা উচিৎ। যদি আপনি তা দিতে পারেন, তবে, দয়া করে সাহায্য:চিত্র দেখুন। |
কিন্তু সেত তাহার ব্যথিত হৃদয়ের আকুল প্রার্থনা উপেক্ষা করিয়া থাকিতে পারে নাই, ডাকিবামাত্র দেখা দিয়াছে।
ইন্দু বলিল “তুমি কি দেখিতে পাইতেছ না? ঐ দেখ রাঙা চরণ নাচিয়া নাচিয়া বেড়াইতেছে, তুমি কি নুপুরের ধ্বনি শুনিতে পাইতেছ না? ঐ শোন, বাঁশী ডাকিয়া ডাকিয়া বাজিতেছে। আমি ভুল করি নাই। কেন ভুল করিব? এযে আমার আপনার।”
নিমীলিত নেত্রে ইন্দু দেখিতেছিল, শ্যামসুন্দর নাচিয়া নাচিয়া আসিতেছে, আবার চলিয়া যাইতেছে, কাতর কণ্ঠে তাহাকে আহ্বান করিতেছে, যেন তাহাকে ছাড়িয়া যাইতে চাহিতেছে না। বাঁশী যেন তাহাকে আহ্বান করিতেছে—
“আমার ক্ষুধিত তৃষিত তাপিত চিত নাথ হে ফিরে এস!
এস এস ফিরে এস, বঁধু হে ফিরে এস।”——
তাহার আর ধৈর্য্য রহিল না, বাঁশীর স্বর তাহাকে আকুল করিয়া তুলিল। ইন্দু চলিয়া গেল।