গুচ্ছ/প্রতীক্ষায়
প্রতীক্ষায়।
তখন ভয়ানক শীত। শীতকালে অত্যন্ত বৃষ্টি হইয়া শীতের মাত্রা চড়াইয়া দিয়াছে। এক্কাযোগে হামিরপুর হইতে নসিরাবাদ যাইতেছিলাম। পঞ্চাশ বৎসর পূর্ব্বের কথা। অনেক দিন পরে আবার এইদেশে আসিয়াছি এবং নাতিনীর নির্ব্বন্ধাতিশয় এড়াইতে না পারিয়া যৌবনের কাহিনী লিপিবদ্ধ করিতে বসিয়াছি।
রসুলপুরের চটী তখন একটা বড় বাজার ছিল। কানপুর, হামিরপুর, ললিতপুর প্রভৃতি জেলার অনেকগুলি পথ রমুলপুর গ্রামের প্রান্তে আসিয়া মিলিত হইয়াছিল। এখন রসুলপুর গণ্ডগ্রাম, কারণ রেলপথ সেখান হইতে দশ ক্রোশ দূর দিয়া চলিয়া-গিয়াছে।
রসুলপুরে দুইদিন বিশ্রাম করিয়া তৃতীয় দিনে যাত্রা করিতে প্রস্তুত হইলাম। দোকানদার অনেক নিষেধ করিল, আকাশের দুই এক স্থানে মেঘ দেখাইয়া বলিল যে, আজ পথ চলিতে আরম্ভ করিলে বিশেষ কষ্ট পাইবার সম্ভাবনা। তাহার অনুরোধ উপেক্ষা করিয়া যাত্রা করাই স্থির করিলাম। পথে দুই চারিদিন বিলম্ব হইয়া গিয়াছে, নসিরাবাদে শীঘ্র পৌঁছিতে না পারিলে বিলক্ষণ ক্ষতি হইবার সম্ভাবনা। কয়েকদিন হইতে বৃষ্টি আরম্ভ হইয়াছে, পথ ঘাট সমস্ত জলে ডুবিয়া গিয়াছে, রাস্তায় অত্যন্ত কাদা হইয়াছে। তথাপি যাত্রা করাই স্থির করিলাম। অপরাহ্লে বাক্স ও বিছানাটী এক্কায় চাপাইয়া রসুলপুর হইতে রওনা হইলাম।
আমি ভাবিয়ছিলাম যে রসুলপুর হইতে চারি পাঁচ ক্রোশ দূরে সলিমাবাদের চটীতে আশ্রয় লইব; কিন্তু দুই ক্রোশ পথ অতিক্রম করিতে না করিতে কাল মেঘে আকাশ ছাইয়া গেল, ভীষণ ঝড় আরম্ভ হইল, তাহার সহিত মূষলধারে বৃষ্টি পড়িতে লাগিল। এক্কা তখনও ধীরে ধীরে চলিতেছিল, কিন্তু অন্ধকার ক্রমে ঘন হইয়া আসিল, পথ আর দেখা যায় না। কিয়ংক্ষণ পরে আমার সারথি জিজ্ঞাসা করিল “বাবুজি, কিছুই ত দেখিতে পাইতেছি না। কি করিব?” আমি বলিলাম “এখানে দাঁড়াইয়া থাকিলে ত শীতে মরিতে হইবে; ঘোড়ার রাশ ঢিল করিয়া দাও, সে নিজেই অন্ধকারে পথ দেখিয়া চলিবে। ধীরে ধীরে চলিলে কোনও সময়ে চটীতে পৌঁছিতে পারিব।” এক্কাচালক তাহাই করিল। অশ্ব ধীরে ধীরে মন্থর গতিতে চলিতে লাগিল। মধ্যে মধ্যে বিদ্যুতালোকে দেখিতে পাইলাম চারিদিকে জল; যত দূর দৃষ্টি যায় জল ব্যতীত আর কিছুই দেখা যায় না; নদীনালা জলে ভরিয়া গিয়াছে, মানুষের আবাসের চিহ্নমাত্রও নাই। মনে বড় ভয় হইল, এক্কা-চালককে জিজ্ঞাসা করিলাম “বাপু, তুমি পথ চিনিতে পারিতেছ ত?” উত্তরে সে আমাকে বুঝাইয়া দিল যে সে পুরুষানুক্রমে এক্কা চালাইয়া আসিতেছে এবং হাজার বার এই পথে গিয়াছে, ইহা অপেক্ষা অধিক দুর্য্যোগেও কখনও পথ হারায় নাই। কি জানি কেন তাহার কথায় আমার বিশ্বাস হইল না।
প্রায় এক ঘণ্টা পরে আমার মনে হইল যে আমরা পথ হারাইয়াছি এবং বনের মধ্যে আসিয়া পড়িয়াছি। সময়ে সময়ে ঘোড়া পথ না পাইয়া দাঁড়াইতেছিল, এক্কার চাকা দুইখানি গাছের গুঁড়িতে ঠেকিয়া যাইতেছিল, কিন্তু আমার সারথি আমাকে বুঝাইয়া দিল যে, ঠিক পথেই চলিতেছে। অল্পক্ষণ পরে মনে হইল আমরা উচ্চে উঠতেছি; তাহার পরেই ঘোড়া থমকিয়া দাঁড়াইল। বিদ্যুতের আলোকে দেখিলাম সম্মুখে এক প্রকাও দীর্ঘিকা। এক্কাচালক তখন বাধ্য হইয়া এক্কা ফিরাইল, দীর্ঘিকার পার্শ্ব হইতে এক্কা আসিয়া সমতলক্ষেত্রে পড়িল। ইহার অল্পক্ষণ পরেই সম্মুখে বাধা পাইয়া ঘোড়াটি পড়িয়া গেল, সঙ্গে সঙ্গে আমি এক্কা হইতে লাফাইয়া পড়িলাম। দেখিলাম সম্মুখে একটী প্রাচীরের ভগ্নাবশেষ, ঘোড়া তাহতেই আঘাত পাইয়া পড়িয়া গিয়াছে। উভয়ে এক্কা হইতে নামিয়া ঘোড়াটিকে তুলিলাম। এই সময়ে উজ্জ্বল বিদ্যুতালোকে চতুর্দ্দিক উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল, দেখিলাম দূরে একটা ধূসরবর্ণ স্তুূপ, বোধ হইল উহা কোন বৃহৎ অট্টালিকার ধ্বংসাবশেষ। দ্বিতীয়বার বিদ্যুৎ চমকিয়া উঠিলে এক্কাচালককে জিজ্ঞাসা করিলাম যে সে কিছু চিনিতে পারিতেছে কি না। সে বলিল “না।” আমি তখন তাহাকে অট্টালিকার ধ্বংসাবশেষ দেখাইয়া দিলাম। তখন তাহার মুখ শুকাইয়া গেল; সে বলিল “বাবুজি, আপনি এক্কায় উঠিয়া বসুন, এখনই এখান হইতে চলিয়া যাই, এই স্থান বড় ভাল নহে, ইহা সয়তানের আবাস।” আমি তাহার কথা উড়াইয়া দিবার জন্য হাসিয়া উঠিলাম, কিন্তু সে কিছুতেই বুঝিল না, বরং অধিক আগ্রহের সহিত আমাকে এক্কায় উঠতে অনুরোধ করিতে লাগিল।
বৃষ্টিতে গায়ের সমস্ত কাপড় ভিজিয়া গিয়াছে, ঝড় উত্তরোত্তর বাড়িতেছে, এক একটা দম্কা বাতাস আসিয়া যেন অস্থিভেদ করিয়া মজ্জার মধ্যে প্রবেশ করিতেছে। এমন অবস্থায় উপস্থিত আশ্রয় পরিত্যাগ করিতে পারিলাম না। এক্কাওয়ালা যখন বুঝিল যে, আমি সে স্থান ত্যাগ করিব না, তখন সে স্পষ্ট বলিল যে “আপনার থাকিতে ইচ্ছা হয় থাকুন, আমি এস্থানে রাত্রিবাস করিয়া প্রাণ দিতে পারিব না।” এই বলিয়া যখন সে আমার বাক্স ও বিছানা নামাইয়া দিবার উদ্যোগ করিল তখন আমি বাধ্য হইয়া তাহাকে চাপিয়া ধরিলাম এবং বলপূর্ব্বক এক্কা হইতে নামাইয় দিলাম। তখন দেহে বল ছিল, স্বচ্ছন্দে দুইটা লোককে কাবু করিতে পারিতাম। এক্কাওয়ালা প্রথমে বলপ্রয়োগ করিয়া দেখিল,কিন্তু যখন বুঝিল যে জোর করিয়া পলাইবার উপায় নাই, তখন সে কাকুতি মিনতি করিতে ও কাঁদিতে আরম্ভ করিল। আমি তখন এক্কার লণ্ঠনটি খুলিয়া লইলাম এবং একহাতে লণ্ঠন ও অপর হাতে এক্কাওয়ালার হাত ধরিয়া প্রাচীরের দিকে অগ্রসর হইলাম। বিদ্যুতের আলোকে দেখিলাম বড় বড় পাথর দিয়া প্রাচীরটি নির্ম্মিত, তাহাতে বড় বড় গাছ জন্মিয়াছে ও স্থানে স্থানে ভাঙ্গিয়া গিয়াছে। একটা ভগ্নস্থান দিয়া প্রাচীর অতিক্রম করিলাম। ভিতরে কেবল জঙ্গল, স্থানে স্থানে বড় বড় পাথর পড়িয়া আছে, বিদ্যুতের আলোকের সাহায্যে ভগ্ন অট্টালিকা লক্ষ্য করিয়া চলিলাম। প্রায় পনের মিনিট পরে ধ্বংসাবশেষের মধ্যে উপস্থিত হইলাম। অট্টালিকাটি প্রস্তরনির্ম্মিত, সন্মুখে বড় বড় খিলানযুক্ত বারান্দা; তাহার দুই একটি খিলান পড়িয়া গিয়াছে, কিন্তু অধিকাংশই তখনও দাড়াইয়া আছে। বারালায় উঠিয়া একটু বিশ্রাম করিলাম, তাহার পর ভাবিলাম বিছানা ও বাক্স এক্কায় পড়িয়া থাকিলে ভিজিয়া যাইবে, ঘোড়াটাও পলাইয়া যাইতে পারে, সুতরাং সেগুলিকেও এই স্থানে আনিয়া রাখা উচিত। এক্কাওয়ালা এক যাইতে অসন্মত হওয়ায় অগত্যা তাহার হাত ধরিয়া বাহির হইলাম। অনেকক্ষণ ধরিয়া পথ চলিয়া এক্কার নিকটে উপস্থিত হইলাম। দেখিলাম ঘোড়াটি স্থির হইয়া দাঁড়াইয়া আছে ও মধ্যে মধ্যে করুণস্বরে ডাকিতেছে। আমার আদেশে এক্কাওয়ালা ঘোড়া খুলিল ও বাক্স এবং বিছানা মাথায় করিয়া লইল। আমি একহাতে লণ্ঠন ও একহাতে ঘোড়ার লাগাম ধরিয়া অগ্রসর হইলাম।
অন্ধকারে পথ চিনিতে না পারিয়া প্রথমে বারান্দার যে স্থানে উঠিয়াছিলাম সেস্থানে পৌঁছিতে পারিলাম না। এইবারে অট্টালিকার যে অংশে পৌঁছিলাম সেস্থানে বারান্দার অধিকাংশ খিলানগুলিই পড়িয়া গিয়াছে, কেবল দুই একটি মাত্র অবশিষ্ট আছে। বারান্দায় উঠিয়া দেখিলাম যে বৃষ্টির জল আসিয়া সেস্থানটি আশ্রয়ের অযোগ্য করিয়া তুলিয়াছে। এক্কাওয়ালা একটি থামে ঘোড়া বাধিয়া আর একটী থামের আশ্রয়ে বাক্স ও বিছানা রাখিল। বারান্দার পশ্চাতে অনেকগুলি বড় বড় ঘর আছে বলিয়া বোধ হইল, কারণ আলোক দেখিয়া অনেক বাদুড় ও চামচিকা ঘুরিয়া বেড়াইতে আরম্ভ করিল। আমি প্রস্তাব করিলাম যে ঘোড়া এইখানে রাখিয়া আমরা ঘরের ভিতর আশ্রয় লই। এক্কাওয়ালা তাহাতে ঘোরতর আপত্তি উত্থাপন করিল। সে বলিল যে, এই বাড়ীতে সয়তান ও জিন ব্যতীত আর কেহই বাস করে না; আমরা যদি এই বারান্দায় রাত্রিযাপন করিয়া সকালে প্রাণ লইয়া পলাইতে পারি তাহা হইলেই মঙ্গল, ঘরের ভিতরে প্রবেশ করিলে আর কাহাকেও ফিরিতে হইবে না। আমি তাহার আপত্তি অগ্রাহ্য করিয়া পূর্ব্বের ন্যায় একহাতে তাহাকে ধরিয়া ও অপর হাতে লণ্ঠন লইয়া প্রথম ঘরে প্রবেশ করিলাম।
সেই প্রকাও অট্টালিকায় রাত্রিবাসের উপযুক্ত স্থান খুঁজিয়া বেড়াইতে লাগিলাম, কিন্তু কোথায়ও উপযুক্ত স্থান পাইলাম না। প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড খিলানের ভিতর দিয়া শন্ শন্ করিয়া তুষার-শীতল বায়ু ছুটয়া আসিয়া হাড় কাঁপাইয়া দিতেছিল, বৃষ্টির জল আসিয়া ঘরের মেঝে ভরিয়া গিয়াছিল। কোনস্থানেই আশ্রয় পাইলাম না। চারি পাঁচটি ঘর ঘুরিয়া ক্লান্ত হইয়া পড়িলাম। এক্কাওয়ালা তখন শীতে থর থর করিয়া কাঁপিতেছিল, ভাবলাম বারান্দায় ফিরিয়া যাই। ফিরিবার চেষ্টা করিয়া দেখিলাম অন্ধকারে পথ হারাইয়াছি। অনেকক্ষণ ঘুরিয়া ঘুরিয়া আর একটি বারান্দায় আসিয়া উপস্থিত হইলাম এবং ক্লান্ত হইয়া তাহার একটা থামের আড়ালে বসিয়া পড়িলাম। একাওয়ালা আমার অবস্থা বুঝিয়া হায় হায় করিতে লাগিল। বসিয়া রসিয়া চারিদিক লক্ষ্য করিয়া দেখিতে লাগিলাম। মাঝে মাঝে বিদ্যুত হানিতেছিল। দেখিলাম যেখানে বসিয়া আছি তাহা অট্টালিকার প্রাঙ্গণের বারান্দ, প্রাঙ্গণটি চতুষ্কোণ এবং তাহার চারিদিকে দ্বিতল গৃহ। ভাবিলাম অট্টালিকাটি যখন দ্বিতল, তখন ইহার কোন না কোন অংশে সিঁড়ি আছে এবং তাহা দিয়া যদি উপরে উঠতে পারি তাহা হইলে আশ্রয় পাইলেও পাইতে পারি।
অল্পক্ষণ খুঁজিতেই সিঁড়ি বাহির হইল, দেখিলাম বারান্দার চারিকোণে চারিটি পাথরের সিড়ি আছে। সিঁড়ি দিয়া উপরে উঠিয়া দেখিলাম চারিদিকে চারিটি বারান্দা, বারান্দার পাশে প্রকাণ্ড প্রকাও ঘর, কিন্তু কোনটিতেই দরজা জানালা বা কপাট নাই। এঘর ওঘর খুঁজিতে খুঁজিতে আর এক মহলে গিয়া উপস্থিত হইলাম। দ্বিতীয় প্রাঙ্গণটি প্রথমটি অপেক্ষা বৃহৎ, তাহারও চারিদিকে বারান্দা এবং চারিপাশে প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড ঘর। এক্কাওয়ালা আর চলিতে পরিল না, সে থামের একপাশে বসিয়া পড়িল, আমিও হতাশ হইয় তাহার পার্শ্বে বসিয়া পড়িলাম। এইরূপে কতক্ষণ কাটিল মনে নাই। বৃষ্টি কমিয়া আসিতেছিল। কিন্তু ঝড় বাড়িতে ছিল। শীতের তাড়নায় থামের আশ্রয় ত্যাগ করিতে বাধ্য হইলাম। ঘুরিতে ঘুরিতে বারান্দার এককোণে আসিয়া দেখিলাম যে ত্রিতলে উঠিবার একটি ছোট পাথরের সিঁড়ি আছে, উপরে যেন একটি ক্ষীণ আলোক দেখা যাইতেছে। এক্কাওয়ালাকে আলোকের কথা বলিবামাত্র সে কাঁদিয়া উঠিল, বলিল প্রাণ যদিও বাঁচিত কিন্তু এখন আর বঁচিল না, জিনেরা যে আগুনে মানুষ পোড়াইয়া খায় তাহারই আলোক দেখা যাইতেছে। তাহার কথা গ্রাহ্য না করিয়া তাহাকে টানিয়া উপরে তুলিলাম।
অট্টালিকাটি এইস্থানে ত্রিতল, মুতরাং বারান্দাও ত্রিতল। সিঁড়ির উপরে একটি ঘরের ভিতর হইতে ক্ষীণ আলোকের রেখা আসিতেছিল। ঘরটি অট্টালিকার অন্যান্য ঘরের ন্যায় প্রকাণ্ড, ইহারও চৌকাঠ ও কপাট প্রভৃতি নষ্ট হইয়া গিয়াছে, তবে তাহার পরিবর্ত্তে পুরাতন কাঠ, মাসের বেড়া ও মাটী দিয়া খিলানগুলি বন্ধ করিয়া রাখা হইয়াছে। পুরাতন কাঠের ছিদ্রপথে যে আলোক বাহির হইতেছিল, আমরা দ্বিতল হইতে তাহাই দেখিতে পাইয়াছিলাম। এক্কাওয়ালা কিছুতেই এই স্থান হইতে নড়িতে চাহিল না। ভাবিলাম তাহাকে যদি ছাড়িয়া দিই তাহা হইলে সে পলাইয়া যাইবে এবং অন্ধকারে পথ না পাইয়া হয় ত মরিয়া যাইতে পারে। অগত্যা তাহাকে টানিয়া লইয়া দরজার অনুসন্ধান করিয়া বেড়াইতে লাগিলাম, দেখিলাম একটি খিলানে ঘাসের বেড়া কাটিয়া ঝাঁপের দরজা তৈয়ারী করা হইয়াছে, কিন্তু দরজা ভিতর হইতে বন্ধ। অনেক ডাকিলাম, কাহারও উত্তর পাইলাম না। তখন বাধ্য হইয়া ঝাঁপের বেড়া ভাঙ্গিয়া ফেলিলাম, দুই একবার পদাঘাত করিতেই ঝাঁপ পড়িয়া গেল, আমরা ঘরের ভিতরে প্রবেশ করিলাম।
দেখিলাম গৃহের এককোণে রজতনির্ম্মিত পাত্রে দুইটি বাতি জ্বলিতেছে। গৃহতলে একখানি অতি প্রাচীন গালিচা বিস্তৃত আছে, তাহা স্থানে স্থানে একেবারে ছিঁড়িয়া গিয়াছে এবং নিম্নের মসৃণ শ্বেত মর্ম্মর বাহির হইয়া পড়িয়াছে। গৃহে আসবাব বড় অধিক কিছু ছিল না; এককোণে একটি পাথরের মেজ, তাহার উপরে রূপার শামাদান; খিলানগুলিতে মো্টা কাপড়ের পর্দ্দা ঝুলান; একটি খিলানের নীচে বহুমূল্য কারুকার্য্য খচিত একটি কাঠের সিন্ধুক এবং তাহার পার্শে একখানি ক্ষুদ্র খাটিয়া, তাহাও বোধ হয় চন্দন কি মেহগনিকাষ্ঠে নির্ম্মিত; তাহাতে নীলরঙ্গের রেশমের মশারি ফেলা, দেখিলেই বোধ হয় কে যেন শয়ন করিয়া আছে। গৃহে প্রবেশ করিয়া দুই তিনবার ডাকিরা বলিলাম, “গৃহে কে আছ, আমরা পথ হারাইয়া বিপন্ন হইয়াছি ও তোমাদের আশ্রয় লইয়াছি।” কেহই যখন উত্তর দিল না, তখন খাটের নিকটে আসিলাম, মশারি তুলিয়া দেখিলাম পীতবর্ণের রেশমের লেপে আপাদমস্তক আবৃত করিয়া কে যেন নিদ্রা যাইতেছে। খাটয়ার নীচে দুইখানি জরির কাজ করা লপেটা পড়িয়া আছে। লেপের উপরে হাত দিয়া দেখিলাম যে, সত্য সত্যই একটি মানুষ শুইয়া আছে। আস্তে আস্তে দুইতিন বার তাহাকে ধাক্কা দিলাম, তাহাতেও যখন সে উঠিল না, তখন একবার জোরে ধাক্কা দিলাম। তখন সে ব্যক্তি উঠিয়া বসিল, কিন্তু আমি তাহাকে দেখিয়া দুইহাত পিছু হটয়া গেলাম, এক্কাওয়াল চীৎকার করিয়া কাঁদিয়া উঠিল।
খাটিয়ায় যে ব্যক্তি শুইয়াছিল সে পুরুষ নহে, স্ত্রীলোক; অত্যন্ত কৃশাঙ্গী, শুভ্রবর্ণা এবং অতি বৃদ্ধা তাহার চুলগুলি শুভ্র হইয়া গিয়াছে, মুখের চর্ম্ম কুঞ্চিত হইয়া ঝুলিয়া পড়িয়াছে, হস্তপদে যেন অস্থির পর চর্ম্ম ব্যতীত আর কিছুই নাই। তাহার গায়ে একটি মিহি জাফ্রান রঙ্গের চিলা জামা, চুলগুলি তয়ফাওয়ালীদিগের ন্যায় বেণীবদ্ধ ও পৃষ্ঠদেশে লম্বিত। তাহার বয়ঃক্রম অনুমান করা কঠিন; প্রথমে দেখিলে বোধ হয় শতবর্ষের অধিক হইবে, কিন্তু তাহা সত্ত্বেও বৃদ্ধাকে দেখিয়া বোধ হইল, সে বড়ই রূপবতী ছিল। তাহার শীর্ণ মুখমণ্ডলে এককালের ভূবনমোহিনী রূপের ধ্বংসাবশিষ্ট তখনও বিদ্যমান ছিল। বৃদ্ধা উঠিয়া বসিয়া আমাকে দেখিল, দেখিয়া একবার চক্ষু রগড়াইল। প্রথম বোধ হয় ভাবিয়াছিল যে স্বপ্ন দেখিতেছে। তাহার পর জিজ্ঞাসা করিল, “তুমি কে, কোথা হইতে আসিতেছ?” তাহার কণ্ঠস্বর কর্কশ বা ক্ষীণ নহে, মনে হইল অশীতি বৎসর পূর্ব্বে তাহা আরও কোমল, আরও মধুর ছিল। আমি বলিলাম যে আমি পথিক, পথ ভুলিয়া এখানে আসিয়াছি এবং রাত্রির জন্য আশ্রয় প্রার্থনা করি। বৃদ্ধ অতি সুন্দর উর্দ্দুতে আমাকে বলিল, “তুমি যৌবনবলদৃপ্ত, তুমি বিদেশীয়, তাই এখানে আসিয়াছ। যৌবনে মরণের ভয় থাকে না। তাহা ছাড়া তুমি এ গৃহের পরিচয় জান না, তাহারই জন্য এ গৃহে প্রবেশ করিয়াছ। যদি মরণের ভয় রাখ, যদি স্ত্রীপুত্রের মুখ পুনরায় দেখিবার ভরসা রাখ, তাহা হইলে এখনই চলিয়া যাও।” আমি মনে মনে বড়ই বিরক্ত হইলাম। বৃদ্ধ আমার মনের ভাব বুঝিয়া পুনরায় কহিল, “ভাবিতেছ, আমি তোমাকে আশ্রয় দিতে অনিচ্ছুক বা এক বেলার খাদ্য দ্রব্য দিতে কুষ্ঠিত? তাহা নহে। যুবক, তোমার এখনও পরমায়ু আছে; যদি বাঁচিবার ইচ্ছা থাকে ত ফিরিয়া যাও। এ গৃহে আমি ব্যতীত রাত্রিবাস করিয়া কেহ বাঁচিয়া ফিরে নাই। এখনও পলাইয়া প্রাণ বাঁচাও।” আমি বলিলাম “অন্ধকার রাত্রি, বাহিরে ভীষণ ঝড় ও বৃষ্টি হইতেছে, ফিরিলে পথে মরিতে হইবে, তাহা অপেক্ষা যদি মরিতে হয় মানুষের কাছেই মরিব।” এক্কাওয়ালা এতক্ষণ বসিয়া ছিল, সে হঠাৎ বলিয়া উঠিল “বাবুজি, জানের দরদ কর, এখনও ফিরিয়া চল।” আমি বলিলাম “না।” বৃদ্ধ বুলিল, “বহুৎ আচ্ছা, তবে বইস।” এই বলিয়া সে খাট হইতে উঠিল এবং খাটিয়ার নীচে হইতে আর এক খান গালিচা বাহির করিয়া বিছাইয়া দিল। আমি তাহাতে বসিয়া পড়িলাম। বৃদ্ধ এক্কাওয়ালাকে একখানা কম্বল বাহির করিয়া দিল, সে তাহা মুড়ি দিয়া শুইয়া পড়িল। তাহার পর সে খাটিয়ার তল হইতে একটা বৃহৎ পেটারা বাহির করিল এবং তাহার ভিতর হইতে একখানা রূপার রেকারী বাহির করিয়া তাহাতে আমার জন্য খাবার সাজাইতে বসিল। রুটী, আঙ্গুর, পেস্তা, কিস্মিস ও আখরোট বাহির করিয়া আমার সম্মুখে ধরিল। আমি এক্কাওয়ালাকে জিজ্ঞাসা করিলাম, সে কিছু খাইবে কি না। সে কম্বলের ভিতর হইতেই উত্তর করিল যে ভূতের বাড়ীতে তাহার কিছু খাইবার ইচ্ছা নাই, সে প্রাণ লইয়া ফিরিতে পারিলেই বঁচে। বড়ই ক্ষুধার উদ্রেক হইয়াছিল, একে একে খাদ্যদ্রব্যগুলি সমস্তই শেষ করিলাম। খাটিয়ার পশ্চাতে একটা বৃহৎ ফরাশি-দেশীয় পুরাতন ঘড়ি ছিল, তাহাতে ঢং ঢং করিয়া বারটা বাজিল। বৃদ্ধা সতর্ক হইয়া উঠিয়া বসিল এবং দুই হাত দিয়া আমার একখানা হাত চাপিয়া ধরিল। আমি আশ্চর্য্যান্বিত হইয়া গেলাম। বলিতে ভুলিয়া গিয়াছি আহার শেষ হইলে দরজার ঝাঁপটা পুনরায় বাঁধিয়া দিয়াছিলাম।
এই সময় অট্টালিকায় উচ্চ-বাদ্যধ্বনি শুনিতে পাইলাম, তাহার পর মনে হইল বারান্দায় অনেক লোক চলিতেছে, একজন আসিয়া উপরে ও নীচে অনেক আলোক জ্বালিয়া দিয়া গেল। নীচে অনেক লোকের কথা শোনা যাইতে লাগিল। কোনও কথা স্পষ্ট বুঝিতে পারিলাম না, কিন্তু বোধ হইল যেন বিশেষ কোন সমারোহ ব্যাপার উপস্থিত। পরিচারকের চারিদিকে ছুটাছুটি করিতেছে, একজন পরুষকণ্ঠে তাহাদিগকে আদেশ করিতেছে। আধ ঘণ্টার মধ্যে গোলমাল থামিয়া গেল। তাহার পর বোধ হইল নিম্নতল হইতে চারিদিকের সিঁড়ি দিয়া অনেক লোক উপরে উঠতেছে, উপরে অন্যান্য লোকেরা তাহাদিগকে অভ্যর্থনা করিয়া বসাইতেছে। একবার ভাবিলাম স্বপ্ন দেখিতেছি। চক্ষু মুছিয়া ভাল করিয়া উঠিয়া বসিলাম, বৃদ্ধ আমার গা টিপিয়া আমাকে উঠিতে নিষেধ করিল।
প্রতীক্ষায়।
নীচে তখনও গোলমাল হইতেছিল, কিন্তু ক্রমে তাহা থামিয়া আসিল; মনে হইল কে যেন এস্রাজের সহিত সারেঙ্গীর সুর মিলাইতেছে। তাহারা অনেকক্ষণ ধরিয়া সুর মিলাইতে লাগিল; প্রথমে সুর মিলিল না, অনেকক্ষণ পরে মিলিল, তাহার পর সারেঙ্গী ও এস্রাজ একত্র মিলিয়া বাজিতে লাগিল, মধ্যে মধ্যে তাহার সহিত নুপুরনিক্কণ শোনা যাইতেছিল। স্পষ্ট বুঝিতে পারিতেছিলাম যে, বাদ্যের সহিত তালে তালে কে যেন নৃত্য করিতেছে। তাহার পর এস্রাজ ও সারেঙ্গীর ধ্বনি ডুবাইয়া বামাকণ্ঠস্বর উত্থিত হইল। যে গাহিতেছিল তাহার ক্ষমতা সত্য সত্যই অপূর্ব্ব, এমন মধুর কণ্ঠস্বর আর শুনি নাই। গান শেষ হইল, শত শত কণ্ঠ প্রশংসাসূচক শব্দ করিয়া উঠিল। তাহার পর আবার সারেঙ্গী বাজিয়া উঠিল, গায়িকা পুনরায় গাহিতে আরম্ভ করিল। ঘড়িতে একটা বাজিল।
দুই তিনখানা গান শেষ হইল, গায়িকা যখন চতুর্থ গান আরম্ভ করিয়াছে তখন নিম্নতলের প্রাঙ্গণে পাল্কীর বেহারার গলার আওয়াজ পাইলাম; মনে হইল যেন একখানি পাল্কী দ্রুতবেগে উপরে আসিতেছে। অকস্মাৎ গীতবাদ্য থামিয়া গেল। তাহার পর কে যেন মৃত্যু-যন্ত্রণায় চীৎকার করিয়া উঠিল, শত শত লোকে তাহার সহিত আর্ত্তনাদ করিয়া উঠিল, তাহার পর সমস্ত নিস্তব্ধ হইয়া গেল। যেন বহুলোক ইতস্ততঃ ছুটির বেড়াইতে লাগিল, তাহাদের সহিত অনেক লোক সোপান বাহিয়া দ্বিতলে আসিল। তাহার পর অনেকক্ষণ কোন শব্দ পাইলাম না। কে যেন কাঁদিতে আরম্ভ করিল, বোধ হইল বামাকণ্ঠ। সমস্ত আশাভরসা, শেষ হইয় গেলে স্ত্রীলোকে যেমন ভাবে কাঁদিয়া থাকে, যেমন ভাবে পুরুষে কাঁদিতে পারে না, বুকের পঞ্জরগুলি ভাঙ্গিয়া হৃৎপিণ্ড ছিনাইয়া লইলে রমণীতে যে ভাবে কাঁদিয়া থাকে, সেই ভাবের শব্দ আসিতেছিল। কি কারণে জানি না আমার মনে হইল গায়িকাই যেন কাঁদিতেছে। তাহার পর অন্য লোকে যেন কাহার দেহ লইয়া বারান্দায় আনিয়া ফেলিল, জল ঢালিয়া ধোয়াইল, তাহার পর “লা ইলাহা ইল্লাল্লা” উচ্চারণ করিতে করিতে নীচে লইয়া গেল ও প্রাঙ্গণ পার হইয়া চলিয়া গেল। রমণী তখনও কাঁদিতেছিল, গুমরাইয়া গুমরাইয়া কাঁদিতেছিল, দেখিতে দেখিতে আলোকমালা নিবিয়া গেল, রমণী তখনও কাঁদিতেছিল। দারুণ যন্ত্রণায় কে যেন আবার আর্ত্তনাদ করিয়া উঠিল, আমি আর সহ্য করিতে পারিলাম না, মূর্চ্ছিত হইয়া পড়িলাম।
যখন জ্ঞান হইল তখন দেখিলাম গালিচার উপরে শুইয়া আছি, ঘাসের বেড়ার ফাঁক দিয়া গৃহে রৌদ্র প্রবেশ করিতেছে। বৃদ্ধা বারান্দায় বসিয়া তামাকু সেবন করিতেছে, এক্কাওয়ালা তাহার পাশে বসিয়া আছে। বৃদ্ধা অপেক্ষাও বয়োজ্যেষ্ঠ একজন পরিচারক কক্ষ পরিষ্কার করিতেছে। উঠিয়া প্রশ্নের উপরে প্রশ্ন করিয়া বৃদ্ধাকে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলিলাম। বুড়ী হাসিল, বলিল “তুমি আহার না করিলে কোন কথার উত্তর দিব না।” কোন মতেই তাহাকে প্রতিজ্ঞা হইতে বিচলিত করিতে পারিলাম না,অগত্য বাধ্য হইয়া স্নান ও আহার করিলাম। বুড়ি আলবোলা লইয়া খাটিয়ার উপরে বসিল। দিল্লী ও লক্ষনৌতে যেরূপ উর্দ্দু প্রচলিত সেই ভাষায় বৃদ্ধা আমাকে যে কাহিনী বলিল তাঁহাই সংক্ষেপে বলিতেছি। বৃদ্ধা বলিল—
“বাবুজি, আমি জাতিতে নর্ত্তকী। পূর্ব্বে হিন্দু ছিলাম, এখন মুসলমানী হইয়াছি। দিল্লী, লাহোর, গোয়ালিয়র ও লক্ষনৌতে রাজদরবারে নৃত্য করিতাম। বাবুজি, দ্বিতীয় আকবরের নাম শুনিয়াছ? যে হতভাগ্য বাদশাহ সিপাহি-বিদ্রোহের সময়ে সিংহাসনচ্যুত হইয়াছিল, আক্বর তাহারই পিতা। ষাট বৎসর পূর্ব্বে দিল্লী ও লাহোরের লোকে আমার নাম শুনিলে পাগল হইত। তওয়াইফ মহলে আমার বড় সুখ্যাতি ছিল। লাহোরে শিখ বাদশাহের দরবারে, গোয়ালিয়রে মহারাজ সিন্ধিয়ার দরবারে আমার প্রায়ই তলব পড়িত। দিল্লী ও লক্ষনৌতে আমার তন্খা বাঁধা ছিল। কোম্পানী বাহাদুর আসিয়া যখন অন্ধ বাদশাহ শাহ আলমকে মারাঠার হস্ত হইতে মুক্ত করিয়া দিল, তাহার তিন বৎসর পরেই বাদশাহের মৃত্যু হয়। আকবর বাদশাহ হইলে তাহার কনিষ্ঠ ভ্রাতা গোলাম আলি মাসে দশহাজার টাকা বৃত্তি পাইতেন। শাহজাদা বড়ই নৃত্যগীতপ্রিয় ছিলেন, তাহার মজলিসে আমার প্রায়ই মজুৱা করিতে যাইতে হইত। তিনি আমাকে বড়ই ভালবাসিতেন, ক্রমশঃ ঘনিষ্ঠত বাড়িয়া উঠিল, তাহার পর আমি মজিলাম!
“বাবুজি আমি জাতিতে হিন্দু সুতরাং শাহজাদা ভরসা করিয়া কিছু বলিতে পারিতেন না। সত্তর বৎসর পূর্ব্বে আমি বড়ই সুন্দরী ছিলাম, সে কথা তুমি এখন বিশ্বাস না করিলেও করিতে পার। তখন নবাব ও শাহজাদারা আমার জন্য পাগল হইয়া বেড়াইত। আমি কখনও কাহাকে অনুগ্রহ করি নাই, কিন্তু গোলাম আলির রূপে ও গুণে মুগ্ধ হইয়া নিজেই মজিলাম,—মুসলমানী হইলাম। গৃহত্যাগ করিয়া মহলে প্রবেশ করিলাম, শাহজাদা আমাকে বিবাহ করিলেন,—আমি তাঁহার উপপত্নী হই নাই। সম্রাট আকবরশাহ তখন কোম্পানী বাহাদুরের আশ্রিত, কিন্তু তখনও দিল্লীতে তাঁহার যথেষ্ট ক্ষমতা ছিল। তিনি বিবাহের কথা শুনিয়া জ্বলিয়া উঠিলেন। ইহার অন্য কারণও ছিল। শাহজাদা গোলাম আলি সম্রাটের প্রধান মহিষীর ভগিনীকে বিবাহ করিয়াছিলেন। শ্যালিকার প্ররোচনায় আকবর শাহ আমাদিগের বিবাহবন্ধন ছিন্ন করিতে কৃতসঙ্কল্প হইলেন। শাহজাদা বাধ্য হইয়া দিল্লী পরিত্যাগ করিলেন, অবশ্য আমাদিগকে লইয়া।
“এই যে অট্টালিকা দেখিতেছ ইহা মালবের প্রাচীন বাদশাহদিগের নির্ম্মিত। রাজধানী পরিত্যাগ করিয়া শাহজাদা এই বনমধ্যে আসিয়া বাস করিতে লাগিলেন। পিশাচী মোগলকন্যা দিল্লীতে থাকিতে পারিল না, সলিমাবাদে আসিল, শাহজাদা তাহাকে অভ্যর্থনা করিয়া গৃহে আনিলেন। এখানে আসিয়া পিশাচী প্রাণ খুলিয়া আমাদের সহিত মিশিল, শাহজাদাও তাহার পূর্ব্ব-বিদ্বেষ বিস্মৃত হইয়া গেলেন। এখানে বড়ই সুখে বন্ধুবান্ধবে পরিবৃত হইয়া শাহজাদ দিল্লীর বিচ্ছেদ বিস্মৃত হইয়া গেলেন।
“বাবুজি, শাহজাদা আমার গান শুনিতে বড় ভালবাসিতেন। তাঁহার আহবানে মালবের অনেক বিখ্যাত বিখ্যাত গায়িকা ও নর্ত্তকী এই প্রাসাদে মজুরা করিতে আসিত বটে, কিন্তু কাহারও গান তাঁহার পছন্দ হইত না। বিবাহ হইবার পরে প্রতিদিন অন্দরমহলে মজলিস বসিত। সদর-মহলে প্রথম রাত্রিতে একদফা মজলিস বসিত, দুই একজন বিশেষ বন্ধু লইয়া শাহজাদা নিশীথ রাত্রিতে অন্দরমহলে আসিতেন। বাবুজি, তাহার আদেশে আমি তাহাদের সম্মুখে বাহির হইতাম; গানে ও নাচে রজনীর অধিকাংশ অতিবাহিত হইত। একদিন আমার কপাল ভাঙ্গিল। পিশাচী সেদিন অসুখের ভাণ করিয়া আমাদিগের সহিত মিশিল না, যথাসময়ে অন্দরমহলে মজলিস বসিল, দুই তিন খান গান গাহিবার পর পিশাচী কোথা হইতে ঝড়ের মত ছুটয়া আসিয়া শাহজাদার বুকে একখানা ছোর বসাইয়া দিল। তাঁহাকে পাল্কী করিয়া অন্য মহল হইতে আসিতে দেখিয়া পরিচারকেরা ভাবিয়াছিল যে বেগম অন্যদিনের ন্যায় মজলিসে যোগ দিতে আসিয়াছেন। শাহজাদাকে হত্যা করিয়া পিশাচী নিজে আত্মহত্যা করিল। সব শেষ হইয়া গেল। হকিম আসিল, পরীক্ষা করিয়া বলিল “ছুরিকা বিষাক্ত, মরণের অধিক বিলম্ব নাই।” শাহজাদাও তাহা বুঝিতে পারিতেছিলেন। আমার কোলে মাথা রাখিয়া বলিলেন, “ভয় নাই, আমি শীঘ্রই ফিরিয়া আসিব।” সেই রাত্রিতেই পরিচারকগণ প্রাঙ্গণে তাঁহাদের মৃতদেহ কবর দিল।
“তাহার পর একে একে বন্ধুবান্ধব, পরিচারক পরিচারিক সকলেই আমাদিগকে পরিত্যাগ করিয়া গেল। শাহজাদার মৃত্যুর সহিত সরকারের তন্খা বন্ধ হইয়া গেল। ক্রমে প্রাসাদ বনে ভরিয়া গেল। বাবুজি, এই বিশাল পুরী সুসজ্জিত করিয়া রাখা আমার সাধ্যাতীত। তাহার পর হইতে প্রতিদিন রাত্রিতে এই স্থানে সেই হত্যা-কাণ্ডের অভিনয় হইয়া থাকে। তুমি যাহা দেখিয়াছ তাহা সম্পূর্ণ সত্য, স্বপ্ন বা মিথা নহে। অতৃপ্ত প্রেতাত্মাগুলি জীবনের শেষ রজনীর ঘটনা এখনও প্রতিদিন অভিনয় করিয়া থাকে। সেই ভয়ে মানুষ এ পথে আসে না। কেবল আব্দুল্লা আমাকে পরিত্যাগ করে নাই, সে ছিল বলিয়াই এতদিন বাঁচিয়া আছি, তাহারই সাহায্যে এই বিশাল প্রাসাদের এককোণে এতকাল বাস করিতেছি। শয়তান ও জিনের আবাস বলিয়া এই দেশের লোকে কেহ এই স্থানের নিকটেও আসেনা। এই স্থানের দশক্রোশের মধ্যে লোকালয় নাই। যাহারা ছিল তাহারা সকলে মরিয়া গিয়াছে বলিয়া ভয়ে নুতন লোক বাস করিতে আসেনা। প্রাসাদের চারিদিক অরণ্যসস্কুল হইয়া উঠিয়াছে।
“আমি যাই নাই কেন জিজ্ঞাসা করিতেছ? আমি যে তাঁহার গৃহে বাস করিতেছি। ইহার প্রত্যেক পাষাণ-খণ্ড আমার হৃৎপিণ্ডের ন্যায় প্রিয়। বাবুজি, শাহজাদা গোলাম আলিকে কেহ কখনও মিথা বলিতে শুনে নাই। তিনি বলিয়া গিয়াছেন আবার আসিবেন, সুতরাং তিনি নিশ্চয়ই আসিবেন; আমি তাঁহার প্রতীক্ষায় রহিয়াছি।”