গুচ্ছ/নিয়তি
নিয়তি
বিদ্যাকাঠীর জীবনমোহন চৌধুরী যশোহরের একজন প্রবল পরাক্রান্ত জমিদার, লোকে বলিত তাঁহার প্রবল প্রতাপে বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খাইত। জীবনমোহন নিষ্ঠাবান হিন্দু ছিলেন, বঙ্গদেশের অধ্যাপকসমাজ নানা বিয়ে তাঁহার নিকট ঋণী ছিল তা ছাড়া ক্রিয়া কর্ম্মে তাঁহার বড়ই ব্যয়বাহুল্য দেখা যাইত। জীবনমোহনের একমাত্র পুত্র প্রাণমোহন, পিতার ঐকান্তিক যত্নে সুশিক্ষিত হইয়াছিলেন। যথাসময়ে পুত্রের বিবাহ দিয়া বৃদ্ধ জীবনমোহন পৌত্রমুখ দর্শনের ভরসায় বসিয়া ছিলেন, কিন্তু তাঁহার সে আশা পূর্ণ হয় নাই। হইবে না হইবে না করিয়া প্রাণমোহনের পত্নী প্রমোদামুন্দরী যখন একটি কন্যা প্রসব করিলেন, তখন বৃদ্ধ যেন চাঁদ হাতে পাইলেন, আদর করিয়া পৌত্রীর নাম রাখিলেন মাধুরী। বৃদ্ধ বয়সে জীবনমোহন বিষয়কর্ম্ম বড় দেখিতেন না, সুশিক্ষিত পুত্রের হস্তে বিস্তৃত জমিদারীর ভার অর্পণ করিয়া বৃদ্ধ নিশ্চিন্তমনে পৌত্রীকে লইয়া দিন যাপন করিতেন। মাধুরী তাঁহার নয়নের তারা হইয়া উঠিয়ছিল, মাধুরীর জন্য তাঁহার কাশীবাস করা হয় নাই। কেহ যদি বলিত যে বড় বাবুর একটি পুত্র সন্তান হইলে ভগবান কর্ত্তার মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করেন, তাহা হইলে বৃদ্ধ তাড়াতাড়ি তাহার কথা চাপা দিয়া বলিত “ও কথা বলিও না, একা মাধু আমার শত পুত্রের কাজ করবে।” মাধুরী সত্য সত্যই মাধুর্য্যময়ী হইয়া উঠিল; যে তাহাকে একবার দেখিত, সে নয়ন ফিরাইয়া লইতে পারিত না। প্রতিদিন প্রভাতে মাধুরী যখন বৃদ্ধ পিতামহের হস্ত ধারণ করিয়া বিশাল পুষ্পোদ্যানে খেলিয়া বেড়াইত, তখন তাহাকে দেখিলে অপ্সরী বা দেবকন্যা বলিয়া ভ্রম হইত।
জীবনমোহন দেশের বিখ্যাত বিখ্যাত জ্যোতির্ব্বিদ্গণের দ্বারা পৌত্রীর জন্মপত্রিকা প্রস্তুত করাইয়াছিলেন, কিন্তু কোনও বিশেষ কারণে তিনি সর্ব্বদাই অস্থিরচিত্ত ও অসন্তুষ্ট থাকিতেন। বিদ্যাকাঠী গ্রামে বিদায়ের লোভে কোন জ্যোতির্ব্বিদ্ বা গ্রহাচার্য্য আসিলে তাঁহার আর সমাদরের অবধি থাকিত না। এইরূপে মাধুরীর শত শত জন্মপত্রিকা প্রস্তুত হইয়াছিল। একবার মাত্র বিক্রমপুরনিবাণী কৃষ্ণবর্ণ, খর্ব্বকায় এক ব্রাহ্মণ জন্মপত্রিকা প্রস্তুত না করিয়াই চলিয়া গিয়াছিল। সেদিন মাধুরী পিতামহের পার্শ্বে বসিয়াছিল, ব্রাহ্মণ আসিয়া সভাতলে বসিল, কাগজ কলম লইয়া জন্মপত্রিক লিখিতে লাগিল, কিন্তু কি দেখিয়া শিহরিয়া উঠিল, আর লিখিল না, কাগজখানি ছিঁড়িয়া ফেলিল। তখন ত্রস্ত হইয়া জীবনমোহন তাহাকে প্রশ্ন করিতে লাগিলেন, কিন্তু সন্তোষজনক কোন উত্তর পাইলেন না। বৃদ্ধ যখন কাতর হইয়া ধরিয়া পড়িলেন তখন ব্রাহ্মণ বলিল “বাবু নিয়তি কেহ খণ্ডাইতে পারে না, অর্থব্যয়ে শান্তিস্বস্ত্যয়নে যদি লোকে নিয়তির হাত এড়াইতে পারিত, তাহা হইলে জগতে শোক, দুঃখ, জরা, মৃত্যু থাকিত না।” মর্ম্মাহত হইয়া বৃদ্ধ বসিয়া পড়িলেন। ব্রাহ্মণ তখনও বলিতেছিল, “শান্তিস্বস্ত্যয়নের ব্যবস্থা আমাদের উদর পূরণের উপায়। গণনার যে ফল প্রত্যক্ষ করিয়াছি তাহা অন্যথা হইবার নহে, আপনি বয়োজ্যেষ্ঠ ব্রাহ্মণ, অর্থের জন্য আপনার নিকট মিথ্যা বলিতে পারিব না।” এই কথা বলিয়া সে গৃহ হইতে নিস্ক্রান্ত হইল; বিদায়, পাথেয় প্রভৃতি বিস্মৃত হইয়া তৎক্ষণাৎ গ্রাম পরিত্যাগ করিল। তাহার পর সে কৃষ্ণকায় জ্যোতিষীকে বিদ্যাকাঠী গ্রামে কেহ দেখে নাই। জীবনমোহন তাহার অনেক অনুসন্ধান করিয়াছিলেন, কিন্তু বিশাল বঙ্গদেশের বক্ষেদেশে সে কোথায় লুকাইয়াছিল তাহা কেহ সন্ধান করিয়া উঠিতে পারে নাই। মাধুরীর বয়স যত বাড়িতেছিল জীবনমোহনের বিষণ্ণতাও তত বাড়িতেছিল। পুত্রের নিকটে মাধুরীর ভবিষ্যতের কোন কথা বলিয়া বৃদ্ধের মনের তৃপ্তি হইত না, কারণ পুত্র নব্যতন্ত্রে দীক্ষিত, তিনি কুসংস্কারের সীমা অতিক্রম করিয়াছিলেন।
মাধুরীর বিবাহের বয়স হইল। প্রমোদাসুন্দরীর ইচ্ছা ছিল যে অষ্টম বর্ষে গৌরীদানের ছলে একটি দরিদ্রের পুত্র ক্রয় করির লালনপালন করেন, কিন্তু জীবনমোহন তাহাতে অমত করিলেন। প্রমোদাসুন্দরী গৌরীদানে শ্বশুরের অমত দেখিয়া আশ্চর্য্যান্বিতা হইলেন, কারণ তিনি জানিতেন যে জীবনমোহন নিষ্ঠাবান হিন্দু। দেখিতে দেখিতে মাধুরী দ্বাদশবর্ষে পদার্পণ করিল। তখন দীর্ঘনিশ্বাস ত্যাগ করিয়া জীবনমোহন পৌত্রীর বিবাহের জন্ত যত্নবান হইলেন। প্রাণমোহন কোনদিনই মাধুরীর বিবাহের কথায় কর্ণপাত করেন নাই, তাঁহার বিশ্বাস ত্রয়োদশবর্ষ উত্তীর্ণ না হইলে কুমারীর বিবাহ হওয়া উচিত নহে। বঙ্গদেশের ব্রাহ্মণসমাজে কর্ত্তৃত্ব করিয়া, কুলাচার্য্য ও গ্রহাচার্য্যগণের উদর পূরণ করাইয়া, অবশেরে জীবনমোহন মাধুরীর বিবাহের সম্বন্ধ স্থির করিলেন। পাত্র কলিকাতা-নিবাসী, ধনীর সন্তান, কলিকাতার একটি বিখ্যাত কলেজের ছাত্র, প্রিয়দর্শন এবং মিষ্টভাষী। বিবাহের সম্বন্ধ স্থির হইলে বৃদ্ধের মুখে হাসি দেখা দিল। যথাসময়ে মহাসমারোহে জীবনমোহন, সৎপাত্রে পৌত্রীকে সমর্পণ করিয়া কৃতার্থ হইলেন। মাধুরীর দুইটি অলঙ্কার বাড়িল,—সীমন্তে সিন্দূর ও মস্তকে অবগুণ্ঠন।
তখন কলিকাতা মহানগরীতে মহামারী দেখা দিয়াছে। প্রতি বৎসর শীতের শেষে গৃহে গৃহে ক্রন্দনের রোল উঠে, গঙ্গাতীরে শবদাহের স্থানাভাব হয়। একদিন অকস্মাৎ বজ্রাঘাতের ন্যায় টেলিগ্রাম পাইয়া পিতাপুত্র কলিকাতায় চলিয়া আসিলেন, কিন্তু তাঁহারা আদিবার পূর্ব্বেই সব শেষ হইয়া গিয়াছে, শমন একটি সুকুমার জীবনের সহিত মাধুরীর জীবনের সকল সুখ হরণ করিয়া লইয়া গিয়াছে। পিতাপুত্রে মস্তকে হাত দিয়া বৈবাহিকের প্রাঙ্গণে বসিয়া পড়িলেন। তখন অন্তঃপুর হইতে পুত্রশোকাতুরা মাতা উন্মত্তার ন্যায় তাঁহাদিগকে গালি দিতেছিল। শুল্কমুখে মাধুরীর শ্বগুরগৃহ পরিত্যাগ করিয়া জীবনমোহন ও প্রাণমোহন বাহিরে আসিলেন। বৃদ্ধ পুত্রকে জানাইলেন যে তিনি এখন আর দেশে ফিরিতে পরিবেন না, তীর্থ পর্য্যটনে বহির্গত হইবেন। ভগ্নহৃদয়ে বিষণ্ণ বদনে গৃহে ফিরিয়া প্রাণমোহন একমাত্র কন্যার সর্ব্বনাশের কথা প্রকাশ করিলেন। মাধুরী কিছুই বুঝিল না, কারণ সে বিবাহের সময় ব্যতীত অন্য সময়ে স্বামীকে দেখে নাই, স্বামী কে তাহা বুঝিতে শিখে নাই, স্বামীর অভাব কি তাহা অনুভব করে নাই। প্রমোদাসুন্দরী ভূতলে লুটাইয়া কাঁদিতেছিলেন, তাহা দেখিয়া কন্যাও কাঁদিতে বসিল; আর, তাহার অশ্রুজল দেখিয়া বিদ্যাকাঠী গ্রামের কেহই অশ্রুজল রোধ করিতে পারিল না।
জামাতার শোক প্রাণমোহনের বুকে বড় বাজিল। তিনি গম্ভীর প্রকৃতির লোক, তাঁহার আনন্দ বা শোক লোকে জানিতে পারিত না, তাঁহাকে সান্ত্বনা করিবারও কেহ ছিল না। চৌধুরীদিগের গৃহে প্রমোদাসুন্দরীই গৃহিণী, প্রাণমোহনের মাতা বহুপূর্ব্বে স্বর্গারোহণ করিয়াছিলেন।
যেমন করিয়া সকলের দিন কাটিয়া থাকে মাধুরীর দিনও তেমনি করিয়া কাটিতে লাগিল। ক্রমে মাধুরী বিবাহের কথা ও স্বামীর কথা ভূলিয়া গেল। মাধুরীর মাতা প্রাণ ধরিয়া তাহার অলঙ্কারগুলি খুলিয়া লইতে পারেন নাই, কিশোরী কন্যাকে হিন্দু বিধবার কঠোর জীবনব্রত অবলম্বন করাইতে পারেন নাই। ইহার জন্য তাঁহাকে বিলক্ষণ লাঞ্ছনাভোগ করিতে হইতেছিল।
এক বৎসরের অধিককাল তীর্থপর্য্যটনে অতিবাহিত করিয়া জীবনমোহন যখন দেশে ফিরিলেন তখন পূর্ব্বের ন্যায় হাসিমুখে সালঙ্কারা নববধূর মত মাধুরী তাঁহাকে অভ্যর্থনা করিতে গেল। তাহার দাদাবাবু যে এতদিন তাহাকে কি করিয়া ভুলিয়া ছিলেন তাহা সে ভাল বুঝিতে পারে নাই। যখন তাহাকে দেখিয়া জীবনমোহনের বিষণ্ণমুখ আরও বিষন্ন হইয়া গেল তখন মাধুরীর মুখও শুকাইয়া গেল, চিরাভ্যস্ত অভ্যর্থনা ভূলিয়া গিয়া মাধুরী ধীরে ধীরে পিছাইয়া আসিল।
গৃহে ফিরিয়া জীবনমোহন মাধুরীর বেশ পরিবর্ত্তন ও ব্রহ্মচর্য্য শিক্ষা লইয়া বড়ই ব্যস্ত হইয়া পড়িলেন। মাধুরীর অঙ্গে সধবার চিহ্ন রাখার জন্য পুত্রবধূকে বড় তিরস্কার করিলেন। মাধুরীর মাতা ভূমিশয্যায় লুটাইয়া কাঁদিয়া কাঁদিয়া তাহার উত্তর দিয়াছিলেন। পিতামহের উপদেশ অনুসারে মাধুরী অলঙ্কার খুলিয়া ফেলিল, সীমন্তের সিন্দূর মুছিয়া ফেলিল, একবেলা হবিষ্যান্ন ভোজন করিতে আরম্ভ করিল; সাত দিনের মধ্যে ফুলের মত সুকুমার মাধুরী যেন শুকাইয়া উঠিল! সে প্রথম প্রথম তর্ক করিয়া বৃদ্ধ পিতামহকে বড়ই ব্যতিব্যস্ত করিয়া তুলিয়াছিল। বিধবা হইলে মাছ খাইতে নাই কেন, থান পরিতে হয় কেন, স্বামী কে, ইত্যাদি যে-সমস্ত প্রশ্নের কোন সন্তোষজনক উত্তর এখনও পর্য্যন্ত পাওয়া যায় নাই সেইগুলি জিজ্ঞাসা করিয়া বৃদ্ধকে সেই বালিকা নির্ব্বাক করিয়া দিত।
কন্যার পরিবর্ত্তন দেখিয়া প্রমোদাসুন্দরী শয্যা আশ্রয় করিলেন, মাধুরীকে দেখিতে হইবে বলিয়া প্রাণমোহন অন্তঃপুরে আসা ত্যাগ করিলেন।
মাধুরী একে একে সব শিথিল, সব বুঝিল, তখন সে বালসুলভ চপলতা পরিত্যাগ করিয়া সন্ন্যাসিনী সাজিল।
জীবনমোহন মাধুরীর শিক্ষা শেষ করিয়া পুনরায় তীর্থভ্রমণে চলিয়া গেলেন। তখন মাধুরী বড় বিপদে পড়িল। একাকী তাহার দিন আর কাটে না। পিতামহের উপদেশ-মত যতক্ষণ সময় পাইত শাস্ত্র-গ্রন্থ পড়িত, সংসারের কাজ তাহাকে বিশেষ কিছু করিতে হইত না, প্রমোদাসুন্দরী নিজেও কিছু দেখিতেন না, আত্মীয়াগণ সমস্তই সম্পন্ন করিতেন। মাধুরী অত্যন্ত আগ্রহের সহিত পিতামহের প্রত্যাবর্ত্তনের অপেক্ষায় রহিল। চৌধুরীদিগের অন্নে অনেক লোক প্রতিপালিত হইত। প্রাণমোহনের পিতা গ্রামে যে বিদ্যালয় স্থাপন করিয়াছিলেন তাহার শিক্ষকবর্গ প্রাণমোহনের গৃহেই আশ্রয় পাইয়াছিলেন। বহুদিন পূর্ব্বে জীবনমোহন এক অনাথ ব্রাহ্মণসন্তানকে আশ্রয় দিয়াছিলেন। কান্তিচন্দ্র গ্রাম্য বিদ্যালয়ে শিক্ষলাভ করিয়া সেইখানেই শিক্ষক হইয়াছিল। জীবনমোহন অনেকবার তাহার বিবাহ দিয়া তাহাকে সংসারী করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন, কিন্তু পারেন নাই। কান্তি আত্মীয়-স্বজন ও অর্থের অভাব জানাইয়া অব্যাহতি লাভ করিয়াছিল। প্রাণমোহনের ইচ্ছা ছিল যে মাধুরীর সহিত তাহার বিবাহ দিয়া তাহাকে পুত্ররূপে গ্রহণ করেন, কিন্তু জীবনমোহনের মত না হওয়ায় তাহার আশা সফল হয় নাই। মাধুরী বিধবা হইবার পরে প্রাণমোহন সঙ্কল্প করিয়াছিলেন যে কান্তির সহিত মাধুরীর পুনরায় বিবাহ দিবেন। জীবনমোহন দ্বিতীয়বার তীর্থপর্য্যটনে নির্গত হইলে প্রাণমোহন একদিন স্ত্রী ও কন্যার নিকটে নিজের মনের ভাব জ্ঞাপন করিলেন। তাহা শুনিয়া প্রমোদাসুন্দরী পুনরায় ভূমিশয্যা গ্রহণ করিলেন, মাধুরী কাঁদিয়া বুক ভাসাইয়া দিল, কিছুতেই বিবাহ করিতে সন্মত হইল না। সে বলিল পিতামহের নিকট শুনিয়াছে হিন্দুর কন্যার একবারের অধিক বিবাহ হয় না, সে কিরূপে দ্বিতীয়বার বিবাহ করিবে। প্রাণমোহন প্রথমদিন আর কিছু বলিলেন না। কিন্তু বারম্বার বলিয়াও যখন কস্তার মত করাইতে পারিলেন না, তখন ক্রুদ্ধ হইয়া বলিলেন যে মাধুরীকে বিবাহ করিতেই হইবে।
সেইদিন হইতে মাধুরী অন্ধকার দেখিল। কথা গোপন রহিল না, ক্রমে গ্রামের লোকে কাণাঘুষা করিতে লাগিল, দেশে রাষ্ট্র হইয়া গেল প্রাণমোহন চৌধুরী বিধবা কন্যার বিবাহ দিবে আত্মীয় স্বজন অনেকেই ধর্ম্মভয় ও সমাজের ভয় দেখাইয়া প্রাণমোহনকে নিরস্ত করিবার চেষ্টা করিল, কিন্তু তিনি সে প্রকৃতির লোক ছিলেন না। তিনি বড় বেশী কথা কহিতেন না! কিন্তু কেহ তাঁহাকে সঙ্কল্প হইতে বিচলিত করিতে পারিত না। কান্তি বিবাহের কথা শুনিয়া লজ্জায় মরিয়া গেল, প্রাণমোহন যখন তাহার নিকট বিবাহের প্রস্তাব উপস্থিত করিলেন তখন সে কি উত্তর দিবে ভাবিয়া ঠিক করিতে পারিল না, নীরবে মুখ নত করিয়া রহিল। প্রাণমোহন ভাবিলেন বিবাহে তাহার সম্মতি আছে। তখন তিনি বিবাহের উদ্যোগে ব্যস্ত হইলেন।
মাধুরী যখন বুঝিল যে পিতা তাহার বিবাহ দিতে স্থিরপ্রতিজ্ঞ হইয়াছেন তখন আকুল হইয়া পিতামহকে সংবাদ দিবার জন্য ব্যস্ত হইল। জীবনমোহন কোথায় গিয়াছিলেন তাহা কেহ জানিত না, তিনি অর্থের আবশ্যক হইলে মধ্যে মধ্যে দুই একখানি পত্র লিখিতেন মাত্র, তারপর আর কোন ঠিকানা পাওয়া যাইত না। মাধুরী অনেক সন্ধান করিয়াও তাঁহাকে পাইল না।
প্রচুর অর্থব্যয় করিয়া প্রাণমোহন বঙ্গদেশের পণ্ডিতসমাজের নিকট হইতে বিধবাবিবাহের ব্যবস্থা আনাইয়াছিলেন। বিবাহের দিন স্থির হইয়া গেল; গৃহে উৎসব আরম্ভ হইল। বিবাহের দিন প্রভাতে যখন নহবৎ বাজিয়া উঠিল তখন মাধুরী ঠাকুরঘরে প্রবেশ করিয়া দরজা বন্ধ করিয়া দিল, সমস্ত দিনে কেহ আর তাহাকে বাহির করিতে পারিল না। সন্ধ্যাসমাগমে প্রাণমোহন যখন কন্যাদান করিতে প্রস্তুত হইলেন, কাস্তি যখন বরবেশে সভায় উপস্থিত হইল, তখন মাধুরীকে আর কেহ খুঁজিয়াএই লেখায় এই অংশে একটি চিত্র থাকা উচিৎ। যদি আপনি তা দিতে পারেন, তবে, দয়া করে সাহায্য:চিত্র দেখুন। |
পাইল না। ব্যাকুল হইয়া প্রাণমোহন স্বয়ং গ্রামের চতুর্দ্দিকে অনুসন্ধান করিয়া বেড়াইতে লাগিলেন,আকস্মিক বিপদ্ আশা করিয়া প্রমোদাসুন্দরী শোকশয্যা ত্যাগ করিলেন ও কন্যার সন্ধান করিতে ব্যস্ত হইলেন, কান্তি বরবেশ ত্যাগ করিয়া মাধুরীর সন্ধানে নির্গত হইল।
ক্রমে বিপদ্ বুঝিয়া নিমন্ত্রিত ব্যক্তিগণ, সরিয়া পড়িল, আলোকমালা নিবিয়া গেল,গ্রামের লোকে বাদ্যধ্বনির পরিবর্ত্তে শোকাতুরা মাতার ক্রদনধ্বনি শুনিতে পাইল। রজনী শেষ হইবার কিঞ্চিৎ পূর্ব্বে প্রাণমোহন হতাশ হইয়া গৃহে ফিরিলেন, কিন্তু কান্তি আর চৌধুরীদিগের গৃহে ফিরিল না।
শেষ রাত্রিতে জেলিয়ারা খালে মাছ ধরিতে গিয়া একটা গুরুভার পদার্থ টনিয়া তুলিল। জাল উঠাইয়া সভায় দেখিল যে উহা একটি রমণীর মৃতদেহ। তাহারা যখন ঘাটে নৌকা লাগাইল তখন দেখিল কে যেন তাহদের প্রতীক্ষায় বসিয়া আছে। ক্রমে ঘাটে লোক জমিয়া গেল, কোথা হইতে কান্তি আসিয়া যখন মৃতাকে মাধুরী বলিয়া ডাকিল তখন লোকে জানিল প্রাণমোহন চৌধুরীর কন্যা মরিয়াছে। সকলে হায় হায় করিতে লাগিল। তখন সেই বাটে নিরুদ্বেগে বলিয়াছিল একজন কৃষ্ণবর্ণ খর্ব্বকায় বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ। সে যেন মাধুরীর মৃতদেহেরই অপেক্ষা করিতেছিল।
ক্রমে প্রাণমোহন সংবাদ পাইলেন। তাঁহার মুখে শোকের কোন চিহ্ন দেখা গেল না, মুখ যেন আরও গম্ভীর হইয়া উঠিল। প্রমোদাসুন্দরীর রোদনধ্বনি গগন বিদীর্ণ করিতে লাগিল। সেই সময়ে কোথা হইতে তীরবেগে একখানা পান্সি আসিয়া ঘাটে লাগিল। একজন বৃদ্ধ তাড়াতাড়ি নৌকা হইতে নামিয়া আসিলেন, জনতা দেখিয়া সেইদিকে অগ্রসর হইলেন। গ্রামের লোকে সসন্ত্রমে বৃদ্ধ জীবনমোহন চৌধুরীকে পথ ছাড়িয়া দিল। মৃতদেহ দেখিয়া বেদনাক্লিষ্টকণ্ঠে বৃদ্ধ একবার শুধু ডাকিলেন “মাধু!” তাহার পর নির্ব্বাক হইয়া বসিয়া পড়িলেন।
কেহ ভরসা করিয়া তাঁহাকে সান্ত্বনা দিতে অগ্রসর হইল না। তখন সেই বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ তাঁহার হাত ধরিয়া উঠাইয়া বলিল—“বাবু, আমি সেই গণনার বিদায় লইতে আসিয়াছি।”