গুচ্ছ/পাগলের কথা
গুচ্ছ।
পাগলের কথা
(গল্প)
লোকে বলে আমি পাগল হইয়াছি, আমার বন্ধুরা বলিয়া থাকেন যে আঘাত লাগিয়া আমার মস্তিষ্ক বিকৃত হইয়া গিয়াছে, বাড়ীতে মেয়ের বলিয়া থাকেন যে অধিক বিদ্যালাভ করিয়া আমার ভারাক্রান্ত মস্তিষ্ক একেবারে খারাপ হইয়া গিয়াছে। আমি নিজে দেখিতে পাইতেছি যে আমার কিছুই হয় নাই, আমার মস্তিষ্ক বেশ সবল এবং সুস্থ আছে। এমন কিছু অধিক বিদ্যালাভ করি নাই বা এমন কিছু অধিক আঘাত লাগে নাই যাহার জন্য আমি উন্মাদ হইয়া যাইব। আঘাত লাগিয়াছিল বটে, কিন্তু সে অনেক পূর্ব্বে, এখন সে কথা মনে হইলে একটু কষ্ট হয় মাত্র। আমি শ্রীযুক্ত মণিলাল চট্টোপাধ্যায় এম্-এ, বি-এল্, সাধারণের মতানুসারে উন্মাণ-রোগগ্রস্ত হইবার পূর্ব্বে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি উজ্জ্বল রত্ব ছিলাম। হাঁ, আর একটি কথা বলিতে ভুলিয়া গিয়াছি, মা এবং বড় বৌদিদিকে আমি বরাবরই বুঝাইবার চেষ্টা করিয়া আসিতেছি যে আমার মনের কোনও বিকার হয় নাই, যাহা কিছু হইয়াছিল সে অনেকদিন পূর্ব্বে সারিয়া গিয়াছে। কিন্তু তাঁহাদিগকে আমি কোনমতেই বুঝাইতে পারিলাম না যে আমার শরীর মুস্থ এবং নীরোগ।
আমার এই কাল্পনিক রোগের কারণ সুরেন। সুরেন আমার বাল্যবন্ধু, সহপাঠী এবং প্রতিবেশী। বাল্যকাল হইতে আমরা উভয়ের সাথী। আমাদের বন্ধুত্ব গ্রামে উদাহরণ-স্বরূপ হইয়া উঠিয়াছিল। স্কুলে এবং কলেজে আমরা এক সঙ্গে পড়িয়াছি এবং বরাবরই একসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্ব্বোচ্চ সন্মান লাভ করিয়া আসিয়াছি। সুরেন এখনও বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি উজ্জ্বল রত্ন, এবং তাহারই জন্য তাহারই দোষে আমি এখন পাগল। সুরেনকে দেখিলে আমি এখন বড়ই চটিয়া যাই সেইজন্ত সেও আর বড় একটা আমার সহিত দেখা করিতে আসে না। বাড়ীর লোকে বলে যে তাহাকে দেখিলে আমার রোগ আরও বৃদ্ধি হয়, সেইজন্যই সে আর আসে না; মা এবং বড় বৌদিদি এইজন্য মধ্যে মধ্যে আক্ষেপ করিয়া থাকেন। মেজদার ছোটমেয়ে সুধা আমাকে একদিন বলিয়াছিল যে, সুরেন কাকা কাছারী হইতে ফিরিবার পথে প্রত্যহ আমার সন্ধান লইয়া যায়। সুরেনকে দেখিলে এমন কি সুরেনের নাম শুনিলে বা মনে করিলে আমার কি মনে হয় জান? কোথা হইতে একটা অমানুষিক শক্তি আসিয়া আমার চোখের সন্মুখ হইতে কলিকাতা, বাসগৃহ, বিদ্যুতালোক এবং বর্তমান সরাইয়া লইয়া যায়। মুহূর্ত্তের জন্য আমি সাত বৎসর পিছাইয়া যাই; দেখিতে পাই কীর্ত্তিনাশাবক্ষে প্রবল ঝটিকাঘাতে তরঙ্গমালার উদ্দাম নৃত্য, দেখিতে পাই মাঝির পানসী রাখিতে পারিতেছে না, প্রবল বায়ুর সম্মুখে পড়িয়া অন্ধকার ভেদ করিয়া নৌকা কোন্ দিকে যাইতেছে তাহা কেহ বলিতে পারিতেছে না। ঝড়ের শ্রবণভেদী শব্দের মধ্য হইতে পরিচিত স্বরে কে যেন বলিতেছে “ভয় নাই” “ভয় নাই”। যখন চড়ায় লাগিয়া নৌকা খণ্ড খণ্ড হইয়া গেল, নগদ দশ সহস্র মুদ্রা এবং অর্দ্ধ লক্ষের অধিক মূল্যের অলঙ্কার-জড়িত নববধূকে যখন কীর্ত্তিনাশা গ্রাস করিল, তখনও দূর হইতে কে যেন জড়িত স্বরে বলিতেছিল “ভয় নাই” “ভয় নাই”। বস্তুতঃ যখন বিবাহের যৌতুক সমেত আমার নববধূ পদ্মার গর্ভে আশ্রয় পাইতেছিল তখন আমার মনে এক মুহূর্ত্তের জন্যও ভয়ের উদয় হয় নাই। তখন আমি কি ভাবিতেছিলাম জান? যে আমাকে অভয় দিতেছে, সে যেন আমার পরিচিত, সে যেন আমার প্রিয়, সে যেন আমাকে অনেক দিন পরিত্যাগ করিয়া গিয়াছে। নৌকা যখন ডুবিল তখন পিতার বিশ্বস্ত কর্ম্মচারী নুটবিহারী মুখোপাধ্যায় অলঙ্কারের বাক্স, এবং মুরেন নববধূকে বাঁচাইবার চেষ্টা করিয়াছিল। কি জানি কেন আমি তখন কাহাকেও বাঁচাইবার চেষ্টা করি নাই, নিজেও বাচিবার চেষ্টা করি নাই। যে আমাকে অভয় দিয়াছিল, সে যেন ক্রমশঃ নৌকার নিকটে আসিয়া বলিতেছিল “ভয় নাই” “ভয় নাই”। নৌকা যখন ডুবিল তখন স্পষ্ট দেখিতে পাইলাম, অলঙ্কারের ভারে মুখোপাধ্যায় তলাইয়া গেল, পর্ব্বতপ্রমাণ একটা তরঙ্গ আসিয়া সুরেনের হাত হইতে নববধূকে ছিনাইয়া লইয়া গেল। তখন আমার হঠাৎ মনে পড়িয়া গেল, সে স্বর লীলার। লীলার কণ্ঠস্বর চিনিতে পারি নাই, এই ভাবিয়া, লজ্জায় ঘৃণায় মরমে মরিয়া গেলাম, জীবন-মরণের কথা তখন স্মরণ ছিল না। কিন্তু কীর্ত্তিনাশা আমাকে গ্রাস করিল না; কে যেন আমার হাত ধরিয়া ধীরে ধীরে লইয়া চলিল—সে করম্পর্শ বড় মধুর—আমার চির-পরিচিত। একাদশ বর্ষ পূর্ব্বে নব বসন্তের পূর্ণিমা রজনীতে প্রথম সে কর স্পর্শ করিয়াছিলাম, এই কথা মনে পড়িয়া গেল। তখন ঝড়, নৌকা-ডুবি, কীর্ত্তিনাশা, জীবন, মরণ, ভূত, ভবিষ্যৎ, বর্ত্তমান ভুলিয়া গিয়া ঘুমাইয় পড়িলাম।
একটা বড় সুন্দর স্বপ্ন দেখিতেছিলাম। গ্রীষ্মের সিত পক্ষে লীলার অঙ্কে মস্তক রক্ষা করিয়া ছাদে শুইয়া আছি। লীলা বলিতেছে “দেখ, আমি বোধ হয় আর অধিক দিন বাঁচিব না।” তাহাকে শাস্তি দিবার জন্য মুষ্টি উত্তোলন করিতেছি, এমন সময় নীচে কে আমাকে ডাকিল। শুনিলাম মা বলিতেছেন “কে, সুরেন এলি? মণি ছাদে আছে।” ব্যস্তসমস্ত হইয়া লীলা তাহার অঙ্ক হইতে আমার মস্তক নামাইয়া দিয়া দূরে সরিয়া গেল। আমার নিকটে আসিয়া সুরেন যেন আমায় ডাকিল। তখন হঠাৎ ঘুম ভাঙ্গিয়া গেল। লীলা যতদিন বাঁচিয়াছিল মাঝে মাঝে এমনই করিয়া সে আমাকে জ্বালাইত।
চাহিয়া দেখিলাম বারিকণাসিক্ত বালুকাসৈকতে শয়ন করিয়া আছি, সুরেন আসিয়া আমাকে ডাকিতেছে—আর দূরে আর্দ্র শুভ্র বসন পরিধান করিয়া আমার লীলা আমার প্রতীক্ষায় দাঁড়াইয়া আছে। তখন বুঝিলাম আমি বর্ত্তমানে—ভবিষ্যতে নহি। যে কোন উপায়ে হউক লীলাকে ফিরিয়া পাইয়াছি। তখন উন্মত্তের ন্যায় “লীলা” “লীলা” বলিয়া চীৎকার করিয়া উঠিলাম, ঝড়ের সমস্ত শব্দ ডুবাইয়া আমার কণ্ঠস্বর শ্রুত হইল। লীলা তাহা শুনিতে পাইল, হস্ত দ্বারা ইঙ্গিত করিয়া সে যেন আমাকে ডাকিল। আমিও “যাই” বলিয়া তাহার দিকে ছুটিলাম, কিন্তু সুরেন আমাকে যাইতে দিল না। অকস্মাৎ কোথা হইতে তাহার দেহে অম্বরের বল আসিল, আমি কিছুতেই তাহার হাত ছাড়াইতে পারিলাম না। তাহাকে মিনতি করিয়া, পায়ে ধরিয়া, অবশেষে বল প্রয়োগ করিয়া, গালি দিয়া, প্রহার করিয়া আমাকে ছাড়ির দিতে কছিলাম, কিন্তু সে কিছুতেই শুনিল না। আমার জন্য লীলা অনেকক্ষণ আর্দ্রবসনে পদ্মা-সৈকতে দাঁড়াইয়া রহিল। ক্রমে ঝড়ের বেগ মন্দ হইয়া আসিতে লাগিল, পূর্ব্বদিকে আলোকের ক্ষীণ রেখা দেখা দিল; হতাশ্বাস হইয়া লীলা বলিল “ওগো তুমি আসিবে না। আমি তবে যাই।” বড় করণস্বরে লীলা কথাগুলি বলিল, তাহার কথায় আমার হৃৎপিণ্ড যেন ছিন্ন ভিন্ন হইয়া গেল। আর একবার স্বরেনের পায়ে ধরিয়া লীলার কাছে যাইবার জন্য অনুমতি প্রার্থনা করিলাম, সে আমার কথা বিশ্বাস করিল না, হাসিয়া উঠিল, কিন্তু হাসির সহিত তাহার দুইটি অশ্রুবিন্দু গড়াইয় পড়িল। লীলা আবার বলিল “তবে যাই”। ধীরে ধীরে তাহার দেবদুল্লভ মূর্ত্তি পদ্মাগর্ভে বিলীন হইয়া গেল, আমি ক্রোধে, ক্ষোভে অধীর হইয়া সুরেনের হাত ছাড়াইবার চেষ্টা করিলাম, না পারিয়া মূর্চ্ছিত হইয়া পড়িয়া গেলাম। সেই অবধি আমি পাগল, সেই অবধি আমি সুরেনকে দেখিলে চটিয়া যাই, বাল্যবন্ধুর দর্শনে ক্রোধে ধৈর্য্যহারা হই, কিন্তু ইহার জন্য লোকে আমাকে পাগল বলে কেন, আমি তাহা বুঝিতে পারি না।
জ্ঞান হইলে চাহিয়া দেখিলাম রৌদ্র উঠিয়াছে, সুরেন আমার পার্শ্বে বসিয়া আছে, তাহার সিক্ত বসন রক্তাক্ত, শতধা ছিন্ন, সে তাহা গ্রন্থি দিয়া পরিধান করিয়াছে। উঠিয়া বসিলাম। লীলার কথা মনে পড়িয়া গেল। তাহার যাতনাক্লিষ্ট পাণ্ডুর মুখখানি মনে পড়িয়া গেল, তাহার শেষ বিদায়ের কথাগুলি মনে পড়িল, অবশেষে যে কঠিন শয্যায় তাহাকে শয়ন করাইয়া, তাহার শীর্ণ ওষ্ঠ দুটিতে প্রজ্বলিত অগ্নি প্রদান করিয়াছিলাম সে কথা মনে পড়িল, তাহার ক্ষুদ্র জীবন অবসান হইলেও সে যে আমাকে বিস্তৃত হয় নাই, আসন্ন মরণ হইতে আমাকে উদ্ধার করিয়া সে যে আমাকে ডাকিতে আসিয়াছিল, সে কথা মনে পড়িল। তখন আর স্থির থাকিতে পারিলাম না; সহস্র সহস্র বৃশ্চিক যেন আমায় দংশন করিতেছিল, হঠাৎ যেন দিগন্ত রক্তবর্ণ হইয়া উঠিল, দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হইয়া ছুটিলাম। দেখিলাম কিয়দ্দূরে মুখোপাধ্যায়ের দেহ তরঙ্গাঘাতে ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত হইতেছে। নুটবিহারী পিতার বিশ্বস্ত কর্ম্মচারী, সে মরণেও বিশ্বাসঘাতক হয় নাই, তখনও তাহার প্রাণহীন দেহ অলঙ্কারের বাক্স আকর্ষণ করিয়া ভাসিতেছিল। নুটবিহারী আমাকে বড় ভালবাসিত, শৈশবে আমাকে কোলেপিঠে করিয়া মানুষ করিয়াছিল, আমিও তাহাকে বড় ভালবাসিতাম। একবার ভাবিলাম সে হয় ত বাঁচিয়া আছে, তাহাকে চেতন করিবার চেষ্টা করি, কিন্তু তাহা পারিলাম না। চারিদিক আবার লাল হইয়া উঠিল, আমার শীর জ্বলিয়া উঠিল, দুটিয়া পলাইয়া গেলাম। কোথায় দিয়া কোন্ দিকে যাইতেছিলাম মনে নাই। অকস্মাৎ দৃষ্টিশক্তি ফিরিয়া আসিল, সূর্য্যের তেজ তখন প্রখর হইয়া উঠিয়াছে। দূরে উত্তপ্তএই লেখায় এই অংশে একটি চিত্র থাকা উচিৎ। যদি আপনি তা দিতে পারেন, তবে, দয়া করে সাহায্য:চিত্র দেখুন। |
বালুকারাশির উপরে লাল চেলী পরিয়া একটি বালিকা শয়ন করিয়া আছে। ভাবিলাম অগ্নিবৎ তপ্ত বালুকা কি তাহার দেহ দগ্ধ করিতেছে না? তাহার নিকটে সরিয়া গেলাম, দেখিলাম সে যেন কাহার নবপরিণীতা বধূ। বহুমূল্য মণিমুক্তাগুলি সুবর্ণের আসনে বসিয়া তাহার দেহের চারিদিক হইতে হাসিয়া উঠিল, আমাকে ব্যঙ্গ করিতে লাগিল, কিসের জন্য তাহা আমি বুঝিতে পারিলাম না। মৃণাল-কোমল বাহুমূলে মস্তক রক্ষা করিয়া বালিকা ঘুমাইতেছিল, আমি তাহার দেহ স্পর্শ করিয়া ডাকিলাম, স্পর্শে বুঝিলাম সে ঘুম ভাঙ্গিবার নহে। আবার পূর্ব স্মৃতি ফিরিয়া আসিল, কীর্ত্তিনাশার শত শত তরঙ্গ তাহার সীমন্ত হইতে সিন্দূর-লেখা দূর করিতে পারে নাই, কপালের স্থানে স্থানে তখনও চন্দন-রেখা স্পষ্ট রহিয়াছে, সে যে আমার নব-বিবাহিতা, কাল সন্ধ্যাকালে তাহার বৃদ্ধ পিতা যে তাহাকে আমার হাতে সঁপিয়া দিয়াছিলেন। ভাবিলাম বুড়া নিশ্চিন্ত হইয়া বসিয়া আছে, আর মনে। করিতেছে তাহার কন্যা নির্ব্বিঘ্নে শ্বশুরগুহে পৌঁছিয়াছে। তাহার বহুমূল্য অলঙ্কাররাশি দেখিয়া লোকে হয়ত আশ্চর্য্য হইতেছে। এই কথা ভাবিয়া হাসি পাইল। হঠাৎ দেখিতে দেখিতে চেলীখানা যেন ঘোর লাল হইয়া উঠিল, পদ্মার জল লাল হইয়া উঠিল, শুভ্র বালুক-সৈকত লাল হইয়া গেল, আকাশ লাল হইয়া উঠিল, জ্ঞানহীন হইয়া আবার ছুটিলাম। অনেকক্ষণ পরে মনে হইল কোথা হইতে শীতল বাতাস আসিয়া আমার কপাল স্পর্শ করিতেছে, আমি ধীরে ধীরে নদীতীরে চলিয়া বেড়াইতেছি, তখন সূর্য্য অস্তমিত হইয়াছে। পশ্চাতে কাহার পদশব্দ শুনিলাম, উদভ্রান্ত হইয়া ডাকিলাম “লীলা!” ফিরিয়া-দেখিলাম ছায়ার ন্যায় সুরেন আমার পশ্চাতে আসিতেছে।
প্রবেশিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া যখন কলিকাতায় পড়িতে গিয়াছিলাম তখন হইতেই সঙ্কল্প করিয়া গিয়াছিলাম যে নিজে না দেখিয়া বিবাহ করিব না। পিতা আমার বিবাহ দিবার অনেক চেষ্টা করিয়া ছিলেন, কিন্তু আমার মত না থাকায় বিবাহ হইয়া উঠে নাই। ক্রমে একে একে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষা-সমুদ্র অনায়াসে উত্তীর্ণ হইয়া গেলাম, বিবাহের বাজারে আমার দর বাড়িল, অনেক কন্যাভারগ্রস্ত আমার হাতে ধরিয়া অনুরোধ করিয়া কাঁদিয়া কাটিয়া গেল, কিন্তু কিছুতেই আমার মন টলিল না। অবশেষে সুরেনই আমার প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করিল। কথার ছলে আমার অন্তরে লুক্কারিত প্রতিজ্ঞা বাহির করিয়া লইয়া আমাকে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করিল। কলিকাতার মেসে থাকি-কলেজে পড়ি, আত্মীয় স্বজনের অত্যন্ত অভাব, এই অবস্থায় হঠাৎ একদিন মধ্যাহ্ন-ভোজনের নিমন্ত্রণ পাইয়া অত্যন্ত আশ্চর্য্যান্বিত হইয়া গেলাম। নিমন্ত্রণকর্তা আমার সম্পূর্ণ অপরিচিত। সুরেন বলিল, তিনি তাহার আত্মীয়। পরে শুনিয়াছিলাম সুরেনের বংশে কেহ কখনও তাহার নামও শুনে নাই। আহারের সময় মলিন বস্ত্র-পরিহিতা একটি বালিকা আসিয়া অত্যন্ত সঙ্কুচিত ভাবে আমাদিগকে পরিবেশন করিয়া গেল। মেসে ফিরির সুরেন আমাকে জিজ্ঞাসা করিল “মেয়েটী কেমন?” আমি সংক্ষেপে উত্তর করিলাম “মন্দ নয়।” এক সপ্তাহ পরে শুনিলাম আমার বিবাহ। সুরেন এমন ভাবে সুবন্দোবস্ত করিয়াছিল যে আর আপত্তি করিবার সুবিধা পাইলাম না। বসন্তোৎসবের দিনে মহাসমারোহে লীলাকে বিবাহ করিয়া ঘরে আনিলাম। বড়ই সুখে বিবাহিত জীবনের তিন বৎসর কাটিয়াছিল, এখনও সে কথা মনে করিলে স্বপ্নের মত বোধ হয়। লীলাকে দেখিলে যুথিবন বলিয়া ভ্রম হইত। ভাবিতাম স্পর্শ করিলেই ঝরিয়া পড়িয়া যাইবে। যাহা ভয় করিয়াছিলাম তাহাই হইল, প্রথম প্রসব-বেদনা সহ্য করিতে না পারিয়া আমার যুথিবন সত্য সত্যই ঝরিয়া গেল। যাইবার সময় সে বলিয়া গেল “আমি তোমার কাছে থাকিতে পারিলাম না, তুমি কিন্তু আমার ভুলিও না।” আমার বাক্যস্ফূর্ত্তি হইবার পূর্ব্বে সে চলিয়া গেল।
এই তিন বৎসরের মধ্যে আইন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইয়া উকিল হইয়াছিলাম, লীলার সহিত আশা ভরসা সমস্তই বিসর্জ্জন দিয়াছিলাম, সুতরাং ব্যবসায়ে উন্নতি করিতে পারিলাম না। কিছুদিন পরে পুনরায় বিবাহের জন্য প্রস্তাব আসিতে লাগিল, আমার উপর রীতিমত উৎপীড়ন আরম্ভ হইল। এইরূপে দুই বৎসর কাটিয়া গেল। পিতার কাতরতা, মাতার অশ্রুজল, ভ্রাতৃবধূগণের সবিনয় অনুরোধ এড়াইতে না পারিয়া বিবাহ করিতে স্বীকার করিলাম। যে দিন মাতার নিকট বিবাহ করিতে অঙ্গীকারাবদ্ধ হইলাম সেই দিন রাত্রিকালে লীলার শয়নকক্ষে একাকী শুইয়াছিলাম। মহানগরীর কলরব তখন থামিয়া আসিয়াছে, কৃষ্ণপক্ষের মধ্যভাগে নিশীথে ক্ষীণচন্দ্রালোক দেখা দিয়াছে, গ্রীষ্মকাল, গৃহের দরজা-জানালাগুলি খোলা রহিয়াছে। কোথা হইতে একটা দমক বাতাস আসিয়া দীপ নিবাইয়া দিয়া গেল, সেই সময় দূরে কে যেন হা-হা-হা করিয়া উচ্চহাস্য করিয়া উঠিল, আমি শিহরিয়া উঠিলাম। লীলা চলিয়া যাইবার পরে আমার চিন্তার শেষ ছিল না, নূতন বিবাহের প্রস্তাব হইয়া সে চিন্তা আরও বাড়িয়া উঠিয়ছিল। একটু তন্দ্রা আসিয়াছে সেই সময়ে ঘরের ভিতর কে যেন আবার হা-হা-করিয়া উঠিল। তন্দ্রা ভাঙ্গিল না, মনে হইল সে ঘরে সে হাসি যেন নূতন নহে, তাহার কণ্ঠস্বর যেন চির-পরিচিত। ধীরে ধীরে অন্ধকার ভেদ করিয়া শুভ্রবসন-পরিহিত রমণীমূর্ত্তি ফুটিয়া উঠিল, যেন স্পষ্ট দেখিলাম অবগুণ্ঠনাবৃত নারী কক্ষে প্রবেশ করিয়া দ্বার অর্গলবদ্ধ করিয়া দিল। তখন আমি সুপ্ত কি জাগ্রত বলিতে পারি না, কিন্তু তাহার আকার, চলনের ভঙ্গী সমস্তই আমার পরিচিত, তাহার কেশাগ্র হইতে পদাঙ্গুলি পর্যন্ত সমস্ত অবয়ব যেন আমার চোখের সম্মুখে ভাসিতেছে। সে আমারই লীলা, অপর কেহ নহে। লীলা ঘরে ঢুকিয়া মুখ খুলিয়া হাসিয়া উঠিল, আমি চিরদিন তাহাকে যেমন ভাবে ডাকিতাম তেমন ভাবেই ডাকিয়াছিলাম, কিন্তু সে যে ভাবে আমার নিকট আসিত সে ভাবে যেন আসিল না। সে আসিল বটে কিন্তু দূরে রহিল, ভাবে বুঝাইয়া দিল যে এখন আমাদের মধ্যে একটা ব্যবধান পড়িয়া গিয়াছে, মিলনের একটা বাধা হইয়াছে, তখন আমার মনে ছিল না যে লীলা আর আমার নাই। রজনীর অধিকাংশ লীলার সহিত কথায় কাটাইয়াছিলাম। যখন জানাল দিয়া রৌদ্র আসিয়া আমাকে স্পর্শ করিল তখন আমার নিদ্রাভঙ্গ হইল, দেখিলাম অতি সন্তর্পণে শয্যার একপার্শ্বে শুইয়া আছি। একবার ভাবিলাম স্বপ্নে লীলাকে দেখিয়াছি, আবার ভাবিলাম স্বপ্নের ত সকল কথা মনে থাকে না, কিন্তু গত রাত্রির প্রত্যেক ঘটনাটি স্পষ্ট মনে রহিয়াছে। সে বলিয়া গিয়াছে আমি তাহারই, আর কাহারও নহি, বর্ত্তমানে বা ভবিষ্যতে আমি তাঁহারই থাকিব, আর কেহ আমাকে অধিকার করিতে পরিবে না। লীলার কথাগুলি আমার কানে বাজিতেছিল, তখনও যেন লজ্জায় ঘৃণায় মরমে মরিয়া যাইতেছিলাম, সেই আমি অপরের হইতে চলিয়াছি। লীলা বলিয়া গিয়াছে সে ছায়ার মত আমার অনুসরণ করিবে, আমি তাহারই সম্পত্তি থাকিব, সহস্র বার বিবাহ করিলেও তাহার সহিত সম্বন্ধ লোপ হইবে না। আমি ত তাহাকে ভুলিয়াছি কিন্তু মরিয়াও সে আমাকে বিস্মৃত হয় নাই।
তাহার কথা বলিতে গেলে ঐ রকম করিয়া চারিদিক লাল হইয়া আসে, চারিদিক কেন লাল হইয়া যায় বলিতে পারি না, আমার শিরায় শিরার কেন বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয় তাহা জানি না। সব বুঝিতে পারি, সমস্তই দেখিতে পাই, কিন্তু সময়ে সময়ে লালের হাত হইতে পরিত্রাণ পাই না। তবুও বলিতেছি তোমরা যাহা মনে করিয়া থাক তাহা সত্য নহে, আমি কখনও পাগল হই নাই। কি বলিতেছিলাম—বিবাহের কথা? নগদ দশ সহস্র রজতখণ্ড ও অর্দ্ধলক্ষাধিক মূল্যের অলঙ্কার মণ্ডিতা দশম বর্ষীয়া বালিকার পরিবর্ত্তে আত্মবিক্রয় করিতে পূর্ব্ববঙ্গে গিয়াছিলাম। নূতন শ্বশুরালয়ে যাইতে হইলে গোয়ালন্দ হইতে ষ্টীমারে গিয়া লৌহজঙ্গ হইতে নৌকা গ্রহণ করিতে হয়! যাইবার সময় আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হইয়াছিল, টিপি টিপি বৃষ্টি পড়িতেছিল! অশনি গর্জ্জনের মধ্যে সম্প্রদান কার্য্য সুসম্পন্ন হইয়া গিয়াছিল, কিন্তু বাসরে উল্লসিতা রমণীবৃন্দ যখন আনন্দোৎসবে উন্মত্ত হইয়া উঠিয়াছিল, তখন আমি যেন কাহার কলহাস্য শুনিতেছিলাম, কে যেন ঘরের চতুষ্পার্শ্বে অন্তরালে থাকিয়া আমাকে ব্যঙ্গ করিতেছিল, যেন বলিতেছিল সহস্র সহস্র বিবাহ করিলেও তুমি আমার থাকিবে, অপরের হইতে পারবে না। বাসর-শয্যায় চন্দন-মাল্য-চর্চ্চিত হইয়া যেন আমি লজ্জায় আড়ষ্ট হইয়া উঠিতেছিলাম। আমি ভাবিতেছিলাম হয়ত লীলা অন্তরাল হইতে আমাদের দেখিতেছে, সে আমার লীলা, কতবার শপথ করিয়া তাহাকে বলিয়াছি যে, ইহপরকালে আমি তাহারই, অপরের নহি।
বরবধূ যখন বিদায় হইল তখনও আকাশ পরিষ্কার হয় নাই। বিলম্ব হইবার ভরে সুরেন নৌকা ছাড়িয়া দিল, যখন ঝড় উঠল তখন ক্ষুদ্র নৌকা কীর্ত্তিনাশার মধ্যস্থলে। তাহার পর যাহা হইল তাহা বলিয়াছি। পিতার বিশ্বস্ত কর্ম্মচারী, মাতার সাধের বন্ধু, দশ সহস্র অথণ্ড মণ্ডলাকার কীর্ত্তিনাশার চরে রাখিয়া আসিয়াছি। কিন্তু আমি তাহারই, অপরের নহি।