উপক্রমণিকা।

 বঙ্কিমচন্দ্র লিখিয়া গিয়াছেন,—“গ্রীণলণ্ডের ইতিহাস লিখিত হইয়াছে; মাওরি-জাতির ইতিহাসও আছে; কিন্তু যে দেশে গৌড়-তাম্রলিপ্তি-সপ্তগ্রামাদি নগর ছিল, সে দেশের ইতিহাস নাই।” উপাদানের অভাবকে ইহার প্রকৃত কারণ বলিয়া স্বীকার করা যায় না;—অনুসন্ধানচেষ্টার অভাবই প্রধান অভাব।

 ইংরাজ-রাজপুরুষগণ ইহা অনুভব করিবামাত্র, অনুসন্ধান-কার্য্যে প্রবৃত্ত হইয়াছিলেন। তাঁহাদিগের শত-বর্ষব্যাপী অনুসন্ধান-চেষ্টায় যাহা কিছু আবিষ্কৃত হইয়াছে, তাহাতে অনুসন্ধানের প্রয়োজন তিরোহিত হয় নাই;—উত্তরোত্তর বর্দ্ধিত হইয়া উঠিয়াছে।

 যাহারা স্মরণাতীত পুরাকাল হইতে, বংশানুক্রমে এ দেশে বাস করিতে গিয়া, নানাবিধ জয়-পরাজয়ের ভিতর দিয়া বর্ত্তমান অবস্থায় উপনীত হইয়াছে, তাহাদিগের সহিত দেশের ইতিহাসের সম্বন্ধ সর্ব্বাপেক্ষা অধিক। তাহারা তথ্যানুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইলেই, অনুসন্ধান-চেষ্টা প্রকৃত পথে পরিচালিত হইতে পারে। ইহা এখন সকলেই মুক্তকণ্ঠে স্বীকার করিতেছেন।

 বিগত এক শত বৎসরের অনুসন্ধান-লব্ধ ঐতিহাসিক তথ্যের বিচার-কার্য্যে প্রবৃত্ত হইবামাত্র বুঝিতে পারা যায়,—মুসলমান-শাসন প্রবর্ত্তিত হইবার পূর্ব্ব-কালবর্ত্তী বরেন্দ্র-মণ্ডলের ইতিহাসের মধ্যেই সমগ্র বঙ্গবাসীর ইতিহাসের মূল-সূত্রের সন্ধান-লাভের আশা করা যাইতে পারে। বরেন্দ্র-ভূমি প্রাচীন ভূমি বলিয়া,—বরেন্দ্র-ভূমি “দেব-মাতৃক” বলিয়া,—[মহানন্দার পূর্ব্ব-তীর হইতে করতোয়ার পশ্চিম-তীর পর্য্যন্ত] নানা স্থানে এখনও অনেক রাজ-দুর্গের, অনেক রাজ-ভবনের, অনেক দেব-মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে বহু-বিস্ময়-বিজড়িত ঐতিহাসিক তথ্য প্রচ্ছন্ন হইয়া রহিয়াছে।

 ডাক্তার বুকানন্ হামিল্‌টন্, আলেকজান্ডার কানিংহাম, ওয়েষ্টমেকট্, রাভেন্‌সা, (স্যর উইলিয়ম) হণ্টার, অধ্যাপক ব্লক্‌ম্যান্ প্রভৃতি বহুসংখ্যক রাজকর্ম্মচারী বরেন্দ্র-ভূমির নানা স্থানে তথ্যানুসন্ধানের সূত্রপাত করিয়াছিলেন। তাঁহারাই বরেন্দ্র-তথ্যানুসন্ধানের প্রথম পথ-প্রদর্শক। কিন্তু অবসরের অভাবে, কেহই ধারাবাহিক রূপে দীর্ঘকাল অনুসন্ধান-কার্য্য পরিচালিত করিতে পারেন নাই।

 এই সকল কারণে,—বাঙ্গালীর ইতিহাসের উপাদান-সঙ্কলনের আশায়,—বরেন্দ্রমণ্ডলে ধারাবাহিক রূপে তথ্যানুসন্ধানের আয়োজন করিবার অভিপ্রায়ে,—দীঘাপতিয়ার রাজকুমার শ্রীযুক্ত শরৎকুমার রায় বাহাদুর এম্-এ, [১৯১০ খৃষ্টাব্দে] একটি “বরেন্দ্র-অনুসন্ধান-সমিতি” গঠিত করিয়া, তথ্যানুসন্ধানে ব্যাপৃত হইয়াছেন। তাঁহার অকাতর অর্থব্যয়, অক্লান্ত অধ্যবসায়, এবং প্রশংসনীয় ইতিহাসানুরাগ, অল্পকালের মধ্যেই, অনুসন্ধান-সমিতিকে সকলের নিকট সুপরিচিত করিয়া তুলিয়াছে।

 অনুসন্ধান-ক্ষেত্র এবং অনুসন্ধানের অবসর অল্প হইলেও, অনুসন্ধানের ফল নিতান্ত অল্প হয় নাই। প্রথম ফলই প্রধান ফল। দেশের লোকে দেশের ইতিহাসের উপাদান-সঙ্কলনে প্রবৃত্ত হইলে, কোন্ প্রণালীতে অনুসন্ধান-কার্য্য পরিচালিত করিতে হইবে, প্রথম হইতেই তাহা সম্যক্‌ প্রতিভাত হইয়াছে। আন্তরিক অনুরাগপূর্ণ সহৃদয়তার সঙ্গে, দেশের লোকের সহিত মিলিত হইয়া, তাহাদিগের সাহায্য লাভ করিতে না পারিলে, অনুসন্ধান-চেষ্টায় সম্যক্ সফলকাম হইবার আশা নাই। ইহা প্রথম হইতেই পরিলক্ষিত হইয়াছে। দেশের অধিকাংশ লোক নিরক্ষর,—অথচ তাহারাই পুরাকীর্ত্তির প্রকৃত সন্ধানদাতা। সহৃদয়তার অভাব থাকিলে, তাহাদিগের নিকট হইতে সকল বিষয়ের সন্ধান-লাভের সম্ভাবনা থাকে না। সহৃদয়তার অভাব না থাকিলে, তাহারাই স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া, নানা বিষয়ের সন্ধান প্রদান করে। অনুসন্ধান-সমিতি এই রূপেই অনেক অজ্ঞাতপূর্ব্ব অনুসন্ধান-ক্ষেত্রের সন্ধান-লাভে সমর্থ হইয়াছেন।

 অনুসন্ধান-সমিতি এ পর্য্যন্ত যতদূর অনুসন্ধান-কার্য্য পরিচালিত করিতে সমর্থ হইয়াছেন, তাহাতেই অনেক বিবরণ সঙ্কলিত হইয়াছে। বাঙ্গালীর ইতিহাসে উল্লিখিত হইবার যোগ্য অনেক স্থান আবিষ্কৃত ও পরীক্ষিত হইয়াছে, অনেক চিত্র সঙ্কলিত হইয়াছে, এবং অনেক পুরাকীর্ত্তির নিদর্শনও সংগৃহীত হইয়াছে। এই সকল নিদর্শন তিন শ্রেণীতে বিভক্ত হইবার যোগ্য,—(১) পুরাতন স্থাপত্যের নিদর্শন, (২) পুরাতন ভাস্কর্য্যের নিদর্শন, (৩) পুরাতন জ্ঞান-ধর্ম্ম-সভ্যতার নিদর্শন [অপ্রকাশিত ও অপরিজ্ঞাত হস্তলিখিত সংস্কৃত গ্রন্থ]।

 অনুসন্ধান-লব্ধ এবং পূর্ব্বাবিষ্কৃত ঐতিহাসিক তথ্য একত্র সন্নিবিষ্ট করিয়া, “গৌড়-বিবরণ” নামক [খণ্ডশঃ প্রকাশিতব্য] গ্রন্থ সংকলন করিবার প্রয়োজন অনুভূত হইবামাত্র, অনুসন্ধান-সমিতি তাহার ব্যবস্থা করিয়াছেন। ভিন্ন ভিন্ন বিষয় ভিন্ন ভিন্ন ভাগে আলোচিত হইবে বলিয়া, “গৌড়-বিবরণ” আট ভাগে বিভক্ত হইয়াছে। তাহা যথাক্রমে—রাজমালা, শিল্পকলা, বিবরণমালা, লেখমালা, গ্রন্থমালা, জাতিতত্ত্ব, শ্রীমূর্ত্তিতত্ত্ব, ও উপাসক-সম্প্রদায় নামে অভিহিত হইবে।

 গৌড়-বিবরণের প্রথম ভাগের প্রথম খণ্ড [অনুসন্ধান-সমিতির সুযোগ্য সম্পাদক শ্রীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দ বি-এ প্রণীত] “গৌড়রাজমালা” প্রকাশিত হইল। তাহার সম্পাদন-ভার আমার উপর ন্যস্ত করিয়া, অনুসন্ধান-সমিতি আমার প্রতি যৎপরোনাস্তি সমাদর প্রদর্শন করিয়াছেন। ইহা আমার পক্ষে নিরতিশয় শ্লাঘার বিষয় হইলেও, এই ভার যোগ্যতর হস্তে ন্যস্ত করিতে পারিলেই ভাল হইত।

 মুসলমান-শাসন প্রতিষ্ঠিত হইবার পূর্ব্বে, গৌড়মণ্ডলে সেনবংশীয় নরপালগণের বিজয়-রাজ্য প্রতিষ্ঠিত ছিল। তৎপূর্ব্বে পালবংশীয় নরপালগণ এ দেশের শাসন-কার্য্যে ব্যাপৃত ছিলেন। এ কথা ইতিহাস-বিমুখ বাঙ্গালীর নিকটও একেবারে অপরিচিত হইয়া পড়ে নাই। ইহার সঙ্গে জনশ্রুতি অনেক অলৌকিক কাহিনী জড়িত করিয়া দিয়াছে; কল্পনালোলুপ লেখকবৃন্দ তাহাকে অনেক রচনা-মাধুর্য্যে পল্পবিত করিয়া তুলিয়াছেন। কিন্তু কোন্ সময় হইতে, কিরূপ ঘটনাচক্রে, পাল-নরপালগণের অভ্যুদয় সাধিত হইয়াছিল;—কোন্ সময় হইতে, কিরূপ ঘটনাচক্রে তাঁহাদিগের রাজ্য সেন-বংশীয় নরপালগণের করতলগত হইয়া, আবার কালক্রমে হস্তচ্যুত হইয়া গিয়াছিল;—তাহার সহিত দেশের লোকের কতদূর পর্য্যন্ত কিরূপ সম্পর্ক বর্ত্তমান ছিল;—তাহা নানা তর্কবিতর্কে আচ্ছন্ন হইয়া পড়িয়াছে! বাঙ্গালীর ইতিহাসের এই সকল অবশ্য-জ্ঞাতব্য কথা [উপযুক্ত আলোচনা-প্রণালীর অভাবে] জনসাধারণের নিকট শ্রদ্ধালাভ করিতে পারে নাই। এরূপ অবস্থায়, অনুসন্ধান-লব্ধ যৎসামান্য বিবরণের উপর নির্ভর করিয়া, ধারাবাহিক ইতিহাস সঙ্কলন করা কিরূপ কঠিন ব্যাপার, তাহা স্মরণ করিয়াই, “গৌড়রাজমালা” অধ্যয়ন করিতে হইবে। এই গ্রন্থের প্রধান অবলম্বন ‘লেখমালা’,—তাহাতে পুরাতন তাম্রশাসনের এবং শিলালিপির পাঠ, বঙ্গানুবাদ এবং টীকা সন্নিবিষ্ট হইয়াছে। আর এক শ্রেণীর উল্লেখযোগ্য অবলম্বন,—ভারতবর্ষের অন্যান্য প্রদেশে আবিষ্কৃত তাম্রশাসনের এবং শিলালিপির পাঠ, পুরাতন পুস্তক-নিহিত ঐতিহাসিক জনশ্রুতি, এবং পূর্ব্বাচার্য্যগণের ঐতিহাসিক গবেষণা। তাহা গ্রন্থমধ্যে যথাস্থানে উল্লিখিত হইয়াছে। লেখক মহাশয় যেরূপ প্রমাণের উপর নির্ভর করিয়া, যেরূপ সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছেন, তাহা স্বাধীনভাবে ব্যক্ত করিয়াছেন। তাহা সঙ্গত হইয়াছে কি না, পাঠক-সমাজ তাহার বিচার করিবেন।

 ইতিহাসের উপাদান সঙ্কলিত না হইলে, ইতিহাস সঙ্কলিত হইতে পারে না;—তাহা বহুব্যয়সাধ্য, বহুশ্রমসাধ্য, বহুলোকসাধ্য;—এ সকল কথা বঙ্গসাহিত্যে পুনঃ পুনঃ উল্লিখিত হইয়াছে। কিন্তু ইহাকেই একমাত্র অন্তরায় বলিয়া নিশ্চিন্ত হইবার উপায় নাই। কিরূপ বিচার-পদ্ধতির আশ্রয় গ্রহণ করা কর্ত্তব্য, তদ্বিষয়েও সংকীর্ণতার অভাব নাই। ন্যায়নিষ্ঠ বিচারপতির ন্যায় নিয়ত সত্যোদ্ঘাটনের চেষ্টাই যে ইতিহাস-লেখকের প্রধান চেষ্টা, তাহা ভাল করিয়া আমাদিগের হৃদয়ঙ্গম হইয়াছে বলিয়া বোধ হয় না। কবি কহ্লণ ‘রাজতরঙ্গিণীর’ উপোদ্‌ঘাতে লিখিয়া গিয়াছেন,—

श्लाघ्यः स एव गुणवान् रागद्वेष-बहिष्कृता।
भूतार्थ-कथने यस्य स्थेयस्येव सरस्वती॥

 আমাদিগের সাহিত্যে এই উপদেশ-বাক্য এখনও সম্যক্ মর্য্যাদা লাভ করিতে পারে নাই। এখনও আমাদিগের ব্যক্তিগত, জাতিগত বা সম্প্রদায়গত অনুরাগ-বিরাগ, আমাদিগকে পূর্ব্ব হইতেই অনেক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের অনুকূল বা প্রতিকূল করিয়া রাখিয়াছে। পালবংশের এবং সেনবংশের নরপালগণের শাসন-সময়ে দেশের অবস্থা কিরূপ দাঁড়াইয়াছিল, তাহা যেন তুচ্ছ কথা,—তাঁহাদিগের জাতি কি ছিল, তাহাই এখনও আমাদিগের নিকট প্রধান আলোচ্য হইয়া রহিয়াছে! জনশ্রুতির দোহাই দিয়া, [এক শ্রেণীর গ্রন্থে] দেশের অবস্থা-সম্বন্ধে যে সকল আলোচনার সূত্রপাত হইতেছে, তাহাতে ঐতিহাসিক বিচার-প্রণালী মর্য্যাদা লাভ করিতেছেনা। এই সকল কারণে, গৌড়রাজমালার লেখক মহাশয় ভিত্তিহীন জনশ্রুতির উপর নির্ভর করিবার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেন নাই বলিয়া, বাঙ্গালীর জনশ্রুতি-মূলক ইতিহাসের প্রধান পাত্র [আদিশূর] ঐতিহাসিক ব্যক্তিরূপে মর্য্যাদা লাভ করিতে পারেন নাই। এখনও তাম্রশাসনে বা শিলালিপিতে বা সমকালবর্ত্তী গ্রন্থে আদিশূরের অসন্দিগ্ধ পরিচয় প্রকাশিত হয় নাই। সমসাময়িক গ্রন্থে বা লিপিতে উল্লিখিত ঐতিহাসিক পাত্রগণের প্রকৃত বিবরণ সঙ্কলনেও কিরূপ সতর্ক দৃষ্টিতে বিচার-কার্য্যে প্রবৃত্ত হইতে হইবে, সুযোগ্য লেখক মহাশয় “গৌড়াধিপ শশাঙ্কের” প্রসঙ্গে তাহার যথেষ্ট পরিচয় প্রদান করিয়াছেন।

 পক্ষান্তরে, “গৌড়রাজমালায়” দেখিতে পাওয়া যাইবে,—পাল-নরপালগণের অভ্যুদয়-লাভের অব্যবহিত পূর্ব্বে, সমগ্র দেশ বহুসংখ্যক খণ্ড-রাজ্যে বিভক্ত ছিল; সমগ্র দেশের উপর কাহারও কোন রূপ আধিপত্য বিদ্যমান ছিল না; বাহুবল প্রবল হইয়া উঠিয়াছিল; সবলের কবলে দুর্ব্বলদল নিপীড়িত হইতেছিল; দেশ একেবারে ‘অরাজক’ হইয়া পড়িয়াছিল! সংস্কৃত-সাহিত্যে এরূপ অবস্থার নাম “মাৎস্য ন্যায়”। তাহাকে বিদূরিত করিবার অভিপ্রায়ে, প্রজাপুঞ্জ গোপালদেবকে রাজা নির্ব্বাচিত করিয়াছিল। তিনিই পাল-নরপালবংশের প্রথম ভূপাল,—ইতিহাসে “প্রথম গোপালদেব” নামে উল্লিখিত।

 এ দেশের প্রজাপুঞ্জ, অরাজকতা দূর করিবার জন্য, এক বার এক জনকে রাজা নির্ব্বাচিত করিয়া, প্রজাশক্তির বিধিদত্ত অমোঘ বলের পরিচয় প্রদান করিয়াছিল,—ইহা বাঙ্গালীর ইতিহাসের সর্ব্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ঘটনা। পৃথিবীর কোন্ কোন্ দেশে, কোন্ কোন্ সময়ে, প্রজাশক্তির এরূপ উন্মেষ লক্ষিত হইয়াছে, তাহার আলোচনার সময়ে, বাঙ্গালীর ইতিহাসের এই উল্লেখযোগ্য ঘটনাটি স্মরণ করিবার যোগ্য।

 বাঙ্গালী ইহার কথা একেবারে বিস্মৃত হইয়া গিয়াছে! লামা তারানাথের [তিব্বতীয় ভাষা-নিবদ্ধ] গ্রন্থে এতদ্বিষয়ক জনশ্রুতির উল্লেখ থাকিলেও, এবং বঙ্গদেশে এই জনশ্রুতির আভাস লৌকিক উপকথায় গ্রথিত রহিলেও, তাহাকে কেহ ঐতিহাসিক ঘটনা বলিয়া গ্রহণ করেন নাই। কিন্তু গোপালদেবের পুত্র ধর্ম্মপালদেবের [মালদহের অন্তর্গত খালিমপুরে আবিষ্কৃত] তাম্রশাসনে ইহা স্পষ্টাক্ষরে উল্লিখিত থাকায়, এই উল্লেখযোগ্য ঘটনা ইতিহাসের মর্য্যাদা লাভ করিয়াছে। এই রূপে, [প্রজাশক্তির সাহায্যে] যে সাম্রাজ্য সংস্থাপিত হইয়াছিল, তাহা সমগ্র উত্তরাপথে [আর্য্যাবর্ত্তে] প্রভুত্ব লাভ করিয়াছিল। তাহার কথা এখনও বঙ্গসাহিত্যে যথাযোগ্য ভাবে আলোচিত হয় নাই। এই গৌড়ীয় সাম্রাজ্যের উত্থান-পতনের কথাই “গৌড়রাজমালার” প্রধান কথা। গৌড়-বিবরণের অন্যান্য ভাগে [শিল্পকলায়, বিবরণমালায়, লেখমালায়, গ্রন্থমালায়, জাতিতত্ত্বে, শ্রীমূর্ত্তিতত্ত্বে, এবং উপাসক-সম্প্রদায়ে] যাহা সন্নিবিষ্ট হইয়াছে, তাহারও প্রধান কথা,—এই গৌড়ীয়-সাম্রাজ্যের উথান-পতনের কথা। কারণ, ইহার সকল কথাই বাঙ্গালীর কথা।

 একটি কারণে, এ সকল কথা বাঙ্গালীর নিকট যথাযোগ্য সমাদর লাভ করিতে পারে নাই। পাল-নরপালগণের জন্মভূমি কোথায় ছিল, তাঁহারা কিরূপে গৌড়ীয় সাম্রাজ্যে অধিকার লাভ করিয়াছিলেন, তাহার আলোচনা করিতে গিয়া, অনেকেই সিদ্ধান্ত করিয়া গিয়াছেন,—তাঁহারা মগধবাসী, মগধের অধিপতি ছিলেন; এবং ক্রমে বঙ্গভূমিতে রাজ্য বিস্তৃত করিয়া, “গৌড়েশ্বর” উপাধি লাভ করিয়াছিলেন;—বাঙ্গালীরা তাঁহাদিগের পদানত হইয়াই বাস করিত। ধর্ম্মপালদেবের তাম্রশাসনে পাটলিপুত্রে, দেবপালদেবের তাম্রশাসনে মুদ্গগিরিতে [মুঙ্গেরে], এবং নারায়ণপালদেবের তাম্রশাসনেও মুদ্গগিরিতে “জয়স্কন্ধাবার” সংস্থাপিত থাকিবার প্রমাণ প্রাপ্ত হইয়া, [অনেকের ন্যায়] আমি নিজেও সিদ্ধান্ত করিয়াছিলাম,—পঞ্চ-পাল-নরপাল বঙ্গভূমিতে বাস করিতেন না। বরেন্দ্রমণ্ডলে অনুসন্ধান-কার্য্যে ব্যাপৃত হইবামাত্র, সে সিদ্ধান্ত পরিবর্ত্তিত হইয়া গিয়াছে। বরেন্দ্রমণ্ডলে সংস্থাপিত গরুড়-স্তম্ভের দ্বিতীয় শ্লোকে, ধর্ম্ম[পাল] প্রথমে পূর্ব্বদিকের অধিপতি থাকিয়া, পরে [মন্ত্রিবর গর্গের মন্ত্রণা-কৌশলে] “অখিল দিকের” অধিপতি হইবার উল্লেখ আছে। তারানাথের গ্রন্থেও, প্রথমে গৌড়, পরে মগধ, বিজিত হইবার পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে। “রামচরিত”-কাব্যে বরেন্দ্রভূমিই পাল-নরপালগণের “জনকভূমি” বলিয়া অভিহিত হইয়াছে। সুতরাং, পাল-নরপালগণ যে বাঙ্গালী ছিলেন, তাহাতে আর সংশয়-প্রকাশের উপায় নাই।

 পাল-নরপালগণ যদি বাঙ্গালী হইবেন, তবে তাঁহাদিগের রাজধানী কোথায় বিলুপ্ত হইয়া গেল? বাঙ্গালা দেশের কোন্ নিভৃত নিকেতনে বাঙ্গালীর নির্ব্বাচিত বাঙ্গালী নরপাল [গোপালদেব] রাজমুকুট মস্তকে ধারণ করিয়াছিলেন? কোন্ ভূমিখণ্ডে বাঙ্গালী প্রজাপুঞ্জের হৃদয় এরূপ অচিঞ্চিতপূর্ব্ব প্রজাশক্তি-বিকাশের প্রশংসনীয় গৌরবে স্ফীত ও স্পন্দিত হইয়া উঠিয়াছিল? কেহ কেহ [গৃহে বসিয়াই] ইহার মীমাংসা করিতে গিয়া, মীমাংসা-সাধনের অন্য উপায় না দেখিয়া, অনুমান-বলে সিদ্ধান্ত করিয়াছেন,—পাল নরপালগণের রাজধানী এক স্থানে প্রতিষ্ঠিত ছিল না; তাঁহারা জয়স্কন্ধাবারেই বাস করিতে ভাল বাসিতেন; যেখানে যখন জয়স্কন্ধাবার সংস্থাপিত হইত, সেখানেই একটি তৎকালোচিত রাজনগর গঠিত হইয়া উঠিত।

 রাজার পক্ষে এরূপ “যাযাবর-বৃত্তি” কখন কখন আনন্দপ্রদ হইবার সম্ভাবনা থাকিলেও, রাজ্যের পক্ষে এরূপ ব্যবস্থা নিতান্ত অসম্ভব বলিয়াই প্রতিভাত হইবে। যে রাজবংশ আর্য্যাবর্ত্তব্যাপী বিপুল সাম্রাজ্যের অধীশ্বর হইয়াছিল, কোনও স্থানেই তাহার স্থায়ী রাজধানী বর্ত্তমান ছিল না,—এরূপ অনুমানের আশ্রয় গ্রহণ করিতে সাহসী না হইয়া,—অনুসন্ধান-সমিতি, বরেন্দ্র-মণ্ডলে অনুসন্ধান-কার্য্যে ব্যাপৃত হইয়া, বিবিধ রাজনগরের ধ্বংসাবশেষের সন্ধান লাভ করিয়াছেন। “বিবরণ-মালায়” তাহার বিবরণ এবং প্রমাণাবলী সন্নিবিষ্ট হইয়াছে।

 এ পর্য্যন্ত পাল-রাজবংশের দ্বিতীয়, তৃতীয়, পঞ্চম, নবম, একাদশ, এবং সপ্তদশ নরপালের তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হইয়াছে। এই সকল প্রাচীন লিপির সাহায্যে বুঝিতে পারা যায়,—প্রথম নরপালের সময়ে, সাম্রাজ্য-প্রতিষ্ঠার সূত্রপাত;—দ্বিতীয় এবং তৃতীয় নরপালের সময়ে, তাহার প্রকৃত অভ্যুদয়;—চতুর্থ এবং পঞ্চম নরপালের সময় পর্য্যন্ত গৌড়মণ্ডলে পাল-নরপালগণের শাসনক্ষমতা অক্ষুণ্ণ প্রতাপে বর্ত্তমান। এই অভ্যুদয়-যুগ বাঙ্গালীর ইতিহাসের গৌরব-যুগ। এই যুগে, বরেন্দ্রমণ্ডলে জন্মগ্রহণ করিয়া, [ধর্ম্মপালদেবের এবং দেবপালদেবের শাসন-সময়ে] ধীমান্‌ এবং তৎপুত্র বীতপাল গৌড়ীয় শিল্পে যে অনিন্দ্য-সুন্দর রচনা-প্রতিভা বিকশিত করিয়াছিলেন, তাহার বিবরণ “শিল্পকলায়” সন্নিবিষ্ট হইয়াছে। তাহার সন্ধান-লাভে অসমর্থ হইয়া, লেখকগণ এই যুগের মগধের এবং উৎকলের শিল্প-নিদর্শনকে মগধের এবং উৎকলের প্রাদেশিক শিল্প-প্রতিভার নিদর্শন বলিয়াই ব্যাখ্যা করিয়া আসিতেছেন।

 ইহার পরবর্ত্তী যুগের [খৃষ্টীয় একাদশ এবং দ্বাদশ শতাব্দীর] বাঙ্গালীর ইতিহাসও তমসাচ্ছন্ন হইয়া রহিয়াছে। অনুসন্ধান-সমিতি এই যুগের যে সকল বিবরণ সঙ্কলিত করিতে সমর্থ হইয়াছেন, তদনুসারে এই দুই শত বৎসরের ইতিহাস পাঁচ ভাগে বিভক্ত হইতে পারে। কারণ, এই দুই শত বৎসরের মধ্যে, পাঁচ বার ভাগ্য-বিবর্ত্তনের পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে।

 প্রথম ভাগে, একটি প্রবল বিপ্লবের অবসানে, পাল-সম্রাজ্যের পুনরাবির্ভাব। তাহার নায়ক প্রথম মহীপালদেব, এবং ফলভোগী তদীয় পুত্র নয়পাল এবং পৌত্র তৃতীয় বিগ্রহপাল। তাঁহাদিগের কথাই একাদশ শতাব্দীর প্রধান কথা।

 দ্বিতীয় ভাগে, একটি অচিঞ্চিতপূর্ব্ব আকস্মিক প্রজা-বিদ্রোহ, রাজহত্যা, এবং কিয়ৎকালের জন্য এক কৈবর্ত্ত-রাজবংশের অভ্যুদয় ও তিরোভাব। তৎকালের প্রধান পাত্রগণের নাম [অনীতিকারম্ভ-রত] দ্বিতীয় মহীপালদেব, তাঁহার নিধনকারী [প্রজা-বিদ্রোহের নায়ক] কৈবর্ত্তপতি দিব্বোক, তদীয় ভ্রাতা রূদোক, এবং রূদোকের পুত্র ভীম রাজা।

 তৃতীয় ভাগে, কৈবর্ত্ত-বিদ্রোহের অবসানে, পাল-রাজগণের জনক-ভূমির [বরেন্দ্রের] উদ্ধার-সাধনের পর, পাল-সাম্রাজ্যের পুনরভ্যুদয় এবং অধঃপতন। এই সময়ের নরপালগণের নাম—শূরপাল, রামপাল, রামপালের পুত্র কুমারপাল, পৌত্র তৃতীয় গোপাল, এবং কুমারপালের ভ্রাতা মদনপাল।

 চতুর্থ ভাগে, সেন-রাজবংশের অভ্যুদয় এবং রাজ্য-বিস্তার; তাহার নায়ক—বিজয়সেন, বিজয়সেনের পুত্র বল্লালসেন, এবং পৌত্র লক্ষ্মণসেন।

 পঞ্চম ভাগ শেষভাগ,—তাহাতে বাঙ্গালা দেশে মুসলমান-অধিকার প্রচলিত হইবার সূত্রপাত।

 এই পাঁচ ভাগে বিভক্ত [খৃষ্টীয় একাদশ-দ্বাদশ শতাব্দীর] বাঙ্গালীর ইতিহাসের বিচিত্র ঘটনাবলী দেশের লোকে বিস্মৃত হইয়া গেলেও, বরেন্দ্রমণ্ডলে তাহার নানা স্মৃতিচিহ্ন বর্ত্তমান আছে। সেই সকল স্মৃতিচিহ্ন ধরিয়া, অনুসন্ধান-কার্য্যে প্রবৃত্ত না হইলে, এই দুই শত বৎসরের ইতিহাসের প্রকৃত মর্ম্ম হৃদয়ঙ্গম হইতে পারে না।

 প্রথম ভাগে যে বিপুল বিপ্লবের কথা উল্লিখিত হইয়াছে, শতাধিক বৎসর পূর্ব্বে [১৮০৬ খৃষ্টাব্দে বরেন্দ্রমণ্ডলের অন্তর্গত দিনাজপুর জেলার আমগাছী গ্রামে] আবিষ্কৃত তৃতীয় বিগ্রহপালদেবের তাম্রশাসনের একটি শ্লোকে তাহা সূচিত থাকিতেও, অক্ষর-বিলোপের অত্যাচারে, অনেক দিন পর্য্যন্ত তাহার সম্পূর্ণ পাঠ উদ্ধৃত হইতে পারে নাই। এই শ্লোকটি নবম নরপাল মহীপালদেবের [বরেন্দ্রমণ্ডলের অন্তর্গত দিনাজপুর জেলার বাণগড়ে আবিষ্কৃত] তাম্রশাসনেও উৎকীর্ণ থাকায়, উত্তরকালে ইহার প্রকৃত পাঠ উদ্ধৃত হইয়াছিল। যথা,—

“हत-सकलविपक्षः सङ्गरे वाहु-दर्पात्
अनधिकृत-विलुप्तं राज्य मासाद्य पित्र्यम्।
निहित-चरणपद्मो भूभृतां मुर्द्ध्नि तस्मात्
अभवदवनिपालः श्रीमहीपालदेव:॥”

 ইহাতে জানিতে পারা গিয়াছিল,—মহীপালদেবের পিতৃরাজ্য “অনধিকারী” কর্ত্তৃক বিলুপ্ত হইয়াছিল, এবং তিনি তাহা পুনরায় বাহুবলে লাভ করিয়াছিলেন। কিন্তু সেই অনধিকারী কে,—তাহা অপরিজ্ঞাত ছিল।

 সেই অনধিকারীর নাম এখনও অপরিজ্ঞাত রহিয়া গিয়াছে। কিন্তু তিনি ৮৮৮ শকাব্দায় [৯৬৬ খৃষ্টাব্দে] বরেন্দ্রমণ্ডলে শিবমন্দির প্রতিষ্ঠিত করিয়া, আপনাকে “কাম্বোজান্বয়জ গৌড়পতি” বলিয়া প্রস্তরস্তম্ভে যে শ্লোক উৎকীর্ণ করাইয়াছিলেন, সেই শ্লোক-সংযুক্ত প্রস্তর-স্তম্ভটি অদ্যাপি বরেন্দ্রমণ্ডলেই [দিনাজপুরাধিপতির উদ্যান মধ্যে] বর্ত্তমান আছে। তাহার সহিত বাঙ্গালীর ইতিহাসের সম্বন্ধ কি, “গৌড়রাজমালায়” তাহা বিস্তৃতভাবে ব্যাখ্যাত হইয়াছে। এইরূপে বাঙ্গালীর ইতিহাসে,—পালরাজবংশের অধিকারকালে,—কাম্বোজান্বয়জ [আগন্তুক] গৌড়পতির সন্ধান-লাভের পর, অনুসন্ধান-সমিতির সুযোগ্য সম্পাদক মহাশয় সেই নবাবিষ্কৃত ঐতিহাসিক সমাচার একটি ইংরাজী প্রবন্ধে লিপিবদ্ধ করিয়াছিলেন। তাহা স্বনামখ্যাত সুপণ্ডিত স্যর আশুতোষ মুখোপাধ্যায় সরস্বতী মহাশয়ের কৃপায়] এসিয়াটিক্ সোসাইটীর পত্রিকায় এবং [একটি বাঙ্গালা প্রবন্ধে] ‘সাহিত্য’ পত্রে মুদ্রিত হইয়াছে।

 দ্বিতীয় ভাগে যে প্রজা-বিদ্রোহ উল্লিখিত হইয়াছে, তাহা পাল-রাজবংশের পঞ্চদশ নরপাল কুমারপালের প্রধান মন্ত্রী [কামরূপাধিপতি] বৈদ্যদেবের [কমৌলীতে আবিষ্কৃত] তাম্রশাসনের একটি শ্লোকে সূচিত হইয়াছিল। ভীমকে নিহত করিবার পর, বরেন্দ্রীর [জনকভূর] পুনরুদ্ধার-সাধনের কথা এই শ্লোকে রামপালদেবের প্রধান কীর্ত্তি-কথা বলিয়া উল্লিখিত থাকিতেও, অধ্যাপক ভিনিস্, তাহার ব্যাখ্যাকালে, “জনকভূমিকে” মিথিলা বলিয়া ব্যাখ্যা করায়, বাঙ্গালীর ইতিহাসের এই উল্লেখযোগ্য ঘটনাটি তমসাচ্ছন্ন হইয়া পড়িয়াছিল। বরেন্দ্রমণ্ডলে এখনও এই প্রজা-বিদ্রোহের নানা স্মৃতিচিহ্ন বর্ত্তমান আছে। তাহার বিস্তৃত বিবরণ “বিবরণমালায়” সন্নিবিষ্ট হইয়াছে।

 এক সময়ে এই প্রজা-বিদ্রোহের কথা বাঙ্গালীর ঘরে ঘরে সুপরিচিত ছিল। শতবর্ষ পূর্ব্বেও বুকানন্ হামিলটন্ তদ্বিষয়ক জনশ্রুতির সন্ধানলাভ করিয়াছিলেন। সমকালবর্ত্তী বরেন্দ্র-নিবাসী রাজকবি সন্ধ্যাকর নন্দী, এই ঘটনা অবলম্বন করিয়া, সংস্কৃত ভাষায় ‘রামচরিত’ নামক একখানি কাব্য রচনা করিয়াছিলেন। মহামহোপাধ্যায় পণ্ডিতবর শ্রীযুক্ত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এম্-এ, মহাশয়ের প্রশংসনীয় উদ্যমে, তাহা নেপাল হইতে আনীত হইয়া, [এসিয়াটিক্ সোসাইটির যত্নে,] মুদ্রিত হইয়াছে। “গৌড়রাজমালায়” এই বিদ্রোহ-ব্যাপারের আদ্যন্তের বিবরণ উল্লিখিত হইয়াছে। প্রজাপুঞ্জের নির্ব্বাচনক্রমে যে রাজবংশ প্রতিষ্ঠা লাভ করিয়া, প্রজাশক্তির সাহায্যে সমগ্র উত্তরাপথব্যাপী বিপুল সাম্রাজ্য সংস্থাপিত করিতে সমর্থ হইয়াছিল,—যে রাজবংশের প্রবল পরাক্রমশালী নরপাল দেবপালদেবও, তদীয় মন্ত্রিবরের সম্মুখে, সচকিতভাবে সিংহাসনে উপবেশন করিতেন বলিয়া বরেন্দ্রমণ্ডলের গরুড়স্তম্ভ-লিপিতে উল্লেখ প্রাপ্ত হওয়া যায়,—সেই রাজবংশে জন্মগ্রহণ করিয়া, দ্বিতীয় মহীপালদেব [অনীতি-পরায়ণ হইয়াই] প্রজা-বিদ্রোহ প্রধূমিত করিয়া তুলিয়াছিলেন; এবং তাহাতে স্বয়ং ভস্মীভূত হইয়া, বরেন্দ্রমণ্ডল হইতে পাল-রাজবংশের শাসন-ক্ষমতাও কিয়ৎকালের জন্য ভস্মীভূত করিয়াছিলেন। বরেন্দ্রমণ্ডলে পুনরায় অধিকার লাভ করিতে, রামপালদেবকে বিপুল সমর-সজ্জার আয়োজন করিতে হইয়াছিল; বহু যুদ্ধে তিল তিল করিয়া, বরেন্দ্রভূমিতে বিজয়-লাভ করিতে হইয়াছিল। ইহাতেই তৎকালের লোকনায়কগণের প্রবল শক্তির পরিচয় প্রকাশিত হইয়া রহিয়াছে। বরেন্দ্রমণ্ডলের এই ক্ষণস্থায়ী প্রজা-বিদ্রোহের একটি চিরস্থায়ী কীর্ত্তি-স্তম্ভ এখনও সমুন্নত শিরে সগৌরবে দণ্ডায়মান রহিয়াছে। তাহার কথা বাঙ্গালীর ইতিহাসে স্থানলাভ করিতে পারে নাই;—বরেন্দ্রমণ্ডলের সহিত পরিচয়ের অভাবে, রামচরিত কাব্য মুদ্রিত করিবার সময়ে, সুপণ্ডিত শাস্ত্রী মহাশয়ের নিকটেও তাহা প্রতিভাত হইতে পারে নাই।

 ভীমের নাম এখনও জনশ্রুতি হইতে বিলুপ্ত হয় নাই। তিনি রামপালদেবের আক্রমণ-বেগ প্রতিহত করিবার আশায়, বরেন্দ্রমণ্ডলের প্রান্তভাগের নানা স্থানে, যে সকল মৃৎপ্রাকার রচনা করাইয়াছিলেন, তাহা এখনও “ভীমের ডাইঙ্গ” এবং “ভীমের জাঙ্গাল” নামে কথিত হইতেছে। কিন্তু কল্পনা-লোলুপ জনসাধারণ তাহাকে মধ্যম পাণ্ডবের কীর্ত্তিচিহ্ন বলিয়া বর্ণনা করিতেছে; কোন কোন আধুনিক ইতিহাস-লেখক তাহাকেই বরেন্দ্রভূমির অতি-প্রাচীনত্বের নিদর্শন বলিয়া ইতিহাস রচনা করিতেছেন।

 তৃতীয় ভাগের প্রধান কথা “রামাবতী”র কথা। প্রজা-বিদ্রোহের অবসানে, রামপালদেব এক নূতন নগর নির্ম্মাণ করিয়াছিলেন। তাহাই পাল-রাজবংশের শেষ রাজধানী—“রামাবতী।” সন্ধ্যাকর নন্দী “রামচরিত” কাব্যে এই নগর-নির্ম্মাণেরও বিস্তৃত বিবরণ লিপিবদ্ধ করিয়া গিয়াছেন। তাহা বরেন্দ্রভূমির শোভাবর্দ্ধন করিয়াছিল। যে ভূমি “অপুনর্ভবা” নামক মহাতীর্থে সুপবিত্র এবং “জাগদ্বল-মহাবিহারে” সুশোভিত,—সেই বরেন্দ্র-ভূমিতেই “রামাবতী” নির্ম্মিত হইয়াছিল। পণ্ডিতবর শাস্ত্রী মহাশয়, তৎপ্রতি লক্ষ্য না করিয়া, তাহাকে পূর্ব্ববঙ্গের “রামপাল” বলিয়া [রামচরিত কাব্যের ভূমিকায়] পার্শ্ব-টীকায় ইঙ্গিত করিয়াছেন। অনুসন্ধান-সমিতি রামাবতীর, জগদ্বল-মহাবিহারের এবং অপুনর্ভবা তীর্থের অনুসন্ধান করিয়া, নানা ধ্বংসাবশেষ দর্শন করিয়া আসিয়াছেন। রামাবতীর নাম এখন বাঙ্গালীর নিকট সম্পূর্ণ অপরিচিত হইলেও, অনেক দিন পর্য্যন্ত সুপরিচিত ছিল। “সেখ শুভোদয়া” নামক [মালদহের অন্তর্গত পাণ্ডুয়ার মস্‌জেদে প্রাপ্ত] হস্ত-লিখিত সংস্কৃত গ্রন্থে “রামাবতীর” প্রথম উল্লেখ দেখিতে পাওয়া গিয়াছিল। সে অনেক দিনের কথা। তখন তাহার সহিত বাঙ্গালীর ইতিহাসের সম্পর্ক-বিচারে প্রবৃত্ত হইবার প্রবৃত্তি উপস্থিত হয় নাই। কিন্তু বরেন্দ্রমণ্ডলের অন্তর্গত দিনাজপুর জেলার মনহলি গ্রামে আবিষ্কৃত পালরাজবংশের সপ্তদশ নরপাল মদনপালদেবের তাম্রশাসনে “রামাবতী-পরিসরে” জয়স্কন্ধাবার প্রতিষ্ঠিত থাকিবার উল্লেখ দেখিয়া, প্রাচ্যবিদ্যা-মহার্ণব শ্রীযুক্ত নগেন্দ্রনাথ বসু মহাশয় [বরেন্দ্রমণ্ডলে পদার্পণ না করিয়াও] তাহাকে দিনাজপুরের অন্তর্গত একটি স্থানের সহিত মিলাইয়া লইবার চেষ্টা করিয়াছিলেন। সে চেষ্টা সফল হয় নাই। কিন্তু তাহা প্রথম চেষ্টা বলিয়া, উল্লিখিত হইবার যোগ্য।

 রামপাল প্রজা-বিদ্রোহের প্রকোপে জন্মভূমি হইতে তাড়িত হইবার পর, নানা ক্লেশে জন্মভূমির উদ্ধার সাধন করিয়া, যেরূপ অধ্যবসায়ের এবং কষ্ট-সহিষ্ণুতার পরিচয় প্রদান করিয়াছিলেন, তাহা স্মরণ করিয়া, রাজকবি তাঁহাকে দ্বিতীয় রামচন্দ্র বলিয়া অভিহিত করিয়া গিয়াছেন। যাঁহার বাহুবলে এবং মন্ত্রণা-কৌশলে রামপাল বিজয়লাভ করিয়াছিলেন, তিনি রামপালের মাতুল এবং চির-সুহৃৎ অঙ্গাধিপতি মহনদেব। “সেখ শুভোদয়া” গ্রন্থে দেখিতে পাওয়া গিয়াছিল,—

“शाके युग्मवेणुरन्ध्रगते(?) कन्यां गते भास्करे
कृष्णे वाक्‌पति-वासरे यमतिथौ यामद्वये वासरे।
जाह्नव्यां जलमध्यत स्त्वनशनै र्ध्यात्वा पदं चक्रिणो
हा पालान्वय-मौलि-मण्डनमणि: श्रीरामपालो मृतः॥”

রামপাল ভাগীরথী-গর্ভে অনশনে তনুত্যাগ করিয়াছিলেন। এরূপ আত্ম-বিসর্জ্জনের কারণ কি, “সেখ শুভোদয়া”-গ্রন্থে তাহার পরিচয়-লাভের উপায় ছিল না। রামচরিত কাব্যে সে পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে;—মহনদেবের মৃত্যু-সংবাদ শ্রবণ করিয়াই, শোকার্ত্ত রামপালদেব আত্ম-বিসর্জ্জন করিয়াছিলেন। তাহার পর, কুমারপাল সিংহাসনে আরোহণ করিলে, [বরেন্দ্রমণ্ডলে আরও কিয়ৎকাল পাল-রাজবংশের অধিকার অক্ষুণ্ণ থাকিলেও] “অনুত্তর-বঙ্গে” এবং কামরূপে বিদ্রোহ-বিকার প্রবল হইয়া উঠিয়াছিল। কুমারপালের প্রধান মন্ত্রী বৈদ্যদেবের বাহুবলে তাহা দূরীভূত হইলেও, পালসাম্রাজ্য আর পূর্ব্ব প্রতাপে সঞ্জীবিত হইতে পারে নাই। কুমারপালের মৃত্যুর পরে, তদীয় শিশুপুত্র তৃতীয় গোপাল, এবং [তাঁহার অকাল-মৃত্যুর পর] কুমারপালের ভ্রাতা মদনপাল, সিংহাসনে আরোহণ করিয়াছিলেন। সেই শেষ। তাহার পর আর বরেন্দ্রমণ্ডলে পাল-নরপালগণের প্রবল প্রতাপের পরিচয় প্রকাশিত হয় নাই।

 চতুর্থ ভাগে সেন-রাজবংশের অভ্যুদয়। তাহা এই সকল কারণেই, সফল হইবার অবসর লাভ করিয়াছিল। সেন-রাজবংশ বাঙ্গালার শেষ হিন্দু-রাজবংশ হইলেও, কিরূপে সে রাজবংশ এ দেশে প্রতিষ্ঠা-লাভ করিয়াছিল, তাহা এখনও তমসাচ্ছন্ন হইয়া রহিয়াছে। অন্ধকার ভেদ করিয়া, ঐতিহাসিক তথ্যের আবিষ্কার সাধন করিবার উপযোগী অধিক প্রমাণ অদ্যাপি আবিষ্কৃত হয় নাই। জনশ্রুতি এই রাজবংশকে নানা কল্পনা-জল্পনার আধার করিয়া তুলিয়াছে। এই রাজবংশের অধঃপতন-কাহিনীর ন্যায় ইহার অভ্যুদয়-কাহিনীও প্রহেলিকাপূর্ণ হইয়া রহিয়াছে। সম্প্রতি [কাটোয়ার নিকটবর্ত্তী স্থানে] এই রাজবংশের দ্বিতীয় রাজা বল্লালসেনদেবের যে তাম্রশাসন আবিষ্কৃত হইয়াছে, তাহাতে নানা সংশয় মুখরিত হইয়া উঠিয়াছে।

 সেন-রাজবংশের প্রথম রাজা বিজয়সেনদেবের [রাজসাহীর অন্তর্গত দেবপাড়ায় প্রাপ্ত] প্রদ্যুম্নেশ্বর-মন্দিরলিপিতে দেখিতে পাওয়া যায়,—

“वंशे तस्यामरस्त्री-विततरतकला-साक्षिणो दाक्षिणात्य
क्षौनीन्द्रै र्व्वीरसेनप्रभृतिभि रभितः कौर्त्तिमद्भि र्व्वभूवे।
यञ्चारिचानुचिन्ता-परिचयशुचयः सूक्ति-माध्वौकधाराः
पाराशर्य्येण विश्व-श्रवणपरिसर-प्रीणनाय प्रणीताः॥”

 [পারাশর্য্য] ব্যাসদেব যাঁহাদিগের চরিত্র-বর্ণনায় বিশ্বনিবাসিগণকে প্রীতি প্রদান করিয়া গিয়াছেন, সেই চন্দ্রবংশীয় দাক্ষিণাত্য-ভূপতি বীরসেন প্রভৃতির বংশে সেনরাজার জন্মগ্রহণ করিবার এইরূপ প্রমাণ প্রাপ্ত হইয়াও, [মহাভারতোক্ত নলরাজার পিতা বীরসেনের কথা চিন্তা না করিয়া] কেহ কেহ বীরসেনকে আদিশূর বলিয়াই ব্যাখ্যা করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন! বীরসেন-বংশধর বিজয়সেনদেবের পিতামহ সামন্তসেন যোদ্ধৃপুরুষ ছিলেন।

“दुर्व्वृत्ताना मयमरिकुलाकीर्ण-कर्णाटलक्ष्मी-
लुण्ठाकानां कदन मतनोत्ताट्टगेकाङ्गवीरः।
यस्मादद्याप्यविहत-वसामांसमेदः-सुभिक्षां
हृष्यत् पौर स्त्यजति न दिशां दक्षिणां प्रेतभर्त्ता॥”

তিনি “কর্ণাটলক্ষ্মী-লুণ্ঠনকারী-দুর্ব্বৃত্তগণের কদন” বিধান করিয়াছিলেন। পরবর্ত্তী শ্লোকে দেখিতে পাওয়া যায়,—তিনি গঙ্গাপুলিন-পরিসরের পুণ্যাশ্রমনিচয়েই শেষ জীবন অতিবাহিত করিয়াছিলেন। বিজয়সেনের পৌত্র লক্ষ্মণসেনদেবের [মাধাই নগরে প্রাপ্ত] তাম্রশাসনে দেখিতে পাওয়া যায়,—সেনরাজগণ কর্ণাটক্ষত্রিয়-বংশ অলঙ্কৃত করিয়াছিলেন। বিজয়সেনের পুত্র বল্লালসেনদেবের [কাটোয়ার নিকটে প্রাপ্ত] তাম্রশাসনে দেখিতে পাওয়া যায়,—রাজ্যলাভের পূর্ব্বে, বিজয়সেনের পিতৃ-পিতামহ রাঢ়দেশকে বিভূষিত করিয়াছিলেন।

 গৌড়রাজমালার লেখক মহাশয় এই সকল প্রমাণের অবতারণা করিয়া, প্রাচীন লিপির “কর্ণাট”-রাজ্য কোথায় ছিল, তাহার পরিচয় প্রদানের জন্য, [বিহ্লনদেবের বিক্রমাঙ্ক-চরিতের এবং কহ্লণের রাজতরঙ্গিণীর উপর নির্ভর করিয়া] কল্যাণের চালুক্য-রাজগণের রাজ্যকেই “কর্ণাট” বলিয়া গ্রহণ করিয়াছেন। “কর্ণাটেন্দু” বিক্রমাদিত্য কর্ত্তৃক [১০৪০-১০৭১ খৃষ্টাব্দের মধ্যবর্ত্তী সময়ে] গৌড়-কামরূপ পরাভূত হইবার একটি কাহিনী “বিক্রমাঙ্কদেবচরিতে” উল্লিখিত আছে।

 ইহাকে ঐতিহাসিক প্রমাণ বলিয়া গ্রহণ করিলে,—ইহাকেই কর্ণাট-রাজের সহিত গৌড়-রাজের প্রথম সংঘর্ষ বলিয়া স্বীকার না করিয়া, ইহার পূর্ব্বেও, [গৌড়াধিপ প্রথম মহীপালদেবের শাসন-সময়ে] আর একটি সংঘর্ষ উপস্থিত হইয়াছিল বলিয়া অনুমান করা যাইতে পারে। সে সংঘর্ষে গৌড়াধিপ মহীপালদেব বিজয়লাভ করিয়াছিলেন; তাঁহার বিজয়োৎসবকে চিরস্মরণীয় করিবার জন্য “চণ্ডকৌশিক” নাটক রচিত ও অভিনীত হইয়াছিল। তাহার “প্রস্তাবনায়” দেখিতে পাওয়া যায়,—

 “अलमति विस्तरेण। आदिष्टोऽस्मि दुष्टामात्य-वुद्धिवागुराऽलङ्घ्य-सिंहरंहसा भ्रूभङ्गलीला-समुद्धृताशेष-कण्टकेन समर-सागरान्तर्भ्रमद्भुजदण्ड-मन्दराकृष्ट-लक्ष्मी-स्वयंवर-प्रणयिना श्रीमहीपालदेवेन। यस्येमां पुराविदः प्रशस्तिगाथा मुदाहरन्ति—

य: संश्रित्य प्रकृतिगहना मार्य्यचाणक्य-नीतिं
जित्वा नन्दान् कुसुमनगरं चन्द्रगुप्तो जिगाय।
कर्णाटत्वं ध्रुवमुपगतानद्य तानेव हन्तुं
दोर्दपाठ्य: स पुन रभवत् श्रीमहोपालदेवः॥”

 নান্দীপাঠ সমাপ্ত হইবার পরেই সূত্রধার বলিতেছেন—থাক্ থাক্, আর [পূর্ব্বরঙ্গের] অতি-বিস্তারের প্রয়োজন নাই। আমরা শ্রীমহীপালদেব-কর্ত্তৃক নাট্যাভিনয়ার্থ আদিষ্ট হইয়াছি। তিনি দুষ্টামাত্যবর্গের বুদ্ধিজালে আবদ্ধ হইবার অযোগ্য অলংখ্য সিংহ-শক্তিসম্পন্ন বলিয়া, ভ্রূভঙ্গলীলায় অশেষ ক্ষুদ্র কণ্টক উদ্ধৃত করিয়া দিয়াছেন। সমর-সাগর হইতে তদীয় মন্দররূপী ভুজদণ্ডের আকর্ষণ-বলে বিজয়-লক্ষ্মী উত্থিত হইয়া, তাঁহাকে স্বয়ংবর-প্রণয়ী করিয়াছে। পুরাবিদ্‌গণ তাঁহার সম্বন্ধে এই প্রশস্তি-গাথা উদ্ধৃত করিয়া থাকেন—

 “যে চন্দ্রগুপ্ত স্বভাব-দুর্ব্বোধ আর্য্যচাণক্য-নীতির আশ্রয়গ্রহণ করিয়া, নন্দরাজগণকে পরাভূত ও কুসুমপুর অধিকৃত করিয়াছিলেন, সম্প্রতি নন্দগণ কর্ণাটত্ব-লাভ করিয়া পুনর্জন্ম গ্রহণ করায়, তাঁহাদিগের নিধন সাধনের জন্য, সেই চন্দ্রগুপ্ত আবার শ্রীমন্মহীপালদেবরূপে পুনর্জন্ম গ্রহণ করিয়াছেন।”

 মহামহোপাধ্যায় শ্রীযুক্ত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী এম্-এ, [রামচরিতের ভূমিকায়] ইহাকে মহীপাল কর্ত্তৃক রাজেন্দ্র চোড়ের পরাভব-কাহিনী বলিয়া ব্যাখ্যা করিতে গিয়া, কর্ণাট-রাজ্যকে চোল-রাজ্যের একাংশরূপে গ্রহণ করিয়াছেন। শ্রীযুক্ত রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এম্-এ, তাহাকেই প্রমাণরূপে গ্রহণ করিয়া, সেনরাজ-বংশের পূর্ব্বপুরুষগণকে রাজেন্দ্রচোড়ের সেনানায়ক বলিয়া সিদ্ধান্ত করিতে চাহিয়াছেন। চোলরাজকে কর্ণাটরাজ বলিয়া গ্রহণ করিবার উপযোগী বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ দেখিতে না পাইয়া, গৌড়রাজমালা-লেখক কল্যাণের চালুক্য-রাজ্যকেই কর্ণাট-রাজ্য বলিয়া গ্রহণ করিতে বাধ্য হইয়াছেন। কর্ণাট-শব্দের এরূপ অর্থে চণ্ডকৌশিকের প্রস্তাবনা পাঠ করিলে, বলা যাইতে পারে—অনেকদিন হইতেই প্রাচ্যভারতের গৌড়ীয়সাম্রাজ্য করতলগত করিবার জন্য অনেকের হৃদয়ে উচ্চাভিলাষ প্রবল হইয়া উঠিয়ছিল। অনেকেই গৌড়রাজ্য আক্রমণ করিয়াছিলেন, এবং পরাভূত হইয়া, স্বরাজ্যে প্রস্থান করিতে বাধ্য হইয়াছিলেন। কল্যাণের চালুক্যরাজগণের উচ্চাভিলাষের অভাব ছিল না; তাঁহারাও মহীপালদেবের সহিত একবার শক্তি পরীক্ষা করিয়াছিলেন। তাহার ফলে “কর্ণাটলক্ষ্মী” লুণ্ঠিত হইয়াছিল,—মহীপালের বিজয়োৎসবে নাট্যাভিনয় সম্পাদিত হইয়াছিল। সেনরাজবংশের পূর্ব্বপুরুষগণ এই সকল যুদ্ধবিগ্রহে লিপ্ত থাকিয়া, কালক্রমে [দক্ষিণরাঢ়ে কর্ণাটরাজের প্রভুত্ব সংস্থাপিত হইবার পর], বাঙ্গালী প্রজাপুঞ্জের নির্ব্বাচিত পাল-রাজবংশের প্রবল সাম্রাজ্যের কেন্দ্রস্থল বরেন্দ্রমণ্ডলেও অধিকার বিস্তার করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন।

 কিরূপে “দাক্ষিণাত্য-ক্ষৌণীন্দ্রবংশোদ্ভব” সেনরাজবংশ এদেশে প্রকৃত প্রস্তাবে অধিকার লাভ করিয়ছিল, তাহা এখনও নিঃসংশয়ে স্থিরীকৃত হইবার সময় উপস্থিত হয় নাই। এখনও সেই চেষ্টায়, লেখকবর্গ নানা প্রস্তাব উত্থাপিত করিয়া, ঐতিহাসিক কারণ-পরম্পরার মর্ম্মোদ্ঘাটনের আয়োজন করিতেছেন। এই রূপেই ঐতিহাসিক তথ্য আবিষ্কৃত হইয়া থাকে,—যে সকল প্রস্তাব উত্থাপিত হয়, তাহা অলীক বলিয়া প্রতিপাদিত হইলেও, তাহার প্রয়োজন অস্বীকৃত হয় না। গৌড়রাজমালার লেখকও সেইরূপ প্রয়োজনেই, ঐতিহাসিক তথ্যের সন্ধান-লাভের আশায়, এই সকল প্রস্তাবের অবতারণা করিয়াছেন বলিয়া, ইহাকে সেইরূপ অর্থেই গ্রহণ করিতে হইবে। ইহাতে অনুসন্ধিৎসা প্রবল হইয়া, প্রকৃত তথ্যের আবিষ্কার সাধন করিতে পারিলে, এরূপ প্রস্তাব উত্থাপিত করিবার উদেশ্য সফলতা লাভ করিবে। এ দেশে আধিপত্য লাভ করিবার পূর্ব্বে, সেনরাজগণ যে দেশে থাকুন না কেন, তাঁহারা আমাদিগের দেশের পুরাতন অধিবাসী ছিলেন না,—তাঁহারা আগন্তুক,—তাঁহাদিগের গৌড়বিজয় গৌড়জনের পরাজয়,—তাঁহাদিগের অভ্যুদয় গৌড়ীয় সাম্রাজ্যের অধঃপতনের প্রথম সোপান। সেখ শুভোদয়া-গ্রন্থে দেখিতে পাওয়া গিয়াছিল,—রামপালদেব তনুত্যাগ করিলে, মন্ত্রিবর্গ পরামর্শ করিয়া, শিবোপাসক কাঠুরিয়া বিজয়সেনকে সিংহাসনে সংস্থাপিত করিয়াছিলেন। এ পর্য্যন্ত ইহার অনুকূল প্রমাণ আবিষ্কৃত হয় নাই। পাল-সাম্রাজ্যের অধঃপতন-সময়ে সেনরাজগণ যে কোন না কোন উপায়ে, পালরাজগণের শিথিল মুষ্টি হইতে রাজদণ্ড কাড়িয়া লইয়া, গৌড়মণ্ডলে একটি আগন্তুক রাজবংশের প্রতিষ্ঠাসাধনে সফলকাম হইয়াছিলেন, তদ্বিষয়ে সংশয় নাই। এ পর্য্যন্ত প্রাচীন লিপিতে যাহা কিছু প্রমাণ আবিষ্কৃত হইয়াছে, তাহাতে সেন-রাজ্য বাহুবলের রাজ্য বলিয়াই প্রকাশিত হইয়াছে; তাহা পাল-রাজ্যের ন্যায় প্রজাপুঞ্জের নির্ব্বাচন-প্রণালীতে গঠিত গৌড়ীয় সাম্রাজ্য বলিয়া কথিত হইতে পারে না।

 এই সাম্রাজ্য পাল-সাম্রাজ্যের ন্যায় সকল উত্তরাপথে প্রাধান্য রক্ষা করিতে সমর্থ হয় নাই। রণ-পাণ্ডিত্যের অভাব না থাকিলেও,—কাশীধামে, প্রয়াগধামে এবং পুরুষোত্তমক্ষেত্রে জয়স্তম্ভ সংস্থাপিত করিবার প্রমাণ-শ্লোকের অসদ্ভাব না থাকিলেও,—সেন-রাজবংশের অধিকারভুক্ত প্রাচ্য-সাম্রাজ্য পতনোন্মুখ অবস্থায় পতিত হইয়াছিল, এবং অল্পকালের মধ্যে, [মুসলমানের সহিত প্রথম সংঘর্ষেই,] পশ্চিমাঞ্চল পরিত্যাগ করিয়া, পূর্ব্বাঞ্চলের আশ্রয় গ্রহণ করিতে বাধ্য হইয়াছিল।

 কোন্ সময়ে, কাহার শাসনকালে, কিরূপ ঘটনাচক্রে, মুসলমান-শাসন প্রবর্ত্তিত হইবার সূত্রপাত হইয়াছিল, তদ্বিষয়ে নানা তর্কবিতর্ক প্রচলিত হইয়াছে। গৌড়রাজমালা-লেখক তদ্বিষয়ে অনেক নূতন তর্ক উত্থাপিত করিয়াছেন। তাহা বিচারসহ হইয়াছে কিনা, ভবিষ্যতের তথ্যালোচনায় তাহা মীমাংসিত হইতে পরিবে। সুতরাং তাহাকে লেখক মহাশয়ের তথ্যানুসন্ধান-চেষ্টা-সূচক ব্যক্তিগত মত বলিয়াই পাঠকগণ তাহার আলোচনা করিতে পারিবেন।

 সেনরাজবংশের অভ্যুদয়লাভের মূল কারণ সহসা আবিষ্কৃত হইবার আশা না থাকিলেও, তাঁহাদিগের প্রথম রাজধানী কোথায় ছিল, তাহার আবিষ্কার-সাধনের জন্যই, অনুসন্ধান-সমিতি চেষ্টা করিয়াছিলেন। সে চেষ্টা সফল হইয়াছে। তাহাতে উৎসাহ লাভ করিবার পরেই, অনুসন্ধান-সমিতি ক্রমে ক্রমে পাল-রাজবংশের বিবিধ রাজধানীর ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত করিবারও সুযোগ প্রাপ্ত হইয়াছেন।

 অনেক দিন হইতে সেন-রাজবংশের এবং পাল-রাজবংশের ইতিহাস-সংকলনের জন্য নানা চেষ্টা প্রবর্ত্তিত হইয়াছে। সে সকল চেষ্টা পুস্তকালয়ের সাহায্যে, [গৃহে বসিয়া,] ইতিহাস-সংকলনের চেষ্টা বলিয়া কথিত হইতে পারে। তাহাতেই নানা তর্কবিতর্ক বিপুলতা লাভ করিয়াছে। যে সকল স্থানে অনুসন্ধান-কার্য্যে অগ্রসর হইলে, তর্কবিতর্ক নিরস্ত হইতে পারিত, তথায় অনুসন্ধানে প্রবৃত্ত হইবার প্রয়োজন অনুভূত হইত না বলিয়া, পুরাতন লিপিতে উল্লিখিত অনেক ঐতিহাসিক তথ্য নানা পুস্তকে মুদ্রিত হইবার পরেও, [ব্যাখ্যা-বিভ্রাটে] তাহার প্রকৃত মর্ম্ম অনুভূত হইতে পারে নাই। অনুসন্ধান-ক্ষেত্রে অগ্রসর হইবামাত্র, ইহার বিবিধ পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে; এবং তাহা বিস্তৃতভাবে “লেখমালায়” আলোচিত হইয়াছে।

 ধোয়ী কবির পবনদূত আবিষ্কৃত ও মুদ্রিত হইবার পর জানিতে পারা গিয়াছিল,—বিজয়পুর নামক রাজধানীতে লক্ষ্মণসেনদেবের অভিষেক-ক্রিয়া সম্পন্ন হইয়াছিল। বল্লালসেন তাঁহার “দানসাগর” গ্রন্থে লিখিয়া গিয়াছেন—তাঁহার পিতা বিজয়সেনদেব “বরেন্দ্রে” প্রাদুর্ভূত হইয়াছিলেন, এবং তাঁহার গুরু অনিরুদ্ধ ভট্ট “শ্লাঘ্যে বরেন্দ্রীতলে” জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। এই সকল সমাচার অবগত হইয়াও, অনেকে নবদ্বীপকেই “বিজয়পুর” বলিয়া ব্যাখ্যা করিয়াছেন;—বরেন্দ্রের কোন্ নিভৃত প্রদেশে বিজয়সেনদেবের প্রাদুর্ভাব-ক্ষেত্র অগৌরবে লুকাইয়া রহিয়াছে, কেহ তাহার অনুসন্ধান করিবার চেষ্টা করেন নাই। রাজসাহী জেলার [গোদাগাড়ী থানার অন্তর্গত] দেবপাড়া গ্রামে সেন-রাজবংশের প্রথম শিলালিপি আবিষ্কৃত হইবার পরেও, কেহ কখন তাহার প্রাপ্তি-স্থান পরিদর্শন করিবার প্রয়োজন অনুভব করেন নাই। অনুসন্ধান-সমিতি এই স্থান হইতেই অনুসন্ধানকার্য্যের সূত্রপাত করিতে গিয়া, বিজয়নগরের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে, নানা পুরাকীর্ত্তির নিদর্শন সংগৃহীত করিতে সমর্থ হইয়াছেন। তাহার বিস্তৃত বিবরণ চিত্রাদিসহ “বিবরণমালায়” সন্নিবিষ্ট হইয়াছে।

 বিজয়সেনদেব বরেন্দ্রভূমির সকল স্থানে, বা তাহার বাহিরে কোনও স্থানে, অধিকার বিস্তার করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন কি না, এখনও তাহার বিশ্বাসযোগ্য নিদর্শন আবিষ্কৃত হয় নাই। এখন কেবল বরেন্দ্রভূমির দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে, রাজসাহী জেলার [গোদাগাড়ী থানার অন্তর্গত] বিজয়নগর অঞ্চলেই, বিজয়-রাজার নাম লোকমুখে শ্রবণ করা গিয়াছে; তাঁহার রাজবাটীর ধ্বংসাবশেষের সন্ধানলাভ করা গিয়াছে; এবং তাঁহার স্মৃতি-বিজড়িত বহুসংখ্যক “বিতত তল্ল” কেবল এই অঞ্চলেই দেখিতে পাওয়া গিয়াছে। কিন্তু তাঁহার পুত্র-পৌত্রের শ্রীবিক্রমপুর-সমাবাসিত-জয়স্কন্ধাবারের কথা, এবং তাঁহার পৌত্রের শ্রীবিক্রমপুরের জয়স্কন্ধাবারে আশ্রয়গ্রহণ করিয়া, [মুসলমান-অভিযানের প্রথম প্রকোপ প্রতিহত করিয়া] পূর্ব্ববঙ্গের স্বাতন্ত্র্যরক্ষার কথা, তাম্রশাসনে এবং মুসলমান-ইতিহাস-লেখকগণের গ্রন্থে উল্লিখিত আছে। তজ্জন্য, বিক্রমপুর-অঞ্চলেও তথ্যানুসন্ধানের প্রয়োজন অনুভূত হইয়াছে। তথায়, [অনুসন্ধান-সমিতির উপদেশে ও উৎসাহে] শ্রীযুক্ত যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত মহাশয়, অশেষ অধ্যবসায়-বলে, অনেক পুরাকীর্ত্তির নিদর্শন সংগৃহীত করিয়াছেন। বিবরণমালায়, শিল্পকলায়, এবং গ্রন্থমালায় তাহার নানা পরিচয় সন্নিবিষ্ট হইয়াছে।

 গৌড়রাজমালায় নরপালগণের শাসনকাল নির্ণয়ের জন্য অধিক আড়ম্বর প্রকাশিত হয় নাই। তাহা এখনও নানা তর্কবিতর্কে আচ্ছন্ন হইয়া রহিয়াছে। তথাপি, যে সকল প্রমাণের আলোচনা করিলে, নরপালগণের শাসনকালের আভাস প্রাপ্ত হইবার সম্ভাবনা আছে, তাহার কথা যথাস্থানে আলোচিত হইয়াছে। এই গ্রন্থ সঙ্কলিত হইবার সময়ে, পাল-রাজবংশের শাসনকাল-বিজ্ঞাপক অনেক অপ্রকাশিত প্রাচীন-লিপি কলিকাতার যাদুঘরে সংগৃহীত হইয়াছে। তাহার সাহায্যে, পাল-নরপালগণের শাসন-কালের সন-তারিখ-নির্ণয়ের নূতন উদ্যম প্রকাশিত হইতে পারিবে।

 রাজা, রাজ্য, রাজধানী, যুদ্ধবিগ্রহ এবং জয়-পরাজয়,—ইহার সকল কথাই ইতিহাসের কথা। তথাপি কেবল এই সকল কথা লইয়াই ইতিহাস সঙ্কলিত হইতে পারে না। বাঙ্গালীর ইতিহাসের প্রধান কথা—বাঙ্গালী জনসাধারণের কথা। জনসাধারণের সকল কথার প্রধান কথা তাহাদিগের ধর্ম্মবিশ্বাসের কথা। ভারতবর্ষের জনসাধারণের পক্ষে তাহাকে একমাত্র কথা বলিলেও, অত্যুক্তি হইবে না। কারণ, ধর্ম্মবিশ্বাসই অধিকাংশ কার্য্যের গতি-নির্দ্দেশ করিয়াছে;—ধর্ম্মের জন্য দেবমূর্ত্তি গঠিত হইয়াছে, দেবমূর্ত্তির জন্য বিচিত্র দেবালয় নির্ম্মিত হইয়াছে, দেবালয়ের প্রচলিত অৰ্চ্চনা-প্রণালীর জন্য উপচার-সংগ্রহের প্রয়োজন অনুভূত হইয়াছে, দেব-লোকের প্রীতি-সম্পাদনের আশায় জলাশয় খানিত হইয়াছে, চিকিৎসালয় সংস্থাপিত হইয়াছে, পান্থশালা নির্ম্মিত হইয়াছে, বিবিধ বিদ্যালয়ে শাস্ত্রালোচনা প্রচলিত হইয়াছে,—কৃষি-শিল্প-বাণিজ্য-ব্যাপারে উপার্জ্জিত অর্থ, গ্রাসাচ্ছাদনের প্রয়োজন সাধিত করিয়া, দেব-কার্য্যেই উৎসর্গীকৃত হইয়াছে। ধর্ম্ম-বিশ্বাসের সঙ্গে যে সকল আচার-ব্যবহার জড়িত হইয়া পড়িয়ছে, তাহার সাহায্যে বাঙ্গালীর জাতিগত পরিচয় লাভ করিবার সম্ভাবনা আছে। কোন্ পুরাকাল হইতে, কিরূপ ঘটনাচক্রে, এ দেশের অধিবাসিবর্গ তাহাদিগের শিক্ষাদীক্ষার এবং আচার-ব্যবহারের প্রভাবে বর্ত্তমান অবস্থায় উপনীত হইয়াছে, তাহার কথাই প্রধান কথা। অনুসন্ধান-সমিতি তদ্বিষয়ে যে সকল অনুসন্ধান-কার্য্যের সূত্রপাত করিয়াছেন, “গৌড়ীয় উপাসক সম্প্রদায়” নামক গ্রন্থাংশে তাহা আলোচিত হইবে। বঙ্গভূমি যে বহুযুগের বহুবিধ শিক্ষা-দীক্ষার মিলন-ভূমি,—আপাত-প্রতীয়মান মত-পার্থক্যের সমন্বয়ভূমি,—অনন্যসাধারণ স্বাতন্ত্র্য-লিপ্সার কৌতূহলপূর্ণ সাধনভূমি—তাহার নানা পরিচয় প্রাপ্ত হওয়া গিয়াছে। এই ভূমিকে স্বতন্ত্র কেন্দ্র করিয়া, ভারতীয় শিক্ষা-দীক্ষা ও সভ্যতা ভারতবর্ষের বাহিরেও নানা দিগ্দেশে ব্যাপ্ত হইয়া পড়িয়ছিল। এই সকল কারণে, বাঙ্গালীর ইতিহাসকে বঙ্গভূমির চতুঃসীমাভুক্ত সঙ্কীর্ণ ক্ষেত্রের ইতিহাস বলিয়া বিচ্ছিন্নভাবে অধ্যয়ন করিবার উপায় নাই। তাহা একদিকে যেমন বাঙ্গালীর ইতিহাস, অন্যদিকে সেইরূপ মানব-ইতিহাসেরও একটি উল্লেখযোগ্য অধ্যায় বলিয়া পরিচিত হইতে পারে। মানব-প্রতিভা, দেশ-কাল-পাত্রের প্রভাবে, কিয়ৎপরিমাণে বিভিন্ন পন্থায় অগ্রসর হইয়া, বিভিন্ন শ্রেণীর পরিণতি লাভের চেষ্টা করিলেও, তাহার অভ্যন্তরে সমগ্র মানব-সমাজের অস্ফুট আকাঙ্ক্ষার পরিচয় প্রদান করে। বাঙ্গালীর ইতিহাসেও তাহার সন্ধানলাভের সম্ভাবনা আছে। সে ইতিহাস সন-তারিখের তালিকায় ভারাক্রান্ত না হইয়াও, অনেক জ্ঞাতব্য তথ্যের সন্ধান প্রদান করিতে পরিবে।

 যাঁহারা এই অধমকে সারথ্যে বরণ করিয়া, অকাতরে বরেন্দ্র-ভ্রমণের অশেষ ক্লেশ সহ্য করিয়াও, অকুণ্ঠিত-চিত্তে অনুসন্ধান-কার্য্যে ব্যাপৃত রহিয়াছেন, তাঁহাদিগের অধ্যয়নানুরাগ, অধ্যবসায়, তথ্যাবিষ্কারে উৎসাহ বঙ্গসাহিত্যে সুপরিচিত। তাঁহারা দিঘাপতিয়ার রাজকুমার শরৎকুমার রায় বাহাদুর এম্-এ, এবং শ্রীযুক্ত রমাপ্রসাদ চন্দ বি-এ। যাঁহারা এই অনুসন্ধান-কার্য্যে বিবিধ প্রকারে সাহচর্য্য করিয়া, অনুসন্ধান-কার্য্যকে অগ্রসর হইবার সুযোগ প্রদান করিয়া আসিতেছেন, তাঁহাদিগের নাম শ্রীমান্ রাজেন্দ্রলাল আচার্য্য বি-এ, শ্রীযুক্ত যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত, শ্রীযুক্ত অধ্যাপক গোলাম ইয়াজ্‌দানী এম্-এ, শ্রীমান্‌ শ্রীরাম মৈত্র, শ্রীযুক্ত বৈদ্যনাথ সান্যাল বি-এল, অধ্যাপক শ্রীশচন্দ্র শাস্ত্রী বি-এ, অধ্যাপক রাধাগোবিন্দ বসাক এম্-এ, শ্রীমান্‌ দেবেন্দ্রগতি রায়, শ্রীযুক্ত কালীপ্রসন্ন আচার্য্য বি-এল, পণ্ডিতবর শ্রীযুক্ত গিরীশচন্দ্র বেদান্ততীর্থ ও শ্রীযুক্ত সতীশচন্দ্র সিদ্ধান্তভূষণ, এবং অনুসন্ধান-সমিতির স্নেহাস্পদ চিত্রকর শ্রীমান্ অনাথবন্ধু মৈত্রেয়।

 যাঁহারা এই অনুসন্ধান-কার্য্যের পৃষ্ঠপোষক হইতে সম্মত হইয়াছেন, তাঁহাদিগের মধ্যে রাজসাহী বিভাগের মাননীয় কমিশনার সুপণ্ডিত এফ্, জে, মোনাহেন মহোদয়ের নাম সর্ব্বাগ্রে উল্লেখযোগ্য। তিনি ক্লেশ স্বীকার করিয়া, বিবিধ অনুসন্ধান-ক্ষেত্র স্বয়ং পরিদর্শন করিয়াছেন, সংগৃহীত পুরাকীর্ত্তির নিদর্শন-নিচয় পরীক্ষা করিয়া দেখিয়াছেন, এবং গুরবমিশ্রের গরুড়-স্তম্ভের সংরক্ষণচেষ্টার যথোপযুক্ত ব্যবস্থা করিয়া দিয়া, সমগ্র বঙ্গদেশের ধন্যবাদের পাত্র হইয়াছেন। অন্য পৃষ্ঠপোষকগণের মধ্যে দিনাজপুরের মাননীয় মহারাজ গিরিজানাথ রায় বাহাদুর, এবং দীঘাপতিয়ার মাননীয় রাজা প্রমদানাথ রায় বাহাদুর অনুসন্ধান-সমিতির অকৃত্রিম কৃতজ্ঞতার পাত্র।

 যাঁহারা অযাচিতভাবে অনুসন্ধান-সমিতিকে অভ্যর্থনা করিয়া, আতিথ্যে, উপদেশে, অজ্ঞাত অনুসন্ধান-ক্ষেত্রের সন্ধান-প্রদানে, সাহায্যে, সদ্ব্যবহারে বিবিধ বিধানে উৎসাহ দান করিয়াছেন, তাঁহাদিগের মধ্যে নবদ্বীপাধিপতি মহারাজ ক্ষৌণীশচন্দ্র রায় বাহাদুর, দীঘাপতিয়ার চতুর্থ রাজকুমার শ্রীযুক্ত হেমেন্দ্রকুমার রায়, মহারাজকুমার শ্রীযুক্ত গোপাললাল রায় (রঙ্গপুর), বর্দ্ধনকুটীর রাজকুমার শ্রীযুক্ত চন্দ্রকিশোর রায়, রায় বাহাদুর শ্রীযুক্ত রাধাগোবিন্দ রায় সাহেব (দিনাজপুর), রায় বাহাদুর শ্রীযুক্ত কেদারপ্রসন্ন লাহিড়ী (কাশিমপুর—রাজসাহী), রায় বাহাদুর কুমুদিনীকান্ত বন্দ্যোপাধ্যায় (রাজসাহী), শ্রীযুক্তা মীনা কুমারী, শ্রীযুক্তা হেমলতা চৌধুরাণী, শ্রীযুক্ত ললিতমোহন মৈত্র, শ্রীযুক্ত রমাপ্রসাদ মল্লিক (রাজসাহী), শ্রীযুক্ত সুরেন্দ্রচন্দ্র রায়-চৌধুরী, শ্রীযুক্ত সুরেশচন্দ্র রায়-চৌধুরী, শ্রীযুক্ত নারায়ণচন্দ্র রায়-চৌধুরী, (মহাদেবপুর—রাজসাহী) শ্রীযুক্ত যোগেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (মনহলি—দিনাজপুর), শ্রীযুক্ত রাজেন্দ্রচন্দ্র সান্যাল (বালুরঘাট—দিনাজপুর), শ্রীযুক্ত ভুবনমোহন মৈত্র, শ্রীযুক্ত কিশোরীমোহন চৌধুরী, এম্-এ, বি-এল, শ্রীযুক্ত কালীচরণ সাহা, শ্রীযুক্ত হরিমোহন চৌধুরী, হাজি সেখ লালমহম্মদ (রাজসাহী), হাজি সেখ সিরাজুদ্দীন (বগুড়া), শ্রীযুক্ত করুণাকুমার দত্ত-গুপ্ত, এম্-এ, বি-ই, শ্রীযুক্ত যোগীন্দ্রচন্দ্র চক্রবর্ত্তী, এম্-এ, বি-এল, (দিনাজপুর) শ্রীযুক্ত নলিনীকান্ত অধিকারী, শ্রীযুক্ত চিন্তাহরণ মুখোপাধ্যায় (বালুরঘাট—দিনাজপুর), শ্রীযুক্ত অমরেন্দ্রনাথ পাল-চৌধুরী (রাণাঘাট—নদীয়া) এবং শ্রীযুক্ত মহেন্দ্রকুমার সাহা-চৌধুরী, বি-এল, মহোদযগণের নাম উল্লেখ যোগ্য।

 যাঁহারা সমিতির সদস্যগণের পরিচর্য্যার ভার গ্রহণ করিয়া, বিবিধ দুৰ্গম স্থানে অম্লানবদলে সেবাকার্য্যে ব্যাপৃত রহিয়াছেন, তাঁহাদিগের মধ্যে দয়ারামপুর-রাজবাটীর কর্ম্মচারী শ্রীযুক্ত প্রিয়নাথ সরকার, শ্রীযুক্ত পণ্ডিত কৃষ্ণলাল গোস্বামী, ও যোগেন্দ্রনাথ গোস্বামী, শ্রীযুক্ত দুর্গাকান্ত কারকুন, শ্রীযুক্ত সুরেশ্বর বিদ্যাবিনোদ, শ্রীযুক্ত শশিভূষণ বিশ্বাস ও শ্রীযুক্ত যামিনীকান্ত মুন্সীর নাম উল্লেখযোগ্য।

 যিনি স্বয়ং নির্লিপ্ত থাকিয়া, নানা প্রকারে অনুসন্ধান-সমিতিকে উত্তরোত্তর বিবিধ তথ্যসঙ্কলনের সুযোগদান করিয়াও, আপন নাম লোক-সমাজের নিকট অপ্রকাশিত রাখিয়াছেন, অনুসন্ধান-সমিতির অকৃত্রিম কল্যাণাকাঙ্ক্ষী সেই প্রিয়দর্শন দীঘাপতিয়ার রাজকুমার শ্রীযুক্ত বসন্তকুমার রায় এম-এ, বি-এল, মহোদয়ের নিকট কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন ও তাঁহার কল্যাণকামনা করিয়া, এই সংক্ষিপ্ত উপক্রমণিকা সমাপ্তিলাভ করিল।

॥शिवमस्तु॥

শ্রীঅক্ষয়কুমার মৈত্রেয়।