মগধে আবিষ্কৃত শিলালিপিতে মহেন্দ্রপাল এবং গোবিন্দপাল নামক আরও দুই জন পাল নরপালের পরিচয় পাওয়া যায়। শিলালিপিতে এবং তাম্রশাসনে প্রত্যেক পাল-নরপালের নামের অন্তে, ‘দেব’-শব্দ দেখিতে পাওয়া যায়। কিন্তু যে দুইখানি শিলালিপিতে মহেন্দ্রপালের নাম উল্লিখত হইয়াছে, তাহার কোন খানিতেই মহেন্দ্রপালকে “মহেন্দ্রপালদেব” বলা হয় নাই।[] ইহাতে মনে হয়, মহেন্দ্রপাল পাল-নরপালগণের বংশ-সম্ভূত এবং তাঁহাদের স্থলবর্ত্তী নাও হইতে পারেন। কিন্তু গোবিন্দপালের যে পরিচয় পাওয়া যায়, তাহা হইতে অনুমান হয়, তিনি পাল-রাজগণের বংশোদ্ভব এবং পালবংশের শেষ নৃপতি। নেপাল হইতে সংগৃহীত এবং লণ্ডনের রয়াল এসিয়াটিক্ সোসাইটীর পুস্তকালয়ে রক্ষিত একখানি হস্তলিখিত “অষ্টসাহশ্রিকা প্রজ্ঞা-পারমিতা” গ্রন্থের সমাপ্তি-বাক্যের পরে লিখিত আছে,—“পরমেশ্বর-পরমভট্টারক-পরমসৌগত-মহারাজাধিরাজ-শ্রীমদ্গোবিন্দপালবিজয়-রাজ্য-সম্বৎ ৪॥” এই পুস্তকের লেখায় ব্যবহৃত অক্ষরের মধ্যে ত, ন, ম এবং র দেবপাড়ার শিলালিপির ত, ন, ম এবং রএর মত বর্ত্তমান বঙ্গাক্ষরের ঢঙ্গের।[] গয়ার একখানি শিলালিপি হইতে গোবিন্দপালের রাজ্যের অবসান-কাল নিরূপণ করা যায়। এই শিলালিপির সম্পাদন-কাল সম্বন্ধে উল্লিখিত হইয়াছ—“সম্বৎ ১২৩২ বিকারি-সম্বৎসরে শ্রীগোবিন্দপালদেব-গতরাজ্যে চতুর্দ্দশ-সম্বৎসরে গয়ায়াং॥”[] ১২৩২ বিক্রম-সম্বৎ বা ১১৭৫ খৃষ্টাব্দের চতুর্দ্দশ বৎসর পূর্ব্বে, অর্থাৎ ১১৬১ খৃষ্টাব্দে, গোবিন্দপালের রাজত্বের অবসান হইয়াছিল। গোবিন্দপাল বা তাঁহার পূর্ববর্ত্তী নৃপতি হয়ত বিজয়সেন কর্ত্তৃক বরেন্দ্র হইতে তাড়িত হইয়া, মগধে আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিলেন। ১২০২ বিক্রম-সম্বতে [১১৪৬ খৃষ্টাব্দে] কান্যকুব্জেশ্বর গোবিন্দচন্দ্র মগধ আক্রমণ করিয়াছিলেন। কারণ, গোবিন্দচন্দ্রের এই সালের একখানি তাম্রশাসনে[] উল্লিখিত হইয়াছে, উহা মুদ্‌গগিরি বা মুঙ্গেরে সম্পাদিত হইয়াছিল। নেপাল হইতে সংগৃহীত এবং কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পুস্তকালয়ে রক্ষিত একখানি হস্ত-লিখিত পুস্তকের উপসংহারে লিখিত আছে,[]—“পরমেশ্বরেত্যাদি রাজাবলী পূর্ব্ববৎ শ্রীমদ্গোবিন্দপাল-দেবানাং বিনষ্টরাজ্যে অষ্টত্রিংশৎ সম্বৎসরেভিলিখ্যমানো।” এ স্থলে বিনষ্ট-রাজ্যের উল্লেখ দেখিয়া অনুমান হয়, কোনও শত্রুকর্ত্তৃক গোবিন্দপাল রাজ্যচ্যুত হইয়াছিলেন। গোবিন্দপালের রাজ্যনষ্টকারী সম্ভবত বিজয়সেনের পুত্র বল্লালসেন। গোবিন্দপালের রাজ্যনাশের ১৪ এবং ৩৮ বৎসর পরেও, তাঁহার বিনষ্ট বা গতরাজ্যের হিসাবে, সাল-গণনার প্রচলন দেখিয়া মনে হয়, যিনি গোবিন্দপালের রাজ্য নষ্ট করিয়াছিলেন, তিনি সেই স্থলে স্বীয় আধিপত্য সুদৃঢ়রূপে প্রতিষ্ঠিত করিতে সমর্থ হইয়াছিলেন না। তিনি ভাঙ্গিতে পারিয়াছিলেন বটে, কিন্তু নূতন করিয়া গড়িবার অবসর পাইয়াছিলেন না। এই জন্যই বিজেতার বিজয়-রাজ্যের সম্বৎসর প্রচলিত হইয়াছিল না; বিজিত গোবিন্দপালের বিনষ্ট রাজ্যের সম্বৎসরই প্রচলিত ছিল।

 যে দুইটি স্বতন্ত্র রাজবংশ অভ্যুদিত হইয়া, পাল-রাজবংশ উন্মূলিত করিয়াছিল, তন্মধ্যে বঙ্গের বর্ম্মা-বংশ পূর্ব্বতন এবং প্রথম উল্লেখযোগ্য। বর্ম্মা-বশের ইতিবৃত্ত-সঙ্কলনকারীর প্রধান অবলম্বন হরিবর্ম্মার তাম্রশাসন, এবং হরিবর্ম্মার ও তাঁহার পুত্রের মন্ত্রী ভট্ট-ভবদেব-বালবলভীভুজঙ্গের ভুবনেশ্বরের প্রশস্তি। হরিবর্ম্মার তাম্রশাসনের পশ্চাদ্ভাগের অস্পষ্ট প্রতিকৃতি এবং তাহার একটি আনুমানিক পাঠ মাত্রই প্রকাশিত হইয়াছে।[] এই অংশ হইতে জানিতে পারা যায়—“বিক্রমপুর-সমাবাসিত শ্রীমজ্জয়স্কন্ধাবার হইতে মহারাজাধিরাজ-জ্যোতিবর্ম্ম-পাদানুধ্যাত-পরমবৈষ্ণব-পরমেশ্বর-পরমভট্টারক-মহারাজাধিরাজ-শ্রীহরিবর্ম্মদেব” ভূমিদান করিতেছেন। ভট্ট-ভবদেব-বালবলভী-ভুজঙ্গের প্রশস্তিতে উক্ত হইয়াছে,—সাবর্ণমুনির বংশধর শ্রোত্রিয়গণ যে সকল গ্রামে বাস করিতেন, তন্মধ্যে রাঢ় বা রাঢ়দেশের অলঙ্কার সিদ্ধলগ্রাম সর্ব্বাগ্রগণ্য। এই গ্রামের একটি সমুন্নত বংশে (প্রথম) ভবদেব জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন। তিনি গৌড়নৃপ হইতে হস্তিনীভিট্ট নামক গ্রাম প্রাপ্ত হইয়াছিলেন। এই ভবদেবের পুত্র রথাঙ্গ। রথাঙ্গের পুত্র অত্যঙ্গ। অত্যঙ্গের পুত্র স্ফুরিত-বুধ। স্ফুরিত-বুধের পুত্র আদিদেব। আদিদেব বঙ্গরাজের মহামন্ত্রী-মহাপাত্র-সন্ধিবিগ্রহী ছিলেন। আদিদেবের পুত্র গোবর্দ্ধন। গোবর্দ্ধন জনৈক বন্দ্যঘটীয় ব্রাহ্মণের দুহিতার [সাঙ্গোকার] পাণিগ্রহণ করিয়াছিলেন। গোবর্দ্ধন এবং সাঙ্গোকার পুত্র ভবদেব-বালবলভীভুজঙ্গ দীর্ঘকাল হরিবর্ম্মদেবের মন্ত্রী ছিলেন, এবং পরে হরিবর্ম্মদেবের পুত্রেরও মন্ত্রিপদারূঢ় ছিলেন। এই দ্বিতীয় ভবদেব রাঢ়দেশে একটি জলাশয় খনন করাইয়াছিলেন; এবং ভুবনেশ্বরে মন্দির নির্ম্মাণ করাইয়া, সেই মন্দিরে নারায়ণ, অনন্ত এবং নৃসিংহমূর্ত্তি স্থাপিত করিয়াছিলেন।

  1. Cf. Epigraphia Indica, Vol. I, plate 19, and the same Vol. II, plates 29–33.
  2. The Journal of the Royal Asiatic Society, New Series, Vol. VIII (1876), p. 3 and plate 2. (Cowell and Eggelling’s Catalogue of Buddhist Sanskrit Manuscripts in the possession of R. A. S.]
  3. Cunningham’s Archæological Survey Report, Vol. III, p. 125. বন্ধুবর শ্রীযুক্ত রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় এই শিলালিপির একটি ছাপ তুলিয়া অনুসন্ধান-সমিতিকে প্রদান করিয়াছেন।
  4. Epigraphia Indica, Vol VII, p. 99.
  5. Bendall’s Catalogue of Buddhist Sanskrit Mss. Cambridge, p iii.
  6. শ্রীনগেন্দ্রনাথ বসু প্রণীত “বঙ্গের জাতীয় ইতিহাস”, দ্বিতীয় ভাগ, ২১৫ পৃষ্ঠা ও চিত্র দ্রষ্টব্য। বসু মহাশয় বলেন,—সুলতান মামুদ কর্ত্তৃক কান্যকুব্জ আক্রমণ সময়ে (১০১৮ খৃষ্টাব্দে) যিনি কান্যকুব্জের রাজা ছিলেন, তাঁহার নাম জয়পাল (কুল-গ্রন্থোক্ত জয়চন্দ্র)। “অধিক সম্ভব, পরম ধার্ম্মিক মহারাজ হরিবর্ম্মদেব কনোজপতি জয়পাল বা জয়চন্দ্রের কন্যার পাণিগ্রহণ করিয়াছিলেন।” আবার “প্রায় আড়াই শত বর্ষ পূর্ব্বে” আবির্ভূত রাঘবেন্দ্র কবিশেখর “প্রাচীন লোকদিগের মুখে শুনিয়া এবং প্রাচীন কুলগ্রন্থ সকল দেখিয়া” যাহা লিখিয়া গিয়াছেন, তাহা হইতে জানা যায়, হরিবর্ম্মদেব যখন “গৌড়োড্রবঙ্গাধিপ”, তখন কান্যকুব্জে “যবনাগমন” ও “রাজ্যনাশ” দেখিয়া, গঙ্গাগতি প্রভৃতি বহু ব্রাহ্মণ বঙ্গে আসিয়াছিলেন। অতএব হরিবর্ম্মা সুলতান মামুদ ও জয়চন্দ্রের বা জয়পালের সমসাময়িক। সুলতান মামুদের আক্রমণ-সময়ে যিনি কান্যকুব্জের অধীশ্বর এবং মুসলমান লেখকগণ যাঁহাকে “রায় জয়পাল” বলিয়া উল্লেখ করিয়া গিয়াছেন, তিনি প্রতীহার-রাজ রাজ্যপাল, এ কথা পূর্ব্বেই উল্লিখিত হইয়াছে। কুলগ্রন্থ এই রাজ্যপালের কোন খবর দিতে পারে কিনা জানি না। সুতরাং এই হিসাবে হরিবর্ম্মার সময় নিরূপণের জন্য বসুমহাশয় যে সকল যুক্তি প্রদর্শন করিয়াছেন, তাহা অমূলক। হরিবর্ম্মার আবির্ভাবকাল সম্বন্ধে প্রধান সাক্ষী হরিবর্ম্মার তাম্রশাসনের এবং ভট্টভবদেবের ভুবনেশ্বর-প্রশস্তির অক্ষর। বসু মহাশয় প্রকাশিত উক্ত তাম্রশাসনের অস্পষ্ট প্রতিকৃতির যে কয়টি অক্ষর বুঝা যায়, তাহা বিজয়সেনের দেবপাড়া প্রশস্তির অনুরূপ। দৃষ্টান্তস্থলে আমরা ত, ম, এবং সএর উল্লেখ করিব। ভট্ট-ভবদেবের ভুবনেশ্বর-প্রশস্তি সম্বন্ধে কিল্‌হর্ণ লিখিয়াছেন,–“On palæographical grounds I do not hesitate to assign this record, like the preceding one, to about A. D. 1200 (Epigraphia Indica, Vol. VI, p. 205).” কিল্‌হর্ণ “preceding one” বলিয়া যে লিপির উল্লেখ করিয়াছেন, তাহা ত্রিকলিঙ্গপতি প্রথম অনিয়ঙ্কভীমের সময়ের স্বপ্নেশ্বরদেবের প্রশস্তি। প্রথম অনিয়ঙ্কভীম ১১৯২ খৃষ্টাব্দে কলিঙ্গের সিংহাসনে আরোহণ করিয়া, দশ বৎসর রাজত্ব করিয়াছিলেন। সুতরাং স্বপ্নেশ্বরদেবের শিলালিপির সময় সম্বন্ধে আর কোন সংশয় হইতে পারে না। ভট্টভবদেবের প্রশস্তির অক্ষর স্বপ্নেশ্বরের লিপির ঠিক অনুরূপ বলিয়া, কিল্‌হর্ণ এইরূপ সিদ্ধান্ত করিয়া গিয়াছেন। কিল্‌হর্ণ-কথিত ঠিকঠাক ১২০০ খৃষ্টাব্দ ভট্ট-ভবদেবের প্রশস্তির কাল না হইলেও, অক্ষরের হিসাবে, হরিবর্ম্মার তাম্রশাসন এবং ভবদেবের প্রশস্তি দ্বাদশ শতাব্দের পূর্ব্বে ঠেলিয়া লওয়া যায় না।